তোলপাড় পর্ব ৩৪

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩৪
_______________
– “অরূণী।”
অরূণী মুখ তুলে সামনের দিকে তাকায়। রুদ্রর গলায় স্পষ্ট রাগ।অরূণীর লেখাপড়ার বেহাল দশা।অরূণী আস্তে করে কেবল বলে, “হুঁ।”
– “সমস্যা কী তোমার লেখাপড়া করো না কেন ঠিক মতো?যতক্ষণ তোমায় পড়াবো ততক্ষণ আমি তোমার টিচার।এর বাইরে কোনো কথা বলবে না।”
অরূণী কিছু’টা বিগড়ে গিয়ে হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়।চোখ তুলে পুনরায় তাকায় রুদ্রর দিকে।রাগে রুদ্রর চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে।না,এমন শক্ত চোখে-মুখের রুদ্র’কে একদম ভালো লাগছে না। ইতোমধ্যে চোখ দু’টো জলে ছাপিয়ে ওঠেছে। দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে নিবদ্ধ করে রেখেছে। রুদ্র কঠিন স্বরে আদেশ করল, “এদিকে তাকাও। পড়ানো শেষে যখন তোমাদের বাসা থেকে বের হবো তখন আমি তোমার অন্য কেউ।”
পরবর্তীতে দিন গুলোতে এই নিয়মেই চলতে থাকলো।পড়ানোর সময় রুদ্র নিতান্তই একজন টিচার।এর বাইরে কোনো কথা বলার জো হয় না অরূণীর। কিছু বলতে গেলেই রুদ্রর কঠিন দৃষ্টিতে অরূণীর কথা অর্ধসমাপ্ত’ই থেকে যায়।
.
পড়ন্ত বিকাল। কনকনে শীত পড়তে শুরু করেছে।অরূণী গায়ে নেভি ব্লু রঙের একটা সোয়েটার চাপিয়েছে। সকাল থেকে হালকা হালকা টনসিলে ব্যথা করছে তাই গলায় মাফলার প্যাঁচিয়েছে।শামীমা বলল, “অরূণী চা কইরা দিমু?বেশি কইরা আদা দিয়ে?গলা ব্যথা কমে যাইবে।”
– “না,না আপা আমার চা খেতে বিশ্রী লাগে।”
অরূণী কিছুক্ষণ পর ফের বলল, “আচ্ছা চিনি ছাড়া চা করে দেও। শুধু আদা আর হালকা লবন দিও।”
শামীমা চা করতে রান্না ঘরে যায়।এর ভিতর রুদ্র ফোন দিয়ে বলে, “আমি তোমার বাসার কাছে। বারান্দায় দাঁড়াও একটু।”
অরূণী উদগ্রীব হয়ে ওঠে, “সত্যি! কোথায় আপনি? বারান্দায় দাঁড়াতে হবে না,আমি আসছি আপনার কাছে।বাসায় সূর্যদা,আব্বা কেউ নেই।”
রুদ্র হেসে বলে, “মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার বছর খানেক পর দেখা হচ্ছে।এত অধীরতা!”
অরূণী সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলে, “আপনার সাথে যত বার দেখা হয় দিনে, তত বারই মনে হয় যুগ যুগান্তর পর দেখা হয়েছে।”
রুদ্র কেমন আদুরে স্বরে বলল, “পাগলী।”
শামীমা চা নিয়ে এসে দেখে অরূণী নেই।পুরো বাসা কোথায়ও নেই।ছাদে, বারান্দায়,রুমে কোথায়ও নেই।কি অদ্ভুত! শামীমা চা ফ্ল্যাক্সে ঢেলে রাখে।
গোধূলির ফিকে আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবী মোহময় হয়ে ওঠেছে।কঠিন রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিরও হয়ত পৃথিবীর এই রূপ দেখে হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করবে। রুদ্র ল্যাম্প পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে।অরূণী রুদ্র’কে দেখেই ব্যগ্র গলায় বলল, “দেখেন পরিবেশ’টা কত মোহময় লাগছে। পৃথিবীর এই রূপ দেখলে যে কারো ই হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করবে।”
– “সদ্য প্রেমে পড়া যুবতীর চোখে পৃথিবী’টার তুচ্ছ জিনিস গুলোও মোহময় ওঠে। তাঁদের পৃথিবীতে হাজার বছর ধরে বাঁচতে ইচ্ছে করে।”
অরূণী চমকে ওঠে।আসলেই কি তাই? রুদ্র পুনরায় বলে, “পৃথিবীর এই রূপের থেকেও আমার কাছে ল্যাম্প পোস্টের হলুদ আলোতে প্রেয়সীর চঞ্চল মুখ’টা দেখতে বেশি ভালোলাগে, অরূণী।”
প্রথমে রুদ্রর কথা বুঝতে পারলো না অরূণী।আর যখন বুঝতে পারলো তখন লজ্জায় মুখ’টা সিঁদুরে হয়ে ওঠলো।শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেল। রুদ্র বলল, “সন্ধ্যা হয়ে গেছে এখন বাসায় যাও।গলা ব্যথা কমেছে?”
– “উঁহু।”
– “কী উঁহু?”
– “গলা ব্যথা কমে নি।”
রুদ্র আশেপাশে তাকালো কফি শপের খোঁজে। একটু দূরেই একটা কফি শপ।
– “চলো কফি খাবে।”
– “আমি তো খাই না কফি।”
– “রোমান্টিক কফি খাবে?”
অরূণী ভারী অবাক গলায় বলল, “রোমান্টিক কফি? রোমান্টিক কফি আবার কী?”
– “যে কফি প্রিয় মানুষের সাথে এক কাপে খাওয়া হয় সেটা রোমান্টিক কফি।”
রুদ্রর মুখ নিঃসৃত এই সুশ্রাব্য ধ্বনি অরূণীর কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশ করতেই অরূণী প্রথমে বিস্ময়ে স্তম্তিত হয়ে গেলেও কিছু মুহূর্ত পর অরূণীর শিড়দাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেল।বুকের কাছ’টা তীক্ষ্ণ এক অনুভূতি’তে শিরশির করছে। মোহাবিষ্ট হয়ে বলল, “এরকম কফি আমি সারাজীবন খাবো।”
অরূণীর মুখাবয়ব দেখে রুদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে। এই মেয়ে’টা এত অল্প’তে আবেগী হয়ে যায় কেন?অরূণী শুধু মনে মনে ঝপছে জীবনের প্রতিটি সন্ধ্যা এমন মোহময় হোক। রুদ্র কফিশপে গিয়ে এক কাপ কফির অর্ডার করলো। রুদ্র কৌতুক করে বলল, “কফি খেয়ে আবার জ্বর আসবে না তো?”
– “জ্বরটা আমার প্রিয় অসুখ‌।”
ওয়েটার কফি দিয়ে গেল। রুদ্র এক চুমুক দিয়ে অরূণীর দিকে এগিয়ে দিলো।এর থেকে সুস্বাদু কিছু বোধ হয় আর হয় না।অরূণী যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেল। রুদ্র নিগূঢ়ভাবে তাকিয়ে রইলো অরূণীর দিকে। শুধু অনুভব করলো ওঁর সামনে শরৎ এর শুভ্র মেঘের ন্যায় স্বচ্ছ আবেগে একটা মেয়ে বসে আছে।যাকে ভালোবাসা যায়, হাজার বছর ধরে ভালোবাসে যায়। কনকনে শীতের সকালের এক খণ্ড আরামদায়ক রোদের ন্যায় রোমাঞ্চকর যার চঞ্চলতা!এই মেয়েটার সাথে কাটিয়ে দেওয়া যায় যুগ যুগান্তর। কফিশপ থেকে বের হয়ে রুদ্র প্রশ্ন করলো, “অরূণী এত ছোট ছোট বিষয়ে তুমি এত খুশী হও কীভাবে?”
– “আপনি মুখে ভালোবাসি না বলেও প্রতি মুহূর্তে যে ভাবে ভালোবাসা অনুভব করান সেভাবে।”
কী জটিল উত্তর! রুদ্র হাসলো শুধু।ব্যস্ত গলায় বলল, “এখন বাসার দিকে হাঁটো।”
– “আপনি আমায় এগিয়ে দিবেন?”
– “তো কী এই সন্ধ্যা বেলায় তোমায় একা ছাড়বো?”
অরূণী আর রুদ্র পাশাপাশি হাঁটছে।রুদ্র হঠাৎ অরূণীর হাত ধরলো।আবার পূর্বের ন্যায় হাঁটতে লাগলো।অরূণীর বাসার কাছাকাছি এসে থেমে যায় রুদ্র।বলল, “এখন যাও। আমি দাঁড়াচ্ছি।”
– “যেতে ইচ্ছে করে না।”
– “তো কী ইচ্ছে করে?”
– “আপনার সাথে এভাবে পুরো শহর’টা ঘুরতে ইচ্ছে করে।”
রুদ্র কী ভেবে যেন হঠাৎ অরূণীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমার অরূণী।”
অরূণী ঈষৎ কেঁপে ওঠলো। রুদ্রর কথায় এত মাদকীয়তা কেন?আমার অরূণী! ইস্ কী ধারালো অনুভূতি যুক্ত কথা।অরূণীর কানে শুধু ভেসে আসতে লাগলো এই সুর’টা।
__________________________
হঠাৎ একদিন বিকাল বেলায় অরূণী বাসায় ঢুকতেই দেখে সেলিনা আহমেদ আর সাহেদ আহমেদ ড্রয়িং রুমে বসে আছে।অরূণী তাঁদের মুখের দিকে একবার তাকাতেই বুঝে ফেলল কিছু একটা ঘটেছে।অরূণী নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও বাড়ালো না। রুদ্রও সকাল থেকে ফোন ধরছে না।অরূণীর মন মেজাজ বিগড়ে আছে কিছু’টা। গিয়ে সেলিনা আহমেদের পাশে দাঁড়ালো।তাঁদের মেজাজ বুঝে অরূণী কেবল আস্তে করে বলল, “আম্মা কিছু হয়েছে?”
কোনো উত্তর আসলো না। কয়েক বার জিজ্ঞেস করলো। সেলিনা আহমেদ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “রুমে যা তুই। দুপুরে তো খাস নি। খেয়ে নে।”
সেলিনা আহমেদের গলায় কেমন একটা দুঃখী দুঃখী ভাব।কি হলো হঠাৎ এটা জানার প্রবল আগ্রহ’টা কে দাবিয়ে রেখে রুমে গেল। রুদ্রর ফোন হঠাৎ বন্ধ কেন?অরূণী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে ফোন হাতে বসে রইলো। এমন তো আগে কখনো হয় নি।অরূণীর কাছে কিরণের ফোন নম্বর ছিলো।সাত-পাঁচ না ভেবে ফোন দিয়ে ফেলল। দ্বিতীয় বারের মাথায় ফোন রিসিভ হলো।কিরণ প্রথম চিনতে পারলো না।চিনতে পেরে হেসে বলল, “ওহ অরূণী তুমি।”
– “রুদ্রর সাথে দেখা হয়েছে আপনার?উনার ফোন বন্ধ কেন?”
– “পারিবারিক ঝামেলার কারণে মুড অফ ওঁর। তুমি তো অবশ্যই জানো।”
অরূণী কিরণের কথা ঠিক বুঝতে পারলো না। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ঝামেলা?আমি তো কিছুই জানি না।”
– “নিম্মি আর তানভীরের ডিভোর্স হয়ে গেছে এটা তুমি জানো না?”
অরূণী স্তম্ভিত হয়ে কেবল প্রশ্ন করল, “কী বললেন?মানে?”
অরূণী ফোন রেখে ছুটে গেল সেলিনা আহমেদের কাছে। সেলিনা আহমেদ শান্ত গলায় বলল, “দোষ তো আমাদের ই। এভাবে কিছু না জেনে ছোট লোকের সাথে আত্মীয় করেছি। একদম হুট করে বিয়ে।থার্ড ক্লাস ফ্যামিলি।”
সাহেদ আহমেদ গুমোট ভাব ধরে বসে আছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় সবাই হকচকিয়ে গেছে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here