তোলপাড় পর্ব ৩৫

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩৫
______________
নিম্মির সাথে তানভীরের সমস্যার শুরু মূলত শাহানাজ বেগমের জন্য।যখন সংসারে ঝামেলার সৃষ্টি হয় তখন দুই জনের ভিতর কোনো এক জনের চুপ থাকতে হয় কিংবা ছাড় দিতে হয়। কিন্তু নিম্মি কিংবা তানভীর কেউই কারো জায়গা থেকে ছাড় দেয় নি।এই কারণেই দুই জনের প্রতি দুইজনের তিক্ততা এসে গেছে।এই তিক্ত সম্পর্ক’টা থেকে মুক্তি পেতে দুই জনেই ব্যগ্র হয়ে ওঠেছিলো। নিম্মি বেশ কয়েকবার অরূণী’কে বলেছিলো শাহানাজ বেগমের কথা।অরূণী তত’টা আমলে নেয় নি। সাংসারিক জীবনে একটু-আধটু ঝামেলা হওয়া’টা স্বাভাবিক।সেটা এত ভয়ঙ্কর রূপ নিবে তা যেন সবার কল্পনাতীত। সিফাজের কারণে নিম্মির সাথেও অরূণীর সম্পর্কের অদ্ভুত এক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো।
অরূণী মনমরা হয়ে বসে রইল।দুই জন কী পারতো না সবকিছু মিটমাট করে নিতে?ডিভোর্স ই কী উত্তম সিদ্ধান্ত ছিলো?অরূণী এক বার ভাবলো নিম্মির কাছে ফোন দিবে।পরক্ষণে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে।ফোন দিয়ে কী বলবে?আপা তোমার না-কি ডিভোর্স হয়ে গেছে?না,ব্যাপার’টা কেমন যেন বেখাপ্পা।
রুদ্রর সাথে অরুণীর দেখা হলো দুই দিন পর। রুদ্র কেবল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “সবকিছু কেমন জটিল হয়ে গেল।”
জটিল থেকে জটিলতর! রুদ্রর ফ্যামিলি সম্পর্কে অরূণীর ফ্যামিলির যে খারাপ ধারণা তৈরি হয়েছে তাতে ই অরূণী বুঝতে পেরেছে ব্যাপার’টা কত জটিল হয়ে গেছে।অরূণী রুদ্র’কে এসব কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। নিজের ফ্যামিলি সম্পর্কে এমন কথা লজ্জা কিংবা অপমানের ব্যাপার। রুদ্রও ডিভোর্স কি কারণে হয়েছে বা কি এসব নিয়ে কোনো কথা বলল না।অরূণী বুঝতে পারলো রুদ্র ব্যাপার’টা এড়িয়ে যেতে চাইছে। যেখানে সমস্ত দোষের কারণ শাহানাজ বেগম সেখানে এসব নিয়ে রুদ্র কীভাবে কথা বলবে?এসব ভাবনা চিন্তা রেখে অরূণী প্রশ্ন করল, “আমাকে আর পড়াতে যাবেন না, তাই না?”
রুদ্র ফিকে হাসলো।বলল, “পাগল তুমি?তোমার বাসায় গেলে নির্ঘাত মার খেতে হবে।”
রুদ্র একটু থেমে আবার বলল, “মিস করবো।তোমার সদ্য ঘুম থেকে ওঠা মুখ’টা মিস করবো।পড়া না পেরে তোমার ভীতি হয়ে থাকা চেহারা’টা মিস করবো।পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তোমার দুষ্টু-মিষ্টি কথা গুলোও মিস করবো,অরূণী।”
বিমর্ষতাপূর্ণ গলা রুদ্রর।অরূণীর চোখ ভিজে যাচ্ছে। রুদ্র কিছু’টা এগিয়ে অরূণীর কাছাকাছি গিয়ে বসে।অরূণীর মন ভালো করতে হেসে বলল, “অরূণী এই সামান্য কারণে কাঁদলে চলে বলো তো?হাসো তাড়াতাড়ি হাসো।”
রুদ্রর আহ্লাদপূর্ণ গলা শুনে অরূণীর আবেগ আরো বেড়ে গেল। টপটপ করে অরূণীর চোখ বেয়ে পানি গড়াতে লাগলো।
– “আহা অরূণী!কান্না থামাও বলছি। প্রতিদিন দেখা হবে, কথা হবে,প্রেম হবে, ভালোবাসা হবে তবুও কীসের কান্নাকাটি বলো তো?”
অরূণীর কান্না থামছে না।‌‌‌কান্নার বেগে ধরে আসা গলায় বলল, “আপনি বুঝতে পারছেন না কত জটিল এই বিষয়’টা। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।”
– “আমি সব বুঝতে পারছি।তোমার থেকে বেশি বুঝতে পেরেছি। কীসের জন্য কাঁদছো তুমি?তোমার ফ্যামিলি তোমাকে দিবে না আমায়?আমি জোর করে তোমায় আদায় করে নিবো। তারপর চলে যাবে দূর অজানায়।বুঝলে আবেগী রাণী?”
আবেগী রাণী?কি অদ্ভুত মিষ্টি ডাক!আহ্লাদ পেলে কান্না বাড়ে অরূণীরও হয়েছে তাই। মিনিট বিশেক হয়ে গেল অরূণীর কান্না থামছে না।শেষে উপায়ান্তর না পেয়ে রুদ্র আলতো করে অরূণীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে দিতে লাগলো। রুদ্রর স্পর্শে শিউরে ওঠছে অরূণী। রুদ্র অরূণীর শরীর ঘেঁষে বসলো।এক হাত অরূণীর কাঁধে রাখলো।অন্য হাত দিয়ে অরূণীর হাত ধরে রাখলো।অরূণীর কান্না নিজের অজান্তেই থেকে গেল। নিবিষ্ট চিত্তে রুদ্রর স্পর্শ অনুভব করছে। রুদ্র অরূণীর কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, “এই তো আমার আবেগী রাণীর কান্না থেমেছে।”
অরূণী চোখ তুলে তাকায় রুদ্রর দিকে।কত কাছে রুদ্র!ভাবতেই সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগছে অরূণীর। রুদ্র মিষ্টি স্বরে অরূণী’কে ধমক দিয়ে বলে, “কী এভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছো কেন?তুমি মেয়ে একদম মাদক।”
অরূণী বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। মন জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আপনায় একটু জড়িয়ে ধরি?”
রুদ্র হেসে আশেপাশে তাকায়।
– “মানুষ তো চারদিকে।জড়িয়ে ধরতেই হবে?গায়ে জ্বর আসবে না তো আবার?”
অরূণী প্রত্যুত্তর করলো না। রুদ্রও কোনো প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করলো না।অরূণীর দিকে ফিরে জড়িয়ে ধরলো অরূণী’কে।অরূণী হকচকিয়ে গেল।নিঃশ্বাস দ্রুততর হতে লাগলো ক্রমে ক্রমে।এত শান্তি অরূণীর আর কখনো অনুভূত হয় নি।এই তীক্ষ্ণ অনূভুতি গুলো চোখের জল হয়ে আত্মপ্রকাশ করলো।কি স্বর্গীয় অনুভূতি!অরূণী শুধু বিড়বিড় করে বলতে লাগলো সময়’টা থেমে থাক। পৃথিবী’টা এখানেই থমকে যাক।অরূণীর শরীর ঈষৎ কাঁপছে। রুদ্র অরূণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “আবার কান্না?আবেগী রাণী আমার শার্ট’টা ভিজে যাচ্ছে। আপনি আমার এত পছন্দের শার্ট’টা নষ্ট করেন না।”
ইস্!এত আহ্লাদ করে কেন রুদ্র?অরূণী যেন হাওয়ায় ভাসছে।অরূণীর মনে হচ্ছে ও সুখের রাজ্যে চলে এসেছে।অরূণী গভীর প্রণয় ভরা গলায় শুধু বলল, “আপনি এত ভালো কেন?”
রুদ্র এই কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “ফ্যামিলি প্রবলেম এসব নিয়ে তোমার মোটেও ভাবতে হবে না।আমি আছি তো সব সামলে নিবো।”
আশেপাশের মানুষ সরু চোখে তাকিয়ে আছে ওঁদের দিকে। রুদ্র আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে অরূণী’কে।অরূণী নেশাগ্রস্ত মানুষের মত তাকিয়ে আছে। ঘোরলাগা চাহনি!বাতাসে কেমন সুখের ঘ্রাণ।প্রতি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস অনুভূত হচ্ছে প্রশান্তি।আর একটু সময় জড়িয়ে ধরে থাকলে কী এমন হতো?
– “অরূণী আবার কী হলো?বলছি তো সব সামলে নিবো।”
রুদ্রর আশ্বস্ত পূর্ণ গলা। অরূণীর ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি।অরূণী এখনো যেন ঘোর থেকে বের হতে পারছে না।প্রিয় মানুষ’টা প্রথম এত গভীর আসক্তি’তে জড়িয়ে ধরেছে।এর রেশ কাটতে সময় লাগবে বেশ।অরূণী নেশাগ্রস্ত মানুষের মত বাসায় ঢুকে। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওঠে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়।জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। শরীরের প্রতি শিরায়-উপশিরায় তীব্র রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে।রাতে খাবারের সময় সাহেদ আহমেদ অরূণী’কে বলল, “রুদ্র’কে পড়াতে আসতে না করে দিস।”
অরূণীর মনে ভীষণ বিষণ্ণতা। মুখ’টা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।সহজ গলায় বলল, “উনি কী এত বেয়াক্কেল যে পড়াতে আসবে আমায়?না করতে হবে না। দেখো এমনিতেই আসবে না উনি।”
অরূণী খাবার টেবিল থেকে ওঠে রুমে গিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। সেলিনা আহমেদ আর সাহেদ আহমেদ বার বার রুদ্রর ফ্যামিলি’কে থার্ড ক্লাস বলছে।অথচ রুদ্র অরূণীর চোখে পৃথিবীর সেরা পুরুষ।কি অমায়িক!কি চমৎকার মানুষ রুদ্র!
__________________________
কিরণের সাথে বেশ অনেক দিন পর দেখা রুদ্রর। কিরণ হুট করেই চলে গিয়েছিলো যশোর। কিরণের বাবা গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। ব্যস্ততার কারণে রুদ্রর সাথেও তেমন কথা হয় নি। রুদ্র জিজ্ঞেস করে, “আংকেলের কী অবস্থা?”
– “এখন সুস্থ।অরূণীর আর তোর কী খবর? রাজশাহী গিয়েছিলি এর ভিতর?”
– “এই তো খবর ভালোই। কতদিন ভালো থাকে কে জানে।”
রুদ্র একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল, “না বাসায় যাই নি। ইচ্ছে হয় না।”
– “আন্টির ওপর রাগ করে কী হবে?দোষ গুণ কমবেশি সবার ই ছিলো তাই না?ভুলে যা ওসব।‌‌‌বাসায় যা। আন্টি আমার কাছে ফোন দিয়েছিলো।তোকে বুঝিয়েসুজিয়ে বাসায় পাঠাতে বলতে।”
রুদ্র কোনো উত্তর দিলো না।কিরণ আবার বলল, “অরূণী তোকে এসব বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে নি?কিংবা তুই ওঁর সাথে এগুলো নিয়ে কিছু বলিস না?”
– “অরূণী আমায় অস্বস্তি ফেলতে চায় নি তাই বোধ হয় এসব নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে নি।না,আমিও কিছু বলি নি।আমার বলার কী আছে? সেদিন সাহেদ স্যারের সাথে দেখা হয়েছে আমায় দেখেও না দেখার ভান করলো।আর সেখানে যদি জানে অরূণীর সাথে আমার সম্পর্ক তাহলে কী হবে বল?”
– “শুধু অরূণীর ফ্যামিলির কথা বলছিস কেন?তোর ফ্যামিলি কী মেনে নিবে?”
রুদ্র উপেক্ষা পূর্ণ গলায় বলল, “ধেৎ বাদ দে এসব। ভালো লাগে না।”
কিরণ আর কথা বাড়ায় না। রুদ্র বাসায় যায়।দিন এভাবেই কাটতে লাগলো।অরূণী খুব সতর্কতার সাথে রুদ্রর সাথে দেখা করে মাঝে মাঝে।যখন বাসায় কেউ থাকে না তখন ফোনে কথা বলে। সতর্ক আগেও ছিলো কিন্তু এখন একটু বেশিই সতর্ক থাকে। যদি বাসায় জেনে যায়?এই শঙ্কা’টা যে অরূণীর বুকের পাহাড়সম যন্ত্রনার সৃষ্টি করে।সেই যন্ত্রনা বেশ কিছুক্ষণ স্থায়ীত্ব লাভ করে।
অরূণীর এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চান্স হলো না। লেখাপড়ার প্রতি কখনোই তেমন মনোযোগী ছিলো না অরূণী। শেষমেষ প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হয় অরূণী। রুদ্রর অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার বাকী মাস দুয়েক। এতদিনে রুদ্র একবারও বাসায় যায় নি। শাহানাজ বেগমের উপর তীব্র অভিমান রুদ্রর। নিজের মায়ের আচরণ সম্পর্কে অবগত রুদ্র। কিন্তু কোনো সন্তানই মায়ের দোষ প্রকাশ করে না, রুদ্রও তার ব্যতিক্রম নয়। নিভৃতে রাগ করে পড়ে রয়েছে ঢাকা। শাহনাজ বেগম আর রুদ্রর বাবা মুকুল আকন অবশেষে ছেলের সাক্ষাৎ পেতে হুট করে একদিন ঢাকায় চলে আসে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here