রুপের বাজারে আমার জুড়ি নেই, বয়স থমকে গেছে এসে কুড়িতেই…
গানটা আর শেষ করতে পারলো না সাজি!চুল মুছতে মুছতে আয়নার দিকে তাকাতেই ওর হার্ট অ্যাটাক করার মতো অবস্থা।কেউ একজন দেয়ালে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে এক ধ্যানে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সাজি।এতো বছর পর এই মানুষটা আমার রুমে?তার থেকেও বড় কথা এতো গুলো বছর পরে আমাদের বাড়িতে?সাজির ভাবনার মাঝেই দীপ্ত বলে উঠে,
– তা বয়স না হয় থমকে গেছে বুঝলাম কিন্তু তুই আমাকে দেখে থমকে গেলি নাকি?
– নাআ আসলে না মানে আ আমি আমি মানে!
সাজির মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।আমতা-আমতা করছে।সাজির এই রকম অবস্থা দেখে দীপ্ত বলে,
– হয়েছে থাক বুঝেছি, তোকে আর তোতলাতে হবে না। এতক্ষণে সবাই হয়তো জেনে গেছে আমি এখানে!
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে আয়,আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।
দীপ্ত চলে যেতেই সাজি নিজের ব্যবহার এর জন্য নিজের মাথায় নিজেই থাপ্পড় দিলো একটা!আর দীপ্ত যা কিছু বলে গেলো সব ওর মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে।
– উনি আমাদের বাসায় এসেছেন তা সবার না জানার কি আছে? তার থেকেও বড় কথা এটা উনার নানাভাই এর বাড়ি! উনি কি লুকিয়ে এসেছেন নাকি যে কেউ উনাকে দেখে নি!
কথাগুলো বিড়বিড় করে বলে সাজি।তারপর রেডি হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখতে পেলো ড্রয়িং রুমে বিশাল বড় আড্ডা জমিয়েছে সবাই মিলে ওর ফুপিও আছে।সাজি এগিয়ে গিয়ে ওর ফুপিকে সালাম দিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞাস করলো।
– কি রে সাজি মা কেমন আছিস?
কথা বলেই সাজির ফুপি ওকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে দিলো।সাজি বিনিময়ে মাথা নেড়ে বললো,ও ভালো আছে।ওর ফুপির কত অভিযোগ!কিরে তুই এতো শুকিয়ে গেছিস কেন?কালো হয়ে গেছিস কেন?খেতে মন চায় না?আরো কত কি!সাজি তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললো,
– ফুপি তোমার ভাইঝি আবার কবে বিশ্বসুন্দরী ছিল যে এইভাবে বলছো?
– এই ফাজিল মেয়ে চুপ কর, তুই কোনো বিশ্বসুন্দরীর চেয়ে কম কিসে?বরং আরো বেশিই সুন্দর!
– হয়েছে হয়েছে এইসব ঢপ মারা এবার বন্ধ করো তো ফুপি।
– আচ্ছা বন্ধ করলাম,সকালে খেয়েছিস কিছু?
– হুম,
এতক্ষণ ফুপি ভাইঝির আলাপন শুনছিলেন সাজির বাবা।উনি ধীর কন্ঠে বলেন,
– সাজি তোমার জন্য দীপ্ত কোন সময় থেকে অপেক্ষা করছে যাও তাড়াতাড়ি। আজকে তো ভার্সিটিতে তোমার প্রথম দিন!
– হুম,যাচ্ছি আব্বু।
সাজি বাহিরে এসে দেখে দীপ্ত গাড়ির মধ্যে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে।এখন দেখে মনে হচ্ছে এক ধ্যানে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।কালো জিন্স হোয়াইট শার্ট হাতে ব্র্যান্ডের ঘড়ি সাথে কালো সানগ্লাস।ওফফ!যা লাগছে না!সাজি গাড়ির পিছনে গিয়ে দরজা খুলতে গেলেই দীপ্ত রাগী কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমাকে কি তোর ড্রাইভার মনে হয়?
এই কথা শুনার পর তাকে তার কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে সামনে এসে দাড়াতেই দীপ্ত গাড়ির দরজা খুলে দিতেই সাজি গিয়ে ফ্রন্ট সিটে বসে।আর বসতে না বসতেই সিট বেল্ট এর সাথে শুরু হয়ে গেল সাজির মিনি যুদ্ধ।দীপ্ত দরজা লাগিয়ে দিয়ে ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে সাজির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,
– বয়স তো দেখছি দুই এ তেই থমকে আছে!
এই কথা বলেই সাজির দিকে এগিয়ে আসে দীপ্ত।সাজি ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে বরফের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে।অনেকক্ষণ কোনো কিছুর সাড়া শব্দ না পেয়ে আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখে দীপ্ত ওর সিট বেল্ট বেধে দিচ্ছে।সাজি এতক্ষণে বুঝতে পারলো দীপ্তের এই কথার মানে।তখন যে ও সিট বেল্ট বাধতে পারি নি তাই দীপ্ত ওই উক্তি পেশ করেছে।কিন্তু সাজির কি দোষ?ও যে সিট বেল্ট বাধতে পারে না।দীপ্ত বেল্ট বাধতে বাধতে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
– তোদের মেয়েদের মাথায় ওইসব ছাড়া আর কিছু আসে না?ইডিয়েট!
কথাটা শেষ করেই দীপ্ত ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয়।
ইডিয়েট!এই শব্দ টা শুনেই সাজির মাথায় আগুন ধরে গেছে।
– কি আমি ইডিয়েট?এতোবড় অপমান!আমি আপনার গাড়িতে যাব না।আমাকে নামিয়ে দেন।কি হলো শুনতে পাচ্ছেন না?আমাকে নামাতে বলছি তো!
কি ভাবছেন এমনটাই করেছে সাজি?হুম,এমন টাই করেছে!তবে বাস্তবে নয়, মনে মনে! কিন্তু না এমনটা তো হওয়ার নয়,কারণ ওর পাশে বসে থাকা মানুষটাকে একসময় ভয় না পেলেও এখন পায়।তাই রাগটা আর প্রকাশ করতে পারলো না।যতটুকু সম্ভব নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে সাজি।
এই যা দেখেছেন আমি তো ওদের পরিচয়টাই এখনো দেই নি আপনাদের।
ওই যে সাজি ওর নাম,গোধূলি ইসলাম সাজি।অনলি ওয়ান ডটার অফ সাজ্জাদ ইসলাম।আর ওর পাশে যে বসে আছে সে হলো দীপ্ত চৌধুরী,সান অফ দীপ্তি ইসলাম,অর্থাৎ সাজির একমাত্র ফুপির একমাত্র ছেলে।আপাতত এইটুকু থাক।বাকি পরিচয় আস্তে আস্তে পেয়ে যাবেন।
আজ সাজির ভার্সিটিতে প্রথম দিন অর্থাৎ নবীন বরন।
ওর বান্ধবীরা সবাই নাকি শাড়ি পড়ে আসবে।ওকেও শাড়ি পড়তে বলেছিল।কিন্তু ও শাড়ি টাড়ি সামলাতে পারে না তাই একটা কালো চুড়িদার পড়ে এসেছে।মেক-আপ ওর একদম পছন্দ না।তাই সাদামাটা ভাবেই এসেছে ও।আজকে তো ভার্সিটিতে ওর একাই আসার কথা ছিল!কথাটা মনে আসতেই সাজি মুখ কালো করে বসে।ও ভেবেছিল,
– বান্ধবীদের নিয়ে ফিল্মই স্টাইলে ভার্সিটিতে এন্ট্রি নিবে।ভার্সিটির সবচেয়ে হ্যান্ডসাম, সুদর্শন ছেলের হাতের ঘড়িতে গিয়ে ওর ওড়না আটকাবে!তার পর আরো কত কি হবে।কিন্তু তা আর হলো কই?সব হয়েছে এই লোকটার জন্য।ওর সব স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো!ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া অব্দি সব ফর্মালিটি ওর আব্বুই করেছেন।তো আজকে কলেজে নিয়ে আসার দায়িত্ব এই লোকটাকে দিতে গেলো কেন সেটাই বুঝলো না সাজি।আর এতো বছর পর হঠাৎ কত্তথেকে উদয় হলো কে জানে!
খুব জুড়ে গাড়ির ব্রেক কষার ফলে সাজি তাল সামলাতে না পেরে কিছুটা সামনের দিকে ঝুকে পড়ে।
চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে সামনে তাকিয়ে দেখে অপরূপ সাজে সাজানো হয়েছে ভার্সিটির মেইন গেইটাকে।না জানি ক্যাম্পাসের ভেতরটা ঠিক কতটা মাধুর্য দিয়ে সাজানো হয়েছে।
– হা করে না থেকে গাড়ি থেকে নাম এবার
দীপ্তের কথায় হুশ ফিরে সাজির।আরো একবার একি ঘটনার রিপিট হয়েছে।সিট বেল্ট খুলা নিয়ে।যাইহোক, গাড়ি থেকে নেমে দাড়াতেই দীপ্ত বললো,
– তুই এখানে দু মিনিট দাড়া এক পা ও এখান থেকে নড়বি না।আমি গাড়িটা পার্ক করে আসছি।
– মানেটা কি?আসছি মানে?এই লোকটা কি এখন আমার সাথে ক্যাম্পাসের ভেতরও যাবে নাকি?
বিড়বিড় করে বলে সাজি।
– হুম যাব! তোর কোনো সমস্যা?
সানগ্লাসটা পড়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে সাজির দিকে এগিয়ে এসে বললো দীপ্ত ।
– ইশশ,শুনে ফেলল নাকি?কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব আমি তো মনে মনে বলেছি তাহলে শুনলো কিভাবে?
– তুই এত জোরে কথা গুলা বলছিলি যে,দেখ গেইট এর সামনে দাড়িয়ে থাকা দারোয়ান দাদুটাও শুনেছে!
দারোয়ানকে দেখিয়ে বলল দীপ্ত।দীপ্তের কথা শুনে সাজি মনে মনে বলে,
– সত্যিই কি আমি এতো জোরে কথা গুলা বলে ফেলেছি।না সেটা পসিবল না কারণ কথা গুলো তো আমি মনে মনেই আওড়ালাম!
– কিরে সাজি তোর কি নিজের উপর ভরসা নাই?
দীপ্ত সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে বললো কথাটা।
– আল্লাহ এটা আমি কি করছি?আমি নিজেই নিজের উপর ভরসা করতে পারছি না? মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
সাজি কথাটা গুলো বিড়বিড় করতে করতে দীপ্তের পিছন পিছন যাচ্ছে ক্যাম্পাসের ভেতর যাওয়ার জন্য।গেইট এর কাছে গিয়েই দাড়িয়ে গেল সাজি।মনটা না কিছুতেই মানছে না।তাই দারোয়ান দাদুকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো,
– দারোয়ান দাদু তুমি কি কিছু শুনেছ?
– কি হুনুম দাদুভাই?
দারোয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো।তার উত্তর শুনে একটুও অবাক হলো না সাজি।কারণ ও জানে ওর কথা দারোয়ানের শুনারই কথাই না!তারপরেও মনটা খছখছ করছে তাই শিউর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলো,
– ওই যে তখন আমি যে কথা গুলো বলছিলাম!
– নারে দাদুভাই,এখান থেকে আমি কিভাবে হুনুম?আর তাছাড়া আমার এখন বয়সও হয়েছে,তাই কানে এখন আর আগের মতো শুনি না।
হেসে জবাব দেয় দারোয়ান।সাজি ধীর কন্ঠে বলল,
– ও আচ্ছা।
– কেন দাদুভাই? কিছু কি হয়েছে?
দারোয়ানের প্রশ্নে সাজি মেকি হেসে বললো,
– না আসলে ওই বদ লোকটা…..
এইটুকু বলেই সাজি থেমে গেলো।
দারোয়ান সম্পূর্ণ কথা শুনার জন্য বললো,
– কোন লোকটা?
– না কিছু না দাদু।
– ওহ!তা তুমি কি ভার্সিটিতে নতুন দাদুভাই?না মানে আগে তো দেখি নি কোনো সময়।অবশ্য পুরাতন হলেও আমার তেমন চিনার কথা না!
মনে কৌতুহল জাগে সাজির।বললো,
– কেন?
দারোয়ান মলিন মুখে বললো,
– কেউই তো আমার সাথে কথা বলে না!সবাই যার যার মতো ভার্সিটিতে আসে আবার সময় হলে চলে যায়।
সাজি নরম গলায় বলে,
– হুম দাদু আমি নতুন।আজকে আমাদের নবীন বরণ না তাই আসলাম।আর তুমি যেন কি বলছিলে কেউ তোমার সাথে কথা বলে না?কেউ বলে না তো কি হয়েছে?তুমি আমার সাথে কথা বলবে ঠিক আছে।
পিছনে তাকিয়ে সাজিকে দেখতে না পেয়ে দীপ্ত আবার গেইট এর কাছে আসে।এসে দেখতে পায় সাজি দারোয়ান দাদুর সাথে কথা বলছে।
– ওই ইডিয়েট!
দীপ্তের ডাকে আবার সাজির কান গরম হয়ে গেল। আবার আবার এই শব্দটা!চোখ বন্ধ করে নিজেকে কন্ট্রোল করে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– আচ্ছা দাদু আমি আসি এখন।তুমি ভালো থেকে কেমন।আবার দেখা ও কথা দুটোই হবে। না না না শুধু কথা না একদিন তোমার সাথে জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবেক্ষন।এখন যাই।
দারোয়ান মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে,
– আচ্ছা দাদুভাই তুমিও ভালো থেকো।
#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে-স্বর্ণালী তালুকদার
#সূচনা_পর্ব
#.