দীপ্ত গোধূলি পর্ব -৪১+৪২

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৪১

এই ভর সন্ধ্যা বেলায় গোধূলির রুমের দরজা বন্ধ দেখে ইমরুল সাহেব একটু অবাক হলেন।এমন সময় গোধূলি রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছে কেন?ভাইঝির কথা ভাবতেই সবার আগে দুশ্চিন্তাটাই মাথায় আসে!ইমরুল সাহেব দরজার কাছে গিয়ে হাতে ঠকঠক শব্দ করে ডাকছেন,

– সাজি সাজি,এই সাজি!

…….

– সাজি,আরে এই সাজি!

…….

– সাজি!কি হলো দরজা খুলছিস না কেন?

…….

– সাজি!সাজি

এবার ইমরুল সাহেবের সত্যি সত্যি দুশ্চিন্তা হচ্ছে।ঘরের ভিতরে ঢুকবেন বলে পিছিয়ে গিয়ে যেইনা দরজায় ধাক্কা দিতে যাবেন ওমনি গোধূলি দরজা খুলে হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।গোধূলি ব্যালকনিতে বসে ছিল তাই ইমরুল সাহেবের ডাকগুলো শুনতে পায় নি।যখন শুনতে পায় তখন ডায়েরিটা তাড়াতাড়ি করে আলমারিতে রেখে দৌঁড়ে এসে দরজা খুলে।ইমরুল সাহেব গোধূলি দেখতে পেয়ে যেনো প্রান খুঁজে পেলেন।বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গোধূলিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললেন,

– আমাকে তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলি তুই!এতক্ষণ ধরে ডাকছি সাড়া দিস নি কেন?

গোধূলিও ইমরুল সাহেবকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী সুরে বললো,

– ভয় পাইয়ে যদি আদর পাওয়া যায় তাহলে সেই আদর পাওয়ার লোভ কি হাত ছাড়া করা যায় বলো!

গোধূলির কথা শুনে ইমরুল সাহেব ওকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বাম কান ধরে বললেন,

– ওরে পাকা মেয়ে!খুব পেঁকে গেছিস না?

– আহ্ কাকাই ছাড়ো আমার ব্যাথা লাগছে।

ইমরুল সাহেব গোধূলির কান থেকে হাতটা সড়িয়ে অবাকের স্বরে বললেন,

– আমি শুধু কানটা ধরে ছিলাম!মোঁচড়ে তো দেই নি তাহলে তোর কিভাবে ব্যাথা লাগলো শুনি?

গোধূলি ফোকলা হেসে বললো,

– মোঁচড়ে দিলো তো ব্যাথা পেতাম নাহ্!তাই আগেই বলে দিয়েছি!

কথাটা শেষ করেই গোধূলি এক দৌঁড়ে নিচে চলে যায়।ইমরুল সাহেব ভাইঝির কান্ড দেখে হেসে উঠেন।

গোধূলির এক্সাম শেষ যাওয়ার পর আবার রোজ ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করে।ভার্সিটিতে তুলি ছাড়াও ওর আরো ফ্রেন্ড হয়েছে।তবে তুলির সাথে ওর ঘনিষ্ঠতাটা বেশি।কারণ তুলি হলো ওর সেই ছোট্টবেলার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড।এখন অব্দি এই একজনই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।ভার্সিটিতে ক্লাস, গ্রুপ স্টাডি,সেমিনার,শেষে বাসায় এসে পড়াশোনা আর সময় পেলে দীপ্তের ডায়েরি পড়তো।তবে আদিবা চলে যাওয়ার পর থেকেই ওকে খুব মিস করে।সারা বাড়িতে ও একলা একটা মেয়ে।বোনের সাথে কাটানো দিনগুলো চোখে ভেসে উঠতেই সাথে সাথে কল করে বসতো আদিবার কাছে।যখন তখন কল করে বসতো।তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেও করতো রায়ানকে জ্বালানোর জন্য।সময় পেলে গিয়ে লাজুকের সাথেও দেখা করে আসতো।লাজুকও সপ্তাহে এক’দু বার আসতো ওদের বাড়িতে।এইভাবেই কাটতে লাগলো গোধূলির দিন।ফাস্ট সেমিস্টারে গোধূলির রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয় নি।তাই এখন পুরো দমে পড়াশোনা করেছে।সেকেন্ড সেমিস্টার এক্সামও শেষ।এই এক্সামটা খুব ভালো হয়েছে।

অনেকদিন পর আজ আবার দীপ্তের ডায়েরি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসেছে গোধূলি।এই ডায়েরির পাতায় লেখা কথাগুলো এতটাই নেশালো যে ও আস্তে আস্তে এই ডায়েরির প্রতি আসক্ত হয়ে পরেছে।ছোট ছোট করে লেখা কথাগুলোর মায়ায় পড়ে গেছে ও।এক লাইনেই কিভাবে প্রিয় মানুষটিকে নিজের মনের ফিলিংস ইমোশন বুঝানো যায় সেটা এই ডায়েরি না পড়লে ও কোনো দিনও গোধূলি বুঝতে পারতো না। এক্সাম চলাকালীন সময়ের অভাবে ডায়েরি পড়তে পারতো না বলে যখন একাডেমিক বই গুলো পড়তো তখন টেবিলে ওর চোখের সামনে ডায়েরিটা রেখে দিতো।এতে নাকি ওর আত্মতৃপ্তি মিলবে।আশ্চর্য!শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও এইটাই সত্যি।দেখতে দেখতে একটা বছর চলে গেছে।ডায়েরিটা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় গোধূলি।ডায়েরিটায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে ডায়েরিটা খুলে।প্রত্যেক বারের মতো এবারো সেই অসমাপ্ত গল্পটা পড়া শুরু করে।

– নীল না লাল লিটমাসটা কি এখনো চড়াইপাখির আশেপাশের ঘুরঘুর করে?যে ডোজ খেয়েছে মনে হয় না চড়াইপাখির ত্রিসীমানায়ো যাবে বলে!

– চাঁদ রাতে চড়াইপাখির হাত খালি ছিল কেন?আমার হাতে মেহেদী পড়বে বলে?সবাই মেহেদী পড়বে চড়াইপাখির হাত খালি থাকবে এটা তো আর আমি মেনে নিতে পারি না নাহ!তুই ঘুমের মধ্যেও বড্ড ছটফট করিস!স্বাদে কি আর চড়াইপাখি নামটা দিয়েছি!মেহেদী তো পড়িয়ে দিয়েই আসলাম সাথে ঈদের সালামিটাও।এখন তোলা থাক সালামটা না হয় ওই দিনই নিবো!

– থাক,এখন বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।বাবা যেতে দেয় নি বলে রাগ করিস না।শ্বশুরকে শুধু বলেছিলাম,দরকার হলে আমি নিয়ে যাবো তাও বন্ধুদের সাথে চড়াইপাখি কোথাও যাবে না।ব্যাস!

– সূর্য ডুবার সময়টা যে আমার বড্ড প্রিয়। তখন তোমার যা খুশি চেয়ো।কভু ফেরাবো না কো তোমায়।

– মাঝে মাঝে তো নিখোঁজ মানুষটার খুঁজ নিতে পারিস চড়াইপাখি!পৃথিবীর কোন সংবিধানে লেখা আছে সব খোঁজ শুধু তাকেই রাখতে হবে?দশ দিন হয়ে গেলো তোর চুলের ঘ্রাণ নেই না!একটু খোঁজ নিলে কি এমন হতো?আজ না হয় অভিমানটা আমিই করি?

– সেই যেতেই হলো!বরাবরের মতো আজো আমিই পরাস্ত!

– আমার কোনো এক জন্মদিনে শ্বশুর আমাকে কথা দিয়েছিলো আমি যা চাই তাই দিবে।তখন আমার কাছে চাওয়ার মতো কোনো কিছুই ছিল না।তাই বলেছিলাম যখন আমার প্রয়োজন হবে তখন ঠিক চেয়ে নেবো।যখন চাইলাম তখন তো আমার শ্বশুর নির্বাক!অবশ্য ভদ্রলোক কথার বরখেলাফ করেন না।যখন বলেছেন দিবেন তখন দিবেনই।তিনি রাজি হয়ে যান।কিন্তু,শ্বশুরমশাই দুইটা শর্ত দিয়ে বসেন।
প্রথম শর্ত ছিল,তোর আঠারো না হওয়া অব্দি নাকি তোকে বিয়ে দিবে না!আর দ্বিতীয় শর্ত ছিল,তোর আঠারো না হওয়া অব্দি আমি নাকি আমার চড়াইপাখির সাথে দেখা করতে পারবো না।আচ্ছা এটা কোনো কথা বল তো চড়াইপাখি!নিকুচি করেছে তার শর্ত!তার কথা মানতে আমার বয়েই গেছে!প্রথমটা না হয় মানলামই।নাগরিক হিসেবে দেশের আইন কানুন মেনে চলা আমাদের দায়িত্ব।তাও শ্বশুরের প্রথম শর্তের চক্করে আজ ছয়টা বছর হয়ে গেল!আবার নাকি দেখা করা যাবে না।তাহলে তো কোনো সাধু সন্যাসীর সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেই পারে!কষ্ট করে আর শর্ত দেওয়ার কি দরকার!এইসব আজব শর্ত আমার পোষাবে না!

– চড়াইপাখি,আঠারো তো হলো!তুই কি বলিস?আমারই প্রাপ্যটা আমাকে দিয়ে দেওয়া উচিৎ নয় কি?
সম্রাজ্ঞী বিহীন রাজ্য কত দিন চলে বল তো?

– শুনলাম রেজাল্ট ভালো হয়েছে।মিষ্টি মুখ করাবি না?তুই তো করাবি না! প্রতিবারের মতো আমাকেই করিয়ে নিতে হবে?তবে তাই হোক!

– আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছিলো রে চড়াইপাখি?শ্বশুর ফোন করে জামাইকে ডাকছে?আসছি আমি!

– চড়াইপাখি আমি তোর গায়ে হাত তুলেছিলাম!অনেক কষ্ট হয়েছিল তোর না রে?কি করতাম বল!এত বছর ধরে যত্নে রাখা পোষা পাখিটাকে আমার চোখের সামনে অন্য কারো হয়ে যেতে দেখতে পারতাম আমি?কেন বুঝিস না তুই?হারানোর শংকায় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম তাই তখন রাগ কন্ট্রোল করতে পারি নি!মাঝে মাঝে তুই বড্ড ছেলেমানুষী করে ফেলিস!তোরই বা কি দোষ বল।আমিই একটু বেশি বেসামাল কিনা!
মেয়ে দিবে না বলে তো শ্বশুরমশাই তো প্রায় বেঁকে বসেছিল।হাতে পায়ে ধরে অনেক কষ্টে ম্যানেজ করতে হয়েছে বাব্বাহ্!আচ্ছা চড়াইপাখি আমাকে একটা কথা বল তো,মেয়েদের বাবাদের কি একটু বেশিই জেদ থাকে?উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয়,তাহলে আমিও আগে মেয়ের বাপই হতে চাই হু!কান খুলে শুনে রাখ,ফাস্ট চান্সে যদি মেয়ে না হয় তাহলে সেকেন্ড চান্সে হলেও আমার মেয়ে চাই। আর এই চান্সেও যদি মেয়ে না হয় তাহলে কিন্তু ননস্টপ চান্স নিতেই থাকবো কথাটা ভালো করে মাথায় সেট করে নে।মেয়ের বাবা তো আমাকেই হতেই হবে!

– যার-তার বাইকে উঠার অন্যায় আবদার আর কখনো যেন না শুনি!তুই শুধু আমার পিটেই মাথা রাখবি!

– আকাশের ওই সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়লে,ক্ষণিক আলো পাওয়ার আশায় যদি তোর দুয়ারে কড়া নারি! তুই কি ফিরিয়ে দিবি আমায়?প্লিজ এমনটা করিস না!

– ভুল ছিলাম আমি!আমার বুঝা উচিত ছিল,আমি যাকে চাই সে হয়তো আমাকে নাও চাইতে পারে!নিজের অজান্তেই অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি বোধহয় না রে?অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোকে।আঘাতটা মনে হয় বেশিই করে ফেলেছি।তুই আমার জন্য কারো সামনে অস্বস্তিতে পড় এটা আমি কখনই চাইবো না।বড্ড লোভী আমি না রে?দেখ না,তোর দিকটা না ভেবে শুরু নিজের দিকটাই দেখলাম।যত দ্রুত পারিস সবটা ভুলে যা। যারা সাক্ষী ছিল তারাও খুব তাড়াতাড়িই ভুলে যাবে।সবার জীবনের গল্প তো আর আমার মতো বিষাদে রূপান্তরিত হয় নি কিনা!বিষাদে ভরা এই জীবন নিয়ে চলে যাচ্ছি দূরের কোনো শহরে!সবটা গুছিয়ে নিতে হয়তো একটু সময় লাগবে তাও নিজেকে সামলে নিস।অবশ্য এই লেখাটা তুই যখন পড়ছিস ততদিনে হয়তো নিজেকে সামলেই নিয়েছিস!আমিও চেষ্টা করবো বেসামাল এই আমিটাকে একটু সামলানোর।মৃত্যুটা হলো ছোট গল্প আর বেঁচে থাকাটা হলো উপন্যাস।আমি তোমাতে বারংবার মরেছি!এবার না হয় অচেনা ওই কংক্রিটের শহরের চিরচেনা সূর্যাস্তের সময়টাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকলাম!

গোধূলির হাতের ছোয়া পেয়ে ডায়েরির পাতা গুলো যেনো নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছে দীপ্তের লেখা কথাগুলোকে আরো প্রানবন্ত চমৎকার করে ফুটিয়ে তোলোর।আজ গোধূলি পরাস্ত।ও প্রেমে পড়ে গেছে।এই ডায়েরিতে লেখা প্রত্যেক কথা ওকে বাধ্য করেছে প্রেমে পড়তে।শক্ত হয়ে বসে আছে গোধূলি।পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্যের তীর্যক আলোর ছটা এসে ওর চোখে মুখে পড়ছে।চোখে কোণে টলমল করা অশ্রু বিন্দু সেই আলোর স্পর্শে তাদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছে!গাল বেঁয়ে সেই জল গিয়ে পড়ছে মেঝেতে পড়ে থাকা ডায়েরির পাতায়।গোধূলি ডায়েরিটা বুকের হাতে শক্ত করে চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,

– দেখুন গোধূলির আলো ফুটেছে,আপনি শুধু একবার আসুন!কথা দিচ্ছি এবার আর ফিরিয়ে দেবো না!

___________________________

সময় নদীর স্রোতের মতোই আবহমান। দেখতে দেখতে তিনটা বছর চলে গেলো।এই তিন বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে।গোধূলি এখন ফাইনাল ইয়ারে।আদিবা আর রায়ানের দু’বছরের এক ছেলে আছে।ছেলের নাম রেখেছে দিয়ান।লাজুকলতা আর আহানও দু’বছর আগেই বিয়ের কাজটা সেড়ে ফেলেছে।বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে।ফুপি ডাক শুনার সৌভাগ্যও গোধূলির হয়ে গেছে।লাজুক ন’মাসের প্রেগন্যান্ট।খাইয়ে খাইয়ে বেচারির হালাত খারাপ করে দিচ্ছে আহান।চেক-আপ করাতে গিয়ে জানতে পারে বেবির ওজন কম।ব্যাস!এখন বাচ্চার ওজন বাড়ানোর দায়িত্ব আহানের।ইহান আর রাহাও চুকিয়ে প্রেম করছে।অবশ্য এর পিছনে গোধূলির অবদানটাই বেশি।ইহান তো বরাবরই ভীতু!তাও একটুখানি সাহস জুগিয়ে রাহাকে প্রপোজ করেছিল।কিন্তু রাহা উল্টো থ্রেট দিয়ে বলেছিল ও নাকি এইসব আহানকে বলে দিবে।বেচারা ইহান ভয় পেয়ে গোধূলির কাছে গিয়ে সে কি কান্না।শেষ মেশ গোধূলিই দুজনের মিলন ঘটিয়েছে।

– জানো ফুপি,ইদানীং মিহিরকে নাকি তুলির আশেপাশে একটু বেশিই ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছে।অবশ্য শুধু যে মিহিরের একার দোষ তাও না।তুলিরো অনেকটাই দূর্বলতা তৈরি হয়েছে মিহিরের প্রতি।কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারছে না।ওরা ভাবতে এই সবের চক্করে শেষে যদি আর বন্ধুত্বটাই না থাকে।ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে প্রেম নিয়ে এই এক ঝামেলা।

রান্নাঘরে দীপ্তি বেগম রান্না করছিলেন গোধূলি তার পাশে সেলের উপর বসে আপেল খাচ্ছিলো আর তুলি মিহিরের কথাটা বলছিল।ফোনে নোটিফিকেশন আসতেই ওটা চেক করেই ফিক করে হেসে উঠে।দীপ্তি বেগম গোধূলির এমন হঠাৎ করে হাসার কারণ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাস করেন,

– তোর আবার কি একা একা হাসছিস কেন?

– আমার সিধে-সাধা ইমোশনাল ভাইটাও নাকি প্রেম করছে।

– মানে?

– মানে তোমার ছোট ভাইপো।

– তুইয়েই তো সবটা করেছিস!তা ওদের মতো তুলি আর মিহিরেরো একটা হেস্তনেস্ত করে দে তাহলেই তো হয়!

দীপ্তি বেগম গা ছাড়া ভাব নিয়ে কথাটা বলে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।ফুপির কথায় গোধূলি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো,

– মানে?

– আমার সামনে একদম ন্যাকামি করবি না।সব জেনে না জানার ভান করবি না।ওইদিন ইহান তোকে যা যা বলেছিল সব শুনেছি আমি।

গোধূলি গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে থেকে বললো,

– তুমি সবটা শুনেছো?

– হুম,

– যাক ভালো হয়েছে।দেখো ছোটদাভাই ওদের ছবি পাঠিয়েছে আমায়।

– থাক আমাকে দেখতে হবে না।তুই বরং গিয়ে রেডি হয়ে আয় আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।ভার্সিটি আছে তো নাকি?

– ওকে।

গোধূলি ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে আসে।কিন্তু মাঝরাস্তা পর্যন্ত এসে আবার কিছু একটা ভেবে বাসায় ফিরে যায়।

– সাজি!ভার্সিটি থেকে এতো তাড়াতাড়ি ফিরে আসলি কি করে?

– ভার্সিটি যাই নি দাদু!

– কেন?

– এমনি ভালো লাগছিল না।ভাবছিল আজকে একটু ও বাসায় যাবো।অনেকদিন যাওয়া হয় না।দাদু তুমি যাবে?

– তাহলে আগে বলতি।একটু আগেই দীপ্তি চলে গেলো।তাহলে তো এক সাথেই যেতে পারতাম।

– সমস্যা নেই আমি রাস্তা চিনি তো নাকি?

– ফুপি আমি চলে যাচ্ছি।কালকে আমার ভার্সিটি আছে।দাদু এত রাতে তোমাকে যেতে হবে না।আর তুমি বরং কয়েকটা দিন থেকে যাও না এখানে।পরে না হয় আমি এসে নিয়ে যাবো।

– দেখি সকাল হোক আগে।তুই সাবধানে যাস।

– সাজি শুন!

– কিছু বলবে ফুপি?

– দিনের আবহাওয়া বেশি ভালো না।রাতে ড্রাইভিং করে যাবি সাবধানে যাস।

– ঠিক আছে,আসছি আমি।

গাড়ির হর্ন বাজতেই দাড়োয়ান এসে গেইট খুলে দেয়।গাড়িটা গ্যারেজে রেখে সদর দরজার কাছে যেতেই আঁতকে উঠে গোধূলি।
#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৪২

এত রাতে বাড়ির সদর দরজা খোলা দেখে মাথা গরম হয়ে যায় গোধূলির।হাতে থাকা গাড়ির চাবিটা শক্ত চেপে ধরে সিকিউরিটিকে ডাক লাগায়।

– সিকিউরিটি!সিকিউরিটি!

– জ্বি ম্যাম!

– বাড়ির সদর দরজা খোলা কেন?

……..

– কি হলো কথা বলছেন কেন?

– সরি ম্যাম।

– হোয়াইট সরি ম্যাম!আপনারা এতো কেয়ারলেস কেন?

– সরি ম্যাম।বাহিরে প্রচন্ড বাতাস তাই হয়তো….

সিকিউরিটি তার পুরো কথা শেষ করার আগেই হুট করে কারেন্ট চলে যায়।এতে গোধূলি বিরক্তি হয়ে বললো,

– ধ্যাৎ!এক্ষুনি এটাকে যেতে হলো।ঠিক আছে আপনি যান,পরের বার থেকে যেনো কাজে কোনো ধরনের গাফিলতি না দেখি।ক্লিয়ার!মনে থাকবে?

– জ্বি ম্যাম!

– ও হ্যাঁ শুনুন,রাতে মনে হয় ঝড় বৃষ্টি আসতে পারে সাবধানে থাকবেন কেমন।

– ওকে ম্যাম।

– ঠিক আছে যান এখন।

গোধূলি ওর ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজাটা ভালো করে লক করে দেয়।সিঁড়ি দিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে নিজের ঘরে চলে যায়।বাহিরের জামা কাপড় চেঞ্জ করে ধুতি আর টিশার্ট পড়ে নেয়।কোনো দিক না তাকিয়ে সোজা গিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে।যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল নয়টা।সজাগ হয়ে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠতে যাবে ঠিক তখনই নিজের পেটের উপর ভারী কিছু অনুভব করে গোধূলি।পেটের উপর তাকিয়ে দেখে কেউ ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটের উপর মুখ গুজে শুয়ে আছে।গোধূলি ভয় পেয়ে গিয়ে চিৎকার দিয়ে এক ধাক্কায় তাকে খাট থেকে নিচে ফেলে দেয়।অনেকক্ষণ হয়ে গেলো কিন্তু নিচ থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না দেখে গোধূলি খাটের একদম কিনারে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখবে বলে যেইনা মাথা নিচু করলো ওমনি ওর হাত ধরে কেউ টান মারে।আর গোধূলি ধড়াম করে নিচে পড়ে যায়।কোমড়ে বেশ লেগেছে গোধূলির।কোমড়ে হাত দিয়ে ব্যাথায় ছটফট করছে।চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।ওকে কেউ একজন ফেলে দিয়েছে এটা মাথায় আসতেই ফট করে পিছনে ফিরে তাকায় গোধূলি।ততক্ষণে সেই ব্যাক্তি উঠে দাঁড়িয়েছে।নিজের গায়ের ময়লা ঝাড়ছে।গোধূলি তার মুখ দেখতে পারছে না।কারণ ওকে পিছন ফিরে সে দাঁড়িয়ে আছে।গোধূলি রেগেমেগে যেই উঠতে যাবে ওমনি কোমড়ে টান পড়তেই আহ্ করে চিৎকার করে উঠে।এতক্ষণে সামনে থাকা মানুষটার হুশ ফিরে।একটু আগে যে তিনি কাউকে হেচকা টানে ফ্লোরে আছাড় খাইয়েছেন সেটা তিনি বেমালুম ভুলে নিজের শরীর ঝাড়তেই ব্যস্ত ছিলেন।পিছনে তাকিয়ে দেখে গোধূলি ফ্লোরে কনুয়ে এক হাতে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে অন্য হাতে কোমড় ধরে আছে।গোধূলি তখনও তার দিকেই তাকিয়ে আছে।কোমড়ের ব্যাথায় নড়তে চড়তে পারছে না।সামনের উপস্থিত মানুষটাকে দেখা মাত্রই গোধূলি দেয় এক গগনবিদারী চিৎকার।গোধূলির চিৎকারে সামনের ব্যাক্তিটি থতমত খেয়ে যায়।তড়িৎ বেগে এসে গোধূলির মুখ চেপে ধরে বললো,

– হুশশ!চুপ,একদম চুপ!

গোধূলি পুরো স্টপ হয়ে যায়।তারপর গোধূলিকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে পিছনে একটা বালিশ রেখে গোধূলিকে আবার ওটাতে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়।গোধূলি কোনো কথা বলছে না।চুপচাপ সামনের মানুষটার গতিবিধি লক্ষ্য করছে।পুরো রুম তন্নতন্ন করে কিছু খুঁজছে।আলমারিতে যত কাপড় ছিল সব এদিক সেদিক ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে।গোধূলির ওয়ারড্রবের সবগুলো ড্রয়ার ফ্লোরে ঢেলে দিয়েছে।যেটা খুঁজছে সেটা পাচ্ছে না বলে রাগে ওর পুরো শরীর থরথর করে কাপছে।নীরব দর্শক হয়ে গোধূলি শুধু দেখেই চলেছে।শেষে কোনো কিছু না পেয়ে রাগে বললো,

– ফাস্টএইড বক্সটা কোথায়?

গোধূলি বেড সাইডের টেবিলের দিকে চোখে ইশারায় বুঝালো,ওটা টেবিলের ড্রয়ারে আছে।গোধূলির চোখের ইশারা পেয়েই সেখান থেকে ফাস্টএইড বক্স খুঁজে একটা পেইন কিলার স্প্রে নিয়ে গোধূলির দিকে এগোতেই গোধূলি হাত বাড়িয়ে স্প্রে টা নিতে চাচ্ছিলো কিন্তু স্প্রে টা গোধূলিকে না দিয়ে নিজের হাতে গোধূলির কোমড়ে স্প্রে টা করে দেয়।তার হাতের ছোয়া পেয়ে গোধূলির যে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিলো সেটা তার নজর এড়ায় নি।স্প্রে টা টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে নিলেই গোধূলি পেছন থেকে ওর হাত ধরে ফেলে।গোধূলির দিকে না তাকিয়েই শীতল কণ্ঠে বললো,

– লিভ মি!

গোধূলি উঠে এসে পিছন থেকে জাপটে জড়িয়ে ধরে বললো,

– ছেড়ে দেবো বলে তো ধরি নি!

গোধূলির এমন কথায় বেশ অবাক হয় সামনের মানুষটি।একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পিছনে ফিরে কিছু বলবে বলে যেই মুখ খুলতে যাবে ফট করে গোধূলি ওর বাম গালে চুমো দিয়ে বসে।গালে হাত দিয়ে ঢ্যাপঢ্যাপ করে গোধূলির দিকে তাকিয়ে আছে।আঙুল উঁচিয়ে যেই না আবার মুখ খুলতে যাবে গোধূলি আবার ওর ডান গালেও চুমো দিয়ে বসে।এইবার দুই গালে হাত দিয়ে হা করে গোধূলির দিকে তাকিয়ে আছে।গোধূলি এবার দীপ্তের গলা জড়িয়ে ধরলো।গোধূলি ওর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না যে মানুষটা সত্যি সত্যি ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।গোধূলির সামনে থাকা মানুষটি আর কেউ নয় স্বয়ং দীপ্ত।

ফ্ল্যাশব্যাক_________

দীপ্ত গত রাতে লন্ডন থেকে ফিরে এসেছে।সারপ্রাইজ দিবে বলে কাউকে কিছু বলে আসে নি।কিন্তু এসে দেখে বাসায় কেউ নেই।সিকিউরিটির কাছ থেকে জানতে পারে দীপ্তি বেগম উনার বাবার বাসায় গেছেন।মা বাবাকে সকালে সারপ্রাইজ দিবে বলে দাড়োয়ান আর সিকিউরিটি গার্ডকে বলে দিয়েছে ওরা যেন দীপ্তি বেগম বা জামাল সাহেবকে কিছু না বলে।অনেকটা পথ জার্নি করে এসে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।তাই নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।একে তো কারেন্ট ছিল না তার উপর এতোটা রাস্তা ড্রাইভ করে এসে কোনো রকম ফ্রেশ হয়ে গোধূলিও শুয়ে পড়ে।ওর বিছানায় যে আরো একজন ঘুমিয়ে আছে সেটা ও খেয়ালই করে নি।যার নমুনা দুজনের মধ্যেই লক্ষনীয়।

বর্তমান_______

গোধূলির এই জোড়া চুমোয় দীপ্ত একটু না অনেকটাই অবাক হয়েছে।দীপ্ত ওর গাল থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে গোধূলির কাছে থেকে ওর গলা ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

– স্টপ দিস ননসেন্স!

গোধূলি আবার দীপ্তের গলা জড়িয়ে ধরলো।অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বললো,

– ননসেন্স!কোনটা ননসেন্স?

আবারো দীপ্তের দুই গালে দুই চুমো দিয়ে চোখ টিপ মেরে ইশারা করে বললো,

– এইটা নাকি এইটা?

দীপ্ত এখন অবাকের চরম পর্যায়ে।গোধূলির এমন হেংলামো ঠিক হজম হচ্ছে না দীপ্তের।যে মেয়ে ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস অব্দি পেত না আর সেই মেয়ে কিনা ডিরেক্ট ওকে কিস করছে?তাও আবার একটা না দুটো না চার চারটে!আঙুল উঁচিয়ে একটু রাগান্বিত কন্ঠে বললো,

– এই মেয়ে এইবার কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!আমি কি….

দীপ্তের কথা না শুনেই গোধূলি দীপ্তের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওকে থামিয়ে দেয়।তার পর দীপ্তের দিকে এগোতে এগোতে বললো,

– হুশশ!বাড়াবাড়ি তো এখন হবে!

গোধূলির এগোনো দেখে দীপ্ত পেছাতে পেছাতে একদম দেয়ালের সাথে গিয়ে ধাক্কা খায়।গোধূলিকে দেখে হঠাৎ এমন ভয় পাওয়ার মতো হলো দীপ্ত নিজেও বুঝতে পারছে।দীপ্তের গলা শুকিয়ে আসছে।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে টেনে টেনে বললো,

– মা্ মা্ মানে?

গোধূলি এগোতে এগোতে একদম দীপ্তের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।দুজনেই মধ্যে এক ইঞ্চি জায়গাও অবশিষ্ট নেই।দীপ্ত পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে আরেকটু উঁচু হয়ে দাঁড়িয়েছে।তাতেও লাভ হয় নি।গোধূলি আরো একটু দীপ্তের দিকে এগিয়ে যায়।দীপ্ত দম আটকে দাঁড়িয়ে আছে।গোধূলির উষ্ণ নিঃশ্বাস গিয়ে দীপ্তের বুকে পড়ছে।হুট করেই দীপ্তের কলার চেপে ধরে গোধূলি।ঘটনাটা আকস্মিক হওয়ায় টাল সামলাতে না পেরে দীপ্ত কিছুটা নিচের দিকে ঝুকে পড়ে।দীপ্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই গোধূলি ওর ঠোঁট জোড়া দীপ্তের ঠোঁট জোড়ায় মিলিয়ে দেয়।গোধূলির ডাকে দীপ্তও সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলো না।যতই হোক পুরুষ মানুষ তো!যদি কেউ নিজ থেকে কাছে ডাকে তবে কি তাকে ফেরানো যায়?আবার সে যদি হয় তার প্রিয় মানুষ!দীপ্ত এক হাতে গোধূলির কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে গোধূলির চুল মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।মিনিট দু’য়েক পরেই গোধূলিকে ছেড়ে দিয়ে দীপ্ত দ্রুত পা চালিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।গোধূলি ওর নিজের করা কান্ডে নিজেই অবাক হচ্ছে।ঘনঘন শ্বাস ফেলছে।লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।নিজের কপালে নিজেই চাপড় দিয়ে বললো,

– ইশশ!এটা আমি কি করলাম?উনি এখন আমায় কি ভাববেন?ধুর,কি আর ভাববে!উনিও তো…. ইশশ কি লজ্জা!

গোধূলি দুই হাত দিয়ে ওর মুখ ঢেকে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এসে দেখে পুরো রুম আগের মতো পরিপাটি করে গুছানো।গোধূলি বেশ অবাক হয়ে চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখছে আর মনে মনে ভাবছে এত অল্প সময়ের মধ্যে কে এইভাবে সবটা গুছিয়েছে।দীপ্তের কথা মাথায় আসতেই ছুট লাগায় বাহিরের উদ্দেশ্যে।দরজার কাছে গিয়ে পায়ে কিছু আটকে পড়ে যেতে নিলেই নিজেকে কোনো মতে সামলে নেয় গোধূলি।নিচে তাকিয়ে দেখে ওর সব জামা কাপড় আর জিনিসপত্র নিচে পড়ে আছে।গোধূলির চোখ দিয়ে আগুন ঝড়ছে।কার এত বড় সাহস যে ওর সব জামা কাপড় এই ভাবে মাটিতে ফেলে রেখেছে।পরক্ষণেই একটু আগেই দীপ্তের করা কান্ডের কথা মনে পড়ে।তবে কি উনিই এই গুলো আবার বাহিরে ফেলে দিয়েছেন?রেগেমেগে দীপ্তের কাছে চলে যায় গোধূলি।গিয়ে দেখে দীপ্ত ডাইনিং রুমে বসে কফি খাচ্ছে।আরেকবার কাপে যেই চুমুক দিতে যাবে ওমনি গোধূলি হেচকা টানে দীপ্তের কাছ থেকে কফির কাপটা নিয়ে নেয়।গোধূলি ওর নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলো।কাপে থাকা সবটুকু কফি এসে ওর গায়েই পড়লো।দীপ্ত ফিক করে হেসে উঠে।দীপ্তের হাসি দেখে গোধূলির রাগ আরো এক ধাপ বেড়ে যায়।কাটকাট গলায় বললো,

– আপনি আমার জামা কাপড় আর জিনিসপত্র বাহিরে ফেলে দিয়েছেন কেন?

– ওইগুলা একটা আমার দরকারি না!

দীপ্তের একরোখা জবাবে গোধূলি খানিকটা উচ্চ গলায় বললো,

– তো?

– তাই ফেলে দিয়েছি।

– মানে আপনি…..

গোধূলিকে বলার সুযোগ না দিয়ে দীপ্ত ওখান থেকে বেড়িয়ে আসে।গোধূলি ওর রাগ ঝাড়ার জন্য কোনো কিছু না পেয়ে শেষে বাম পায়ে ফ্লোরে আঘাত করে আবার রুমে চলে যায়।

রুমের সোফায় বসে ল্যাপটপে মুখ গুজে কাজ করছে দীপ্ত।ক্ষনে ক্ষনেই পাশের টি টেবিলে রাখা জুসের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে।বাম হাতে জুসের গ্লাসটা নিয়ে আবার চুমুক দিয়ে মুখে নিয়েছে মাত্র ঠিক তখনই দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকাতেই বিষম খেয়ে বসে দীপ্ত।মুখের মধ্যে থাকা সব জুস ল্যাপটপের উপর ছেড়ে দেয়।সবেই গোধূলি শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়েছে।হঠাৎ দীপ্তের বিষম খাওয়ার মানে বুঝতে না পেরে গোধূলি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।দীপ্ত মাথা নিচু করে বসে আছে।দীপ্তের ভাবাবেগের কোনো পরিবর্তন নেই দেখে গোধূলির হাতে থাকা টাওয়াল দিয়ে ওর চুল মুছতে মুছতে দীপ্তের ঠিক পাশে সোফায় অবশিষ্ট জায়গাটা দখল করে বসলো।গোধূলি আপন মনে নিজের মতো করে ওর কাজ করছে।কিন্তু আরেক জনের বিপি হাই হয়ে যাচ্ছে।মাথা নিচু রেখেই দীপ্ত আড়চোখে গোধূলির উন্মুক্ত পায়ের দিকে তাকিয়েই বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধুপ করে উঠলো। মুহূর্তেই আবার নজর সড়িয়ে নেয়।দীপ্তের হোয়াইট শার্ট ব্যতীত গোধূলির শরীরে আর কোনো কাপড়ের বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই।গোধূলি গুনগুন করছে আর হাত দিয়ে চুলে বারি দিচ্ছে।ফলে চুলে থাকা অবশিষ্ট পানির ছিটেফোঁটা এসে দীপ্তের চোখে মুখে পড়ছে।সদ্য স্নান সেড়ে আসা গোধূলিকে ভেজা চুল খুবই আবেদনময়ী লাগছে।দীপ্তের মধ্যে এক অন্য রকম ফিলিংস এসে ভীড় করছে।বেশিক্ষণ এই ভাবে বসে থাকলে যেকোনো সময় নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলতে পারে! দীপ্ত ফট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,

– এটা আমার শার্ট!

গোধূলি নিজেকে একটু দেখে নিয়ে বললো,

– হুম, তো?

গোধূলির কথায় দীপ্ত দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– আমার জিনিসে কেউ হাত দিক এটা আমার পছন্দ না।

গোধূলি উঠে গিয়ে দীপ্ত যেইদিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে সেইদিকে গিয়ে ঠিক দীপ্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,

– আচ্ছা তাই বুঝি?তা একটু আগে আমার জিনিসে হাত দেওয়ার সময় বুঝি এই থিওরী মাথায় ছিল না?

গোধূলির কথায় দীপ্ত রেগে গিয়ে গোধূলির দিকে কিছুটা ঝুকে বললো,

– শার্ট টা আমার ফেরত চাই,রাইট নাও!

গোধূলি কিছুটা পিছিয়ে যায়।বাম হাতটা বুকে রেখে ডান হাত দীপ্তের মুখের সামনে উঁচিয়ে বললো,

– ওয়েট!

দীপ্তের চোখে মুখে বিরক্তির চাপ স্পষ্ট।সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে ও।

– এক্ষুনি খুলে দিচ্ছি!

কথাটা কানে যেতেই ফট করে ফিরে তাকায় গোধূলির দিকে।ওর দিকে তাকাতেই দীপ্তের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।কেননা গোধূলি ওর সামনেই শার্টের বাটন খুলতে শুরু করেছে।অলরেডি একটা খুলেও ফেলেছে।দীপ্ত চিৎকার করে বললো,

– এ এই!এখানে খুলতে বলি নি স্টুপিড।

গোধূলি অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বললো,

– তো?আপনি না মাত্র বললেন?

দীপ্ত গোধূলিকে শক্ত গলায় বললো,

– তাই বলে আমার সামনে?

– তাতে কি হয়েছে?

দীপ্ত বিরক্তির সুরে বললো,

– স্টুপিড!

– আপনি আবার……..

গোধূলির কথাকে পাত্তা না দিয়েই দীপ্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।দীপ্তের উপর রাগ না বরং বেশ অবাকই হচ্ছে গোধূলি।গোধূলি সকাল থেকেই লক্ষ করছে দীপ্ত একটা বারের জন্যও গোধূলির নাম নেয় নি!এমনকি তুই সম্মোধনটাও অব্দি উচ্চারণ করে নি।গোধূলি ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,

– বুঝতে পারছি সাহেবের মনে অনেক অভিমান জমে আছে।তবে এখন সেই অভিমান ভাঙার সময় হয়ে গেছে।

ছেলে ফিরে এসেছে শুনে দীপ্তি বেগম আর এক মুহূর্তও দেরি না করে বাসায় চলে এসেছেন।দীপ্তকে বুকে জড়িয়ে কি কান্নাটাই না করেছেন।কান্না করাটাই স্বাভাবিক।তিন বছর পর সন্তানকে কাছে পেয়ে কোন মা কান্না না করবে?মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে দীপ্ত।ছেলের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন দীপ্তি বেগম।দীপ্ত ওর মাকে ভারী গলায় জিজ্ঞাস করলো,

– আম্মু,ওই মেয়ে আমাদের বাসায় কি করছে?

– কে?সাজি?

– হুম!

– ও গত দুই বছর যাবত আমাদের বাসাতেই আছে।

মায়ের কথা শুনে বেশ অবাক হয় দীপ্ত।উঠে মায়ের মুখোমুখি বসে জিজ্ঞাস করলো,

– কেন?

– জানি না!তবে যেদিন এসেছিল সেইদিন তোর রুমের দরজা বন্ধ করে খুব কান্না করেছিল।ও কেনই বা এখানে এসেছে?কেনই বা ওদের বাসায় না থেকে আমাদের বাসায় থাকছে?এসব প্রশ্ন কোনো দিনই আমি ওকে করে নি।তুই চলে যাওয়ার পর একটা বছর আমি কিভাবে পাড় করেছি সেটা একমাত্র আমিই জানি।কিন্তু বিশ্বাস কর গত দুইটা বছরে একটা বারের জন্যও সাজি আমাকে তোর অভাবটা বুঝতে দেয় নি।নিজের মেয়ের মতোই আগলে রেখেছে আমাকে আর তোর আব্বুকে।

– সারা জীবনের জন্যেই তো এই বাড়িতে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম!

মিনমিনে স্বরে কথাটা বললো দীপ্ত।

– কিছু বললি?

– না আম্মু!তুমি কিছু বলছিলে না?

– হুম।ওকে ছাড়া কেউই ওই বাড়িতে ভালো নেই।যে বাবাকে ও সবচেয়ে বেশি ভয় পেতো সেই বাবাকেও মুখের উপর বলে দিয়েছ ও এইখানেই থাকবে।তোর নানুজানও সাজিকে ছাড়া থাকতে পারে না বলে দুই বাসাতেই উদল বদল করে থাকে।আমাদের বাসাতেই ছিল কালকেই গোধূলি দিয়ে এসেছে।

– তুমি তো কখনো বলো নি যে ও আমাদের বাসায় থাকে।

– তুই কখনো ওর কথা জিজ্ঞাস করেছিস?

মায়ের কথায় চোখ নামিয়ে নেয় দীপ্ত।আসলেই তো ও এই তিন বছরে একটা বারের জন্যও গোধূলির খোঁজ নেয় নি।দীপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।নিজের অজান্তেই চোখ বেঁয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।হাতের পিঠে বার বার চোখের জল মুছার পরেও অবাধ্য চোখের জল কোনো বারনেই মানছে না।দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে দীপ্ত খেয়ালই করে নি।ফোনে কল আসার শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে দীপ্তের।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে সাজ্জাদ সাহেব কল করেছে।কলটা রিসিভ করতেই ওইপাশ থেকে সাজ্জাদ সাহেব বললেন,

– দীপ্ত একটু নিচে আয় তো।

আসছি বলেই কলটা কেটে দেয় দীপ্ত।ও বুঝতে পেরেছে সাজ্জাদ সাহেব ওদের বাড়িতে এসেছে।নিচে গিয়ে দেখে ড্রয়িং রুমে কেউ নেই।তাই দীপ্ত আবার সাজ্জাদ সাহেবকে কল দেয়।সাথে সাথে রিং বাজতেই চমকে উঠে দীপ্ত।সেকেন্ড দু’এক পরেই বুঝতে পারে সাজ্জাদ সাহেব ওর মায়ের রুমে।সেখানে গিয়ে দেখতে পায় মোটামুটি একটা বৈঠক বসেছে।গোধূলি আর শিখা বেগম ছাড়া ওই বাড়ির সবাই এইখানে উপস্থিত।থমথমে একটা পরিবেশ।দীপ্ত একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো,

– কি ব্যাপার সবাই এইখানে কেন?

– তোর মামু তোকে কিছু বলবে বলে এখানে ডেকেছে।

বাবার কথায় দীপ্ত বললো,

– তা বেশ তো!ড্রয়িং রুমে চলো!

সাজ্জাদ সাহেব বললেন,

– না এখানেই ঠিক আছে।এইদিকে আয় তুই।

দীপ্ত সাজ্জাদ সাহেবের সামনে গিয়ে বললো,

– বলো কি বলবে?

সাজ্জাদ সাহেব একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন,

– তোর মা বলছিল বিয়ের কাজটা সেড়ে ফেলতে!কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বিয়েটা হওয়ার আগেই তোমাদের সবার সত্যিটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন!

– কি সত্যি?

…….

– কি হলো মামু?

…….

– বলো!

– সাজি আমার নিজের মেয়ে না দীপ্ত!

#.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here