#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -১৪
গোধূলির পুরো পরিবার অপারেশন থিয়েটারের সামনে পাইচারি করছে!কারো মুখেই কোনো কথা নেই!শিখা বেগম মেয়ের এমন হাল সহ্য করতে না পেরে সেন্স লেস হয়ে পাশের কেবিনে ভর্তি রয়েছেন!রায়ানদের বাসা থেকে লাইফকেয়ার হসপিটালটা একদম কাছেই!ওরাই সব কিছু এরেঞ্জ করে রেখেছিল।
দীপ্ত আর রাবিয়া বেগম হসপিটালে চলে এসেছেন।হসপিটালে এসেও তিনি অনবরত কেঁদেই যাচ্ছেন!আদিবা উনাকে কিছুইতে সামলাতে পারছে না!আর অন্যদিকে দীপ্তের অবস্থা তো পাগলপ্রায়!মাথার চুল গুলো উল্টে ধরে দিশেহারা হয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে পাইচারি করছে!সাজ্জাস সাহেব তো এখন কথা বলার অবস্থাতেই নেই!আহসান সাহেব নিজের মেয়ের থেকেও গোধূলিকে বেশি ভালোবাসেন!তিনি নির্বিকার দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন অপারেশন থিয়েটারের ওই লাল বাল্বটার দিকে!ইমরুল সাহেব আর জ্যোতি বেগম আছে গোধূলির মায়ের কেবিনে।নিজের মেয়ের চিন্তায় তিনি বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন!ইহান আলিফ আলবী দুইজনকে দুই হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।আহানের দৃষ্টি স্থির হাসপাতালের কংক্রিটের ওই সাদা মেঝেটাতে!পড়নের অফ হোয়াইট টিশার্টটা যে প্রানপ্রিয় বোনের রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে! কারোরেই চলনশক্তি নেই বললেই চলে!ডাক্তার আর নার্সদের দিকটা রায়ান আর রনিত চৌধুরী এই দেখছেন।
অপারেশন থিয়েটার থেকে সার্জারী ডাক্তার জন মিল বের হয়ে এসে বললেন,
– রোগীর অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল।শরীর মারাত্মক ভাবে ঠান্ডা হয়েছিল।অনেক কষ্টে পালস পাওয়া গেছে!তার থেকেও বড় সমস্যা হচ্ছে প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে এক্ষুনি চার ব্যাগ এবি নেগেটিভ ব্লাড লাগবে!হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকেও ব্লাড পাওয়া যায় নি।বুঝতেই পারছেন রেয়ার ব্লাড,এবি নেগেটিভ।সহজে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।আমরা আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করছি আপনারাও দেখুন কোথাও পাওয়া যায় কিনা।
ডাক্তার সাহেব একজন বিদেশী ডাক্তার।হসপিটালের আটচল্লিশ ঘন্টার একটি ক্রিটিক্যাল অপারেশন করা হয়েছে তারই ডিরেকশনে।গোধূলিকে হসপিটালে নিয়ে আসার পর রনিত চৌধুরীর সাথে দেখা হয়।তারা দুজনেই পূর্ব পরিচিত আর ভালো বন্ধুও।সেই সুবাধে গোধূলির ব্যাপারটা তিনিই হ্যান্ডেল করছেন।লাজুক আর মিহির এসেছে!আদিবার এনগেজমেন্টের তারিখ ঠিক হতেই লাজুক আর মিহির চলে গিয়েছিল!বাসায় কোনো কাজ ছিল বিধায় দুই ভাই বোনকে চলে যেতে হয়েছিল!তাই লাজুক আর মিহির আসতে একটু দেরি হয়েছে।গোধূলিদের বাড়ি থেকে লাজুকদের বাড়ি যেতে ঘন্টা খানেক সময় তো লাগেই।
ছাতক পাখির ন্যায় দাঁড়িয়ে ছিল দীপ্ত।ভেবেছিল ডাক্তার হয়তো পজিটিভ কোনো খবরই দিবেন।কিন্তু তা আর হলো কই?ওর ভাবনা তো তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে গেল।নিজেকে ঘৃণ্য অপরাধী মনে হচ্ছিল ওর!অক্সিজেন বিহীন মানুষ যেমন ছটফট করতে থাকে এই মুহূর্তে দীপ্তেরো একি হাল।ডাক্তার এর বলা প্রত্যেকটা কথা বার বার ওর কানে বারি খাচ্ছে।আর সহ্য হলো না দীপ্তের।উৎকন্ঠিত সুরে বলে,
– স্টপ ইট ডক্টর!গোধূলির কিচ্ছু হবে না। আমি ওর কিছু হতে দেব না!আমি ব্লাড এনে দেবো!আপনি অপারেশন থিয়েটারে যান।
দীপ্ত আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বেড়িয়ে পড়ে।আহান আর ইহানও কোনো দিক না তাকিয়ে কাদের কাদেরকে যেন ফোন দেয়!তারপর ওরাও বেড়িয়ে যায়।
•
অপারেশন থিয়েটারের সামনে উৎসুকভাবে বসেছিল গোধূলির পুরো পরিবার।অপারেশন থিয়েটারের বাল্বটা অফ হতেই সবাই তড়িঘড়ি করে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়।কিছুক্ষণ পর ডক্টর জন মিল আর দীপ্ত অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে আসে!হুম দীপ্তও অপারেশন থিয়েটারেই ছিল!কিছুতেই ওকে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে রাখা যাচ্ছিল না!মানে ও থাকতে চাচ্ছিল না!শেষমেশ উপায় না পেয়ে ডাক্তার দীপ্তকে অপারেশন থিয়েটারে এলাও করে!
– ডাক্তার আমার মেয়ে কেমন আছে?
সাজ্জাদ সাহেব উত্তরের অপেক্ষায় ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।ডাক্তার সৌজন্যমূলক হেসে বললো,
– অপারেশন সাকসেসফুল এন্ড নাউ শী ইজ আউট অফ ডেঞ্জার।
সবাই চিন্তামুক্ত হলেন।রাবিয়া বেগমসহ বাকি সবাই লক্ষ লক্ষ বার শুকরিয়া আদায় করছেন।
– গোধূলিকে কিচ্ছুক্ষণ অবজারভেশনে রাখতে দেওয়া হয়েছে!তারপর কেবিনে শিফট করে দেওয়া হবে।কাল সকাল নাগাদ গোধূলির জ্ঞান ফিরে আসবে বলে আশা করছি।
ডাক্তার সাহেব চলেই যাচ্ছিলেন কি মনে করে যেন আবার ফিরে এসে দীপ্তকে বলেন,
– ও হে দীপ্ত তোমায় একটা কথা বলতে তো ভুলেই গেয়েছিলাম!থ্যাংক্স ইয়াংম্যান তুমি না থাকলে গোধূলিকে আজকে আরো সাফার করতে হতো!
– আমি আছি বলেই ওকে আজ এত কিছু সাফার করতে হচ্ছে!
মনে মনে বলল দীপ্ত!যেটা ডাক্তারের কান অব্দি পৌছালো না।
– ওই অবস্থাতে থেকেও তুমি যেভাবে সবটা সামল দিলে!থ্যাংক ইউ ওয়ান্স এগেইন।আর সারা জীবন এইভাবেই ওর পাশে থেকো।
ডাক্তার সাহেব দীপ্তের কানে কানে কথাটা বললেন!দীপ্ত মুচকি হাসলো!ডাক্তার আবার বলেন,
– হীরার টুকরো ছেলে আপনাদের।দেখবেন ওর প্রতি যাতে কোনো অন্যায় না হয়!
সবাই শব্দবিহীন তৃপ্তির হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে ডাক্তারকে আশ্বাস দিলেন যে, হ্যাঁ তাঁরা দেখবেন!
মেয়ের অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে শুনেই শিখা বেগম মেয়েকে দেখার জন্য রীতিমতো পাগলামি শুরু করে দিয়েছেন।যতই হোক মায়ের মন এমনি এমনি কি আর মানে?সবাই বাধ্য হয়েই গোধূলির সাথে মায়ের দেখা করাতে নিয়ে গেছেন।আহান দীপ্তকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে কপালে আর হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনে!গোধূলির চিন্তায় দীপ্তের দিকে কারো তেমন নজর ছিল না!তবে ব্যান্ডেজ লাগানোয় এবার সবার নজর দীপ্তের উপরেই স্থির।
উৎকন্ঠিত স্বরে দীপ্তি বেগম ছেলেকে জিজ্ঞাস করেন,
– দীপ্ত তোর হাত আর কপালে ব্যান্ডেজ কেন?কি হয়েছে তোর? এইভাবে কাটলো কোথায়?
– তেমন কিছু হয় নি আম্মু!
আমতা-আমতা করে বলে দীপ্ত।দীপ্ত বেগম চোখ রাঙিয়ে বললো,
– তা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি!হেয়ালি না করে বল তাড়াতাড়ি।
– আসলে আম্মু সিট বেল্ট বাঁধতে ভুলে গেয়েছিলাম! জোরে ব্রেক করায় ব্যালেন্স হারিয়ে একটু কপালে লেগেছে আরকি এই যা!
কথাটা দীপ্তের মায়ের কাছে বেশি গ্রহনযোগ্য না হলেও বিশ্বাস করলেন!কারণ তিনি তার ছেলেকে চিনেন!সিট বেল্ট না বেঁধে ড্রাইভ করার মতো এতটা ইরেসপন্সিবল ছেলে তো দীপ্ত না!তাও তিনি ছেলেকে জিজ্ঞাস করলেন,
– তা এত জোড়ে গাড়ি চালানোর কারণটা কি জানতে পারি?
দীপ্ত মায়ের কথায় ফিচেল হেসে বললো,
– আম্মু আসলে হয়েছে কি আহান আর আমি একটু কার রেস্লিং করতে গিয়ে এক্সাইটমেন্টে সিট বেল্ট বাঁধতে ভুলে গিয়েছিলাম।আর রেস্লিং এ কি আস্তে আস্তে গাড়ি চালালে হয় বলো!
ওইদিকে আহান যেনো আকাশ থেকে পড়লো!দীপ্তের কথা শুনে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে!কিসের রেস্লিং?আমি কখন ওর সাথে রেস্লিং করতে গেছি?বজ্জাত হারামি নিজে ধরা খেয়ে এখন আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে!আহানের এইসব ভাবনার ভিতরেই দীপ্তি বেগম রেগেমেগে তেড়ে আহানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,
– আহান তুই কবে থেকে ওর সাথে এই সব করতে শুরু করেছিস?যদি বড় কোনো এক্সিডেন্ট হত?
আহান হকচকিয়ে যায়।গলা টেনে বললো,
– ফুপি আমি নাআআ….
এটুকু বলে দীপ্তের দিকে তাকাতেই দীপ্ত ওকে কিছু না বলতে ইশারা করছে!
– না মানে ফুপি!আর হবে না এই কান ধরছি এইবারের মতো মাফ করে দাও!
– হয়েছে আর কান ধরতে হবে না! আমি আমার ছেলেকে খুব ভালো করেই চিনি!আমি জানি এখানে তোর কোনো দোষ নেই!তা বাবা দীপ্ত হাতটা কিভাবে কাটলো শুনি?
কার ঘাড়ে দোষ চাপানো যায় এই প্রশ্নের জবাবে ইহানকেই পেলো দীপ্ত!এক সেকেন্ডও দেরি না করে দীপ্ত বলে উঠে,
– ইহান!
ইহান সবে আসলো আলিফ-আলবী আর রাবিয়া বেগমকে বাসায় দিয়ে।ও এই সব কিছুই জানে না।
দীপ্তি বেগম অবাক হয়ে বললো,
– ইহান?
দীপ্ত ফোকলা হেসে বললো,
– হ্যাঁ আম্মু!আমি আর ইহান ট্রুথ অর ডেয়ার খেলছিলাম! ইহান আমাকে ডেয়ার দিয়েছিল দেয়ালে পাঞ্চ করতে হবে!পাঞ্চটা একটু বেশিই জোড়ে মেরেছিলাম তাই একটু ছুলে গেছে!তোমার ছেলে কি সাহসী তুমি জানো না?সামান্য একটা পাঞ্চই তো!তোমার ভাইপো যা ভিতুর ডিম!ওর ওকাদ দেখাতে আমি নিজেই ডেয়ার নিয়েছিলাম!আমি কি ভয় পাই নাকি?আর আহান তো আমার একটু বেশিই কেয়ার করে তাই জোড় করে এই ব্যান্ডেজ ফ্যান্ডেল লাগিয়ে দিয়েছে!অযথাই এই সবের কিছুই দরকার ছিল না!
ইহান একবার দীপ্ত আর একবার ফুপির দিকে তাকাচ্ছে।দুই মা ছেলের মধ্যে কি কথপোকথন চলছে ও কিছুই বুঝতে না পেরে আহানকে জিজ্ঞেস করে,
– কিরে দাভাই দীপ্ত ভাইয়া ভুলভাল এইসব কি বলছে?আমি কোন কালে ট্রুথ অর ডেয়ার খেলেছি তাও আবার দীপ্ত ভাইয়ার সাথে?
আহান দাঁতে দাঁত চেপে মিনমিনে স্বরে বললো,
– চুপ থাক!বেটা ফেঁসেছে তাই তোর নাম নিচ্ছে!তুই ওকে চিনিস না?মুখ ওমন করে লাভ নাই ভাই একটু আগে তোর মতো সেইম রিয়েকশন আমারো ছিল!
– ট্রুথ অর ডেয়ার?তাও আবার ইহান এর সাথে?
দীপ্তি বেগম বেশ বুঝতে পারছেন!যে ছেলের মশা মারতে কামান লাগে সেই ছেলে নাকি খেলবে ট্রুথ অর ডেয়ার।তাই দীপ্তের এই ব্যাখ্যা দীপ্তি বেগম বিশ্বাস করলেন না।তবে তিনি এটা বুঝতে পারছেন ছেলে মিথ্যা কথা বলছে!ও যখন একবার ঠিক করে নিয়েছে কিছু বলবে না তো বলবেই না।তাই দীপ্তি বেগম আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে ছেলেকে আর প্রশ্ন না করে চলে যান!
– উফ বাবা বাঁচলাম!
এতক্ষনে আটকে রাখা দম ছেড়ে বুকে হাত দিয়ে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে দীপ্ত!দীপ্তের এই হাল দেখে আহান আর ইহান ঠোঁট টিপে মিটিমিটি হাঁসছে।
#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -১৫
– তোরা দুই ভাই এইভাবে হাঁসছিস কেন?কি হয়েছে?
আহসান সাহেব কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললো। ইহান মেকি হেসে বলে,
– কিছু হয় নি আব্বু!
আহসান সাহেব ছেলেদের দিকে এক কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চলে যান।
– আহান!
দীপ্তের ডাকে আহান দীপ্তের দিকে তাকায়।দীপ্ত ছুটে এসে আহানকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে বলে,
– থ্যাংক্স ইয়ার!তুই না থাকলে আজ আমার যে কি হতো।আমি তো আজ মরেই যেতাম।
আহান দীপ্তকে ছেড়ে দিয়ে স্মিত হেসে বললো,
– আরে ইয়ার!তুই এইভাবে বলিছস কেন?আর এতে থ্যাংক্স দেওয়ারই কি আছে?আচ্ছা একটা কথা বল তো,আমার জায়গায় তুই থাকলে কি করতি?
দীপ্ত আবার আহানকে শক্ত জড়িয়ে ধরে।এই ভাবেই জড়িয়ে ধরে আছে যেন ছেড়ে দিলে এক্ষুনি পালিয়ে যাবে!
– চেপে ধরে আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিস নাকি?
– উফস সরি!তুই এখন বাসা যা আহান।বাসায় গিয়ে শার্টটা চেঞ্জ করে ফ্রেশ হও গিয়ে।তোর তো এখন না আসলেও চলবে!আমরা সবাই তো রয়েছেই এখানে!প্রায় ভোর হয়ে এলো বলে।তুই বরং বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে একটা ঘুম দিয়ে বিকালে আসিস।
– তোর এত না ভাবলেও চলবে।আমি বাসায় যাচ্ছি শুধু শাওয়ার নিবো বলে।তারপর চলে আসবো।তুইও বরং আমার সাথে চল।নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস শরীরের কি হাল বানিয়েছিস?
– না আমি যাবো না!আচ্ছা রায়ান ভাইয়া আর আঙ্কেল আন্টিরা চলে গেছেন তাই না!অনেক খেটেছেন তারা!অনেক সাহায্য করেছেন তারা?
– হুম,তাঁরা আমাদেকে নিজেদের পরিবারের বাইরে চিন্তা করে না।আঙ্কেল আন্টি খুব সৎ মনের মানুষ।ঠিক আছে তাহলে তুই থাক।কথা শুনার ছেলে তো তুই না।বললাম আমার সাথে চল তা তো যাবি না।আমি গেলাম!
★
রাতের শেষ ভাগে আযানের প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে চারদিক থেকে।আহসান,সাজ্জাদ, ইমরুল সাহেব আর ইহান মসজিদে নামাজ আদায় করতে গেছে।দীপ্ত যায় নি!হাসপাতালেই নামাজটা পড়ে নিলো দীপ্ত!আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটছে তার সাথে কারো কারো প্রতিক্ষার প্রহরও শেষ হচ্ছে!পাখিদের কিচিরমিচিরের শব্দ শুনা যাচ্ছে!এখানো পুরোপুরি অন্ধকার কাটেনি!
নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে সবাই চলে এসেছে।ভোরের দিকে গোধূলিকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।সবাই গোধূলির কেবিনেই অবস্থান করছে।জ্ঞান ফিরে এলে কাউকে দেখতে না পেয়ে যদি গোধূলি ভয় পায়!তাই সবাই ওর পাশেই রয়েছে।অবশ্য ভয় পাওয়াটাও স্বাভাবিক!যে মেয়ে ইঞ্জেকশন এর সুচের ভয়ে সারা বাড়ি মাথায় করে নেয়! জ্ঞান ফিরে এলে সে যদি দেখতে পায় তার হাতে এত মোটা ক্যানোলা দিয়ে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে তাহলে পুরো হাসপাতাল চিল্লিয়ে মাথায় তুলবে!
ঘড়ির ঘন্টার কাঁটাটা ঠিক সাতটার ঘর ছুইছুই!এখনো গোধূলির জ্ঞান ফেরে নি।দীপ্ত রুমের পূর্ব দিকে জানালার পাশের দেয়ালটালে এক পা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে হাতগুলো আঁড়াআঁড়িভাবে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে।ওইখান থেকে গোধূলির গতিবিধির লক্ষ্য রাখছে!দীপ্ত একধ্যানে তাকিয়ে ছিল গোধূলির দিকে। হঠাৎই ওর মনে হলো গোধূলির আঙ্গুলগুলো হালকা নড়েচড়ে উঠেছে।দীপ্তের ইচ্ছে তো করছে দৌঁড়ে গিয়ে গোধূলিকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু এখন তা করার সময় বা পরিস্থিতি কোনোটাই সঠিক নয়!দীপ্ত উৎকন্ঠিত স্বরে বলে উঠলো,
– গোধূলির জ্ঞান ফিরছে!
সবার দৃষ্টি গোধূলির উপর।মিটমিটিয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করছে গোধূলি।যতবারই চেষ্টা করছে ততবারই ব্যর্থ হচ্ছে।অতিরিক্ত কান্নাকাটি করলে এমনিতেই চোখ ফুলে গিয়ে চোখের পাতা ভারী হয়ে যায় তার উপর যদি অপারেশনের রোগী হয়ে থাকে তাহলে তো কোনো কথাই নেই!তবে গোধূলির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন!ও তো কপালে আঘাত পেয়েছে আর আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে অস্ত্রোপচারও হয়েছে যার ফলে সারা মুখই ফুলে আছে! মিনিট পাঁচেক পর পুরোপুরি চোখ খুলতে সক্ষম হয় গোধূলি।পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো গোধূলি।চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বলতে পারছে না।কেউ কিছু বুঝতে না পারলেও দীপ্ত ঠিকই বুঝতে পেরেছে!দীপ্ত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি টেনে সোজা গিয়ে জানালার পর্দাটা সড়িয়ে দেয়।
পর্দা সড়াতেই বাহিরের আলো রুমের ভিতরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে!এতক্ষণ মনে হয় ওরা এইটারি অপেক্ষায় ছিল!সূর্য উদয় দেখা ছাড়া যে গোধূলির দিন শুরু হয় না এটা আর কেউ না জানলেও দীপ্ত ঠিকই জানে!এই জন্যই তো পূর্ব পাশের কেবিনটায় গোধূলিকে রাখার ব্যবস্থা করেছে দীপ্ত। তবে সেটার কারণ সবার অজানা।সবাইকে বুঝিয়েছিল ওই রুমটাতে বেশি আলো থাকে!আর পূবালী বাতাসও পাওয়া যাবে!
গোধূলি মাথাটা আস্তে করে হালকা ঘুরিয়েছে সূর্য উদয় দেখবে বলে!জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও গোধূলির চিনতে অসুবিধে হয় নি!আজ সূর্যটা বেশ ক্ষানিকটা উপরে উঠে গেছে!গোধূলি ভাবছে হয়তো আজকে তার ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হয়ে গেছে!পরক্ষনেই মনে পরে সবাই ওর রুমে কি করছে?হাতে ভারী কিছুর উপস্থিতি টের পেয়ে উপরে তাকিয়ে দেখে স্যালাইন!আরেকবার পুরো রুমটায় চোখ বুলিয়ে নেয়।বুঝতে বাকি রইলো এটা হাসপাতাল।গোধূলি অনেক কষ্টে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
– আআমি হাহাসপাতালে কেকেন?
– দীপ্তের কলিজাটা ধক করে উঠলো! গোধূলির চোখ বেঁয়ে পানি পড়ছে!দীপ্তের মনে হচ্ছে কেউ ওর গলাটা চেপে ধরেছে শ্বাস নিতে যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।চোখ জোড়া সড়িয়ে নিয়েছে দীপ্ত।গোধূলির দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না।জ্ঞান ফিরেছে শুনে ডাক্তার গোধূলিকে দেখতে এসেছে।ডাক্তার এসে স্যালাইনটা অফ করে দিয়েছেন।স্যালাইন প্রায় শেষের দিকেই ছিল আর ঘন্টাখানেক চললেই শেষ হয়ে যেতো।
– ডাক্তার সাহেব স্যালাইন কি চলছে না?
– আপনার মেয়ে অনেক স্ট্রং সাজ্জাদ সাহেব।জ্ঞান ফিরে এসেছে এখন আর ওটার প্রয়োজন নেই।গোধূলি মা তোমার কেমন লাগছে এখন?
গোধূলির চোখ থেকে অনবরত পানি পড়েই চলেছে।ডাক্তারের কথায় মাথাটা হালকা উপর নিচ করে জবাব দিলো ভালো লাগছে!
– ডাক্তার ও কথা বলতে পারছে না কেন?
শিখা বেগম কান্নারত অবস্থায় বললেন।
– কান্নাকাটি করবেন না আপনার মেয়ে কথা বলতে পারবে।কিচ্ছুক্ষণ পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।গোধূলি আমি একটু পরে আবার আসবো কেমন তুমি এখন রেস্ট নাও।
গোধূলির মাথার দুপাশে আদিবা আর লাজুক বসে আছে!শিখা বেগমের শরীরটা ভালো নেই তাই তাকে জোর করে সাজ্জাদ সাহেব কে দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়েছে।সাথে জাকিয়া বেগম ও আহসান সাহেবও গেছেন।নাতনির জ্ঞান ফিরে এসেছে শুনে রাবিয়া বেগম বাসায় রীতিমতো চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছেন তাকে নিয়ে আসার জন্য।তাই আহান উনাকে নিয়ে এসেছে।আহান এসে ইহানকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। বাসা গিয়ে একটু রেস্ট আর ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার জন্য। ইমরুল সাহেব আর জ্যোতি বেগমকেও চলে যেতে বলা হয়েছে তারাও তো কাল থেকে হাসপাতালেই ছিল!
রাবিয়া বেগম গোধূলির মাথার কাছে বসে আছেন গোধূলিও তার দাদুর দিকে তাকিয়ে আছে।কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না!নাতনির এই হাল রাবিয়া বেগমের আর সহ্য হলো না কেঁদে দিলেন!আহান ওর দাদুকে এই অবস্থায় এখানে রাখা ঠিক হবে না ভেবে বলে,
– দাদু তোমাকে এইভাবে কাঁদতে দেখলে গোধূলিও কাঁদবে না?
আহানের কথা শুনে রাবিয়া বেগম একটু শান্ত হলেন।
আহান গোধূলির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘুমিয়ে গেছে!কিছু একটা ভেবে বলে উঠলো,
– গোধূলি ঘুমিয়ে আছে, মনে হয় না ঘন্টা তিনকের আগে ওর ঘুম ভাঙ্গবে!বুবু তুই আর লাজুকও না হয় বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয় আমি তো এখানে আছেই।আর সাথে দাদুজানকেও নিয়ে যা।
– না আমি যাব না।
কঠোর গলায় বললো রাবিয়া বেগম। আহান শান্ত স্বরে বললো,
– তুমি এখন বাসায় যাও পরে তোমাকে আমি আবার গিয়ে নিয়ে আসবো!
রাবিয়া বেগমকে নিয়ে আদিবা আর লাজুক চলে যায়।
– তুই এখনো ওখানে ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবি?
– আহান আমি একটু একা থাকতে চাই!
আহান কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।সবটা ক্লিয়ার না হলে দীপ্তের কাল থেকে করা প্রত্যেকটা আচার-আচরণ আহান লক্ষ্য করেছে।গোধূলির প্রতি ওর যে একটা অন্যরকম ফিলিংস আছে সেটা আহান ঢের বুঝতে পারছে।তাই ওকে একটু স্পেস দিয়ে আহান চলে যায়।দীপ্ত গোধূলির দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে মেঝেতে বসে।গোধূলির ক্যানোলা বিহীন ডান হাতটা দীপ্তের দু’হাতের মধ্যে আবদ্ধ করে নেয়।গোধূলির হাতের পিঠে ভরাক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে চুমো এঁকে দেয়।
#.