#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৪৩
– হসপিটালে তোর মামীর ডেলিভারি হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আমাদের বাচ্চাটা মারা গিয়েছিল।ডাক্তার যখন বলেছিল শিখা আর কোনো দিনও মা হতে পারবে না তখন আমার পুরো পৃথিবীটাই থমকে গিয়েছিল।আমার বাচ্চাটা আর এই পৃথিবীতে নেই,আমার স্ত্রী আর কোনো দিনও মা হতে পারবে না এই দুইটা সত্য একসাথে মেনে নিতে পারছিলাম না।কিন্তু মানতে আমি বাধ্য ছিলাম।সত্য যতই ভয়ংকর হোক না কেন কেউই তা উপেক্ষা করতে পারে না।তেমন আমিও পাই নি।না কোনো দিন শিখা মা ডাক শুনতে পাবে, না আমি কোনো দিন বাবা ডাক শুনতে পাবো।তখন কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।তোর মামীর তখনও জ্ঞান ফিরে নি।জ্ঞান ফেরার পর যখন ও সদ্যোজাত সন্তানের মৃত্যু আর মাতৃত্ব খোয়ানোর সংবাদ শুনতে পেত তখন আমি ওকে কি জবাব দিতাম?কি বলে সান্ত্বনা দিতাম ওকে?সন্তানের সাথে সাথে নিজের মাতৃত্বও হারিয়েছে এটা জানার পর নিশ্চয়ই কোনো মা বা স্ত্রী এই সত্যটা খুব সহজেই মেনে নিতে পারতো না।যখন ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জর্জরিত হয়ে হসপিটালের করিডরে পাইচারি করছিলাম।তখনই কোনো এক নার্সকে ডাক্তারের কাছে এসে বলতে শুনলাম,
– স্যার ৪০১ নং কেবিনে সন্ধ্যা সময় যে মহিলাটার ডেলিভারি হয়েছিল উনি উনার বাচ্চাকে ফেলে রেখে চলে গেছে।
ডাক্তার আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
– সিরিয়াসলি?আর ইউ শিওর?
– ইয়েস স্যার!এই যে দেখুন ওই মহিলা চলে যাওয়ার আগে এই চিরকুটটা রেখে গেছে।
– কি লেখা আছে ওতে?
নার্স চিরকুটটা খুলে ডাক্তারকে পড়ে শুনাতে লাগলো,
– যখন জানতে পারলাম আমি প্রেগন্যান্ট ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল।বাচ্চাটা একটু একটু করে আমার পেটের ভিতর বেড়ে উঠতে শুরু করেছে।যার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি সেই তো এখন অস্বীকার করছে।একটা নিস্পাপ শিশুর প্রাণ শেষ করার মতো এই পাপ কাজটা আমি করতে পারি নি।আজ তাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি।একজন অবিবাহিতা মেয়ে হয়ে সমাজে আমি ওকে কি পরিচয়ে বড় করবো?আমার পাপের বোঝা নিয়ে আমার সন্তান বেড়ে উঠোক এটা আমি চাই না।নয়টা মাস খুব কষ্টে করে সমাজের অগোচরে রেখেছি নিজেকে।পরিবার ছেড়ে তো সেই পাঁচ মাসেই চলে এসেছি।বাধ্য হয়ে ছিলাম।আমাদের সমাজব্যবস্থা আবার বড্ড বেশি সুশীল কিনা!যদি কখনো জানতে পারিস আমাকে মাফ করে দিস মা।কারণ তোকে এই নিষ্ঠুরতার দুনিয়ায় একা ফেলে রেখেই আমি চললাম এই পাপের জীবনের ইতি টানতে।যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস।
ডাক্তার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,
– ও মাই গড!এখন এই বাচ্চাটার কি হবে?
– বাচ্চাটা আমার চাই ডক্টর!
আমার কথাটা শুনে বিনিময়ে ডক্টর শুধু তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন।সেদিন আমি নতুন করে বাবা ডাক শুনার ভরসা পেয়েছিলাম আর শিখা তো জানতোই না কাকে হারিয়ে কাকে পেয়েছে।যখন জ্ঞান ফিরে তখন তো মেয়েকেই প্রথম দেখেছিল।এখন অব্দি শিখা এই বিষয়ে অবগত নয়।
দারজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের পায়ের নিচ থেকে মাটি সড়ে গিয়েছিল তো সাজ্জাদ সাহেবের ওই প্রথম বাক্যেই।
“সাজি আমার নিজের মেয়ে না”- কথাটা কানেই
যেতেই গোধূলির মনে হয়েছিল এক বিকট শব্দে পুরো আকাশটাই যেন ওর মাথায় ভেঙে পড়েছে।নিথর হয়ে আসা দেহটা নিয়ে কোনো মতে দাঁড়িয়ে ছিল সাজ্জাদ সাহেবের পুরো কথা শুনার জন্য।সাজ্জাদ সাহেবের কথা শেষ হতেই চলে আসতে পা বাড়িয়ে দু’এক কদম এগোতেই দীপ্তের হাসির আওয়াজ শুনে থেকে যায় কিন্তু পিছন ফিরে নি।
দীপ্ত সাজ্জাদ সাহেবের কথা শেষ হতেই তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,
– বিয়েটা হবে না…..
ব্যাস!গোধূলির জন্য এতটুকুই যতেষ্ট ছিল।গোধূলি ওখান থেকে দৌঁড়ে চলে যায়।
“বিয়েটা হবে না বলে যারা মনে করছো তারা ভুল ভাবছো”- এ কথাই দীপ্তের বলার ছিল।দীপ্তের কথা শুনে সবাই খুব অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।দীপ্ত বলতে শুরু করলো,
– এই চরম সত্যিটার মুখোমুখি আমি বাইশ বছর আগেই হয়েছিলাম।
সাজ্জাদ সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললেন,
– মানে?
– হসপিটাল থেকে সেদিন ফিরে এসে নানাজানের রুমে বসে যখন গোধূলিকে তোমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছিলে তখন আমি সবটা শুনে নিয়েছিলাম।তোমাদের মতো আমিও বাইশটা বছর ধরে এই সত্যিটার সাথে পরিচিত।বাড়ির ছোটরা না জানলেও আমি জানতাম।তাও আমি তখনও বিশ্বাস করতাম গোধূলি তোমার মেয়ে এখনো মানি ও তোমারই মেয়ে আর ভবিষ্যতেও জানবো ও তোমারই মেয়ে।
– সাজি যার কাছে যা ছিল এখনো তাই আছে আর তাই থাকবে মেজো বাবা।সাজি তোমার মেয়ে আর আমাদের বোন এটা ছাড়া আর কোনো সত্যি নেই বুঝেছো তুমি!
আহানের কথায় সায় দিয়ে ইহান বললো,
– সাজি তোমার মেয়ে এইটাই একমাত্র সত্যি মেজো বাবা!পুরো পৃথিবীতে এক দিকে আর আমাদের বোন এক দিকে।সাজি আমাদের বোন,আমাদের চোখের মণি।
দীপ্ত আর আহান ইহানের কথায় সাজ্জাদ সাহেবের মুখে প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট।চোখ ভরে উঠেছে উনার।সাজ্জাদ সাহেবের নিজেকে খুব হালকা লাগছে।জীবন সঙ্গী হিসেবে গোধূলির অতীত বর্তমান সবটা জানার অধিকার দীপ্তের আছে।বিয়ের পরে যদি এই রকম কোনো সত্যির মুখোমুখি হয়ে দীপ্ত উনার দিকে আঙুল তুলতো তাহলে দীপ্তকে উনি কি জবাব দিতেন?দীপ্তের চোখে ছোট হয়ে যেতেন উনি।যেটা মোটেও ভালো হতো না।তবে সাজ্জাদ সাহেব একটু সংশয়ে ছিলেন সত্যিটা জানার পর বাকিরা এই সত্যিটা আদৌ গ্রহণ করবে কিনা?তবে মনের কোণে কিছুটা হলেও আশা ছিল দীপ্তের প্রতি।কেননা যে ছেলে গোধূলিকে পাওয়ার জন্য এতটা সময় ত্যাগ স্বীকার করেছে সেই ছেলে আর যাই করুক গোধূলিকে অন্তত অস্বীকার করবে না!মেয়েটাকে যে বড্ড বেশি ভালোবাসে ছেলেটা।তাই তো উনি এতোটা ভরসা পান।সাজ্জাদ সাহেব তৃপ্তির হাসি দিয়ে দীপ্তকে জড়িয়ে ধরেন।উনাকেই সত্যি প্রমাণ করে দিয়েছে দীপ্ত।দীপ্ত সাজ্জাদ সাহেবকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– মামু!তুমি মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করো।
দীপ্তের কথায় হাতের পিঠে চোখ মুছে নিয়ে বিনিময়ে স্মিত হাসি দিয়ে মাথা নাড়ালেন সাজ্জাদ সাহেব।কথাটা শেষ করে দীপ্ত এক সেকেন্ডও দেরি না করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।
•
দীপ্ত ওর মায়ের রুম থেকে বেড়িয়ে এসে ওর রুমে এসে দেখে গোধূলি ঘরে নেই।ঘর থেকে বের হতে যাবে তখন দীপ্তের নজর যায় বিছানায়।বিছানা উপর কলমের নিচে একটা কাগজ চাপা দেওয়া।ভ্রু কুচকে এলো দীপ্তের।ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানা থেকে কাগজটা হাতে নিয়ে ওটার ভাঁজ খুলতেই থমকে যায় ওর পুরো পৃথিবী।মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে।চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।পাশে থাকা সোফাটায় ধপ করে বসে পড়ে দীপ্ত।নিজেকে সামলে নিয়ে হাতে থাকা চিঠিটা পড়তে শুরু করে,
সম্মোধন করার সাহসটা পেলাম না!
~ আমার জীবনে যে এত ঘৃণ্য বর্বরোচিত একটা কালো অধ্যায় আছে এটা আমি স্বপ্নেও কোনো দিন চিন্তা করি নি।তখন যদি আপনাকে ফলো করে ফুপির রুমের দিকে না যেতাম তাহলে হয়তো আজও আমি এই সত্যির অগোচরেই থেকে যেতাম!অস্বীকার করা ঘৃণ্য মানুষটার জায়গায় আব্বু আমার বাবার পরিচয় দিয়েছেন।ফেলে রেখে চলে যাওয়া নির্দয় গর্ভধারিনীর জায়গায় আম্মু তার বাহুডোরে ঠাই দিয়েছেন।আমাকে একটা সুস্থ সুন্দর পবিত্র পরিবার দিয়েছেন।কিন্তু সত্যটা তো সত্যই হয় নাহ্?স্বীকৃতিহীন পিতা-মাতার করা পাপের শাস্তি তো আমারই প্রাপ্য তাই না?কারণ তাঁদের করা পাপের ফলই যে আমি!আমার জন্মটাই তো ভুল!আমার জন্মটাই তো অপবিত্র!আমার সাথে বিবাহের মতো একটা পবিত্র বন্ধনে আপনি আবদ্ধ হতে চাইবেন না এটাই তো স্বাভাবিক!আপনি বিয়েতে মত দেন নি বলে বলছি না আমি বাস্তবতার প্রেক্ষিতেই বললাম!এই তিন বছরে অনেক কথা জমে গিয়েছিল।অপেক্ষায় ছিলাম!ভেবেছিলাম সে যদি আলো নিতে আবার আসে সব কথা উগলে দেবো!তাকে আর যেতে দেবো না।কিন্তু….!সবসময় অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় না কখনো কখনো তেঁঁতোও হয়!কথাটা এত দিন শুনে এসেছি আর আজ প্রমাণও পেয়ে গেলাম!
এতখানি পড়ে থেমে যায় দীপ্ত।চোখ ঘোলা হয়ে এসেছে।মাথা নাড়া দিয়ে দৃষ্টি পরিষ্কার করে নিয়ে হাতে থাকা চিঠিটা সামান্য ঝাড়া দিয়ে নাক টেনে নিয়ে আবার পড়তে শুরু করে দীপ্ত,
– আমার নামে অনেক পুড়েছেন আপনি!হয়তো সত্যিটা অজানা ছিল বলেই!কিন্তু এখন আর পুড়তে হবে না।মনই চাইবে না!ঘৃণা করবে তো!আমার নিজেরই নিজেকে ঘৃণা করছে!মনে যদি সামান্যতম করুণা আসে ছেড়ে দিন!চিন্তা করবেন না, আমি নিজের প্রাণহানি ঘটাবো না।যে তকমাটা আমার গায়ে লেগেছে তার থেকে পালাবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই।সত্যটা আমি বরণ করে নিয়েছি!আচ্ছা,পৃথিবীটা নাকি খুব সুন্দর?শুনেছি যা যত সুন্দর তা নাকি তত ভয়ংকরও হয়?তবু আজ বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে।বিশাল এই পৃথিবীতে মাথা গুজার ঠাইটুকু মনে হয় অনায়াসেই পেয়ে যাবো কি বলেন?কেউ একজন বলেছিল, “মৃত্যুটা হলো ছোটগল্প আর বেঁচে থাকাটা হলো উপন্যাস”তবে তাই হোক!আমিও না হয় বেঁচে তাকলাম বাস্তবতার এই শহরে।
তুমি এসো না আমার শহরে,
না বলা গল্পের অহেতুক ভীড়ে!
চলে যাচ্ছি বাস্তবতার শহরে।
ভালো থেকে তুমি,
চিরচেনা এই আপন শহরে!
আফসোস রইলো একটাই,
সূর্যাস্তের সময়কার ক্ষণিক লাল আলোকে
সাক্ষী রেখে বলা হয় নি, “ভালোবাসি তোমায়”
ইতি,
নাম!নাইবা লিখলাম!
হাত আলগা হয়ে আসে দীপ্তের।হাত ফসকে চিঠিটা পড়ে যায়।সেই দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই দীপ্তের।কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে।চোখ দুটো জলে টলটল করছে।আবার ঘোলাটে হয়ে গেছে নয়ন জোড়া।শুধু একটু পলক ফেলার অপেক্ষায় মুখিয়ে আছে অবাধ্য চোখের জল গড়িয়ে পড়ার জন্য। অনেকক্ষণ গোধূলি বা দীপ্ত কাউকেই দেখতে না পেয়ে দীপ্তি বেগম ওদের খুঁজ করতে দীপ্তের রুমে এসে দেখে দীপ্ত সোফায় বসে আছে।রুমের চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে গোধূলিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ছেলের কাধে হাত রেখে বললেন,
– সাজি কোথায় রে দীপ্ত?
মায়ের ছোয়া আর কন্ঠ পেতেই এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দীপ্ত।ছেলের আচমকায় এমন কান্না করার কারণ বুঝতে না পেরে দীপ্তি বেগম উৎকন্ঠিত স্বরে বললেন,
– কি হয়েছে বাবা?তুই কাঁদছিস কেন?
– গোধূলি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আম্মু!ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে!
কাঁদতে কাঁদতেই কথাটা বললো দীপ্ত।দীপ্তি বেগম আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাস করেন,
– মানে?
– গোধূলি সবটা জেনে গেছে।
দীপ্তি বেগম স্তব্ধ হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন।বিশ্বাস করছে পারছেন না যে গোধূলি চলে গেছে।দীপ্ত কেঁদেই চলেছে।ছেলের কান্না দেখে নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলেছেন তিনিও।দীপ্ত মাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।সারা রুম জুড়ে পাইচারি করছে আর ছটফট করছে।দীপ্তি বেগমের সামনে এসে করুন সুরে বললো,
– আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না আম্মু।গোধূলি হীনা দীপ্তের কোনো অস্তিত্বই নেই।গোধূলিকে আমার চাই আম্মু!ওকে চাই আমার।আমি বাঁঁচবো না ওকে ছাড়া।
শেষের কথাটা অনেকটা জোরে চেঁচিয়ে বললো দীপ্ত।রাগে পুরো রুমের জিনিস পত্র ভেঙে ফেলছে।গোধূলির বাড়ির সবাই জামাল সাহেবের সাথে দীপ্ত আর গোধূলি বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছিল।দীপ্তের চিৎকার শুনে এসে দেখে দীপ্ত পাগলের মতো করছে। হাতের সামনে যা পাচ্ছে সেটাই ভেঙে চুরে গুড়িয়ে দিচ্ছে।আহান দৌড়ে গিয়ে দীপ্তকে আটকানো জন্য ধরে।কিন্তু দীপ্ত রাগে আহানকে ঝাড়া দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
– আমার গোধূলিকে চাই!ওকে চাই আমার রাইট নাও।
আহানসহ বাকি সবাই আহাম্মকের মতো দীপ্তের কার্যকলাপ দেখছে।কেউই কিছু বুঝতে পারছে না।আহান বিরক্ত হয়ে বললো,
– কাল বাদে পরশু তোদের বিয়ে দীপ্ত!তাহলে এখন তুই এমন করছিস কেন?এটা কোন ধরনের ছেলেমানুষী? আমরা কি বলেছি বিয়েটা দিবো না?আর একটু আগে তুইয়েই না বলে আসলি?
– যার সাথে বিয়েটা হওয়ার কথা সেই যদি না থাকে?
বিস্ফোরিত চোখে আহানসহ বাকি সবাই দীপ্তি বেগমের দিকে তাকায়।
– সাজি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।ওর অতীত ও জেনে গেছে।
সারা শরীর থরথর করে কাপছে আহানের।মাথা ভার ভার লাগছে।হালকা চক্করও দিয়ে উঠে।ফলে খানিকাটা পিছিয়ে যায়।নিজেকে ব্যালেন্স করার জন্য পাশে থাকা ভাঙা ড্রেসিং টেবিলটায় হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে।জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বললো,
– এটা তুমি কি বলছো ফুপি?সাজি কোথায় যাবে?কার কাছে যাবে? এই শহরের কতটুকুই বা ও চিনে!
আহানের কথার দীপ্ত তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,
– বাস্তবতার শহর চিনতে গেছে ও!
কথাটা বলেই মুহুর্তেই আবার দীপ্তের চোখ রক্ত জবার মতো লাল হয়ে গেছে।হাত মুঠো করে রাগ সংবরণ করতে করতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– চিনাচ্ছি ওকে বাস্তবতার শহর।দেখাচ্ছি ওকে সুন্দর পৃথিবী!
#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#অন্তিম_পর্ব
দীপ্ত রাগে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে তো ঠিকই কিন্তু কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।একে তো ঘড়ির কাঁটা দশটা ছাড়িয়েছে তার উপর গোধূলি একা একটা মেয়ে।পাগলের মতো অবস্থা হয়ে গেছে দীপ্তের।দিশেহারার মতো মাথার চুল উল্টে ধরে রাস্তায় পাইচারি করছে।নিজের অবস্থা বুঝতে পারছে। এখন আমার মাথা গরম করলে চলবে না।ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে।রাস্তা পাশে থাকা ল্যাম্প পোস্টটের খুটিটায় গা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ায় দীপ্ত।বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।অশান্ত মন খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে।দীপ্ত কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবলো।পরমুহূর্তেই ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– উড়াল দেওয়ার বড্ড শখ হয়েছিল না চড়াইপাখি! আসছি আমি!তোর ডানা ছাটতে!
____________
– সকাল না হওয়া অব্দি আপনি কোনো ফ্লাইটই পাবেন না ম্যাম।
– কেন?আমি তো একটু আগেই টিকিট কাটলাম!
– আজকে রাতের যত ফ্লাইট ছিল সব ক্যান্সেল করে দেওয়া হয়েছে ম্যাম।
– কেন?
– জানি না ম্যাম।তবে অর্ডারটা মন্ত্রীমহল থেকেই এসেছে!
শুকনো মুখে এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে আসে গোধূলি।টিকিট কাটার পর হঠাৎ করে ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ায় বেশ অবাকই হয়েছে ও। কিন্তু কিছু করার নাই। যেহেতু সরকারি আমলাদের অর্ডার সেহেতু হয়তো কোনো রাষ্ট্রীয় কাজের জন্যই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।কিন্তু ওকে তো যে করেই হোক আজ রাতের মধ্যেই এ শহর ছাড়তে হবে!রাস্তায় কোনো রিকশা, সিএনজি বা অটোরিকশা কোনোটাই পাচ্ছে না।আর মনে হয় না কোনো কিছু পাওয়া যাবে বলে।সারা রাস্তাই তো দেখা যায় ফাঁকা।তাই গোধূলি দ্রুত পা চালিয়ে হাটছে।গন্তব্য বাস স্টপ!সেখান থেকেও হতাশ হয়েই ফিরতে হলো গোধূলিকে।বাসের নাকি ধর্মঘট চলছে!রাতে বেলা কিসের ধর্মঘট?কই শহরের ধর্মঘট হচ্ছে এমন কোনো নিউজ তো ও শুনে নি! বাস ড্রাইভারদের বকতে বকতে পুরো রাস্তা এসেছে গোধূলি।এখন তার লক্ষ্য সিএনজি স্টেশন!সেখানে শতেক খানিক সিএনজি ছাড়া প্রাণের কোনো অস্তিত্বই পেল না!অতএব এই যাত্রাপথও বন্ধ!শেষ মেশ উপায় না পেয়ে পা চালাতেই শুধু করে গোধূলি!অন্তত শহর থেকে তো আগে বের হওয়া যাক!কিন্তু এই আত্মবিশ্বাসও বেশিক্ষণ স্থানী হলো না!কুকুর বাবাজি তাড়া করে ঠিকঠাক মানুষটার কাছেই নিয়ে এসেছে।বলিষ্ঠ বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায় গোধূলি।নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা তোলে চকিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকায়।সামনের মানুষটাকে দেখতে পেয়ে বিরবির করে বলে উঠে,
– এর থেকে তো কুকুরের দৌঁড়ানি খাওয়াটাই ভালো ছিল!
দীপ্ত ভ্রু কুচকে বললো,
– হোয়াট!এই মেয়ে…..
দীপ্ত কিছু বলার আগেই গোধূলি ওর কথাটা বলেই জ্ঞান হারায়।পড়ে যেতে নিলেই ওকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয় দীপ্ত।গোধূলিকে ওর বাবার বাড়িতে নিয়ে যায় দীপ্ত।মেয়েকে অজ্ঞান দেখে ভড়কে গিয়েছিলেন শিখা বেগম।মেয়ের জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না।কুকুরের দৌড়ানিতে যে তার মেয়ে এই হাল দীপ্ত অলরেডি দশবার বলেছে।তবে কুকুরের দৌড়ানি খাওয়ার কারণ জানতে চাইলে দীপ্ত শিখা বেগমকে বলে,
– মামী তোমার মেয়ে একটু বেশিই শান্তশিষ্ট কিনা!
আসল গল্পটা না হয় শিখা বেগমের অজানাই থাক!গোধূলির উপর সবাই নীরব রাগ অভিমান দেখিয়েছে।গোধূলি অনেক কষ্টে তাদের মান ভাঙিয়েছে।কান অব্দি ধরেছে।উঠবস করেছে ভাইয়েদের সামনে। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল বলে যে শব্দটা আছে ওইটা ছোট বেলা থেকেই বেশ আয়ত্ত্ব করে নিয়ে ছিল কিনা!তাই বেশি বেগ পোহাতে হলো না।উপায় না পেয়ে শেষে গোধূলির কাছে পরাস্ত হয় সবাই।বিয়েটা না হওয়া অব্দি গোধূলি ওর বাবার বাড়িতেই ছিল।লজ্জা আর ভয়ে বিয়ের আগের সাত দিন এক বারের জন্যও দীপ্তের সামনে পড়ে নি গোধূলি।ভয়টাই ছিল বেশি।কারণ অর্ধেক কথা শুনেই সেন্টি খেয়েছিল কিনা!যখন জানতে পারে ওইদিন ওর শুনা অসম্পূর্ণ কথাটাই শেষ কথা ছিল না।তখন থেকেই ভয়ের মাত্রাটা আরো বেশি করে বাড়তে শুরু করে।খুব ধুমধামে দীপ্ত আর গোধূলির বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়।তবে গোধূলি বিয়ের আসরে কবুল বলা নিয়ে একটু সময় নিচ্ছিল।কাঁন্না করছিল প্রচুর।কাজী বার বার গোধূলিকে কবুল বলতে বলছিল।কিন্তু গোধূলিকে কবুল বলতে বলায় আরো জোরে জোরে কাঁদতে থাকে।গোধূলির এমন কান্না দেখে দীপ্তের সহ্যও হচ্ছিলো না আবার বিরক্তও লাগছিল।
– এই মেয়ে কি বিয়েটা না করার ধান্দায় আছে নাকি?তা না হলে সামান্য একটু কবুল বলতে এত সময় নেওয়ার কি আছে?আর এত কাঁদারই বা কি হলো?যাচ্ছে তো ওর ফুপির বাড়িতেই।দুই বছর তো দিব্যি ছিল ওইখানে!তাহলে আজ এত ঢং করার কি হলো?দেখে তো মনে হচ্ছে ওকে কেউ ভিনগ্রহে পাঠিয়ে দিচ্ছে।আর আমার দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যে আমি মনে হয় সেই গ্রহের এলিয়েন!
দীপ্ত গোধূলির দিকে বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে বিড়বিড় করে কথা গুলো বললো।গোধূলি অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে।কাঁন্না থামাচ্ছেই না।শেষে উপায় না পেয়ে দীপ্ত কাজী সাহেবের কাছ থেকে কলমটা নিয়ে হাতে থাকা টিস্যুটাতে কিছু একটা লিখে গোধূলির দিকে এগিয়ে দেয়।গোধূলি হাত বাড়িয়ে টিস্যুটা নিয়ে যখন নাক চোখ মুছতে যাবে ওমনি দীপ্ত বিষম খেয়ে বসে।চকিত দৃষ্টিতে দীপ্তের দিকে তাকালো গোধূলি।দীপ্ত ওর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চোখে ইশারা করল টিস্যুটা দেখার জন্য।দীপ্তের চোখ রাঙানো দেখে টিস্যু টা খুলে গোধূলি,” ওইদিনের বাড়াবাড়ির রিটার্নটা কি এখন দিয়ে দিবো?”লেখাটা চোখে পড়তেই ফটাফট তিন কবুল এক সাথেই বলে দেয় গোধূলি।গোধূলির অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছিল দীপ্ত।গোধূলি ওর দিকে তাকাতেই দীপ্ত ওর মুখের হাসি গায়েব করে দিয়ে ভ্রু কুচকে ইশারায় জিজ্ঞাস করে,কি?গোধূলি দীপ্তের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।ভয়ে তো দীপ্তকে মুখে কিছু বলতে পারছে না কিন্তু মনে মনে চোদ্দগুষ্টির নাম উদ্ধার করে তবেই ছেড়েছে।
একটু আগে তুলি গোধূলিকে দীপ্তের ঘরে বসিয়ে দিয়ে রেখে গেছে।তুলি বলে গেছে ও যেন এখান থেকে এক পা ও না নড়ে।
– ধ্যাৎ!এত ভারী লেহেঙ্গা কি এতক্ষণ পড়ে রাখা যায় নাকি?সেই যে কখন তুলার বাচ্চা এই এলিয়েনের গুহায় রেখে গেল এখনো তো কারোর আসার নামই নেই।না পাচ্ছি এলিয়েনের দেখা না পাচ্ছি মানুষের দেখা অসহ্য! বড্ড খিদেও তো পেয়েছে!ও ফুপি আমাকে কিছু খেতে দাও তো!খুব জোরে খিদে পেয়েছে আমার!ফুপি….!এত জোরে জোরে ডাকছি কেউ সাড়া দিচ্ছে না কেন?ধ্যাৎতেরিকি!দেখি তো সবাই কই গেলো!
– গোধূলি!
গম্ভীর কণ্ঠে নিজের নাম উচ্চারিত হতেই পা টা তাড়াতাড়ি করে আবার বিছানায় উঠিয়ে নেয় গোধূলি। অনেকক্ষণ একা একা বসেছিল বলে বোরিং লাগছিল আর খুব খিদেও পেয়েছিল।দীপ্তি বেগমের সাড়া না পেয়ে ও বিছানা থেকে নেমে দেখতে যাচ্ছিল।কিন্তু তার আগেই দীপ্তের ডাকে থমকে যায়।গোধূলি চমকে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে ব্যালকনিতে যাওয়ার দরজাটায় দীপ্ত হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এক ঝলক দেখেই চুপ করে ঠিক আগের জায়গায় বসে পড়ে গোধূলি।অনেকক্ষণ চলে গেছে দীপ্তের কোনো সাড়াশব্দ নেই বলে গোধূলি আবার পিছনে ফিরে।কিন্তু এ কি!দীপ্ত কোথায়?পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নেয় গোধূলি।পুরো রুম ফাঁকা!রুমের কোথাও দীপ্ত তো দূর,দীপ্তের ছায়াও দেখতে পাচ্ছে না গোধূলি।বেশ অবাক হয় গোধূলি।একটু আগে স্পষ্ট মানুষটাকে দেখতে পেলো ও। এখন কোথাও দেখতে পাচ্ছে না কেন?তাহলে ও কি ভুল দেখেছে?
– উহুম উহুম!
গোধূলির ভাবনার মাঝেই আগমন ঘটে দীপ্তের।দীপ্তের কন্ঠ পেয়েই চমকে উঠে গোধূলি।গলা খাঁকারির আওয়াজ পেয়ে ফট করে পিছনে ফিরতেই চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের।সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয় গোধূলি।এই ঘরে দীপ্তের অবস্থান ওর হার্টবিট ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে।ভয় আর লজ্জা দুটোই খুব করে ঘিরে ধরেছে গোধূলিকে।
চারপাশে রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়ে ডেকোরেশন করা খাটের ঠিক মাঝখানটায় বসে আছে গোধূলি।বাসর রাত নিয়ে একটা মেয়ের যেমন হাজারটা স্বপ্ন থাকে তেমন অনেকটা লজ্জা আর খানিকটা ভয়ও থাকে।যেটা এই মুহূর্তে গোধূলির সাথে হচ্ছে।ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে ধীর পায়ে এগোয় দীপ্ত।দীপ্তের অবস্থান গোধূলি ওর খুব কাছে বুঝতে পেরে একটু নড়েচড়ে বসে গোধূলি।
– কিছু একটা ভুলে যাচ্ছিস না?
দীপ্তের কথায় গোধূলি আশ্চর্য হয়ে তাকায়।পরমুহূর্তেই দীপ্তের কথার মানে বুঝতে সক্ষম হয় গোধূলি।জিভে কামড় দিয়ে চটজলদি বিছানা থেকে নেমে দীপ্তের সামনে এসে দাঁড়ায়।মাথায় থাকা ঘোমটাটা আরেকটু ভালো করে টেনে নিয়ে দীপ্তকে সালাম করে।দীপ্তের মুখে লাগাতার সেই স্মিত হাসি।গোধূলি সালাম শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই দীপ্ত গোধূলিকে হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসাতে বসাতে বললো,
– আর কবে বড় হবি তুই শুনি?
গোধূলির মুখ কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেল।দীপ্তের কথার মাথা মন্ডু কিছুই ওর বোধগম্য হলো না।তাই দীপ্তের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।দীপ্ত গোধূলির মুখে এক লোকমা খাবার দিয়ে বললো,
– বাসর ঘরে বসে থেকে কেউ শাশুড়িকে এই ভাবে চিৎকার করে ডাকে?
দীপ্ত গোধূলির মুখের ভেতর খাবার পুরে দিতেই গোধূলির আঁখিদুটি বেড়িয়ে আসার উপক্রম।মুখে খাবার নিয়ে দীপ্তের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে দীপ্তের হাতে একটা কাচ্চির প্যাকেট!আরেকটা পাশে রাখা।গোধূলিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে দীপ্ত বলে উঠলো,
– মুখের খাবারটা চিবিয়ে তাড়াতাড়ি হা কর।আমারও বড্ড খিদে পেয়েছে!
দীপ্ত ওকে একের পর এক লোকমা মুখে তুলে দিচ্ছে।কেউ কোনো কথা বলছে না।গোধূলি শান্ত মেয়ের চুপচাপ বসে খাচ্ছে আর ভাবছে,উনি কি করে জানলেন আমার কাচ্চিবিরিয়ানি পছন্দ?পরমুহূর্তেই তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,ধুর আমিও না!যে মানুষটা আমার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অব্দি খবর রেখেছে,আমার পছন্দের অপছন্দের কথা জানা তো তার জাস্ট একটা তুড়ির ব্যাপার।
– উহু হয় নি!
গোধূলি আশ্চর্য হয়ে দীপ্তের মুখের দিকে তাকায়।তাকানোর ভঙ্গিটা এমন যে,দীপ্ত কি বললো ও বুঝতে পারে নি।গোধূলির চাহনিতে দীপ্ত মুচকি হেসে হাতে থাকা অবশিষ্ট খাবারটুকু মুখে তুলে দিয়ে বললো,
– একটি চোখের পলক পড়তে যতক্ষণ লাগে ঠিক ততক্ষণ।
দীপ্তের কথার বিনিময়ে গোধূলি শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল।স্মিত হেসে মুখের খাবারটা শেষ করে।বেড সাইডের টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা বাম হাতে নিয়ে গোধূলিকে খাইয়ে দেয় দীপ্ত।তারপর ওর হাত ধুয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে যায়।গোধূলি শুধু দীপ্তকেই দেখে চলেছে।দীপ্ত ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের।চোখ সড়িয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে নেয় গোধূলি।দীপ্ত এগিয়ে গিয়ে গোধূলি সামনে দাঁড়িয়ে খানিকটা শীতল কণ্ঠে বললো,
– শুধু কি তাকিয়ে থাকলে হবে?
দীপ্তের দিকে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে গোধূলি।
– আমিও তো বড্ড তৃষ্ণাক্ত!
গোধূলি মাথা নামিয়ে নেয়।পাশে হাতরিয়ে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে তাকিয়ে দেখে বিরিয়ানির প্যাকেটা নেই।সামনের টেবিলে উপর দুটো খালি প্যাকেট রাখা দেখে কপাল কুচকে আসে গোধূলির।সেকেন্ড খানেক পরেই গোধূলি বুঝতে পারে দীপ্ত ওকে দুই প্যাকেট খাবারই খাইয়ে দিয়েছে।এখন যদি ওর পেট খারাপ হয়?গোধূলি চোখ বড় বড় করে দীপ্তের দিকে তাকালো।
– আমার কি দোষ!আমি তো কাউকে জোর করে খাওয়াই নি!
কথাটা বলে গা ছাড়া ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত।গোধূলির বরাবরই কাচ্চি পছন্দ।তাই বলে দুই প্যাকেট কাচ্চি একাই সাবার করে দিলো!লজ্জায় পড়ে যায় গোধূলি।উনি যে বললেন উনারো খিদে পেয়েছে।তাহলে এখন?উনি কি খাবেন না?গোধূলি বিছানা থেকে নেমে এসে বললো,
– আপনি বসুন,আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।
গোধূলি চলে যেতে নিলেই দীপ্ত পিছন থেকে গোধূলির হাত ধরে আটকে দেয়।পিছনে ফিরে দেখে দীপ্ত ওর দিকে তাকিয়ে আছে।গোধূলির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে দীপ্ত ধীর কন্ঠে বললো,
– কোথায় যাচ্ছিস তুই?
– আপনার জন্য খারাব আন…….
দীপ্ত গোধূলির ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে গোধূলিকে চুপ করিয়ে দেয়।অন্য হাতে গোধূলির কোমড় ধরে অনেকটা কাছে টেনে নিয়ে আসে।শিউরে উঠে গোধূলি।কোমড় ছেড়ে দিয়ে গোধূলির দু’গাল হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নেয় দীপ্ত।শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
“রামধনুর ওই সাত রঙেতে
সাজিয়ে তোমার মন
নতুন রূপে মুগ্ধ করো
তৃষ্ণার্ত দুই নয়ন”
অবাক চোখে দীপ্তের দিকে তাকিয়ে আছে গোধূলি।এই মানুষটার মনে কত আকুলতা!ঠিক কতটা ব্যাকুলতা নিয়ে এতগুলো বছর অতিবাহিত করেছেন উনি।আমি কি তার তৃষ্ণা মেটাতে পারবো?পারবো!পারতে হবে।তার প্রাপ্তি তাকে তার কাছে সমর্পণ করতে আজ বাধ্য।কারণ সেও তো খুব করে তাকে কাছে চায়।আপন করে নিতে চায়।আজ নিজেকে বিলিয়ে দেবো।
– মে আই?
দীপ্তের কথায় ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে গোধূলি।গোধূলি চুপ করে আছে।মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।
নেশালো চোখে দীপ্ত গোধূলির দিকে তাকিয়ে আছে।পিটপিট চোখে গোধূলির চাহনি,অতিরিক্ত কাঁন্নার করার ফলে গোধূলির ওই ফোলা ফোলা চোখ,ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে কিঞ্চিৎ ভাঁজ,লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া গাল আর গোলাপি ঠোঁট,দীপ্ত আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।নিজের ওষ্ঠদ্বয় গোধূলির ওষ্ঠদ্বয়ে ডুবিয়ে দেয়।হতভম্ব হয়ে গেছে গোধূলি।চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোধূলি।বাসর ঘরে বরের চুমো খাওয়াটা প্রত্যাশিত থাকলেও এই মুহূর্তে ও সেটা মোটেও এক্সপেক্ট করে নি।মিনিট পাঁচেক পরেও গোধূলির কোনো রেসপন্স না পেয়ে দীপ্ত ওকে ছেড়ে দেয়।ছাড়া পেয়ে গোধূলি লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলতে থাকে।দীপ্ত গোধূলির দিকে ঝুকে কানে কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
– চড়াইপাখির কি আরেকটু সময় প্রয়োজন?
দীপ্তের কথা শুনে আঁতকে উঠে গোধূলি।সত্যিই তো!মুখে যতই বলুক না কেন যে,ও নিজেকে দীপ্তের কাছে সঁপে দিবে তাও মনের কোণে কোথাও না কোথাও ভয় কাজ করছে।না পারছে নিজেকে কমফোর্ট করতে আর না পারছে দীপ্তেকে কমফোর্টেবল করতে!ওউ তো খুব করে দীপ্তকে কাছে চায়।কিন্তু পারছে না।লজ্জা আর ভয় ওকে ঘিরে ধরেছে।
গোধূলিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীপ্ত ওর প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর খুঁজে নিয়ে চলে যেতে নিলেই গোধূলি ওর হাত ধরে আটকে দেয়।দীপ্ত নিজের হাত থেকে গোধূলির হাতটা আলতো করে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
– ইটস ওকে,টেক ইউর টাইম।আমি না হয় আরেকটু অপেক্ষা করলাম।অপেক্ষা করতে করতে এখন আমার সয়ে গেছে।
দীপ্তের বলা শেষের কথাটা গুলো গোধূলির বুকে তীরের মতো গিয়ে আঘাত করেছে।দীপ্তের কথায় চাপা কষ্ট অভিমান স্পষ্ট।চোখ ছলছল করছে গোধূলির।গোধূলিকে দেখে দীপ্ত উৎকন্ঠিত স্বরে গোধূলির দু’গাল ধরে বললো,
– আরে তুই কাঁদছিস কেন?বুঝতে পারছি মানিয়ে নিতে তোর একটু সময় দরকার।বললাম তো,তোর যত সময় নেওয়ার আছে তুই নে।আমি শত যুগ অপেক্ষা করতে পারবো।শুধু আমাকে ছেড়ে চলে যাস না।সহ্য করতে পারবো না।
গোধূলি মাথা নিচু করে চুপ করে আছে।দীপ্ত আবার বলতে শুরু করে,
– দিনটা ছিল পহেলা ফাল্গুন।সবাই আমাদের বাড়িতে এসেছিলি।তুই বায়না ধরেছিলি নানাজান তোদের সাথে কানামাছি খেলুক।নানাজান রাজি হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তার শর্ত ছিল বাড়ির সবাইকেই খেলতে হবে।আমার এক্সাম ছিল তাই আমি খেলতে না গিয়ে ঘরে বসে স্টাডি করছিলাম।খিলখিল করে হেঁসে উঠা অচেনা মানুষের সেই চিরচেনা হাসি।মনের ভুল ভেবে পড়ায় মন দিলাম।কিন্তু না!সেই হাসির আওয়াজ ক্রমশ আমার মনকে মাতাল করে দিচ্ছে।টেবিলে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।নিচে গার্ডেন থেকে শব্দটা ভেসে আসছে।ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার পর্দাটা সড়াতেই বসন্তের কোকিলকে দেখতে পেয়েছিলাম সেদিন।প্রথমবারের মতো!সেদিন রাস্তায় যাকে দেখতে না পেয়ে শুধু তার হাসির আওয়াজ শুনতে পেয়েই এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম শুধু একটা বার দেখবো বলে।আর আজ সেই হৃদয় হরনী আমার সামনে।বুকের ভেতর ধক করে উঠে। হার্টবিট ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মনে হয়েছিল ছুটে গিয়ে সবার সামনে জাপটে জড়িয়ে ধরি।আমার সেই কোকিল ছিলি তুই।ওই দিন বসন্তের কোকিল হয়ে তুই আমার সামনে এসেছিলি চড়াইপাখি।তুই আমার ছিলি আছিস আর আজীবন থাকবি।আমি অপেক্ষা করতে পারবো কিন্তু উপেক্ষা নয়।
দীপ্ত গোধূলির কপালে চুমো দিয়ে চলে যেতে নিলেই গোধূলি দীপ্তের কলার চেপে ধরে।দীপ্ত ভ্রু কুচকে গলার দিকে তাকিয়ে গোধূলির মুখের দিকে তাকাতেই গোধূলি ওর ঠোঁট জোড়া দিয়ে দীপ্তের ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরে।দীপ্তের কলার ছেড়ে দিয়ে বাম গালে এক হাত রেখে অন্য হাতে দীপ্তের চুল মুষ্টি বদ্ধ করে নেয়।দীপ্ত কোনো রেসপন্স করছে না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।গোধূলি দীপ্তের ঠোঁটে শক্ত করেই একটা কামড় বসিয়ে দেয়।দীপ্তের দুই হাত ধরে ওর কোমড় জড়িয়ে দেয়।কিন্তু গোধূলি এই সংকেত গুলো যেন দীপ্তের জন্য যতেষ্ট ছিল না।টায় ওইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।পা উঁচিয়ে রেখে বরকে চুমো খাওয়া গোধূলির পক্ষে সম্ভব না।বেটা এলিয়েন!আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলে কি হতো?একটু আগে তো ঠিকই কোমড় জড়িয়ে ধরে চুমো খাওয়া হয়েছে।আমি কি এত উঁচুতে নাগাল পাই?পা ব্যাথা হয়ে গেছে আমার।গোধূলি অভিমান করে দীপ্তকে ছেড়ে দেয়।ছাড়া পেয়ে দীপ্ত চলে যেতে নিলেই গোধূলি বললো,
– আপনি ভালোবাসেন আমায়?
হুট করে গোধূলির এমন প্রশ্নে দীপ্ত একটু আশ্চর্য চোখে গোধূলির দিকে তাকায়।দীপ্ত বুঝতে পারছে গোধূলি ওকে আটকানো জন্যই এই প্রশ্নটা করেছে।সেটা গোধূলিকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।বড্ড বেশি ছটফট করছে।হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল দিয়ে মোচড়াচ্ছে।দীপ্ত ঠোঁট টিপে হেসে শীতল কন্ঠে বললো,
– ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসা যায়।
গোধূলি চুপ হয়ে গেছে।দীপ্ত আবারো চলে যেতে নিলে গোধূলি হুড়মুড়িয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।দীপ্ত ভ্রু কুচকে তাকায় গোধূলির দিকে।গোধূলি দীপ্তের উপর চোখ রাঙিয়ে কাটকাট গলায় বলে উঠলো,
– কোথায় যাচ্ছেন আপনি?আপনি কি বুঝতে পারছেন না কিছু?
গোধূলির শাসানো শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীপ্ত গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
– কি বুঝবো?তবে এটা বুঝতে পারছি তোর খুব ঘুম পাচ্ছে!যা ফ্রেশ হয়ে গিয়ে শুয়ে পর।
দীপ্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে নিলেই গোধূলি দীপ্তের কলার আবার চেপে ধরে।
– আমার বেবি লাগবে!আমি ঘুমাবো না এখন।
কথাটা অনেকটা জোরেই চিল্লিয়ে বলে গোধূলি। বিষম খেয়ে যায় দীপ্ত।
– আমার এক্ষুনি বেবি লাগবে!শুনতে পাচ্ছেন আপনি?
দীপ্ত গোধূলির মুখ চেপে ধরে একটু ধমকানোর স্বরে বললো,
– এই মেয়ে চুপ।এইসব কথা কেউ এইভাবে চিল্লিয়ে বলে!আর এক্ষুনি বেবি লাগবে মানে?এটা কি মামা বাড়ির আবদার নাকি।
– এ্যাএ….!
ন্যাকা কান্না জোরে দিয়েছে গোধূলি।
গোধূলির কান্না দেখে দীপ্ত সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,
– সত্যি করে বলো তো, তোর আবার বাসর টাসর করার ফিলিংস হচ্ছে না তো!
গোধূলি কান্না থামিয়ে গোল গোল চোখ করে দীপ্তের দিকে তাকায়।শুকনো একটা ঢোক গিলে গোধূলি।
– মো মোটেই নাহ্!
টেনে টেনে কথাটা বলল গোধূলি।দীপ্ত গোধূলির দিকে ঝুকে কানে কানে ফিসফিস করে জোর গলায় বললো,
– আরে হচ্ছে হচ্ছে!এটা তো আগেই বলতে পারতি যে তোরও বাসর করার ফিলিংস হচ্ছে!শুধু শুধু এতক্ষণ ধরে সময় নষ্ট করছিস।ভাঙবি তবু মচকাবি না!মাঝখানে বেবিকে অব্দি টেনে আনলি!আগে বললে তো এতক্ষণে অর্ধেক প্রসেস কমপ্লিট হয়ে যেত!
কথাটা শেষ করেই গোধূলিকে কোলে তুলে নেয় দীপ্ত।আচকায় এমন হওয়ায় দীপ্তের গলা আঁকড়ে ধরে গোধূলি।লজ্জায় মুখ লুকায় দীপ্তের বুকে। দীপ্ত গোধূলি ডুব দিলো ভালোবাসার অতল গভীরে।অতঃপর অনেক অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বার্থকতা পায় দীপ্ত গোধূলি।
_____________________
~সমাপ্ত🌸