দীর্ঘ রজনী পর্ব -৪৩ ও শেষ

নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৪৩ (অন্তিম পর্বের প্রথম খন্ড)

যেখানে এংগেইজমেন্টের দুই দিন পর বিয়ে হওয়ার কথা সেখানে সাদ বিয়ের জন্য মানা করছে।করবেইবানা কেন! সাজি জেগে ওঠার পর সাদকে দেখে আড়াল হচ্ছে। এক কথায় সাজি সাদকে ভয় পাচ্ছে।

সকালের সূর্যদয়ের সাথে সাজি জেগে ওঠে। তখনই সাদকে দেখে প্যানিক করতে শুরু করে। বিছানার কোনে গুটিয়ে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সাজির এমন ব্যবহারে চমকায় সাদ। নিজেকে নিজের কাছে জঘন্য অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। ক্ষানিকের জন্য হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে বসে ছিল। অনিলা আর সেঁজুতি এসে সাজির এমন ব্যবহার দেখে নিজেরাই অবাক। অনিলা সাদকে শান্তনা দিতে নিলে সাদ অশ্রুসিক্ত চোখে বলে উঠলো,, আমায় নিয়ে ভেবো না। সাজির দিকটা একবার ভেবে দেখো। ও এখনো পুরো স’ক কে’টে উঠতে পারেনি।
সাদ সেখানে আর এক মুহূর্তও বসলো না। সোজা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি থামায়। ভেজা চোখ দুটো মুছে ড্রাইভিং সিটে মাথা এলিয়ে দেয়। সাজির তাকে দেখে ভয় পাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না সে। সাজি আগেও ভয় পেতো , কিন্তু তখন সাজির চোখে ইনসিকিউর ভাবটা ছিলো না,যা এখন দেখতে পাচ্ছে। সাজির এই ভীতু দৃষ্টি সাদের হৃৎপিণ্ডে কাঁ*টা*র মতো বিঁ*ধ*ছে। সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া বন্ধ করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সাদ।কালকের প্রতিটা মুহূর্ত একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সাদ বুঝতে পারছে না ভুলটা ঠিক কোথায় হলো। সাজিতো তাকে ভয় পাওয়ার কথা না! তাহলে? সাদ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে রায়হানকে কল দিয়ে ডাক্তার সহ সাজিদের বাড়ি যেতে বলেছে। সাদ গেলো না, বরং সেই একই জায়গায় বসে রইল।

রায়হান ডাক্তারকে পুরো ঘটনা খুলে বলে। এরপর ডাক্তার সাজিকে চেকআপ করে বেরিয়ে আসে। ডাক্তারের মতে এতো কিছু একসাথে হওয়াতে সাজির মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারেনি। তাই তখন সেন্সলেস হয়ে গেছিলো। তবে সাদকে দেখে সাজির অস্বাভাবিক আচরণ করার মূল কারণ সাদের কালকের ব্যবহার। সাদের ওই হিং*স্র রূপটা সাজি আগে কখনো দেখেনি যার ফলে ভয়ে এমন ব্যবহার করেছে। খুব প্রিয় মানুষের বদলানো আচরন অনেকেই মানতে পারে না।সাজির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কোথাও না কোথাও মনে করছে হয়তো তার সাথেও সাদ এমন কিছু করবে।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সাদ পুরনরায় সাজিদের বাড়িতে আসে। জুবায়েরের সাথে নিশান আর সাজির ব্যাপারে কথা বলে বেরিয়ে যায়।

সাজি বিছানার কোন চেপে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর হাতে পরা আংটির দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। সাদকে যতবার দেখছে ততবার কালকের ওই রক্তাক্ত পরিস্থিতির কথা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। না চাইতেও সাজির সাদকে দেখে ভয় হচ্ছে প্রচুর। ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
রেনু ,লতা আর রিমি সাজির পাশে বসে আছে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর নিরবতা ভেঙ্গে রেনু বলে উঠলো,, সাজিঁ আপা! কাল পুরো রাত সাদ ভাই দুচোখের পাতা এক করেনি। তোমার হাত ধরে পুরো রাত জেগে বসে ছিল।
রিমি সাজির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,, দেখ সাজিঁ। আমি জানি তোর জন্য এমন পরিস্থিতি মেনে নেওয়া মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু তুই জানিস না সাদ ভাইয়ের জন্যেও সহজ ছিল না। পা*গ*লের মতো ছুটে এসেছিল তোকে বাঁ*চা*তে। শুধু তোকে ছুঁয়েছে বলে নিশানকে এতোটা মে*রে*ছে। আর তুই কিনা তা দেখে ভয় পাচ্ছিস?
লতা মিনমিনে গলায় বলল,, জানো আপু তুমি সাদ ভাইকে দেখে দূরে সরে গেছো দেখে সাদ ভাই খুব কেঁদেছে। আমি বাগানে ছিলাম তখন দেখি এক কোনে দাঁড়িয়ে মুখে হাত চেপে কাঁদছে। প্লিজ আপু তুমি এমন করো না।সাদ ভাই কষ্ট পাচ্ছে।

সবার কথা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সাজিঁ। সব কিছু যেন সাজির কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। কেন এমন করলো সে?কেন ওই মানুষটাকে কষ্ট দিলো? একটা বছর সাদকে কষ্ট দেওয়া কি কম হয়েছে !এখন আবার তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে।সাজি দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো। কেন সব সময় তার সাথে এমন হয় সেটাই বুঝতে পারছে না। কাকে দোষারোপ করবে সাজি। নিজেকে নাকি নিজের ভাগ্যকে?

সন্ধ্যায় গড়িয়ে রাত। আজ রাত পোহালে কাল হলুদের অনুষ্ঠান। তার আগে সাদ জুবায়েরের কাছে আবদার জুড়ে দিলো, জুবায়ের যেন বিয়ে ভেঙে দেয়। সাদের কথা শুনে জুবায়ের আচম্বিত হয়ে বললো,, পা*গ*ল হয়েছিস?কি বলছিস মাথা ঠিক আছে?

সাদ নিরেট স্বরে বলল,, হ্যা ঠিক আছে। যা বলছি জেনে বুঝে বলছি। তুমি বিয়ের ক্যানসেল করে দাও। দেখো মামু ছেলে পক্ষেরা বিয়ে ভাংতে গেলে মেয়ের বদনাম হয়। আমি তা মোটেও চাই না। তাই বলছি তুমি বিয়ে ভেঙে দাও।

জুবায়ের দাঁতে দাঁত চেপে বললো,, তো তোর বদনাম হবে না? নাকি তুই প্রধান মন্ত্রী তোর বদনাম কেউ করতে পারবে না?

~ আমার কথা চিন্তা করতে হবে না আমি সব সামলে নিবো। তুমি একবার সাজির কথা ভেবে দেখো। ওর মানসিক অবস্থা ভালো নেই। এই সময় বিয়ের জন্য প্রেশার দেওয়া নিশ্চই ঠিক হবে না?

জুবায়ের চশমা খুলে রেখে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো,, সাজি আমার মেয়ে হলে তুইও আমার ছেলে থেকে কম না। মনে রাখবি , সাজি জন্মানোর আগ থেকে তোকে আমি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। সাজির কথা একবার ভাবলে তোর কথা আমি দশবার ভাবতে বাধ্য।

জুবায়েরের এই কথার পর সাদ আর কিছু বলতে পারলো না। তাই চুপচাপ বসে রইলো। এই দিকে সেঁজুতি মুখে ওড়না চেপে কাঁদছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছে না। লতা আর রেনু তাকে সামলাতে ব্যাস্ত।

জুবায়ের চশমা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সাদ কিছু বলবে তার আগে সাদকে থামিয়ে বললো,, আমাকে বিয়ে ভাঙ্গার কথা না বলে যার সাথে তোর বিয়ে হওয়ার কথা তাকে গিয়ে বল ভাংতে। আমি কিছুই করতে পারবো না।

জুবায়ের সেঁজুতিকে ইশারায় উঠতে বলে,রেনু আর লতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,, রাত কতো হয়েছে খেয়াল আছে? রিমিকে ডেকে নিয়ে আয়। সেঁজুতি টেবিলে খাবার সাজাও ক্ষীদে পেয়েছে।

রেনু খালুর ইশারা ঠিকই ধরে ফেলেছে। তাই হড়বড়িয়ে উঠে গিয়ে সাজির রুম থেকে রিমিকে টেনে হিচড়ে নিয়ে এলো। সাদ কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। সাদের পা যেন চলছে না। সাদ জানে সাজি তাকে দেখে ঠিক কেমন রিয়েক্ট করবে। এটাও জানে সাজির করা অস্বাভাবিক আচরণ তাকে ঠিক কতটা আ*ঘাত করবে। সাদ নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে এককথায়। হাজারটা ইচ্ছে পা দিয়ে মাড়িয়ে সাজির রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

পুরো রুমের বাতি বন্ধ করে রেখেছে সাজি। ঈষৎ আলোয় জানালার গ্ৰিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে । রুমে যেটুকু আলোর দেখা মিলছে তা বারান্দা থেকে আগত। চোখ জোড়ায় বিগত রাতের প্রেত্যেকটা মূহুর্ত এক এক করে কল্পনা করছে সাজি। নিশানের নোং*রা আচরণ,হুট করে সাদ এসে নিশান থেকে ছাড়িয়ে আগলে নেওয়া, তাকে ছোঁয়ার দুঃসাহস করায় নিশানকে করা সাদের আ*ঘাত সবটা একে একে কল্পনা করছে সাজি। তার সাথে গড়িয়ে পড়ছে চোখের কোন বেয়ে নোনা জল।যার জন্য এতো কিছু করলো সে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যাপারটা যতবার মনে উঠছে ততবার সাজিঁ ডুকরে কেঁদে উঠছে।

সাদ সাজির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ হলো। ভিড়ানো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করার সাহস কুলোচ্ছে না।মনে হচ্ছে একটা দরজা নয়, বরং হাজার মাইলের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাদের মাঝে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করলো। অতঃপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো সাদ। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সাজি চোখ মুছে কম্পিত গলায় সুধালো,, সাদ ভাই এসেছে রিমি? কি বলেছে উনি? রেগে আছে তাই না?

সাজির করা প্রশ্নে থমকালো সাদ। বাড়িয়ে নেওয়া পা পুনরায় পিছিয়ে নিলো। কথা গুলো কি শোনা উচিৎ নাকি ,না শুনে চলে যাওয়া উচিৎ। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে সাদ। তাও গেলো না। দাঁড়িয়ে রইলো ঠায়।সাজি ঘুরে দেখলো না কে দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেছে হয়তো রিমি এসেছে সাদের খবর নিয়ে।

সাজি শব্দ করে কেঁদে উঠে বলল,, আমিকি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছি রিমি? আমি খুব খারাপ তাই না? শুধু শুধু একটা মানুষকে কষ্ট দিচ্ছি? আ’ম সরি ইয়ার আমি না বুঝে মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।আ’ম স্যরি!

সাজি জানালার গ্ৰিলে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে। সাদ ভেজা চোখ মুছে দু’পা এগিয়ে কোমলমতি গলায় বলল,, আমি একটুও রেগে নেই সাজঁবাতি।

সাদের গলার আওয়াজ পেয়ে চমকায় সাজি। চমকে উঠে ফিরে তাকায়। ঈষৎ আলোয় সাদের অশ্রু জলে শিক্ত চোখ জোড়া জল জল করছে। সাজির কল্পনাও করেনি ,সাদ তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে। মুখে না বললেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই সাদকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিল সে। তবে সেই ব্যাকুলতা এই ভাবে শেষ হবে স্বপ্নের ভাবেনি । সাদকে দেখে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালাতে লাগলো। তবে তা হওয়ার নয়, চোখের জল যেন বাঁধ ভাঙার মতো করে বইছে। সাজিঁ দ্রুত পা ফেলে সাদকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আচমকা এমন হওয়ায় টাল সামলাতে না পেরে দু’পা পিছিয়ে গেলো সাদ। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দুহাতে আগলে নিলো প্রিয়তমাকে।

দরজার বাইরে থেকে রেনু,লতা,আর রিমি তিনজন মাথা বের করে এতক্ষণ সাদ আর সাজিকে দেখছিলো। সাজি সাদকে জড়িয়ে ধরতেই দুইজন উল্টো দৌড় দিয়ে পালালো। রয়ে গেল বেচারি রেনু। রেনু বেচারি এদিক ওদিক তাকিয়ে ছুটে পালালো। জুবায়ের আর সেঁজুতি বসে ডিনার করছে। তিনজন দৌড়ে আসতে দেখে জুবায়ের ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সেঁজুতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,, রেনুটা নিজে তো মানুষ হয়নি,তার সাথে মিশে বাকি মানুষ দুটোও ক্যাঙ্গারু হয়ে যাচ্ছে। তুমি রেনুকে কিছু বলছো না কেন সেঁজুতি?
রেনু সেজুতিকে ইশারায় খবর জানায় । সেঁজুতি তা দেখে খুশি হলেও, জুবায়েরের কথায় বেজায় বিরক্ত হয়ে বলল,, সবাই মানুষ হলে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। দু একটা ক্যাঙ্গারু থাকলে ভারসাম্য রক্ষা পাবে। তুমি এসব চিন্তা না করে হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজনে লেগে পড়ো। বর বউ তৈরি কাল হলুদ কনর্ফম।
জুবায়ের চশমা খুলে বললো,, মানে! তুমি কি করে জানলে? সেঁজুতি চোখ ছোট ছোট করে বললো,, ক্যাঙ্গারু খবর দিয়েছে।
জুবায়ের হা-হুতাশ করে টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে যেতে বললো,, এই ঘরে বোধ হয় আমিই একমাত্র মানুষ। বাকি সব চিড়িয়াখানা থেকে এসেছে।

অনেকক্ষণ হলো সাদ ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। সাজি ইচ্ছে মতো কেঁদে সাদের শার্ট ভিজিয়ে জবজবে করে ফেলেছে। সাদের অনেক কথা বলার ছিল, অনেক প্রশ্ন করার ছিল, অনেক উত্তরের খোঁজ ছিল। কিন্তু সব যেন মূহুর্তে ভুলতে চলেছে। যাকে এতো কথা, এতো প্রশ্ন করবে সে নিজে কেঁদে কেটে বুক ভাসাচ্ছে। সাদ জানে তার আর প্রশ্ন করা হয়ে উঠবে না। শুধু আজ নয় অনন্ত কালের জন্য ওসব প্রশ্ন করা হয়ে উঠবে না। তাকে জিজ্ঞেস করতে পারবে না, কেন সে দূরে ঠেলে দিয়েছিল! দূরে ঠেলে দিয়ে যে নিজে ক্ষতবিক্ষত তাকে আবার কিসের প্রশ্ন? বিয়ে ভাঙ্গার কথা বলতে এসেছিলো সাদ আর এখন প্রিয়তমা বক্ষ পিঞ্জীরা দখল করে বসে আছে। কার থেকে দূরে যাবে? কাকে দূরে সরাবে? যাকে দুরে সরানোর জন্য এসেছে সে আগ থেকেই জেঁকে বসে আছে। সাদ ভেজা চোখ মুছে নিলো। অতঃপর মুচকি হেসে সাজির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,,সাজি!! চোখ মুখ ফুলে গেছে তো!আর কত কাদবি? এইবার তো চুপ কর?

সাজিঁ সাদের বুকে মুখ গুঁজে ভাঙ্গা গলায় বলল,, আ’ম স্যরি! আমি খুব খারাপ সাদ ভাই। আমি খুব খারাপ। শুধু কষ্ট দেই তাই না!
সাদ ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললো,, খারাপ হলেও কিছু করার নেই। সেই খারাপটাই আমার।

সাজি মাথা তুলে সাদের মুখের দিকে তাকায়। সাদ আলতো হাতে সাজির চোখ মুছে দিয়ে দুগালে হাত রেখে বলল,, আর কাঁদতে হবে না। দেখ আমি একটুও রেগে নেই। কেঁদে কেঁদে চোখ- মুখের কি অবস্থা করেছিস! এইভাবে মিসেস সাদ হওয়া যাবে না। আমার শুধু সাজঁবাতিকে চাই, ছিঁচকাদুনে সাজির দরকার নেই।

সাদের কথা শুনে মুখ ফুলায় সাজিঁ। ঈষৎ আলোতেও তা সাদের নজর এড়ায়নি। সাদ ফিক করে হেসে উঠে,সাজিঁ কপালে অধর ছুঁইয়ে আদুরে গলায় বলল,,Get ready for be my wife সাজঁবাতি।
নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৪৪(অন্তিম পর্ব)

দুই বাড়িতে বিয়ের আমেজ শুরু হয়েছে। এই দিকে অনিলার ঠোঁটে হাসির রেখা যেন সরছেই না। অনিলা খোশ মেজাজে সকল আয়োজন নিজে থেকে গিয়ে পর্যবেক্ষন করছে। আনিস আর রাজিয়া তারা বসে নেই সবাই নিজ থেকে দায়িত্ব নিয়ে সবটা সামলাচ্ছে। জুবায়েদা খাতুন রাজিয়ার এমন আচরণ দেখে মনে মনে বেশ খুশি হলো।

ওই দিকে সেঁজুতিও বসে নেই। একমাত্র মেয়ের বিয়ের আয়োজনে কোনো কমতি রাখছে না। জুবায়ের দৌড়ে ঝাপের উপর আছে। কোথাও যে দুটো মিনিট বসবে তার যো নেই।
রেনু ,লতা ,রিমি সবাই সাজিকে নিয়ে ব্যাস্ত। হলুদের জন্য সাজিকে সাদের আদেশ অনুসারে সাজাচ্ছে। ঠিক যে ভাবে সাদ চেয়েছে ওভাবে। নো মেকআপ ওনলি কাঁচা ফুলের গহনা আর একটু লিপস্টিক। সাদের মতে যে এমনিতেই সুন্দর তাকে আবার সুন্দর করতে এতো কিছু লাগানোর কি দরকার!সে অকৃত্তিম সুন্দর সাজঁবাতিকে দেখতে চায়।
এই দিকে রায়হান সাদের পেছনে পাঞ্জাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে হিস হিস করতে করতে দাঁত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাদের সেই দিকে তেমন নজর নেই। সাদ কখনো মোবাইল নিয়ে ব্যাস্ত ,তো কখনো মেহমান নিয়ে। এক পর্যায়ে রায়হান কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো, দেখুন স্যার আজ আপনার হলুদ। আপনি বলেছেন ম্যামকে আপনি আগে হলুদ ছোয়াবেন। কিন্তু আপনার আচরন দেখে মনে হচ্ছে আপনি ওই বাড়িতে খাওয়া শেষে প্লেট ধুতে যাবেন।
সাদ রায়হানের এমন উদাহরণ শুনে কপালে আঙ্গুল ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,, শোনো রায়হান রিসেপশন শেষে উদাহরণ শেখার জন্য তুমি আলাদা ক্লাস জয়েন করবে। ক্লাস ফি আমি দিবো।
রায়হান মুখ গোমড়া করে বিড়বিড় করে বললো,, আগে বিয়ে করে আমাকে উদ্ধার করুন। ক্লাস আপনার ছেলেমেয়ের সাথে করবো।
সাদ শুনেও না শোনার ভান করে পাঞ্জাবি পরতে শুরু করলো। সাদ জানে রায়হানকে কিছু বলা আর কলা গাছের ফার্নিচার তৈরি করা একই কথা।

সাদ আর সাজির হলুদ সন্ধ্যা। যেখানে সাদ গাড়ির বহর নিয়ে তার হবু বধুয়াকে হলুদ ছোঁয়াতে গেছে। দুই বাড়ির মানুষের মেল বন্ধনে অনুষ্ঠান আর জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সাজিকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে সাদ। গাড়ি থেকে নেমে স্টেজ ওবদি পথটা যেন শেষ হতেই চাইছে না। সাদের এমন ব্যাকুলতা রায়হান দারুন মজা নিচ্ছে। সাদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে গাইছে,
Dekha hazaron dafa aapko
Phir beqarari kaisi hai .
Sambhale sambhalta nahi ye dil
Kuch aap mein baat aisi hai
Lekar ijazat ab aap se .
Saansein ye aati jaati hain
Dhoondhe se milte nahi hain hum
Bas aap hi aap baaki hain .
কিছুক্ষণ পর পর সাদ চোখ রাঙানি দিচ্ছে। তবে এতে রায়হানের কিছু যায় আসছেনা। রায়হান নিজের মতো করে সাদের পায়ে পাড়া দিয়ে খোঁচাচ্ছে।

একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো সাজিকে। সাজি শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেঁচিয়ে বিড়বিড় করছে,,সাদ ভাই এমন নি*র্লজ্জের মত কাজ না করলেও পারতো। কেন আসতে হবে তার!সবাই কি ভাবছে? নিশ্চয়ই বলছে সাদ বউ পা*গ*ল। সাজি নিজে নিজে বিড়বিড় করে উঁকি দিয়ে দেখছে, কোথাও যদি একটু সাদকে দেখা যায়। সাজির এমন কাজে রিমি টিপ্পনি কে*টে বললো,, জামাইটা আখের তোর। এতো উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিস কেন? একটু আগে না ফোনে কথা বললি?
সাজি রিমির বাহুতে চাপড় মে*রে বললো, চুপ করনা! আমার খুব লজ্জা লাগছে। সাদ ভাই কেন আসছে বলতো? লোকটার কি মাথা ন*ষ্ট হয়ে গেছে?

রিমি চোখ বড়বড় করে বললো, আস্তাগফিরুল্লাহ সাজি!এখনো সাদ ভাই! এমন চলতে থাকলে বেচারা নিজের ছেলেমেয়ের মুখ থেকে বাবা ডাক শোনার আগে মামা ডাক শুনবে। এইবার তো সাদ ভাই বলা ছেড়ে দে! সাদ ডাক। অনলি সাদ! সাথে বাবু,বেবী লাগাতে পারিস। কিন্তু ভাই না প্লিজ!!!

সাজি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,, এইখান থেকে সর বে*য়া*দব! রিমি হাসতে হাসতে পেটে হাত চেপে গেইটের দিকে ছুটলো। আপাতত সাজির খবর সাদ ভাই ওবদি পৌছানোটা তার মূল কাজ।

অবশেষে সাদ সবার থেকে ছাড়া পেয়ে স্টেজের দিকে এগোয়। মেহমানদের আনাগোনা, বাচ্চাদের হই হই , সাদের কাজিন ,বন্ধু বান্ধব আর অফিসের সবাই মিলে হলুদ সন্ধ্যাকে আরো বেশি রোমাঞ্চিত করে তুলছে। স্টেজের সামনে থামলো সাদ । পলকহীন চোখে নিজের ব্যাক্তিগত রমনীকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে দেখে তবেই এগোলো। সাদের হলুদ ছোঁয়ানোর পর একে একে সব আয়োজন শুরু হয়। যা সম্পন্ন হতে হতে রাত দুটো।

অপেক্ষার রজনী শেষে ভোর হয়। মেয়েদের সাজ সয্যা, গাড়ির দরজা খুলে ছেলেদের তাড়া দেওয়া সব মিলিয়ে অন্য রকম সুন্দর পরিবেশ। কিছু প্রনয়ের সূচনা এইখান থেকে শুরু। কেউ চোখে চোখে ইশারা করছে ,কেউবা মুচকি হেসে। কারো প্রেম নিবেদন গোলাপ সহ টিস্যু পেপারে নাম্বার অদল বদল ওবদি।কেউবা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকে অনূভুতি অন্য কারো নাম করছে , আর কেউ লাজুক হেসে সেই অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।

অন্যদিকে বিয়ের সাজে সেজে লাল টুকটুকে বউ হয়ে বসে আছে সাজি। ফটোগ্ৰাফার বিভিন্ন এংগেল থেকে ছবি তুলতে ব্যাস্ত। বিরক্তে কপাল কুঁচকে আসছে সাজির। বিয়ে এতো ঝামেলা জানলে করতোই না। বরং সাদ ভাইকে নিয়ে পালিয়ে যেতো।

অবশেষে বউ নিতে বরের আগমন।স্টেজে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সাদ ,এইতো তার বধুয়া এলো বলে। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেছে।হাত ঘড়িতে সময় দেখে অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। জুবায়ের উঠে সাদের সামনে দাঁড়িয়ে শেরওয়ানীর বোতাম ঠিক করে দিতে দিতে রহস্য করে বললো,, বিয়ে ক্যানসেল করে দেই? মেয়ে পক্ষেরা বিয়ে ভেঙে দিলে নাকি বদনাম হয় না!
সাদ জুবায়েরের কথা শুনে মুচকি হেসে জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরলো। জুবায়ের সাদের পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বললো,, কখনো কোনো কিছুতে হার মানবি না,হোক সেটা ভালোবাসা কিংবা যু*দ্ধ। এইটা মনে রাখবি ভালোবাসায় হেরে যাওয়া মানে জীবনের সবচেয়ে বড় হার।
সাদ বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে মুচকি হেসে বললো, সব সময় মনে থাকবে।
বর এসেছে ,বর এসেছে শব্দে ফটোগ্ৰাফারের ফটোগ্ৰাফি নামক অত্যাচার থেকে রেহাই পেলো সাজি। আনিসের সাথে দুইজন লোক এসে বিয়ের পর্বটা সেরে ফেললো। এর পরেই সাজিকে নিয়ে গেলো স্টেজের দিকে যেখানে সাদ অপেক্ষারত। টুকটুকে লাল রঙের বেনারসী শাড়ি পরিহিতা নিজের সদ্য বিয়ে করা বউকে দেখে ভাবুক হলো সাদ। ঠোঁটে হাসি হলেও ভেজা চোখ জোড়া স্থীর । সাদ একবারের জন্যেও নজর ফেরায়নি। সাজির প্রতিটা কদমে সাদের ঠোঁট প্রসারিত হচ্ছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে তা দেখছে জুবায়ের। সেঁজুতি জুবায়েরের হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুবায়ের সেঁজুতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,, আমার লাইফে নেওয়া সেকেন্ড বেস্ট ডিসিশন।
সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে বললো, সেকেন্ড!! তাহলে প্রথম কোনটা?
জুবায়ের চশমা ঠিক করতে করতে বললো,, প্রথমটা তোমার বাবাকে থ্রে*ট দিয়ে তোমাকে বিয়ে করা।
সেঁজুতির চোখ জোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম। সেঁজুতি জানে তাদের বিয়েটা এরেন্জ মেরেজ যা সেঁজুতির বাবা ঠিক করেছিলো। কিন্তু এইখানে কাহিনী অন্য রকম।
জুবায়ের মুচকি হেসে নজর ফেরায়। সে জানে এখন তার প্রিয়তমা প্রশ্নের সাগরে ডুব দিবে।

সাদ চোখ মুছে হাত বাড়ায়।বাড়ানো হাতে সপ্তপর্নে হাত রাখলো সাজি। এই ওবদি পৌছাতে অনেক কাঠখড় পো*ড়া*তে হয়েছে। পরিবারের হস্তক্ষেপ না থাকলেও পরিস্থিতি তাদের মধ্যে ঠিকই দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। অবশেষে চার হাত এক হলো। জীবনের নতুন আর সুন্দরতম অধ্যায়ের সূচনা। যা সাদের কাছে স্বপ্নের মতো ঠেকছে। মনে হচ্ছে জেগে উঠলে সব কিছুর সমাপ্তী। সাদ জাগতে চায় না,হাতের মুঠোয় নেওয়া রমনীর হাত ধরে অজস্র প্রহর পার করতে চায়। নির্ঘুম কিংবা গভীর তন্দ্রায়।

হইহুল্লোড় করে খাওয়া দাওয়া শেষ হয়। বিদায় বেলা জুবায়ের মেয়েকে সাদের হাতে তুলে দেয়। সেঁজুতি চোখ জোড়া ভিজে উঠেছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু আটলো। সেঁজুতি জানে মেয়েকে এমন একজনের হাতে তুলে দিচ্ছে যে তার সবটুকু উজাড় করে আগলে রাখবে। ঠিক যেমনটা জুবায়ের তাকে রেখেছে।
সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে দেখে জুবায়ের মেয়েকে নিজে গাড়িতে তুলে দেয়। গাড়িতে বসার পর থেকে সাজি কান্না জুড়ে দিয়েছে। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে সাজি ,সাদ আড় চোখে সাজির দিকে তাকায়। অনূভুতিরা বদলায়নি ,এখনো সাজিকে কাঁদতে দেখলে নিষিদ্ধ ইচ্ছে গুলো জেকে বসে। সাদ জানে এখন কোনোটাই নিষিদ্ধ নয় কারন রমনীটা তার একান্ত ব্যাক্তিগত। সাদ আলতো করে সাজির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে উল্টো পিঠে চুমু আটলো। কেঁপে উঠলো সাজি, ভেজা চোখ জোড়ায় সাদকে ইশারা করে ,ড্রাইভিং সিটে বসা রায়হানকে দেখালো। সাদ সাজির চোখ মুছে দিতে দিতে বললো,, আগ থেকে বলা আছে। পেছনে ফিরে তাকালে বেতন কাটা যাবে।সাথে তার জন্য বরাদ্দকৃত পাত্রী বাতিল। সে পেছনে ফিরবে না ।
রায়হান ড্রাইভ করতে করতে বললো, বেতন কাটা গেলে যাবে পাত্রী বাতিল ব্যাপারটা মানবো না স্যার। আপনার পর আমার সিরিয়াল।

রায়হানের কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠলো সাদ,সাজিঁ। বাকি পথটা সাদের দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটিতে পাড়ি দিলো ।

শ্বশুর বাড়িতে পা রাখতে না রাখতে নানান রকমের নিয়ম কানুন পালন করায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো সাজি।
আর সবটাই জুবায়েদা খাতুন নিজে বসে থেকে দেখছে। এইদিকে সাদ আসার পর থেকে রিসেপশন নিয়ে ব্যাস্ত। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ছেলে মেয়েরা হই হই করে সময়টা পার করেছে। অনিলা জোর করে সাজিকে খাইয়ে দিয়েছে । আপাতত সে তার দাদির শিয়রে বসে আছে। জুবায়েদা খাতুন স্বামী সংসার নিয়ে নানাবিধ জ্ঞান সাজিকে দিচ্ছে। সাজি লজ্জা মাথা নুইয়ে বসে আছে। সাদ তার সকল কাজের ভার রায়হানকে বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে ফিরলো। অনিলা খাবার বেড়ে সাদকে হাক ডাক শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সাদ সেটার তোয়াক্কা না করেই নানীর পাশ ঘেষে বসে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। জুবায়েদা খাতুন মুখ টিপে হেসে বলল,, কিগো নাতনীর বর!বিয়ে করতে না করতেই বউ মুখো হয়ে গেলে?মা ডাকছে কানে যাচ্ছে না?
জুবায়েদা খাতুনের কথা শুনে সাজি চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। দুটোতে মিলে এখন তাকে লজ্জায় ফেলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সাদ নানীর কাঁধে মাথা রেখে অভিযোগ করে বললো, বউ মুখো আর হতে পারলাম কই? বউ নিয়ে আসার পর একবারও দেখলাম না। তুমি তো বউয়ের পাশ থেকে সরছো না।কি করি বলো তো? আমাদেরও তো একটু প্রাইভেসির দরকার আছে। তোমাদের জন্যই আমার বংশ আগে বাড়বে না নানী।

সাদের কথা শুনে সাজি বার কয়েক মনে মনে আওড়ালো, নির্লজ্জ! নির্লজ্জ!

জুবায়েদা খাতুন মিথ্যা রাগ দেখিয়ে বললো,, দুইদিন পরতো চলেই যাবো তাই তোর বউয়ের আশেপাশে থাকছি। এরপর না হয় প্রাইভেসি নিয়ে বউয়ের আঁচল ধরে পড়ে থাকিস। আমি বাপু একে বারে বাচ্চা কাচ্চার মুখ দেখতে আসবো।

দাদি আর সাদের কথায় সাজি লজ্জা লাল নীল হয়ে গেছে। না পারছে বসে থাকতে না পারছে পালাতে।
নানীর কথা শুনে সাদ আফসোস করে বললো,, তা হবেনা নানীজান। বাচ্চা কাচ্চার আশা করে বসে থেকো না। তোমার নাতনি নিজেই এখনো বাচ্চা।তার চেয়ে বরং তুমি তোমার বাচ্চা নাতনিকে দেখতে এসো।
জুবায়েদা খাতুন ফোড়ন কে*টে বললো,, কিসের বাচ্চা নাতনি! ওর বয়সে তোর মা আমার কোলে ছিলো। আনিস যখন হয় তখন আমার বয়স কেবল ষোলো।
দাদীর কথা শুনে সাজির কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। সাজিঁ হাত মুচড়ামুচড়ি করছে। সাদ বাঁকা হেসে সাজির দিকে তাকিয়ে বলল,, আহা নানী!কেন শুধু শুধু আমার বউটাকে লজ্জায় ফেলছো? বেচারি তাকাতে ওবদি পারছে না।
জুবায়েদা খাতুন মুখ টিপে হেসে উঠে যেতে যেতে বললো,, তোর বউ তুই লজ্জা ভাঙ্গা বাপু। আমার যা শেখানোর তা শিখিয়ে গেলাম।

জুবায়েদা খাতুন উঠে যেতে সাদ সাজির দিকে চেপে বসে বললো, নানী আমার আলাভোলা বউটাকে আর রাখলো না। আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করাচ্ছে বউকে দিয়ে।

জুবায়েদা খাতুন হাসতে হাসতে রুমের দিকে অগ্রসর হলো।

সাদ মুচকি হেসে সাজির হাতে হাত রেখে সুধালো,, চেন্জ করিসনি কেন? কি গরম পড়েছে দেখেছিস?
সাজি আড় চোখে চেয়ে বললো,, দাদি দেয়নি তাই।
সাদ পকেট থেকে চাবির গোছা সাজির হাতে দিয়ে বললো,, কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা রুমে যাবি। ফ্রেশ হয়ে আলমিরা খুলে দেখবি সব রাখা আছে । যা ভালো লাগে তা পরে তবেই রুম থেকে বের হবি।

সাজি বাধ্য মেয়ের মত মাথা নেড়ে উঠে পড়লো।
অনিলা দূর থেকে দুজনের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসছে।সাজি সাদের রুমের দিকে যাচ্ছে দেখে রাজিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,, দেখেছো অনিলা! বিয়ে হয়েছে কতক্ষন,এখনই বরের রুমে চলে যাচ্ছে।
অনিলা বিরক্ত হয়ে বলল,, আমি চাই সাজি সবটা নিজে থেকে বুঝে নিক। ওরা দুজন খুশি থাকলেই হবে। আমার আর কিছু চাই না। ব্যাস তুমি কিছু বলো না।
অনিলার কথা শুনে রাজিয়া মুখ বাঁকিয়ে গটগট করে রুমে চলে গেল।

খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে যায়। যদিও এর জন্য সাদকে মোটা অংকের টাকা দিতে হয়েছে। তবেই বিচ্ছু বাহিনী বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্য দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে।

রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই সাজিঁ সাদের রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দার গ্ৰিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে আকাশী রঙের শাড়ি জড়ানো।হাতে সাদের পরিয়ে দেওয়া আংটি বাদে কোনো গহনা গায়ে জড়ানো নেই। যা আছে সবটাই কাঁচা ফুলের গহনা যা কিছু সময় আগে শেফালী, রশনি আর বিন্দু এসে পরিয়ে দিয়ে গেছে। সাদের দেওয়া আংটি হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগতেই চোখ বুজলো সাজিঁ। খোঁপা থেকে বেরিয়ে আসা অবাধ্য চুল চোখ মুখ ছুয়ে দিচ্ছে বারবার। বিরক্ত হলেও হাত বাড়িয়ে সেই চুল কানের পেছনে গুঁজে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। মৃদু মন্দ বাতাসে ভেপশা গরমে রেশ কেটে গেছে। এইদিকে আকাশে দৃশ্যমান তারা গুলো সব কালো মেঘের আড়ালে লুকালো।হয়তো আজ বৃষ্টি হবে, বছরের প্রথম বৃষ্টি। ধীরে ধীরে বাতাসের বেগ বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে উঠছে শাড়ির আঁচল। সব মিলিয়ে মোহনীয় পরিবেশ।

দরজা খুলে রুমে ঢুকলো সাদ। কাঁচা ফুলের গন্ধ মৌ মৌ করছে চারপাশ। চোখ বুলিয়ে সাজিকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা চালালো কয়েক সেকেন্ড। সামনে যেতে দেখতে পেলো শাড়ির আঁচল। সাদ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সেই দিকে। ঈষৎ আলোয় তার সাজবাতি দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল । সাদের কাছে মনে হচ্ছে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর একটিও হয় না। বছরের প্রথম বৃষ্টি আগ মুহূর্তে ফুলে সজ্জিত প্রেয়সী। সাদ মুচকি হেসে সাজির পেছনে দাঁড়ায়। সাজি চোখ খুললো না, বরং চোখ বন্ধ রেখে সাদের বুকে পিঠ এলিয়ে দেয়। সাদির এমন কাজে শব্দ করে হাসলো সাদ। সে ভেবেছে হয়তো সাজি তার উপস্থিতি টের পায়নি।
সাজি সম্পুর্ন ভার ছেড়ে দিতেই সাদ নিবিড় ভাবে বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে। সাজি মুচকি হেসে বলল,, আপনার উপস্থিতি আমি বুঝতে পারি সাদ‌।
সাজির সম্বোধনে অবাক হয় সাদ। সাজিকে ঘুরিয়ে দুগালে হাত রেখে সুধালো,, কি বললে?
সাজি লজ্জা আড়ষ্ট হয়ে সাদের বুকে মুখ লুকিয়ে মৃদু আওয়াজে পুনরায় বলে উঠলো,, সাদ!
সাদের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি যেন থামছেই না। অপেক্ষা না করে প্রেয়সীকে পাজা কোলে তুলে নিলো। তার সাথে মেতে উঠলো প্রকৃতি। ঝুম বৃষ্টির ছন্দ পতন হচ্ছে চারদিকে।বছরের প্রথম বৃষ্টি সতেজ করে তুলেছে চারপাশ। তার সাথে প্রতিক্ষার প্রহর পেরিয়ে দীর্ঘ রজনীর সূচনা। এই রজনী ভালোবাসার রজনী। দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে একে অপরের কাছে আসার রজনী। এই রজনীতে কেউ নির্ঘুম,কেউ ঘুমে বিভোর,কেউবা ভালোবাসায় আচ্ছন্ন, কেউবা প্রেয়সীর খোঁজে। কারো কাছে দীর্ঘ রজনী,আর কারো কাছে শেষ প্রহর। সাদের কাছে তার প্রেয়সিকে ভালোবাসার চাদরে মোড়ানো বোহু প্রতীক্ষিত দীর্ঘ রজনী।

_________সমাপ্ত________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here