দুঃখগুলো নির্বাসিত হোক পর্ব -১১

#দুঃখগুলো_নির্বাসিত_হোক(১১)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
____________________

শশুর বাড়িতে দুটো দিন থেকে পরদিন মালিহাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো জাওয়াদ। ঈদের আগে একদম ছুটি দিতে চান না অফিস থেকে। নেহাত জাওয়াদের পূর্বের পেন্ডিং ছিল ছুটি তাই তো হঠাৎ চাওয়ায় ছুটি মঞ্জুর হয়েছে।

শশুর বাড়িতে আসার পর থেকে মালিহার পূর্বের সেই রুটিন অনুযায়ী জীবন চলছে। শুধু যুক্ত হয়েছে জাওয়াদের বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসা, যত্নের। প্রথম প্রথম এগুলো মালিহা খুবই আনন্দের সাথে উপভোগ করলেও এখন কেমন যেন বিরক্তি ধরে গেছে। ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে মাঝেমধ্যে জাওয়াদ এমন অদ্ভুত কান্ড করে বসে বিরক্তি আর রাগ না করে থাকা যায় না।

মালিহাকে সারপ্রাইজ দিতে জাওয়াদ নিজে নিজে কেক বানাতে গিয়েছিল কিচেনে। মালিহাকে ঢুকতেই দেয়নি। ঘন্টা দুয়েক পর একটা পোড়া কেক মালিহার সামনে হাজির করেছে। জাওয়াদের মন রক্ষার জন্য একটু মুখে দিয়েছিল। এত তিতা হয়েছে বেচারি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বমি করে ফেলে দিয়েছে। পরে কিচেনে গিয়ে দেখে, ময়দা, চিনি, ক্রিম, দুধ আরও কেক বানানোর যে উপকরণ সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সময় নিয়ে সেগুলো মালিহার পরিষ্কার করা লেগেছে। এখন কথা হচ্ছে, সে যখন পারবে না তাহলে বানাতে কেন গেল? উপকরণ, কেক সবই নষ্ট হলো। আরও হুদাই খাটতে হলো মালিহার। এসব নিয়েই মালিহা প্রচণ্ড বিরক্ত জাওয়াদের উপর। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এমন জঘন্য ভাবে না করলেও চলবে।

শশুর বাড়িতে আসার পর কেটে গিয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ। আজ সকালে অফিসে যাওয়ার আগে জাওয়াদ বলে গিয়েছে তার জন্য সারপ্রাইজ আছে। এখন না, সন্ধ্যায় দেখতে পাবে। সেই থেকে মালিহা সারপ্রাইজের চিন্তাই বিভোর হয়ে আছে। না জানি মানুষটা আবার কোন আকাম করে রাখবে!

বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত জাওয়াদ মালিহাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাইনি। এখন রমজান মাস যখন তখন বেড়িয়ে পড়া যায় না। ইফতার বা সাহরী বাইরে গিয়ে করা যায়। ভালো কোন একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ইফতার করবে বা শপিং করবে এতে মালিহা খুব একটা খুশি হবে বলে মনে হয় না। অন্তত এটুকু জানে জাওয়াদ। ভাবনা চিন্তার মাঝেই দারুণ একখানা বুদ্ধি এসে উপস্থিত হলো মস্তিষ্কে। জাওয়াদ তখনই ফোন দিল প্রাণপ্রিয় বন্ধুর নাম্বারে। অফিস সামলিয়ে ওসব কিছুই আয়োজন করতে পারবে না। অগ‍্যতা বন্ধুর সাহায্য খুবই প্রয়োজন। তাছাড়া বন্ধু আছে কি জন্য যদি অন‍্য বন্ধুর বিপদে না সাহায্য করতে পারে। বন্ধুকে সব বুঝিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হলো জাওয়াদ। অতঃপর নিশ্চিন্তে অফিসের কাজে মনোযোগী হলো।

তিনটার কিছু পরে জাওয়াদ অফিস থেকে ফিরলো। বাড়িতে ফিরে মালিহাকে বলল, “একটু পর রেডি হয়ে থেকো। আমরা বেড়োবো।”

মালিহা কৌতূহলী স্বরে বলল, “কোথায় যাবেন? তাছাড়া রোজা রেখে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। এমনিতেই শরীর ইদানীং খুব ক্লান্ত লাগে।”

জাওয়াদ মালিহার কথা আমলে নিল না। বলল, “ইফতার আজ বাহিরে করবো। কিছু হবে না।”

“বাহিরে করবেন মানে? বাড়ির সবাই কি মনে করবে? তাছাড়া আম্মা যদি রাগ করেন?”

“রাখো তোমার কিছু মনে করা। কি মনে করবে? আমার বউকে আমি নিয়ে যাবো বাহিরে ইফতার করতে। এতে কি হবে? তুমি সবকিছুতে এত প‍্যারা নেও কেন?”

“প‍্যারা নেওয়ার কিছু না। আপনার সাথে গেলাম তারপর সুযোগ বুঝে আপনার মা-বোন আমাকে কথা শুনিয়ে দিবে। এসব আমার ভালো লাগে না। কারো খো’চা কথা একদম সহ‍্য হয় না।”

“চিন্তা করো না। আম্মাকে আমি চিনি। তিনি কিছু বলবেন না। আর রইলো বাকি জাকিয়া! ও কিছু বলে দেখুক ওর কানের নিচে হেলিকপ্টার নামাবো।”

“সামান‍্য বিষয় নিয়ে ভাইবোনের মধ্যে ঝামেলা হোক আমি চাই না।”

মালিহার অবান্তর যুক্তিগ্রাহ্য করলো না জাওয়াদ। রাগী স্বরে বলল, “দেখো ইবনাত, আমাকে রাগীও না। তোমার স্বামী তোমার নিয়ে যাবে। তুমি যাবে। শেষ! এখানে এত কথা আসছে কেন?”

প্রতিত্তোরে মালিহা নিরব রইলো। কিছু বলল না। নিজের বাড়াবাড়ি বুঝতে পারলো। ততক্ষণে জাওয়াদ ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছে।

আসরের নামাজ পড়ে মালিহাকে নিয়ে জাওয়াদ বেড়িয়ে পড়লো। মালিহার কেমন বুক ধুকপুক করছে। কি সারপ্রাইজ এ‍্যারেঞ্জ করেছে লোকটা আল্লাহ্ জানেন।

প্রায় পনেরো মিনিট পরে উপস্থিত হলো কাঙ্খীত গন্তব্যে। রিকশা থেকে নেমে একটা নদী আর নদীর পার ছাড়া মালিহার নজরে কিছু বাধলো না। প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে জাওয়াদের পানে তাকায় সে। জাওয়ার স্ত্রীর চোখের ভাষা পড়তে পারলো। মুচকি হেসে বলল, “এত অধৈর্য হলে চলে? চলো!”

মালিহা কথা না বাড়িয়ে জাওয়াকে স্বরণ করলো।
কয়েক পা বাড়াতে মালিহার চোখে মনোরম এক দৃশ্য ধরা দিল। মুহূর্তেই মন ছুয়ে গেল। বেশ পরিচ্ছন্ন জায়গাটা। নদীর তীরে। সেখানে খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে জাওয়াদের পানে তাকালো মালিহা। চোখ দুটো চকচক করছে মালিহার। জাওয়াদ মালিহার চকচকে দৃষ্টি দেখে বুঝলো তার পছন্দ হয়েছে। নিশ্চিত হলো জাওয়াদ। বলল, “আমরা আজ এখানে ইফতার করবো। পছন্দ হয়েছে?”

“মাশা আল্লাহ্ খুব পছন্দ হয়েছে। এখানে আমরা দুজন শুধু আর কেউ থাকবে না?”

“না। শুধু তুমি আর আমি।”

“এত কিছু কিভাবে ম‍্যানেজ করলেন?”

“সে করেছি একভাবে। তোমাকে ভাবতে হবে না।”

ইফতারের সময় বেশি নেই। জাওয়াদ মালিহাকে নিয়ে বসলো বিছিয়ে রাখা মাদুরে। সামনে খাবারের সব সমাহার।
সূর্য উদয় হওয়া আর অস্ত যাওয়া এই দুটো দৃশ্য নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যর মধ্যে পড়ে। নদীর পাটে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সূর্যের গায়ে যেন কমলা রঙা আবির মাখিয়ে দেওেয়া হয়েছে। সূর্যাস্তের পরে কায়া জুরে নেমে আসবে আধার। মালিহা মুগ্ধ হয়ে সূর্যাস্ত দেখছে। সে ভাবতেও পারেনি এত সুন্দর কিছু সারপ্রাইজ দিবে জাওয়াদ। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালো জাওয়াদের দিকে। অন‍্যদিকে সবকিছু রেখে জাওয়াদ তাকিয়ে আছে তার জীবনের একান্ত সূর্যটার দিকে। যার অনুপস্থতিতে জাওয়াদের গোটা জীবন আধারে ঢেকে যায়। মালিহা নামক সূর্যটার যত গভীরে প্রবেশ করছে ততই যেন ঝলসে যাচ্ছে রমনীর প্রণয়ের অনলে। মনে মনে বলল, “ঝ’ল’সে যাক হৃদয়, পু’ড়ে যাক অন্তর তবু সে আমার থাক। একান্তই আমার।”

আজান হয়ে গেছে। আজ প্রথমবার জাওয়াদ-মালিহা একসাথে ইফতার করছে। কিছু সময় পর মালিহা বলল, “এত সুন্দর একটা সময় উপহার দেওয়ার জন্য কি বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো বলুন তো?”

জাওয়াদ প্রতিত্তোরে মোহনীয় কন্ঠে বলল, “কৃতজ্ঞতা দুরের মানুষকে প্রকাশ করতে হয়। কাছের না। তুমি আমার আপন। একান্তই আমার। শুধু সারাজীবন তোমাকে ভালোবাসার সুযোগ দাও এতে আমি শত খুশি। আমার হৃদয় আঙ্গিনায় ফুল হয়ে এসেছো। তোমার সৌরভে আমার ভগ্ন হৃদয়ের আনাচকানাচে ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে। ভঙ্গুর হৃদয় হয়েছে সজীব। আর কি চাই? থেকে যাও আমার হয়ে। রাগ করো, অভিমান, অভিযোগ যায় করো তাও আমার থেকে দুরে সরে যেয়েও না। ভালোবাসার কোন ডেফিনেশন হয় কিনা জানিনা। কিন্তু তুমি আমার আস্ত ভালোবাসা। পৃথিবীতে ভালোবাসা নামক শব্দটা হয়তো তোমার জন‍্যই আবিষ্কৃত।”

প্রিয় পুরুষের মুখ থেকে এমন সুন্দর কথা শোনার পরে মালিহার কেমন ঘোর লেগে গেছে। ঘোর লাগা কন্ঠে বলল, ”সত‍্যিই?”

“মিথ‍্যার কিছু নেই তো। তবে তুমি চাইলে কৃতজ্ঞতা স্বরুপ এক ডজন বাচ্চার বাবা বানিয়ে দিতে পারো। আমি মাইন্ড করবো না।”

জাওয়াদের দুষ্টামিতে মালিহা নিজেও হেসে ফেলল। নিঃসন্দেহে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম দৃশ্য। হয়তো এমন সুন্দর দৃশ্যে মহান আল্লাহ ও খুশি হয়েছেন।

প্রিয় পুরুষের সাথে মনোরম পরিবেশে রমজানের এই উত্তম সময়ে ইফতার করার সৌভাগ্য কারো হয় কি না জানা নেই। তবে মালিহার হয়েছে।

মালিহা বলল, “জাযাকাল্লাহু খাইরন সোয়ামি।”

প্রতিত্তোরে জাওয়াদ বলল, “ওয়া আনতুম ফা জাযাকিল্লাহু খাইরন বিবিজান।”
__________

মালিহা জাওয়াদের ফোন খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া ধরে না। কি একটা দরকারে ফোনটা হাতে নিল মালিহা। ফোনের ফাইল এ‍্যাপে গিয়ে ফটো ফোল্ডারে গেল। জাওয়াদ ওয়াশরুমে তখন। হঠাৎ একটা ছবিতে মালিহার চোখ আটকে গেল। শ‍্যাম বর্ণের মায়াবী চেহারার এক মেয়ের ছবি। মালিহা জাওয়াদের কাজিন মহলের প্রায় সবাইকে চিনে। কিন্তু এ মেয়েকে সে চিনে না। এমনকি জাওয়াদও কখনও কিছু বলেনি। তবে কে এই মেয়ে? মেয়েটার ছবিটা একদম শেষের দিকে পড়ে আছে। পুরো ফোন না ঘাটলে বোঝাই যাবে না এই ছবিটা কোথাও আছে। এর মধ্যে জাওয়াদ রুমে আসলো। ছবিটা জাওয়াদের সম্মুখে ধরে মালিহা বলল, “কে এই মেয়ে। কি হয় আপনার?”

জাওয়াদের পা দুটো যেন সেখানেই জমে গিয়েছে। মুখটা যেন রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে। আমতা কন্ঠে বলল, ” ও কিছু না। তুমি চিনবে না।”

মালিহার সন্দেহ হলো। পুনরায় বলল, “চিনবো না চিনিই দিলেই হয়। চিনে নিব সমস্যা কি?”

জাওয়াদ পড়লো মহা বিপাকে। কি বলবে সে? সে চাইছিল না ছবির মানুষটার কথা মালিহা জানুক। সম্পর্ক কেবল একটু সুন্দর সুশীল হচ্ছিলো। কিন্তু মালিহা যদি জানে ছবির মেয়েটি কে আদোও সুখ থাকবে তো! আবার যদি চলে যায় মালিহা। নানাবিধ চিন্তাই ফুল ভলিউমে ফ‍্যান চালতে থাকার পরেও জাওয়াদের শরীর বে’য়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। অজানা সঙ্কায় চিনচিন ব‍্যাথা করছে বুক।

এদিকে মালিহা প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। কখন জবাব দিবে জাওয়াদ সেই আশায়।

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here