#দূরে নয় কাছেই আছি!
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃসপ্তম পর্ব
–” এগুলো কেন দিলাম জানেন? বাসর তো হলো না আমাদের, আপনাকে কিছুই দেওয়া হয়নি আমার, তাই আজ এগুলো আপনাকে দিলাম।” শায়োরীর কানে কানে বলতে লাগল আরাফ। কান দুটো ও যেন আজ লজ্জায় মরি মরি করছে। আরাফ যেন আরও লজ্জা বাড়িয়ে দিতে বলে উঠলো–” আজ কি বলেছি মনে আছে?”
শায়োরী চুপ করে আছে। আরাফ তার কানের কাছে গিয়ে বলল –” পাবো কি সেই অনুমতি?”
–” শ্যামাঙ্গিনী!”
–” উমম,”
–” কিছু বলুন,”
শায়োরী সব ভুলে, মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে দিল।
আরাফ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। খুব শান্তি লাগছে তার, কখনোই এই নিষ্পাপ মুখটাকে সে অবিশ্বাস করতে পারবে না। এই মুখের মানবীকে সে মন প্রাণ দিয়ে আগলে রাখবে।
শায়োরীর বান্ধবীরা এসেছিল সকালবেলা দেখা করতে ওদের মধ্যে নূপুর সবচেয়ে ঘনিষ্ট শায়োরীর। শায়োরী রান্নার কাজে ব্যাস্ত ছিল, তাই খুব একটা কথা বলতে পারেনি। নূপুর বলতে শুরু করল, —
–“জানেন ভাইয়া শায়োরী ছিল আমার বান্ধবী কম বোন বেশি, মেয়েটার মা যখন মারা যায় তখন তার বয়স মাত্র চার বছর। পাড়াপ্রতিবেশি আর ওর দাদুর চাপে পরে বিয়ে করেন ওর বাবা। দাদু ওকে দেখে রাখত সবসময়।
যত দিন দাদু ছিল, ওর মাথার উপর একটা ছায়া ছিল ঠিক বটগাছের ছায়ার মত, দাদু যত দিন ছিল তিনি নিজ হাতে সব সামলিয়ে ছিলেন, শায়োরীকে মায়ের আদর না হোক তাকে আগলে রেখে মমতার স্পর্শ দিয়েছিলেন।
দাদু মারা যাওয়ার পর মেয়েটা একা হয়ে পরে।
যে বয়সটা মেয়েটার আর পাচঁটা মেয়ের মত বাল্যকালের উন্মাদনা নিয়ে বেড়ে উঠার কথা, এদিক ওদিক ছুটে বেড়ানোর কথা সেই বয়সে মেয়েটির পায়ে পরিয়ে দেওয়া হলো শেকল! অদৃশ্য শেকল! বন্দি শালার পাখির মত শায়োরীর জীবন টা বন্দি হয়েগেল শেকল বন্দি! বাবা ও কেমন পর হয়েগেল, নারীর মায়ায় আর কায়ায় বন্দি হয়ে বাবা নামক ব্যাক্তিটি হয়েগেল একদম অচেনা, খেয়ে না খেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ঘরের কাজ সামলিয়ে উঠতে উঠতে বালিকা শায়োরী হঠাৎ করে হয়েগেল কিশোরী শায়োরী, শায়োরীর জীবনটা কিশোরী বয়সের মধ্যে ঝড়ে আগেই ঝরে গিয়েছিল। সেখানে এসে আরও এক দমকা হাওয়ার মত প্রবেশ করল আবির নামক আরও এক হিংস্র সংকেত, আতঙ্ক ! প্রবল আতঙ্কে মেয়েটা সবসময়ই নেতিয়ে পরত। আবির শায়োরীর ক্ষতি তো কখনোই চাইতো না। তবে সে শায়োরীর খুব কাছের কেউ ছিল না। মানি শায়োরী তাকে খুব একটা পছন্দ করত না, আবির তাকে সব সময় নিজের করে চাইতো, যা ছিল একদম জোর করেই।”
আরাফ মন দিয়ে শুনতে লাগল, নূপুরের কথা গুলোও খুব গুছানো, নূপুর বলতে লাগল-
–” শায়োরী খুব সরল ভাইয়া, এতটাই সরল আর খাটি যে ওর মাঝে আপনি কোন খুত পাবেন না। ভাববেন না
যে বান্ধবী বলে আমি ওর প্রশংসা করছি, তা ভাবলে একদম ভুল ভাবছেন আপনি। ”
আরাফ নূপুরের কথাগুলো শুনছিল আর ভাবছিল। শুধু শুধু মেয়েটাকে সে ভুল ভাবছিল। এবার সে ভেবেনিল শায়োরীকে সে যোগ্য সম্মান দিবে। মেয়েটার জীবনকে সে সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিবে, আগলে রাখবে তাকে।
___________________________________
ঘুমন্ত শায়োরীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আরাফ ভাবতে লাগল। নূপুর কে ধন্যবাদ দিবে, নূপুর যদি তাকে
সব না বলতো, হয়তো সে এই গোলক ধাধায় আটকে থাকতো, কতটা সময় নষ্ট হতো, এত মিষ্টি একটা প্রহর হাত ছাড়া হয়েযেত। কত মধুর আলাপন, কত মধুর স্মৃতির কথনগুলোর আড়ালে পরে থাকতো দুজনের কত ভুল বুঝাবুঝির স্মৃতি, পাশাপাশি দিনের পর দিন একসাথে থেকেও দুজনের মনে রয়েযেত সংকোচ আর ভয়। সেই জায়গায় নূপুর সেই সব সমস্যা গুলোকে এক নিমিষেই সমাধান করে দিয়েছে। শায়োরীর হাত গুলোকে ধরে একটা চুমু দিয়ে বুকের মধ্যে আগলে রাখল।
ঘুমন্ত শায়োরী নেড়েচেড়ে শুয়ে পরল, আরাফের স্পর্শ পেতেই দূরে সরে যেতে চাইলে, আরাফ তাকে আরও কাছে টেনে আনল।
খুব সকালে সূর্য স্নানে বসেছে শায়োরী, আশপাশ ভালো করে চেয়ে মাথার ঘোমটা টা ফেলতেই, খোপা করা চুল গুলো কোমরে গিয়ে পরল। নতুন বউ, নাকফুল টা চকচক করে উঠছে, মুখে তার স্নিগ্ধতা যেন আরও ফুটে উঠেছে। চুল গুলোকে নেড়েচেড়ে বসেই দেখল আরাফ এইদিক টায় আসছে। শায়োরী মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিল। আরাফকে দেখলেই তার লজ্জা করে ভিষণ রকমের লজ্জা, কি করে মুখ দেখায় মানুষটাকে?
লজ্জায় নেতিয়ে পরা মুখটাকে আর লজ্জায় ফেলতে চায় না তাই, উঠে চলেগেল ঘরে।
ঘরে আসতেই, আরাফ ও এসেগেছে তার পিছু পিছু।
আরাফকে দেখে মনে মনে ভাবলো। পালাই পালাই করে কি লাভ হলো? সেই তো আবার সামনে পরতেই হলো।
শায়োরী বিছানায় বসাছিল। আরাফ তার সামনে এসে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে বলল –
–” আম্মা কথা বলবে তোমার সাথে!”
–“আম্মা কথা বলবে? আচ্ছা দিন!”
–” মাইর দিব ” শায়োরী বুঝতে পারল না কেন এই কথাটা বলল। সে শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
শাশুড়ি মা তার শাশুড়ি থেকেও মায়ের স্থান গড়ে নিয়েছেন। শায়োরীকে বলেদিলেন আরাফ আর শায়োরী যেন খুব তারাতারি চলে আসে। খালি ঘর তার ভালো লাগে না পূত্রবধু আর পূত্র ছাড়া বাড়ি তার বিরাণ।
পূত্র তার দূরে থাকলে বুক তার পুড়ায়, পূত্র কি সে কথা বুঝে? পূত্রবধু ও তো এখন চোখের মণি! চোখ থেকে আড়াল হলেই সারাদিন তার মাটি হয়ে যায়। শাশুড়ির সব কথা মন দিয়ে শুনে রাখতেই। আরাফ তার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে তার সামনে বসিয়ে দিয়ে বলল –
–” কাল কি বলেছিলেন?”
–” কি বলেছিলাম?”
—” মনে নেই? আপনার?”
–” আবার আপনি আপনি সমন্ধ করছেন?”
–” আপনি ও করছেন! কাল বলেছিলেন আমি আপনি করে বললে মনে হয় আপনাকে আমি গরুজনের সম্মান দিচ্ছি! এখন নিজেই আবার আমাকে আপনি সমন্ধ করছেন!
—” মনে নেই, সর্যি আর হবে না!”
–” আর হবে নাতো?”
–” না,”
–” মা কি বলল?”
–” মা বলেছে ঢাকায় যেন খুব তারাতারি চলে যাই দুজনে মিলে।”
–” জানতাম!”
–” চলুন, সর্যি চলো, ঢাকায় চলে যাই আম্মা খুব টেনশন করেন আমাদের নিয়ে। ”
আরাফ শায়োরীকে কাছে টেনে বুকের কাছে ধরে বলল-
–” যাবো আমরা, আজই সন্ধ্যায়!”
–” সন্ধ্যায় না! রাস্তা গুলো ভালো না, সকালবেলায় দুজন মিলে চলে যাবো সেদিনের মত এটাই ভালো হবে। ”
–” বিয়ের দিন সন্ধ্যায় যখন যাচ্ছিলে তখন ভয় লাগেনি?”
–” তখনকার বিষয়টা অন্যরকম ছিল, আজ আপনি যাবেন না! যদি রওনা দিতে চান না আপনার খবর আছে বলে দিলাম।”
–” কি খবর করবে? মানে আমাকে নিয়ে নিউজ করবে?
কোন টেলিভিশনের নিউজ রিপোর্টার তুমি? ও মাই গোড! ছদ্মবেশী সাংবাদিক তুমি?”
–” উফফ এত মজা করেন কেন আপনি?”
–” মজা কোথায়?খবর করলে বললে তাই বললাম,খবর তো টেলিভিশনে পাঠ করা হয়! আর এখন বারবার যে আপনি করছো আমিও তোমার মত খবর করতাম তবে সেটা তো টেলিভিশনে দেওয়া যাবে না। সিক্রেট, সিক্রেট!
–“অসভ্য লোক!”বলেই শায়োরী আরাফকে ধাক্কা দিয়ে চলেগেল বাইরে। আরাফ সেই দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। গুমরে থাকা মেয়েটি একটু একটু করে চঞ্চলা হয়ে উঠছে, আগের সেই গুমোট প্রকৃতির ভাব এখন কিছুটা কমেছে মেয়েটার মধ্যে থেকে।
এ যেন মরা ডালে নতুন কুড়ি আর পাতার আবির্ভাব!
নতুন প্রাণের সঞ্চার ও যেন হয়েগেল মেয়েটার মধ্যে।
চলবে।