দূর আলাপন
পর্ব-১০
অদ্রিজা আহসান
_______________
রাত্রির পর দিনের আগমনের যে স্বাভাবিকতা, নিনাদের জীবন এখন সেই নিয়মে বাঁধা। নিগূঢ় আঁধারের রাত্রি গুলো কেটে যায়, ফের দিন আসে। নিনাদ খায়, দায়, ভার্সিটি যায়। সবকিছু চলছে আগের মত। তবে পরিবর্তনও কিছু এসেছে নিনাদের। নিসঙ্গতায় বোঝা যায় লোকসমাগমের মাহাত্ম্য। নিনাদও ঠিক তেমনি এখানে একা পড়ে, ভালোবাসাহীন হয়ে বুঝেছে অনুরাগের মূল্য কত। নিনাদ এখন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, সময় পেলেই বসে কুরআন নিয়ে। যে মরিচীকার পেছনে সে ছুটেছে চিরকাল, তার নাগাল সে পায়নি কোনদিন। অথচ কোরআন শান্তির বাণী নিয়ে কত কাছে ছিল সমসময়, সেদিকে তাকানোর সময় বা ইচ্ছা কোনদিন তার হয়নি। যদিও জানত সবাই ছেড়ে গেলেও এই আনকোরা ভাঙা ভাঙা সুরে, ভুলে ভরা উচ্চারণে করা তার তিলাওয়াত কখনো বৃথা যাবে না।
আজকাল কাজ ছাড়া নিনাদ ঘরের বাইরে পা বাড়াতে চায় না একটুও। নিজের ঘরে একা বসে থাকে চুপচাপ। কি করবে যেন সে ভেবেই পায় না। তার এই অদ্ভুত আচরন দেখে বাকিরা অবাক হয়। প্রথম প্রথম এখানে আসার পর, কি রেখে কি করবে, কোন জায়গা ছেড়ে কোন জায়গায় যাবে সেসব ভেবেই অস্থির থাকে সবাই। অথচ নিনাদের যেন শুরু থেকেই কোন কিছুতেই কোন আগ্রহ নেই। সে যেন আমেরিকা নামক বন্দী জেলখানায় বছরের পর বছর অবরুদ্ধ থেকে ভীষণ ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছে। একটুখানি বাইরের আলো বাতাসের জন্য তার ভেতর যেন হাঁসফাঁস করছে সবসময়।
আজও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সবাই যখন সাজগোজ জুড়ে দিল বাইরে যাওয়ার জন্য, তখনো নিনাদ বসে রইল চুপচাপ। জিগ্যেস করলে জানাল শরীর ভালো লাগছে না তার। অবশেষে তাকে রেখেই বিকেলে বেরিয়ে যায় সবাই। নিনাদ একটু একা হতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচে যেন।
জানালার পর্দা সরিয়ে নিনাদ বাইরে তাকায়। রাস্তা দিয়ে সা সা করে একের পর এক গাড়ি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলেছে। গুড স্ট্রিটের ইতস্তত ছড়ানো বাড়ি গুলোয় সন্ধ্যেতেই যেন মাঝরাত্রির নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কোনো আওয়াজ নেই, কারো বাড়ির আঙ্গিনায় কোন মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। নিনাদ সেদিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। সঙ্গোপনে ফেলে দীর্ঘ নিশ্বাস। এত একা কেন সে?
আজ চার মাস হতে চলল তিহা বা তার পরিবারের কারো সাথেই যোগাযোগ নেই তার। প্রথম ছ’মাস সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কথা হত নিয়মিত তিহা, ছোটন আর রওশানের সাথে। তারপর হঠাৎ একদিন তিহার কল এল। ছোট বাচ্চাদের বড়রা যেভাবে ভোলাতে চায়, ছলনা করে বোঝাতে চায় যে “তাদের চাহিদার বস্তুটি দূর আকাশের চাঁদ। নাগাল পাওয়া যার অসম্ভব। অতএব তা পাওয়ার বাসনা তাকে ছাড়তে হবে।” ঠিক সেভাবেই সেদিন তিহাও তাকে কিছু একটা বোঝাল।
জানালার কাছ থেকে সরে নিনাদ আলমিরার সামনে এসে দাঁড়ায়। আলমিরা খুলে খুব সন্তর্পণে বের করে কিছু একটা। একটা রেপারে মোড়ানো প্যাকেট। প্যাকেট হাতে নিয়ে সে বিছানায় এসে বসে। জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে থাকে প্যাকেট টার দিকে। এই নিয়ে বোধহয় একশবারের বেশি খুলেছে সে এই প্যাকেট টা। পুরোনো হয়ে গিয়ে কেমন ছোপ ছোপ দাগ বসে গেছে তাতে। ছিড়ে গেছে নানা অংশ । তবুও যেন প্রতিবার একই রকম উত্তেজনা অনুভব করে সে প্যাকেট টা খোলার সময়।
একটা গাঢ় সবুজ জায়নামাজ, খুব সুন্দর কাঠের একটা তসবিহ্ আর অনুবাদ সহ একটা কুরআন শরীফ।
একে একে সবগুল বের করে নিনাদ। নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শুকে দেখে। মুহুর্তেই ওহিও’র গুড স্ট্রিটের একটি বাড়ির এক নিভৃত অন্ধকার ঘরে বসে থেকেও সে যেন ফিরে যায় বাংলাদেশে, তার ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোতে। তখন যা ছিল অতি তুচ্ছ, হয়তো যা কিছুই ছিল না। এখন যেন তা-ই নিনাদের কাছে এক সমুদ্র দুঃখের মাঝে হয়ে ওঠে এক পশলা সুখের মতন। অতীতের একই কিছু স্মৃতি আজ কেবলই অনুরণনের মত বারবার বেজে যায় তার কানে।
এটুকুই তিতিক্ষার শেষ স্মৃতি চিহ্ন হিশেবে রয়ে গেছে তার কাছে। আর কিছুই নেই। নতুন করে কোন স্মৃতি জমানোর সুযোগও নেই। তিতিক্ষাকে আর কোনোদিন ছোট গিন্নি বলে ডাকতে সে পারবে না। তিতিক্ষার বিয়ে হয়ে গেছে!
এই কথাটা জানাতেই তিহা তাকে কল করেছিল সেদিন। বিয়ের তখনো তিনদিন বাকি। তারপর আর কথা হয়নি তাদের কারো সাথে। নিজে থেকেই তারপর সে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। নিনাদকে তিহা বুঝিয়েছিল সেদিন, তিতিক্ষা কোনদিন তাকে চায়নি। সে ভীষণ স্বাধীনচেতা মেয়ে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কাজ সে করবে না কখনো। নিনাদকে সে শুরু থেকেই অপছন্দ করে। বিয়ে করার তো প্রশ্নই আসে না।
কথাগুলো শুনে নিনাদ সেদিন খুব শান্ত হয়ে গিয়েছিল। এতটা শান্ত যে আর কোনো কথা বলারই শক্তি রইল না তার। তবুও শুনতে হয়। সে শুনল তিতিক্ষার যে বর, সে নাকি মস্ত বিজ্ঞ ব্যাক্তি। দশ এলাকার ছেলেদের আদর্শ। কলেজের প্রফেসর। নিনাদ হাসল। ভালোই হয়েছে। তিতিক্ষা এমন বর ই তো চেয়েছিল। সে তবে সুখে থাকুক।
____________________
শ্রাবণ পেরিয়েছে সেই কবে। এখন বৈশাখ। চারিদিকে শুধু কাঠফাটা রোদ্দুরের উষ্ণ রেশ। খাঁ খাঁ দুপুরে, শেষ বসন্তের কোকিলের ডাক এখনো শোনা যায়। ডাকতে ডাকতে কোকিল গুলো ক্লান্ত হয়ে পড়ে। থেমে যায় তাদের সুর। তৃষ্ণায় শুষ্ক হয়ে ওঠে ওদের ঠোঁট। এই কাঠফাটা রোদে কোকিলের ডাকে, আকাশের বুক চিরে মাঝে মাঝে ধূসর মেঘও উঁকি দেয়। ব্যাস্ত জনজীবনে কারো সেসব খেয়ালের সময় নেই। একমাত্র যারা এসব খেয়াল করে নিসন্দেহে তারা নিতান্ত অকর্মা নাহয় বিরহে কাতর নিষ্প্রভ প্রাণ। সেজন্যই প্রকৃতির খেয়ালে আজ হঠাৎ বড় নজর পড়েছে তাদের।
ঘরের ঝকঝকে সাদা মেঝেতে একটা নিস্পন্দ বস্তু পড়ে আছে। জানালার পাতলা সফেদ পর্দাগুলো স্থির থাকছে না এক মুহূর্ত। সমুদ্র তরঙ্গের ন্যায় তারা ওঠা নামা করছে অবিরত। বারান্দার দরজাটা হাট করে খোলা। সেদিক দিয়ে শ্রান্ত বৈশাখ দুপুরের শুষ্ক রূপ ভীষণ ভাবে চোখে পড়ে। বাইরে থেকে কেউ খুব ক্ষীণ স্বরে ডাকছে। খানিকটা ভয়, স্নেহ আর কত দরদ মেশানো সে ডাক। মেঝেতে পড়ে থাকা বস্তুটি হঠাৎ একটু নড়েচড়ে ওঠে। তখন বোঝা যায় সেটা কোনো বস্তু নয়, একটা মানুষ। মরে গিয়েও বেঁচে থাকা জীবন্ত একটি প্রাণ!
তিহা আবার ডাকে। ধীরে ধীরে ভীষণ যত্নে সে উচ্চারণ করে, ‘তিতি, দরজা খোল তিতি!’
এদিকে কোন সারা নেই। বস্তু রুপী সেই প্রাণটি ওভাবেই পড়ে থাকে। তার কোন তাড়া নেই, কোন আকাঙ্ক্ষা নেই, নেই কোন কৌতূহল। সে তখনো একদৃষ্টে চেয়ে আছে উজ্জ্বল সাদা নীল ওই আকাশের পানে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ বুজে আসতে চায়, চারপাশ সব আঁধার ঠেকে। তবুও সে চেয়ে থাকে উদ্দেশ্যহীন ওই গন্তব্যে।
দরজার বাইরে গলার আওয়াজ একসময় জোড়ালো হয়, তারপর আবার নিভে যায়। হতাশ হয়ে থেমে যায় সেই কণ্ঠস্বর। চলে যায় দরজা ছেড়ে।
তিতিক্ষা দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নেয়। সময় হয়েছে তার একান্ত এবং একমাত্র প্রিয়জনের সাথে কথা বলার। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। ওযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে নামাজে। আধঘন্টা, একঘন্টা, দেড়ঘন্টা….. সময় পেরিয়ে যায়। তিতিক্ষা নামাজ পড়তে থাকে। সিজদায় গিয়ে উঠতে আর তার মন চায় না। সে চুপচাপ পড়ে থাকে সিজদায়। মুখে কোন রা নেই, চোখ বেয়ে শুধু পানি পড়তে থাকে ফোঁটায় ফোঁটায়। যিনি মনের সব কথা জানেন, তার কাছে কয়েকটা এলোমেলো শব্দ উচ্চারণের কিইবা প্রয়োজন?
সে ঘরের সামনে থেকে মলিন মুখে ফিরে আসে তিহা। মারুফ সাহেব তাকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ান। মেয়ের ফিরে আসার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। অসহায় মুখে নিচু স্বরে কথা বলেন মারুফ সাহেব , ‘তিতি দরজা খুলেছে? খেয়েছে কিছু? কি কথা বলল?’
তিহা মলিন হাসে।’আজকের দিন কি অন্য দিন থেকে আলাদা বাবা? যে ও কথা বলবে? আর কথা বলবে কিভাবে? দরজাই তো খোলে নি।’
মারুফ সাহেবের মলিন মুখ আরও ম্লান হয়ে আসে। ‘আচ্ছা, আমি যাই, ছোটদাদুকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি। ও এলে যদি সে কথা বলে… ‘
তিহা উত্তরে নিশ্চুপ থাকে। রোজ রোজই তো ছোটনকে ওঘরে পাঠাচ্ছে সে। লাভ একদিনও হয়নি এপর্যন্ত।
ছোটন ফিরে এলে তার পোশাক বদলে, তাকে খাইয়ে আজও তিহা ফের ওঘরে পাঠায়। নানান কথা শিখিয়ে পড়িয়ে বুঝিয়ে দেয় তাকে কি করতে হবে। ওইঘরে যাওয়ার নাম শুনলেই ভয়ে মুখ শুকিয়ে আসে ছোটনের। তিতিক্ষা কে সে আজকাল বাঘের মত ভয় পায়। তবুও সে যায়। সেই যে একটা সময় ছিল, যখন মিমি তাকে খুব ভালোবাসতো, রাতদিন তারা দুজন একসাথে কাটাত, কত হাসি, কত দুষ্টুমি..। সেসব দিনের কথা মনে করেই সে ওই ঘরে, মিমির কাছে একা যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে।
একমাত্র ছোটন ডাকলেই ওই ঘরের অবরুদ্ধ দরজা আর রুদ্ধ থাকতে পারে না। তিতিক্ষা দরজা খুলে আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে। তা দেখে ছোটন দমে যায়। মায়ের শেখানো কথাগুলো একে একে ভুলে যেতে থাকে। তারপর কাছে গিয়ে বসে নিজের মনেই নানান এলোমেলো কথা সে তিতিক্ষাকে বলে।
-‘জানো মিমি, স্কুলে রাকা নামে আমার যে বান্ধুবিটা আছে? আজ ও পরে গেছিল মাঠে, সবার সামনে, হো হো করে সবার সে কি হাসি… রাকা খুব কাঁদছিল তখন।’
তিতিক্ষা তখন হঠাৎ ভীষণ গম্ভীর হয়ে ওঠে। চোখ বড় বড় করে ছোটনের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ স্বরে বলে,’ তুমি কি করলে তখন? তুমিও হাসছিলে সবার সাথে, না? ‘
ছোটনের চোখ দুটো ভীত হয়ে ওঠে। সে নিচু স্বরে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘ ও তো আমার বন্ধু। আমারও কান্না পাচ্ছিল তখন। তাই আমি…..আমি ওকে টেনে তুলেছি।’
তিতিক্ষার বাঁকানো ভ্রু জোড়া আস্তে আস্তে আবার সরল হয়ে আসে। হঠাৎ সে ছোটনকে কাছে টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে। ‘
বিরবির করে কিসব বলতে বলতে, নাক টেনে টেনে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে। কি করুণ শোনায় তখন তার কান্না। ছোটন কিছুই বুঝতে পারে না। তার ভয় কেবল বাড়তে থাকে। মনে হয় দম আটকে মারা যাবে সে। কিন্তু তিতিক্ষা তাকে ছাড়ে না। তার সে খেয়ালই নেই। সে ছোটন কে ওভাবেই জাপটে ধরে বসে থাকে। বারবার বলতে থাকে, ‘তুমি কক্ষনো ওদের মত হয়ো না। ওরা খুব বাজে। কেউ কাঁদলে তুমি তা দেখে কক্ষনো হেসো না। খুব কষ্ট হয়। কাঁদলে যখন কেউ হাসে। তখন আমার খুব কষ্ট হয়। শ্বাস আটকে আসে, নিশ্বাস নিতে পারি না আমি। আমি কাঁদলে আর তুমি হেসো না।’
তিহা দরজার বাইরে আড়াল থেকে ভীত চোখে ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু বইতে থাকে। কেন এমন হল! এত বড় কলঙ্ক কেন ঘটল তার নিষ্পাপ বোনের জীবনে? আজ এভাবে ধুঁকে ধুঁকে তাকে মরতে দেখেও সে কেন এত নিরুপায়? আর কখনো কি তিতিক্ষা হাসবে না? তার খিলখিল হাসির কলরবে কখনো কি আর মুখর হবে না এই ঘর? সে কি তবে এভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে সমাপ্তির দিকে?
একসময় কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত তিতিক্ষার হাত আলগা হয়ে আসে। প্রথম সুযোগেই ছোটন দৌড়ে পালায়। তিতিক্ষা ওভাবেই বসে রয়। অনবরত বিরবির করে বলতে থাকে, ‘আমি যখন কাঁদি, তুমি তখন হেসো না। আমার খুব কষ্ট হয়।’
চলবে…….