#দূর_আলাপন
পর্ব-১৩
অদ্রিজা আশয়ারী
_____________
আফরিন তিতিক্ষার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল। এই অসময়েও ঘরের দরজাটা ভিড়ানো। হঠাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারল না সে। ইতস্তত করতে লাগল। তারপর খানিক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে নিরুপায় হয়ে বেশ শব্দ করেই দরজাটা খুলে আস্তে আস্তে সে পা বাড়াল ভেতরে।
মাগরিবের সালাত শেষে তিতিক্ষা শুয়ে ছিল বিছানায়। আজ বহুদিন পর সে বিছানায় এসে শুয়েছে। নাহয় এই কয়েক মাস যাবৎ ওই সফেদ ঠান্ডা মেঝেই ছিল ওর বিছানা। তার শরীর গরম, গায়ে হালকা জ্বর। তিহার অনেক চেঁচামেচি আর নিষেধের পর তাই আজ তাকে শুতে হয়েছে বিছানায় এসে।
দেয়ালের দিকে মুখ করে চোখ বুজে শুয়েছিল তিতিক্ষা। তার বাম চোখ বেয়ে ক্রমাগত পানি পড়ে যাচ্ছে। সবসময়ই হয় এমনটা। আজকাল কারণ ছাড়াই চোখ তার ভেজা থাকে সবসময়। ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সন্তর্পণে সে ডান হাতের তর্জনী দ্বারা মুছে নিল চোখের জলটুকু। তারপর পাশ ফিরে শুল। তাকিয়ে দেখল আফরিন কেমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি কিছুটা ভীত। তিতিক্ষা সহসা মিষ্টি করে হাসল। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ এসো আফরিন। এখানে এসে বসো।’
আফরিন কলের পুতুলের মত এসে বসল সিথানে, তিতিক্ষার মাথার কাছে। তিহার মুখে তিতিক্ষার অসুস্থতার কথা শুনে সে একাই এসেছিল তিতিক্ষার ঘরে তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু অসুস্থতাটা ঠিক কি, সে তার জানা ছিল না। এবং অসুস্থতা যাই হোক, সে নিয়ে তার ভাবনাও ছিল না। কিন্তু তিতিক্ষার ঘরে এসেই সে একটা ধাক্কা খেল। এসেই তার মনে হল কি যেন একটা বড় ব্যাপার ঘটে গেছে। যেন এক ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে সবকিছু। নাহয় তিতিক্ষা আর তার এই ঘর তো এমন ছিল না আগে। এত বদলালো কি করে? পুর ঘর জুড়ে কেবল ওই কালো, পুরনো দিনের উঁচু পালঙ্কটা, একটা ওয়ারড্রব আর একটা বইয়ের তাক। তাছাড়া ছিল একটা ড্রেসিং টেবিল। সেদিন কাঁচ ভেঙে ফেলার পর সরিয়ে নেয়া হয়েছে সেটা। আগের সেই স্নিগ্ধ ভাবটাও আর নেই ঘরে। গুমোট পরিবেশ। আবহাওয়া টা এমন, যেন এখানে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে সবসময়। আফরিনের সম্বিৎ ফিরল হাতে তিতিক্ষার স্পর্শ পেয়ে।
তিতিক্ষা তার রেশমি চুড়ি পড়া রাঙা হাতে নিজের ফ্যাকাসে সাদা ছুঁইয়ে শীতল স্বরে জিগ্যেস করল, ‘কেমন আছো?’
অস্বস্তি নিয়ে মৃদু হাসল আফরিন। নিচু স্বরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ভালো। আপনি?’
এইবার তিতিক্ষাও মৃদু হাসল। আসলেই তো! কেমন আছে সে? নিজেরও তো জানা নেই। তবে যেমনই থাকুক, এর চেয়েও কি করুণ হতে পারত না তার অবস্থা? ক’জনই বা তার মত শুয়ে বসে এভাবেই নিজের ভীষণ দুঃখে, তার বিলাস করতে পারে নিশ্চিন্তে? সেই অবসর টুকুও তো জোটে না সবার কপালে। তবে সে কিভাবে বলে যে সে ভালো নেই? এত বড় অকৃতজ্ঞতা তো সে করতে পারে না আল্লাহর সাথে। তিতিক্ষা মনে মনে শুকরিয়া গুজার করে আল্লাহ তায়ালার কাছে। তারপর মুখে বলে, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
বলে সে চুপ হয়ে যায় স্বভাবমত। অন্যমনস্ক হয়ে কিসব ভাবতে শুরু করে কপালে ঈষৎ ভাজ ফেলে। পাশে বসে থাকা আফরিনের কথা আর খেয়াল থাকে না তার।
আফরিন আড়চোখে তাকিয়ে দেখে তিতিক্ষা কে। তার কিশোরী মন ছটফট করে কথা বলার জন্য। সে ভেবেছিল আজ তিতিক্ষার সাথে খুব জমিয়ে তার বিয়ের গল্পটা করবে। মিনহাজের সাথে তার বিয়েটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে পুরো গ্রাম জুড়ে। তার সৎ মায়ের ধারণা ছিল শেষ অবধি কোনো এক দিন খাটা কামলা মজুরের ঘাড়ে ঝুলতে হবে আফরিনকে। গ্রাম বাসিরও তাই ধারণা। কিন্তু সৎ মায়ের এবং পুরো গ্রাম বাসির ধারণার মুখে ছাই দিয়ে আফরিন বিয়ে করেছে এক বিদেশ ফেরত শহুরে ছেলেকে। মিনহাজের জন্ম গ্রামে হলেও সে শহরেই মানুষ। সিঙ্গাপুরে গিয়েও ছিল সেখানে বেশ কিছুদিন। তারপর আবার দেশে ফিরে ব্যাবসায় ঢুকেছে।
গ্রামের অনেক ছেলের সাথেই প্রেম প্রেম খেলা চলত আফরিনের। সৎমায়ের এত অত্যাচার আর সবার কাছে পাওয়া মাত্রাতিত অবহেলার মাঝে এভাবেই নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছিল সে। তার মায়াবী মুখশ্রী আর মোহনীয় চোখের ওই কটাক্ষ দেখে অনেক ছেলেই পাগলপারা হত। আফরিনও তাদের দূর্বলতা টের পেয়ে সুযোগের সৎ ব্যাবহার করত। তার যাবতীয় প্রসাধনী ও বিলাসিতার খরচ যুগতো তার সেই মিথ্যে প্রেমের সত্যিকারের প্রেমিক গুলোর থেকেই!
এভাবে মিনহাজকেও জালে আটকেছিল সে। কিন্তু একসময় দেখা গেল মিনহাজের চেয়েও বড় জালে সে নিজে আটকা পড়েছে। ফাঁদ না পেতেও মিনহাজ তার মন হরণ করে নিয়েছে। তারপর আফরিন আর খেলা নয়, বুঝল সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে সে মিনহাজকে। মিনহাজ কালো, দেখতে অসুন্দর এবং মা হারা। বাবা তার আরেকটা বিয়ে করেছে। গ্রামে থাকা তাই তার আর চলে না। ইতোমধ্যে ব্যাবসা করে ভালো উন্নতি করেছে সে। ঢাকায় নিজের বাড়িও নিয়েছে। তখন পুরো গ্রামকে অবাক করে দিয়ে বিয়ে হল আফরিন আর মিনহাজের। গ্রামের অনেক মেয়ের বাবারই আশাভঙ্গ হল।
আফরিন ভেবেছিল আজ মিনহাজের মাথা খাওয়ার সেই বিস্ময়কর ইতিহাস টা আগাগোড়া সে বলে শোনাবে তিতিক্ষা কে। কিন্তু তিতিক্ষার দিক থেকে কোন সারা পাওয়া গেল না আর। আফরিন তখন শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে চেয়ে দেখতে লাগল তিতিক্ষাকে।
ভীষণ সাদা ফ্যাকাসে মুখের ওপর এখানে সেখানে লাল লাল আঁচড়। অবগুণ্ঠিত মাথার লম্বা খোলা চুল পাশের বালিশের ওপর এলানো। তার কিছু অংশ এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে মুখের ওপর। চোখের ওপর-নিচে গাঢ় বাদামি রেখা আর ঠোঁট জোড়া ভয়ানক লাল। যেন লিপস্টিক মাখানো। তার পড়নে হালকা ধূসর রঙা একটা সুতির কুর্তি। জামার রঙ যেন মিশে গেছে তার শরীরের রঙে। যেন এক আসমানী পরী শুয়ে আছে, ভীষণ দুঃখে ক্লান্ত যার মন, মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদাস যার দৃষ্টি। আফরিনের চোখ ধাধিয়ে যায় সেই বন্দিনী অভিশপ্ত আসমানী পরীর দিকে চেয়ে।
তিতিক্ষা তখন সামনের দেয়ালে একদৃষ্টে তাকিয়ে অনবরত বিরবির করে চলেছে নানান কথা।
আফরিনের চোখে বিস্ময়। কি হয়েছে তিতিক্ষার? সে যে স্বাভাবিক নেই তা বুঝতে বাকি নেই তার। কিন্তু এত বদলে গেল কি করে মেয়েটা? কোনো বড় অসুখ করেছে কি তার? তিহা কি তবে তাকে জানাতে চাইছে না সেসব? আফরিন আনমনেই হাত দেয় তিতিক্ষার কপালে। সাথে সাথে চমকে ওঠে সে। তিতিক্ষার গায়ে ভীষণ জ্বর। আফরিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
নিনাদের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। গত ছ’দিনে অসংখ্য বার কল করেছেন শিউলি বেগম। ওপাশ থেকে জবাব আসে নি একবারও। সেই নিয়ে তিনি খানিক চিন্তিত। তিহাকে সেকথাই বলছিলেন তিনি। তিহা নিশ্চুপ। সেদিন রাতেই নিনাদের সাথে তার শেষ কথা হয়েছিল। যেদিন সে নিনাদকে জানিয়েছিল এসবকিছু। এরপর কাজের চাপে আর কল করা হয়ে ওঠে নি।
কিন্তু নিনাদ কেন হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করল? ফুআম্মা কেমন মানুষ সে তো তার অজানা নয়। তিনি যে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যাবেন জানার পরও তবে কেন এই ছেলেমানুষী? নিনাদ ঠিক আছে তো। কোন অসুখে পরে নি তো আবার? তিহা ভাবছিল। আফরিনের ডাকে সে সম্বিৎ ফিরে পায়। তিতিক্ষার জ্বরের কথাটা আফরিন তাকে জানায় চিন্তিত মুখে । তিহা তৎক্ষনাৎ উঠে পা বাড়ায় বোনের ঘরের দিকে। শিউলি বেগম আর আফরিনও ছোটে পেছন পেছন।
তিহা বোনের কাছে এসে কপালে হাত রেখে দেখে। তারপর দ্রুত একটা রুমাল ভিজিয়ে এনে কপালে দিয়ে সে ব্যাস্ত হয়ে পরে বোনকে নিয়েই। কখনো হাত পা মালিশ করে দেয়, কখনো মাথায় হাত বুলাতে থাকে। শিউলি বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন তিতিক্ষার মুখের দিকে। তিহার ব্যগ্রতা দেখে তার কপালে ভাজ পড়ে এবার। তিতিক্ষাকে দেখেও তো মনে হচ্ছে মানসিক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ নয় মেয়েটা। শুধু বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় কোন মেয়ে কি এতটা প্রভাবিত হতে পারে? প্রেমের বিয়ে হলেও নাহয় একটা কথা ছিল! তবে এদের ব্যাপারখানা কি?
নিনাদের কথা সেদিন চাপা পরে যায়। শিউলি বেগম আফরিনকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাস্ত হয়ে ওঠেন। রাত বাড়ছে। আবহাওয়া ভালো নয়। তাই খানিকপর চলে যান তারা।
বাইরে বৈশাখের তান্ডব শুরু হয়েছে তখন। থেকে থেকে মেঘের ভীষণ গুড়ুম গুড়ুম শব্দ আর জোড়াল বাতাস। ঝড়ের ইঙ্গিত পুরো রাতের আকাশ জুড়ে। তিতিক্ষার জ্বরও রাত্রির গভীরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তিহা চিন্তিত মুখে বসে আছে বোনের সিথানের ধারে। মারুফ সাহেব ছোটনকে নিয়ে ঘুমোচ্ছেন পাশের ঘরে। আর এ ঘরে তিতিক্ষা জ্বরের ঘোরে অনবরত বলে চলেছে আবোলতাবোল কথা।
তিহা তখন আনমনেই হিশেব মেলাতে বসে জীবনে তার সকল প্রাপ্তি -অপ্রাপ্তির । শুরু থেকেই জীবনটা তার গোছানো, সুন্দর। মা মারা গেলেন অল্প বয়সে, মা হারা তিতিক্ষা জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা দিচ্ছে এখন, বাবা মারুফ সাহেবও পুরোপুরি সুস্থ নন। শরীরে তার নানান জটিল রোগ বাসা বেঁধেছে। রাতের পর রাত তার নির্ঘুম কাটে। ছটফট করেন তিনি যন্ত্রণায়। অথচ তাদের এত কাছে থেকে তিহা তাদের যন্ত্রণার ভাগই নেয় শুধু। তার নিজের কোনো কষ্ট নেই। ছোট বেলায় সে পেয়েছে বাবা মায়ের আদর, বড় হয়ে পেয়েছে সৎ একজন স্বামী, তিহার একবিন্দু চোখের জল যে সইতে পারে না। তারপর এসেছে ছোটন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। জীবনে তো নিজস্ব কোন দুঃখ তার নেই। কেন তবে তার প্রতিই আল্লাহর এই বিশেষ অনুগ্রহ? তিহা ভাবে। আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার মত কোন কাজই তো সে করেনি কোনদিন। তবুও সবসময় একটা নিয়মের মধ্যে আছে তার জীবন। যে জীবনে কখনো ঝড় আসে না। পরন্তু তার পাশেই তার ছোট বোন দিয়ে চলেছে কঠিন পরীক্ষা।
তিহা সমাচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। বাইরে তখন ঝড় প্রবল। লোডশেডিং হয়েছে। বাতি জ্বালানোর কথা তিহার খেয়াল থাকে না। বোনের সিওরে বসে দুহাত একত্রে তুলে হঠাৎ সে মোনাজাত ধরে। তার হাত কাঁপতে থাকে, চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরে যায় ঝর্ণা ধারার মত। গুনগুন করে সে বলে, ‘আল্লাহ, না চাইতেও সারাজীবন আপনি আমাকে দিয়ে গেছেন সব। কোনদিন আপনার দুয়ারে শুকরিয়া জানাই নি এত নিয়ামতের জন্য। আজ আপনার এই অধম বান্দা হাত তুলেছে আপনার দুয়ারে। আপনি ফিরিয়ে দিবেন না। কবুল করে নিন মালিক। আমাকে সবর , ধৈর্য দিন। আর নিজেকে বদলে ফেলার তৌফিক দিন। যেন আমি আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের যোগ্য হতে পারি। আর আমি চাইব না কিছু কোনদিন।’
তখন অদূরে কোথাও একটা বাজ পরল। তিহা একটু কেঁপে ওঠে। মুখে হাত রেখে সে কেঁদে চলে অনবরত। আরশের মালিক কি তার মত পাপী বান্দার কথা শুনবেন? সে যে ভীষণ পাপী, সারাজীবন অবাধ্য থেকেছে আল্লাহর। না শুনুক, আজ থেকে সে বদলে যাবে, সব সে করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। ক’দিন ফিরিয়ে দেবেন তিনি? তার দয়ার বিশালতা যে সমুদ্রের চেয়েও অসীম।
কেমন অদ্ভুত, অপরিচিত এক ঘোরে যেন চলে যায় তিহা। পাশে তিতিক্ষা শুয়ে জ্বরের ঘোরে গোঙাতে থাকে। তার উষ্ণ দেহের তাপের আঁচ তিহার গায়েও অনুভূত হয়। কিন্তু সে খেয়াল করে না। কি যেন ভাবতে থাকে।
তার ধ্যান ভাঙ্গে ফোনকলের আওয়াজে। তিহা অবাক হয়। তখন শেষ রাত। কে এই রাত্রে ফোন করেছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে একটা বিদেশি নাম্বার। সে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে একটি অপরিচিত কণ্ঠস্বর তখন বলে ওঠে, ‘আপনি কি তিহা?’
-‘হ্যাঁ ‘
-দুঃখীত। বড় অসময়ে ফোন করে ফেললাম। বাংলাদেশে তো এখন বোধহয় মধ্যরাত। তাইনা?’
-‘হ্যাঁ। মধ্যরাতও শেষ। এখন শেষরাত। ভোর হবে খানিক বাদেই।’
-‘আসলে এতটা ভয়ে ছিলাম যে সময়ের হিশেব টা খেয়াল করারও সময় পাই নি। আসল কথাটা বলি। আপনি তো নিনাদের খুব কাছের মানুষ। প্লিজ শুনবেন মনোযোগ দিয়ে। ‘
তিহার হঠাৎ হৃদকম্পন বেড়ে যায়। সে বসে যাওয়া গলায় বলে, ‘ কি হয়েছে আমাকে বলুন।’
সেই অপরিচিত কণ্ঠস্বরে কেমন কোমলতা নেমে আসে। সে একটা নিশ্বাস ফেলে বলে,’ নিনাদের কি হয়েছে আমরা জানি না। তবে সে একদম ভালো নেই। গতকাল রাতে আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি।’
চলবে……
#দূর_আলাপন
পর্ব-১৪
অদ্রিজা আশয়ারী
______________
তিহা রুদ্ধ স্বরে জানতে চায়, ‘কি হয়েছে নিনাদের?’
ওপাশ থেকে উত্তর আসে, ‘কিছুদিন ধরেই একটু অদ্ভুত আচরন করছিল নিনাদ। দিন পাঁচেক আগে এক দুপুরে আমাদেরই এক রুমমেট তৌহিদ জানায় নিনাদের ঘরের দরজা নাকি আগেরদিন বিকেল থেকে বন্ধ। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। এখনো সে বের হয়নি একবারও। তাই আমরা ডাকি ওকে। ওর ঘরের চাবি তৌহিদের কাছেই ছিল। অনেক ডাকাডাকির পরও ওর সারা না পাওয়ায় তখন সেই চাবি দিয়ে নব খোলা হয়। ভেতরে গিয়ে দেখি নিনাদ উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয় ওখানেই। তারপর বুঝতে পারি ও জ্ঞান হারিয়েছে। সেদিন থেকেই সমস্যাটার শুরু। দিনরাত দরজা বন্ধ করে বসে থাকত ও। খাওয়া দাওয়া একেবারেই করত না। দরজা খুললেও দেখা যেত জায়নামাজেই বসে রয়েছে সবসময়। আর ভীষণ অস্থির থাকত সারাক্ষণ। ফ্লাইটের তারিখ কিভাবে এগোনো যায় সেই নিয়েই সারাদিন ভাবত ভীষণ। আগের টিকিট ক্যান্সেল করে এই কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশে যাওয়া যায় কিনা সেই নিয়েও বিস্তর চেষ্টা করেছে ও। আমাদের ধারণা নিনাদের বাড়িতে হয়ত কিছু একটা ঝামেলা হয়ে থাকবে। আর বাড়ির মানুষ বলতে শুধু ওর ফুফুকেই চিনি আমরা। তাই সেখানে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নিনাদ বাঁধা দিল। আর তারপর কাল ওর অবস্থাও ভীষণ খারাপের দিকে চলে যায়। প্রায় সপ্তাহ হতে চলল নিনাদ স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে চলছে। খাওয়া, ঘুম সব বেঠিক। তাই কাল ওকে হাসপাতালে ভর্তি করাটা জরুরি হয়ে পড়ে।’
তিহা স্তব্ধ হয়ে ফোন কানে নিয়ে বসে থাকে। নিনাদকে তিতিক্ষার পুরো ব্যাপারটা সে জানিয়েছিল দিন পাঁচেক আগেই। নিনাদের ঝালেমার শুরুও সেইসময় থেকে। অর্থাৎ তিতিক্ষার খবর শোনার পর থেকে। প্রতুত্তরে কিছু বলার কথা তিহার খেয়াল থাকে না। ওপাশ থেকে ছেলেটি তখন বলে,’কিছু মনে করবেন না। একটা কথা…এখন বোধহয় আমি বলতে পারি। নিনাদের কি হয়েছে আপনি কি জানেন? যদি জেনে থাকেন তাহলে ওর সাথে কথা বলে ওকে একটু বোঝাতে চেষ্টা করুন প্লিজ। এভাবে নিজেকে কষ্ট দেয়াটা আসলে কোন সমাধান নয়।’
তিহার সম্বিৎ ফিরে আসে,’ হ্যাঁ কথা বলব আমি ওর সাথে। কেমন আছে ও এখন?’
-‘ মারাত্মক কিছু এখনো হয়নি ওর। শুধু কেবল মানসিক ভাবে অসুস্থ আর শারিরীক ভাবেও খুব বেশি দূর্বল।’
তিহা নিচু স্বরে বলে, ‘ও’
আরও দু একটা কথার পর ছেলেটি ফোন ছেড়ে দেয়। তিহার মনে তখন নতুন চিন্তার উদ্রেক হয়। সেই শুরু থেকেই নিনাদ দূর্বল তিতিক্ষার প্রতি। একথা সে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ইঙ্গিতে জানিয়েছে। অথচ তিতিক্ষার মনে কি চলে তার কিছুরই খোঁজ সে পায় না। নিনাদের প্রতি তার সামান্যতম দূর্বলতাও কোনদিন নজরে পড়েনি তিহার। আর যদি থাকতই তবে কি রাজি হত সেবার বিয়েতে অত সহজে?
সকাল হয়ে আসে। তিহা স্যুপের বাটি নিয়ে বিছানার পাশে চেয়ারে রেখে, এসে বসে তিতিক্ষার মাথার কাছে। রাতের সেই অসহায়, ভীত ভাবটা আর তার হৃদয়ে থাকে না। নিজের জমাট অন্ধকারের সাথে সাথে রাত্রি যেন তার মনের ভীত অসহায় ভাবটাকেও সঙ্গে নিয়ে গায়েব হয়। তিহা একদৃষ্টে চেয়ে দেখতে থাকে বোনের মুখ। নিমীলিত চোখের সেই ভীষণ ফর্সা মুখ যেন শরতের সবুজ দীঘিতে ফোঁটা শ্বেতপদ্মের মতই সুন্দর দেখায়। তিহা সেখানে একটা কিছু খুঁজতে থাকে। একটু ভালোবাসার চিহ্ন! নিনাদের জন্য কোন অনুভূতিই কি নেই তিতিক্ষার? কই, আছে বলে তো এত বছরে একবারও মনে হয়নি তার। তিহা খুঁটিয়ে দেখে তিতিক্ষার মুখ, নিমীলিত আঁখি আর রাঙা ঠোঁট। সবটা জুড়ে কেবলই মায়া। এত মায়া। তবুও কি কোথাও স্থান নেই একটু ভালোবাসার, নিনাদের জন্য?
তারপরের কয়েকটা দিন তিহার কাটে একটু ভিন্নরকম ব্যাস্ততায়। সেই যে একরাতে কল করেছিল, সেই ছেলেটির নাম হাসনাত। তিহা তারপর হাসনাতকে কল করে কয়েকবার। উদ্দেশ্য নিনাদের সাথে একটু কথা বলা। নিনাদের নিজের ফোন তো বন্ধ সেই কবে থেকে। হাসনাত দুঃখিত হয়ে জানায় নিনাদ কথা বলতে চায় না তিহার সাথে। এর একটা কারণ তিহা নিজেই ভেবে বের করে তারপর। হয়ত তিতিক্ষার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য নিনাদ দায়ী করছে তাকে। তাই কথা বলতে চাইছে না তার সঙ্গে। তিহা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। সত্যিই তাই! দায় সে এড়াতে পারে না। তিতিক্ষার জীবনের প্রতিটি ছোট থেকে বড়, সব সিদ্ধান্তই সে নিজে নিয়েছে চিরকাল। সেবার বিয়ের সমন্ধটাও মধ্যস্থতা করেছিল সে। অতঃপর তিতিক্ষা কেবল রাজি হয়েছিল বোনের কথায়। একটি মেয়ের দায়িত্ব, তাকে সকল বিপদ থেকে আগলে রাখার দায়িত্ব কম কথা নয়। তা সে পারে নি। নরখাদক শেয়াল কুকুর থেকে বাঁচাতে সে পারেনি তার বোনকে। দায় তার ওপরই পরে বটে।
যে ভিন্নরকম কাজে কাটে আজকাল তিহার সময়, কাজ হিশেবে তা পরম উপভোগ্য! রোজ সে খানিক পর পর যায় বোনের ঘরে। বোনের সাথে বন্ধু হতে চেষ্টা করে। নানান কথা বলে তাকে হাসায়। জানতে চেষ্টা করে তার মনের খবর আর তার মুখে, চোখের দৃষ্টিতে খুঁজে ফেরে অন্যরকম একটা কিছু। সেই ভালোবাসার চিহ্ন!
তিতিক্ষার সামনে নিনাদের নাম মুখে নিতেও কেন যেন তার বাঁধে। লজ্জা হয়। তিতিক্ষা যদি ভাবে তার বোঝা বইতে না পেরে এখন বোন তাকে গছাতে চাইছে নিনাদের ঘাড়ে!
তাছাড়া ভয়ও হয়। তিতিক্ষা অন্য সব মেয়েদের মত তো নয়। এত যে তার আত্মভাব। সে কি পারবে আর কখনো ঘুরে দাঁড়াতে, নতুন করে সবটা শুরু করতে?
দিনগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। শিউলি বেগম আফরিনকে নিয়ে তোড়জোড় চালাচ্ছেন ভাতিজার বিয়ের। তিতিক্ষাদের বাড়ি অত ঘনঘন আসার সময় তার নেই।
তিহা আছে বোনকে নিয়ে। তিতিক্ষার একটু সুস্থতা এখন তার পরম কাম্য। সেই সাথে আছে তার নিজের মনের তীব্র অনুতাপ। এখানে তিতিক্ষা, ওখানে নিনাদ আর মাঝখানে তার বৃদ্ধ বাবা। সবাই কষ্ট পাচ্ছে। কষ্টের সে কি নিদারুণ প্রচ্ছন্নতা! কেউ কারোও সামনে কাঁদে না, আলাপ করে না কষ্ট নিয়ে। এই কষ্ট শুধু একাই ভোগ করতে হয়। কারোরই ভাগিদার যে হওয়া যায় না এই কষ্টে। একজন বাবা কিভাবে তার নির্জিত মেয়েকে বলবেন, ‘তুমি কষ্ট পেয় না। এসো আমরা একসাথে একটু কাঁদি। দেখবে সব কষ্ট চলে যাবে।’
এভাবে কেউ পারে না বলতে। সেই কষ্টে একথা বলা যায় না। তিহা সঙ্গোপনে কত দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। আর ওপরে দৃষ্টি মেলে দু’হাত তুলে বলে, ‘আল্লাহ, এমন দিন আর কোন মেয়ের জীবনে না আসুক। কোনদিন না আসুক।’
পনেরটা দিন এভাবে কেটে যাওয়ার পর একদিন একটি বিচিত্র ও অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে।
সেদিন সকাল থেকেই বড় বেশি পাগলামি করছিল তিতিক্ষা। বোনের বেপরোয়া আচরণ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তিহাকে। মারুফ সাহেব ছোটনকে স্কুলে দিতে গেছেন। এদিকে আকবরের মা ও আসে নি তখনো। তিতিক্ষা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে অনবরত কেঁদে চলেছে। দু’হাতের মুঠোয় খামছে ধরে রেখেছে নিজের খোলা চুল। গায়ে তার গোলাপি রঙের সুতির বড় গোল জামা। সেই রঙে মিলানো পাজামা। ওড়নাটা পড়ে আছে দূরে। ঘরের এক কোণে। মাঝে মাঝেই সে মাথা থেকে হাত নামিয়ে আঁচড় কাটছে নিজের মুখে। তারপর আবার খামছে ধরছে চুল। আর মুখে বলে চলেছে অজস্র এলোমেলো কথা।
তিহা অদূরে মেঝেতে বসে দেখছিল বোনের কীর্তকলাপ। এবার আর সইতে না পেরে সে কল করল রওশানকে। বলল,’ হ্যালো, রওশান। দয়া করে আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। তুমি এসো। কিছু একটা করো। আমি আর পারছি না। এবার সত্যি মরে যাব আমি। ‘ বলে সেখানে বসেই চিৎকার করে কাঁদতে লাগল সে।
তিতিক্ষা নিজের কান্না ও ক্রিয়াকলাপ দুটোই বন্ধ অবাক চোখে চেয়ে রইল বোনের দিকে। তার মুখ জুড়ে সদ্য দেয়া আঁচড়ের লাল লাল দাগ। হঠাৎ তিহাকে কাঁদতে দেখে সে নিজেই কাঁদতে ভুলে গেছে। তখন কলিংবেল বেজে উঠল। তারপর বাজতে লাগল একনাগাড়ে। রওশান তিহাকে কিছু বোঝাচ্ছিল। বারবার বলছিল সে আসবে। আজই আসবে। তিহা যেন আর কান্নাকাটি না করে। তিহা তাকে কিছু না বলেই ফোন কেটে দিল। হঠাৎ কান্না থামিয়ে চোখ মুছে এগোল দরজার দিকে। নিশ্চয়ই আকবরের মা এসেছে। দরজায় তখন বেলের পাশাপাশি আঙুলের টোকাও পরতে শুরু করেছে। তিহা দ্রুত নব ঘোরাল। দরজা খুলে তার আর বিস্ময়ের সীমা রইল না। সে তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় তুলে দিল। অবাক চোখে চেয়ে রইল সামনে। পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। গলায় গামছা ঝোলান অপরিচিত এক লোক সাথে। আর তাদের পায়ের কাছে দেয়ালে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে নিনাদ বসে আছে। তার চোখ নিমীলিত। পাশেই রাখা তার সুটকেস। তিহা বিস্মিত স্বরে সেই ভাড়াটিয়া লোকটিকে বলল,’ একি আফসান ভাই। ওকে কোথায় পেলেন আপনি? কি হয়েছে ওর? ‘
আফসান নামের ভদ্রলোকটি কপালে ভাজ ফেলে চিন্তিত মুখে বললেন,’ আর বলো না। আমি বেরিয়েছি দোকানে যাব বলে। বেরিয়েই দেখি ইনি তোমাদের গেটের সামনে সিএনজির বাইরে দাঁড়িয়ে টলছেন। বোধহয় ভাড়া দিতে দাঁড়িয়েছিলেন। পড়ে যাবেন যেকোনো মুহুর্তে। গিয়ে ধরে জিগ্যেস করলাম কোথায় যাবেন? তোমার বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। ইনি কি হয় তোমার? আগে তো দেখতাম প্রায়ই আসত এখানে। ইদানীং দেখি না।’
তিহা একবার নিনাদের কাছে গিয়ে তার কপালে হাত রাখল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ওর। তারপর থমথমে স্বরে বলল,’ আমার ভাই হয়। দারান আসছি আমি।’বলে সে ত্বরিতে ঘর থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট এনে ধরিয়ে দিল সিএনজি ওয়ালার হাতে। ভাড়ার বেশি টাকা পেয়ে সিএনজি ওয়ালা তখন খুশি মনে ফিরে যাচ্ছিল। এর মাঝেই তিহা দ্রুত কিছু জিনিস ভেবে নিল। প্রথমত নিনাদকে এখানে রাখা একদমই উচিত হবে না এখন। তিতিক্ষা তাকে দেখলে আবার নতুন কি ঝামেলা করে তার ঠিক নেই। তাছাড়া নিনাদও সুস্থ নয়। তার সেবা শুশ্রূষার দরকার। এখন তাকে মোহাম্মদপুর পাঠিয়ে দেয়াই তাই সবচেয়ে মঙ্গল। ভেবে নিয়ে তিহা সাথে সাথে ডাকল সিএনজি ওয়ালাকে। তারপর ভাড়াটিয়া ভদ্রলোকটিকে বলল, ‘আফসান ভাই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কষ্ট করে ওকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু এখন আরেকটু কষ্ট করতে হবে আপনাকে। দয়া করে আবার একটু সিএনজিতে তুলে দিতে হবে ওকে। ওকে মোহাম্মদপুরে ওর বাসায় রেখে আসব আমি। আপনি প্লিজ উনার সাহায্য নিয়ে ওকে একটু সিএনজিতে তুলে দিন। আমি এক্ষুনি আসছি।’
আফসান নামের লোকটি ও সিএনজি ওয়ালা মিলে নিনাদকে ফের নিয়ে গিয়ে তুলল গাড়িতে। বলা বাহুল্য। এতে তাদের অনেক কষ্ট পোহাতে হল। তিহা দৌড়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিল বোরকা আর ব্যাগ আনতে। মাঝরাস্তায় এসে সে থমকে দাঁড়াল। তিতিক্ষা তার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। তিহার উপস্থিতি টের পেয়ে সেদিকে আঙুল নির্দেশ করে সে জিগ্যেস করল, ‘কে ও?’
তিহা টলমল চোখে তাকাল একবার বোনের মুখের দিকে। তারপর কাছে এসে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,’ কেউ না।’ বলে সে দ্রুত নিজের ঘরে গেল। বোরকা ও ব্যাগ তারপর বেরিয়ে গেল নিনাদের কাছে, নিজের আধপাগল বোনকে একা ফেলে।
নিনাদের বাড়ি পৌঁছাতেই শিউলি বেগম নিনাদকে দেখে কেঁদে, চিৎকার চেচাঁমেচি করে তৎক্ষনাৎ হুলুস্থুল বাধিয়ে দিলেন। বারবার বললে লাগলেন, ‘বাও লাগছে। আমি কইছিলাম বিদেশ না যাইতে। পোলার পড়বার শখ। শুনল না আমার কথা। ঠিকি গেল গা একলা একলা। এই বাও তো সোজা বাও না। নিশ্চয়ই বিদেশ বিভূঁইয়ে পরীর আছর পরছে। ও আল্লাহ গো। এহন কি হইব আমার নিনাইদ্দার। পোলার বিয়াডা মনেহয় আর দিতে পারমু না আমি।’ বলে তিনি কপাল চাপড়ে কাঁদতে লাগলেন। আফরিনও ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল নিনাদকে অজ্ঞান দেখে। তিহা বুঝল এদের থেকে কোনরকম সাহায্য পাওয়ার আশা তার নেই। সিএনজি ওয়ালাকে সাথে নিয়ে সে বহুকষ্টে নিনাদকে ভেতরে এনে শোয়াল। ফোন করল মারুফ সাহেবকে। বলল ছোটনকে স্কুলে রেখে একটা ডাক্তার নিয়ে দ্রুত মোহাম্মদপুরে নিনাদের বাসায় চলে আসতে। ডাক্তার এলে নিনাদের মোটামুটি একটা ব্যাবস্থা হল। মারুফ সাহেবকে তিহা পাঠিয়ে দিল বাড়িতে তিতিক্ষার কাছে। নিজে সে রয়ে গেল এখানেই। রাতেই দেখা গেল রওশান এসে হাজির। তখন প্রায় মাঝরাত। তিহার কাছে সব শুনে রওশান সরাসরি চলে এসেছে নিনাদের ওখানে। তিহা অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি এত রাতে? আজ রাতে কেন এলে? কাল এলেই তো পারতে।’
রওশান ক্লান্ত চোখে তাকাল। অসহায় মুখে বলল ,’ তুমি না বললে এখানে একা সবকিছু সামলাতে পারছ না। আর বলেই কান্নাকাটি জুড়ে দিলে। আমি ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই কাজ ফেলেই ছুটে এলাম।’
এত কষ্টের মাঝেও তিহা হাসল। বলল, ‘ভালো হয়েছে। তুমি এখানে থাকো নিনাদের কাছে। কাল সকালে আমি যাই ওখানে তিতিক্ষা, ছোটন ওদের কি হাল কে জানে। দেখে আসি গিয়ে।’
চলবে….।