দূর আলাপন পর্ব ১৫

#দূর_আলাপন
পর্ব-১৫
অদ্রিজা আশয়ারী
_______________
ভিড়ানো দরজার খানিকটা খুলে তিহা উঁকি দিল ভেতরে। এখান থেকে শুধু ওর পেছন টুকুই নজরে পড়ছে। মেঝেতে শুয়ে আছে মেয়েটা। জানালার গরাদ গলে সকালের নরম রোদ এসে পড়ছে তার গায়ে।
তিহা ধীর পায়ে এগোয় সেদিকে। রোদে নিজের হাত রেখে সে হাতটাকে নাড়াচাড়া করছে তিতিক্ষা। সৃষ্টি হচ্ছে অদ্ভুত সব আকৃতির ছায়া। সেসব চঞ্চল ছায়া এসে পড়ছে তার মুখে, চোখে। রোদে পড়ে জ্বলজ্বল করে ওঠা নিজের ফ্যাকাসে সাদা হাতের দিকে সে তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ চোখে।
তিহা এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে। হাসি হাসি মুখ করে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কি করিস?’
বোনের উপস্থিতি টের পেয়েও তিতিক্ষা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ওভাবেই রোদে হাত রেখে নাড়তে নাড়তে বলে, ‘রোদ দেখি।’
তিহা অস্ফুট হাসে,’ রোদ কি আবার দেখার জিনিস নাকি?’
-‘আমার দেখতে ভালো লাগে। রোদ থেকে আমি শক্তি নিই। গাছের মতো। ‘
তিহার দৃষ্টি গভীর হয়। ওভাবেই তাকিয়ে থেকে সে দেখতে থাকে নিজের কাছের মানুষের বদলে যাওয়া অন্য রূপটাকে। দিনের পর দিন এই বদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে মেয়েটার সাদা মুখ আরও ভয়ংকর সাদা হয়েছে উঠেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় কোন বিদেশিনী। তখন তার কালো চুল দেখে সেই ভ্রম ভাঙ্গে। চোখের রঙও যেন বদলে গেছে অনেকটা। তার হালকা বাদামি চোখ এখন গাঢ় ধূসর রঙে পরিনত হয়েছে। আর চোখের ওপরের বাদামি রেখা যেন পূর্ণতা দান করেছে সেই চোখের সৌন্দর্যে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নিখুঁত হাতে আঁকা গাঢ় অঞ্জন যেন।
তিহা সূর্যের দিকে চোখ তুলে তাকায়। তাকানো মাত্র রোদের তেজে চোখ তার বুজে আসে। সে খুব দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয় তখন। তারপর নিশ্বাস ছাড়ে ধীরে ধীরে। যেন কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে সে সূর্যের থেকে।
-‘কতবার না বলেছি মেঝেতে না শুতে। তবুও? উঠে বোস এক্ষুনি!’ বলে সে টান দেয় তিতিক্ষার হাত ধরে। তিতিক্ষা ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে বসে।
-‘আমি ফের একটু বাইরে যাব। ফিরতে খানিক দেরি হবে। এখন খাইয়ে দিয়ে যাই।’ বলে সে আকবরের মা কে ডাকে গলা উঁচিয়ে। আকবরের মা প্রায় সাথে সাথেই হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে হাজির হয়। নিনাদের ওখান থেকে ফিরে, নিজে ফ্রেশ হয়ে ছোটনকে খাইয়ে আকবরের মা কে সে বলেছিল তিতিক্ষারও খাবার দিতে। তাকে খাইয়ে তবেই আবার সে যাবে নিনাদের বাড়ি।

তিহা রুটি ছিড়তে ছিড়তে আড়চোখে তাকায় বোনের দিকে। তারপর সবজি নিয়ে তিতিক্ষার মুখে পুরে সতর্ক ভাবে বলে,’কাল যে এল আমাদের বাড়িতে একটা ছেলে। তাকে চিনতে পেরেছিলি তুই?’
বোনের দিকে তিতিক্ষার খেয়াল নেই তখন। জানালার বাইরে গাছের ডালে বসে থাকা কি একটা পাখির দিকে তার নজর। ওদিকে তাকিয়েই সে সরল গলায় বলে, ‘কিভাবে চিনব? তাছাড়া তুমি না বললে ও কেউ নয়?’
তিহা থতমত খেয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিতে কিছুটা সময় লাগে তার। এর মাঝে আর কোন কথা না বলে সে খাইয়ে যায় বোনকে। তারপর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলে, ‘কাল তো এত ব্যাস্ত ছিলাম। অতকিছু ভেঙে বলার সময় কই! কিন্তু তাই বলে তুই চিনতে পারিস নি! কে ও?’
তিতিক্ষা বিরক্ত স্বরে বলে, ‘না।’
তিহা আবারও বেফাঁস কিছু বলবার আগে ধাতস্থ হয়। তারপর দায়সারা ভাবে বলে, ‘নিনাদকে চিনিস না তুই? আমার বন্ধু। দু’দিন পর পরই আসত এখানে। সেদিন না আমেরিকা গেল পড়তে। এর মাঝেই ভুলে গেলি! ও তো….’ তিহা থেমে যায়। সন্দিগ্ধ চোখে দেখতে থাকে বোনের মুখ। নিনাদের নাম শুনে তিতিক্ষা কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে না তো আবার!
তিতিক্ষা কিন্তু স্বাভাবিকই থাকে। অনেকক্ষণ ধরে সে ভাবে কিছু একটা নিয়ে। তারপর হঠাৎই চোখে মুখে অস্বস্তি ফুটে ওঠে তার। সে অস্থির হয়ে বলে, ‘আর খাব না বুবু, তুমি এখন যাও এখান থেকে।’ বলে বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
তিহা একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সেই গমন পথের দিকে। তারপর হতাশ মুখে উঠে পা বাড়ায় বাইরে।

_________________________
নিনাদের ঘুম ভাঙে প্রচন্ড গরমে। জ্বর গায়ে, ঘুমের রেশ লাগা বোজা বোজা চোখে প্রথমে সে কিছু বুঝতে পারে না। ভাবে আমেরিকাতেই আছে এখনো। তবে এত গরম কেন লাগছে? এমনিতে শীতের প্রকোপে তো টেকা দায়। রুম হিটার ছাড়া চলে না এক মুহুর্ত, তবে হঠাৎ এত গরম…। নিনাদ চোখ খুলে দেখে গায়ে তার কাঁথা জড়ানো। পড়নের টি-শার্ট টা ঘেমে ভিজে একাকার। কাঁথা সরাতে সরাতে ঘরের দিকে সহসা চোখ পড়তেই সে চমকে ওঠে। এটা তোর তার গুড স্ট্রিটের বাড়িটা নয়। তারপর অনেকটা সময় লাগে তার ধাতস্থ হতে। সে বুঝতে পারে এখন সে আছে বাংলাদেশে, তার নিজের ঘরে। আমেরিকা থেকে ফিরেছে সকালের ফ্লাইটে। সবকিছু বুঝতে পারা মাত্র মুহুর্তে নিনাদ অস্থির হয়ে ওঠে। যে কারণটা তাকে সময়ের আগে জোর করে টেনে নিয়ে এসেছে এখানে, সেটা মনে হতেই শুরু হয় এই অস্থিরতা। নিনাদ বিছানা ছেড়ে উঠতে চায়। কিন্তু শরীর বেঁকে বসে। তখন সে খেয়াল করে ঠিক মত উঠে বসবার শক্তিও তার নেই। মনের জোরের সাথে সাথে দেহের জোরও কোথায় হারিয়ে গেছে। আর কিছু ভাবার আগেই দরজার নব নড়েচড়ে ওঠে। যে এগিয়ে আসে তাকে দেখে নিনাদের বুক চিরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেড়োয় শুধু। সে গন্তব্যহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনে। তিহা বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে এসে বসে। তার মুখ দেখে মনে হয় এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী ও অপরাধী মানুষটা সে।

নিনাদ একটু উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। তাকায় তিহার দিকে। তিহা চোখ তুলতেই সে হালকা হাসে। শান্ত স্বরে বলে,’কেমন আছিস?’
প্রতুত্তরে মলিন মুখে তিহা শুধু মুচকি হাসে। নিনাদও কিছু না বলে বালিশে হেলে পড়ে। তার দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ তিহার কানেও পৌঁছায়। যা ভেঙে দেয় তিহার মনে বেঁচে থাকা বাকি জোর টুকু। দুজনে নিরব থাকে অনেকক্ষণ। তিহা অস্থির ভাবে নিজের হাত কচলাতে থাকে কেবল। তার বেপরোয়া মন আর বাঁধা মানতে চায় না। সহসা সে অস্ফুট স্বরে ডেকে ওঠে। ‘নিনাদ’
নিনাদ পাশ ফিরে তাকায়।
তিহা কিছুটা থেমে করুন স্বরে বলে, ‘মাফ করে দিস আমায় নিনাদ। আমার জন্যই সম্ভব হয়েছে সবটা। আমার লোভের জন্য, বেশি চাহিদার জন্য। ভালো ঘর পেয়ে, চেয়েছিলাম ওকে পার করে দিতে। কিন্তু….. ‘
মাঝপথে নিনাদ ওকে থামিয়ে দেয়। বলে, ‘থাক ওসব কথা। আমি অবুঝ নই। তোকে কখনোই দায়ী করতে পারি না এসবের জন্য। যা ঘটে গেছে, সেটা ঘটারই ছিল। আর, আমি কেই বা ওর! কেন কৈফিয়ত দিচ্ছিস আমার কাছে?’
তিহা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। যেন সে হারিয়ে ফেলেছে সব শব্দকে। কথা বলবে সে কি করে?
নিনাদ মাথা নুইয়ে কিছু ভাবে, গম্ভীর হয়। তারপর মেঘ স্বরে বলে, ‘আমাদের সম্পর্কের নীড় যেখানে, সেখানেই আমরা ফিরে যাই। আমরা দুজন ভালো বন্ধু সেই ছোটবেলা থেকে। বন্ধুত্বটা ভালো থাকুক। বন্ধুত্বে যেটুকু চলে, সেটুকুই চলুক। আর সব বাদ যাক। তোর পরিবার শুধু তোর, আর আমার পরিবার… ‘ নিনাদ থেমে যায় হঠাৎ। সত্যিই কি তার কিছু আছে পরিবার বলতে? খানিক থেমে সে বলে,’আমার ব্যাক্তিগত যা কিছু, সেসব শুধুই আমার। এখন থেকে আমরা দুজন শুধু ভালো বন্ধু। আর কিছু না।’ বলে সে মুচকি হাসে।
তিহা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে নিজের বন্ধুর দিকে। আহত গলায় কেবল উচ্চারণ করে, ‘নিনাদ।’
নিনাদ তাকে থামিয়ে দিয়ে, কিছুই যেন হয়নি এমন ভঙ্গিতে অবাক হবার ভান করে বলে, ‘একি! আমি তো খেয়ালই করি নি এতক্ষণ। কি অবস্থা হয়েছে তোর! মুখ শুকিয়ে, চোখের নিচে কালি পরে গেছে। বরের হাতে মার খেলে মেয়েদের মুখ এমন হয়। রওশান ভাইকে কি আজকাল বউ পেটানোর রোগে ধরল নাকি?’
তিহা হাসে। এমন ভাবে তাকায়, যেন সে দেখছে কাছে বসে থাকা খুব দূরের কোন মানুষকে। এতটা দূরের, যে তার সাথে শুধু সুখের দিনে দু একটা খোশগল্পই বলা চলে। দুঃখের দিনের একফোঁটা অশ্রুর বিসর্জন সেখানে প্রহসনের মত শোনায়!

তবুও তিহা নিজের দায় এড়ায় না। শিউলি বেগম আর আফরিন দুজনেই অনুষ্ণ ধরনের মানুষ। তাদের কেবল মুখেই রা। কাজের বেলায় ততটা শক্ত নন। তাই তিহাকে তারা সেদিন অনেক বেলা পর্যন্ত আটকে রাখেন জোর করে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিহার সন্ধ্যে পেড়োয়। গেট পেড়িয়ে উঠোনে পা রাখতেই তিহা দেখে মারুফ সাহেব ছোটনকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন উঠোন জুড়ে। সে এগিয়ে যায়। কিছুটা রাগি স্বরেই বলে,’ বাবা, এই ভর সন্ধ্যে তে তুমি ওকে নিয়ে বাইরে কেন ঘুরছ? তাছাড়া তিতিও তো ঘরে একা রয়েছে।’
মারুফ সাহেব শান্ত গলায় বলেন,’তিতি মা’র আজ হঠাৎ যে আবার কি হল। তুমি যাওয়ার পর থেকেই খুব চিৎকার চেচাঁমেচি করছে। দরজাও বন্ধ করে রেখেছে, খেলও না কিছু সারাদিন। কেমন যেন হয়ে গেছে মেয়েটা। কথা শোনে না একদম। ছোটন ভয় পাচ্ছিল সেসব দেখে। তাই…’
তিহা চিন্তিত মুখে বলে, ‘ওহ, তাই নাকি? আচ্ছা চল ভেতরে। আমি দেখছি কি করা যায়। ‘

তিহার অনেক আর্জি-অনুরোধের পর দরজা খোলে তিতিক্ষা। তিহা ভেবেছিল নিশ্চয়ই ঘরে বসে কোন অনর্থ বাঁধিয়েছে মেয়েটা। হয়তো ভাংচুর করেছে আবারও। কিন্তু ঘরে ঢুকেই তার ধারনা পাল্টে যায়। সে ভেতরে পা বাড়াতেই তিতিক্ষা এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তিহা একটু কেঁপে ওঠে। মুখের কাঁচা ক্ষত গুলোর ওপর খামচিয়ে সেগুলোর অবস্থা করুন করে ফেলেছে মেয়েটা। দু এক জায়গা থেকে রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে আছে ওখানেই। তিহা তাকিয়ে থাকে বোনের মুখের দিকে। তিতিক্ষা তাকে জড়িয়ে ধরে হিচকি তুলে কাঁদছে। সে হাত রাখে বোনের মাথায়। চাপা স্বরে বলে, ‘কি করেছিস!’
তিতিক্ষার খেয়াল নেই সেসবে। সে গুমরে কাঁদতে কাঁদতে অসহায় মুখে বলে,’ আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন বুবু? আমি শ্বাস নিতে পারছি না। শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরা জ্বলছে। নিজের গলা কেটে ফেললেও বোধহয় কারো এত যন্ত্রণা হয় না। আমি কি মারা যাব বুবু? আমি বোধহয় মারাই যাচ্ছি বুবু। এখানে আর কোন সুখ নেই। মরেই আমার শান্তি। আমাকে একটু শান্তি দাও।’
তিহা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তিতিক্ষার দিকে। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে অনবরত। সে হঠাৎ তিতিক্ষার হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। আর যে নিতে পারছে না সে। কত আর সওয়া যায়?
ঘর থেকে বেড়িয়ে তিহা আবারও থমকে দাঁড়ায়। তার বাবার মারুফ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে, পাথরের মূর্তির মত। কিন্তু মূর্তির চোখে কি কখনো জল ঝরে? মারুফ সাহেবের চোখ বেয়ে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে পানি। তিহাকে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি এবার কথা বলেন। করুন স্বরে বলেন,’ তিহা, কারো কষ্ট যখন জীবনের সকল কিছুর থেকেও প্রবল হয়ে ওঠে তখন তার জন্য মৃত্যুই হয় শ্রেয়, মুক্তির একমাত্র উপায়। এসো, তিতিক্ষাকেও আমরা মুক্তি দিই।’
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here