দেশলাই – ৩২ পর্ব
রাফসান কিছুই বললো না। ইলি ভুরু উঁচিয়ে ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিতে খানিক্ষণ তাকিয়েও কোনো সাড়া না পেয়ে বললো,
– ‘বসতেও বলবে না?’
কথাটি বলে ইলি আশা করেছিল রাফসান হয়তো এবার হাসবে। একটু স্বাভাবিকভাবে কথা বলে বিদায় দেবে। কিন্তু সে এসবের ধারেকাছে না গিয়ে উল্টো বললো,
– ‘ইলি এখন ফাজলামো করার সময় না। যা, বাড়িতে যা। হোয়াটসঅ্যাপে কথা হবে, যখন-তখন এভাবে আসবি না।’
ইলি চুপচাপ বাইরে এলো। ভেতর ঘরের পালঙ্ক থেকে রাফসানের চাচিরা গলা লম্বা করে তাকাচ্ছেন। ইলি বাড়ি থেকে ঢালু রাস্তা দিয়ে মাঠে নামে। হাঁটতে হাঁটতে এসে তাল গাছের নিচ দিয়ে কবর গলিতে উঠে। বাড়ির গেইট খুলে ভেতরে যেতেই মা-বাবার কথা কাটাকাটি শুনতে পায়। ইলি চুপচাপ নিজের রুমে চলে যায়। লতিফ মিয়া তাকিয়ে দেখে কিছুই বললেন না। রহিমা বেগম খানিক পর এসে বললেন, ‘নবাবজাদি আসো, নাশতা করো আইসা।’
– ‘আমি খাবো না মা।’
রহিমা বেগম খানিক্ষণ দাঁত কটমট করে তাকিয়ে চলে গেলেন। ইলি দরজা বন্ধ করে মোবাইল হাতে নিয়ে রাফসানকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেয়,
– ‘তুমিও সবার মতো আজ আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারলে?’
খানিক পর রাফসান মেসেজ দেয়,
– ‘কি রকম ব্যবহার করেছি?’
– ‘সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে তাই না?’
রাফসান সিন করে আর রিপ্লাই দিলো না। ইলির আরও অনেক কথা বলার ছিলো। তবুও থেমে গেল। এখন এমনিতেই রাফসান ভাইয়ের মানসিক অবস্থা ভালো নেই। মানুষটাকে সে চাপ মুক্ত রাখতে চায়। বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়ে হেডফোন কানে গুঁজে রবীন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে চোখবুঁজে,
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে গো
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
নাইবা আমায় ডাকলে
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না….
****
লতিফ মিয়া সন্ধ্যার দিকে গেলেন রাফসানের কাছে। সে এ অবেলায় দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছে। লাল টকটকে চোখ। ফোলা মুখ। এলোমেলো চুল। বাতি জ্বেলে দরজা খুলে মামাকে বসতে দেয়। লতিফ মিয়া চেয়ারে বসে কোনো ভদ্রবিধি না খুলে ভূমিকায় না গিয়ে মূল কথায় চলে গেলেন।
– ‘রাফসান তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।’
– ‘আচ্ছা, বলুন মামা।’
– ‘দেখো রাফসান, তুমি আর ইলি আমার কাছে আলাদা কিছু না। আমরা একই পরিবারের মানুষ। আমার ইজ্জত, তোমারও ইজ্জত। আর আমি এটাও জানি তুমি ইলির ভালো চাইবে। তুমি হয়তো জানো বাবা, আরও কয়েক বছর আগে থেকে ইলির বিয়ে ঠিক হয়ে আছে৷ আগামী মাসের দুই তারিখ ওর মামা-মামী আসবে। এই অবস্থায় মেয়েটি যা শুরু করেছে নিজের গ্রামেও মুখ দেখানো দায়। ওর মামা-মামীর কাছেও বা কি জবাব দেবো আমরা? তাও বাবা তুমি বিবাহিত হলেও ভেবে দেখতাম। কিন্তু এখন তো তুমি বিয়েও করতে পারবে না। অযথা মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে না বলো?’
এই মুহূর্তে এগুলো নিয়ে রাফসানের একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কি জবাব দেবে তাও ভেবে পাচ্ছে না। সে আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘মামা আমাকে আরও একটা বছর সময় দেয়া যায় না?’
লতিফ মিয়া হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন,
– ‘বেয়াদবের মতো কথা বলবা না রাফসান। তুমি আমার মেয়েকে শ্রীমঙ্গল নিয়ে মাথা নষ্ট করেছো। আপন ভাগ্নে হয়ে আমার ইজ্জৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছো। বিশ্বাস করে মেয়ের সাথে মিশতে দিতাম আর তুমি প্রেম করে বেরিয়েছো। তাছাড়া তোমার জন্য কিসের সময়? ইন্টার ফেইল ছেলে, একটা মেয়ের সাথে নষ্টামি করে পাগল ছিলে, তুমি একজন বিবাহিত, এখন আবার তোমার নিজেরই অস্তিত্ব নেই। কোন মুখে ইলিকে বিয়ে করার জন্য সময় চাও? একবারও ভাবছো না আমি কত বড়ো বিপদে আছি।’
রাফসান ঠান্ডা মাথায় বললো,
– ‘কিন্তু ইলি তো আমাকে পছন্দ করে মামা।’
– ‘তাইতো তোমার কাছে এসেছি। না হয় তুমি ইলির কোনদিক দিয়ে যোগ্য? বাচ্চা মেয়ে আবেগে কি করতেছে বুঝতেছে না। তুমি তো বুঝো। তোমার কাছে হাতজোড় করে বলছি। ইলির ভালোর জন্য হলেও তুমি তাকে বিয়েতে রাজি করাও।’
– ‘আমার কি করতে হবে?’
– ‘ইলির সুখ চাইলে তাকে বুঝিয়ে বলো হৃদকে বিয়ে করতে।’
– ‘এটা আমি বলতে পারবো না মামা।’
– ‘আরে বোকা না-কি তুমি? তুমি একবার ভাবো ইলির জীবন নষ্ট হোক তুমি কি চাও?’
– ‘না।’
– ‘তাহলে তুমি নিজেই দেখো ইলি অনার্স ফাইনাল ইয়ারের একটা মেয়ে। ওর কয়েক বছর আগে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে বিলেতি বরের সাথে। এখন তুমি তাকে বিয়ে করতে চাও। তুমি কে? তুমি ইন্টার ফেইল, এক সময় নষ্টামি করে পাগল ছিলে এবং বিবাহিত বেকার। কোন বিবেকে তুমি বিয়ে করতে চাও তাকে? এটা কি স্বার্থপরের মতো চিন্তা না? বিশ্বাস করো বাবা, তোমার ব্যবসা থাকলে আমি নিজেই ভেবে দেখতাম। এখন আমার কোনো উপায় নেই৷ তুমি আমার ভাগ্নে এবং ইলির ভালো চাও এটাই আমার ভরসা। তুমি ইলির জীবন নষ্ট না করে ওকে বুঝিয়ে রাজি করাও।’
রাফসানের এই মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। নিজের মামার সঙ্গে এই প্রসঙ্গে কথা বলতেও অস্বস্তি লাগছে। তবে উনি ঠিকই বলেছেন। তার নিজেরই এখন অস্তিত্ব নেই। বিয়ে-শাদিও তার দ্বারা কি আর সম্ভব? তাহলে ইলির জীবনটা সে নষ্ট করবে কেন? ইলিকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আর তার জীবনটা বারংবার ভাঙ্গাগড়া, জোড়াতালির। এই জীবনের সঙ্গে ইলিকে জড়ানো যায় না। ইলির মতো অসাধারণ মেয়ের জীবন নষ্ট হতে পারে না। ওর মা-বাবা অবশ্যই ইলির ভালো চান। কীভাবে সুখী হবে। সে কীভাবে ভালো থাকবে অবশ্যই তারা জানেন। সেও চায় ইলি ভালো থাকুক। এবং অবিভাবকহীন এই জীবনে এখন এই মামা-চাচারাই তার মাথার ছায়া। এরাই বিপদে-আপদে তাকে আগলে রেখেছেন এবং রাখবেন। রাফসান আর ভাবতে গেল না। সে যা বুঝার বুঝে গেছে। আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘মামা আমি ইলিকে রাজি করানোর চেষ্টা করবো।’
তার গলা ধরে এলো৷ দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্না আটকাতে আটকাতে আবার বললো,
– ‘ইলি এতো সহজে রাজি হবে না মামা, ও একটু জেদি। প্লিজ ওকে মারধর করবেন না।’
লতিফ মিয়া শান্ত গলায় বললেন,
– ‘কীভাবে রাজি করাবে তুমি?’
– ‘আমি বাড়ি থেকে কোথাও চলে যাবো। আর মেসেজ দিয়ে যা বলার ইলিকে বলবো। বাকিটা আপনারা দেখবেন।’
– ‘কোথায় যাবে তুমি?’
– ‘সে চিন্তা করতে হবে না মামা।’
– ‘তাহলে ফোনে যোগাযোগ রাইখো। আমি এখন উঠি।’
রাফসানের আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সে ‘আচ্ছা’ বলে বিদায় দেয়।
তার ঠোঁট কাঁপছে। বারংবার চোখ ফেটে জল আসছে। তাড়াতাড়ি একটা ব্যাগে সবকিছু ভরে কাউকে কিছু না বলে বাইরে চলে যায়। মা-বাবার কবরের সামনে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তার কান্না পাচ্ছিল। আবার হাঁটতে থাকে দু-চোখ যেদিকে যায়। একটা হাওরের মাঝখানে গিয়ে আইলে বসে হোয়াটসঅ্যাপে ইলিকে মেসেজ দেয়,
– ‘ইলি তুই একদিন বলেছিলে না পৃথিবীতে কি স্বর্গসুখ পাওয়ার নিয়ম আছে? আসলে নেইরে। আমাদের মিলন হলে পৃথিবী বোধহয় স্বর্গ হয়ে যেতো। না না, ভুল বললাম। আমার সাথে জড়িয়ে কখনও তুই স্বর্গসুখ পেতি না। আচ্ছা যাইহোক, এতো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। হাত কাঁপছে। আমার লেখাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তবুও মূল কথাটা শোন। তুই হৃদকে বিয়ে করে নিস। প্লিজ ইলি। তুই হৃদকে বিয়ে করলে সুখী হবি৷ মামা-মামী সুখী হবেন। তোর সুখ দেখে আমিও সুখী হবো। ইলি আমাকে তুই একদম খুঁজবি না। আমি দূরে কোথাও চলে যাচ্ছি। তবে হ্যাঁ, যেখানেই থাকি তোর বিয়েতে ঠিক হাজির হয়ে যাবো। যতদিন পর্যন্ত তোর বিয়ে হবে না আমাকে তুই দেখতেও পাবি না। তোর বিয়ের আগপর্যন্ত আমি আর কখনও তোর কলও রিসিভ করবো না। পারলে ক্ষমা করিস। আমি তোর যোগ্য হতে পারলাম নারে ইলি। হৃদের মতো বড়ো লোকের সন্তান হলে হয়তো মামা-মামীরা আমার কাছে তোকে তুলে দিতেন। সব মা-বাবাই তো সন্তানের সুখ চায়। সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ চায়। ভালো থাকিস। ছোট্ট জীবনে আমি পদে পদে শুধু ভুল করেছি। তোর সাথে জড়ানো ছিল আমার আরেকটা ভুল৷ জানি তোর অনেক কষ্ট হবে ইলি। এই কষ্টগুলোর সাথে আমি খুব পরিচিত। এরা আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। তাই তোর ব্যথা আমি বুঝি। ক্ষমা করিস ইলি। অবশ্যই বিয়েতে রাজি হবি৷ বিয়ে করে সুখ-শান্তিতে তোর জীবন কাটুক।’
রাফসান মেসেজ পাঠিয়ে আবার হাঁটতে থাকে। এক জায়গায় বসলে অযথাই কান্না পায়। হাঁটতে ভালো লাগে। একটা গন্তব্য থাকলে আরও ভালো লাগতো। জীবন বহমান নদীর মতো। সময়ও বহমান। বসে থাকা জগতের নিয়মের বিরুদ্ধাচারণ। চলতে হবে, হাঁটতে হবে। রাফসানও হাঁটে, অবচেতন মনকে ধোঁকা দেয়ার জন্য ব্যস্ততা দেখানো। যেন তার গন্তব্য আছে। সে বসে নেই। তার অনেক কাজ। ঝিঁঝিঁ পোকারা ডাকছে। চোখ বারংবার ঝাপসা হয়ে আসছে কেন? এমনিতেই রাত, তাও যদি চোখ ঝাপসা হয় সে হাঁটবে কীভাবে? হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। কয়েক গ্রাম পেরিয়ে পেল একটা মসজিদ। ব্যাগটা পুকুরঘাটে রেখে হাত-মুখ ধুয়ে মসজিদের বারান্দায় ঢুকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রইল। খানিক পরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে। ফজরের আজানের সামান্য আগে স্বপ্নে দেখলো তার বাবা বিদেশ থেকে এসে বলছেন,
– ‘কিরে রাফসান, তোর বউ কই?’
সে আমতা-আমতা করে বললো, ‘তুমি হঠাৎ না জানিয়ে চলে এলে আব্বা। নিশিতা তো জয়নগর গেছে।’
– ‘বলিস কিরে? যা নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। বউকে এতো ঘনঘন বাপের বাড়ি দিতে নাই। শেষে শ্বশুড়বাড়িকে আপন ভাবতে পারবে না।’
তখনই কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে তাকে বললো,
– ‘এই মিয়া কি আপনি?’
রাফসান ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে চারদিকে তাকায়।
– ‘কে আপনি?’
রাফসান মানুষটিকে দেখে বুঝতে পারে মসজিদের মুয়াজ্জিন হবে। সে ব্যাগটা পেছনে নিয়ে বললো,
– ‘বকুল পুর বাড়ি।’
– ‘এখানে কি?’
– ‘এদিকে যাচ্ছিলাম। ঘুম পাইছিল তাই বারান্দায় শুয়ে পড়লাম।’
– ‘আপনার কথা কিছুই বুঝলাম না। আজানেরও সময় হয়ে গেছে যান অযু করে আসুন পরে শুনবো।’
রাফসান ব্যাগ নিয়ে বাইরে এসে সোজা হাঁটা শুরু করে। এতো জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ার ইচ্ছা তার নেই। এখন স্বপ্নটা মাথায় ঢুকে আছে। বাবা কি চাচ্ছেন নিশিতাকে ঘরে আনি? কিন্তু তার ভরণ-পোষণ সে দেবে কীভাবে? তবুও রাফসান এই মুহূর্তে ঠিক করলো জয়নগর গিয়ে ওর খোঁজ-খবর নেবে। নিশিতার সঙ্গে ভারী অন্যায় হয়েছে। কেবল সন্তান জন্ম দেবার অক্ষমতার কারণেই কি একটা মেয়ে এতোটা ফেলনা হয়ে যাবে? এতটাই তুচ্ছ কি নারী জন্ম? তা হতে পারে না। সে তখন সুস্থ ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে মেইন রাস্তায় আসে। ধীরে ধীরে আবছা অন্ধকারকে ভোরের আলো গিলে ফেলেছে। কিন্তু রাস্তায় মানুষ কিংবা গাড়ি নেই৷ সে হাঁটতে থাকে শেরপুরের উদ্দ্যশ্যে। শেরপুর আসতে আসতে গাড়ি চলাচল শুরু হয়ে গেল। সেখান থেকে বাসে করে চলে গেল জয়নগর। নিশিতার নানা বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো, কোন দ্বিধা, বিব্রতবোধ তার মাঝে উপস্থিত নেই। সোজা বাড়ির গ্রিলের দরজায় গিয়ে নাড়া দেয়। নিশিতার মামী এসে তাকে চিনে ফেললেন।
রাফসান সালাম দেয়।
তিনি অবাক বিস্ময়ে দরজা খুলে বললেন,
– ‘আরে আপনি এই ভোর বেলা।’
রাফসান কিছু না বলে আমতা-আমতা করছিল। ভদ্রমহিলা তাকে সামনের রুমে বসালেন।
রাফসান জড়তা কাটিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন করলো,
– ‘নিশিতা কোথায়?’
– ‘ও তো স্বামীর বাড়ি।’
রাফসান অবাক নয়নে তাকিয়ে বললো,
– ‘মানে?’
– ‘ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে।’
– ‘কোথায়?’
– ‘আমাদের মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের সাথে। উনার দ্বিতীয় স্ত্রী সে।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘আপনি বসুন। আমি চা-নাশতা দিচ্ছি।’
উনি চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। রাফসানের ভালো লাগছে না। আবার হাঁটতে হবে। কাউকে কিছু বলে যাবার মতো ভদ্রতা না দেখিয়ে সে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটতে থাকে মেইন রাস্তা ধরে। খানিক পর পর থেমে থেমে আকাশের দিকে কপাল ভাঁজ করে তাকায়। কেন তাকায় কে জানে। তবে বারংবার আকাশের দিকে তাকানোর অভ্যাস বাড়তে থাকে। গন্তব্যহীন হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে এক ব্যস্ত জনবহুল বাজারে। সেখান থেকে চলে গেল এক মাজারে। প্রতিদিন কত কত মানুষের সমাগম। কেউ আশা পূর্ণের জন্য আসে, কেউ আসে অভিযোগ নিয়ে, কেউ আসে সম্ভাব্য বিপদ থেকে বাঁচতে। রাফসানের কোনো উদ্দ্যশ্যে নেই। একটা শিরিষ গাছের বেশকিছু ডালে লাল কাপড়ের টুকরো বাঁধা৷ একটা কাক কা-কা করে উড়ে গেল। কুকুর কয়েকটা এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে। নানান ধরনের মানুষ আসা-যাওয়া করছে। সে ব্যাগে মোবাইলটা রেখে মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লো৷ ক্লান্ত শরীরে খানিক পরেই ঘুম এলো। ঘন্টা কয়েক পর হৈ-হুল্লোড় শুনে ঘুম থেকে উঠে মাথার নিচের ব্যাগটা আর খুঁজে পেল না। তবে এগুলো নিয়ে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। শিরনী বিতরণ হচ্ছে। মানুষজন হৈ-হুল্লোড় করে কলাপাতা মেলে ধরছে। তারও পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। এগিয়ে গেল লাইনের দিকে।
****
ইলির পাশে রহিমা বেগম শুয়ে আছেন। এখন রোজই তিনি ইলির পাশে ঘুমান৷ ইলির ছটফটানি টের পান। বোবা কান্নাও শুনতে পান। তিনি মাথায় বিলি কাটতে কাটতে সান্ত্বনার বাণী শুনান। তবুও ইলির অস্থিরতা কমে না৷ আজ গুনে গুনে এক সপ্তাহ হয়ে গেল ইলির চোখে ঘুম আসে না। কেবল একটা মেসেজ দিয়ে রাফসান ভাই হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল? তারও তো কিছু বলার থাকতে পারে। এমন তো কথা ছিল না। এরকম হলো কেন? প্রতিদিন ইলি কল দিয়ে মোবাইল বন্ধ পায়। মেসেজ দিলে সিন হয় না।
গতকাল রাত দু’টায় মেসেজ দিয়েছিল,
“বিচ্ছেদের বিষাক্ত ক্লেশে নীল হয় ব্যার্থ প্রেমিকার শহর,
তবু কোথাও সাঁটবে না তার চিত্ত কবরের খবর।”
বারবার হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে দেখে সিন হলো কি-না৷ প্রতিবারই আশাহত হয়।
অনিয়মের দিনকাল কাটছে। খাওয়া-গোসল, ঘুম সবকিছুতেই অনিয়ম।
মা-বাবার সারাক্ষণ প্যানপ্যানানি চলে। কি হয়েছে তোর? শুকিয়ে যাচ্ছিস সেদিকে কি খেয়াল আছে? রাতে ঘুমাস না কেন? চোখের নিচে যে কালি পড়ে যাচ্ছে দেখিস না?
ইলি কিছুই বলে না। কেবল শুনে। মাঝে মাঝে জানালার পাশটায় দাঁড়িয়ে থাকে। কালো ফিঙেটা এখন আর বাউন্ডারিতে এসে বসে না। অন্য কোথাও বসত গেড়েছে হয়তো। দিন এভাবেই যাচ্ছে। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। হয়তো আবার রাফসান ভাই ফিরে আসবে। যেভাবে আচমকা ইন্ডিয়া থেকে এসেছিল। অথবা হঠাৎ একদিন কল দেবে। অথবা ঘুম থেকে উঠে দেখবে মেসেজ সিন করেছে। শত শত মেসেজ দেখে রাফসান ভাই কি অবাক হবে না? মধ্য রাতের আবেগের বিরহের কবিতাগুলো পড়ে কি হাসবে? না-কি মুগ্ধ হবে?
আরও এক সপ্তাহ চলে গেল। আজ হৃদকে নিয়ে ওর মামা-মামীরা দেশে ফিরেছেন। ইলি ঘরে বন্দী জীবন-যাপন করছে। বাইরের কোনোপ্রকার খোঁজ-খবর সে রাখে না। মাঝে মাঝে খুব কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। প্রায়ই নিজেকে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছা করে।
আজ সন্ধ্যাবেলা ফ্লোরে পড়ে আছে ইলি। রুমের কোথাও পড়ে থাকা মোবাইলে মৃদু সুরে রবীন্দ্র সঙ্গীত বেজে চলেছে,
“ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে নারে…
রহিমা বেগম চা নিয়ে এসে রুমের বাতি জ্বালিয়ে চমকে উঠলেন। ইলি ফ্লোরে পড়ে আছে। ওর হাত থেকে ভেসে যাচ্ছে রক্ত।
তিনি হাঁটু ভাঁজ করে ফ্লোরে বসে ডাকলেন। ইলি কেবল ঠোঁট নাড়ালো। তাড়াতাড়ি একটা ওড়না দিয়ে ওর হাত বেঁধে লতিফ মিয়াকে ডাকলেন। গাড়ি এনে সদর হাসপাতালে নেয়া হলো। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের পরও মরতে মরতেও বেঁচে গেল ইলি।
কিন্তু লতিফ মিয়া আর রহিমা বেগম মহাবিপদে পড়েছেন। ইলির কাঁটা হাত দেখলে ওর মামা-মামীরা কি ভাববেন? ওরা প্রতিদিন কল দিয়ে যেতে বলেন। সকল চিন্তা ইলিই দূর করলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ইলির মনে হলো রাফসান ভাই বলেছিল বিয়ের দিন আসবে৷ তখন শেষ কথাগুলো বলবে সে। সকল অভিযোগ শুনিয়ে অভিমান করে চলে যাবে অন্যের ঘরে। তবুও তো রাফসান ভাই ফিরে আসবে? দেখা হবে? সে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিলো, – ‘তুমি বলেছিলে যেখানেই থাকো আমার বিয়ের দিন তুমি ঠিক হাজির হয়ে যাবে। জানি না কীভাবে বিয়ের খবর পাবে৷ তবে আমার বিশ্বাস তুমি কথা রাখবে। আমিও হৃদের কাছেই বিয়ে বসবো রাফসান ভাই।’
মেসেজটা পাঠিয়ে সে বারংবার হোয়াটসঅ্যাপে উঁকি দেয়। কিন্তু না, রাফসান ভাই আর মেসেজ সিন করে না।
ইলি ঘরে জানিয়ে দিলো সে বিয়েতে রাজি৷ ক্ষতস্থান ঢাকতে সব সময় পরে থাকে ফুলহাতা কামিজ।
বিয়ে ঠিক হলো আগামী শুক্রবারে। বাড়ি ভর্তি মেহমান আসতে শুরু করেছে। কেনা-কাটা সব চলছে। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোনো কিছুর ক্ষমতি রাখছেন না লতিফ মিয়া৷
বিয়ের দিন ভোর থেকে ইলি চারদিকে শুধু একজন মানুষকেই খুঁজে। বন্ধ মোবাইলে বারংবার কল দেয়। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ সিন হলো কি-না দেখে৷ কিন্তু বারংবার আশাহত হয়। এক সময় বিয়ের পীড়িতে তাকে নিয়ে বসানো হয়। ইলি মানুষের ভীড়েও চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। চোখ দু’টো কেবল একজন মানুষকে খুঁজে। কথা দিয়েছিল আসবে। অবশ্যই আসবে। কিন্তু কই সে? কখন সামনে এসে দাঁড়াবে। কখন দেখতে পাবে সেই প্রিয় মুখ? হয়তো লুকোচুরি খেলছে। উকিল বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার আগপর্যন্ত সামনে না আসার পণ করেছে। উকিল বিয়ে পড়ালেন৷ ইলি ঘোরের মধ্যে থেকেই কবুল বলে দেয়। কাগজে সই করে। মাথা তুলে তাকায়। কই সে? আসে না কেন? কথা দিয়েছিল তো যেখানেই থাকে বিয়ের দিন ঠিক সামনে এসে দাঁড়াবে। ইলিকে গাড়িতে তোলা হলো নিয়ে। সে বারংবার পেছন ফিরে তাকায়। অসংখ্য মুখ, চেনা-অচেনা। কিন্তু সে নেই, এলো না। শেষ কথাটিও রাখেনি। ইলি হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গেল রুমের দিকে। সবাই অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল ওর ছুটে যাওয়া দেখে। বের হলো হাতে একটা দেশলাই নিয়ে। তাকে ধরে গাড়িতে তোলা হলো। গাড়ি ছুটলো শা শা করে। রাতে বরকে বিছানায় রেখে বারংবার বেলকনিতে ছুটে যায় ইলি। চারদিকে তাকায়। সে আসে না কেন? হাতের মুঠোয় এখনও দেশলাই। তার ছেলেমানুষীকে গুরুত্ব দিয়ে সেদিন এই দেশলাইটা হাতে তুলে দিয়ে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল রাফসান। সেদিন প্রথম মুখ ফুটে বলেছিল, ‘পৃথিবীতে এখন আমার সবচেয়ে আপন মানুষ কেউ থাকলে তুই আছিস ইলি। আমার প্রকৃত আপন মানুষ। এই একাকীত্বের দিনে তুই ছাড়া কে আমাকে এতো সঙ্গ দিচ্ছে বল?’
কিন্তু আজ ইলিকে অন্যের হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে কোথায় সে একা দিন যাপন করছে?
কে তাকে সঙ্গ দেবে? কেন সে এলো না?
ইলির গাল বেয়ে জল পড়ে।
কাঁধে কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখের জল লুকিয়ে তাকায়। পেছনে এসে হৃদ দাঁড়িয়েছে,
– What happened? You can share with me..
ইলি ভেজা গলায় বললো,
– ‘তুমি যাও আমি আসছি।’
হৃদ চলে গেল। ইলি মোবাইল বের করে আবার রাফসানকে মেসেজ দেয়, ‘জানো রাফসান ভাই? গত পরশু ভোরেও আমার জানালায় দু’টা চড়ুই পাখির মিলন দেখলাম। তাদের এসবের জন্য খুব বেশি আয়োজন, প্রয়োজন, অনুষ্ঠান লাগে না। মাঝে মাঝে দেখি ডোবায় ভেসে বেড়ানো হাঁসেরা সঙ্গম করছে। তাদের খুব বেশি নিশ্চয়তার, নির্ভরতার প্রয়োজন হয় না। এতটুকুতেই দু’জন কেমন এক হয়ে যায়। মানব জীবন এতো কঠিন কেন? এখানে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে মিলনের মাঝখানে থাকে পাহাড় সম বাঁধা। চাইলেই মিলন হয় না। কখনও, কখনও পুরো জীবনভর দু’জনের দেখাও হয় না। কি বিচ্ছিরি ধরনের বিষাদের জীবন। দু’টা মনের মিলন হলো, অথচ তাদের দেহের মিলন হলো না? পাশাপাশি থাকা হলো না? কে বলে মানব জীবন সুখের! পৃথিবীতে মানুষ থেকেও কোনো দুঃখী প্রাণী কি থাকতে পারে রাফসান ভাই? তুমি এই মেসেজ দেখবে কি-না জানি না। তুমি কোথায়, কি করছো কিছুই জানি না৷ আর কখনও দেখা হবে কি-না তাও জানি না৷ কিন্তু তুমি তো চাইতে আমি হৃদের সঙ্গে সংসার করি। সুখে-শান্তিতে থাকি। জানি না তোমাকে ছেড়ে কীভাবে আমি ভালো থাকবো। তবুও আমি চেষ্টার ত্রুটি করবো না।’
পরিশিষ্ঠ:
আঞ্চলিক নিয়মানুযায়ী আড়াই দিন পর ইলিরা ‘ফেরা যাত্রায়’ বকুল পুর যায়৷ রহিমা বেগমের মানত ছিল বিয়েটা ঠিকঠাক হলে হামিদ শা’র মাজারে শিরনী দেবেন। এই মাজারে এর আগে বহুবার তিনি শিরনী দিয়েছেন। গাড়ি করে তারা সকল মাজারে গেলেন। লাইন ধরে ফকির-সন্ন্যাসী আর পাগলরা দাঁড়িয়েছে। রহিমা বেগম হৃদের হাতে কলাপাতার বান্ডিল দিয়ে বললেন সবাইকে দিতে। সে বিব্রত ভঙ্গিতে একে একে সবাইকে দেয়। লতিফ মিয়া শিরনীর তাগারি ধরে ইলির হাতে চামচ দিলেন। ইলি একজন একজন করে সবার কলাপাতায় শিরনী দিয়ে আচমকা আঁতকে উঠে। চামচ হাত থেকে পড়ে যায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাফসান। উস্কোখুস্কো চুল। মুখ ভর্তি দাঁড়ি। গায়ে ময়লা কাপড়।
ইলি অস্ফুটে বললো, ‘রাফসান ভাই।’
সে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে কলাপাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যেন ইলিকে চিনতেই পারছে না।
—–সমাপ্ত—-