দেশলাই – ২২ পর্ব
সরু রাস্তায় এখন আর ভীড় নেই। ঝর্ণার পানির কলকল শব্দ আরও তীব্র হয়েছে। গাইড রাস্তার পাশে আরাম করে বসে বিড়ি টানছে।
রাফসান কাছে গিয়ে বললো,
– ‘কি মামা ডাকলেন না যে?’
– ‘খুঁইজা পাইলাম না তো।’
– ‘আমরা টিলায় ছিলাম। চলুন এবার যাওয়া যাক।’
গাইড তাদের নিয়ে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আবার ঝর্ণার সম্মুখের ঝিরিপথ নামে। এদিকটায় অধিক পাথর। ইলি রাফসানের হাত ধরে পা টিপে টিপে হাঁটছে। ঝর্ণার পানির তীব্র গর্জন শোনা যাচ্ছে। কেমন একটা ঘ্রাণও নাকে ভেসে আসছে। খানিকটা পথ এগুতেই ইলি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে উত্তেজনায় ‘ওয়াও’ বলে লাফিয়ে উঠে।
চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক আশ্চর্য দৃশ্য। পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠেছে।
এভাবেই পাহাড়ের ডাকে হাঁটতে হাঁটতে একসময় তারা পৌঁছে যায় প্রিয় গন্তব্য হামহাম জলপ্রপাতের কাছাকাছি। বেশ খানিকটা আগে থেকেই কানে আসছিল হামহাম জলপ্রপাতের গর্জন। এখন দেখা যাচ্ছে প্রায় ১৬০ ফুট ওপর থেকে আসা জলপ্রপাতের এক অপূর্ব দৃশ্য। প্রচণ্ড গতিতে নিচের পাথরের ওপর গড়িয়ে পড়ছে ঝর্ণার পানি। পাথরের আঘাতে জলকণা বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে তৈরি করেছে কুয়াশা। সেগুলো ধোঁয়ার মতো উপরের দিকে ভেসে উঠেছে৷
– ‘দারুণ লাগছে তাই না ইলি?’
– ‘হ্যাঁ অনেক। আমি নামবো পানিতে।’
– ‘হ্যাঁ নামতে তো হবেই।’
রাফসান পাথরের ওপর তার ব্যাগটি রাখে। ছেলে-মেয়েরা লাফিয়ে পড়ছে পানিতে। ঝর্ণার সম্মুখের জলে পাথর নেই। কাচের মতো সচ্ছ শীতল পানি।
রাফসানকে রেখেই ইলি একা একা নেমে সাতার কেটে জলপ্রপাতের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু খানিক এগিয়ে দাঁড়াতেই পাথরে ঝর্ণার আছড়ে পড়া পানির কণা ইলিকে যেন ধাক্কাতে শুরু করে। চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছে না। শ্বাসও যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নাকে-মুখে আছড়ে পড়া জলকণার ঠান্ডা ছাট ভিজিয়ে দিচ্ছে।
রাফসান ব্যাগ রেখে পানির কাছটায় গিয়ে চারদিকে তাকায়।
কেমন শিতল শান্ত পরিবেশ। ডানে বামে কোনোদিক থেকেই চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে অনন্তকাল দু’চোখ ভরে দেখে গিলে নিই প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টি। এই অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে ভুলে যাচ্ছে সে কোথায় আছে, চারদিকে গহীন জঙ্গল, উপরে আকাশ, পায়ের নিচে বয়ে যাওয়া ঝির ঝির স্বচ্ছ পানির ধারা আর সামনে বহমান অপরূপ ঝর্না।
আয়নার মতো স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের শরীর বেঁয়ে আছড়ে পড়ছে বড়ো বড়ো পাথরের গায়ে। গুড়ি গুড়ি জলকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। বুনোপাহাড়ের ১৫০ ফুট উপর হতে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে সামনের ডোবায়। চারিপাশে গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারো প্রজাতির লতাগুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ি শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভুমিতে। রাফসান সবকিছু বুঁদ হয়ে দেখছিল। কিন্তু আচমকা ধাক্কা খেয়ে পড়লো গিয়ে পানিতে৷ পেছনে কেবল শুনতে পেল ঝর্ণার পানির কলকল শব্দের মতো হাসি। পানি থেকে সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায় ভেজা কাপড়ে হাস্যজ্বল এক মায়াবিনীকে। রাফসান মুখ মুছতে মুছতে বললো, ‘এটা কি করলি?’
ইলি হাসতে হাসতেই জবাব দেয়,
– ‘তুমি নামছিলে না তাই।’
– ‘দাঁড়া এখানে তোকে কি করি দেখ।’
রাফসান লাফ দিয়ে কিনারায় উঠে। ইলি খিলখিল করে হাসতে হাসতে পা টিপে টিপে এদিক-ওদিক দৌড়াতে থাকে। কিন্তু খানিক যেতেই সামনে শুধু পাথর৷ দৌড়ানো আর সহজ হচ্ছে না। ইলি বারবার বলছে, ‘রাফসান ভাই আমি পড়ে যাবো। আমার পিছু ছাড়ো।’
– ‘তাহলে থাম।’
– ‘তুমি পানিতে নিয়ে ফেলবে।’
– ‘তা তো ফেলবোই।’
ইলি আগের মতো দৌড়ায়। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারে না। রাফসান পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে শুন্যে তুলে নেয়। ইলি হাপাচ্ছে আর ছাড়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করছে। কিন্তু রাফসান তাকে নিয়ে যাচ্ছে পানির দিকে।
মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো অন্যরা তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। দৃশ্যটি দেখে রাফসান ইলিকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– ‘যা ছেড়ে দিলাম।’
ইলি গিয়ে পাথরে বসে হাপাতে থাকে। রাফসান নেমে যায় পানিতে। অন্য সবার সঙ্গে সাঁতার কাটতে থাকে। মাঝে মাঝে জলপ্রপাতের সামনে যতটুকু যাওয়া যায় গিয়ে চোখবুঁজে পানির ছাট নিচ্ছিল। দারুণ লাগে নাকে-মুখে এসে পড়লে।
আবার জলপ্রপাতের দিকে এগিয়ে যায় রাফসান। হাত মেলে চোখবুঁজে দাঁড়ায়। পুরো শরীরে এসে আছড়ে পড়ছে জলকণা। ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো শরীর। হঠাৎ কারও স্পর্শে চোখ মেলে তাকাতেই পানির ছাট চোখ বন্ধ করে দেয়।
– ‘ইলি তুই..
কথা বলতেই মুখে ঢুকে গেল পানি। ‘থু-থু’ করে বামদিকে ফেলে। ইলি রাফসানের সামনের দিকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। পাথরের আছড়ে পড়া জলকণা পড়ছে এসে ইলির পিঠে। তার চোখ মেলে তাকাতে বা কথা বলতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তবুও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখবুঁজে আছে৷ পিঠে শীতল পানি বেয়ে যাচ্ছে।
রাফসান দুই হাত সামনে নিয়ে জলকণা ফিরিয়ে বলল, -‘লোকজন দেখছে ইলি ছাড়।’
– ‘সবাই সাতার কাটছে। ওরা আমাদেরকে চিনেও না। তাছাড়া এসব জায়গায় প্রেমিক-প্রেমিকা, হাসবেন্ড-ওয়াইফ এগুলো করে।’
– ‘তবুও ছাড় ইলি।’
– ‘প্লিজ, চোখবুঁজে থাকো। আমাকে স্বর্গ সুখ থেকে বিতাড়িত করতে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছ।’
রাফসান হাত দিয়ে ছাড়াতে যাচ্ছিল। ইলি আরও শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ রেখেই ওর গালে নিজের নাক ঠোঁট দিয়ে ঘষতে থাকে।
– ‘ইলি করছিস কি কেউ দেখবে তো।’
– ‘তাহলে চুপচাপ আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো প্লিজ।’
– ‘কি বলছিস এগুলো?’
ইলি চোখ মেলে সতর্কভাবে সামনের লোকগুলো দেখে ওর ঘাড়ের চুল খামচে ধরে গালে গাল ঘষে বলে,
– ‘কেন বিয়ে হয়নি বলে তো? যাও বলে দিচ্ছি কবুল কবুল কবুল। এখন আর এতো নিষেধ নেই।’
রাফসান হেঁসে ফেললো। তারপর অসহায়ভাবে বলে, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না ইলি ছাড়।’
ইলি গাল ফুলিয়ে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– ‘কত অজুহাত, যাও লাগবে না।’
ইলি ছেড়ে দিয়ে পানিতে নেমে সাঁতার কেটে যেতে থাকে। রাফসাম যায় পিছু পিছু।
– ‘ইলি কি হলো গাল ফুলিয়ে চলে যাচ্ছিস কেন?’
ইলি কোনো জবাব দিলো না। সে একা একা বুক সমান পানিতে সাঁতার কাটতে থাকে। রাফসান তাড়াতাড়ি গিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে। ইলি উল্টো হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে পানি ছিটা দিতে থাকে। রাফসান চোখ মেলতেও পারে না। ইলি খিলখিল করে হাসছে। রাফসান বুদ্ধি করে পানিতে ডুব দিয়ে গিয়ে পেট জড়িয়ে ধরে উপরে তুলে পানিতে ছেড়ে দেয়। নাকে-মুখে পানি ঢুকে কাশি উঠে ইলির। রাফসান হাসতে থাকে। ইলি দাঁত কটমট করে তেড়ে যায়। রাফসান সাঁতার কাটতে থাকে। ইলি ধরে ফেলে পায়ে। ওর সাঁতারের গতি কমে আসে। ইলি বেয়ে বেয়ে কোমর থেকে উপরে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে কামড় দেয়। রাফসান আর্তনাদ করে উল্টে গিয়ে ইলিকে নিচে ফেলে দেয়। কিন্তু আবার কোমর জড়িয়ে পেট কামড়ে ডুব দিয়ে দূরে সরে যায়। রাফসান রাগান্বিত হয়ে তাড়া করে। ইলি এক ডুবে চলে যায় অন্য মানুষদের মাঝখানে। রাফসান মাথা তুলে চারদিকে তাকাচ্ছে। ইলি একা একা দূর থেকে হাসছে। হঠাৎ দেখে এদিকে আসতে থাকে। ইলি আবার ডুব দিয়ে জলপ্রপাতের দিকে ইচ্ছে করে ছুটে যায়। সাঁতার কেটে গিয়ে জলপ্রপাতের সামনে হাত মেলে দাঁড়িয়ে চোখবুঁজে একা একা জলকণার শীতল ছাট নিতে থাকে। খানিক পর আচমকা ইলি ঘাড়ের দিকে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। বুঝতে পারে রাফসান প্রতিশোধ নিচ্ছে। ইলি চুপচাপ ব্যথা সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিক্রিয়া না পেয়ে রাফসানের বোধহয় একটু রাগই হলো। সে আবার একটু জোরে কামড় দেয়। ইলির ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি এসে যায় তবুও প্রতিক্রিয়া দেখায় না৷ রাফসান রেগেমেগে ইলির মতোই সামনে গিয়ে কোমর জড়িয়ে পেটে নাক ডুবিয়ে কামড় দেয়। ইলি যন্ত্রণায় দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে। রাফসান দাঁড়িয়ে হাত সরিয়ে দেখে কাঁদছে ইলি। অবাক হয়ে বলে, ‘ওমা, এমন ভাব নিচ্ছিলি যেন লাগছেই না তোর। এখন কাঁদছিস কেন?’
ইলি জবাব না দিয়ে আবার মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকে।
– ‘কিরে বেশি ব্যথা পেয়েছিস?’
ইলি আচমকা জড়িয়ে ধরে রাফসানকে। পানির ছাট এসে চোখে-মুখে পড়ে। কথা বলার জন্য ইলি রাফসানের চওড়া বুকে লুকিয়ে বলে, ‘হুম ব্যথা পেলেও সহ্য করেছি।’
– ‘কেন?’
– ‘তুমি তো ব্যথা দেবার জন্যই কামড় দিয়েছো। আদর করে তো দেবে না।’
– ‘তাই বলে কামড়ের সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠবি না? তুই নড়লেও আমি ছেড়ে দিতাম৷ এমন ভাব করছিলি যেন কিছুই টের পাচ্ছিস না।’
ইলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘ব্যথাই লাগুক। তবুও তো তোমার ছোঁয়া।’
– ‘কি বলিস এগুলো? সিরিয়াসলি না-কি কোনো উপন্যাস বা সিনেমা দেখে ন্যাকামো করছিস?’
ইলি মাথা তুলে আহত চোখে তাকিয়ে বলে, ‘এমন মনে হয় কেন তোমার? মানুষ কি প্রেমের জন্য মরে না? তাহলে আমি প্রিয় মানুষের স্পর্শের জন্য সামান্য ব্যথাও সহ্য করতে পারবো না কেন? তোমার মতো কি সবাই অনূভুতিহীন রোবট হয়ে গেছে?’
রাফসানের বুকটা যেন শিরশির করে। হাত বাড়িয়ে ইলির মুখটা আঁজলা করে ধরে চোখের দিকে তাকায়।
– ‘আল্লা জানেন ইলি তোর কপালে কতো দুঃখ আছে। গোপনে এতো ভালোবেসে যে ফেললি। এর পরিণতি কি শুভ হবে?’
– ‘তুমি পুরুষ মানুষ হয়ে মেয়েদের মতো আচরণ করছো রাফসান ভাই।’
– ‘কীভাবে?’
– ‘কিছু না।’
– ‘শক্ত হ ইলি৷ বাড়িতে গিয়ে দেখ হৃদের সাথে বিয়েও ভেঙে দিতে পারবি না।’
– ‘তো কি হয়েছে? সেই ভয়ে কি এমন সুন্দর জায়গায় এসে প্রিয় মানুষকে পাশে রেখেও গোমড়ামুখো হয়ে থাকবো।’
– ‘সেটা না, তুই খুশিতে যতো বেশি উড়ছিস। সেখান থেকে নিচে পড়লে ঠিক ততটাই ব্যথা পাবি। তাই আগে বাড়িতে গিয়ে দেখ বিয়ে ভেঙে দিতে পারিস কি-না৷ আর তুই তো এমন ছিলি না কখনও৷ কত বুদ্ধিমান, বুঝমান, ম্যাচিউর মেয়ে। এখন এতো দূর্বল হয়ে যাচ্ছিস কেন?’
ইলি রাফসানের কথাগুলো শুনে মুচকি হেঁসে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বললো,
– ‘ইশ, আমার বরটা কত সুন্দর করে বুঝায়।’
দেশলাই – ২৩ পর্ব
রাফসান ওর মাথায় গাট্টা মেরে বলে, ‘আবার একই কাজ করলি কেন? ছাড় আমাকে।’
ইলি ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘অনেক ক্ষুধা লেগেছে চলো কিছু খাই।’
– ‘এখানে খাবার পাবি কোথায়?’
– ‘আছে জনাব৷ আমি জায়গাটার রিভিউ পড়েই এসেছি৷ না হয় আমার হবু বরটাকে এই জঙ্গলে নিয়ে আসতাম না।’
– ‘এমনভাবে বলছিস যেন আমি মেয়ে, আমাকে তোর দেখভাল করতে হবে।’
ইলি ফিক করে হেঁসে ফেলল।
– ‘আচ্ছা চলো। গাইডকে গিয়ে বললেই দোকানে নিয়ে যাবে।’
দু’জন আবার সাঁতার কেটে কিনারায় আসে। ইলি ভেজা কাপড় আর চুল খানিকটা ঝেড়েমুছে মাথা তুলতেই দেখে রাফসান পরনের গেঞ্জি খুলে চিপা দিয়ে পানি ফেলছে। পেশি টানটান হয়ে আছে৷ বাইসেপে গালের টোলের মতো গর্ত। ঘাড়ে এবং পেটের এক পাশে ভেসে উঠেছে কামড়ের লাল দাগ।
– ‘ইশ, দাগ পড়ে গেছে।’
রাফসান মাথা তুলে তাকিয়ে বললো, ‘একা একা কি বিড়বিড় করছিস?’
– ‘তোমার পেটে দেখো কামড়ের দাগ পড়ে গেছে।’
– ‘পড়বে না? তুইতো..।’ এটুকু বলে থামে, ‘থাক, কিছু বললাম না।’
– ‘কি বলবে বলো।’
– ‘না।’
– ‘আবার কামড় দেবো কিন্তু।’
– ‘দিলেও বলবো না। চল গাইডকে নিয়ে দোকানে যাই।’
– ‘আচ্ছা চলো।’
গাইড গাছের ছায়ায় পাথরের ওপরে বসা। রাফসান গিয়ে বললো, ‘মামা এখানে না-কি খাবার দোকান আছে?’
– ‘হ আছে, তবে দাম বেশি রাখে।’
– ‘কি কি পাওয়া যায়?’
– ‘ডিম, বিরিয়ানি, চা বিস্কিট এগুলা পাওন যায়।’
– ‘চলুন তো, খেতে হবে আমাদের।’
গাইড তাদেরকে নিয়ে পাশের টিলার দিকে হাঁটতে থাকে।
– ‘ইলি তুই বিরিয়ানি খাওয়ার দরকার নাই৷ শুধু ডিম খাবি আর চাইলে চা বিস্কিট।’
– ‘ওমা কেন?’
– ‘এখানকার রান্না বুঝছ তো। তোর পেটে সমস্যা করতে পারে।’
– ‘তুমি খাবে?’
– ‘হ্যাঁ।
– ‘তোমার সমস্যা করবে না? শুধু আমার করবে?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কেন?’
– ‘এতো কথা বলিস না তো৷ আমি সিগারেট খাই, তুই গন্ধও নিতে পারিস না। আমার সাথে তোর তাল ধরলে হবে?’
– ‘রেগে যাও কেন?’
– ‘রাগিনি।’
তারা জলপ্রপাতের পাশের একটা টিলাতে এসেই দোকানটি পেয়ে গেল৷ বন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি দোকান। আরও কয়েকজন বাঁশের বেঞ্চে বসে খাচ্ছে। এক পাশে জ্বলছে ইটের তৈরি উনুন। তারা বসার মতো জায়গা পেলো না।
– ‘আমরা তিনজনকে দুইটা করে ডিম দেন তো।’
তারপর গাইডের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘মামা আপনি ডিমের সাথে বিরিয়ানি খান।’
– ‘না, খালি ডিমই লন। পরে চা খামু। আপনেরাও চা খান, হাঁটাহাঁটি করছেন তো চা খাইলে শরীরের ব্যথা যাইব।’
– ‘হ্যাঁ, তা ঠিক বলছেন।’
ইলি রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি হলো? তুমি না বিরিয়ানি খাবে বললে?’
– ‘তর্কের জন্য বলেছি। মানে আমি খেলেও তোর খেতে হবে এমন ভাবনা যেন না আসে।’
– ‘বুঝিনি।’
– ‘বুঝতে হবে না।’
– ‘রাগ করলে না-কি? তুমি বিরিয়ানি খাও। মামা ওকে বিরিয়ানি দিয়েন।’
– ‘আরে না, এমনিই খাব না। মামা দিয়েন না।’
দোকানি তাদেরকে দু’টা করে ডিম দেয়। বসা লোকগুলোর সামনে ভেজা কাপড়ে ইলি বিব্রতবোধ করছিল। রাফসান বোধহয় বুঝতে পারলো।
– ‘মামা একটা পলিথিনের ব্যাগ দেন তো।’
দোকানী ব্যাগ বাড়িয়ে দেয়। রাফসান নিজের ডিম ব্যাগে রেখে ইলিকে বললো,
– ‘এখানে রাখ।’
– ‘কেন?’
আঙুল দিয়ে নিচের দিকে দেখিয়ে বললো,
– ‘ডিম ঐখানে গিয়ে পাথরে বসে খাওয়া যাবে। এখন চা খেয়ে চলে যাই।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘মামা চা দেন দুইটা। আর আমাদের এই মামাকে পরে দিয়েন।’
রাফসান চা খেয়ে বিল দিয়ে গাইডকে বললো,
– ‘আপনি আসুন আমরা ওইখানে আছি।’
– ‘আইচ্ছা যান।’
ইলিকে নিয়ে রাফসান এসে গাছের ছায়া দেখে পাথরে বসে৷
– ‘ওইখান থেকে চলে আসলে কেন?’
– ‘তুই যা স্লো। দুইটা ডিম খেতেই সারাদিন যেতো।’
– ‘তো এখানে কি তাড়াতাড়ি হবে?’
– ‘এতো কথা বলিস ক্যান? এখানে বসে আরাম করে খেতে পারবি। তাছাড়া ছেলেগুলো কীভাবে তাকাচ্ছিল দেখিসনি তো।’
ইলি সবই দেখেছে৷ তবুও বললো, -‘কীভাবে তাকাচ্ছিল? আমি তো খেয়াল করিনি।’
– ‘তাকায় আবার কীভাবে? ডিম খা।’
– ‘খাব তো। কিন্তু ওরা তাকাবে কীভাবে? আমার পেছনে ছিল তো ওরা।’
– ‘সামান্য ব্যাপার টেনে লম্বা করা তোর অভ্যাস। ভেজা কাপড় ছিল৷ পেছনে সেঁটে আছে৷ তাই ছেলেদের তাকাতে ভালো লাগছিল।’
– ‘ওমা, পেছনেও ছেলেরা এভাবে তাকায়?’
– ‘হ্যাঁ তাকাবে না। তুই সামনে দাঁড়ানো।’
– ‘হ্যাঁ, তাও ঠিক। ওরা তো আর তোমার মতো রসকষহীন পাথর না।’
– ‘হ্যাঁ আমি পাথর, রোবট৷ এবার খেয়ে মুখটা বন্ধ কর।’
ইলি ভেতরে ভেতরে হাসছে৷ তবুও ইচ্ছে করে বললো, ‘বুঝি না রাফসান ভাই৷ তুমি আমাকে কেন জানি একদম সহ্য করতে পারো না। কথা বললেই তুমি বারবার রেগে যাও।’
– ‘কি বলিস এগুলো? আমি তোকে সহ্য করতে পারবো না কেন?’
– ‘তাহলে এভাবে কথা বলো কেন? তাছাড়া বারবার বলছো মুখবন্ধ করতে। তোমার এতো অসহ্য লাগে কেন আমারে? সামান্য কথা শুনলেও যেন তোমার শরীর জ্বলে।’
– ‘আরে তুই এভাবে নিচ্ছিস কেন? আমি শুধু বলছি বকবক বন্ধ করতে।’
– ‘আমি বকবক করি? তুমি সব সময় আমাকে এমন বাজে কথা বলো। আমি কি মানুষ না? আমার সাথে তুমি এতো বাজে আচরণ করো, তবুও আমি কিছু বলি না।’ কথাটি বলেই ইলি ব্যাগে ডিম রেখে পেছনের পাহাড়ি পথের দিকে যেতে লাগলো।
রাফসান বোকার মতো খানিক্ষণ তাকিয়ে রইল। সে ভেবে পাচ্ছে না সামান্য ব্যাপারটা কোনদিকে চলে গেল।
– ‘ইলি কোথায় যাচ্ছিস?’
– ‘তোমার কাছ থেকে দূরে যাচ্ছি৷ আমি পাশে থাকলে গা জ্বলবে তোমার, কথা বললে বকবকানি হয়ে যাবে।’
– ‘ইলি দাঁড়া, আমি এভাবে বলতে চাইনি।’
রাফসানও ডিম ব্যাগে রেখে তাড়াতাড়ি ফেরাতে গেল। ইলি এতোক্ষণে খানিকটা আড়ালে গিয়ে একটা গাছের শেকড়ে মুখ ভার করে বসে থাকে৷ রাফসান তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে হাত ধরে টেনে তুলতে তুলতে বললো, ‘বিশ্বাস কর ইলি, তুই কষ্ট পাবি আমি ভাবিনি।’
ইলি টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে খানিক দূরে গিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি কষ্ট পাবো কেন। আমি তো মানুষই না। আমি সস্তা নির্লজ্জ মেয়ে। তোমার জন্য পাগল হয়ে আছি৷ তাই যা ইচ্ছে বললেও কষ্ট পাবো না।’
রাফসানের এবার নিজের কাছেই খারাপ লাগে। সত্যিই বোধহয় সে একটু কাঠখোট্টা হয়ে গেছে। নিজের লাগাম টেনে ধরা উচিত। ইলিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘সরি ইলি, আর কখনও একরকম করে কথা বলবো না। আমি আসলে বুঝিনি কথাগুলো তোকে এভাবে কষ্ট দেয়।’
ইলি ধীরে ধীরে ঘুরে ওর চোখে চোখ রাখে। তারপর আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে অস্ফুটে বলে, ‘আমার বরটা।’
রাফসানের পুরো শরীরের লোম নাড়া দিয়ে উঠে। ইলি তার বুকের ধুকপুক শুনতে পায়। পিঠে হাত নিয়ে আলগোছে জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ইলি মাথা তুলে তাকায়। তারপর কাঁপতে থাকে পুরো শরীর। রাফসানের গলায় গালে নাক ঘষতে থাকে। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় মুখ।
– ‘ইলি করছিস কি?’
রাফসানের মুখটা আঁজলা করে ধরে জল ছলছল চোখে তাকায়।
– ‘কি করছি আমি?’
– ‘এগুলো ঠিক হচ্ছে না ইলি।’
– ‘কেন ঠিক হবে না? শুধু তুমি চাইলে পৃথিবীর এমন শক্তি নেই আমাদের বিয়ে ঠেকানো। দেইখো ঠিকই আমি তোমাকে পাবো।’ কথাটি বলে আবার জড়িয়ে ধরে, ‘শুধু তুমি চাইলেই হবে রাফসান ভাই।’
– ‘ছাড় ইলি, আগে বিয়ে হোক।’
– ‘ছাড়বো কেন? কেন ছাড়বো বলো?’
– ‘পাপ হবে ইলি।’
– ‘হবে না পাপ। একটুও পাপ হবে না। তুমি আমার বর। আমার বৈধ পুরুষ।’
– ‘কেন এতো আবেগি হয়ে যাচ্ছিস বল তো?’
– ‘জানি না।’
ইলি ওর বুকে মাথা রেখে পরম শান্তিতে চোখবুঁজে ছিল। আচমকা রাফসান তাকে ধাক্কা দিয়ে সরায়। চমকে যায় ইলি। তাকে স্বর্গ সুখ থেকে হঠাৎ কেন বিতাড়িত করা হলো? পরক্ষণেই দেখে রাফসান টিলা থেকে দৌড়ে নামছে। ইলি তাড়াতাড়ি পিছু পিছু নামে। রাফসান একটা ছেলেকে তাড়া করছে।
– ‘এই শুয়োরের বাচ্চা দাঁড়া, দাঁড়া বলছি।’
ছেলেটি না দাঁড়িয়ে পাথরের ওপর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। রাফসান আচমকা পায়ে ল্যাং মারে। ছেলেটি মুখ থুবড়ে গিয়ে পড়ে পাথরে। তার হাতের মোবাইল ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে। রাফসান তাড়াতাড়ি গিয়ে মোবাইলটা হাতে নেয়। রাগে ছুড়ে ফেলে পানিতে। খানিকদূরে ছিল ছেলেটির সঙ্গী আরও দু’জন। তারা তেড়ে এসে বললো, ‘মোবাইল ফেললি কেন? কি সমস্যা?’
– ‘মোবাইল ফেলবো না? ভিডিয়ো করবে কেন?’
– ‘ভিডিয়ো করবে না? বনেবাদাড়ে মাইয়া নিয়ে আকাম করে বেড়ালে পোলাপান তো ভিডিয়ো করবেই। এখন মোবাইল ফেলেছিস দাম দিয়ে যাবি।’
ছেলেগুলোকে চিনতে পারে রাফসান। দোকানের বেঞ্চে বসে এরাই তাকাচ্ছিল ইলির দিকে।
আচমকা ছেলেটির গালে সজোরে একটা চড় মেরে দেয়। আরেকজন সঙ্গে সঙ্গে রাফসানকে পেছন থেকে ধাক্কা মারে। সে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় পাথরে।
প্রচন্ড রাগে পাথর নিয়ে তাড়া করে রাফসান। তিনটা ছেলেই দৌড়াতে থাকে। ইলি তাড়াতাড়ি গিয়ে রাফসানকে কোমর জড়িয়ে ধরে আঁটকে বলে, ‘প্লিজ থামো। থামো প্লিজ।’ গাইড আর দোকানীও আসে দৌড়ে।
এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে?’
রাফসান রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘শুয়োরের বাচ্চাটা আমাদেরকে ভিডিয়ো করছিল।’
– ‘কে?’
– ‘ওই ছেলে।’
সবাই তাকায় ছেলেটির দিকে। গলগল করে থুতনি থেকে রক্ত বেরুচ্ছিল।
দোকানী জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনাদের লগের গাইড কই?’
ওরা আঙুল দিয়ে দূরে দেখায়। গাইড এদিকেই আসছে৷ অন্যান্য পর্যটকরাও ভীড় জমাচ্ছে। ছেলেগুলো নানান কথাবার্তা বলে চিল্লাচিল্লি করছিল। গাইড দোকানী সহ পর্যটকরা রাফসানদের সমর্থন করে।
সবারই এক কথা। কে কি করলো সেটা ভ্রমণ কর্তৃপক্ষের নিয়মের বাইরে হলে তারা দেখবে। তৃতীয় ব্যক্তি লুকিয়ে ভিডিয়ো করবে কেন? উপস্থিত সকলের মাধ্যমে বিষয়টি শেষ হয়। ওদেরকে নিয়ে তাদের গাইড অন্যদিকে চলে যায়। ইলি রাফসানকে বললো, ‘বিকেল তিনটা হয়ে গেছে। আমরা ফিরে যাই কি বলো?’
রাফসান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
– ‘যাওয়া যাক মামা।’
– ‘হ, বেলা অনেক হয়ে গেছে যাওন দরকার।’
– ‘হাঁটেন, আসছি আমরা।’
রাফসান ডিমগুলো এক হাতে নিয়ে জলপ্রপাতের জলের পাড়ের পাথরের ওপর রাখা তার ব্যাগটা নেয়। তারপর ইলির কাছে এসে বলে, ‘ডিম খেয়ে নে। টিলা পথে হাঁটতে কষ্ট হবে।’
ইলির ভালো লাগছে না, সে মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘না খাবো না।’
– ‘থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেবো। তোর বাড়াবাড়ির কারণে এতো ঝামেলা হয়েছে৷ এখন যদি না দেখতাম আর ভিডিয়ো করে ভাইরাল করে দিতো?’
ইলি ওর মুখের দিকে আহত নয়নে তাকায়। তারপর ডিম নিয়ে এক কামড় দিয়ে বললো, ‘পানি খেতে হবে তো।’
রাফসান ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ছিপি খুলে দিলো।
– ‘তুমি পানিও এনেছিলে?’
– ‘হ্যাঁ।’
ইলি এক চুমুক পানি খেয়ে বোতলটা আবার ফিরিয়ে দেয়।
– ‘ডিম খেতে খেতে হাঁটতে থাক।’
দু’জন আবার গাইডের পিছু পিছু হাঁটে।
– ‘তুমিও খাও ডিম। না খেলে হাঁটতে পারবে না।’
– ‘হ্যাঁ খাবো।’
– ‘খেয়ে শেষ করো৷ এগুলো নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠবে না-কি?’
রাফসান খেয়ে খেয়ে হাঁটতে থাকে। খানিক পরেই সামনে পড়ে একটা টিলা। দু’জনেই লাঠি হারিয়ে ফেলেছে। গাইড খানিক্ষণ বকবক করলো। টিলাগুলোর রাস্তা ছোট করে বানানো। চাইলেও একজন আরেকজনকে ধরে তুলতে পারে না। ইলি প্রথম টিলা উঠতে গিয়েও হাঁপিয়ে গেল। ঘন্টা খানেক তারা এভাবেই জঙ্গলের পথে হাঁটে। ইলি রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। রাফসান ধরে ধরে নিয়ে হাঁটছে। সামনে একটা টিলা দেখে ইলি এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে বসে গেল।
– ‘আল্লাহ আরেকটা টিলা।’
গাইড দাঁত বের করে হাসে। রাফসান খানিক্ষণ আমতা-আমতা করে। পাঁজাকোলা করে ইলিকে কোলে নেয়।
– ‘আরে তুমি নিজেই এতটা পথ হেঁটে এসেছো ছাড়ো আমাকে।’
– ‘গলা জড়িয়ে চুপচাপ ধরে থাক। তোর কষ্ট দেখে নিজের হাঁটা থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে।’
ইলি গলা জড়িয়ে ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তাই? এতো মায়া? তাহলে আগে আমাকে থাপ্পড় মারতে বলছিলে কেন?’
– ‘তুই এগুলো এতো মনে রাখিস কেন বল তো?’
– ‘আমার সব মনে থাকে।’
– ‘উপরে উঠে সেল্ফি ক্যামেরায় তোর মুখটা দেখিস।
– ‘কেন?’
– ‘হাঁপাতে হাঁপাতে আর ঘাম মুছে মুখ লাল করে টমেটো বানিয়েছিস।’
ইলি ফিক করে হেঁসে বুকে মুখ লুকিয়ে বললো, ‘আমাকে আদর করে দিতে ইচ্ছে করছে তোমার, তাই না?’
– ‘অ্যাঁ কচু ইচ্ছা করছে।’
ইলি গলা জড়িয়ে চোখবুঁজে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে খানিক্ষণ চুপচাপ থাকে, তারপর আবার মাথা তুলে গালে এক হাত রেখে বলে,
– ‘তোমার কষ্ট হচ্ছে তাই না?’
– ‘না।’
ইলি আবার গলা জড়িয়ে ধরে চোখবুঁজে বলে,
– ‘রাফসান ভাই।’
– ‘হু।’
– ‘আম্মা আগে যেকোনো বিপদ-আপদের আশংকায় মসজিদের হুজুর খাওয়াতেন। যেকোনো কিছুর জন্য কোরআন খতম করতেন। আমি ভেতরে ভেতরে এগুলো নিয়ে হাসতাম। কেমন যেন দূর্বল মানুষের কারবার মনে হয়। বাট আমি তোমাকে যদি পাই বিয়ের প্রথম মাসেই কোরআন খতম করবো। জীবনের প্রথম কোরআন খতম।’
– ‘তোর যে কি হয়েছে ইলি।’
ইলি কিছু বললো না। রাফসানের গরম শ্বাস মাথায় আছড়ে পড়ছে। তাকিয়ে দেখলো আর বেশি জায়গা বাকী নেই৷ খানিক পরেই ওপরে চলে আসে তারা। গাইড দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইলি তাকিয়ে বললো, ‘মামা একটু অপেক্ষা করেন, ও একটু জিরিয়ে নিক।’
– ‘আইচ্ছা।’
ইলি রাফসানকে বললো, ‘তোমার সিগারেটের প্যাকেট দাও।’
– ‘কেন?’
– ‘দাও বলছি।’
– ‘ব্যাগের চেইন খুলে দেখ।’
ইলি চেইন খুলে সিগারেটের পুরো পকেট নিয়ে গাইডের কাছে গিয়ে বললো, ‘মামা সিগারেট খান ওইদিকে বসে। ও আমাকে কোলে করে তুলছে তো হাঁপিয়ে গেছে। একটু জিরিয়ে নিক৷’
রাফসান তাকিয়ে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছে। ইলি পাশে এসে ঘাসে আসন পেতে বসে বললো, ‘ব্যাগ থেকে পানি খেয়ে মাথা রেখে জিরিয়ে নাও।’
– ‘ধ্যাৎ, এখন কীসের জিরানো।’
– ‘প্লিজ, ব্যাগটা পাশে রেখে একটু মাথা রাখো। আমি চুলে হাত বুলিয়ে দেই।’
রাফসানের বুকটা শিরশির করছে ওর পাগলামো দেখে। হঠাৎ মাথা রাখতেও অস্বস্তি লাগছিল। তবুও ধীরে ধীরে কোলে মাথা রাখে। ইলি মাথা নুইয়ে ওর মুখ আঁজলা করে চোখেচোখে তাকায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
রাফসান খানিক্ষণ তাকাতে তাকাতে নিজের দুই হাত তুলে ইলির মুখ আঁজলা করে ধরে। তার সত্যিই ইচ্ছে করছে ভীষণ আদর করতে। তবুও নিজেকে সামলাতে হয়। কেবল ইলির কথায় সায় দেয়া যেখানে বাড়াবাড়ি হচ্ছে, সে কীভাবে সীম অতিক্রম করে আদর করবে?
– ‘ইলি গাইড আমাদের পাগলামো দেখে হাসবে।’
– ‘হাসুক, প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিয়ে সকল মানুষই হাসে। আবার তারাও যখন প্রেমে পড়ে এমন কতকিছু করে।’
– ‘তুই বেশি করছিস।’
– ‘করবোই। খেয়ে ফেলবো আপনাকে।’
রাফসান ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ “আপনাকে” মানে?’
মুচকি হেঁসে জিভ কেটে বললো, ‘জানি না, মুখ ফসকে “আপনি” বলে ফেলেছি।’
– ‘তুই যে পাগল হয়ে যাচ্ছিস তার একটা প্রমাণ।’
– ‘ইশ শাড়ি পরে যদি আসতে পারতাম। কত সময় এক সঙ্গে কাটাচ্ছি এভাবে বাজে অবস্থায়।’
– ‘এক কথা থেকে আরেক কথায় যাচ্ছিস কেন?’
– ‘জানি না।’
– ‘নিশ্চিত তোর মাথা গেছে ইলি।’
– ‘রাফসান ভাই।
– ‘কি?’
– ‘কাল শাড়ি পরে যাবো। তুমি আমাকে একবার কপালে আদর দিয়ে বউ ডাকবে?’
– ‘কিসব পাগলামি শুরু করছিস উঠ।’
ইলি টেনে আবার আঁটকে রেখে বললো,
– ‘আচ্ছা এসব বলবো না। আরেকটু সময় থাকো।’
রাফসান আবার কোলে মাথা রেখে তাকায়। তারও ইচ্ছে করছে না এই কোল ছেড়ে উঠে যেতে। এই মায়াবিনীকে সে আর কত উপেক্ষা করতে পারবে বুঝতে পারছে না। ইলি ওর হাতের পেশিতে হাত রেখে বললো, ‘মধুশ্বরী বাজারে জিম সেন্টার খুলেছে।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, ভর্তি হবে তুমি?’
– ‘না এগুলো এখন ভাল্লাগে না।’
– ‘আবার সব ভালো লাগবে দেইখো। বাড়িতে গিয়ে তোমার চাচাদের সাথে কথা বলে কোনো ব্যবসা দিয়ে দাও।’
– ‘হু দেখি।’
– ‘আসলে দু’জন মানুষ না খেয়ে মরবো না। আমরা যেভাবে হোক চলবো। শুধু হৃদের সাথে বিয়েটা ভেঙে যদি রাজি করাতে পারতাম।’
– ‘ইলি উঠ, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
ইলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে। রাফসান ব্যাগ কাঁধে নেয়। দু’জন গাইডের কাছে গিয়ে বললো, ‘চলুন মামা।’
—-চলবে—-
লেখা: MD Jobrul Islam
—চলবে– (লেখাটি অগোছালো আছে৷ কিছু ব্যস্ততার কারণে লিখে এডিট করারও সময় হয়নি।)
লেখা: MD Jobrul Islam