দ্বিতীয় জীবন পর্ব -০৩

#দ্বিতীয়_জীবন (৩)

দিনদিন শুভর আচরণে কেমন অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে লাগল। বাসার কারো সাথে তেমন কথা বলেনা। সকালে উঠে সবার আগে নাস্তা করে কোথায় যেন যায় আর ফিরে সেই রাতে। জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দেয় না। চুপচাপ থাকে। পারতপক্ষে তিন্নির সামনে আসে না।

চেহারা আর স্বাস্থ্যের কি অবস্থা হয়েছে তা আর নাই বা বললাম। বাসার সবাই কে কি আঁচ করেছে তিন্নি জানে না তবে শুভর এই অবস্থা সে কোনো ভাবে মেনে নিতে পারে না। ভীষণ আত্মগ্লানিতে ভোগে এই ভেবে যে আজ যদি সে আদিলকে বিয়ে না করত তাহলে শুভর এই অবস্থা হতো না। প্রত্যক্ষভাবে না হোক পরোক্ষভাবে শুভর আজকের এই অবস্থার জন্য সে কিছুটা হলেও দায়ী।

মাস ছয়েক পর

এক বিকেলে শুভ সবাইকে জানায় তার স্কটল্যান্ডের স্কলারশিপটা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে মেইলে তাকে কনফার্ম করেছে। এরপর কাগজপত্র রেডি করতে এবং ভিসা পেতে যা সময় লাগে। এইকথায় তিন্নি যেন কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তাদের এই চোর পুলিশ খেলা না হয় আর অল্প কিছুদিন টেনে নিয়ে গেল। কারণ তিন্নি যথাসম্ভব চেষ্টা করে শুভকে এড়িয়ে যাওয়ার। কিন্তু আদিল বাসায় থাকলে তা সম্ভব হয় না। পরিবারের সবার এক সঙ্গে বসে খাওয়া চাই। খাওয়ার পরে সকলে মিলে কফি খেতে খেতে আড্ডা তো আছেই। আর ছুটির দিনের আগের রাত হলে তো আর কথাই নেই। সবাই মিলে মুভি দেখা চাই।
এমনি এক সময় আদিল শুভকে জিজ্ঞেস করে বসল
-কিরে শুভ তোর আর তিন্নির মাঝে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?
শুভ এক পলক তিন্নির মুখের দিকে আড়চোখে চেয়ে উত্তর দিল
-কই না তো ভাইয়া। কেন? হঠাৎ এমন প্রশ্ন করলে?

শুভ ভয় পাচ্ছে। তিন্নি অবশ্য কোনো কিছু বলার মতো মানুষ না। তবে বাসার কেউ কি কোন কিছু আঁচ করতে পেরেছে? শুভ অনেক কষ্টে এই কয়টা মাস নিজের মনকে বেঁধে রেখেছে। বলতে গেলে তিন্নির কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছে। নিজেকে কষ্ট দিয়েছে। সব কিছু ভেবে বাইরে চলে যাওয়াটাই তার কাছে ভালো বলে মনে হয়ছে। দেশে থাকলে সে তিন্নিকে এড়াতে পারবে না। শেষমেশ তীরে এসে তরী না ডোবে?

আদিল হেসে বলল
-কিরে তুই তো ঘাবড়ে গেছিস দেখছি। ভয়ের কিছু নেই। আমি এমনি জিজ্ঞেস করলাম। তোদের আগের মতো খুনসুটি করতে দেখি না তো তাই।

শুভ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। আড়চোখে একবার তিন্নির দিকে তাকিয়ে তারপর বলল
-এখন হাজার হোক সে আমার বড় ভাইয়ের বউ। মুরুব্বি মানুষ। তার সাথে কি আর ইয়ার্কি ফাজলামি করা শোভনীয়?
একথায় আদিল অট্টহাসিতে ফেটে পরল। কিছুটা সামলে বলল
-বাহ! আমার ভাই দেখি অনেক মেচিউর হয়ে গেছে।

কিছুদিন পর শুভ চলে গেল তার গন্তব্যে। এদিকে বেশ চলছে তিন্নি আর আদিলের সংসার। দুজনের মাঝে খুনসুটি থাকলেও বোঝাপড়া দারুন। দুই ভাইয়ের মাঝে অনেক মিল। সেটা অবশ্য তিন্নির জন্য একটা বড় প্লাসপয়েন্ট। সে খুব সহজেই আদিলকে বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে তিন্নির মনে হয় যেন শুভর সাথেই যেন সংসার করছে।

দেখতে দেখতে দুই বছর পেরিয়ে গেল ওদের বিয়ের। আদিলের নতুন চাকরী হয়েছে। আগের চেয়ে ভালো পজিশন এবং বেতন। তবে সমস্যা হলো এই অফিসের ট্রাসপোর্ট সাপোর্ট নেই। আর অফিসও বেশ দূরে। পাবলিক বাসে আসা যাওয়া বেশ কষ্টকর হয়ে গেল। তিন্নি অবশ্য বলেছিল অফিসের কাছাকাছি বাসা নেয়ার জন্য। কিন্তু আদিল বলল
-অফিসের আশেপাশে যেসব এলাকা তোমরা গিয়ে থাকতে পারবে না। আর বাসায় থাক দুইজন মেয়েলোক। আমি অফিসে কাজ করব না তোমাদের নিয়ে টেনশন করব। তার চেয়ে এখানে আছ ভালো আছ। আশেপাশে সব পরিচিত লোকজন আছে। আমি অন্তত টেনশন ফ্রি থাকব। আশা যাওয়ার জন্য কি করা যায় দেখি। এভাবে বাসে করে আসা যাওয়া করা আমার পক্ষেও সম্ভব নয়।

সপ্তাহ দুই পর

আদিল নতুন বাইক কিনেছে। খুব উচ্ছ্বসিত থাকে সারাদিন বাইক নিয়ে। তিন্নির এই ব্যাপারে শুরু থেকে আপত্তি ছিল। কিন্তু অফিসে যাতায়াতের সুবিধা দেখিয়ে আদিল তিন্নির আপত্তি শুনল না। তবে তিন্নির কাছে প্রমিজ করেছে কখনো রাফ চালাবে না এবং সব সময় হেলমেট পরে চালাবে।

শুরু শুরতে খুব যে ভালো চালাতো এমনটা নয়। দুই একবার পড়ে গিয়ে হাত পা ছিলে ফেলেছে। তিন্নি অনেক বলেছে বাইকটা বিক্রি করে একটা পুরোনো গাড়ি নেয়ার জন্য। কিন্তু আদিলের সেই এক কথা গাড়ি নিলে তো সেই জ্যামে বসে থাকতে হবে। বাইকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো চিপা গলি দিয়ে চলে যাওয়া যায়। এতকিছুর পরও তিন্নির মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু আদিলকে আর কিছু বলল না। শেষ আশ্রয়স্থল শাশুড়িকে বলল ব্যাপারটা। সব শুনে উনি বললেন
-জানিস তো দুইটাই প্রচন্ড একগুঁয়ে। নিজেরা যা বুঝবে সেটা। অন্য কেউ হাজার বললেও শুনবে না।

দুই মাস পর

রোজ সকালের মত সেদিন আদিল অফিসের জন্য বের হল ঠিকই কিন্তু ফিরল লাশ হয়ে। বাসের সাথে ধাক্কা লেগে বাইক সহ ফ্লাইওভারের উপর থেকে পরে গিয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় আদিল। ফ্লাইওভার থেকে নীচে পরে গিয়ে আদিলের পুরো শরীর থেতলে গেলেও আশ্চর্যজনক ভাবে মোবাইলের কিছু হয়নি। আদিলের নাম্বার থেকে যখন ফোন এল রাহেলা বেগমের মোবাইলে, রাহেলা বেগম ব্যস্ত থাকায় তিন্নিকে রিসিভ করতে বললেন। তিন্নি রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে অচেনা এক কণ্ঠ কি যেন বলল গাড়ির শব্দের জন্য কিছু বুঝতে পারল না। রাহেলা বেগম জিজ্ঞেস করতেই বলল
-মনে হয় মোবাইল হারিয়ে ফেলেছে আপনার ছেলে। লোকটা কি বলল কিছু বুঝতে পারলাম না।

কিছুক্ষণ পর অপরিচিত নাম্বার থেকে রাহেলা বেগমের নাম্বারে আবার কল এলে এবার রাহেলা বেগম রিসিভ করলেন। তিন্নির কাছে মনে হল রাহেলা বেগম কেমন যেন শক্ত হয়ে যাচ্ছেন কথা বলতে বলতে। ফোন রাখতেই উনি ধপ করে মাটিতে বসে গেলেন আর তিন্নির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।

তিন্নির বুকের ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। উৎকণ্ঠার সাথেই জিজ্ঞেস করল
-কি হয়েছে মা?

রাহেলা তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না করতে করতে বললেন
-আমার আদিল নেই।

এই কথা শুনার সাথে সাথে তিন্নি জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। বেশ কয়বার জ্ঞান হারাল সেদিন। প্রিয় মানুষটাকে শেষ বিদায় পর্যন্ত দিতে পারল না।

তিনদিন পরেই শুভর দেশে আসার কথা। দুই ভাই মিলে কত পরিকল্পনা কত কিছু করবে। রাহেলা বেগমের কত প্রস্তুতি দুইবছর পর ছেলে দেশে আসছে, ঠিক করেছেন এবার শুভকে বিয়ে করাবেন। কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল। একটা ঝড় এসে পলকে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল।

শুভ এসেছে বেশ কিছুদিন হয়েছে। তিন্নির সাথে এখনো দেখা হয়নি। সারাদিন নিজের রুমেই থাকে, তিন্নি। শুভও অবশ্য চেষ্টা করেনি তিন্নির সাথে দেখা করার। কারন এই তিন্নির সামনে দাঁড়াবার সাহস এই মুহুর্তে শুভর নেই। শুভ দেশে আসার কয়দিন পর তিন্নি ওর বাবার বাসায় চলে যায়।

শুভ ফিরে যাবার আগে একবার তিন্নির সাথে দেখা করার জন্য তিন্নির বাবার বাসায় গেলে তিন্নি শুভর সাথে দেখা করতে রাজী হলনা। শুভ তখন বলে পাঠাল দেখা করতে হবে না শুধু কিছু কথা তিন্নির রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে চলে যাবে।

তিন্নির সম্মতি পেয়ে শুভ বলল
-নিজেকে কখনো একা ভাবিস না। আমি যে কোন পরিস্থিতিতে তোর পাশে আছি সবসময়ের জন্য।

শুভ ফিরে যাবার কিছুদিন পর খবর পেল তিন্নি অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে কেউ কিছু বলতে পারছে না। প্রচণ্ড অস্থিরতা কাজ করতে লাগল শুভর মাঝে। তিন্নির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোন লাভ হল না। দুইদিন পর রাহেলা বেগম শুভকে সুসংবাদটা দিলেন তিন্নি সন্তান সম্ভবা।

শত দুঃখের মাঝে যেন আনন্দের ছটা নিয়ে আসল এই খবরটা। শুভ এম এস শেষ করে স্কটল্যান্ডে সেটেল হবার চিন্তা করেছিল। কিন্তু গত দুই মাসে ওদের জীবনে যা কিছু ঘটে গিয়েছে এরপর সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশে ফিরে আসবে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here