দ্বিতীয় জীবন পর্ব -০১

ঝলমলে আলোক সজ্জায় সজ্জিত কমিউনিটি সেন্টারের সামনে যে পার্কিংটা আছে তার সামনেই ফুলের বাগান। সেই বাগানের বড় বাগানবিলাস গাছটার নীচে বসে আছে শুভ। তার কোন কিছুই ভাল লাগছে না এই মুহুর্তে। বিয়ের আনন্দ উল্লাস, হৈ হোল্লোড় কিছুই না।

আজকে শুভর বড় ভাই আদিলের বিয়ে। ভাইয়ের বিয়ে হিসেবে যতটুকু আনন্দিত হবার কথা তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী আনন্দিত ছিল শুভ। বিয়ের সব আয়োজন তার নিজের হাতে করা। কিন্তু আজ হঠাৎ তিন্নিকে দেখে কি যে হয়ে গেল শুভর, সে নিজেও জানে না।

তিন্নি আর শুভ একসাথে পড়ত। বন্ধুত্ব সেই ছোটবেলা থেকে। পাশাপাশি বাড়িতে থাকার সুবাদে বন্ধুত্বটা আরো তীব্র হল। হবে নাই বা কেন? একই স্কুল, একই ক্লাস এমনকি একই সেকশনে পড়ে আসছে সেই নার্সারী ক্লাস থেকে। পাশাপাশি বাড়ি হওয়াতে যেন পোয়াবারো।

শৈশব থেকে এই বন্ধুত্ব কৈশোরে এসে পৌছালো। কিন্তু তখনি বাঁধল বিপত্তি। শুভ বাবার চাকুরীতে প্রমোশন হল আর সেই সাথে বদলী দিল বগুড়াতে। তখন ওরা ক্লাস সেভেনে পড়ে। শুভরা সপরিবারে চলে গেল বগুড়া।

তিন্নির সাথে এর পর আর কোন যোগাযোগ নেই। থাকবেই বা কি করে ওদের কি আর নিজেদের মোবাইল বা ফেসবুক প্রোফাইল আছে যে চাইলেই যোগাযোগ করা যায়।

ইউনিভার্সিটির প্রথম দিনটায় ঠিক ছয় বছর পর তিন্নির সাথে আবার দেখা হল শুভর। সেই থেকে আবার শুরু হয় দুজনের বন্ধুত্ব। ওরা কেউ এখন আর ছোট নয়। শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে দুইজনেই এখন তারুন্যের দরজায় কড়া নাড়ছে। সাথে রয়েছে এতদিনের বিচ্ছেদ। দুজন দুজনকে একটু নতুন করেই আবিষ্কার করল যেন। তিন্নির মাঝে শুভ খুঁজে পায় পরম নির্ভরতা। ক্লাস লেকচার বুঝতে সমস্যা? ক্লাসের এটেনডেন্স খাতায় সাইন চাই? পরীক্ষার আগে নোট দরকার? সকল সমস্যার এক সমাধান শুভর কাছে। আর সেটা তিন্নি। অবশ্য সবসময় লাজুক থাকা তিন্নিকে শুভ এসবের বাইরে খুব বেশী জানতে চেষ্টা করেনি কখনো। জানতে চাইলে হয়তো বা আজকের দিনে শুভকে এইভাবে বসে থাকতে হত না।

আর লাজুক তিন্নি শুভর মাঝে যেন দিন দিন হারিয়ে যেতে লাগল। তিন্নির মনের মাঝে কখন থেকে বসবাস করা শুরু করে দিয়েছে শুভ, তিন্নি যেন টেরই করতে পারল না। আর এই বসবাসকে পাকাপোক্ত করতে সাহায্য করল শুভ নিজেই। সারাক্ষণ তিন্নির উপর নির্ভরতাই কখন যে তিন্নির মনে ভালবাসার জাগরণ করল তা দুইজনের কেউ টের পেল না।

ইউনিভার্সিটির প্রায় শেষের দিকের ঘটনা। তিন্নি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল সে শুভ কে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু শুভর দিক থেকে আশানুরূপ কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। শুরু থেকে শুভর আচরণ যেমন ছিল এতদিন পরেও তেমনি আছে। কেউ কাউকে ভালবাসলে তার আচার আচরন, কথাবার্তায় যেমনটা আশা করে তেমন টা তিন্নি দেখতে পেত না। শুভ খুব স্বাভাবিক আচরন করত, কিন্তু মাঝে মাঝে খুব অধিকার খাটাত। এই ব্যাপারটা তিন্নিকে বিভ্রান্ত করে দিত। আদৌ কি শুভ ওকে ভালবাসে? এক সময় তিন্নি ঠিক করল শুভর সাথে ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবে।

শুভর মা রাহেলা বেগমের তিন্নিকে খুব পছন্দ। উনি সবসময় নিজের পুত্রবধু হিসেবে এমন একজন কেই চান। আর উনি তিন্নির চোখ দেখেই বুঝতে পারতেন তিন্নি শুভকে কতটুকু পছন্দ করে। কিন্তু ওনার ছেলে যে একটা অপদার্থ তিন্নির এই ভালবাসা সে বুঝতে পারত না রাহেলা বেগমের টা বুঝতে আর বাকি নেই। কিন্তু উনি এটা জানতে চাইতেন শুভর মনের মাঝে কি চলছে?

একদিন যখন সবাই গ্রুপ স্টাডির জন্য আসল শুভর বাসায় তখন রাহেলা বেগম সুযোগ পেয়ে তিন্নিকে বললেন

-আমার ছেলে না হয় গাধা সে বুঝে না। কিন্তু তুই যে গাধী সেটা আমার জানা ছিল না।

তিন্নি খুব অবাক হয়ে যায় রাহেলা বেগমের কথায়। সে জানতে চায়
-হঠাৎ করে কি হল তোমার আন্টি? কি বলছ এইসব?

রাহেলা বেগম এইবার একটু ঝাঁঝালো ভাবেই বললেন
-কি বলছি মানে? তুই কি কিছুই বুঝতে পারছিস না?
-না।
-আচ্ছা শোন তোর সাথে আমার কয়বার, কত ঘন্টা দেখা হয়?
-বারে সেটা আমি কি করে বলব? আমি কি হিসেব করে রাখি?
-ভাল কথা হিসেব করে রাখিস না।
তোকে আমি দেখি কিছু সময়ের জন্য। তাতেই আমি আমি তোর চোখ দেখে বলে দিতে পারি তোর মনে কি চলছে। কিন্তু আমার ছেলেটা দিনের বেশির ভাগ সময় একসাথে থাকার পরেও সেটা পারছে না।

তিন্নি এইবার একটু লজ্জা পায়। লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গেলে সেই লাল মুখখানা দেখতে রাহেলা বেগমের খুব ভাল লাগে। ওনার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল। কিন্তু আল্লাহ্‌ ওনাকে দুইটাই ছেলে দিয়েছেন। তিন্নিকে বরাবরই ওর শান্ত স্বভাবের জন্য পছন্দ করেন উনি। তাই খুব ইচ্ছা যে কোন এক ছেলের বউ করে আনার। বড় ছেলের জন্য হলে এখনই প্রস্তাব দিতে পারেন। বড় ছেলে আদিল সবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরীতে জয়েন করেছে। কিন্তু তিন্নির চোখে রাহেলা বেগম শুভর জন্য ভালবাসা দেখেন। তাই অপেক্ষা করছেন কবে ওনার ছেলে তিন্নির মনের কথাটা বুঝবে।

রাহেলা বেগম আবার বলতে শুরু করলেন
-শুন ঐ গাধাটাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তুই সাহস করে বলে ফেল মনের কথা। না হলে এইভাবে ঝুলে থাকবি কিন্তু।
তিন্নি এই কথায় যেন আরো লজ্জা পেয়ে বলে
-কি বল না তুমি আন্টি।

ওদের এই আলাপচারিতার মাঝে শুভ আসে। দুইজনের দিকে একবার একবার করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে
-কি কথা হচ্ছে তোমাদের মাঝে?
তিন্নির দিকে তাকিয়ে
-কিরে তুই এমন লাল হয়ে আছিস কেন? ব্যাপার কি?
রাহেলা বেগম শুভকে উদ্দেশ্য করে বলেন
-জিজ্ঞেস কর ওকে কি ব্যাপার। তোকে কিছু বলতে চায় মনে হয়।

শুভ তিন্নিকে কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই তিন্নি কিছু না এমন বলে চলে আসে সেইদিন। কিন্তু রাহেলা বেগমের কথাগুলো তিন্নির মনে দাগ কেটে যায়। তারপরদিন ভার্সিটি যেতেই শুভকে বলে ওর সাথে জরুরী কথা আছে ছুটির পর যেন অপেক্ষা করে।

ছুটির পর শুভ তিন্নির জন্য অপেক্ষা করার বিষয়টা একেবারেই ভুলে যায়। তিন্নি অনেক খোজা খুঁজির পর শুভকে না পেয়ে ফোন করে জানতে পারে ও এক বন্ধুর বাসায় গেছে। তিন্নি একটু রাগ করে এতবার বলার পরেও কেন শুভ এমন করল? বাসায় আসার পর বারবার মনে হচ্ছিল এখুনি হয়তো শুভ ফোন করবে। কিন্তু না রাত দশটা বেজে গেল কিন্তু শুভর কোন খবর নেই। সেই প্রথম তিন্নির কাছে মনে হতে থাকে শুভর কাছে ওর আলাদা কোন গুরুত্ব নেই। তারপরেও নিশ্চিত হবার জন্য ফোন দেয় শুভকে।

বেশ কয়েকবার রিং হবার পর শুভ ফোন রিসিভ করে বলে
-কিরে এত রাতে ফোন দিলি কেন?
তিন্নি খুব কষ্ট পায় শুভর এমন আচরনে। তারপরেও বুঝতে না দিয়ে বলে
-তুই কেমন মানুষ বলতো, বললাম কথা আছে তারপরও অপেক্ষা করলি না আমার জন্য। পরে একটা ফোনতো দিতে পারতি।
শুভ উত্তরে শুধু বলে
-হুম।

তিন্নি এবার নিজের উপর বিরক্ত লাগে কেন যে এই অপদার্থটাকে ফোন দিতে গেল? আর কেনই বা এত ছেলে রেখে এই অপদার্থটাকেই ভালবাসতে হল। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী তিন্নি না। তাই শুভ কে বলল
-দেখ শুভ বেশ কিছুদিন ধরে তোকে আমি কিছু কথা বলতে চাচ্ছি।
তিন্নিকে থামিয়ে এইবার শুভ বলল
-কি বলবি জানি তো। বাদ দে না এসব ভালবাসাবাসি। বন্ধু আছি তাতে ক্ষতি কি?
তিন্নি খুব অবাক হয় শুভর কথা শুনে
-তুই জানতি?
-না জানতাম না। কাল রাতে মা বলেছে।
-ওহ
-দেখ তিন্নি আমি কখনো তোকে ঐভাবে দেখিনি। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল আমি কোন কমিটমেন্টে যেতে চাই না। অন্তত এখন না। কমিটমেন্ট দিয়ে যদি পরে সেটা রাখতে না পারি তখন আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগবে। এইসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মন দিয়ে পড়াশুনা কর।

শুভর এই কথার পর আর কোন কথা বলল না তিন্নি। আই কথার পর অবশ্য কিছু বলারও থাকে না। আর যদি কিছু বলতে যায় তাহলে নিজের আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিতে হয়। তিন্নি পক্ষে সেটা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।

চলবে

©
#দ্বিতীয়_জীবন
তানিয়া আবেদিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here