#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০৩
#Arshi_Ayat
১৪২১ বঙ্গাব্দ,১লা জৈষ্ঠ্য,শিলিগুড়ি…
একটি নব্যদিনের সূচনা।এখন বেলা আট’টা।কাঁচের জানালা ভেদ করে সূর্যের একফালি রশ্মি মেয়েটির মুখে পড়ছে।সিঙ্গেল বিছানার মাঝখানে এভাবেই মেয়েটি একদম সটান হয়ে শুয়ে আছে বিগত তিনমাস ধরে।দুইপায়ের হাটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ব্যান্ডেজ,বাম হাত পুরোটা ব্যান্ডেজ,মাথায়ও ব্যান্ডেজ,গালে তিনটা সেলাই ডান হাতে স্যালাইন লাগানো।গত তিনমাস তাকে এভাবেই বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে তিনমাসে একবারও চোখ খোলে নি,কোথাও বলে নি একদম মূর্তির মতো শুয়ে ছিলো।
——————–
রাত ১০ টা।খাবার টেবিলে সবাই একসাথে খাচ্ছে।এই বাড়ির একটা ধরাবাঁধা নিয়ম আছে তাহলে রাতে সবাই একসাথে খাবে।যতো ব্যস্তই হোক সবাইকে একসাথে খেতে হবে।আর এই নিয়মের হেরফের এখনো হয় নি।আজকে খাবার মেনু তে পাট শাক,মুসুরির ডাল,ডিম ভুনা,সালাদ,আর ভাত আছে।যে যার মতো খাচ্ছে।খেতে খেতেই পূর্ব চৌধুরী বললেন,’অর্হনিশ,মেয়েটির কি অবস্থা?এখনো কোনো ইম্প্রুভমেন্ট নেই?’
‘না বাবা।এখনো কোনো রেসপন্স নেই।’অহর্নিশ হতাশ গলায় বলল।
‘আর কতোদিন এভাবে ওকে রাখবে?হাসপাতালে দিয়ে আসো।ওরাই ওর টেক কেয়ার করবে।’গম্ভীর কন্ঠে বললেন পূর্ব চৌধুরী।
‘চেষ্টা তো কম করলে না অর্হনিশ।এখন তোমার বাবা যা বলে তাই করো।’মিসেস অনামিকাও স্বামীর সাথে সায় দিলেন।
‘জ্বি বাবা।’সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো অর্হনিশ।
হাত ধুয়ে অচেনা মেয়েটির রুমে পা বাড়ালো।ওর স্যালাইন পাল্টানোর সময় হয়ে গেছে।মেয়েটির ঘরে এসে লাইট জ্বালিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলো।তারপর ডানহাতটা ধরে বলল,’হ্যালো,আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?’
প্রতিদিন যখনই অহর্নিশ এই ঘরে আসে তখনই মেয়েটার হাত ধরে কথা বলে যদি কোনো উত্তর অথবা সাড়া পাওয়া যায় সেই আশায় কিন্তু তিন মাস ধরে মেয়েটির কোনো উত্তর নেই তবুও অহর্নিশ তার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
এবারও কোনো উত্তর না পাওয়ায় অহর্নিশ হতাশ হয়ে স্যালাইন পাল্টে দিয়ে শেষ বারের মতো মেয়েটির হাত ধরে বলল,’হ্যালো,আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?প্লিজ সাড়া দিন।’
হঠাৎই কি হলো কে জানে মেয়েটি আস্তে আস্তে চোখ খুললো।ওকে চোখ খুলতে দেখে অহর্নিশের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম।অনেক কষ্টে নিজেকে প্রতিহত করে উত্তেজিত গলায় বলল,’এই যে আমাকে দেখতে পাচ্ছেন?’
মেয়েটা অহর্নিশের দিকে তাকালো।মুখ দিয়ে খুব ক্ষীণ স্বরে কিছু একটা বলল কিন্তু অক্সিজেন মাক্সের জন্য বোঝা গেলো না।অহর্নিশ মাক্সটা খুলে আবার বলল,’কিছু বলবেন?’
‘আমি কোথায় আছি?’খুব ক্ষীণ কন্ঠে বলল মেয়েটি।
এতোদিন পর মেয়েটার কথা শুনতে পারায় অহর্নিশ খুশিতে আটখানা।এতোদিন কম চেষ্টা করে নি ও।তবে আজ আকস্মিক ভাবে যে চেষ্টার ফল মিলে যাবে সেটা অহর্নিশ ভাবতেও পারে নি।
ও মেয়েটার প্রশ্নের উত্তরে অভয় দিয়ে বলল,’চিন্তা করবেন না আপনি আমার বাসায় আছেন।’
‘আপনি কে?’মেয়েটা আবার দুর্বল গলায় বলল।
‘এক্সিডেন্টের পর আপনাকে আমারা উদ্ধার করেছি।’
‘আমার কি হয়েছিলো?’
মেয়েটার শেষ প্রশ্নে অর্হনিশ বুঝলো ওর কিছু মনে নেই।মেমোরি লস হয়েছে।অবশ্য ওর বাঁচারই চান্স ছিলো না তবুও যে কিভাবে বাচলো আল্লাহ জানে!
অহর্নিশ নতুন করে কিছু বলল না।এখন ব্রেইনে প্রেশার দেওয়া ঠিক হবে না।ওকে এক্সিডেন্টের কথা বললে ও এখন এগুলো ভাববে।এগুলো ভাবলে প্রেশার পড়বে ব্রেইনে।
অর্হনিশ উত্তর দিতে গিয়ে খেয়াল মেয়েটা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।ও স্মিত হেসে মেয়েটার হাত ধরে ভরসার গলায় বলল,’আপনি তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে উঠবেন স্নো হোয়াইট!’
এটা বলেই অহর্নিশ মেয়েটার হাত ছেড়ে উঠে দাড়ালো।তারপর ওর ঘরের লাইট বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে এলো।ড্রেসিং টেবিলের ড্রায়ার থেকে একটা লকেট বের করে দেখলো একটা হাস্যোজ্জ্বল মেয়ের ছবি আর একজন মহিলার ছবি।বোঝাই যায় মা মেয়ে।চেহারায় মিল আছে।কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে অহর্নিশ লকেট’টা আবার রেখে দিলো।এই তিনমাসে একদিনও বাদ নেই যেদিন অহর্নিশ এই লকেট’টি দেখে নি।অহর্নিশ নিজেও জানে না ও কেনে এই লকেট’টা দেখে।তবে প্রতিদিন এটা না দেখলে ভালো লাগে না ওর।তবে ও অচেনা মেয়েটার একটা নাম দিয়েছে।মেয়েটার নাম স্নো হোয়াইট!
অহর্নিশ খুব খানদানি পরিবারের ছেলে।দাদার বাড়ি বাংলাদেশে তবে বাবার বাড়ি ভারতের শিলিগুড়িতে।নানার বাড়িও বাংলাদেশে।বাংলাদেশে বছরে দুই/তিন বার যাওয়া পড়েই।অহর্নিশ পেশায় ডাক্তার।গতবছর ইন্টার্নশিপ শেষ করে হাসপাতালে পার্মানেন্ট জয়েন হয়েছে।
—————–
খুব ভোরে ঘুম ভাঙতেই অহর্নিশ মেয়েটার ঘরে এলো।তারপর নিচে হাটু গেড়ে বসে মেয়েটার হাত ধরতেই মেয়েটা চোখ খুললো।ক্ষীণ কন্ঠে বলল,’আমি পানি খাবো।’
বেডসাইড থেকে খালি পানির গ্লাসটায় পানি ভরে আনলো অহর্নিশ তারপর মেয়েটার মাথাটা একহাত দিয়ে একটু তুলে ধরে আরেকহাত দিয়ে একটু পানি খাইয়ে দিলো।তারপর মুখটা মুছে দিলো।অহর্নিশ আস্তে আস্তে মেয়েটার স্যালাইন খুলে ফেললো।তারপর নিজের ঘরে গিয়ে সার্জিক্যাল ব্লেড,গরম পানি,তুলা,অ্যান্টিসেপটিক নিয়ে আবার মেয়েটার ঘরে চলে এলো।দুইপায়ের ব্যান্ডেজ আর হাতের ব্যান্ডেজগুলো খুলে ফেললো।কাটাগুলো শুকিয়ে গেছে আর হাড়ও মোটামুটি জোড়া লেগে গেছে এখন শুধু ব্যায়াম করতে হবে আর নিয়ম মাফিক চলতে হবে তাহলেই আবার হাটাচলা করা সম্ভব।প্রথম প্রথম কষ্ট কিন্তু তবুও চেষ্টা করতে হবে।
হাত পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা শেষ হতেই অহর্নিশ চলে গেলো রান্না ঘরে একবাটি সবজি স্যুপ এনে মেয়েটার মুখের সামনে ধরে বলল,’এটা খেয়ে নিন।ভালো লাগবে।’
মেয়েটা অহর্নিশের দিকে চেয়ে বলল,’আচ্ছা আমার কি হয়েছিলো?আর আমি এখানে কেনো?আপনিই বা কে?আপনি কি আমাকে চেনেন?’
‘আচ্ছা সব বলবো কিন্তু আগে খেতে হবে।আপনি খেতে থাকুন আর আমি বলতে থাকি।’
অহর্নিশ মেয়েটাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলতে লাগলো,’আপনার কি হয়েছে আমি জানি না তবে সম্ভবত আপনি কোনো বাস অথবা রেল দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন।আমি যখন শিলিগুড়ির স্থানীয় হাসপাতালে জয়েন করি তার একমাস আগে থেকে আপনি সেখানে ছিলেন।তবে আপনার জ্ঞান ছিলো না।ডক্তার’রা হাল ছেড়ে দিয়েছিলো।তারপর থেকে আপনার অযত্ন হচ্ছিলো যেটা আমার ভালো লাগে নি তারপর আমি আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি।এখানে আপনি আরো দুইমাস অচেতন অবস্থায় ছিলেন।অতঃপর কাল রাতে আপনার জ্ঞান ফিরেছে।আমি এতটুকুই জানি।তবে এর আগে আপনার কি হয়েছিল,আপনি কে,কোথায় থাকেন কিছুই জানি না।’
অহর্নিশের কথা শুনে মেয়েটার কপালে চিন্তার ছাপ দেখা গেলো।মেয়েটাকে চিন্তিত দেখে অহর্নিশ বলল,’চিন্তা করবেন না।আপনি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে যাবেন আর সবকিছু মনেও পড়ে যাবে।’
মেয়েটা উত্তরে কিছু বলল না।স্যুপ খাওয়ানো শেষ হতেই মিসেস অনামিকা ঘরে আসলেন।ওনাকে দেখে অহর্নিশ বলল,’আম্মু দেখো কাল রাতেমেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে।তোমাদের বলতাম কিন্তু তোমরা ঘুমিয়ে গিয়েছিলে।’
মিসেস অনামিকা মেয়েটার পাশে এসে বসলেন।বললেন,’এখন কেমন বোধ করছো?’
‘ভালো।’
‘তোমার বাড়ি কোথায়?’
মিসেস অনামিকার এই প্রশ্ন শুনে মেয়েটা অহর্নিশের দিকে তাকালো।অহর্নিশ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’মা ওনার আসলে কিছু মনে নেই।’
মিসেস অনামিকা আফসোসের স্বরে বললেন,’ওহ!’
তারপর আবার হাস্যমিশ্রিত কন্ঠে বললেন,’তুমি রেস্ট করো।আমি আসি।’
যাওয়ার সময় মিসেস অনামিকা অহর্নিশকে ইশারায় বাইরে আসতে বললেন।অহর্নিশ রুমের বাইরে আসতেই উনি বললেন,’মেয়েটার তো জ্ঞান ফিরলো কিন্তু এখন তো ওর কিছুই মনে নেই।বাড়ি ফিরবে কি করে?’
‘মা আপাতত এখানেই থাকুক।যখন মনে পড়বে তখন ফিরে যাবে।’
মিসেস অনামিকা শঙ্কাপূর্ণ গলায় বললেন,’পরে যদি না ফেরে?’
অহর্নিশ বিরক্তকন্ঠে বলল,’মা পরেরটা পরে দেখা যাবে।আগে ওনাকে শারীরিক ভাবে সুস্থ করে তোলা প্রয়োজন।আর ততদিনে হয়তো সবকিছু মনেও পড়ে যেতে পারে।’
‘হ্যাঁ তাই জেনো হয়।তবে বেশিদিন কিন্তু রাখা যাবে না।’এটা বলেই মিসেস অনামিকা চলে গেলেন।আর অহর্নিশ আবার মেয়েটাট ঘরে আসতেই দেখলো মেয়েটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।অহর্নিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,’আচ্ছা আপনার নাম কি?’
‘অহর্নিশ চৌধুরী।’অহর্নিশ ঠোঁট হাসি রেখেই উত্তর দিলো।তারপর পাল্টা প্রশ্নে বলল,’আপনার নাম কি?’
‘জানি না।’মেয়েটার গলায় বিষন্নতা।
অহর্নিশ কিন্তু একটা ভেবে বলল,’আপনার নাম অহি।’
‘আপনার নামের সাথে মিলিয়ে রাখলেন মনে হচ্ছে।’মেয়েটা বলল।
‘হ্যাঁ,মিলিয়েই রেখেছি।কেনো সুন্দর হয় নি?’
‘হ্যাঁ সুন্দর তবে আমার নাম তো এটা নয়।’
‘যতোদিন না আপনার সব মনে পড়ছে ততদিন এটাই আপনার নাম।’
চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)