দ্বিতীয় বাসর পর্ব ৩৫+৩৬

দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৩৪
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

জামানকে ফোন করে কিছু কথা জানিয়ে দেয় বন্ধন।গুরুত্বপূর্ন কনফারেন্স কক্সবাজারে তাই মিতুকে না জানিয়ে বন্ধনকে চলে যেতে হয়েছে।
“শোন জামান।’
“জ্বী স্যার।’
“তুমি তো জানো আমি কক্সবাজারে চলে এসেছি।মিতুকে এখন জানাতে পারো।সূর্যাস্ত দেখে ফুরফুরে মেজাজে আছে।’
“স্যার, সেটা তো আপনি জানালে ভালো হতো না?’
“তুমি বুঝতে পারছো না কেন জামান?তোমার ভাবি অনেক ইমোশোনাল,আমি জানালে বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি শুরু করে দিবে।তখন আমি আবার নিজেকে সামলাতে পারবো না….।’
জামান, বন্ধনের কথায় মৃদু হাসে খানিকটা দূরে তাকিয়ে দেখে মিতু মুগ্ধপানে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে।রাত নামার সাথে সাথে নীলগিরি সুন্দরী সাজে আরো অপরূপা হতে থাকে।চাঁদনী রাতে চাঁদের ফোয়ারায় সে কি এক অসামান্য আবেশ! আর ঝিরিঝিরি বাতাসে পুরো আকাশ জুড়ে নক্ষত্রের মেলা, সবচেয়ে বিস্ময়কর লাগে ইতিউতি মেঘের আনাগোনা যেন চাইলেই হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় বহু সাধের মেঘ!হালকা হালকা ঠান্ডা লাগছে মিতুর,মিতু যেন হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় নক্ষত্রময় আকাশটাকে।
দূর থেকে জামানকে ইশারা করে কি কথা বলছে এত স্যারের সাথে?হাত ইশারা করে ডাকে, ফের তার সংগী হয়ে মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠতে।
জামান বিস্ময় হয়ে ওঠে কেবলি,মিতুর উদ্দীপনা দেখে।
বন্ধন জামানকে আরো বলে,
“শোন তোমার ভাবীর সাথে তোমার ভাব হয়েছে কেমন?’
“স্যার খুব ভালো,তবে হঠাৎ হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে যান ভাবী।আপনাকে যে অনেক মিস করছে সেটা বোঝা যায়।’
“হুম তা আমি জানি।যেহেতু এখন তোমার ভাবীর সাথে বেশ ভাব হয়েছে তোমার,তুমি আমার হয়ে তাকে বোঝাবে, আর শোন আটটার ভিতর হেলিকপ্টারে করে চিটাগাং, সেখান থেকে বিমানে করে সোজা ঢাকা আমার বাসায় দিয়ে আসবে।খুব সাবধানে।ও হ্যা তোমার ভাবী অনেক ছেলেমানুষ, ওকে মজার মজার গল্প বলে প্রফুল্ল রাখবে।এই দায়িত্ব দিলাম জামান,জার্নির পুরো সময় জুড়ে তোমার ভাবীকে খেয়াল রাখবে।লেট মি রিমাইন্ড ইউ।সি ইস এক্সপেকটিং…সে এখন একা নয়, টেককেয়ার হার সিনসিয়ারলি ওকে!’
কমান্ড স্টাইলে বল্ল যেন বন্ধন,জামানকে।
“স্যার কঠিন একটা দায়িত্ব দিলেন।’
“আর ইউ এফ্রেইড?’
“নো স্যার আসলে ভাবী আই মিন ম্যাডাম অনেক বেশী ইমোশনাল,আপনাকে ছাড়া উনার মনটা অনেক খারাপ করে বসবে।তখন সামাল দেয়াটা বুঝেন তো স্যার?’
“দেখো আমি কাজে ফেঁসে না গেলে তো আর এটা হতো না,আর ছোটভাই হিসেবে তুমি ছাড়া এই মুহূর্তে আর কাকে ভরসা করবো বল ?’
“স্যার আই অ্যান্ডারস্ট্যান্ড।ওকে স্যার ইউ ডোন্ট ওয়ারি আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট টু টেক কেয়ার হার ডিউরিং দ্যা জার্নি।স্যার প্লিজ আপনি আপনার কাজে মন দিন এন্ড স্যার একটা রিকোয়েষ্ট?’
“হ্যা বলো।’
“কাজ শেষে ভাবীকে সময় দিবেন যত জলদি।’
“ইন শা আল্লাহ,তা আর বলতে….’
কথা শেষ হতেই জামান, মিতুর সামনে আসে এবার।
“ম্যাডাম আমাদের এখন যেতে হবে স্যারের অর্ডার।’
“ম্যাডাম!আমি ভাবী থেকে ম্যাডাম হয়ে গেলাম?ভাবীই তো ভালো ছিল?’
“না মানে অফিসিয়াল কার্টেসী।’
“হুম। আর একটু থাকা যাবে না?’
জামান ঘড়ি দেখে,ঘরির কাটা সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে।
“না ভাবী হাতে সময় কম।আটটার ভিতর হেলিকপ্টারে উঠতে হবে।’
“তাতো বুঝলাম তোমার ভাই তো কাজে আঁটকে গেছে,তার কাজ তো শেষ হতে দাও?’
“ভাবী প্লিজ মন খারাপ না করলে একটা কথা বলবো?’
“আবার কি কথা?’মিতু এবার ভ্রুকুটি করে তাকায় জামানের দিকে।
মিতুর এমন তীক্ষ্ণ চাহনী দেখে জামানের গলা শুকিয়ে আসে।
“তাকানো তো না যেন দশ নাম্বার মহা বিপদ সংকেত!স্যার তো আমারে আচ্ছা ফান্দে ফেলসে..
সব স্যারের ওয়াইফদের সামাল দিতে দিতে আমি তো তেজপাতা হয়ে গেলাম…দে সামাল দে জামান…তোর কাজই এখন এইটা….’
“স্যার তো কক্সবাজারে চলে গেসেন আপনাকে বলেন নি ভাবী?’
মিতু যেন থমকে গেল কথাটা শুনে।
“কি কক্সবাজারে?আমাকে এই অবস্থায় রেখে?কিভাবে গেলেন তোমার স্যার?’
“ভাবী প্লিজ রাগ করেন না?স্যারের এখানে কোন দোষ নাই,আর্মি অফিসারদের এই এক জ্বালা ভাবী।কখন কোন সিডিউল আসে… ভাবী,স্যারের সাথে তাহলে এতক্ষন কি কথা হয়েছে তাহলে?’
জামানের কৌতুহল।
“তোমার স্যার বল্লেন,আজই ঢাকায় চলে যাওয়ার জন্যে,বোধহয় তুমি দিয়ে আসবে এরকম কিছু বল্লেন।উনি যাবেন না এটা ধারনা ছিল,কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছিল না।তাছাড়া আমি ভাবতে পারছিনা আমি ঢাকা চলে যাব অথচ তোমার স্যারের সাথে দেখা হবে না একবারও এটা কেমন কথা?’
মিতুর চোখ ফের ছলছল হয়ে আসে…
“আহারে মাইয়া মানুষ!দুনিয়ার সব মেয়ে একটুতেই কেন যে এত সেন্টি হয়?হায় হায় ভাবী কি এখন চোখের পানি নাকের পানি এক করবে…?’মনে মনে বিড়বিড় করে জামান।
জামান ফের প্রসঙ্গ পাল্টাতে থাকে।
“ভাবী আকাশটা দেখেন কি অদ্ভুত সুন্দর!আকাশে কিন্তু অনেক নক্ষত্রের মেলা,মেঘের কারনে কিন্তু ওত বোঝা যাচ্ছে না,তাও হালকা বোঝা যাচ্ছে দেখেন ভাবী!’
“হুম।’মিতু এবার জামানের সাথে হাটতে হাটতে আকাশটার দিকে তাকায়।
জামান সাবধানে তাকে পথ দেখিয়ে দেয়।
কটেজে ফিরে তবে বন্ধনের জন্য মনটা ভীষন অস্থির করছে মিতুর।এত সুন্দর,মনোরমা দৃশ্য সে একা একাই দেখলো,অথচ কত আশা ছিল স্বামীর হাতে হাত রেখে এই সুন্দর সুন্দর জিনিসগুলো দেখবে!কত না মধুময় হতে পারতো সে স্মৃতি?’
“প্রায় ছয়মাস হয়েছে তোমার বাবার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে অথচ দেখো ছোটবাবু তোমার বাবা আমাকে আজও মধুচন্দ্রিমায় নিয়ে যায়নি?আর্মি অফিসার বলে কথা,কেমন ফাঁকি দিয়েছে তোমার মামনীকে দেখো….’
মিতু কনসিভ করার পর থেকেই পেটে হাত দিয়ে তার অনাগত শিশুটার সাথে কথা বলে।কি আর করা শিশুর পিতা তো মহাব্যস্ত। বলে লাগেজ গুছিয়ে ফেলে মিতু মন খারাপ করে।
হেলিকপ্টারে ওঠার আগে জামান, মিতুকে বলে ডিনারটা এখান থেকে সেরে নিতে।কিন্তু মিতু কিছু খেতে চায় না ওর নাকি গা গুলাচ্ছে,খেলে বমী হয়ে যেতে পারে।
জামান বেগ থেকে বড়ই এর আচার বের করে মিতুকে দেয়।বন্ধন আগেই সব বলে জামানকে দিয়ে আনিয়ে রেখেছে।
হেলিকপ্টারে উঠে মিতুকে আবার নীলগিরির সৌন্দর্য্য নিয়ে কথা বলে জামান।
চাঁদের আলোয় এক মায়াবী প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘিরে ফেলেছে তাদের।যদিও চাঁদটা ঐদিন ওতো বড় ছিল না আর তাতেই এতখানি মহনীয়তা!পুরো জোৎস্না থাকলে কি হতো মিতু ভেবে অবাক হয়।
জামান ফের বলে,
“ভাবী আকাশে অনেক তারা মিটিমিটি জ্বলছে দেখতে পারছেন?’
“হ্যা তবে আবছা।’
“ঢাকার আকাশে এরকম সৌন্দর্য পাবেনিই না ভাবী,তবে কক্সবাজার এর আকাশে কিন্তু বোঝা যায় বিশেষ করে সেইন্টমার্টিনে। আর ঢাকার বাইরে যে গ্রাম,শহর,উপশহর সেখানে কিছু দেখা যায়।’
“হুম।’
মিতু মুগ্ধ বিস্ময়ে, বিমোহিত নয়নে চারপাশে উজাড় করা বিশুদ্ধ সৌন্দর্য অবলোকন করছে ঠিকই, কিন্তু মনটা তার হঠাৎ করেই উদাস হয়।
বাংলাদেশে,নীলগিরি নামে যে এত সুন্দর জায়গা বা পর্যটন কেন্দ্র ছিল তার জানাই ছিল না।
নীচে তাকাতে ভয় করছিল মিতুর তারপর খুব সাবধানে যেন দেখে নেয় নীলগিরির পাহাড়ি সৌন্দর্য।পাহাড়ের দুধার ঘেষে আঁকাবাঁকা সরু পথ,দুইধারে অজস্র পাহাড়ি বুনো লতাপাতা,গুল্ম,নানা রং এর ঘাস ফুল আর সবুজে ঘেরা যেটা আজ দিনের আলোয় দেখেছিল কাপ্রুপাড়ায় নামবার পথে।হেলিকপটার থেকে যেন শেষবারের মতো দেখে নিতে চায়।হেলিকপটারে বাতাস অনেক বেশী তাই জানালার একটু দূরে সাবধানেই বসে।
চুল বাঁধা মিতুর মাথায় ঘোমটা দেয়া,বাতাসে বারবার নেমে যায় ঘোমটা।
জানালার ফাঁকে মেঘগুলোকে সাহস করে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় সে।
বন্ধন স্যার থাকলে,ভাবীকে এভাবে হাত বাড়াতে দিত না ভাবে জামান।
ফের বলে, “ভাবী দিনের আলো যখন ফোঁটে মেঘ গুলো আরও সুন্দর লাগে,এক একটা মেঘ যেন শুভ্র তুলো বালিশের মতো, মনে হয় কোলে নিয়ে ঘুমায় থাকি।’
মিতু জামানের কথা শুনে সশব্দে হেসে ওঠে এবার।
অনেকক্ষন পর যেন প্রাণ ফিরে এলো মিতুর।
“মেঘের এত সুন্দর বর্ণনা দিলা,আবার কোলবালিশ বানায় দিলা?এত শখ তোমার?’
জামানও মজা পেয়ে গেল শুনে ভাবীর কথায়।
অবশেষে ঢাকার ধানমন্ডির বাসায় পৌঁছায় মিতু রাত প্রায় একটার মতো বেজে যায়।নানুকে ফোন করে জানিয়ে দেয় বন্ধন মিতু চলে আসছে।কিন্তু সুসংবাদটা বন্ধনের কাছে পেয়ে নানুর মেজাজ থমথমে।
ফের শুরু করে নানু,
“তোর বউ পোয়াতি হইসে আর এই অবস্থায় ওরে লয়া এতদূর ঘুরতে গেসোস?আর এহন আমারে বইল্যা কি হইবো আমি কেডা?’
“কেন নানু তুমি কিছু জানো না?’
“জানলে কি এই কতা কই?মিতু কি আইজকাল আমার লগে কোন কতাবার্তি কয়….?’
“আহা নানু তুমি শুধু শুধু মিতুর উপর রাগ করছো,মিতু তো এমন মেয়ে নয়?’
“হো তোর বউ পয়াতি হইসে তোর বউরে কি খারাপ কওন যাইবো?ওহন দুনিয়ার বেবাগ খারাপ হইলাম আমরা……’
“আহ নানু কি শুরু করলে,তুমিই তো মিতুকে পছন্দ করে এনেছো?আর এখন এসব কি বলছো,দেখো নানু অশান্তি করোনা,ঘরে নতুন অতিথি আসছে এখন কি এভাবে কথা বলবে?রানুকে বা বুয়াকে মিতুর কাছে রেখো ওর দিকে খেয়াল রাখতে বলো।’
“হো আমরা ওহন বুড়া হয়া গেসি আমরা তো ওহন অশান্তি করি…. ‘
নানুর হা হতাশ শুনে বন্ধন এবার প্রচণ্ড রেগে যায়।
“এতোই যদি এমন আফসোস হচ্ছে তোমার, তাহলে আমাকে আবার বিয়ে দিলে কেন?যা খুশি করো….!’
বলেই ফোনটা দুম রেখে দেয় বন্ধন।(চলবে)অনেকে আমার গল্পের শহর চ্যানেল থেকে গল্প পড়ে না বিষয়টা আমাকে খুব কস্ট দেয় তাই গল্পের শহর থেকে নিয়মিত গল্প পড়তে ভিজিট করুন গল্পের শহর চ্যানেলের ।community আর চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে রাখুন যাতে পোস্ট হওয়ার সাথে সাথেই আপনি নোটিফিকেশন পান)
নিয়মিত গল্প পড়তে ভিজিট করুন গল্পের ঠিকানা ওয়েবসাইট এবং গল্পের শহর চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে রাখুন যাতে করে পোস্ট হওয়ার সাথে সাথেই নোটিফিকেশন পান

দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৩৫
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

আধঘন্টার বিমান জার্নিতে সারা পথ বমী করতে করতে ক্লান্ত মিতু।যদিও নীলগিরিতে কিছু খায় নি।খাওয়ার মতো শারীরিক, মানসিক কোন অবস্থাই ছিল না তার।শেষটায় বন্ধনকে না দেখতে পেরে পুরো ট্যুরটা তার কাছে পানসে লেগেছে।তবু জামান তাকে নানান কথায় মনটাকে ডাইভার্ট করতে চেয়েছে।কখনো কৌতুক,তার কখনো স্যারদের নানান মজার অভিজ্ঞতা অভিনয় করে যথাসাধ্য মিতুর মনকে চাঙা রাখতে চেয়েছে।
চিটাগাং এ এসে জামান, মিতুকে একটা রেস্তোরায় নিয়ে গেল খেতে।সেই দুপুরে খেয়েছে মিতু।তখনও শরীর ভালো লাগছিল কিন্তু এখন খাবারের কথা শুনেই যেন ওর গা গুলে আসছিল।একে তো জার্নি তার উপর প্রিয় মানুষটা কাছে নেই।
এসময় মেয়েরা স্বামীকে সবসময় কাছে পেতে চায়।স্বামী তাকে যত্ন করে খাওয়াবে,কেয়ার নিবে এটাই তো মিতু চেয়েছিল অন্য দশটা স্ত্রীর মতো।কিন্তু কি হলো?
আর বন্ধনেরও দোষ নেই।লোকটা এত ব্যস্ত।তবু বারবার জামানকে ফোন করে মিতুর খোঁজ খবর নিচ্ছে।কখনো আপ্লুত হয়ে পড়ছে কিন্তু এখন আফসোস করা ছাড়া আর কিই বা করার আছে?
তারপরও পেটের শিশুটির কথা ভেবে মিতু খেতে বসে।রাত এগারোটার মতো বাজে।নীলগিরি থেকে হেলিকপটার দিয়ে চিটাগাং এ আসতে যদিও খুব বেশী সময় লাগেনি তবে মিতু, তার স্বামীর করে দেয়া পূর্বের ব্যবস্থামতো চিটাগাং আর্মি রেষ্টহাউসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নেয়।
রেস্তোঁয়ায় এত রাতে খাবার তেমন নেই বল্লেই চলে।মুরগী,ডাল ভুনা,ভাজি ছিল।
মিতু কষ্ট করে খেয়ে নেয়।কিন্তু বুঝতে পারেনি এতটা বমী হয়ে যাবে।বিমানে ওয়াশরুমে বমী করছিল,এয়ার হোস্টেজ তাকে ধরে সাহায্য করছে।কিন্তু মিতুর যেন সহ্য হচ্ছিল না অন্য কারো স্পর্শ।
মাথা ঘুরছিল ওর, ঘোরের ভিতর বাবু বাবু বলে কয়েকবার ডাকছে আর মুহুর্তেই মুর্ছা যাচ্ছে।
অথচ গতকালকেও তার বাবু তাকে সারাটাক্ষন প্লেনে পেছন দিক থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে ছিল।গতদিন তো কোন বমী হয় নি?
জামান হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে।প্লেন চলাকালীন তো ফোনও করা যায় না।সুইচ অফ রাখতে হয়।
তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে এয়ারহোস্টেজ লেডিদের সহায়তা নিতে হয়।
বিমানের একপাশে বিছানার মতো একটা ব্যবস্থা করা ছিল অনেকটা ইজি চেয়ারের মতো।
এয়ারহোস্টেজ মেয়েরা মিতুকে ধরে সেখানে শুইয়ে দেয়।একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা যাত্রী দেখছিলেন মিতুর এ অবস্থা।উনি মিতুর মাথার কাছে এসে বসলেন।
উনার বেগ থেকে একটা তেল এর শিশি বের করে মিতুর মাথা ঢলে দিতে লাগলেন।
“আহা বেচারি কি হয়েছে বেটি?বাবু বলে কাকে ডাকছো?’
“উনি আমার সাহেব।’
“উনি কোথায় বেটি,সংগে করে কাকে এনেছো?’
মিতু জামানের দিকে ইশারা করে কি বলবে একটু চিন্তা করে বলে,
“আমার স্বামীর ছোট ভাই এর মতো হয়।’
“সে কি স্বামী তোমাকে একেলা কেন ছেড়েছে তুমি তো মা অনেক অসু্স্থ?বারবার বমী কেন করছো…?’
বলতে না বলতেই ফের বমী মিতুর।
“আস্তে আস্তে বেটি…।’
ভদ্রমহিলা তাকে সহযোগিতা করে মিতুকে বড় প্লাসটিকের ব্যাগ দিয়ে দেয়া হয়েছিল।
বমী করার পর কিছুটা হালকা লাগে মিতুর।
মিতু প্রেগন্যান্ট সেটা জানিয়ে দেয়।ভদ্রমহিলা অবশ্য মিতুর অবস্থা দেখেই বুঝে ফেলেন।
স্বামীর জন্য অস্থির মিতুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
“এই তো বেটি আর একটু পর প্লেন ল্যান্ড করবে, তোমার স্বামী তোমাকে নিতে আসবে তো?’
কথাটা শুনে মিতু যেন এবার কেঁদে ফেলে।
“উনি কক্সবাজারে আন্টি উনি কনফারেন্সে ব্যস্ত বলেই তো আসতে পারেন নি!কবে দেখা হবে তাও জানি না?’
“আহা বেটি কাঁদে না, আমি বুঝি মা এসময় স্বামীর জন্য মন কেমন করে,তোমার স্বামী উনিও বুঝি আর্মি অফিসার? ‘
জামানকে দেখে বুঝে যান মহিলা।
“জ্বী।’
“মা তোমার আংকেলও কিন্তু কর্নেল ছিলেন উনাদের অনেক দায়িত্ব মা একটু ধৈর্য্য ধর,কাজ শেষ হলেই তোমার বাবু তোমার কাছে আসবে….।’
এভাবে নানা কথায় মহিলাকে ভালো লেগে গেল মিতুর।
মিতুর মা নেই শুনে ভদ্রমহিলাও আবেগী হয়ে উঠলেন।বল্লেন তারও এক কষ্টের কাহিনী।মিতুর মতো বয়সী তার এক মেয়ে ছিল,সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যায় মেয়েটা।
মিতুকে তার গুলশানের বাসার এডরেস ও ফোন নাম্বার দিয়ে দিল।
মিতু যখন বাসায় ফিরলো রাত প্রায় একটার মতো বেজে গিয়েছে।
ঘরে কলিংবেল বাজতেই বুয়া খুলে দিল।বুয়াকে দেখে স্বস্তি এখন মিতুর।
এ বাসায় তো এখন সবাই তার সাথে অপরিচিত মানুষের মতো আচরন করছে।
জামান আর ঘরে ঢুকেনি।মিতু যদিও সাধলো, জবাবে জানালো কাছেই তার বোনের বাসা সেখানে উঠবে।
নানু আর বাবাই এর খোঁজ জানতে চায় মিতু বরাবরের মতো বুয়ার কাছ থেকে।
তারা ঘুমিয়ে গেছে,আর নানু যে বন্ধনের কথামতো বুয়াকে খবর দিয়ে আনিয়েছে তা বুয়ার কথায় বোঝা যায়।
“আফামনি শরীর ওহন কেমন লাগতাসে?’
“ভালো না বুয়া,সারা রাস্তায় বমী করেছি,তার ভেতর তোমার ভাই নাই…বাজে অবস্থা।’
“আফামনি গিজার্ড ছাইরা দিমু গোসল করবেন?’
“গোসলটা করলে ভালো হতো কিন্তু এ অবস্থায় কি গোসল করা যাবে?’
“না না থাক্,শরীল মুইছা ফেলেন,জামা কাপড় বদলায়া ঘুমায় পড়েন,না হইলে ভাইয়ে আবার টেনশন করবো।’
“তুমি বুঝলে কি করে?’
“বুড়ী কি জানি কইতেসিল।আইজ মনে হয় ভাই এর লগে কথা কাটাকাটি হইসিল।আমারে তড়িঘড়ি কইরা খবর দিয়া আনসে,বুড়ী কয় যে কি কয়? ‘
“কি বলে?’
“কয় আমার বাবুসোনারে মিতু এমন জাদু করসে এখন হে যা কয় তাই শুনা লাগবো?নাইলে আমারে এত রাতে এমনে কইরা খবর দেয় কন?’
“তাই নাকি?নানু এসব বলেছে?’
“হো। বুড়ীর মাথা পুরাই গেসে আর রানু তো তাতে ইসসামতো তেল ঢালতাসে।’
মিতু এবার সত্যি চিন্তিত হয়ে পড়ে।ফোনের চার্জও নেই যে বাবুর সাথে দুটা কথা বলবে।বাসায় নামার পথে জামানের ফোনে তাও একটু কথা হয়েছিল কিন্তু নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না।
মিতু গোসল করে না তবে ফ্রেশ হয়ে আসে ভালো মতোন।রাতে ঢিলেঢালা পোশাক কখনোবা বন্ধনের দেয়া স্লিপিং স্যুট পড়ে।
ফ্রেশ হয়ে এসে রাতের নামাজের ফরজটা পড়ে নেয় শুধু।এসময় বেশী বেশী কোরআন পাঠ করবে মনে মনে ঠিক করে সে।
তবে প্রচন্ড ক্ষুধা লাগে তার।
“ফ্রিজে খাবার কি আছে বুয়া?’
“বিরানী আসে,ছোটবাবু আজ খাইতে চাইসিল,খানসামা আইসা রাইনধা দিয়া গেসে।’
“উফহ্ তাড়াতাড়ি গরম করে আনো।’
বিরানী খুবই পছন্দের খাবার মিতু।খাবারের নাম শুনেই আরো ক্ষুধা দ্বিগুন গেলো বেড়ে।
বুয়া খাবারটা গরম করে আনলো।রাত আড়াইটার মতো বেজে গেছে।মোবাইলেও চার্জ হয়ে গেছে।বাসায় এসে দিয়েছিল মনে করে।
ক্ষুধার তাড়নায় তৃপ্তি করে খেয় নিল তার পছন্দের বিরিয়ানি। যদিও মিতু এখন আগের মতো ওত খায়না, রাতে এসব রিচ খাবার এভোয়েড করে।
তাছাড়া রাতে কিছুদিন না খেয়ে থাকারও অভ্যেস করেছিল ডায়েট ফলো করতে গিয়ে।
মোবাইলটা অন করে।বন্ধনকে ফোন করবে কিনা ভাবে।
“কি করছে আমার বাবুটা?’
বন্ধনের একটা টেক্সট ম্যাসেজ আসে,
“জান আই এম রিয়ালি এক্সট্রিম লি সরি।বাসায় যেয়ে কিছু খেয়ে নিও আর লক্ষী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ো আর হ্যা ওষুধ মনে করে খেও।’
প্রেগন্যাসসির জন্যে দেয়া ভিটামিন,আয়রন,ক্যালসিয়াম খেয়ে নেয় মিতু।
মিতু টেক্সট ব্যাক করে,
“আপনার বুক ছাড়া আমি কি এখন ঘুমাতে পারি?কই আপনি এসময় আমাকে বেশী বেশী ভালোবাসবেন,সময় দিবেন?কোথায় আপনি পড়ে আছেন আর কই আমি…’
সেন্ড করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মিতু।বমী আজকের মতো আর না আসলেই হয়।বুয়াও তেল আর ঠান্ডা পানি মিতুর মাথায় ডলে দিতে থাকে।
মিতু তার স্বামীর ছবি মোবাইল স্ক্রীনে দেখতে থাকে।আর ভাবে আজ সেই ভদ্রমহিলার কথা যার কিনা মেয়েটা মারা যায় বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে।
অজানা একটা আশংকা মিতুকে ছেয়ে যায়।ফের আল্লাহর উপর ভরসা করে।মিতু প্রেগন্যান্ট শুনে ভদ্রমহিলা কত মায়া করলেন,কপালে নির্দ্বিধায় চুমু খেলেন মিতুর কাছে মনে হয়েছিল, সেই যেন তার মা।রাজশাহী দেশের বাড়ী,এখানে গুলশানে স্বামী,ছেলে,ছেলে বউকে নিয়ে থাকেন।একদিন যাবে মিতু এই এক দিনের পরিচিত এমন দরুদে মায়ের কাছে।
মিতুর এখন তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ল।ঘুমের ঘোরে অজান্তে সেই মহিলার কথা ভাবলো,অসহায় মিতু পেটে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে,
“আমার তো মা নেই,হবেন আপনি আমার মা?আমার যে এখন মায়ের আদর অনেক দরকার….'(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here