ধ্রুব পর্ব ২৭

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৭

আমার শ্বশুর মহাশয়ের জীবদ্দশায় ধ্রুবর নামে তিনি উত্তরার যেই পাঁচকাঠা জমি কিনেছিলেন ওর চিকিৎসার জন্য দালালের সহযোগিতায় খুবই অল্প সময়ের মধ্যে দুইকোটি দশলক্ষ টাকায় সেই জমিটা বিক্রি করে ফেলা হলো। ধ্রবর শিপিং কম্পানী থেকে তারাও বেশ ভালো পরিমানে সহযোগিতা করলো। সবমিলিয়ে দুই পরিবারের গণ্যমান্য সদস্যরা সবাই বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন ধ্রুবর চিকিৎসা দেশের বাইরে করা হবে। ধ্রুব প্রথমে একটু নাখুশ ছিলো। এতগুলো টাকা ওর চিকিৎসার জন্য খরচ হবে শুনে ক্রমেই সেটা ঘোর আপত্তিতে পরিনত হলো। আমি এবং আন্টি ওর আপত্তি পুরোদমে খারিজ করে দিলাম। যেহেতু দেশের বাইরে চিকিৎসা হবে সুতরাং প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়তি টাকাপয়সা অবশ্যই হাতে রাখা উচিৎ! আমরা কোনভাবেই চাইছিলাম না ট্রিটমেন্টে বিন্দুমাত্র গাফিলতি হোক! টাকা পয়সা খরচ হয় হোক কিন্তু বেস্ট ট্রিটমেন্ট যেন নিশ্চিত হয়!

ধ্রুবর ছুটি, ভিসার কাগজপত্র সব রেডি করতে প্রায় একমাসের মত লেগে গেলো। যাওয়ার আগে টেলিফোনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম আমরা আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ ক্লিনিকাল সেন্টার, বেথেসডা, ম্যারিল্যান্ড এর একজন চিকিৎসক এর সাথে যোগাযোগ করি। পরোবর্তীতে তাঁর রেফারেন্সেই চিকিৎসার জন্য ধ্রুবকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো।

ধ্রুবর সাথে আন্টি এবং তরুর বর সাদেক ভাই গেলেন। প্রেগন্যান্সির কারণে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো না। আমাকে বোঝানো হলো এইমুহূর্তে একজন মানুষ বাড়তি যাওয়া মানে একজন মানুষের জন্য বাড়তি খরচ! আমি না গেলে সেই টাকাটা ধ্রুব চিকিৎসার জন্য খরচ করা যাবে! আমি রাজি হয়ে গেলাম! পরে জানতে পারলাম ধ্রুবর বুদ্ধিতেই আমাকে এসব ইমোশনাল কথাবার্তা বলা হয়েছে। ধ্রুব চাইছিলো না এই অবস্থায় আমি আমেরিকাতে যাই। এই কয়েকমাসের ছোটাছুটিতে অলরেডি আমার স্বাস্থ্য অনেকখানিই ভেঙ্গে গেছে। বেবি এবং আমার স্বাস্থ্যসুরক্ষার কথা চিন্তা করেই ও আমাকে লুকিয়ে এই প্ল্যানটা করেছিলো! শুনে খুব রাগ হলেও কিছু করার ছিলো না!

আমেরিকাতে যাওয়ার আগে ধ্রুব যেই কয়দিন বাসায় ছিলো বাসার বাইরে বেরই হয় নি বলতে গেলে। সারাক্ষণ বাসায় বসে গম্ভীরমুখে চুপচাপ কি যেন ভাবতো। কখনো বারান্দায় বসে, কখনো কম্পিউটার টেবিলের সামনে, কখনো ছাদে! ওর চিন্তিত মুখ দেখে আমি ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে যেতাম। একসাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ে যেত! কত হাসিমাখা সুন্দর, প্রাণোচ্ছলই না ছিলো দিনগুলি! সব এখন স্মৃতি! কে জানতো আমার সুখের খামে জড়িয়ে থাকা দিনগুলি কান্নারবৃষ্টিতে চাপা পড়ে দিনরাত এভাবে গুমড়ে মরবে! জীবন সুখের দিপ্রহরে এসে ঝলমলে করতে থাকা আলোর পরিবর্তে নৈশপ্রহরের গাঢ় অন্ধকার দেখতে হবে! তবুও ধ্রুবর ভালো হয়ে যাবার আশা নিয়ে নতুন দিনের অপেক্ষায় থাকতাম!

বাসায় থাকাকালীন সময়ে প্রায় সারাক্ষণই আমি ধ্রুবর আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম। নিজেকে ধ্রুবতে কনভার্ট করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালাম। ও আগে আমার সাথে যেই কাজগুলো করতো আমি বেশি বেশি সেই কাজগুলোই ওর সাথে করতাম! ওর মুখে একট টুকরো হাসি দেখবো বলেই আমার যত নিরলস পরিশ্রম!

আমেরিকাতে যাওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে একদিন দেখলাম ও কম্পিউটার টেবিলের সামনে বসে কি যেন টাইপ করছে। আমি ওর জন্য চা নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ও তখনো টাইপ করছিলো। চায়ের কাপটা ওর সামনে রেখে লাজুক হেসে বললাম,”এক্সকিউজমি স্যার! মে আই হ্যাভ ইউর অ্যাটেনশন?”
ধ্রুব ব্যস্তভাবে চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,”কাজ করছি।”

আমি হার মানলাম না। ওর মুখটা নিজের দিয়ে ঘুরিয়ে বললাম,”কাজ পরে, আগে আমার কথা শোনো।”

ধ্রুব মুচকি হেসে বললো,”ঠিক আছে। কি বলবে বলো!

আমি লজ্জায় আরক্তিম হয়ে মৃদুকন্ঠে ফিসফিস করে বললাম,”মি.হ্যান্ডসাম! মে আই হ্যাভ ইউর লিপ্স ফর ফাইভ মিনিট? আমি কি আপনার ঠোঁট দুটো পাঁচমিনিটের জন্য ধার পেতে পারি?”

ধ্রুব পলকহীন ভাবে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আমি ভেতরে ভেতরে বিব্রত হলেও মুখে প্রকাশ করলাম না। জোর করে মুখে হাসি বজায় রাখলাম। ধ্রুব ফের টাইপিং এ মনোযোগ দিয়ে বললো,”মরে যাবো ভাবছো?”
রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে হয়ে গেলো আমার মুখ। তীরের ফলার মত তীক্ষ্ণভাবে বুকে গিয়ে লেগেছে কথাটা! ভয়ে পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো! হঠাৎই কেঁদে ফেললাম। ধ্রুব ধরলো না। চেয়ারের পিঠে কনুই ঠেকিয়ে নিরবে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আগের নিশাত হলে হয়ত এই কথার পর রাগ করে উঠে চলে যেতাম কিংবা ইচ্ছেমত ধ্রুবকে কিছু কটূ কথা শুনিয়ে দিতাম। কিন্তু আজকে পারলাম নাম! নিজে থেকেই ওর কাছে সরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,”আমি শুধু তোমার মন ভালো করার জন্য বলেছিলাম!”
ধ্রুব আরো কিছুক্ষন চুপ করে থেকে হো হো করে হেসে উঠে বললো,”জানি আমি! মজা করছিলাম।”

আমি জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলাম। মাথা থেকে ধ্রুবর বলা কথাটা কিছুতেই সরাতে পারলাম না।হৃদপিন্ডের তীব্রগতির সাথে পাল্লা দিয়ে মাথায় ভেতরেও ঘুরছে! এইমুহূর্তে ওয়াশরুমে ঢুকে কিছুক্ষন হাউমাউ করে কাঁদতে পারলে মনটা হালকা হতো। কিন্তু সেটা সম্ভব না। ধ্রুব এখন একটু নরমাল আছে, আমি কাঁদছি টের পেলে হয়ত আবার মন খারাপ করে ফেলবে। মৌনমুখে বসে রইলাম। ধ্রুব আমার হাতের আঙ্গুল টেনে দিয়ে দিতে দিতে বললো,”আমি মাঝে মাঝেই ভাবি জানো, আমার কিছু হয়ে গেলে মায়ের কি হবে? বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমাদের দুইভাই বোনকে নিয়েই মা বেঁচে আছেন। আপুর তো বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আমার কিছু হয়ে গেলে মাকে কে দেখবে! কি করে থাকবে মা!”
ধ্রুবর প্রশ্নের জবাবে আমি যেন নিজেকে শুনিয়েই বললাম,”তোমার কিচ্ছু হবে না! তুমি একদম ভালো হয়ে যাবে!”

ধ্রুব হাসলো। বললো,”আরো অনেক কিছুই ভাবি!”
আমি ওর বুকে মাথাটা রেখে বললাম,”আর কিচ্ছু ভাবার দরকার নেই। আপাতত তুমি শুধু একটাই কাজ করবে। সেটা হচ্ছে বেশি বেশি করে আমাকে ভালোবাসবে! এর বাইরে আর কিছু ভাবার দরকার নেই।”

আমার কথা ধ্রুব শুনেছে কি না বোঝা গেল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”তোমার কথা ভাবলে খুব কষ্ট লাগে নিশাত! প্রতিটা মুহূর্তে আমার ভয় হয়! যখনই আমি ভাবি আমি চলে গেলে আমার নিশাত তো পাগল হয়ে যাবে তখন আমার ভেতরটা অসহায়ের মত আর্তনাদ করে উঠে! আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। অস্থির, অসহ্য, দুর্বিষহ লাগে সবকিছু!”

এই কথাগুলো আমি শুনতে চাই না। বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠে। মানসিক শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। হাহাকারে মাতম তুলে দেয়!জবাবহীন হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুব আমার ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে একমুহূর্তেই আমার ভেতরটাকে পড়ে নিলো। হেসে উঠে বললো,”জানোই তো অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা! এন আইডেল ব্রেইন ইজ দ্যা ডেভিল’স ওয়ার্কশপ! তাই আজেবাজে চিন্তা মাথায় আসে।” আমি এবারেও চুপ করে রইলাম। ধ্রুব দুষ্টু হেসে বললো,”তারপর আরো কি মনে হয় জানো? মনে হয় আমার চুমু ছাড়া তো নিশাত পাগলীটার ঘুমই হয় না। কি হবে তাহলে! তাই ভাবি তোমার একটা বিয়ে দিয়ে যেতে পারলে ভালো হত! আবার মাঝেমাঝে তো ভাবি ভূত হয়ে তোমাকে চুমু খেয়ে যাবো! ”

আমার পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব হলো না। মাথায় যন্ত্রনা শুরু হলো! কান্নাচেপে নিজের ঘরে চলে এলাম। রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় ধ্রুব গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো! ইচ্ছে করছিলো আবার ছুটে ওর কাছে যাই। কেঁদে ফেলার ভয়ে গেলাম না! কিন্তু হায়! আমি যত বেশি কান্নাকে এড়িয়ে যেতে চাইলাম কান্না ততসহজে আমাকে পিছু ছাড়লো না!

এয়ারপোর্টে যেদিন ধ্রুবকে সি অফ করতে গেলাম সেদিন আমার কান্না দেখে আশেপাশের লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছিলো। আমার চিৎকারে বোধহয় এয়ারপোর্টের আকাশ বাতাস মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিলো। ধ্রুবকে হারানোর ভয় আমার সমস্ত পৃথিবীটাকে ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিচ্ছিলো। আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিলো, এমনকি আশেপাশে লোকজন পর্যন্ত চোখের জল ফেলেছিলো আমার কান্না দেখে। টেনে আমাকে ধ্রুবর কাছ থেকে সরানো যাচ্ছিলো না। আমি স্থান কাল পাত্র ভুলে গিয়ে পাগলের মত ওকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিলাম।

আমাকে শান্ত করা যাচ্ছিলো না দেখে ধ্রুব লাজলজ্জা ভুলে সবার সামনেই দুহাতে আমাকে আঁকড়ে ধরে বললো,”শান্ত হও নিশাত! আমার কিচ্ছু হবে না। আমি ভালো হয়ে যাবো।”
আমি আরো শক্ত করে, আরো জোরে, খুব জোরে ধ্রুবকে আঁকড়ে ধরলাম। ঐমুহূর্তটাতে ধ্রুবকে হারানোর ভয় এতটাই প্রবলভাবে কাজ করছিলো যে আমার আশেপাশে কাউকে সহ্য করতে পারছিলাম না। সবার বাধা ঠেলে ধ্রুবকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলার চেষ্টা করছিলাম!

শরীরের সব শক্তি দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ধ্রুব সরালো না। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার কান্না থামলো ততক্ষন পর্যন্ত আমাকে জড়িয়ে ধরে বিরতিহীনভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আমি পুরোটা সময় ওর বুকে মাথা রেখে অসহায়ের মত কাঁদলাম। কান্নার বেগ কিছুটা কমলে ও আমার দুগালে হাত রেখে চোখভর্তি পানি নিয়ে বললো,”এবার একটু হাসো নিশাত। অনেকদিন তোমার হাসি দেখি না!”
ধ্রুব হাসতে বলায় মনে পড়লো কতদিন দুজনে একসঙ্গে হাসি না! হাসি এলো না! হাসির পরিবর্তে বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে গেলো। অনেক্ষন কপালে কপাল ঠেকিয়ে দুজনেই নিঃশব্দে কাঁদলাম।”

ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে। বাবা আর চাচ্চু জোর করে আমাকে ধ্রুবর কাছ থেকে টেনে সরালো। ধ্রুব যখন ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে যাচ্ছিলো আমার মনে হচ্ছিলো আমার সমস্ত পৃথিবীটাকে কেউ সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে! আমি কান্নারত চোখে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় চেয়ে রইলাম। আমার অন্তরাত্মা জানে সেদিন কতটা ভালোবাসার কাঙ্গাল হয়ে গিয়েছিলাম আমি!

ধ্রুব চলে যাওয়ার পর আমি জানতে পারলাম, ওর জেদের কারনেই বাবা জমি বিক্রির টাকা থেকে আমার নামে আলাদা কিছু সেভিংস রাখতে বাধ্য হয়েছেন। এবং আন্টির পরামর্শে বিয়ের পর আমরা যেই নতুন ফ্ল্যাটটিতে উঠেছিলাম তার মালিকানাও আমার নামে হস্তান্তরের সব ব্যাবস্থা ধ্রুব নিজেই করে দিয়ে গেছে। এসবের উদ্দেশ্য কি কারোই বুঝতে অসুবিধে হলো না! ভবিষ্যতে আমাকে কিংবা আমার অনাগত সন্তানকে যাতে কোনরকম ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিসে পড়তে না হয় তারজন্যই ধ্রুব এই ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here