ধ্রুব পর্ব ২৬

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৬

ধ্রুবর অসুখের খবর একে একে আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবার কানে পৌঁছে গেলো। সেই সাথে আমার প্রেগন্যান্সির খবরও! রোজই কেউ না কেউ দেখা করতে আসে কিংবা ফোন করে সমবেদনা জানায়। হিতাকাঙ্ক্ষি মহিলাদের মধ্যে বেশিরভাগই আমার দুর্দশা নিয়ে কপাল চাপড়ালো। খুব করে আমাকে বোঝালো অ্যাবোরশন করে ফেলার জন্য। এই সময় বেবি নেওয়াটা মোটেও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নয়! আমি পাত্তা না দিয়ে চুপ করে থাকতাম। কিন্তু যত সহজ ভাবে আমি এড়িয়ে যেতে পারবো ভেবেছিলাম বিষয়টা তত সহজ রইলো না।

চারদিকের চাপে, দুশ্চিন্তায় আতঙ্কে বাবা মা অস্থির হয়ে গেলেন। বাকিদের মত তারাও অ্যাবোরশনের জন্য মরিয়ে হয়ে উঠলেন। এমনকি ধ্রুবকে কনভিন্স করার জন্য বাবা লোক পর্যন্ত লাগিয়ে দিলেন। সেই লোকেরা তথাকথিত হিতাকাঙ্ক্ষি সেজে কখনো বাসায় এসে কিংবা কখনো ফোন করে আমার ভালোমন্দের ব্যাপারে ধ্রুবকে সতর্ক করতে শুরু করলো! খোলাখুলিভাবে কিছু না বললেও বেশিরভাগই ইশারা ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করতো এই পরিস্থিতি অ্যাবোরশনের কোন বিকল্প নেই ! অথচ আমি এসবের কিছুই জানতাম না।

দুতিনদিন বাদে একদিনে সকালে বাবা,মাকে নিয়ে হাজির হলেন। তখনো আমি জানতাম না অ্যাবোরশনের ব্যাপারে তারাই ধ্রুবর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ভেবেছিলাম ধ্রুবকে দেখতে এসেছে।

সকাল থেকেই ধ্রুবর শরীর খারাপ। বমি হয়েছে দুবার, খিঁচুনি ছিলো। সেই সাথে ইদানীং আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি ও সবকিছু কেমন যেন ভুলে যায়। ওর শরীর খারাপ দেখে মন মেজাজ ভালো নেই। মাকে দেখে চেপে রাখা কান্নাটা প্রবল বেগে বেরিয়ে এলো। তার বুকে মাথা রেখে কাঁদছিলাম। মা আমার গায়ে, মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”ধৈর্য রাখ মা! এত ভেঙ্গে পড়িস না! ধ্রুবর কিচ্ছু হবে না। আল্লাহ ভরসা!”

আমি কান্নারুত অবস্থায়ই তাঁকে ধ্রুবর শারীরিক অসুস্থার কথা এক এক করে সব বলছিলাম। হঠাৎ মা আমার কথার মাঝখানে ইতস্তত করে বললো,”তোকে একটা কথা বলার ছিলো মা!”

আমি কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কি?”

মা শঙ্কিত মুখে ভয়াতুর কন্ঠে বললো,”বাচ্চাটাকে অ্যাবোর্ট করিয়ে ফেল। ধ্রুব সুস্থ হলে পরে আবার বেবি নিতে পারবি। কিন্তু এখন বেবি নেওয়ার সময় নয়। এইমুহূর্তে তোর বেশি করে ধ্রুবর পাশে থাকা উচিৎ। ওকে সময় দেওয়া উচিৎ, ওর যত্ন নেওয়া উচিৎ। এই অবস্থায় তুই ওর যত্ন নিবি কি করে? তাছাড়া আল্লাহ না করুক ওর কিছু হয়ে গেলে তোরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে।”

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! প্র‍থমে ভেবেছিলাম মাতৃসুলভ দুশ্চিন্তা! কিন্তু ধীরেধীরে বুঝতে পারলাম না দুশ্চিন্তা নয়, এটা মায়ের স্বার্থপরতা! নিদারুণ কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো। আমার ধ্রুবর এই দুঃসময়ে আমার নিজের আপনজনেরা পর্যন্ত স্বার্থপর হয়ে গেছে! এই লজ্জা আমি কি দিয়ে ঢাকবো!” অগ্নিদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,”তোমাদের কি দয়া মায়া বলে কিছু নেই? একবারও ধ্রুবর কথাটা ভাবছো না?”

মা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,”ভাবছি রে মা! ভাবছি। আল্লাহর কাছে বারবার শুধু ওর জন্যই দোয়াই করছি। আল্লাহ যেন ওকে সুস্থ করে দেয়। নেক হায়াত দান করে। কিন্তু! আমি মা! আমাকে তো আমার মেয়ের ভবিষ্যতের কথাও ভাবতে হয়! আল্লাহ না করুক ওর কিছু হয়ে গেলে তোর কি হবে? কে দেখবে তোকে! তোর এই বাচ্চাকে?”

লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস ধ্রুব সামনে নেই! ও সামনে থাকলে এসব কথা শুনে মরার আগেই মরে যেত ! আমি থমথমে গলায় বললাম,”যতদিন আমি আছি ততদিন আমার সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। তাছাড়া ধ্রুব রাস্তার ফকির নয় যে তার সন্তানের দায়িত্ব অন্য কাউকে নিতে হবে। ভুলেও আর কখনো এসব কথা আমার সামনে বলবে না।”

মা হাল ছাড়লো না। নিজের মতামতকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললো,”শুধু টাকা পয়সাই কি সব? তোর বয়স কম। আজ বাদে কাল ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে তুই সারাজীবন একা থাকবি কি করে? মাথার ওপরে তো একটা শক্ত আশ্রয় চাই!”

রাগের বশত স্বীকার না করলেও আমি জানি মায়ের যুক্তি ভিত্তিহীন নয়! কারণ পৃথিবীর সকল বাবা মায়ের কাছে সবার আগে তাদের সন্তান, সন্তানের ভবিষ্যৎ! সন্তানের জন্য স্বার্থপর হতে বাবা মা একমুহূর্ত দ্বিধা করেন না। আমার বাবা মাও এর ব্যতিক্রম নয়। তারা হয়ত ধারণা করে নিয়েছে ধ্রুবর যদি কিছু হয়ে যায় তাঁরা আমাকে আবার বিয়ে দেবেন। তাই বাচ্চাটাকে নিয়ে তাদের এত সমস্যা। আমাদের সমাজে বাচ্চাসহ একটা মেয়েকে বিয়ে দেওয়া খুব সহজ কথা নয়! সেই ভয় থেকেই বাবা মা অ্যাবোরশন করানোর জন্য মরিয়া হয়ে গেছে।

মায়ের কথার জবাবে কিছু বলার আগেই বাবা ধ্রুবকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ইশারায় মাকে জিজ্ঞেস করলেন কাজ হয়েছে কি না। মা হতাশমুখে নাসূচক মাথা দোলালো। বাবার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। থমথমে গলায় ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বললো,” ওকে বোঝাও ধ্রুব সবসময় খুব বেশি মহৎ হওয়ার ফলাফল ভালো নাও হতে পারে! আবেগ দিয়ে জীবন চলে না! পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনরা দুতিনদিন বাহবা দেবে তারপর আর কেউ কারো নয়! সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। বেঁচে আছো কি মরে গেছো তার খোঁজও নিতে আসবে না! তাই সময় থাকতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ। পরে অনুতাপ করে কোন লাভ হবে না কারন বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর!”

ধ্রুব নতমুখে দাঁড়িয়ে রইলো। মুখে হাসি নেই! আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। সব কিছুর একটা সীমা আছে। বাবা মা হিসেবে আমার জন্য তাদের দুশ্চিন্তা থাকতেই পারে! কিন্তু তাই বলে ধ্রুবর সাথে এতটা স্বার্থপরতা! একটা মানুষ মরতে বসেছে তার চিন্তা বাদ দিয়ে সবাই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। এ কি নিষ্ঠুর পৃথিবী! ইয়া আল্লাহ কি দেখাচ্ছো এসব আমাকে! আমার চোখের সামনে কেন আমার ধ্রুবকে তুমি এতটা অবহেলার বস্তু বানাচ্ছো! কিসের সাজা দিচ্ছো তাকে! যার মুখে সদাসর্বদা একটুকরো হাসি লেগে থাকতো তার মুখের দিকে আজকাল তাকানো যায় না। যেই মানুষটার আত্মসম্মান নিয়ে একসময় আমার গর্ব হতো সেই মানুষটা এখন অপরাধীর মত মুখ করে ঘোরে! নিজেকে আমি কি দিয়ে বোঝাবো?

কথা শেষে বাবা মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বেরিয়া যাওয়ার সময় মা আমার বাহু চেপে ধরে কোমল স্বরে বললো,”তুই আমাদের ভুল বুঝিস না মা। তোর যেমন তোর সন্তানকে নিয়ে চিন্তা হয় আমাদেরও তো তেমনি তোকে নিয়ে, তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা হয়।” আমি রাগে মুখ ফিরিয়ে নিলাম!

মা বাবা বেরিয়ে গেলে রাগে ক্রুদ্ধ হয়ে ধ্রুবর কলার চেপে ধরে বললাম,”কেন তুমি চুপ করে আছো? কেন তুমি বলছো না বেবি তোমারও চাই! তোমার বাচ্চার ব্যাপারে ডিসিশন নেওয়ার অধিকার কেন তুমি আরেকজনকে দিচ্ছো? বলো?”

ধ্রুব মাথা নিচু রেখে নিস্তেজ গলায় বললো,”আমার বেবি চাই না!” হতাশা, যন্ত্রনা আমাকে মতিচ্ছন্ন করে দিলো! দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে অসুস্থ মানুষটার বুকে এলোপাথাড়ি কিল মেরে বললাম,”কেন চাইনা? এই কথাটা বলতে একটুও লজ্জা করলো না তোমার? আমার বেবি তোমাদের কি এমন ক্ষতি করেছে যে তোমরা সবাই ওকে মারার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো?”

কিন্তু ফলাফল শূন্য! ধ্রুব আগের মতই নির্লিপ্ত! যেমনি দাঁড়িয়ে ছিলো তেমনি দাঁড়িয়ে রইলো। হাজার চেষ্টা করেও ওর মুখ থেকে টুঁশব্দটি পর্যন্ত বের করতে পারি নি। দিশেহারা হয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়লাম। ও আমাকে ধরার জন্য এগিয়ে এলো। মোলায়েম কন্ঠে বললো,”এভাবে কান্নাকাটি করো না নিশাত। তোমার শরীর খারাপ হবে!” তীব্র অভিমানে,ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম,”ধরবে না তুমি আমাকে!”

ধ্রুবর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শান্ত শীতল কন্ঠে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,”কেন বুঝতে পারছো না নিশাত! এইমুহূর্তে…”

আমি সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বললাম,”আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। নতুন আর কিচ্ছু বোঝার দরকার নেই! বেবিকে আমি অ্যাবোরশন করাবো না! ব্যস!”

ধ্রুব পুনরায় কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই আন্টি এসে ভেতরে ঢুকলেন। আমাকে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলেন। ধ্রুবও ম্লান মুখে চেয়ে রইলো। এর মানে,”আমি পারছি না। তুমি বোঝাও!” ওর চোখে অনুনয়!
আন্টি আমার মাথায় হাত রেখে ছলছল চোখে বললেন,”ধ্রুবর কথা শোন মা, ও তোর ভালো চাইছে।”

আমি একটা কথাও বললাম না। কারণ আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিয়েছি। যে যাই বলুক না কেন, আমার সন্তান পৃথিবীতে আসবেই। আমার অস্তিত্ব থেকে ধ্রুবর ভালবাসার চিহ্ন মুছে দেওয়ার অধিকার কারো নেই। কারণ আমি জানি ধ্রুবর বলা কথাটা মন থেকে বলে নি ও! নিরুপায় হয়ে বলেছে !

ধ্রুব চোখভর্তি টলমল করতে থাকা পানি নিয়ে বললো,”মরার আগে তোমার কাছে শান্তি চাইছি নিশাত। সবাই যা বলছে শোনো! এতে তোমার ভালো হবে। আমিও শান্তিতে থাকতে পারবো।”

আমিও অভিমানী কন্ঠে বললাম,”আমি মরে তারপর তোমাকে শান্তি দিয়ে যাবো।”

ধ্রুব বিস্ফোরিত নয়নে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আন্টিও ঘাবড়ে গেলেন। চোখে দেখেই বোঝা গেলো আমার দৃঢ়তা তাঁকে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছে। ধ্রুবকে ধমক দিয়ে বললেন,”বাচ্চা তোর একার নয় যে তুই একা সিদ্ধান্ত নিবি। মা হিসেবে বাচ্চার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ওরও আছে। ও যা করছে ওকে করতে দে!” ধ্রুব করুণ মুখে আন্টির দিয়ে চেয়ে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো। আমি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে আন্টির দিকে চাইলাম। আন্টি চোখ মুছে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”তোর কষ্ট আমি বুঝি মা। কিন্তু তোর বাবা মায়ের কথা একবার ভাব। তারাও তো তোকে নিয়ে চিন্তায় আছেন।”

আমি পূর্বের ন্যায় দৃঢ় কন্ঠে বললাম,”আমার কথা ভাবার কোন দরকার নেই তাদের। আমার ভালোমন্দ আমি বুঝি। আমার বেবির ব্যাপারেও ডিসিশন নেওয়ার কোন অধিকার নেই তাদের! আমার বেবির ব্যাপারে সম্পূর্ণ ডিসিশন আমার!”

আমি কথা শেষ করতে না করতেই মা এসে ভেতরে ঢুকলো। নরম গলায় বললো,”তোর বাবা তোকে রেডি হতে বলেছো। হস্পিটালে যাবো।”

হস্পিটালে যাওয়ার উদ্দেশ্য আমি এবং আন্টি দুজনেই বুঝতে পারলাম। মেডিকেল সাইন্স অনুযায়ী প্রেগন্যান্সির বারো সপ্তাহের মধ্যে অ্যাবোরশন করানোটা নিরাপদ। তাই বাবা মা জলদি কাজ সেরে ফেলতে চাইছেন।

আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করলো। পা টলছিলো! মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। সহযোগিতার আশায় আন্টির মুখের দিকে চাইলাম। তিনি নিরবে চোখের পানি মুছে বললেন,”যা মা, রেডি হয়ে আয়!” তারপর বেরিয়ে গেলেন।

আমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো! টলছিলাম! সবকিছু বাদ দিয়ে ধ্রুবর বাসায় ফেরার দিনটার কথাই বারবার করে মনে পড়লো। আমার প্রেগন্যান্সি নিয়ে কত উচ্ছ্বাস, আনন্দ, হৈচৈ ছিলো ওর আর আন্টির মাঝে। আজ তার ছিঁটেফোটাও নেই! তীব্র হাহাকারে চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো।বিরতিহীনভাবে ঝরতে থাকা চোখের পানি নিঃশব্দেই গড়িয়ে পড়লো। আমার টলমল অবস্থা দেখে মা ভীত কন্ঠে বললেন,”আমার ওপর রাগ করিস না মা! তোর বাবা মনস্থির করে ফেলেছেন। তুই না গেলে ধ্রুবর ওপর খেপে যাবে। তুই তো তোর বাবাকে চিনিস। রেগে গেলে তাঁর হুঁশ থাকে না। ধ্রুবর কথা ভেবে অন্তত চল মা!”

আমি বুঝতে পারলাম এখন আর আমার জেদের সময় নয়। বাবাকে আমি চিনি। তিনি বরাবরই আমাকে নিয়ে পজেসিভ! কাজ হাসিল করার জন্য ধ্রুবকেও ছাড়বেন না। আর এসব কথা শুনলে ধ্রুব মরে যাবে! কালক্ষেপণ না করে তড়িৎগতিতে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললাম ,”এত কঠোর হয়ো না মা। তুমি মা হয়ে আমার দুঃখ না বুঝলে কে বুঝবে? তোমরা ছাড়া আর কে আছে আমার। এই দুঃসময়ে তোমরা পাশে না থাকলে কি করে আমি ভরসা পাবো! বাবাকে বোঝাও মা, আমার বাচ্চাটার কিছু হলে ধ্রুব মরে যাবে! দয়া করো মা! বেঁচে থাকতে তোমরা ওকে মেরে ফেলো না! ওর কিছু হলে আমি মরে যাবো!”

মায়ের মন সন্তানের আকুতিতে গলে গেলো! পা ছাড়িয়ে আমাকে টেনে তুললো। চোখের পানি মুছে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুঁকরে কেঁদে উঠে বললো,”আল্লাহ তোর কপালে কেন এত অশান্তি দিলো মা! তোর বাবাকে আমি কি বলে বোঝাবো?”
আমার কান্নার বেগ ক্রমশ বেড়ে গেলো।
আমার সুখের দিনের এভাবে অবসান হবে আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। কান্না যেন আমার নিত্যকার সঙ্গি হয়ে দাঁড়ালো! এবার মা-ও আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁদছে। কান্নারত কন্ঠেই বললো,”আল্লাহ তোর চোখের পানি স্বার্থক করুক মা! তোর প্রতি সদয় হোক! ধ্রুবকে তিনি আরো হাজারবছর বাঁচিয়ে রাখুক!”

মা বাইরে গিয়ে বাবাকে ডেকে আনলেন। কিন্তু বাবা কিছুতেই মানতে রাজি হলো না। ঘোরতর আপত্তি করলো। আমি অসহায় ভাবে মায়ের দিকে চাইলাম। লাভ হলো না। বাবা তার সিদ্ধান্তে অবিচল!
আমি মনে মনে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেও মুখে কোনরূপ রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ করলাম না। বাবার পায়ের কাছে বসে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বললাম,”একবার শুধু ধ্রুবর কথাটা ভাবো বাবা। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখো কতটা অসহায় বানিয়ে দিয়েছো তোমরা ওকে! একটা মানুষ কতটা নিরুপায় নিঃসহায় হলে তাঁর নিজের সন্তানের ওপর অধিকারটকু পর্যন্ত ছেড়ে দেয়! এতটা নিষ্ঠুর কেন হচ্ছো বাবা? আমার কপালে যদি দুঃখ লেখা থাকে হাজার চেষ্টা করেও তুমি তাকে ফেরাতে পারবে না! তাহলে বিনাদোষে কেন শুধু শুধু ওকে এত কষ্ট দিচ্ছো? ও কি দোষ করেছে?”
বলতে বলতেই কেঁদে ফেললাম। অনেক্ষন যাবত আটকে রাখা কান্নার বেগ বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এলো। কাঁদতে কাঁদতেই সৃষ্টিকর্তা কাছে মন প্রাণে প্রার্থনা করছিলাম বাবা যেন নিজের ভুল বুঝতে পারে!

আমার ডাক সফল হলো! বাবা হার মানলো!
অশ্রুসিক্ত নয়নে আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললো,”অনেক বছর বেঁচে থাকো মা! বাবা হিসেবে তোমার মত মেয়েকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি! আল্লাহ তোমার সহায় হোক। তোমার সব দুঃখ, কষ্ট তিনি দূর করে দিক। তোমার সকল মনোবাসনা পূর্ণ হোক!”

আমি আনন্দে খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফের কাঁদতে শুরু করলাম। বাবা আমার মাথায় চুমু খেয়ে বললো,”ধ্রুবর খেয়াল রেখো, আল্লাহ ভরসা!” তারপর বেরিয়ে গেলো।

যাওয়ার সময় ধ্রুবর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখো বাবা। ধৈর্য রাখো, তিনি অবশ্যই মহান। তিনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন। নিশাতের জন্য চিন্তা করো না। যতদিন নিশাতের বাবা বেঁচে আছে ততদিন নিশাত এবং তোমার সন্তানের মাথার ওপর ছায়া নিয়ে তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই! তুমি মনোবল রাখো! ইনশাআল্লাহ তোমার কিচ্ছু হবে না ” ধ্রুব নতমুখে বসে ছিলো। বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। বাবার হঠাৎ পরিবর্তন বিশ্বাস করতে পারছিলো না বোধহয়! মুহূর্তেই মলিন মুখটায় খুশির ঝলক দেখা দিলো! আমি হাসলাম। বাবা নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন করে বেরিয়ে গেলেন!

রাতে বাবা মা চলে যাওয়ার পর সব গোছগাছ শেষে রুমে ঢুকে দেখলাম ধ্রুব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিছানা ঝেড়ে শোওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, ধ্রুব বারান্দা থেকে রুমে ঢুকে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
জিজ্ঞেস করলাম,”কিছু বলবে?”
ও অনুতপ্ত কন্ঠে বললো,”খুব কষ্ট হয়েছে তোমার তাই না?”
আমি না-সূচক মাথা নেড়ে বললাম,”একদম না।” ধ্রুব আশ্বস্ত হলো না। অপরাধীর মত মুখ করে বললো,”বিশ্বাস করো নিশাত, তুমি যদি অ্যাবোরশন করাতে রাজি হয়ে যেতে তাহলে আমি মরে যেতাম। একদম মরে যেতাম!”

ওর চোখে পানি টলমল করছে। আমি ওর কাছে সরে গেলাম। ওর গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে মিষ্টি হেসে বললাম,”আমি জানি। তোমার ব্যাখ্যা করার কোন প্রয়োজন নেই।”
মুখে যতই নির্বিকার নির্লিপ্ত থাকুক না কেন বাবা মা যতবার অ্যাবোরশনের কথা বলেছে ততবার ধ্রুবর চোখে আমি ভয় দেখেছি। ওর ভয়ার্ত চোখজোড়া বারবার আমাকে মিনতি করে বলছিলো,”আমার সন্তানের জীবন তোমার হাতে নিশাত, তুমি তাকে বাঁচাও! ও তোমার আর আমার ভালোবাসা অংশ!” সুতরাং মুখে বলার কোন প্রয়োজন হলো না। ওর অসহায়, বিধ্বস্ত, নিরুপায় মুখটা একমুহূর্তেই আমার করনীয় সম্পর্কে আমাকে নিঃসংশয় করে দিলো।

চোখে বন্ধ করে ধ্রুব বুকে মাথা রেখে ক্লান্ত নিশ্বাস ফেললাম। সেরাতে প্রাণভরে কান্নাকাটি হলো, নিবিড়ভাবে ভালোবাসাবাসি হলো দুজনার। ভালোবেসে ধ্রুবর দুঃখগুলো সব ভুলিয়ে দিতে চাইলাম! সেই সাথে একটুকরো আশার আলো নিয়ে নতুন ভোরের প্রতিক্ষায় রইলাম দুজনে।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here