#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_১২
#লেখায়_জারিন
৫৫.
‘নাফিজকে বিয়ে করে আমি যখন এ বাড়িতে আসি তখন ওর মা ভীষণ অসুস্থ ছিল। একটা কিডনী ড্যামেজ হওয়ার কারণে অপরেশন করে সেটা বাদ দেওয়া হয়। আরেকটাও কিছুটা ড্যামেজ ছিল। যেটা রেগুলার ট্রিটমেন্ট আর মেডিসিন কন্টিনিউ করে মাকে বাঁচিয়ে রাখার সম্ভব ছিল। মা এটার সুযোগ নিলেন।নাফিজকে আবারও বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। কিন্তু নাফিজ বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না।
রেণু আপার সাথে তখন তার বিয়ের ৩ বছর পেরিয়েছে। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার কারণে নাফিজ চেয়েছিল আপা পড়াশোনা চালিয়ে যাক। আপার বয়সও তখন কম ছিল। এ বাড়িতেও তাকে মেনে নেওয়া হয়নি। এটা প্রথম জানাজানি হওয়ার পর রেণু আপার বাবাও মেয়েকে আর নিজ বাড়িতে জায়গা দেননি।
‘কেন?’
‘একজন স্বল্প পরিচিত ছেলেকে ভরসা করে তার পরিবারের অজান্তেই মেয়ে বিয়ে দিয়ে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মেয়েও স্বামী নামক ছেলেটির সাথে কিছুদিন একসাথে ছিল একটা বাড়িতে। অথচ তাকে শশুড়বাড়িতে জায়গা দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় মেয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে তাদের সম্মানহানির ব্যাপার ছিল।গ্রামের মানুষের ধ্যান ধারণা বুঝোই তো। মেয়ে মরলে মরে যাক, তবুও সে স্বামীর ঘরেই থাক।উপরন্ত রেণু আপার মা ছিল না। বিয়ের পর ফিরে গেলে মেয়ের শিক্ষা চরিত্র নিয়েও কথা উঠতে পারে। এমন টাইপের ধারণার ফলে রেণু আপার বাবাও মেয়েকে ফিরিয়ে নেওয়ার সাহস করেননি। তাই নাফিজের হাতেই মেয়ের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়েছিলেন তিনি।
‘তারপর?’
‘মা মেডিসিন খাওয়া ছেড়ে দিলেন। নিজের জেদ বজায় রাখার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিলেন। এটা নাফিজ মানতে পারলো না। মায়ের জেদের কাছে হার মানলো। কিন্তু, রেণু আপাকে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলার সাহস ওর হয়নি।
‘আর বিয়ের আগে আপনাকেও বলা হয়নি, তাই না?’ বুদ্ধিদীপ্ত স্বরে বললো ইরিন।
‘হ্যাঁ, বলা হয়নি। ইনফ্যাক্ট বিয়ের দীর্ঘদিন পরেও আমি ঘুবাক্ষরেও ব্যাপারটা টেরই পাইনি। আসলে, আমার বাপের বাড়ি চাঁদপুর এলাকায়। ঘটক লাগিয়ে এতদূরেই ছেলের বিয়ে ঠিক করলেন মা। নাফিজের বিয়ের ব্যাপারে ওর আত্মীয়স্বজন ছাড়া তেমন কেউ জানতো না। তাই ছেলে সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার সময় আমার আব্বাও বিয়ের ব্যাপারটা জানতে পারেননি। বাকি সব দিক থেকেই নাফিজের জন্য দ্বিমত পোষণ করার কিছু ছিল না। হয়ে গেল আমাদের বিয়েটাও। ‘ – এটুকু বলে হাঁপিয়ে উঠার মত বড় একটা শ্বাস ফেললেন শায়লা। নিজের অতীত বলতে গিয়ে এতকালের চাপা কষ্টটা নতুন করে উথলে উঠে চেপে ধরছে তাকে আবারও।
‘তাহলে আপনি কখন জেনেছিলেন সত্যিটা?’
‘আয়শার জন্মের প্রায় ৩ বছর পরে, যখন নক্ষত্রের জন্ম হয়। ‘
‘বাবা বলেছিলেন?’
‘হ্যাঁ,অনেকটা সেরকমই। ‘
‘মানে?’
৫৬.
‘আমাদের বিয়ের ১ বছর পরেই আয়শার জন্ম হয়। কারণটা আমার শাশুড়ি মা-ই ছিলেন। বিয়ের পর থেকেই তিনি আমাকে আর নাফিজকে মেন্টালি প্রেশারাইজ করে গেছেন একটা বাচ্চার জন্য। তিনি অসুস্থ, কখন কি হয়ে যায় এই বাহানায়। নাতির মুখ দেখে, বংশের একটা গতি করে রেখে তবেই তিনি পরপারে যেতে চান। এসব কথা বলতেন প্রায়ই। তাই আমিও শাশুড়ির মন রাখতে নাফিজকে জোরাজুরি করতাম। বাধ্য হয়েই বোধয়, নাফিজ আমার জোরাজুরিতে হার মানে। আয়শার জন্ম হয়।
আমি বেশ সুখেই ছিলাম নাফিজের সাথে। শাশুড়ি মা নিজে পছন্দ করে বাড়ির একমাত্র ছেলের বউ করে এনেছিলেন বিধায় আমাকে আদর যত্নে মাথায় করে রাখতেন। আবার ভুল হলে শাসনও করতেন একটু আধটু। আমি নিজের মায়ের মতই সম্মান করে তার আদর শাসন দুটোই সাদরে গ্রহন করে নিতাম। কিন্তু, আয়শার জন্মের পর থেকেই তিনি আমার প্রতি কিছুটা নারাজ হন। তার দরকার ছিল বংশধর হিসেবে একটা ছেলের। আমাকে বুঝালেন যাতে পরের বার আমি ছেলে সন্তানের জন্ম দেই। কিন্তু তিনি এটা জানতেন না , ছেলে বা মেয়ে সন্তান হওয়ার ওপর আমার কোন হাত নেই। তবুও চুপচাপ মেনে নিলাম তার কথা। নতুন করে চেষ্টা শুরু করলাম নাফিজের কাছাকাছি যাওয়ার। কারণ, আয়শার জন্মের পর থেকেই নাফিজ আমায় খুব একটা সময় দিতো না। ঘর সংসার ও বাচ্চা সামলে আমিও খুব একটা সময় করে উঠতে পারতাম না। তাই এটাকে তেমন গুরুত্ব দেইনি।
কিন্তু, যখন নতুন করে নাফিজের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলাম, লম্বা একটা সময়ের পরে ঝিমিয়ে পড়া সম্পর্কটাকে নতুন করে ঝালাই দিতে গেলাম, আমি বুঝলাম ততোদিনে অনেক কিছুই বদলে গেছে। আমার একটু একটু করে মনে হতে লাগলো যেন নাফিজ আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বা গেছে অনেক আগেই। যদিও নাফিজ আমার সাথে খুব একটা কথা বলতো না, কিন্তু স্বামীর সকল দায়িত্ব কর্তব্য এমনভাবে পালন করতো যে ওকে সন্দেহ করার কোন সুযোগ কখনো হয়নি আমার। তবুও, মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একটি বেশিই তেজি। আমিও বুঝলাম নাফিজ কিছু একটা নিয়ে সমস্যায় আছে।
‘ খুব একটা কথা তো আপনার ছেলেও বলেন না। কিন্তু, দায় দায়িত্ব তো সবই ঠিকঠাক পালন করে। হুহ, বাপকে পাত্তা দেয় না আবার হয়েছে একদম বাপের মতই! এক্কেরে বাপ কা বেটা যাকে বলে। এই বলে মনে মনে নক্ষত্রকে ভেংচি কাটলো ইরিন। অতঃপর, নিজের কাজ এবং ভাবনার প্রতি নিজেই অবাক হলো। অপ্রস্তুত হয়ে গেল ভেতর ভেতর। ক্ষণিকের মাঝেই আবার সামলে নিল নিজেকে। শায়লার কথায় সঙ্গ দিতেই জিজ্ঞেস করলো, ‘ তারপর?’
আয়শার ১ বছর বয়স হওয়ার পরেই আমি শাশুড়ি মায়ের মন বাসনা পূরণ করার চেষ্টায় লেগে গেলাম। কিন্তু, কাজ হচ্ছিল না। সব ঠিক থাকলেও এ ব্যাপারে নাফিজ আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। আমার এমন লাগাতার প্রচেষ্টায় একদিন রাগ করেই নাফিজ জানতে চাইলো, সমস্যা কি?!
স্ত্রী হলেও প্রথমত আমি একজন নারী। তখনও যৌবনের ছিটে ফোঁটাও কাটেনি। লাজ লজ্জা একটু বেশিই ছিল তখনো। আমি মুখ ফুঁটে বলতে পারলাম না আমার আরেকটা বাচ্চা চাই। শুধু মায়ের মনের চাওয়া তাকে জানালাম। সে রাগারাগি করলো। ১ বছর যেতে না যেতেই আরেক সন্তান চাইছি বলে। এত ধকল আমি সামলাতে পারবো না। লাগবে না আর কোন বাচ্চা। এসব বলে রাগ দেখালো। আমি তার রাগকে পাত্তা দিলাম না। ভাবলাম আমার কষ্টের কথা ভেবেই চিন্তা হচ্ছে তার। সেটাই রাগ হিসেবে প্রকাশ করছে। কিন্তু, আমার তখনো জানা ছিল না আমার এই চাওয়া অন্য কারো কোল আলো করবে।
‘ঠিক বুঝলাম না! ‘
‘মা, বংশের জন্য ছেলে সন্তান চান..এ কথাটা নাফিজের মাথায় ক্লিক করে গেল। রেণু আপাকে এ বাড়িতে প্রাপ্য স্থান পাইয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে তার কোল জুড়ে এ বাড়ির বংশধর আনার চেষ্টা করতে লাগলো। এবং তা সফলও হলো। রেণু আপা নক্ষত্রের জন্ম দিলেন।
নাফিজ একটা বারও ভাবেনি কতবড় ভুল অংক কষে নিয়েছিল সে জীবনের। আপা গর্ভবতী এ খবর সম্ভবত আগেই জানানো হয়েছিল মাকে। কিন্তু মা আপাকে মানেন বলে আপার গর্ভের সন্তানকেও অস্বীকার করেন। তাই তখনো আপা এ বাড়িতে আসার সুযোগ পায়নি।
৫৭.
‘নক্ষত্রের জন্মের পর একদিন দুপুরবেলা সে রেণু আপাকে এ বাড়িতে নিয়ে এলো। নক্ষত্রের তখন ৩ দিন বয়স মাত্র। বংশের প্রদীপ বাড়ির চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে শুনে মা একপ্রকার বাধ্য হয়েই নাতির মুখ দেখতে এলেন। কিন্তু, এবারেও তিনি তাকে অস্বীকার করলেন। কারণ, নাতি তার মায়ের রূপ রঙ নিয়ে জন্মেছে। যে আশংকা করে মা আপাকে বাড়ির বউ বলে স্বীকৃতি দেননি, তার সেই আশংকা সত্যি করে সৃষ্টিকর্তা নক্ষত্রকেও একই রূপে গড়ে দেন।
আর এখন তাকে স্বীকার করলে এ বংশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও এই কালোর ছাপ পড়বে বলে তিনি নক্ষত্রকে গ্রহণ করলেন না। ভাবতে পারো ইরিন? শুধুমাত্র বংশে যাতে কেউ রূপ রঙে অসুন্দর না হয় সেই ভেবে একটা নবজাতকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার বাড়ির চৌকাঠ থেকে। কি পরিমাণ নিম্নমানের ধ্যান ধারণা পুষলে পরে মানুষ এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে? ‘
‘আপনি তখন কোথায় ছিলেন? ‘
‘বাড়িতেই ছিলাম। সব দেখেছি…শুনেছি। কিন্তু প্রতিবাদ করিনি কোন।
‘কেন?’ কপাল কুচকে প্রশ্ন করলো ইরিন।
‘কিসের প্রতিবাদ করতাম বলো তো? আমার স্বামীর প্রথম থেকেই একজন স্ত্রী ছিল,যেটা আমাকে জানানো হয়নি। সেটার প্রতিবাদ? নাকি আমার স্বামী আমাকে কখনো মন থেকে নিজের স্ত্রী বলে গ্রহণ করেনি…ভালোবাসেনি অথচ আমি তখন তার এক সন্তানের মা, এই নিয়ে? নাকি আমার স্বামী তার প্রথম স্ত্রীকে এতটাই ভালোবেসেছে যে তাকে বাড়িতে জায়গা দেওয়ার জন্য তার কোল জুড়ে বংশধর এনে দিয়েছে? যদিও এটা আল্লাহর রহমত ছাড়া সম্ভব ছিল না,কিন্তু ওই যে নিয়তের উপর ফল নির্ভরশীল! তাই যেটা আমি চেয়েছিলাম সেটা সে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য বরাদ্দ রাখলো। এটার প্রতিবাদ করতাম? ‘
‘একটা নবজাতক ও তার মাকে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছিল, এটার প্রতিবাদ করতে পারতেন!’
ইরিনের এই কথা শুনে হেসে উঠলেন শায়লা। ইরিন চমকালো তার এই হাসি দেখে। মনে মনে আউড়ালো, ভুল কিছু কি বলে ফেলেছে সে? মন জানান দিল, হ্যাঁ…তার কথাটা ভুল। শায়লাও একই উত্তর দিলেন।
‘যেখানে আমি এমন একটা প্রতারণার শিকার, আমার সতীন তার ছেলেসহ বাড়িতে জায়গা নিতে এসেছে, আমার এতকালের যত্নে গড়া সংসার, ভালোবাসার স্বামীতে ভাগ বসাতে এসেছে তাকে আমি সাপোর্ট করবো? সত্যি ইরিন! এতটা মহানুভব কোন স্ত্রীর পক্ষে হওয়া সম্ভব? তুমি হলেও করতে না এমন। একেবারেই অসম্ভব সেটা। অন্তত সেই মূহুর্তে তো নয়-ই। ‘
‘স্যরি…মা। আমি আসলে এত ভেবে বলিনি। ‘ অপরাধী গলায় বললো ইরিন।
‘ব্যাপার না। ‘ আলতো হেসে ব্যাপারটা কাটিয়ে দেওয়ার জন্য বললেন শায়লা। নিরবে আলতো হাসলো ইরিনও। অস্বস্তিকর পরিস্থিতিটা কাটাতে বললো,
‘আচ্ছা, তারপর কি হলো?’
‘নাফিজ তাদের রেখে বাড়ি আসার পর আমার মুখোমুখি হওয়ার সাহস ওর হচ্ছিল না। আসলে, ওর ধারণা ছিল মা একবার আপাকে মেনে নিলেই আমাকে আর কোন কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন ওর হবে না। কিন্তু, ওর হিসাব ভুল হলো।মা রেণু আপা বা নক্ষত্র কাউকেই মানলেন না। মাঝখান থেকে আমি সবটা জেনে গেলাম। ‘
‘আচ্ছা, উনার মা জানতেন না আপনার ব্যাপারে? যখন বাড়ি এসেছিলেন উনাকে নিয়ে আপনাকে দেখেননি তিনি?’
‘কাকতালীয় হলেও সত্যি, প্রতারণার স্বীকার সেও ছিল। নাফিজ ভেবেছিল আপাকে ওর মা একবার স্বীকার করে নিলেই আর কারও কিছু বলার থাকবে না। রেণু আপাকে সে ভালোবাসতো,রেণু আপাও তাই। উপরন্ত তাদের সম্পর্ককে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে নক্ষত্র তখন এই পৃথিবীতে এসে গিয়েছে। এসব ছেড়ে আপা কখনোই যাবেন না কোথাও। তাকে নাফিজের সাথেই থাকতে হবে। সতীনের সাথে ঘর করে হলেও থাকতে হবে।
জানো তো, আমি সেদিন কি পরিমাণ অবাক হয়েছিলাম নাফিজের এই পরিকল্পনা আর হিসেবের কথা শুনে বলে বোঝানোর মত না। প্রায় চার বছর একসাথে সংসার করার পরে নিজের স্বামীর এমন একটা রূপ দেখতে পাওয়া সত্যিই অভাবনীয় ছিল আমার জন্য।
বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি মানুষ কি সত্যিই এত নিখুঁতভাবে মিথ্যা সংসার সাজিয়ে তার সাথে জুড়ে থাকতে পারে দিনের পর দিন? কোন খাদ নেই, কোন সন্দেহের চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না, এতটাই নিখুঁত অভিনয় ছিল নাফিজ আর আমার শাশুড়ি মায়ের। -শায়লার কন্ঠে স্পষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ পেল। কিন্তু ইরিনের প্রশ্ন অন্য জায়গায়। যেটা সে মুখ ফুঁটে জিজ্ঞেসও করলো শায়লাকে।
‘তারপর? উনার মা বা আপনি…মেনে নিয়েছিলেন সবটা?’
‘নাহ। আমি কিংবা রেনু আপা কেউই নাফিজের এই প্রতারণা মানতে পারিনি। রেণু আপা মেধাবী ছাত্রী ছিল। এইচ. এস. সি পাশ করার পরে ঢাকা ইউনিভারসিটিতে চান্স পেয়ে যায় সে। ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা ছিল তার। কিন্তু, নক্ষত্রের জন্মকে কেন্দ্র করে নাফিজের চাপে পড়ে তাকে পড়াশোনা ছাড়তে হয়। গ্রেজুয়েশনটাও আর কামপ্লিট করা হয়নি তার। কিন্তু, তিনি গ্রামের মেয়ের হলেও শিক্ষিত ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ছিল খুব। নাফিজের সাথে তার দীর্ঘ ৭ বছরের সংসার ছিল। ভালোবেসে বিয়ে করা এই মানুষটার থেকে পাওয়া এই প্রতারণা তিনি মানলেন না। নাফিজের সাথে সংসার করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিল।
নাফিজ সেটা মানতে পারলো না। নাফিজ যাই করুক না কেন আপাকে সে সত্যিকার অর্থেই খুব ভালোবাসতো। এখনো বাসে ইনফ্যাক্ট। তাই আপাকে ধরে রাখার কোন চেষ্টাই সে বাদ রাখলো না। আপাকে ও ডিভোর্স দিবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল নক্ষত্র এবং আপার দায়িত্ব তিনি নিবেন। প্রতিমাসে তাদের যাবতীয় খরচ সে দিবে। কিন্তু আপা নক্ষত্রকে নিয়ে তাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।
আপার আত্মসম্মানবোধ ছিল খুব প্রখর। নক্ষত্রও হয়েছে একদম মায়েরই মত। ফলে, আপা সাফ জানিয়ে দিলেন এত বড় প্রতারণার পর নক্ষত্রের বাবার সাথে আর কোন সম্পর্কই যখন সে রাখবে না তখন তার থেকে কানা কড়িও সে নেবে না। আর যদি সংসার করতেই হয় তাহলে যে কোন একজনকে নিয়েই করতে হবে। কিন্তু, নাফিজের সেই উপায় ছিল না। আপাকে সে ভালোবাসতো আর আমার প্রতি ছিল তার দায়বদ্ধতা। উপরন্ত যোগ হয়েছিল আমার প্রতি করা অন্যায়ের অপরাধবোধ। তাছাড়াও, আমি ছিলাম তার প্রথম সন্তানের মা। যে সন্তানকে সে খুব ভালোবাসে। ফলে এতসব কিছুর আগে পরে সে কাউকেই ছাড়তে পারলো না। এই নিয়ে নাফিজের সাথে খুব ঝামেলা হলো আপার।
‘আর আপনি? আপনি কি করেছিলেন তখন?’
‘আমার আর কি! চারবছর একটা মানুষের সাথে সংসার করার পর, এক কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে, একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এই সংসারেই পড়ে রইলাম বাস্তুহারার মতো।
৫৮.
‘আমি রয়ে গেলেও রেণু আপাকে বাঁধতে পারলো না নাফিজ। আপা একদিন নক্ষত্রকে নিয়ে বনানীর ফ্ল্যাটটা ছেড়ে কোথাও একটা চলে গেলো। একটা চিঠি রেখে গেছিল অবশ্য। যেখানে লিখেছি যে, একজন প্রতারক স্বামী এবং একজন অপরাগ বাবা যে কিনা নিজের সন্তানকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে পারে না, তাকে তাদের দুজনের কারওই প্রয়োজন নেই। নাফিজকে এইসব টানাপোড়ন থেকে মুক্তি দিয়ে চলে যাচ্ছে সে।
চিঠি পেয়ে নাফিজ আপার বাপের বাড়ি খোঁজ করে এবং সেখানেই আপাকে পায়। ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও আপা নিজের শর্ত থেকে নড়লেন না। নাফিজ আমাকে আর ঠকাতে চায়নি বলে আপাকে রেখেই ফিরে আসে।
কয়েকমাস পর বাপের বাড়ি থেকেও আপার তল্পাতল্পি গুটিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। একা নক্ষত্রকে নিয়ে ফিরে আসে এই চেনা শহরেই। শহরে এসে একটা বস্তিতে থাকা শুরু করে। নক্ষত্রর তখন মাত্র ৯ মাস বয়স। এই ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়েই সে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে খেতো।
তারপর, একটা গার্মেন্টসে চাকরি পায় সেলাই কর্মী হিসেবে। তখন নক্ষত্রের বয়স বোধয় ৫/৬ বছর।
‘বাবার সাথে তখন উনার যোগাযোগ ছিল না আর?’
‘নাহ। আপা একরকম হারিয়েই যায় এই বিশাল শহরে। নাফিজও অভিমানে একসময় তার খোঁজ নেওয়া ছেড়ে দেয়। তাই বাপের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথাটা সে জানতো না।
কিন্তু নিয়তি বলেও একটা কথা থাকে। সময়ের সাথে বা এক সাথে থাকার ফলেই আমরা আবারও স্বামী স্ত্রীর মতই সংসার করতে থাকি। কিন্তু সেটা কেবলই দায় দায়িত্বের খাতিরে। ভালোবাসাটা নাফিজের তরফ থেকে তো ছিলই না আমার জন্য, তার জন্য যেটুকু ছিল আমার মনে সেটাও মরে গেছিল।কিন্তু, আমাদের সম্পর্কের গাঁট হয়ে আমাদের মাঝে ছিল আয়শা।
এরই মধ্যে দীর্ঘ সময় পর জন্ম হয় অদ্রিজার। শাশুড়ি আবারও আমার ওপর দায় চাপালেন। আমাকে একপ্রকার হুমকি দেওয়া হলো দ্রুত পুত্র সন্তানের মুখ না দেখালে আমাকে বাপের বাড়ি ফেরত পাঠাবেন।
আমি আবারও মরিয়া হয়ে উঠলাম বাচ্চা নেওয়ার জন্য। ফলাফল, দেড় বছরের মাথায় কনকের জন্ম হয়। সেই সাথে শেষ হয়ে যায় আমার সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা।
‘মানে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ইরিন।
‘কনকের জন্মের সময় আমার জরায়ুতে সমস্যা হয়। ফলে, কনকের জন্মের পর আমার জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়। আমি মা হওয়ার ক্ষমতা হারাই চিরতরে। এই কথা শাশুড়ি মা জানার পরে হাহাকার করে বাড়ি মাথায় তুললেন।
বংশধর তার চাই-ই চাই। তাই আবারও পুরোনো ট্রিক এপ্লাই করলেন। কিন্তু এবারে কাজ হলো না। নাফিজ বিয়ের জন্য রাজি হলো না কিছুতেই। তার একটাই কথা, যদি বংশধর একান্তই প্রয়োজন হয় তাহলে আপাকে সহ নক্ষত্রকে ফিরিয়ে আনুক। গ্রহণ করুক। তাদের প্রাপ্য অধিকার দিয়ে।
ছেলের জেদের কাছে এবার হার মানলেন মা নিজেই। নাফিজকে বলা হলো নক্ষত্রকে ফিরিয়ে আনতে। নাফিজ ছুটলো আপার বাপের বাড়ি। কিন্তু এত বছর যোগাযোগ না থাকায় সেখানকার কেউ তার খোঁজ দিতে পারলো না। কারণ আপা ওখান থেকেও না বলে চলে এসেছিল। অবশ্য আসতোই না বা কেন! অপমান তো আর কম সহ্য করতে হয়নি তাকে। যখন সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে তখন আপনও পর হতে পর হয়ে যায়।
‘আপনি এসব জানলেন কি করে?’
‘রেণু আপার থেকে। সেই বলেছিল। ‘
‘আপনি তাকে কোথায় পেয়েছিলেন? মানে উনাকে তো বললেন খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ ইরিনের কন্ঠে প্রচন্ড উত্তেজনা আর কৌতুহল।
‘একটু আগেই তো বললাম, চেষ্টা আর নিয়তের উপর অনেক কিছুই করা বা পাওয়া সম্ভব। নাফিজও পেয়েছিল। আপার একটা ছবি দিয়ে পত্রিকায় সন্ধানী বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ৫০ হাজার টাকা অফার করা হয় বিনিময়ে। এতেই কাজ হয়। আপা যে গার্মেন্টসে কাজ করতো সেখানকার সুপারভাইজারের চোখে পড়ে খবরটা। সেই খোঁজ দেয়। আপাকে খুঁজে পাওয়া যায়। আর তারপর…
‘তারপর?’ উত্তেজনার মাত্রা বেড়ে গেল ইরিনের কন্ঠে।
‘আপাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য আমাকে ধরা হয়। আমাকে বলা হয় যেন আমি অনুরোধ করে আপাকে যেভাবেই হোক বাড়ি নিয়ে আসি। শাশুড়ি মা হুকুম করলেও নাফিজ অনুরোধ করলো। আর নাফিজকে আমি ফিরাতে পারিনি। আপা যে বস্তিতে থাকতো সেখানে যাই আমি আর নাফিজ।
৫৯.
‘সেবারই প্রথম নক্ষত্র জানতে পারে তার বাবার কথা। ওর বয়স তখন ১০ বছর। ক্লাস ফোরে পড়ে। আপা অনেক কষ্টের মাঝেও নক্ষত্রকে নক্ষত্র করে তুলতে চেষ্টা করে গেছে।
সব না বুঝলেও খুব একটা অবুঝও সে ছিল না। আপা তাকে কি বলেছিল তার বাবা সম্পর্কে জানা নেই। কিন্তু, আপার সাথে সাথে সেও অসম্মত্তি জানায় বাড়ি ফিরে আসার জন্য। সে যাত্রায় আমাদের খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল। কিন্তু, নাফিজ বা আমি কেউই হাল ছাড়িনি। আমি প্রায়ই যেতাম রেণু আপার সাথে দেখা করতে। আমি আপাকে আমাদের দুজনের জীবনের একই পরিণতির কথা বলেছিলাম। দুজনেই প্রতারণার শিকার ছিলাম। তাই হয় আপার মন আমার প্রতি নরম ছিল। খারাপ ব্যবহার করেনি কখনো। কিন্তু,আমার অনুরোধ মেনে ফিরেও আসেনি।
চেয়েছিলাম ব্যাপারটা নিজেদের মাঝেই মিটে যাক। কিন্তু শাশুড়ি মায়ের কারণে নাফিজ তা কোর্ট পর্যন্ত টানতে বাধ্য হলো। লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হলো আপাকে, নক্ষত্রর কাস্টাডি চেয়ে। আপা কিছুতেই চায়নি নক্ষত্র নাফিজের ছত্রছায়ার বড় হোক। ওর মত প্রতারকের কাছে ছেলের দায়িত্ব দিতে নারাজ ছিল আপা। তাই, গার্মেন্টসের কাজ ছেড়ে নক্ষত্রকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেল আবারও।
আবারও বেঁচে নিল আগের কষ্টদায়ক জীবন। মানুষের বাসায় কাজ করে খেতো। আপাকে হন্যি হয়ে খুঁজলাম আমরা আবারও।
প্রায় বছর খানিক পড়ে খোঁজ মেলে আপার। পুলিশ জানায় আরও ১ বছর আগেই একটা বাসায় কাজ করার সময় গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে আগুন ধরে যায়। সেখানেই ওই পরিবারের দুজনসহ আপাও মারা যায়। আশপাশের কয়েক বাসায় কাজ করায় আপাকে চিহ্নিত করা হয়। বস্তিতে জানানোর পর নক্ষত্রকে পুলিশ স্টেশন নেওয়া হয় লাশ চিহ্নিত করার জন্য। বাজেভাবে পুড়ে যাওয়ায় মুখ বোঝা যায়নি। আপার হাতের চুড়িজোড়া, যেটা এখন তুমি পড়ো…ওগুলো দেখেই নক্ষত্র আপার লাশ চিহ্নিত করে। ‘-
এটুকু বলতেই ইরিন নিজের হাতের চুড়িজোড়ায় হাত বুলায় একবার। প্রথমবারের মত সামান্য একজোড়া সোনার চুড়ির চাইতে অনেক বেশি কিছুই মনে হয় তখন ওই চুড়ি দু’খানা। শায়লার কন্ঠ শুনে আবার মনোযোগ দেয় বাকি কথা শোনার জন্য।
৬০.
‘আত্মীয়স্বজন কেউ নেই বলায় বস্তির মানুষই লাশ দাফন করে। নক্ষত্রের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ না ছিল বলে পুলিশের তরফ থেকে ওকে একটা এতিমখানায় দেওয়া হয়। সেখানেই ১ বছর ছিল নক্ষত্র। মা হারানোর পর নক্ষত্রের অবস্থা ছিল পাগলপ্রায়। নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছিল একপ্রকার। আমরা যখন নক্ষত্রের কাছে যাই তখন ওকে দেখে চিনতে বেশ কষ্ট হয়েছিল আমার। কি ছেলের কি অবস্থা হয়েছিল, তা বলার মত না। ‘
‘আর তারপর আপনারা উনাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসেন?’
‘হ্যাঁ, তবে সেটাও খুব একটা সহজ ছিল না। নক্ষত্র আসতে চায়নি। এতিমখানার পরিচালককে টাকা দিয়ে ওর অমতে একপ্রকার জোর করেই নিয়ে আসা হয়েছিল নক্ষত্রকে। যেটা নক্ষত্রের কাছে ওকে কিনে আনার মত ছিল।’
‘আচ্ছা, উনি যে বললেন উনি এ বাড়ির কোন অর্থ সম্পদ নেননি কখনো, সেটার মানে কি? তাহলে আমাকে এত টাকা মোহরানা দিলো কিভাবে? কি কাজ করেন উনি এমন?’ জিজ্ঞাসু মনের কৌতুহল মিটাতে জিজ্ঞেস করলো ইরিন।
‘ঠিকই বলেছে ও। নক্ষত্র এ বাড়িতে আসার পর থাকতে চায়নি কিছুতেই। বেশ কয়েকবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করে। শেষ পর্যন্ত ওকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল অনেকগুলো দিন। নাফিজকে তো ও সহ্যই করতে পারতো না। আমার শাশুড়ি মা-কেও না। কারণ, রেণু আপা নক্ষত্রকে তাদের জীবনের সত্যিটা বেশ ভালো ভাবেই জানিয়ে গিয়েছিল। আপা চেয়েছিল যাতে নক্ষত্র নিজের জীবনের এই অন্ধকার অধ্যায়কে ছাপিয়ে নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলুক। নিজের লক্ষ্য বুঝুক। তা অর্জন করুক। ‘
‘এবং সেটা উনি করেওছেন। ‘মুচকি হেসে বললো ইরিন।
মৃদু হাসলেন শায়লাও। এটা তার জন্যও অনেক গর্বের। কারণ, এর দ্বারাই তিনি নিজেকে একটা সফল নারী চরিত্র হিসেবে অনুভব করেন। এমনকি একজন সফল নারী যোদ্ধাও। এসব ভাবতেই মুখের হাসিটুকু বিস্তৃত হলো তার।ইরিন মুগ্ধ হয়ে দেখলো সেই হাসিমুখের চমৎকার নারীটিকে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শায়লা বললেন,
‘জানো তো ইরিন, মা চরিত্রটা একটা নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় চরিত্র। এটা একনিষ্ঠভাবে তার সবচেয়ে শক্তিশালী স্বত্বা। এটা যতটা না মধুর, সুন্দর ঠিক তার চাইতেও বেশি কঠিন আর চ্যালেঞ্জিং একটা চরিত্র। সন্তান জন্মদানের চাইতে মা হয়ে ওঠা বেশি কষ্টের। আর এই কাজটাই আমাকে করতে হয়েছিল নক্ষত্রের জন্য। আমি ওকে জন্ম দেইনি ঠিকই, হতে পারে ও আমার সতীনের ছেলে, আমার সৎ ছেলে….কিন্তু আমি ওর আম্মু হয়ে উঠেছি। আর সত্যি বলতে আমার তিন মেয়ের মা হওয়ার চাইতে আমার নক্ষত্রের আম্মু হতে পারাটা আমার জন্য অনেক বেশি আনন্দের। সেই সাথে গর্বেরও।’
‘কেন?’
‘কারণ নক্ষত্র আমাকে সেই মা সত্ত্বার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যেটা শুধু সন্তান চিনে। সে সন্তান ছেলে না মেয়ে, নিজের নাকি অন্যের সেটা ভাবায় না। মা কেবলই মা হয়, ইরিন। যার ভেতরে পরম মমতায় লালিত হয় মাতৃত্ব নামক একটা অনুভূতির । সন্তান জন্ম দিয়ে যারা বলে মা হয়েছি, তারা আসলে বুঝেই না মাতৃত্বের স্বাদ এর থেকেও অনেক বেশি কিছু। এটা তুমি যখন মা হবে তুমিও বুঝবে! ‘ মিষ্টি হেসে বললেন শায়লায়। তার এ কথায় লাজে রাঙা হয়ে উঠলো ইরিনের চোখ মুখ। মা হওয়া বুঝি এতই সুখের…এতই আনন্দের?!
‘জানো নক্ষত্রকে এ বাড়িতে আনার পর প্রায় বছর খানিক সে ঘরবন্দি থাকে। আমি ছাড়া কাউকে ও ধারে কাছে ঘেঁষতে দিত না। আমাকে ও বহুবার দেখেছিল ওদের বাড়িতে যেতাম বলে। রেণু আপা এদিক থেকে আমার কাজটা অনেকখানি সহজ করে দিয়েছিল। আমাকে যোগ্য সম্মান দিতে শিখিয়ে গিয়েছিল সে নক্ষত্রকে।
আয়শা তখনও নক্ষত্রকে ভাই বলে মেনে নিতে পারেনি। অদ্রিজা আর কনক তখনো অবুঝ শিশু। নক্ষত্রকে স্বাভাবিক করার এই প্রচেষ্টায় ওরা হলো আমার ক্ষুদে সৈন্য। আমি নক্ষত্রকে বুঝাতাম নানাভাবে। কিন্তু, আপার মৃত্যু ও মেনে নিতে পারতো না তখনো। ওর মনে এই ধারণা জায়গা করে নিয়েছিল যে, রেণু আপা আর ওর এই জীবনের জন্য নাফিজ দায়ী।
অদ্রিজার বয়স তখন প্রায় ৩ বছরের কাছাকাছি। আর কনক সবে মাত্র হাটা শিখেছে।কথা শিখেছে এমন। ওরা নক্ষত্রকে নিজের ভাই বলেই ভালোবেসেছিল। সত্যি জেনেছে অনেক পরে। কিন্তু, এ সত্যিটা ওদের ভাই বোনের ভালোবাসা যেন বহুগুণ দৃঢ় করেছে। ‘
৬১.
আমার সাথে মাঝে মাঝে নক্ষত্রের ঘরে যেত ওরা। ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকতো। কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করতো। নক্ষত্র ওদের ফেরাইনি। প্রথম প্রথম দূরে দূরে থাকলেও পরে সত্যিকার অর্থেই ওদের প্রাণপ্রিয় ভাই হয়ে ওঠে। সেই থেকেই নক্ষত্রের ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে ওঠা। আমাকে প্রথমে আন্টি ডাকতো। তারপর, ওর ১৪ বছরের জন্মদিনে ওকে খুব করে বুঝাই। রেণু আপা কি চেয়েছিল সেটার দায় ওর কতখানি সেটা বুঝাই। ততোদিনে নক্ষত্র আমার সাথে বেশ সাবলিল হয়ে উঠেছিল। সেদিন আমার কোলে মাথা রেখে সারারাত কেঁদেছিল ছেলেটা। প্রথমবার আমাকে আম্মু বলে ডেকেছিল। আমাকে কথা দিয়েছিল রেণু আপার ইচ্ছা সে পূরণ করবে। নিজেকে এতটা যোগ্য করে গড়ে তুলবে যেন ওর কাছে শিক্ষা, জ্ঞান, অর্থের কমতি না থাকে।
সেই থেকেই ওর লড়াই শুরু। কিন্তু, তখনও ওর জেদ ও এই বাড়ির কিছুই নিবে না। থাকবে না এখানে। আমি অনেক বুঝিয়ে রাজি করেছিলাম এখানে থাকার জন্য। ছেলেটা আমার কথার মান রেখেছিল। কিন্তু, নিজের জন্য বেঁছে নিয়েছিল বাড়ির স্টোররুম। বাধ্য হয়ে ওটাকেই আমার সাফ সাফাই করে ওর থাকার উপযোগী করে দিতে হয়েছিল।
পড়াশোনায় ৩ বছরের গ্যাপ পড়ে যায়। আবার নতুন করে একটা স্কুলে ভর্তি করে দেই। টাকা পয়সা যা লেগেছিল সব আমিই দিয়েছিলাম আমার বাপের বাড়ি থেকে এনে। কিন্তু, এভাবে আর কতবার কি করবো। শেখ বাড়ির বউ বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করবে এটাও তো সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করলো নাফিজ। আমি হ্যান্ড পেইন্টের কাজ জানতাম। সে আমাকে বুদ্ধি দিল এটাকে নিয়ে কাজ করার। শাশুড়ির অজান্তেই আমি শাড়ি, চাদর, কামিজে হ্যান্ডপেন্টের কাজ করতে থাকি। নাফিজ নিজের কন্টাক্ট ইউজ করে সেগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করে। তবে এই নিয়ে খুব বেশিদিন কষ্ট করতে হয়নি আমাকে। ক্লাস এইটে নক্ষত্র স্কলারশিপ পায়। পুরো দেশে সেকেন্ড আর জেলায় ফার্স্ট হয়। এ কারণে, স্কুল থেকেও বেতন মাফ করা হয় দু বছরের। বাকি আমার কাজ আর ওর স্কলারশিপের টাকায় হয়ে যেত।
এরই মাঝে নক্ষত্রের দাদী মারা যান। যে নাতির জন্য এতসব শেষ সময়ে সেই নাতির থেকে দাদী হওয়ার সম্মানটুকুও সে নিয়ে যেতে পারেনি নক্ষত্রের থেকে। কিন্তু, নক্ষত্রকে দিয়ে যায় ওর প্রাপ্য অধিকার। আমার কাছে শেষ চাওয়া হিসেবে নক্ষত্র ও এ বংশের অগ্রগতির দায়িত্ব দিয়ে যায়। সেই কথা আমি আজও রাখার চেষ্টা করে চলেছি।
৬২.
মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকেও স্কলারশিপ পায়। ততোদিনে ও নিজে টিউশন করা শুরু করে। আমার বিজনেস ততোদিনে সফল হয়ে উঠে। প্রয়োজন ছেড়ে শখের বসেই চালিয়ে গেলাম কাজটা।
তারপর তো স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশেই পাড়ি জমায় আমার ছেলেটা। ওখানেই পার্টটাইম জব করে নিজের খরচ চালাতো ও। আমাকেও পাঠাতো কিছু কিছু।
রেণু আপার জন্য ও যা করতো আমার জন্যও ঠিক সেভাবেই সব করে। আয়শার সাথে ওর সম্পর্ক পুরো ফর্মাল। নক্ষত্র চাইলেও আয়শা ওকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। তাছাড়া বাকি দুই বোন ওর জান বলতে গেলে।’
‘হ্যাঁ, খুব ভালোবাসেন উনি নিজের বোনেদের।’
‘তুমি জানতে চাইলে না যে তোমায় এত টাকা দেনমোহর ও কিভাবে দিল? ওটাও ওর নিজের ইনকাম। বিদেশে থেকেছে অনেকগুলো বছর। চাকরিও করেছে ওখানে। পাশাপাশি শেয়ার মার্কেটেও ইনভেস্ট করতো নক্ষত্র। এই যে তোমার নামে যে জমি কিনেছে, বাড়ি করছে ওটাও ওর নিজের টাকায়। ইরিন, আমার ছেলেটা এতটাই যোগ্য যে ও চাইলে নিজের আলাদা সাম্রাজ্য করে নিতে পারে। কিন্তু, তবুও একমাত্র আমার কথায় ও এই বাড়িতে থাকছে, আমাদের বিজনেস সামলাচ্ছে। তবে একজন এমপ্লয়ি হয়ে। ‘
এটুকু বলে শায়লা ক্ষান্ত হলেন। ইরিন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। ওর কেবলই মনে হলো, শায়লা ভুল কিছু বলেননি। নক্ষত্র আসলেও নক্ষত্র। আর তার জন্য ইরিন! সে নিজে কি? কিছুই তো না। নক্ষত্রের অর্ধাঙ্গিনী হওয়া তো দূর তার ন্যূনতম একাংশ হওয়ারও যোগ্য নয় সে। একই সাথে ওর মনে হলো ওয়াসিফের ব্যাপারটা। মূহুর্তেই নিজের প্রতি ঘৃণায় মন বিষিয়ে এলো ওর নিজেরই। কিন্তু, এখন তো চাইলেও কিছুই করার নেই। সময় ঘনিয়ে এসেছে, বিদায় নেবার। একটা ভারী কষ্ট যেন পিষে ফেলছে ইরিনকে। দমবন্ধ লাগছে ওর ভীষণ।
ইরিনকে এভাবে বসে থাকতে দেখে শায়লা কি একটা ভেবে চট করে প্রশ্ন করলেন।
‘ইরিন, তুমি তো নক্ষত্রের স্ত্রী।তাহলে ওর ইনকাম সোর্স সম্পর্কে তুমি কেন জানতে না? জিজ্ঞেস করোনি কখনো?’
চলবে…