নক্ষত্র বন্দনা পর্ব ২৪

#নক্ষত্র_বন্দনা

#পর্ব_২৪

#লেখায়_জারিন

১৩৫.

ভোর ৪ টা। আর কিছুক্ষণ পরেই ফজরের আযান দিবে। নক্ষত্র ল্যাপটপ…ফাইলপত্র সব গুছিয়ে রাখলো। ফ্রেশ হয়ে মসজিদে যাবে সে। ফজরের নামাযটা ওখানেই পড়বে আজ। আড়মোড়া ভেঙে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।কফির মগ টা রান্নাঘরে রেখে পা বাড়ালো ইরিনের ঘরের দিকে।ওর ঘরের লাগোয়া ওয়াশরুমটাই নক্ষত্র ব্যবহার করে এ বাড়ি এলে।

ঘরে গিয়ে অবাক হলো নক্ষত্র। প্রায় অন্ধকার ঘরটায় পুতুল একা ঘুমিয়ে আছে। ইরিন নেই পাশে। এলোমেলো হয়ে পুরো বিছানাজুড়ে কেবল পুতুল শুয়েছে। নক্ষত্র ওয়াশরুমের দিকে তাকালো। আলো জ্বলছেনা ভেতরে। যার অর্থ ইরিন নেই ওখানে। ভ্রু কুচকে গেল নক্ষত্রের। কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে পা বাড়ালো ব্যালকনিতে। দরজার কাছে যেতেই খুঁজে পেল ইরিনকে। খোলা চুলে গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। শুকতারাটা এখনো মেলায়নি মেঘের আলোতে। ওটাই দেখছে বোধয় সে।

পুতুলকে একা রেখে এভাবে এ সময় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেও পছন্দ হলো না নক্ষত্রের। নারাজ গলায় ইরিনকে ডাকলো সে।

‘পুতুলের আম্মু?’

ইরিন কোন জবাব দিল না।আরও মেজাজ খারাপ হলো নক্ষত্রের। কঠোর গলায় বললো,

‘এই সময় এভাবে এখানে কি করছো তুমি? তাও পুতুলকে ঘরে একা রেখে?’

‘আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি ; যে নক্ষত্র – নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার বার দিয়ে গেছে বাঁধা
আমি তা ভুলিয়া গেছি ;
তবু এই ভালোবাসা – ধুলো আর কাদা।

_জীবনান্দ দাশ

ইরিনের মুখে কথাগুলো শুনে চমকালো নক্ষত্র। ইরিন কি কোন কারণে কষ্টে পেয়েছে নতুন করে? প্রশ্ন জাগে নক্ষত্রের মনে। নক্ষত্র উত্তর খুঁজে পায় না। ভাবনার চাকা মস্তিষ্ক ঘুরে সতর্ক করে, ইরিন কি তবে পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে করছে আবার? অতীতের সেই বিভৎস স্মৃতি, বেদনার দিনগুলি কি এখনো হুটহাট উৎপাত শুরু করে তার মন মস্তিষ্কের আঙিনায়? ভাবনাগুলো মাথায় আসতেই নক্ষত্র দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল ইরিনের কাছে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে ডাকলো, ‘পুতুলের আম্মু?’

ইরিন এবারেও জবাব দিল না। নক্ষত্র টের পেল ইরিনের শরীর মৃদুবেগে কাঁপছে। ঠিক যেমন ভেঙে চূড়ে কান্না পেলেও তা নিরবে গিলে নেওয়ার চেষ্টায় হয়। তবুও কান্না শব্দবিহীন উপচে পড়ে বাঁধভাঙা স্রোতের মতই।

নক্ষত্র এবারে দুহাতে ইরিনের বাহু চেপে ধরে একপ্রকার টেনেই নিজের দিকে ফিরালো। আজ জোছনা নেই। ভোরের আকাশ জেগে উঠতে শুরু করেছে সবেমাত্র। নিজের নৈসর্গিক রূপে ঘিরে ফেলেছে সমগ্র আকাশ। খুব স্পষ্ট না হলেও দেখতে পাওয়া যাবে এতটা আলোকিত হয়ে আছে চারপাশ। এই নৈসর্গিক মূহুর্তটায় এক অশ্রুমাখা বিদ্ধস্ত রমনীর মুখোমুখি হলো নক্ষত্র। ভেতরটায় বেশ ধারালো ভাবেই কিছু একটা খাঁমচে ধরলো তার।

ইরিনকে শেষ কাঁদতে দেখেছিল পুতুলের যেদিন জন্ম হলো সেদিন।ও.টির টেবিলে শুয়েই পিচ্চি শরীরটাকে বুকে নিয়ে খুব কেঁদেছিল সে। এরপর সামনাসামনি তাকে আর কখনো কাঁদতে দেখেনি নক্ষত্র। দূরত্ব এতটাই রেখেছিল যে দুঃখ, ব্যাথা নিয়ে মুখোমুখি হওয়া হয়নি আর কখনো তাদের। সবটাই ছিল দুজনের আঁড়ালে। কিন্তু এতকাল পরে ইরিনের এমন বিদ্ধস্ত সিক্ত চোখ মুখ দেখে পুরোনো অস্থিরতা আবার জেগে উঠলো নক্ষত্রের। ইরিনের কান্না যে কখনোই সহ্য করতে পারতো না সে।আর না আজও সে পারে!

ইরিন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদছে নিরবে। নক্ষত্র একহাত ইরিনের গালে রেখে মুখখানি তুলে ধরলো তার মুখোমুখি। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে…কাঁদছো কেন তুমি?’

ইরিন এবারেও কিছু বলে না। নক্ষত্রের বিচলিত অস্থির চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবে। নক্ষত্র উত্তরের অপেক্ষা করে। ইরিনের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মন পড়ার চেষ্টা করে।

কিন্তু, সেসবের কিছুই হলো না। ইরিন আচমকা নক্ষত্রের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সজোরে কেঁদে ফেলে। নক্ষত্র ঘাবড়ে যায় সহসা ইরিনের এমন আচরণে। পুতুলের এ পৃথিবীতে আসার খবর পাওয়ার পর থেকে এমনভাবে আর কখনো কাউকে স্পর্শ করা হয়নি তাদের।

নক্ষত্র নিজের সাথে হওয়া ছলনার অপরাধে স্ত্রীর মর্যাদা ও নিজের উপর ব্যক্তিগত সকল অধিকার থেকে ত্যাজ্য করেছে ইরিনকে। সেদিনের পর থেকে ইরিন কেবল দায়িত্বের খাতিরে স্বামী নামক মানুষটিকেই নিজের জন্য পেয়েছে। এমন স্পর্শ…ভালোবাসা..আদর থেকে তাকে দূরে করে দিয়েছিল নক্ষত্র। প্রবল অপরাধবোধ ইরিনকেও আর সাহস দেয়নি নক্ষত্রের সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা অবধি করতে।

একদিকে নক্ষত্রের কড়া নিষেধ অন্যদিকে ইরিনের নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। দূরত্ব বেড়েছে শরীরের, স্পর্শের,গভীর ভালোবাসার। তারা কেবল দায়িত্বের খাতিরে স্বামী স্ত্রী ও পুতুলের বাবা মা হয়েই কাটিয়েছে বিগত পাঁচটা বছর। তবে, মনের দূরত্ব কি আদৌ কখনো তৈরী অবধি হয়েছিল তাদের? নক্ষত্র প্রশ্নের জবাব খোঁজে না কখনো। অতীত আঁকড়ে ধরতে নেই ঠিক ; কিন্তু শিক্ষাটুকু আজীবনে স্মরণে রাখতে হয়। এই দূরত্ব ইরিনের শাস্তি ও শিক্ষা দুটোই নক্ষত্রের তরফ থেকে।

কিন্তু, এতকাল পরে এই অবেলায় ইরিনের এমন আচরণ আঁচড় কাটলো নক্ষত্রের হৃদপিঞ্জরের দরজায়। অনুভূতিরা সজাগ হয়ে ছটফট শুরু করলো। অস্থির গলায় নক্ষত্র প্রশ্ন করলো, ‘এই…পুতুলের আম্মু? সমস্যা কি? কাঁদছো কেন তুমি? না বললে বুঝবো কিভাবে কিছু আমি?? এইই..’

‘আপনি আমাকে এখনো মাফ করতে পারেননাই, তাই না পুতুলের বাবাই? ‘ কাঁদতে কাঁদতেই বললো ইরিন।

ইরিনের কথায় এবার চিন্তার ভাঁজ মিলিয়ে গেল নক্ষত্রের। একটু আগের নিজের অস্থিরতার প্রতি তাচ্ছিল্য করে কিঞ্চিৎ হাসলো সে নিরবেই। ভীষণ শান্ত গলায় বললো, ‘ কিসের জন্য মাফ করবো তোমাকে? মাফ করার মত কিছু কি করেছো তুমি? ‘

নক্ষত্রের ইংগিতটা বুঝতে পেরে এবার কষ্টে আরও বেশি কেঁদে ফেললো ইরিন। কান্না জড়ানো গলায় বললো, ‘আমি জানি আমাকে মাফ করা যায় না, কিন্তু তাও বিশ্বাস করেন পুতুলের বাবাই….আমার আর কিচ্ছু চাই না। শুধু আপনার ঘৃণা,অবিশ্বাসের পিঞ্জর থেকে মুক্তি চাই আমার।তারপর এই পৃথিবী থেকেও। আমার যে এভাবে মরে মরে বেঁচে থাকা খুব কঠিন লাগে। কষ্ট হয় অনেক। ‘

‘আমি তো বলেছিলামই, যতদিন না আল্লাহ তোমাকে মুক্তি দিবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বাঁচায় রাখবো তোমাকে। আমার মেয়েটা মা ছাড়া বড় হচ্ছে হোক, মা হিসেবে তোমার এ দায়িত্ব তুমি পালন করতে চাওনি এটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু,জেনে বুঝে আমার মেয়েকে মা হারা হয়ে বড় হওয়ার সুযোগ আমি দিব না। ছাড়ো আমাকে। এভাবে টাচ করার অধিকার তোমার নেই আর। ‘

‘অধিকার নেই বলছেন তাহলে একেবারে মুক্তি কেন দিচ্ছেন না আমাকে? কেন স্ত্রীর মর্যাদা না দিয়েও স্ত্রীর জায়গায় ব্যবহার করছেন আমাকে?’ নক্ষত্রের কথায় তাকে ছেঁড়ে দিয়ে ফুঁসে উঠে বললো ইরিন।

‘আস্তে! পুতুল ঘুমাচ্ছে কিন্তু ঘরে। ‘ ইরিনকে সতর্ক করে দিয়ে বললো নক্ষত্র। একপলক জানলা দিয়ে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে নিল পুতুলকে। শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে সে।

তাকে ঘুমাতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো নক্ষত্র। ইরিনের দিকে ফিরে ঝাঁঝালো গলায় বললো,

‘ কি যেন বললি তুই? তোকে স্ত্রীর জায়গায় ব্যবহার করতেছি আমি? আরেএএ ব্যবহার তো তুই আমাকে করছিলি স্ত্রীর জায়গা ফিরে পাওয়ার জন্য। ভুলে গেছিস সব? আমি কিন্তু ভুলিনাই কিছুই। শুধু আমাকে কেন…আমার মেয়েটাকেও হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে ছাড়িস নাই তুই নিজের জন্য। তাই এখন ওর জন্যই তুই ওর বৈধ মা হয়েই থাকবি। সারাজীবন আমার স্ত্রী হিসাবেই পুতুলের মায়ের পরিচয় দিবি তুই। এইটাই তোর শাস্তি। তোরে মাফ করার কোন অপশন তুই রাখিস নাই আমার জন্য। আমি আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিছি সব অনেক আগেই। কিন্তু, এই শাস্তিটুকু থেকে তোর রেহাই নাই।’

তারপর, সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো নক্ষত্র। কিন্তু, পারলো না। পূর্বেই স্বরেই বললো, ‘ পুতুলের মা হয়ে আছিস থাক। ওর মা হিসেবে যেটুকু সম্মান অধিকার তোকে দেই তা নিয়েই খুশি থাক। এর বেশি কিছু চাইতে আসলে ভালো কিছু যে কখনোই পাবিনা সেটা মাথায় রাখিস।’

কথা শেষ করে দ্রুতপায়ে ব্যালকোনি থেকে চলে গেল নক্ষত্র। ইরিন ধম পরে বসে পড়লো মেঝেতে। অনুতাপ, আত্মদহনের উত্তাপে..যন্ত্রণায় ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো সে। এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি কি তার আদৌও হবে না কখনো?

ওয়াশরুমে দরজা আটকে মেঝেতে বসে আছে নক্ষত্র। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।কিছু সময়ের মধ্যেই আযানের ধ্বনি শুনতে সে। গভীর এক শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে।তারপর, অযু করে তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল মসজিদের উদ্দেশ্যে। এখন এই অশান্ত মন, পুরোনো ক্ষতর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ কেবল তার রবের দরবারে গিয়েই সম্ভব। তার কাছে নিজেকে সঁপে দিলেই অযাচিত সব দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে সে। এই জায়গা যে পরম শান্তির। পরম নিশ্চিন্তের!

১৩৬.

নামায শেষ করে অনেকটা সময় নিয়ে মসজিদে বসেই দোয়া কালাম পড়লো নক্ষত্র। মন ভীষণ ভার হয়ে আছে তার।যদিও মোনাজাতে সে অনেক করে দোয়া করেছে তার এ অশান্ত মনের কষ্টগুলো লাঘব করে দেওয়ার জন্য। ইরিনের মনের শান্তি, সুখী জীবনের জন্যও দোয়া করেছে সে। নক্ষত্র জানে ইরিন তাকেই ভালোবাসে, নিজেকে তার অপরাধী ভাবে, কষ্ট পায়। কিন্তু নক্ষত্র পারে না। সে পারে না নিজের সাথে হওয়া ছলনাটুকু ভুলতে। ইরিনের সব ভুল মাফ করে দিলেও এই কষ্টটুকুর দায় থেকে তাকে মুক্তি দিতে পারে না নক্ষত্র।

সন্তান তো স্বামী স্ত্রীর মাধ্যকার দৃঢ় সেতুবন্ধ। তাকে ঘিরেই দুটো মানুষের সম্পর্ক নতুন জন্ম লাভ করে। স্বামী স্ত্রীকে বৈধভাবে বাবা মা হওয়ার স্বাদ দেয়। যার জন্য স্বামী স্ত্রী একে অন্যের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। ভালোবাসা গভীর হয় তাদের। বিশ্বাস ভরসা বাড়ে। অথচ ইরিন সেই সন্তানকে ব্যবহার করেছে নিজের জায়গা ফিরে পেতে। নক্ষত্র সব জেনে বুঝেও বাঁধা দেয়নি। কেবল তাকে রাজাহীন রাণী করে রেখেছে। সমাজের কাছে ইরিনের পরিচয় নক্ষত্রের স্ত্রী এবং তার সন্তানের মা। কিন্তু নক্ষত্র তাকে দিয়েছেন কেবল পুতুলের মা হওয়ার পরিচয়..দায়িত্ব ও অধিকার।স্ত্রীর জায়গাটায় থেকেও পায়নি তার অধিকার কিংবা মর্যাদা।

সারাদিনের ক্লান্তি নিয়েও গত রাতে ঘুমানো হয়নি নক্ষত্রের। ভারাক্রান্ত মনের সাথে ঘুম, ক্লান্তিও এবার জেঁকে বসেছে শরীরে। দোয়া কালাম শেষ করে একসময় মসজিদের মেঝেতেই এককোণায় শুয়ে পড়লো নক্ষত্র। লম্বা করে পা মেলিয়ে দিয়ে এক হাত মাথার নীচে দিয়ে শুয়ে রইলো সে।সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আজ ভোর রাতের কথাগুলো মস্তিষ্কে কড়া নাড়তে শুরু করলো। নক্ষত্র হতাশ হয়ে ক্লান্তির শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো। তার বন্ধ চোখে…মস্তিষ্কের স্মৃতিপটে ধীরে ধীরে ভীড় করতে থাকলো অতীতের কিছু খন্ড খন্ড চিত্রপট।

১৩৭.

ইরিনের আত্মহত্যা করার চেষ্টার ঘটনাটার পর পেরিয়েছে আরও তিনমাস। এর মাঝে অনেক কিছুই বদলে গেছে। সেদিনের পর থেকে নক্ষত্র প্রয়োজন ছাড়া ইরিনের সাথে কথা বলে না। ইরিনের কাছেও ঘেঁষে না খুব একটা। শুরুর দিকে যেমন ইরিন একটু নাড়াচাড়া করলেই অস্থির হয়ে ছুটে যেত, তার কিছু লাগবে কিনা…ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করতো এখন আর করে না। কেবল স্বামীর দায়িত্ব হিসেবে অসুস্থ ইরিনের খেয়াল রাখে।সেবা করে….যত্ন নেয়। ইরিনও বুঝে এসব কেবলই দায়িত্ব হিসেবে করে নক্ষত্র। ভালোবাসা কিংবা যৎসামান্য সহানুভূতিও মিশে থাকে না সেসবে।

তবে এত সব কিছুর পরেও ইরিন এখন প্রায় সুস্থই। শরীরের ক্ষতগুলো শুকিয়ে গেছে। তবে মনের ক্ষতগুলো তখনো তাজা। নক্ষত্রের নিগূঢ় সেবা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে ইরিন এখন নিজ পায়েই আবারও হাঁটতে সক্ষম।যদিও ডাক্তার এখনো খুব একটা নাড়াচাড়া করার অনুমতি দেয়নি। এখনো নক্ষত্র ধরে ধরে নিয়ে হাঁটায়। ঘরের ভেতর, বাগানেই চলে ইরিনের হাঁটাচলা। ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া বাইরে যাওয়া হয় না ইরিনের। রিতুকে আবারও নিয়ে আসা হয়েছে শেখ ভিলায়। ভাই বোনেরা যোগাযোগ, খোঁজ খবর না রাখলেও আম্বিয়া খাতুন মাঝে মধ্যে এসে দেখা করে যান দুই মেয়ের সাথে।

এমনই একদিন আম্বিয়া খাতুন আসেন শেখ ভিলায়। ইরিনের সাথে কথা বলার সময় কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেন।

‘হ্যাঁ রে ইরিন…অনেকদিন তো হইলো, তুইও মোটামুটি সুস্থ এখন। তা…আরেকটা বাচ্চা কাচ্চার ব্যাপারে ভাবছিস কিছু?’

ইরিন এ কথা শুনে প্রথমে চমকালেও পরে হাসে। তাচ্ছিল্য করেই হাসে। তাকে এভাবে হাসতে দেখে আম্বিয়া খাতুন চিন্তিত স্বরে বলেন, ‘কি রে হাসিস ক্যান এম্নে? আমি কি ভুল কিছু বলছি নাকি!’

‘তোমার কি মনে হয় আম্মা…উনি কি মানুষ না? এত কিছুর পরেও যে তোমার মেয়েকে উনি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেনাই, ঘরে তুলছে…এত সেবা যত্ন করতেছে এটা তো তোমার মেয়ের সাত জন্মের কপাল।তাই বলে যে উনি আমাকে মাফ করে দিছেন এমন ভাবার ভুল করো না তোমরা। ‘

‘নক্ষত্র বাবাজি ছেলে হিসেবে অনন্য। ওর সাথে অন্যদের তুলনা করিস না। সে যে তোরে কতটা ভালোবাসে সেটা আমরা সবাই বুঝি। নইলে এত কিছুর পরেও সে তোরে নিজের কাছে রাখতো না। তুই যা করছিস তোরে মাফ করা উচিৎই না আসলে। কিন্তু, তাও যখন সংসার করতেছিস এটারে ধইরা রাখ। স্বামীর মন যুগায় চল। দেখবি একদিন না একদিন ঠিকই মাফ কইরা দিবে সে তোরে।’ মেয়েকে বুঝিয়ে বললেন আম্বিয়া খাতুন।

‘উনি আমাকে সাফ সাফ বলছেন আম্মা….আমাকে স্ত্রীর পরিচয় দিলেও…আমার প্রতি দায়িত্ব পালন করলেও, উনার স্ত্রীর মর্যাদা আর অধিকার আমি পাবো না আর কখনো। উনি আমাকে আর ভালোবাসেন না আম্মা।এমনকি গত ৩ মাস ধরে প্রয়োজন ছাড়া একেবারেই কথা বলেন না আমার সাথে। আমাকে আগের মত আগলায়াও রাখেন না। শুধু দায়িত্বের খাতিরে আমি উনার স্ত্রী হয়ে গেছি। ‘ কান্না জড়ানো ব্যাথিত কন্ঠে বললো ইরিন।

আম্বিয়া খাতুনও ব্যাথিত হলেন মনে মনে মেয়ের এমন করুন দশা শুনে। খানিক ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘শোন ইরিন….পুরুষ মানুষের মনে একবার আঘাত দিলে এরা সহজে ভুলে না সেইটা। যারে সত্যিকারে ভালোবাসে তার আঘাত বড় কঠিন আঘাত তাদের জন্য।আমরা মেয়ে মানুষেরা নরম মনের হই। ভালোবাসার মানুষ একটু আদর সোহাগ দিলেই মন গইলা যায়। মাফ কইরা দেই। কিন্তু, পুরুষ মানুষ এত সহজে সেইটা পারে না।

আর তুই নক্ষত্র রে যে কষ্ট দিছিস সেটা অনেক বেশি। তাও তোরে বলি , তুই তার মন ফিরানোর চেষ্টা কর। আরেকটা বাচ্চা নে। পুরুষ মানুষ যতই কঠিন হইক না ক্যান, তাদের একটা দূর্বলতা কিন্তু মাইয়া মানুষের টান। তুই তারে আদর সোহাগ দিয়া বানতে(বাঁধতে) পারলে সে তোরে ফিরাইতে পারবো না। তাও আবার সে তোরে ভালোবাসে। তুই কাছে টানলে ফিরাইবো না দেখিস। আর বাচ্চা কাচ্চা হইলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সেতুবন্ধন। দুইজনরে একলগে বাইন্ধা রাখে। একখান বাচ্চা আইলেই দেখবি জামাই বাবাজি আবার আগের মত সোহাগ করবো তোরে। যত যাই হোইক, তার সন্তানের মা রে তো আর অবহেলা করবো না সে। ‘

ইরিন অবাক হয়ে শুনলো আম্বিয়া খাতুনের কথাগুলো। গ্রামের মানুষের ধ্যান ধারণা হিসেবে তার মায়ের যুক্তিগুলো ভুল না। কিন্তু, ইরিন জানে নক্ষত্রের মন কতটা কঠিন। প্রায় দেড় বছর সে এই মানুষটার সাথে আছে। খুব অল্প সময়ে অনেক ভালো খারাপ ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে তাদের বিবাহিত জীবন। সামনে এসেছে অনেক অজানা অতীত। নক্ষত্রকে নতুন করে জেনেছে সে। আবিষ্কার অন্ধকারের গভীরে জেগে থাকা এক অনন্য নক্ষত্রের। যার ভালোবাসা, স্নেহ, দায়িত্বশীলতা আবার শাসনের মত ভিন্ন ভিন্ন রূপের মায়ায় জড়িয়েছিল সে। অথচ, সেসব বুঝতে না পেরে মনের বিভ্রান্তিতে পড়ে কি বড় ভুলটাই না করেছে সে। কতটা কষ্ট দিয়েছে সে নক্ষত্রকে। এসব ভাবলেই এখন দমবন্ধ লাগে ইরিনের। মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, সেদিনের চেষ্টার পর নক্ষত্রের যে রূপ তার সামনে এসেছে এরপর আর সাহস হয়নি নিজ থেকে মরতে চাওয়ার।

হতাশা গলায় ইরিন বললো, ‘সব পুরুষ এক হয় না আম্মা। যে পুরুষ ভালোবাসে সে শরীর নিয়া টানা হ্যাঁচড়া করে না।লোভ করে না। ভালোবেসে কাছে টানে। আর উনার মনে আমার জন্য ভালোবাসাটাই শেষ হইয়া গেছে। আমার এই সংসার আমার শাস্তি আম্মা। উনি আমাকে ছাড়বেন না কিন্তু কাছেও টানবেন না। এইসব বাচ্চা কাচ্চা নতুন জীবন সব কেবলই কল্পনা ।যেইটা কোনদিন বাস্তব হবে না আমার জীবনে। ‘

‘তুই একবার চেষ্টা তো কইরা দেখ…একটা বাচ্চা হইলেই দেখবি জামাইয়ের মন নরম হইবো। তোরে সে ভালোবাসে। তুই কাছে টানলে কতক্ষণ আর দূরে থাকবো সে?এক না এক সময় ধরা দিবোই।’

‘উনি আমাকে ছুঁবেনও না আম্মা। আর না আমি পারবো এই নোংরা শরীরে উনার মত পবিত্র মানুষের আরশ রে জায়গা দিতে। তুমি আর এইসব কথা বইলো না। ‘

‘শোন রে মা…..তুই ভুল করছিস, শাস্তিও তুই পাইছিস। কিন্তু এইভাবে কি জীবন চলবে? তোর জন্য কি জামাই বাবা হওয়ার স্বাদটুকুও পাবে না?’

‘আমি তারে বলছিলাম আম্মা, আমাকে ডিভোর্স দিতে। উনি আমাকে আবারও চড় মারছিল।এই নিয়া দুই দুইবার চড় মারছেন উনি আমাকে । ‘ ব্যাথিত অভিমানী গলায় বললো ইরিন।

‘ভালো করছেন। তোর সাহস ক্যাম্নে হয় তালাক চাওয়ার? নিজ হাতে নিজের সর্বনাশ করতে চাস ছ্যামড়ি, তোরে তো আরও কয়েকটা চড় মারতাম আমি হইলে। ‘ ঝাঁঝালো গলায় বললেন আম্বিয়া খাতুন।

‘আম্মাআআ…!!’ আহত স্বরে বলে ইরিন।

‘কিসের আম্মা? যা বলতেছি শোন। আরেকটা বাচ্চা নে। সংসার কর মন দিয়া। এমন ভাগ্য সবার হয় না রে ইরিন। তুই যে কি ভাগ্য নিয়া এমন স্বামীর পাইছিস আল্লাহ মালুম। এইটারে যত্ন কইরা ধইরা রাখ। নইলে যা হইছে, আমি হইলে তোরে বিষ খাওয়ায় মাইরা ফেলতাম। অথচ নক্ষত্র তোরে নিয়া সংসার করতেছে এখনো।’

‘আচ্ছা…দেখি। ‘ দ্বিধা জড়িত গলায় বললো ইরিন।

‘জলদি করিস। পুরুষ মানুষ যতই ভালো হইক, সুযোগ মত মন ঘুরতে সময় লাগে না।।দুইজনের মাঝে এমন দূরত্ব রাখিস না যে কোন দিক দিয়া সে মন বদলায় ফেলবো আর তুই টেরও পাবি না। হাজার হইক, আমি তো মা। মেয়ের সংসার ক্যাম্নে টিকবো এই চিন্তা আমারও কম না। ‘ নিজের জায়গা থেকে বুঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বললেন আম্বিয়া খাতুন।

ইরিন ভাবনায় পড়ে গেল তার কথাগুলো নিয়ে। প্রথমে মন পাত্তা না দিলেও নক্ষত্রকে ফিরে পাওয়ার লোভাতুর মনটা তাকে খুঁচাখুঁচি করতে শুরু করে দিয়েছে আম্বিয়ার কথায় সায় দিতে। ইরিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। মন বলে, নক্ষত্র বাবা হতে চায়।এই সুখটুকু যদি সে দিতে পারে নক্ষত্রকে তবে কি তার ভুলের কিঞ্চিৎ হলেও ক্ষমা মিলবে? যদি মিলে যায়? একটা সুযোগ তো নেওয়াই যায়। একটা বাচ্চা আর এমন কি? সে নিজেও তো নক্ষত্রের সন্তানের মা হতে চেয়েছিল। নওরিনকে গর্ভে ঠাই দিয়েছিল। আরেকবার কি সেটুকু করা যায় না? এর জন্য হলেও নক্ষত্র যদি তাকে আবার ভালোবাসে…ক্ষতি কি!!

১৩৮.

দিন কয়েক পরের ঘটনা।ইরিন এ ক’দিন অনেক ভেবেছে। আম্বিয়া খাতুনের বাতলে দেওয়া পথটায় একবার হাঁটলে কি খুব বেশি খারাপ হবে? ইরিনের মন বারবার একই উত্তর দেয়, চেষ্টা করতে দোষ কি। নক্ষত্র তো এমনিতেও ইরিনকে সবভাবে নিজের থেকে দূরে করে দিয়েছে। এবার যদি রাগ হয় বেশি কি আর করবে….মারবে? নয় তো ডিভোর্স দিবে তাকে। কিন্তু, ভালো থাকার জন্য এটুকু চেষ্টা তো সে করতেই পারে। তারপর যা হওয়ার হোক। সে মেনে নিবে সবটাই। তবুও নক্ষত্রের খুশির জন্য এটুকু সে করবেই!

একরাতে ইরিন প্রস্তুত করলো নিজেকে। নক্ষত্রের কাছে নতুন করে নিজেকে সঁপে দেওয়ার জন্য। সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে নারীরা কত কিছুই না করে! ইরিন না হয় একটু বেহায়াই হলো। নিজের পঁচে যাওয়া শরীর দিয়েই নক্ষত্রকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করুক সে।

রাতে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল নক্ষত্র। বিছানা ঠিকঠাক করে শুতে যাবে সেই মূহুর্ত ইরিন এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। নক্ষত্র চমকালো প্রথমে হঠাৎ ইরিনের এমন আচরণে। কারণ গত ছয় মাসে ইরিন নিজকে বেশ গুটিয়ে নিয়েছিল নক্ষত্রের থেকে। নক্ষত্রের সামান্য স্পর্শেও অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে থাকতো।তবুও কেবল অসহায়ত্বের কারণে নক্ষত্রের কাছে নিজেকে ছাড়তে হয়েছে ইরিনকে। তাছাড়া আত্মহত্যার চেষ্টার পর থেকে নক্ষত্রও খুব একটা কাছে যায়নি তার।কাঁদলেও আগলে নেয়নি নিজের বুকে।
তাই আজ হঠাৎ ইরিনের এই আচরণ তার জন্য চমকই বটে।

‘কি সমস্যা? ‘ ইরিনের হাত সরিয়ে দিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো নক্ষত্র।

ইরিন এতে মন খারাপ করলো না। সে জানেই এমন আচরণ তার জন্য স্বাভাবিক। সে হাল ছাড়লো না। এবার সরাসরি নক্ষত্রের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে চোখ তুলে তাকালো নক্ষত্রের মুখপানে। নক্ষত্র খেয়াল করলো ইরিনের পড়নে বাসর রাতের সেই কালো লেহেঙ্গা। সেই গয়নাগুলোই যেগুলো নক্ষত্র নিজে পছন্দ করে তার জন্য কিনে ছিল। একদম সেদিনের মত করেই সেজেছে ইরিন তার জন্য। যে রূপের প্রেমে পড়েছিল সে বাসররাতেই।অথচ ভালোবেসে কাছে টানতে পারেনি তার নব্য বিবাহিত স্ত্রীকেই। মনের সংশয় সেদিন সেই অধিকারে লাগাম টেনেছিল আর আজ মনের ক্ষততে এই রূপ…এই নারী বিক্ষিপ্ত চিত্রপট।

‘আমি ঠিক কি করলে আপনি আমাকে মাফ করবেন বলবেন প্লিজ?’ বেশ সাহস নিয়ে অনুতপ্ত গলায় বললো ইরিন।

এতক্ষণে নক্ষত্রের কাছে ইরিনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হলো। ইরিনকে আগাগোড়া আরেকবার ভালো করে দেখে বাঁকা হাসলো সে। ইরিন বিভ্রান্ত চোখ মুখে সে হাসির রহস্যে ডুবে গেল। কিন্তু কিছু উদ্ধার করতে পারলো না। নক্ষত্র বললো,

‘কি চাই তোমার ইরিন?’

‘আমি নিজ ভুলে যা হারিয়েছি। ‘

‘তুমি ঠিক কি হারিয়েছো সেটাই তো তুমি জানো না। অথচ ফেরত পাওয়ার আশা করছো।’

‘আপনি কি আমাকে আর একটুও বিশ্বাস করেন না?’

‘পুরোপুরি অবিশ্বাস করিনা।’

‘তাহলে যদি বলি আমি আপনাকে ভালোবাসি….বিশ্বাস করবেন আপনি?’

‘ভুলেও অবিশ্বাস করবো না। আমার অনুভূতি এতটাও ভুল হওয়ার নয়। আগেই বলেছিলাম তুমি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো। কিন্তু, আমি তোমাকে ভালোবাসি না আর। তোমার সাথে এখন আমার কেবল দায়িত্বে সম্পর্ক। ‘

‘নক্ষত্র……প্লিইইইজজজ!!’

‘দেখি সরো..শুতে দাও। রাত বিরাতে আর নাটক করো না। ঘুমাও।’ কথাটা বলে ইরিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় নক্ষত্র। বিছানার কাছে যেতেই ইরিনের কথায় থমকে দাঁড়ায় সে।অনেকটা কঠিন স্বরে ইরিন বলে,

‘দায়িত্বের সম্পর্ক তাহলে দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কেন?’

‘মানে?’ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।

‘স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব কি শুধুই অর্থ সম্পদের? তার অন্যসব চাহিদা মেটানোর দায় কি নেই আপনার?’

নক্ষত্র ইরিনের কথার ধরণে রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ইরিন একরোখা, জেদি বলে সে জানলেও নক্ষত্রের সাথে এমন কঠিন গলায় কথা বলার সাহস সে করেনি কখনো। নক্ষত্র মিনিট খানিক সময় নিয়ে ভাবলো কিছু একটা। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ইরিনের দিকে। ইরিন কাঁদছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। নক্ষত্র তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক হাতে তার থুতনিতে ধরে মুখ হালকা উঁচু করে ধরলো। ইরিন কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একবার যখন সাহস করে এগিয়েছেই যত যাই হোক এই পথ সে পাড়ি দিয়েই ছাড়বে।

‘আমার দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলছো তুমি? জবাবটা সহ্য করতে পারবে তো ইরিন? সেই ক্ষমতাটুকু নিয়েই প্রশ্ন তুলেছো তো??! ‘একদম ঠান্ডা গলায় হুমকির মত করে বললো নক্ষত্র।

ইরিনও নিজের জেদ থেকে নড়লো না। শক্ত গলায় বললো, ‘সহ্য না করতে পারলে শেষ হয়ে যাবো। তবুও আপনার অপরাগতার অভিযোগ তো আর থাকবে না। প্রশ্নও উঠবে না।’

‘বেশ।’ ইরিনের চোখে চোখ রেখে বললো নক্ষত্র। কথা শেষ করে এক মূহুর্তও দেরি করলো না নক্ষত্র। ইরিনের ঘাড়ের পেছন দিয়ে হাত নিয়ে চুলের ভাজে আঙুল ডুবালো। শক্ত করে চেপে ধরলো তাকে। চুলে টান পড়ায় ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে গেল ইরিনের। তবুও টু শব্দটি না করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নক্ষত্র অন্য হাতটা তার কোমড়ে রেখে শক্ত হাতে কোমড় চেপে কাঁছে টেনে আনলো তাকে। মিশিয়ে নিল নিজের সাথে। সি সেকশনের ধাক্কাটা এখনো পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি ইরিন। ভারী কোন কাজ করতে পারে না। চাপ সহ্য করতে পারে না। ব্যাথা হয় প্রচুর। নক্ষত্রের এমন শক্ত হাতের চাপে ব্যাথায় ঝনঝন করে উঠলো সমস্ত শরীর। তবু সে সহ্য করে দাঁড়িয়ে রইলো।

নক্ষত্র কয়েকমুহূর্ত ইরিনের কঠিন মুখখানা তাকিয়ে দেখলো। কালোর গভীরতার মাঝে নারীর কঠিন মুখখানি এক অনন্য রূপের প্রতিচ্ছবি। এরূপ প্রেমে ফেলতে বাধ্য। হিংস্র হতে বাধ্য করার মত। নিজের কামনাকে অবলীলায় লাগামহীন করার জন্য যথেষ্ট।

নক্ষত্র সময় নষ্ট করলো না। পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিল ইরিনকে। অতঃপর, স্বামীর দায়িত্ব পালন হলো।নিজের অপরাগতার অভিযোগও মিথ্যা করে দিল নক্ষত্র। বিপরীতে,বিদঘুটে কালো আঁধার রাতে আরও একটা ভুলের সাক্ষী হলো ইরিনের বিদ্ধস্ত শরীর -মন।
#নক্ষত্র_বন্দনা

#পর্ব_২৪_শেষাংশ

#লেখায়_জারিন

১৩৯.

সময়টা মধ্যরাত্রী। স্বামীর দায়িত্ব পালন শেষে বিছানার এক পাশে পিঠে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে নক্ষত্র। একই চাদরের নীচে থেকেও মাঝে বেশ দূরত্ব ইরিনের সাথে তার অবস্থানের। দুজন দুপাশে। বিমুখ। নক্ষত্রের আঙুলের ভাঁজে জ্বলন্ত সিগারেট। ইতোমধ্যে আরও দুটো শেষ করেছে সে। মনের ক্লান্তি পোড়ানোর চেষ্টা চলছে তার। ঘরজুড়ে পিন পতন নিরবতা। ঠিক তখনই ইরিনের শান্ত গলার আওয়াজে কিছুটা চমকে উঠলো নক্ষত্র।

‘আপনি যখন প্রথম আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিলেন আমি জেনেছিলাম ভালোবাসার স্পর্শ কেমন হয়। কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু যন্ত্রণা হয়নি। কামনার স্পর্শ তখনো আমার অজানা। ওয়াসিফ যেদিন ভোগ করেছিল আমাকে, সেদিন বুঝেছিলাম কামনা জাগলে পুরুষ মানুষ কেমন জানোয়ার হয়ে উঠে। স্পর্শ কতটা হিংস্র আর বেপরোয়া হয়। কামনার তৃপ্তি না হওয়া পর্যন্ত কামসাধনার অবসান ঘটে না। কিন্তু, আজকে প্রথম বুঝলাম ভালোবাসাহীন স্পর্শ কামনার স্পর্শের চাইতেই অনেক বেশি যন্ত্রণা দেয়। ভালোবাসাহীন গভীর স্পর্শ এতটা নির্দয় হয় সত্যিই জানাছিল না আমার। আজ সত্যিই মানুষ বলে মনে হচ্ছে না আপনাকে। ‘

‘তো আগে কি আমাকে ফেরেশতা ভেবেছিলে নাকি তুমি?’ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাঁকা হেসে বললো নক্ষত্র।

‘আপনি একটা অমানুষ হয়ে গেছেন নক্ষত্র।ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলে বুঝি এমন অমানুষ হয়ে উঠে মানুষ?’

‘ঠিক তা নয়। তবে দায়িত্ব পালনে বড়জোর নিষ্ঠার প্রয়োগ করা যায়…ভালোবাসা নয়। তুমি চেয়েছিলে আমি স্বামীর দায়িত্ব পালন করি, করেছি। সেটা আমি কতটা নিষ্ঠা বা অবহেলায় করবো সেটা আমার ব্যাপার।’

‘এতটা ক্ষোভ নিয়ে কি করে বাঁচিয়ে রেখেছেন আপনি আমাকে? খুন করবেন না, আমাকেও নিজেকে শেষ করতে দিবেননা…তো সেদিন মরার জন্য ছেড়ে দিলেই পারতেন। আমি মরে গেলেই তো এত অশান্তি, ক্ষোভ নিয়ে বাঁচতে হতো না আপনাকে।’ বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো আবারও ইরিন।

‘দায়িত্ব যে! দায়িত্ব পালন করতে আমি আবার কার্পণ্য বা অবহেলা করি না সচারাচর । এই যে দেখো আজও করলাম না। বাই দা ওয়ে…..মন ভরেছে তোমার? চাহিদা মিটেছে নাকি আরও এফোর্ট দিতে হবে আমায়?’

‘ছিঃ……এমন অসভ্যের মত কথা বলছেন কেন আপনি? ‘রাগে..দুঃখে.. লজ্জায় একাকার হয়ে বললো ইরিন।

‘সভ্য থেকে কি উদ্ধার হয়েছে আমার? দায়িত্ববোধ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলে তুমি। জবাবটা ভালো মতই পেয়েছো নিশ্চয়।’ সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বললো নক্ষত্র। তার এমন অচেনা রূপের মতই ধুয়াশায় ছেয়ে গেল তার বাহ্যিক অবয়বটাও।

কষ্টে..যন্ত্রণায় ইরিন এবার চোখ বুজে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সমস্ত শরীর ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে আছে। নিজের সম্পূর্ণ ক্ষোভ ঢেলে দিয়েছে আজ নক্ষত্র তার প্রতিটি স্পর্শে। গভীর ছোঁয়ায় মিশিয়েছে আক্রোশের বিষ। রুক্ষ বিচরণে পিষে গেছে ইরিনের সমগ্র সত্তা। ইরিন পদে পদে টের পেয়েছে নক্ষত্রের ভালোবাসাহীন স্পর্শের তীক্ষ্ণতা। সূক্ষ যন্ত্রণায় ছটফট করেছে সে। নক্ষত্র রেহায় দেয়নি। ইরিনকে কোন সুযোগ দেয়নি তার রুক্ষ স্পর্শের দাবানল থেকে মুক্তির।

ইরিন সহ্য করতে না পেরেও বাধ্য হয়েই নিজেকে সঁপে দেয় নক্ষত্রের দেওয়া অমানুষিক যন্ত্রণার কাছে। নক্ষত্রও যেন অন্য এক নক্ষত্রে পরিণত হয়েছিল আজ। ছাড় দেয়নি একবিন্দুও। নিজের অপরাগতার অভিযোগের অবসান ঘটিয়ে ছেড়েছে। ফলাফল ব্যাথাতুর নিস্তেজ শরীর নিয়ে বিছানার সাথে মিশে আছে ইরিন। কিঞ্চিৎ নড়নচড়ন বা স্পর্শও যেন বিষাক্ত ছোবল তার জন্য এখন।

১৪০.

ইরিনের কান্না শুনে পাশ ফিরে তাকালো নক্ষত্র। বিরক্ত হলো সে। ব্যাথায় কাতর ইরিনের এক বাহু ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো নক্ষত্র। নক্ষত্রের জোরালো স্পর্শে যন্ত্রণায় সশব্দে আর্তনাদ করে উঠলো ইরিন। নক্ষত্র তাতে পাত্তা দিল না।এক হাতে ইরিনের চোখ মুছে দিয়ে বললো, ‘কান্না থামাও ইরিন। খুশি মনে নিজের দায়িত্ব পালন করো। ‘

নক্ষত্রের কথায় অবাক চোখে তার দিকে তাকালো ইরিন।নক্ষত্রের সাথে চোখাচোখি হতেই তার দৃষ্টির অর্থ বুঝে নিল নক্ষত্র। বাঁকা হেসে বললো, ‘আমরা তো স্বামী স্ত্রী, রাইট? আমি আমার স্ত্রীর চাহিদা মিটিয়ে স্বামীর দায়িত্ব পালন করেছি এবার তো আমার স্ত্রীর পালা। সে তার দায়িত্ব পালন করবে না? এমন হয় নাকি!’

নক্ষত্রের কথার অর্থ বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না ইরিনের। অনাগত স্পর্শের কথা ভেবে মনে মনে শিউরে উঠলো সে। নিজের দূর্বল হাতেই নক্ষত্রকে ঠেলে দূরে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু, নক্ষত্রের বাহুবন্ধনের দৃঢ়তা ভেঙে মুক্তি মিললো না তার। নক্ষত্রকে আগাতে দেখেই ইরিন অস্পষ্ট আর্তনাদে চেঁচালো।

‘নক্ষত্র…না…প্লিজ।’

নক্ষত্র সুযোগ দিল না। সত্যিই বুঝি আজ অমানুষ হয়ে উঠেছে সে। ভালোবাসা মরে গেলে কি মানুষ অমানুষ হয়ে উঠে নাকি ঘৃণা ক্ষোভ তা গিলে খেলে? নাকি প্রতিশোধে পিষে যায় অনুভূতি? প্রিয় হয়ে উঠে অপ্রিয়। প্রেম হয়ে উঠে বিষাক্ত।
ভালোবাসা ভুলে গিয়ে বেঁচে থাকে ভুল, ক্ষোভ আর যন্ত্রণা!

১৪১.

সারারাত অমানুষিক স্পর্শের যন্ত্রণায় কাতর ইরিনের ভোর নাগাদ রেহাই মিললো। বিদ্ধস্ত শরীর ও মনের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে গেল সে। নক্ষত্রও পাশেই শুয়ে ছিল তার। ইরিনকে ছাড়ার পর কপালে হাত রেখে চোখ বুজে শুয়ে ছিল সে। ইরিনের কান্না তার সহ্য হয় না, তবুও আজ সে নিজেই তার কান্নার কারণ হয়েছে। স্বেচ্ছায়…নিজ উদ্যোগে। ইরিন কত করে বলেছিল কষ্ট হচ্ছে তার নক্ষত্র মানেনি। বরং কষ্ট বাড়িয়ে তুলেছে শতগুণে। নিজের মাঝে সুপ্ত অমানুষের রূপটাকে পুরোদমে লাগামহীন করে দিয়ে চড়াও হয়েছিল ইরিনের উপর। ইরিনের প্রশ্নের যোগ্য জবাব দিতেই তার এই রূপ সে ব্যাবহার করেছে বলে মনকে প্রবোধ দিয়ে গেছে প্রতি মূহুর্তে।

ইরিনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে পাশ ফিরে তাকে দেখলো নক্ষত্র। এলোমেলো হয়ে বিদ্ধস্ত এক রমণী ঘুমিয়ে আছে কিছু দূরেই। তার রক্ত জমাট বাঁধা ঠোঁট, ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া শুকনো রক্তের ধারা, কিংবা ফর্সা শরীরে লালচে হওয়া জায়গাগুলো এ মূহুর্তে যে কোন পুরুষের কামরূপকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করতে সক্ষম। কিন্তু, নক্ষত্র তাতে আকর্ষিত হলো না। যন্ত্রণাময় হাসি ঠিকরে পড়লো তার ঠোঁটের বাঁকে। মুখ ফিরিয়ে নিল সে ইরিনের থেকে। নিজেকে দেখলো একবার।তার হাতে, কাঁধে এমনকি পিঠেও নিজের যন্ত্রণার ছাপ ফেলেছে ইরিন।

নক্ষত্র একছটাক হাসলো নিজের অবস্থা দেখে। বালিশে মাথা রেখে সিলিং এ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। আপন মনে মৃদু স্বরে আউড়ালো…

আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন- কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু- একই আলো পৃথিবীর পারে
আমারা দু’জনে আছি; পৃথিবীর পুরোনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?’

(জীবনানন্দ দাশ)

১৪২.

ডাক্তার সুব্রতর চেম্বারে বসে আছে নক্ষত্র। তার হাতে ইরিনের ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট । মিটমিটিয়ে হাসছে সে। ইরিনের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং তার নিজেরও। দ্বিতীয়বারের মত গর্ভধারণ করেছে ইরিন। ছাব্বিশতম দিন চলছে। নক্ষত্র আবারও বাবা হতে চলেছে এবং ইরিন তার সন্তানের মা।

‘এত তাড়াহুড়োর কি বিশেষ কোন দরকার ছিল, আদৃত?’ -নারাজ গলায় বললেন ডাক্তার সুব্রত।

‘ইরিনের ইচ্ছেয় হয়েছে এটা।’ নির্বিকার গলায় বললো নক্ষত্র।

‘তার ইচ্ছে ছিল মানলাম, কিন্তু তুমি সব জেনে বুঝে তাতে সায় দিয়েছো কেন? এটা কি তোমার অন্যায় মনে হচ্ছে না?’

‘অন্যায়ের সাথে কি অন্যায় করা যায়, ডক্টর সুব্রত?’

ডাক্তার সুব্রত চমকালেন নক্ষত্রের এমন কথায়। আজ প্রায় ৮ মাস যাবৎ ইরিনের নিয়মিত চেকআপ করছেন তিনি।সেই সূত্রে নক্ষত্রের সাথে সাক্ষাৎ আলাপও হয়েছে বহুবার। শুধু মাত্র ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক ছাড়িয়ে তা স্নেহ ও আন্তরিকতার সম্পর্কে গড়িয়েছে। সম্বোধন বদলেছে।

স্বামী হিসেবে নক্ষত্রের দায়িত্বশীল আচরণ, মানুষ হিসেবে তার অমায়িক মানসিকতা তাকে মুগ্ধ করেছে বারেবার। কিন্তু, বিগত কয়েক বারের চেক আপে আসা ইরিনকে দেখে তিনি বেশ চিন্তায় পড়ে যান। ইরিন আগের তুলনায় অনেকটা শুকিয়ে গেছে, চোখের নীচে কালি জমেছে, মুখে বিষাদের ছাপ।বাহ্যিকভাবে দৃষ্টিগত দিক থেকেই ইরিনের শরীরেও কিছু আঘাতের ছাপ তিনি দেখেছেন, যেটা নিয়মিতভাবে স্বামী স্ত্রী তাদের বিশেষ মূহুর্তের সংস্পর্শে এলে তৈরী হয়। কিংবা যখন জোরপূর্বক মিলিত হয় একে অন্যের সাথে। ইরিনকে তিনি মেয়ের মত স্নেহ করেন। তাই এমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞেসও করেছিলেন বার কয়েক, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা তার। ইরিন প্রতিবার না সূচক জবাব দিয়ে এড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা। গত পরশু ইরিনের অবস্থা দেখে সত্যিই বেশ বিচলিত হন তিনি। মনে খটকা লাগে। তাই ব্লাড টেস্ট দেন।

আজ রিপোর্ট দেখে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। তার ধারণাই ঠিক। ইরিন গর্ভবতী। অথচ, তিনি বারবার নক্ষত্রকে বলেছিলেন ইরিনের এমন শারিরীর অবস্থায় অন্তত একবছর যেন বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে না ভাবে তারা। বিশেষ মূহুর্তেও যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি। অথচ সাত মাস যেতে না যেতেই কি করলো তারা!

আচ্ছা, আদৃত কি ইচ্ছা করেই করেছে এমন? প্রশ্ন জাগে ডাক্তার সুব্রতর মনে। কিন্তু, তিনি তো ভালোভাবেই বুঝিয়ে বলেছিলেন। নক্ষত্রও বুঝেছিল। ডাক্তারের প্রতিটা কথা পরামর্শ মেনে চলতো সে। তাহলে এমন কেন করলো নক্ষত্র? এই মূহুর্তে ইরিনের শরীর একদমই প্রস্তুত নয় এই বাচ্চাটার জন্য। এই বাচ্চাটাকে জন্ম দিতে গেলে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করতে হবে ইরিনকে। এত কষ্ট দেওয়ার কি খুব দরকার ছিল তাকে? এসব ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল ডাক্তার সুব্রতর। হতাশ হয়ে তিনি নক্ষত্রকে বললেন,

‘ইরিনের জীবন ঝুঁকির সম্ভাবনাও আছে এই মূহুর্ত বাচ্চাটাকে জন্ম দিলে। এটা তো জানতে তুমি, তাই না?’

‘জীবন মৃত্যু সবটাই সৃষ্টিকর্তার হাতে। দু-দুবার মরতে মরতে বেঁচে এসেছে, এরপরের হায়াত যতদিন আছে ততোদিনই বাঁচবে সে। কিন্তু, আল্লাহ যখন এই রহমত দান করেছেন আমি খুশি এর জন্য। বাকিটাও আল্লাহ ভরসা।’

‘তুমি তাহলে বুঝে শুনেই এমনটা করেছো!’ অসন্তুষ্ট গলায় বললো ডাক্তার সুব্রত।’

‘স্বামীর দায়িত্ব পালন করেছি। স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ করে। বাকি সময়টাও তাকে দেখে রাখার দায়িত্বটাও আমার। এবং আমি তা ভালোভাবে পালন করার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ।’

‘দেখো, আদৃত….ইরিনের কেসটা সত্যিই জীবনের একটা নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন দৃষ্টান্ত আমার জন্য। তোমার মত হাজবেন্ড আমি এই প্রথম দেখেছি। তাই এমন আচরণের আশা তোমার থেকে কখনোই ছিল না আমার। তারপরেও, আমি তো জাস্ট একজন ডাক্তার। পেশেন্টের ভালো মন্দের ব্যাপারে সাজেস্ট করাই আমার কাজ। বাকি মানা না মানা তাদের উপর ডিপেন্ড করে। তবে, সত্যি বলতে তোমাদের এই কাজে আমার একদমই সাপোর্ট নেই।ডাক্তার হলেও একজন মানুষ আমি। দীর্ঘদিন কোন রোগীর সাথে চিকিৎসা সূত্রে জড়িত থাকলে তা আন্তরিকতার সম্পর্কে গড়ায়।তোমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তুমি জানো সবটাই। ইরিন আমার মেয়ের মতন। তার ভালোর জন্যই বলেছিলাম কথাগুলো। তবুও যখন কাজটা তোমরারা করেছোই তখন আমার কি বা বলার আছে আর। ‘

‘আপনি ওর ভালোর জন্য যা করা দরকার সেসব সাজেস্ট করুন। আমি ওর খেয়াল রাখবো। আমার সন্তান সুস্থ ভাবেই পৃথিবীতে আসবে এবং তার মা-ও ভালো থাকবে ইন শা আল্লাহ।’

নক্ষত্রের এমন একরোখা জবাবের পর আর কিছু বলার থাকে না ডাক্তার সুব্রতর। তিনি ইরিনকে আরেকবার চেক আপে নিয়ে আসার জন্য বলেন।আরও কিছু প্রয়োজনীয় টেস্ট করানো দরকার। বাচ্চার অবস্থা জানা জরুরি।সেই সাথে ইরিনের মনের খবরও।

১৪৩.

আছরের আযান দিয়েছে বেশ অনেকক্ষণ। কিন্তু নামাযটা এখনো পড়া হয়নি ইরিনের। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না তার একদমই। ইদানীং শরীর প্রচুর দূর্বল লাগে তার। খাওয়া দাওয়া মুখেই তুলতে পারে না বলতে গেলে। নক্ষত্র বকে ধমকে জোর করে খাওয়ায়। আজকাল নক্ষত্রকে বেশ ভয় পেতে শুরু করেছে ইরিন।

সেরাতের অমানুষিক যন্ত্রণার পরে প্রায় রাত একই যন্ত্রণার শিকার হতে হয়েছে তাকে। নক্ষত্রের ভাষায় স্বামীর দায়িত্ব পালন করেছে সে এভাবে। স্ত্রী হিসেবে ইরিনের দায়িত্ব পালনের দায় মিটিয়ে নিয়েছে নিজের ইচ্ছেমত। লাগাতার দেড় দু মাস এভাবেই কেটেছে তার রাতগুলো। তারপর কোন একটা অজানা কারণে নক্ষত্র নিজ থেকেই দূরত্ব তৈরী করে নিয়েছে তাদের মধ্যে। ছুঁয়েও দেখেনি তাকে। ইরিন ব্যাপারটা খেয়াল করলেও কোন প্রশ্ন করেনি।

গত পরশু হঠাৎ করেই নক্ষত্র ইরিনকে নিয়ে যায় ডাক্তার সুব্রতর কাছে। ইরিন জিজ্ঞেস করলে শুধু এটুকু বলে যে রুটিন চেক আপের জন্য যাচ্ছে। অথচ ইরিন জানতো সেদিন বা কাছেপিঠে তার আগে/পরে কোন চেক আপের তারিখ ছিল না। ইরিন কথা বাড়ায়নি। অসুস্থ মন, ভঙ্গুর শরীর নিয়ে আজকাল তার কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। তাছাড়া নক্ষত্রের প্রতি ভয়টাও একটা বড় কারণ যার জন্য সে নক্ষত্রের কথার উপর কথা বলে না। তার চাওয়ার প্রতি আপত্তি করেনা। যার শ্রেষ্ঠ সাক্ষী নক্ষত্রের কাছে আসার প্রতিটা যন্ত্রণাময় রাত।

‘কংগ্রাচুলেশনস, মিসেস. ইয়াসমিন রাওনাফ। ‘

চোখ বন্ধ করে বিছানাতেই পড়ে ছিল ইরিন। নক্ষত্রের এমন কথায় দ্রুত চোখ মেলে তাকালো। অবাক হলো ভীষণ। নক্ষত্রের হাতে মিষ্টির বাটি।দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে সে। কিন্তু, হঠাৎ মিষ্টি হাতে এমন কথার কোন মানে খুঁজে পেল না ইরিন। অবাক চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকাতেই নক্ষত্র এগিয়ে এলো। মিষ্টির বাটিটা পাশের টেবিলের উপর রেখে ইরিনের বাহু ধরে তাকে উঠিয়ে বসালো। ইরিন বালিশে হেলান দিয়ে বসতেই তার পাশে বসে মিষ্টির বাটিটা হাতে নিল নক্ষত্র। খুশি খুশি গলায় ইরিনকে বললো, ‘দেখি…হা করো।’

ইরিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কেন?’

‘আহা…হা না করলে মিষ্টি খাবে কি করে। দেখি মুখ খুলো। ‘

‘এ সময় মিষ্টি কেন খাবো হঠাৎ? ‘

‘আগে খাও…তারপর বলছিল।’

ইরিন আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ হা করে। নক্ষত্র তাকে নিজ হাতে মিষ্টি খাইয়ে দেয়। নক্ষত্র মিষ্টির বাটিটা রেখে ইরিনকে চূড়ান্ত অবাক করে দিয়ে গাঢ় করে চুমু খায় ইরিনের ঠোঁটে। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে। ইরিন পুরো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। মন স্মরণ করার চেষ্টা করে…ঠিক কতকাল পরে এতটা কোমলভাবে যন্ত্রণাহীন স্পর্শ করেছে নক্ষত্র তাকে? মনে করতে পারে না ইরিন। মনের ভেতর অভিমান জেগে উঠে। ভিজে আসতে শুরু করে আঁখিপল্লব।

নক্ষত্র তাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই ঘোর কাটে ইরিনের। কানের খুব কাছে নক্ষত্রের ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে শিউরে উঠে সে। কি হচ্ছে…কেন হচ্ছে এটুকু আন্দাজ করার আগেই নক্ষত্র বলে, ‘কংগ্রাচুলেশনস,ইরিন। ইউ ডিড ইট। তোমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আমার সন্তানের মা হতে চলেছো তুমি। ‘

নক্ষত্রের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় ইরিন। বুকের ভেতর অজানা একটা অনুভূতির সূক্ষ চলাচল শুরু হয়। এটা সুখের নাকি কোন অজানা আশংকার বুঝে না ইরিন। তবে নক্ষত্রের কথায় ‘উদ্দেশ্য সফল হওয়ার ‘ ব্যাপারটা সে ধরতে পারলো না। নক্ষত্র তাকে ছেড়ে দিয়ে আলতো হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকায়। ইরিনের শান্ত স্তব্ধ দৃষ্টির অর্থ বুঝে বুক পকেট থেকে প্রেগন্যান্সি রিপোর্টটা বের করে। বাড়িয়ে দেয় ইরিনের দিকে। ইরিন সেটা দেখে। হাত বাড়িয়ে নেওয়ার সাহস হয় না তার।

‘এটা দেখো….তোমার প্রেগন্যান্সির পজেটিভ রিপোর্ট। এটাই তো চেয়েছিলেনা তুমি?নাও…তোমার উদ্দেশ্য সফলের সার্টিফিকেট । ‘ চাপা ক্ষোভ নিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বললো নক্ষত্র।

‘আপনি খুশি হননি?’ দ্বিধান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন করে ইরিন।

‘খুশি না হওয়ার কি আছে! অবশ্যই আমি খুশি। আল্লাহ আমাকে স্বামীর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার সফলতা দিয়েছেন, আমাকে বাবা হওয়ার রহমত দিয়েছেন…তুমি মা হচ্ছো…আলহামদুলিল্লাহ, আমি অনেক খুশি।’ একদম হাসি হাসি মুখে বললো নক্ষত্র।

কিন্তু, ইরিনের মন মানলনা নক্ষত্রের কথায়। সে আরও বেশি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। চোখে মুখে চিন্তার ভাজ ফেলে কিছু একটা ভাবনাতে থাকলো। তাকে এভাবে দেখে নক্ষত্র বললো,

‘এত চিন্তা করছো কি নিয়ে? তুমি তো এটাই চেয়েছিলে। তাই তো সেদিন আমার দায়িত্বের প্রতি প্রশ্ন তুলেছিলে।নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই তো ছিল তোমার এমন নোংরা প্রচেষ্টা। এটার আংশিক তো সফল হলো। তো এখন সামনের প্ল্যান কি? আর কি করার আছে তোমার?’

‘মানে?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করে ইরিন।

‘মানে…এই যে বাচ্চাটাকে দিয়ে আমাকে বশ করার প্ল্যান করেছিলে! বাচ্চা তো এলো।তুমি প্রেগন্যান্ট। কিন্তু, অতি দুঃখের সাথে তোমাকে জানাতে হচ্ছে যে….তোমার উদ্দেশ্য পরের ধাপে খুব বাজেভাবে ফ্লপ হয়েছে। এই বাচ্চাটা কখনোই আমার স্ত্রী হিসেবে তোমাকে তোমার জায়গা ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আজ থেকে আমার জন্য তুমি শুধুমাত্র আমার বৈধ সন্তানের মা। এছাড়া আর কিছুই না। আমার প্রতি তোমার আর কোন ব্যক্তিগত অধিকার রইলো না। আর না আমার প্রতি কোন দায় থাকবে তোমার। তুমি শুধুই আমার সন্তানের মা হয়ে থাকবা আমার জীবনে। সেই হিসেবে তোমার যতটুকু যা প্রয়োজন সেই সবটার দায়িত্ব আমার। স্বামী হিসেবে আমাকে দাবি করার অধিকার তোমার আর রইলো না আজ থেকে। তাই জিজ্ঞেস করছি, এরপরের প্ল্যান কি? কি করবা আমাকে বশ করার জন্য?’

‘ এইসব আপনি কি বলতেছেন? কিসের উদ্দেশ্য… কিসের প্ল্যান করেছি আমি?’ আতংকিত গলায় অস্থির হয়ে বললো ইরিন।

‘ডোন্ট এ্যাক্ট ইনোসেন্ট। আমি সবটাই জানি,ইরিন। সেদিন সবটাই শুনেছিলাম আমি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। তোমরা খেয়াল করোনি আমাকে। কিন্তু, জানো…আমি সেদিনও বোকার মত আশা করেছিলাম যে এই ভুল করার কথা ভুলেও ভাববে না তুমি। কিন্তু, চিরচারিতভাবে তুমি আমার বোকামোটাই নিষ্ঠার সাথে আমাকে প্রমাণ করে দেখালে। আমিও কিন্তু তোমাকে ফেরাইনি আর। তুমি যা চেয়েছো সেটাই করেছি। কিন্তু, এই যাত্রা এখানেই শেষ। ‘

একদম সাবলিলভাবে ঝরঝরে গলায় কথাগুলো বললো নক্ষত্র। ইরিন বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল সম্পূর্ণ ব্যাপারটায়। কিছু বলার মত বোধশক্তিও খুইয়েছে যেন সে। একদম নির্বাক হয়ে হতবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো সে নক্ষত্রের দিকে।

নক্ষত্র এবারে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ইরিনকে বললো, ‘তোমার মাকে ফোন করে জানিয়ে দাও সুখবরটা। আমি আম্মুকে বলে মিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েছি অলরেডি। পৌঁছালো বলে। কারণটা তুমি নিজে জানিয়ে দিও। সাথে এও বলে দিও……সন্তান শুধুমাত্র বাবা মায়ের মধ্যে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে নয়। সব বাবা-মা স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকে না আজীবন। উনার ধারণা পুরোপুরি ভুল।’

কথা শেষ করে নক্ষত্র জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ইরিন নিজের পেটে হাত রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। তার ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে নক্ষত্র। যে সন্তানকে ঘিরে নতুন করে সম্পর্ক পুনর্স্থাপন করতে চেয়েছি সেই সন্তানই সম্পর্কটা নষ্টের কারণ হয়ে গেল। এই ভুলের শেষ পরিণতি কি? নক্ষত্র কি তবে আর কখনোই ক্ষমা করবে না তাকে? এসব চিন্তায় ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায় ইরিনের। অবাধ্য নোনাজলে ভেসে বেড়ায় অসহনীয় যন্ত্রণারা। এ কেমন জীবন তার…অজস্র ভুলে ভরা!

১৪৪.

‘আমি যদি আজকে মরে যাই….মাফ করে দিবেন তো আমাকে?’ কাতর গলায় ইরিনের এমন কথা শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে নক্ষত্রের। তবুও, নিজেকে ইরিনের সামনে শক্ত রাখতে কঠিন গলায় বললো,

‘তোমাকে হাফ এনেস্থিসিয়া দেওয়া হবে ইরিন। এতে মরার কোন চান্স নাই। এত আজেবাজে চিন্তা করবা না একদম। আমার বাচ্চার ক্ষতি হবে। ‘

ইরিন দূর্বল শরীরে অনেক কষ্টে হাসে। সামান্য হাসির শক্তিটুকুও নেই ওর। তবুও হাসে নক্ষত্রের কথায়। নক্ষত্র ভেতর ভেতর দূর্বল হয়। কিন্তু বাইরে বিরক্তির ভাব করে। ইরিনকে ধমকায়।

‘এভাবে হাসছো কেন? আমি কি হাসির কিছু বলেছি?’

‘নিজের জন্য হাসতেছি। জীবনে এমনই কঠিন পাপ করেছি যে মরণ দুয়ারে এসেও ক্ষমা নেই আমার। আপনার ভালোবাসা কি একেবারে গোড়া থেকেই মরে গেছে নওরিনের আব্বু?’

‘যে আসতেছে তার কথা ভাবো ইরিন। পুরোনো কথা মনে করো না। ‘ কঠিন গলায় বলে নক্ষত্র।

‘নক্ষত্র..’ ভীষণ দরদমাখা গলায় ডাকে ইরিন। ইরিনের এই ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য হয় না নক্ষত্রের। ইরিনের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে সাড়া দেয়।

‘হু? কিছু বলবা? খারাপ লাগছে বেশি? ‘

‘আমাকে শেষবার একটু ভালোবেসে ছুঁয়ে দিবেন প্লিজ? ক্ষমা না পেলাম, আপনার একটুখানি স্পর্শ নিয়ে যাই! ‘

নক্ষত্র ইরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আলতো করে একবার। ইরিন চোখ বন্ধ করে সে স্পর্শ অনুভব করে। দুচোখ বেয়ে আনন্দধারা ঝরে পড়ে। নক্ষত্র আর দাঁড়ায় না ইরিনের কাছে। ও.টি রেডি কিনা দেখবে বলে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। ইরিন আবারও কাঁদে। এই মানুষটাকে ভালোবাসতে পারার…তার সন্তানকে নিজ গর্ভে ধারণ করার সুখে কাঁদে। আবার কয়েকমুহূর্তের ব্যাবধানে তাকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টেও কাঁদে। মন বলে, জীবন এত জটিল কেন? যার সাধনায় সাধক হওয়া…এ তারে কেমন পাওয়া? কেনই বা এমন ছেড়ে যাওয়া? জীবন কেন একটু সহজ হয় না তার? সুখপাখি ডানা ঝাপটা অথচ আঙিনায় পা অবধি রাখে না।

হায়…জীবন! জন্মের পর জন্ম ঘটে তবুও বেঁচে থাকা হয়ে উঠে না। প্রতি ধাপে নতুন করে জন্মাতে জন্মাতেই জীবন দুয়ারে মৃত্যু এসে কড়া নাড়ে। এত জন্ম পার করেও বেঁচে থাকা হয় কি আদৌ?

১৪৫.

‘ইরিনকে ও.টিতে নেওয়া হয়েছে। সি-সেকশনের প্রস্তুতি চলছে তার। নক্ষত্র বাইরের চেয়ারে বসে আছে। সাথে আম্বিয়া খাতুন, শায়লা, কনক আর রিতুও এসেছে। তারাও অপেক্ষা করছে নতুন অতিথির সাথে প্রথম সাক্ষাতের।
নক্ষত্র বাইরে যতই শক্ত থাকুক, ভেতর ভেতর অস্থিরতায়, ভয়ে মরণ দশা তার। সে ভাবে বিগত কয়েকমাসের কথা। কিভাবে এতগুলো দিন পার করেছে ইরিন আর সে। কতটা কষ্ট করেছে ইরিন শুধুমাত্র তার ক্ষোভের শিকার হয়ে। নক্ষত্র অনুতপ্ত হলেও ইরিনের সামনে কোমল হয়নি একবারের জন্যও। নিজের কষ্ট হলেও কষ্ট দিয়ে গেছে সে ইরিনকে।

এ যে পুরুষের মন। বহু বছরের পুরোনো বটবৃক্ষের মতন।বুড়িয়ে যাবে তবু শক্ত শেকড়ের জোরে ঠাই দাঁড়িয়ে রবে বছরের পর বছর।

নক্ষত্রের মনে পড়ে, প্রথম সন্তানের সময় ইরিন রাগ করে বলেছিল…বাচ্চাটা তার রক্ত মাংস খেয়ে তাকে একেবারে শেষ করে তারপর পৃথিবীতে জন্ম নেবে। নওরিন তা করেনি। তার ভাগ্যই হয়নি শরীরে প্রাণ নিয়ে মাতৃগর্ভের অন্ধকার থেকে আলোকিত পৃথিবীতে আসার। মাতৃগর্ভের অন্ধকার থেকে দুচোখে অন্ধকার মেখে একেবারে পৃথবীর অতল অন্ধকারে ঠাঁই করে নিয়েছিল সে ।তবে, ইরিনের দ্বিতীয় সন্তান যেন বোনের অসম্পাদিত কাজটাই সম্পন্ন করে ছেড়েছে।

একটা স্বাভাবিক গর্ভাবস্থায় একজন গর্ভবতী নারী যতটা না কষ্ট করে ইরিনকে তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি কষ্ট করতে হয়েছে। নক্ষত্র তার সেবায় কোন ত্রুটি রাখেনি। কোন ভুল হওয়ার সুযোগ দেয়নি। কড়া নজরে রেখেছিল ইরিনকে। কিন্তু, তাও শারিরীকভাবে অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে ইরিনকে।

সন্তান গর্ভে এলে নাকি একটা আলাদা দ্যুতির আবির্ভাব ঘটে হবু মায়ের চেহারায়। ইরিনের ক্ষেত্রে হয়েছে তার বিপরীতটাই।পুরো গর্ভকালীন সময়টায় শরীর একদম ভেঙে চূড়ে গেছে ইরিনের। রক্ত সল্পতার কারণে বেশ কয়েকবার তাকে রক্ত দিতে হয়েছে। বাচ্চা অপুষ্টিতে যেন না ভুগে সেজন্য জোর করেই খাবার মুখে তুলেছে। কিন্তু, শরীরে ধরে রাখতে পারেনি কিছুই। ঘুম হতো না ঠিকমত। পায়ে পানি এসে পা ফুলে গেছে। হরমোনের পরিবর্তনে মানসিকভাবেও অনেক সমস্যার সম্মুখিন হয়েছে ইরিন। তারপরও সবই সে সহ্য করেছে নক্ষত্রের সন্তান জন্ম দিবে বলে।

নক্ষত্রের মাঝে মাঝে খারাপ লাগতো অনেক বেশি। সে এতটা নিয়ন্ত্রণহীন না হলেও পারতো। ইরিনের প্রতি ক্ষোভ তাকে দিশেহারা করে দিয়েছিল। ইরিনের উদ্দেশ্যকেই তার বিপরীতে ব্যবহার করতে চেয়েছিল নক্ষত্র। সে জানতো এখন নতুন করে মা হওয়ার জন্য ইরিনের শরীর মোটেও প্রস্তুত নয়। ইরিন নিজেও জানতো এটা। তবুও সে এই ঝুঁকিটাই নিয়েছে। নক্ষত্রের দোষ শুধু এটুকু সে ইরিনের এই ভুলকে নিজ থেকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ফলাফল ইরিন একটু একটু করে শেষ হয়ে গেছে অনেকাংশেই।

কি অদ্ভুত জীবন মানুষের। কেউ অবুঝ হয়ে ভুল করে।কেউ আবার ভুলকে প্রশ্রয় দেওয়ার ভুল করে। ভুলে ভুলে ভুক্তভোগী হয় কিছু নির্দোষ জীবন। অনুতাপও সেই ভুলের মাসুল দিতে ব্যার্থ হয়। নক্ষত্রের ভুলটাও ছিল ঠিক এ রকম। ইরিনের প্রতি জমা রাগ অভিমান তার দ্বিতীয় ভুলের কারণে নক্ষত্রের ক্ষোভে পরিণত হয়। সবটা জেনে বুঝে সে ইরিনের সন্তান ধারণের পরিকল্পনায় সহায়ক হয়ে উঠে।পরিণাম হয় ইরিনের অতিমাত্রায় খারাপ শারিরীর অবস্থা এবং অপুষ্ট সন্তান ধারণ।

দেখতে দেখতে ৩৫ সপ্তাহ কেটে যায়। ইরিনের এমন খারাপ অবস্থা দেখে ডক্টর সুব্রত কোন ঝুঁকি নিতে চাননি। ৩৫ সপ্তাহ পরেই পুনরায় সি- সেকশনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুযায়ী আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সন্তানের আগমন ঘটতে চলেছে পৃথিবীতে।

১৪৬.

‘পেশেন্ট ইরিনের হাজবেন্ড কে এখানে?’ একজন নার্সের বিরক্তিমিশেল বাঁজখাই গলার আওয়াজে ভাবনাচুত্য হয় নক্ষত্র। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে যায় নার্সের দিকে।

‘জ্বী..বলুন। কোন সমস্যা?’

‘আপনি পেশেন্ট ইরিনের হাজবেন্ড?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনি রেডি হয়ে ভেতরে চলুন। স্যার যেতে বলেছেন।’

নার্সের এমন কথায় বেশ ভয় পেয়ে যায় নক্ষত্র। আতংকিত গলায় প্রশ্ন করে, ‘ক্যা..ক…কেন? কি হয়েছে? ইরিনের কোন সমস্যা?’

‘আরেএএ আপনার ওয়াইফই তো একটা সমস্যা। বিগত আধা ঘন্টা ধরে এনেস্থিসিয়ার লোককে সে বসিয়ে রেখেছে। বারবার বলছে, আপনাকে ডেকে দিতে। আপনি না গেলে সে এনেস্থিসিয়া নিবে না। সিজারও করবে না। আপনিই বলেন এইটা কোন কথা? আমাদের কি আর পেশেন্ট নাই? সারাদিন তারে নিয়ে ও.টিতে বসে থাকবো? চলেন এখন তাড়াতাড়ি। আরও তো ও.টি আছে স্যারের।’

নার্সের কথায় নক্ষত্র ঠিক কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারলো না। ইরিনের উপর রাগ লাগছে, মেয়েটা এক নাম্বারের ঘাঁড়ত্যাড়া, জেদি মানুষ। আবার হাসিও পাচ্ছে তার ইরিনের এমন পাগলামোতে। মেয়েটা তাকে ভালোবেসেই মরেছে একেবারে। তবুও এ ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে যায় নক্ষত্র। পুরোনো ক্ষত এ ভালোবাসায় কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত জ্বালা ধরায়। নক্ষত্র এ জ্বালা থেকে পরিত্রাণের জন্য উপেক্ষার আশ্রয় নেয়।

১৪৭.

‘তুমি একটা যাচ্ছেতাই ইরিন। এতগুলা মানুষকে হয়রানি করার কি মানে, হ্যাঁ?’ চাপা স্বরে ইরিনকে ধমকে বললো নক্ষত্র।

ইরিন এ ধমক গায়ে মাখলো না। নিরবে হাসলো নক্ষত্রের কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে। নিস্তেজ গলায় বললো,’ যদি মরে যাই এখানেই…..আপনাকে কাছ থেকে না দেখে যেতে পাওয়ার আফসোস রয়ে যাবে।নিজের ভুলের জন্য অনেক আফসোস জমে গেছে আমার।কিন্তু, এই আফসোসটুকু নিয়ে মরতে চাই না আমি। আপনি কি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবেন প্লিজ?’

নক্ষত্র আর কোন কথা পায় না ইরিনের এমন আকুতি মিনতির পরে।তার নিজের ভেতরটাই অবশ অবশ লাগতে শুরু করেছে। ইরিনকে এনেস্থিসিয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়। নক্ষত্র শক্ত করে তার হাতটা ধরে রাখে। ইরিন নিরবে সুখজল বিসর্জন দেয়।

প্রায় ১০ মিনিট পর নবজাতকের কান্না আওয়াজে নক্ষত্র পাশ ফিরে তাকায়। ডক্টর সুব্রতর হাতে লম্বা নাড়ি সমেত রক্তে মাখামাখি হওয়া একটা ছোট্ট শরীর।নক্ষত্র অবাক নয়নে তাকিয়ে প্রথম দেখলো তার সদ্যজাত সন্তানকে। ডক্টর সুব্রত নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কংগ্রাচুলেশনস আদৃত। ইটস আ বেবি গার্ল।তোমার মা এসেছে। মিষ্টি কিন্তু ডাবল চাই আমার।’

নক্ষত্র কিছু বলার মত ভাষা হারিয়ে ফেললো। একদিকে তার নবজাতক কন্যা গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদছে। অন্যদিকে ইরিনও কান্নায় ভেঙে পড়েছে। নক্ষত্রের হাতের মুঠোয় থাকা ইরিনের হাতের কম্পনে নক্ষত্র নির্বাক দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো ইরিনের দিকে। তার চোখদুটোও সুখজলে ছলছল করছে। সমস্ত শরীর পুরো অসাড় হয়ে আসছে এক অভাবনীয় সুখের আবেশে। মনে মনে কয়েকদফায় ‘আলহামদুলিল্লাহ ‘ পড়ে ফেললো সে। এমন সুখে রবের শুকরিয়া আদায় না করলে কি আর চলে!!

প্রথমবার বাবা হয়েছে সে। তার পরী ছোট্ট আরেকটা পরীর জন্ম দিয়েছে। পরিপূর্ণ করেছে তার জীবন। তার মনের বাসনা পূরণ করে আল্লাহ তার ঘরে বরকতসরূপ প্রথম সন্তান মেয়ে দিয়েছেন। তার মায়ের জায়গাটা ভরাট করার জন্য তার মেয়ে এসেছে।এত সুখ সে কিভাবে সামলাবে!

হাতে টান পড়তেই হুঁশ হয় নক্ষত্রের। ইরিন তার ধরে রাখা হাতটা ছাড়াতে চাইছে। নক্ষত্র ইরিনকে খেয়াল করতেই দেখলো সে একহাতে তাদের মেয়েকে বুকে আগলে রেখেছে। বাচ্চাটাও এখন আর কাঁদছে না। মায়ের বুকের উষ্ণতা পেয়ে শান্ত হয়ে লেপ্টে আছে মায়ের বুকের মাঝে।সম্ভবত মায়ের প্রথম স্পর্শ অনুভব করছে। ক্যানোলা লাগানো থাকায় ইরিন একহাতে ঠিকমত ধরতে পারছে না বাবুকে।অন্যহাতটাও এই জন্যই ছাড়াতে চাইছে সে।

নক্ষত্র হাত ছেড়ে দিতেই ইরিন তার হাত ধরে নিল আবার। হাতটা টেনে এনে মেয়ের মাথায় স্পর্শ করালো। নক্ষত্রের সমস্ত শরীর জুড়ে হিম শীতল এক শিহরণ বয়ে গেল। সন্তানকে প্রথম স্পর্শ করার স্বাদ বুঝি এতটাই সুখের..এতটাই মধুর?! এ যেন সত্যিকার অর্থেই স্বর্গীয় সুখ।একদম অতুলনীয়।

‘বাচ্চার ওজন কম আদৃত। অপুষ্ট অনেকটাই। তাকে কয়েকদিন এনআইসিইউতে রাখতে চাইছি। তারপর কিছুটা স্টেবেল হলে তোমাদের কাছে দিয়ে দেওয়া হবে। ‘ ইরিনের সেলাইয়ের কাজ করতে করতে বললেন ডক্টর সুব্রত।

‘আপনার যেটা ভালো মনে হয় করুন ডক্টর। আমার মেয়েটা সুস্থ থাকলেই হলো।’

‘মেয়ের নাম কি রাখবে বলে ভেবেছো?’

‘এখনো ভাবিনি কিছুই। ছেলে হবে নাকি মেয়ে এটা তো জানতাম না। তাই ভাবা হয়নি কিছু। ‘ কিছুটা লাজুক স্বরে জবাব দেয় নক্ষত্র। নওরিনের বেলায় তো না জেনেই নাম ঠিক করে ফেলেছিল। তার বিশ্বাস ছিল মেয়েই হবে। হয়েছিলোও তাই। কিন্তু, নামটা ধরে তাকে ডাকার ভাগ্যটা আর হয়নি কারও। তাই এবার আগেভাগেই কিছু ঠিক করেনি নক্ষত্র। যা হওয়ার হোক, একটা সুস্থ বাচ্চা হলেই হলো তার।

‘আদৃতা রাওনাফ – বাবুর নাম। ‘ ইরিন বললো আচমকাই।

আদৃত চমকালো মেয়ের নাম শুনে। তার নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে ইরিন।

ডক্টর সুব্রত হাসতে হাসতে বললেন, ‘বাহ! আদৃতর মেয়ে আদৃতা। চমৎকার নাম। ‘

‘মাশাল্লাহ।’নক্ষত্র আউড়ালো মনে মনে। ইরিনের প্রতি তার যতই রাগ অভিমান থাকুক….এই সন্তানের জন্য সে ইরিনের কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ।

চলবে…
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here