#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_৯
#লেখায়_জারিন
৩৯.
‘তো আজ কোন অধ্যায় থেকে গল্প শুনতে চলেছি আমি?’
– মুখ ভর্তি বার্গার চিবাতে চিবাতে জিজ্ঞেস করলো রাফিদ। তার পাশেই কিছুটা দূরে নদীর পারে সবুজ ঘাসের উপর বসে আছে ইরিন। আজ ছুটির দিন। মাঝে কিছুদিন কাজের ব্যস্ততায় রাফিদ একদমই সময় পায়নি ইরিনের সাথে দেখা করার। তাই আজ একপ্রকার জোর করেই ইরিনকে রাজি করিয়েছে তার সাথে দেখা করার জন্য। ইরিন কথা দিয়েছিল পুরোটা বলবে। তাই সেও একরকম বাধ্য হয়েই নিজের জন্য বরাদ্দ সময়টুকু আজ রাফিদকে দিচ্ছে।
শান্ত একটা বিকেল। তবুও, চারপাশে…নদীর ঘাটে নৌকায় ঘুরতে আসা মানুষের সমাগম। সেখানেই একদিকে জায়গা খুঁজে বসেছে তারা। মানুষের চলাচল থাকলেও শব্দের কোলাহল নেই খুব একটা এদিকে।
পাশ ফিরে রাফিদকে দেখে কপাল কুচকে ফেললো ইরিন। রাফিদের হাতে বার্গারের বক্স। তাতে দুটো বার্গার। একটা ইতোমধ্যে রাফিদ খেতে শুরু করেছে। আরেকটা সে ইরিনের জন্য এনেছিল। ইরিন খাবে না বলায় নিজের জন্য বরাদ্দ করে নিয়েছে। বেশ মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে রাফিদ।
রাফিদের থেকে চোখ সরিয়ে দুজনের মাঝখানের জায়গাটা দেখলো ইরিন। ওটার পুরো জায়গাটা চিপসের প্যাকেট, কোল্ড ড্রিংস, পেস্ট্রি, আরও কয়েকপদের ফাস্টফুড দিয়ে ভর্তি। পরিচয়ের শুরু থেকেই দেখে আসছে রাফিদ খেতে ভালোবাসে। কিন্তু, শরীর স্বাস্থ্যের গড়নে একদম ফিট। জিম-টিম করে বোধয়…এমনটা ইরিন ভেবে নিয়েছে। তারপরেও একটা মানুষ সারাক্ষণ এত কি করে খেতে পারে ভেবে পায় না ইরিন। আজ মুখ ফুটে প্রশ্ন করেই ফেললো,
‘আপনি এখানে গল্প শুনতে এসেছেন নাকি খেতে এসেছেন?’
‘গল্প শুনতে। কিন্তু, খেতে খেতে গল্প শুনতে ভালো লাগে বেশি। ‘ বার্গারে আয়েশ করে আরেকটা কামড় দিয়ে বললো রাফিদ।
রাফিদের উত্তরে হতাশ হয়ে একটা শ্বাস ফেললো ইরিন। সামনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আজকের অধ্যায়টা একটু দীর্ঘ। সময় হবে আপনার পুরোটা শোনার?’
‘আমার আজ আর কোন কাজ নেই। আজ সারা রাত এখানে বসিয়ে রাখলেও আমি রাজি। সাথে খাবার দাবার থাকলে তো কোন কথাই নেই। তবে, ভোর হতেই ছাড়তে হবে। বাসায় ফিরে শাওয়ার নিয়ে অফিসে যেতে হবে। ‘
‘আপনি না বড্ড বেশি কথা বলেন। ‘ বিরক্ত হয়ে বললো ইরিন।
‘কি করবো ম্যাডাম, প্রোফেশনটাই এমন। চাপা চালিয়েই পেট চালাতে হয়। তাই এটাই স্বভাব হয়ে গেছে এখন।’ বেশ রসিকয়তার স্বরে বললো রাফিদ।
ইরিন আর কিছু বললো না এ নিয়ে। চুপ করে বসে রইলো। তাকে চুপ থাকতে দেখে রাফিদ তাড়া দিয়ে বললো, ‘বললেন না তো আজ কোন অধ্যায় উন্মোচন করছেন আপনি?’
ইরিনও এবার নিরবতা ভাঙলো। ছোট একটা চাপা শ্বাস ফেলে বললো, ‘আজকে একজন স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠার গল্প শোনাবো আপনাকে।’
ইরিনের কথায় খাওয়া থামিয়ে দিল রাফিদ। এই ব্যাপারটা কিছুটা রাফিদ জানে। এই থেকেই ইরিনের জীবনের সর্বনাশের শুরু হয়েছিল। আপন মনেই কিছুটা বিষন্ন হয়ে উঠলো রাফিদের মন। নিস্তেজ গলায় বললো, ‘বলুন।’
কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করলো ইরিন। তারপর বলতে শুরু করলো।
৪০.
‘আমাদের বিয়ের পরে সিলেট ট্যুরে যান উনি। একটা বড় ডিল ফাইনাল করে আসেন। এরপর থেকেই উনার ব্যস্ততা হয়ে উঠে পাহাড়সম। রাত দিন কাজে ডুবে থাকতো মানুষটা। আমি কখনো জানতে চাইনি উনার কিসের এত কাজ। উনি কি নিয়ে এত ব্যস্ত। কারণ, আমার উনাকে নিয়ে কোন প্রকার কোন আগ্রহ ছিল না। দায়িত্বের খাতিরে যতটা দরকার ছিল উনার প্রয়োজনগুলোর খেয়াল রাখতাম কেবল। উনি খুব একটা সময় বাড়িতে থাকতেন না। অফিস…মিটিং নিয়েই দিন কাটতো। উনার রাতগুলো কাটতো ল্যাপটপে মুখ গুঁজে নয় তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে।
কিন্তু, এসবের মাঝেও উনি চেষ্টা করতেন আমাকে সময় দেওয়ার। উনার হাজার ব্যস্ততাতেও আমার প্রতিটা বিষয়ে উনার নজর থাকতো। কখন কি লাগবে না লাগবে, রিতুর কি লাগবে না লাগবে…কোন স্কুলে, কার কাছে পড়াশোনা করবে সব কিছুর খেয়াল রাখতেন উনি। আমাদের কথা ছাড়ুন…উনার পরিবারের সবার খেয়াল রাখতেন উনি। উনাকে পছন্দ না করা সত্ত্বেও আমি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলাম উনি সত্যিকার অর্থে একজন দায়িত্ববান পুরুষ।
তবে, উনার এই ব্যস্ততা ছিল আমার স্বস্তির কারণ। আর উনাকে এড়িয়ে চলার বাহানা হিসেবে আমি রিতুকে ব্যবহার করতাম। রিতু কথা এটা ওটা কিছু একটা বলে আমাদের ব্যক্তিগত মূহুর্তগুলোও সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে সক্ষম ছিলাম আমি।উনি এই নিয়ে কোন অভিযোগ করতেন না। মলিন হেসে আমায় যেতে দিতেন। ‘
‘আচ্ছা, শুধুমাত্র গায়ের রঙ কালো বলেই আপনি একটা মানুষকে অপছন্দ করেছেন, এটা কোন ধরণের লজিক? আরেএএ…ভাই! বাংলাদেশের মানুষ আমরা। ভৌগলিক কারণে এদেশে নারী পুরুষ উভয়ই ফর্সা, শ্যামলা, কালো চামড়ার হয়। এই দেখেই… এদের সাথে মিলে মিশেই আমরা বেড়ে উঠি সমাজে। এই নিয়ে মানুষ বিশেষে মানসিকতার দিক থেকে হলেও আমাদের দেশে অন্তত সামাজিকভাবে কোন বৈষম্য আমি দেখিনা। তাহলে আপনার সমস্যাটা কি ছিল বলুন তো? আগে এটাই শুনবো আজকে। পরে বাকি কথা!’
– চাপা রাগে বেশ উত্তেজিত স্বরে বললো রাফিদ। এদেশের বেশিরভাগ নারী পুরুষ যেখানে শ্যামলা বা কালো চামড়ার সেখানে এমন মনোভাব সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। পুরুষ না হয় মেয়েদের সৌন্দর্য হিসেবে সাদা চামড়া খুঁজে। নারীর ক্ষেত্রে পুরুষের চাহিদায় রূপ সৌন্দর্য্যেই মুখ্য বিষয় হলেও , মেয়েরাও কি পুরুষদের মতই রূপ সৌন্দর্য্যকেই প্রধান মনে করে? মেয়েরা তো রূপবান পুরুষের চাইতে দায়িত্ববান পুরুষ বেশি পছন্দ করে। তাহলে ইরিন কেন এমন? এসব প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরেই মনে পুষে রেখেছিল রাফিদ। আজ নিজের জিজ্ঞাসু মনকে দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছে ইরিনকে।
৪১.
নিজের কথার মাঝে আচমকা রাফিদের এমন আক্রমণাত্মক প্রশ্নে অবাক চোখে তাকালো তার দিকে ইরিন। রাফিদের চোখ-মুখে চাপা রাগ…প্রবল উত্তেজনার ছাপ। কয়েকসেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো ইরিন। তা দেখে রাফিদের এবার গায়ে জ্বালা ধরে গেল। ইরিন শুধু রহস্য করে চলে। সব খুলে বলেও খোলাসা না করতে পারা এক ধাঁধাঁর সৃষ্টি করে যায় যেন। ইরিনের এ ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ বিরক্ত রাফিদ। কিন্তু, আজ আর রহস্য করলো না ইরিন। একদম সহজ গলায় বললো,
‘ জন্ম থেকে জীবনের বেশ কয়েকটা বছর আমি গ্রামে থেকেছি। গ্রাম্য কালচারে বেড়ে উঠেছি। আমাদের গ্রামে তখন বাল্য বিবাহ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। আমার বড় আপারই তো বিয়ে হয় মাত্র ১৪ বছর বয়সে। আব্বা আম্মা না চাইলেও দাদীর জোরাজুরিতে ওইটুকুন বয়সেই বিয়ে হয় যায় আমার বড় আপার। আমার বড় দুলাভাই আপার থেকে ১৭ বছরের বড় ছিল। পেশায় সে ছিল শহরের থানায় পুলিশের কন্সটেবল।
বয়সের দিক থেকে আপার সাথে তুলনা করলে উনি ছিলেন বুড়োভীম। কালো, বেঁটে, ভুঁড়িওয়ালা। এককথায় কুৎসিত। পান খাওয়া লাল লাল দাঁত বের করে যখন হাসতেন কি যে বিদঘুটে দেখা যেত…বলার মত না। আমি তো ভয়ে কাছেই যেতাম না। পর্দার আড়াল থেকে দেখেই দৌঁড় দিতাম।
আমার এমন ভয় পাওয়া দেখে আমাদের পাশের বাড়ির বেলী আপা হাসতে হাসতে বলেছিল, দেখ ইরিন তোর দুলাভাই কেমন কালো। কি বিচ্ছিরি দেখতে। তোর আপা না এত হয় ফর্সা না।তাই এমন বর জুটেছে। দেখিস তোর বরও না এমন কালো দেখতে হয়। সেদিন আমিও অবুঝ মনে বলে বসেছিলাম, আমার বর মোটেও এমন হবে না। খুব সুন্দর দেখতে হবে। সেদিন কথাটা অবুঝ মনে বললেও পরিবেশ পরিস্থিতির ধারায় আস্তে আস্তে সেটা আমার অবচেতন মনেই জেঁকে বসে।
এটুকু বলে আলতো হাসলো ইরিন। মূহুর্তেই আবার মেদুর ছায়া পড়লো তাতে। বিষন্ন কন্ঠে বললো,
বিয়ের আগে আপা অনেক কান্না কাটি করেছিল এই লোককে বিয়ে করবে না বলে। আমি দেখেছিলাম। আমার বয়স তখন ৭ বছর মাত্র। বিয়ে নিয়ে অতশত বুঝতাম না। গ্রামের বিয়ে মানেই একটা বড় সড় উৎসবমুখর ব্যাপার। ছোট্ট অবুঝ আমি তাতেই মত্ত ছিলাম। আপার কান্না আমার বোধগম্য হয়নি সেদিন।তবুও বিয়েটা হয়ে যায়।
আমার আপা শ্যামলা হলেও দেখতে ভীষণ মিষ্টি ছিল। একদম মায়াবতীর মত। আমাকে ভীষণ আদর করতো। সবার ছোট ছিলাম বলেই হয় তো! যে উঠান থেকে বিকেল বেলা আপা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়েছিল ঠিক দু’রাত পরে এক চড়া রোদের সকালে সেই উঠানেই নিথর দেহে ফিরে আসে আমার আপা। ‘ এটুকু বলতে বলতেই কন্ঠ ভিজে উঠে ইরিনের।
রাফিদ হতভম্ব। ইরিনের দিকে তাকিয়ে তার টলমলে চোখ দেখে কিছু বলার মত ভাষা হারিয়ে ফেললো সে। অস্ফুটভাবে কেবল উচ্চারণ করলো, ‘মানে?’
সেদিন বুঝিনি আপার ছেড়ে যাওয়ার কারণ। পরে মেজ আপার থেকে শুনেছিলাম। কচি লতার মত আমার আপার শরীরটা স্বামী নামক পুরুষটির পৌরষত্বের ভারটুকু সামলাতে ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের পরেও তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। জানাজানি হয়ে গেলে বদনাম হয়ে যেত যে! বরং মেয়ে এত নাজুক কেন এই দোষ চাপিয়ে তাকে বাপের বাড়ি ফেরত নেওয়ার জন্য আব্বাকে খবর দেওয়া হয়। খবর পেয়ে আব্বা যেতে যেতেই আমার আপা দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। আব্বা আপাকে নিয়ে ফেরত তো আসে কিন্তু আমার আপা আর ফেরেনি কখনো। – কথাটুকু শেষ হতেই ইরিনের টলমলে চোখ ভরে এলো পুরোপুরি। মরা নদীতে অলস বৃষ্টির ধারার মতই টুপটুপ করে ঝরতে থাকলো তারা।
রাফিদের কিছু বলার সাহস হলো না। তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পথে এত নিষ্ঠুর এক সত্যের মুখোমুখি হতে হবে বুঝতে পারলে কখনোই এমন প্রশ্ন করতো না সে। অবশ্য যে কোন রহস্যের পেছনেই কিছু না কিছু নিষ্ঠুর, বেদনাদায়ক সত্য থাকে। আমরা কেবল যা ভুল সেটাই দেখি। সেটা নিয়েই বিচার করি। যুক্তি তর্ক সাজাই। কিন্তু, যা ভুল তা কেন ভুল হলো সেই খোঁজ কেউ করিনা। তাই হয় তো অনেক সহজ সুন্দর বিষয়ও শুধুমাত্র ভুলের বিচার করতে গিয়ে জটিল করে ফেলি আমরা। অথচ, ভুলের কারণ খুঁজে যদি তা বুঝে শুধরানোর চেষ্টা করা যেত তবে হয় তো অনেক সমস্যা অনেক জটিলতা খুব সহজেই মিটিয়ে নেওয়া যেত। – আপন মনে এসব ভাবতে ভাবতেই তার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ইরিনের সিক্ত কন্ঠ শুনতে পেলো সে।
‘ আপার মৃত্যুর পর আব্বা দাদীর সাথে খুব রাগারাগী করে। দাদী ভীষণ জেদি ছিলেন। সেকেলে ধ্যান ধারণা ছিল তার রন্ধ্রগত। তিনিও আপার দোষ ধরলেন। সেই সাথে আম্মারও। আপাকে কেন আগে থেকে সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠায়নি এই ছিল আম্মার দোষ। এসব নাকি মায়েদের দায়িত্ব। আপনিই বলুন, কোন মা কি পারে নির্লজ্জের মত নিজের মেয়ে এসব শিখাতে যে বাসর রাতের তথাকথিত অর্থ এ সমাজের ভাষায় ঠিক কি?! পারে না তো! আমার মাও পারেনি তার সহজ সরল, অপরিপক্ব মনের মেয়েটাকে এসব বলতে।
বাবা দাদীর সাথে রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার মত বিবেকহীন আমার আব্বা ছিলো না বিধায় মাকে ছাড়তে পারেনি। আম্মার দায়িত্বে রেখে তিনি কাজে ফিরে যান। কয়েকমাস এভাবে গড়ালো। এরমাঝেই দাদী মেজ আপার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। মেজ আপার বয়স তঝন ১২ বছর। আম্মা সেবার আর চুপ থাকতে পারেনি। প্রতিবাদ করে। আব্বাও আম্মার সাথে সহমত থাকায় লড়াইটা আম্মা জিতে যায়। আব্বা বাড়ির বড় ছেলে ছিল। দাদীকে ছোট চাচার দায়িত্বে রেখেই এবার আমাদের সবাইকে নিয়ে শহরে পাড়ি জমালেন। তখন থেকেই আমার শহরের মধ্যবিত্ত সমাজের ধ্যান ধারণায় বড় হওয়া। না…আমি বলছিনা শহরের মানুষের ধ্যান ধারণা আমার মতই। তবুও,পরোক্ষভাবে অনেকটাই এমন।
এস.এস.সির পর আমার এক কাছের বান্ধুবী দিপার বিয়ে হয়ে যায়। দীপা বেশ সুন্দরী ছিল। যার সাথে বিয়ে হয় সেও খুব সুন্দর ছিল। বন্ধুমহলে কেউ কেউ বললো, দিপা সুন্দরী বলেই এত সুন্দর ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে।নয় তো জুটতো কোন কালো শ্যামলা, ভুড়িওয়ালা বয়স্ক লোকে।তার সাথেই বিয়ে হতো। তখনই আমার মস্তিষ্কে বড় আপার বিয়ের ব্যাপারটা আরও তীব্রভাবে নাড়া দেয়। মনে ধারণা জন্মে মেয়েদের সৌন্দর্যটাই তাদের প্রধান গুণ। হাতিয়ারও বলা চলে। তাই সৃষ্টিকর্তা যা দিয়েছেন সেটার উপর নিজের পরিচর্যা চালিয়ে সুন্দরের তালিকায় নিজের জায়গা করার চেষ্টা ছিল আমার। নিজে যখন দেখতে সুন্দর নিজের জন্য একটা সুন্দর দেখতে মানুষ আশা করা কি খুব বেশি অন্যায়? নাকি কেবল পুরুষেরই চাহিদা থাকবে, অধিকার থাকবে নিজের জন্য সুন্দর রূপের মানুষটিকে লাইফপার্টানার করার?
একজন মেয়ে কি নিজের হাজবেন্ড হিসেবে সুদর্শন কাউকে চাইতে পারে না? একজন পুরুষ কালো হলেও তার বউ সুন্দরী হওয়া চাই। সুন্দরী বউ পেলে লোকে তার ভাগ্যের তারিফ করে। কিন্তু, একটা কালো মেয়ের সুন্দর কারো সাথে বিয়ে হলেও তাকে বিদ্রুপের মুখে পড়তে হয়। তার ভাগ্যকে যোগ্যতা না থাকার পরেও পাওয়া সৌভাগ্যের কাতারে ফেলা হয়। তাহলে এক্ষেত্রে আমার চিন্তা ধারা…চাওয়াটা কি অন্যায় ছিল?
‘না। ‘একপ্রকার ঘোরের মধ্যেই বললো রাফিদ। ইরিনের কথাগুলো ওকে বিশাল এক ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।
‘ছিল। ‘ ইরিন জবাব দিল।
‘হু?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো রাফিদ।
‘অনেকটাই অন্যায় ছিল আমার চাওয়াটা। আমি কেবল সুন্দর দেখতে একটা পুরুষ মানুষ চেয়েছিলাম। অথচ আমার চাওয়া হওয়া উচিৎ ছিল একটা সুন্দর মানুষ। ঠিক আমার নক্ষত্রের মত। যে নিজের মনের সৌন্দর্য দিয়ে সব অন্যায় বিভেদ এক করে দিতে সক্ষম। যে নিজের ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে ভালো রাখতে জানে। ‘
‘আপনার চাওয়াটা অন্যায় ছিল না, মিসেস. ইরিন। মানুষ হিসেবে আপনার নিজের জন্য মন মত কাউকে চাওয়ার শতভাগ অধিকার আছে। আমি এতদিন ভাবতাম মি. নক্ষত্র কালো দেখতে বলেই আপনি তাকে অপছন্দ করেছিলেন। কিন্তু, আজ বুঝতে পারছি, কারণ আসলে সেটা ছিলই না।
কারণটা ছিল আপনার এতদিনের মন বাসনা ছাপিয়ে বিপরীত কাউকে পেয়ে সেটা মেনে নিতে না পারা। এটাই স্বাভাবিক। আমরা যা আশা করি, আর বিপরীতে তার ভিন্ন কিছু পেলে মেনে নিতে কষ্ট হয়। আপনি ভুল ছিলেন না। তবুও, জীবনে কিছু শিক্ষা থাকে যা আমাদেরকে দেওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ফেলেন। ভুল না থাকলেও যেটা বেশি সঠিক সেটা শেখানোর জন্যই তিনি এমন করেন। যা আমাদের পাওনা বা যা আমাদের রিজিকে নেই বা আছে তা আমাদের প্রত্যাশার সাথে না মিললেও আল্লাহ তাই দেন আমাদের। হয় তো এতে কেউ খুশি হয় কারও বা আপনার মত মানতে কষ্ট হয়। কিন্তু, সময়ের সাথে আমরা ঠিক বুঝতে পারি তিনি কেন আমাদের এমন ফল দিয়েছেন যা আমারা আশাই করিনি।’
‘ঠিক। তবে আমি বুঝতে অনেকটা দেরি করে ফেলেছিলাম।আমার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রকে আমার অন্ধ ধারণায় পড়ে নিষ্প্রভ বলে ভুল করেছি। ভুল পথে গিয়ে তার আলোকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজের পাপের অন্ধকারে ডুবে নিজেকে তার আলো থেকে বঞ্চিত করার মত কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজটাও করেছি আমি। ‘ প্রচন্ড ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যভরা স্বরে বললো ইরিন। যার সবটাই ছিল তার নিজের প্রতি।
‘তবে সেই গল্পটাই না হয় শুনি এবার? নাকি অন্য কোনদিন?’ আলতো হেসে বললো রাফিদ।
আলতো হাসলো ইরিনও। চোখ মুছে নিল। তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল রাফিদ। ইরিন হাত বাড়িয়ে নিল বোতলটা।ছিপি খুলে কয়েক ঢুক পানি খেয়ে নিল এক নিশ্বাসে। তারপর মুখ মুছে বললো, ‘নাহ…..আজ সবটা বলেই যাই। এক কবর বারবার খুঁড়তে ভাল্লাগে না আমার। আজ খুঁড়ে আজই মাটি চাপা দিবো আবার এই বিদঘুটে অধ্যায়টাকে। ‘
নিরব হাসলো রাফিদ। মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল ইরিনের কথায়। সেও মনে প্রাণে চাইছে আজ পুরোটা শুনে তবেই বাড়ি ফিরবে। হাতে সময় বেশি নেই। যত দ্রুত সবটা জানবে ততোই দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সে।
৪২.
‘সেদিন কনকের ১৬ তম জন্মদিন ছিল। কাছের আত্মীয়স্বজন ও কনকের বন্ধুবান্ধদের দাওয়াত করে ঘরোয়া ভাবেই ছোট্ট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানেই আমার পরিচয় হয় ওয়াসিফের সাথে। ওয়াসিফ ছিল নক্ষত্রের একমাত্র ফুপুর বড় ছেলে। ফুপুর তিন ছেলের মাঝে সবার বড়। বিয়ের সময় তিনি লন্ডনে ছিলেন। তাই দেখা হয়নি। সেবারই প্রথম দেখা।
ওয়াসিফ ছিল এককথায় যে কোন নারীর চোখের মুগ্ধতা হওয়ার মতই সুদর্শন। লম্বা চওড়া, সু স্বাস্থ্যের অধিকারী। নক্ষত্রের ৫ বছরের ছোট সে। আর আমার ৩ বছরের বড়। আমি প্রথমবার দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। মিথ্যা বলছিনা, আমি যে কারও বিবাহিতা স্ত্রী এই বোধয়টুকুও খুইয়েছিলাম তাকে দেখার পর।
ওয়াসিফের সাথে আমার পরিচয় ওর ভাবী হিসেবে হলেও সে আমাকে বয়সে নিজের ছোট বলেই ট্রিট করতো। নাম ধরে ডাকতো। তুমি করেই বলতো। নক্ষত্র সেদিন বাড়ি ছিলেন না। গাজীপুরে একটা সাইট ভিজিট করতে গিয়েছিলেন।
ওয়াসিফ আমার প্রতি বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছিল।আমার রূপ সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করছিল। একসময় গিয়ে আমার সবচেয়ে দূর্বল জায়গা, নক্ষত্রকে আমার সাথে মানায় না বলে তুলনা করে বসলো। আমার মন খারাপ হলেও আমি সেদিন কিছু বলিনি।
সেদিন অনুষ্ঠানে এনাউন্স করা হয়, অদ্রিজার সাথে ওয়াসিফের বিয়ের কথা। আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম অদ্রির জন্য। ওয়াসিফের মত সুদর্শন একজনকে হাজবেন্ড হিসেবে পাচ্ছিল তাই। আমার অবচেতন মনে তখনই হয় তো অদ্রির সাথে নিজেকে তুলনা করে বসে।যার কারণে কিঞ্চিৎ হলেও খারাপ লাগা তৈরী হয় যেটা তখন না বুঝলেও পরে টের পেয়েছিলাম।
এরপর থেকে ওয়াসিফ প্রায়ই বাড়িতে আসতো। অদ্রিজার সাথে দেখা করার বাহানায়। আমার হাতের রান্না খেয়েও প্রশংসা করতো। ও…হ্যাঁ, একটা মজার কথা বলি। আমি মধ্যবিত্তের সংসার চেয়েছিলাম বলে উনি আমার জন্য ব্যক্তিগতভাবে একজন মধ্যবিত্ত স্বামী হয়ে গেছিলেন। তার সব কাজ আমার গুছিয়ে দিতে হতো। তার জন্য একবেলা হলেও আমাকেই রান্না করতে হতো। আমার রান্না না খেলে নাকি উনার খাওয়াই হতো না ঠিকমত। এক কথায় একজন মধ্যবিত্ত ঘরের স্ত্রী যেমন স্বামীর যত্ন করে ঠিক তেমনি আমাকে তার জন্য করতে হতো। আমিও দায়িত্বের কাতারে ফেলে করে দিতাম। তার বাড়ি থাকছি, তার টাকায় চলছি এটুকু তো করাই যায়!
যাই হোক, বাকি কথা বলি। আমি ধীরে ধীরে ওয়াসিফের প্রতি আকৃষ্ট হই। তার কথা বলার ধরণ, হাসি…দুষ্টিমিষ্টি ঠাট্টা সবই ভাল্লাতো আমার। আমার সচেতন তখনো এটাকে ভুল বা খারাপ বলে আভাস দিতে ব্যার্থ ছিল।
ওয়াসিফ আদ্রির জন্য বাড়িতে এলেও নানান বাহানায় আমার সাথে সময় কাটাতো। রিতুকেও ভীষণ আদর করতো। ও বাড়ির সবার কাছে রিতু হলো আদুরে পুতুল। প্রচন্ড ভালোবাসে সবাই ওকে।
ওয়াসিফকে আমি ভাইয়া বলে সম্বোধন করলেও সে আমায় নাম ধরেই ডাকতো। সম্পর্কটা বেশ সহজ করে ফেলেছিল সে, নিজের মিষ্টি মধুর কথায় আর আচরণে।
এরই মধ্যে আরেকটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটলো। আমার এক কলেজ ফ্রেন্ডদের একটা গ্রুপে একজন আমার আর নক্ষত্রের একটা ছবি দিয়ে লিখেছিল, ‘এটা আমাদের সুন্দর জামাইয়ের সুন্দরী বউ…ইরিনরাণীর জামাই। আল্লাহ মাফ করো….কিছু বলার নাই! ‘ সোজাসুজি বিদ্রুপ!
আমার সাথে তিনি বেমানান এই নিয়ে শুরু হলো বিশ্লেষণ। নানান জন কমেন্টে নানান কথা বলা শুরু করলো। আমি টাকা দেখে এমন একটা লোককে বিয়ে করেছি। কলেজে ভাব নিতাম সুদর্শন হাজবেন্ড হবে বলে,আর এখন কি জুটলো?!
অন্যজন বললো, আরেএএ এমন সবাই বলে। টিনএইজ ফ্যান্টাসি সব। এখন তো টাকা দেখে কালো জামাইও তার সোনার ডিম পারা হাঁস। কে হাত ছাড়া করতে চায় এমন কপাল! ‘ এমন অনেক কু মন্তব্যে ভরে গেছিল কমেন্ট বক্স। আমার মন ভীষণ রকম খারাপ হলে গেল। যে ব্যাপারটা আপনার মনপুত নয় তাতে অন্যের সায় পেলে তা আরও বাজেভাবে নেগেটিভলি ইফেক্ট করে মনকে। আমারও তার বিপরীত হলো না। আমার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত লাগলো ব্যাপারটা। উনার প্রতি আরও বেশি বিরক্ত হয়ে গেলাম। ঠিক উনার উপর নয়, আমার ভাগ্যের উপর। একটা ভুল মনোভাবকে ঠিক মনে করার প্রতিই ছিল আমার এই বিরক্তি, রাগ, অভিমান। আমি নিজেকে আরও গুটিয়ে নিলাম। উনার থেকে যথা সম্ভব নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতাম। কিন্তু, একই ঘরে একটা বৈধ অধিকার আর সম্পর্কের ছায়াতলে থেকে কতদূর দূরত্ব রাখা সম্ভব। উনার সংস্পর্শে জড়াতেই হতো আমায়। আমি কেবল কম্প্রোমাজ নামক একটা শব্দকে সান্ত্বনার হাতিয়ার করে নিজেকে তার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যেতাম।
লোকে বলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে নাজুক সম্পর্ক। অনেকটা নৌকা আর পালের মত। পালে সামান্য ফুটো হলেও যেমন নৌকার দিক দিশা পাল্টে যেতে পারে তেমনি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে ফাঁক তৈরী হলে তা সামলানোর কেউ না থাকলে বিগড়ে যেতে সময় লাগে না। আমারও তাই হলো।
উনি ব্যস্ত থাকতেন নিজের কাজে। সম্পর্কের দেখভাল করতেন ঠিকই তবে আমি করতাম না। যার জন্য ওয়াসিফ খুব সহজে তার জায়গাটা গড়ে নিয়েছিল আমাদের মাঝে।
ওয়াসিফের সাথে ঘন ঘন দেখা হওয়া, কথা হওয়ায় আমার অবচেতন মন তাকে অন্যভাবে পছন্দ করা শুরু করলো।এটা আমি তখন বুঝলাম যখন আমি অদ্রির সাথে ওয়াসিফকে দেখে আর সহ্য করতে পারছিলাম না। মন জানান দিল আমি হিংসা করছি অদ্রিকে। অদ্রির সাথে আমার যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তা আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্পর্কে বদলে ফেললাম নিজের অন্ধ মনের প্ররোচনায়।
অদ্রি আমার থেকে অনেক বেশি সুন্দরী। ওয়াসিফের মত সুদর্শন ছেলের সাথে সে একদম পার্ফেক্ট। কিন্তু আমি ওয়াসিফের প্রতি দূর্বল ছিলাম। বিশ্বাস করুন এত সব কিছুর পরেও আমার একবারের জন্যও নক্ষত্রের খেয়াল আসেনি মনে। আমি যে কারও স্ত্রী এটা জানলেও আমি সেটাও আমি ভুলে বসলাম। ঠিক কতটা নীচে নেমে গেছিলাম আমি এখন তা মনে করতে গেলেও মনে হয় এর থেকে মরে যাওয়া সহজ।
‘মৃত্যু কি এতই সহজ, মিসেস. ইরিন? সব কিছুর সমাধানে মৃত্যুই কি একমাত্র সহজ পথ?’ – পাশ থেকে বললো রাফিদ।
‘নাহ! মৃত্যু কোন কিছুর সমাধান না। মৃত্যু সহজও নয়। আসলে মৃত্যুর মুখোমুখি না হলে বোঝায়ই যায় না মৃত্যু আসলে কি! বেঁচে থাকতে কষ্ট হলেও একটা পরিশেষ পাওয়া যায়, কিন্তু একবার মরে গেলেই তো সব শেষ। আর কিছুই করার থাকে না। অবলীলায় সব হারাতে হয়। ‘
‘এতই যখন বোঝেন তাহলে কথায় কথায় এত মরার সাধ কেন জাগতো আপনার?’
‘ওই যে মরতে বসার আগে জানা ছিল না যে জীবন কতটা মূল্যবান!’
চলবে…