#নষ্ট_গলি
পর্ব-৩
লেখা-মিম
রেস্টুরেন্টের ভিতরে মুখোমুখি বসে অাছে দুজন। কিছুক্ষন অাগেই ওয়েটার খাবার দিয়ে গেছে। সোহান লক্ষ্য করছে মায়া কাঁটা চামচ ছুরি দিয়ে ঠিকভাবে খেতে পারছে না। ওপাশ থেকে চেয়ার ছেড়ে এপাশের চেয়ারে এসে বসলো সোহান। মায়ার হাত থেকে চামচ নিজের হাতে নিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে মায়াকে। কখনো এভাবে যত্নআত্তি পায়নি সে। এই প্রথমবার এতটা যত্নঅাত্তি পাচ্ছে। অাবেগটা একটু অাধটু উঁকি দিচ্ছে। যদিওবা মাত্র কয়েকঘন্টার পরিচয় এমন আবেগ উঁকি দেয়ার কথা না। তবু দিচ্ছে। মানুষটাকে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিজের মনের সমস্ত অপ্রকাশিত কথাগুলো, ইচ্ছেগুলো জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে।
-” এভাবে তাকিয়ে অাছো কেনো? কিছু বলতে চাও?”
-” হুম।”
-” বলো কি বলবে?”
-” আমি কে সেটা তো আপনি ভালো করেই জানেন। তাহলে এত যত্ন নিচ্ছেন কেনো?”
-” তোমার পছন্দ হচ্ছে না?”
-” সেটা বলিনি। পছন্দ অবশ্যই হচ্ছে।”
-” যেহেতু পছন্দ হচ্ছে সেহেতু চুপচাপ যত্ন উপভোগ করো। এত কেনো কেনো করছো কেনো?”
-” আপনার রাগ বেশি তাই না?”
-” না আমি যথেষ্ট ঠান্ডা মানুষ।”
-” তাহলে আমার সামান্য প্রশ্নে রেগে গেলেন কেনো?”
-” আমি এমনই।”
-” তারমানে আপনি রাগী।”
-” তুমি অনেক কথা বলো।”
-” না। কিন্তু আজকে আপনার সাথে কথাা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
-” তাই? পছন্দ হয়েছে আমাকে?”
-” হুম পছন্দ হয়েছে। অাপনার রাগটাকেও ভীষন ভালো লেগেছে। ”
-” বাহ্ তাহলে তো সোনায় সোহাগা। হাজার ধমকালেও পালাবে না। জানো জাহিদকেও অনেক বকা দেই। বেচারা একটা টু শব্দও করে না।”
-” জাহিদ কে?”
-” ঐ যে একটা ছেলেকে দেখলে না আমার সাথে?”
-” হুম।”
-” ঐটাই জাহিদ।”
-” আপনার বয়স কত?”
-” ৩০।”
-” অাপনার তো বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়ে না করে আমার মত মেয়ের পিছনে কেনো ছুটছেন?”
-” বিয়ে করলে বুঝি পুরুষ মানুষরা তোমাদের পিছে ছুটে না?”
-” ছুটে তবে বিয়ের পাঁচ ছয় বছর পর। সংসার করতে করতে তিতা হয়ে যায়। তখন অামাদের কাছে অাসে।আর কতগুলা থাকে জাত লুচ্চা। ওগুলা বিয়ের পরদিনই চলে অাসে অামাদের কাছে।”
-” আমি জাত লুচ্চা না। একজনকে নিয়ে থাকতেই পছন্দ করি। আর সংসার করে মনটাকে বিষিয়ে তুলতে চাই না। তাই তোমার কাছে আসা।”
-” সবাই তো খারাপ হয় না।”
-” ম্যাক্সিমাম মেয়ে মানুষই এমন ত্যানা প্যাচানো টাইপ হয়। তিনজনের সাথে প্রেম করেছি। তিনোটাই একই স্বভাবের ছিলো। অহেতুক ঘ্যানর ঘ্যানর করতো। কিছু থেকে কিছু হলেই ব্রেকঅাপ করবো, সুইসাইড করবো, হাত কাটবো। উফফ! কি যে পেইন দিতো মেয়েগুলা।”
-” আপনি না একটু আগে বললেন একজনকে নিয়েই থাকতে পছন্দ করেন। তাহলে তিনজন আসলো কেমন করে?”
-” একসাথে তো তিনজনের সাথে প্রেম করিনি। যখন যার সাথে প্রেম করেছি তখন তাকে নিয়েই পড়ে থেকেছি। অন্য কোথাও নজরদেইনি। আমি যথেষ্ট লয়্যাল পারসন। প্রতিটা প্রেমের ইতি টানার পর নতুন প্রেমে জড়ানোর আগে ছয়মাস করে সময় নিয়েছি।”
-” সময় কেনো নিয়েছেন?”
-” ওদেরকে পুরোপুরি ভুলার জন্য।”
ঠিক এই মূহূর্তে সোহানের কথায় মায়ার মনে হচ্ছে একটা মানুষ জীবনে কয়টা প্রেমকরতে পারে? যেহেতু একেকজনকে ভুলার জন্য ছয়মাস সময় লেগেছে তারমানে প্রেম গভীর ছিলো। যেহেতু গভীর ছিলো তাহলে ছেড়ে দিলো কেনো? নাকি মেয়েগুলোই ছেড়ে চলে গেছে?
-” সম্পর্ক কে ভেঙেছিলো?”
-” প্রথম দুটো আমি ভেঙেছি। সারাদিন লাগাতার প্যানপ্যানানি,অভিযোগ চলতেই থাকতো এই দুইটার আর শেষেরটা আমার রাগ হজম করতে পারেনি। যখনই বকতাম তখনই কাঁদতো আর কি কি জানি বলতো। ওর কান্নার জন্য কথাগুলো স্পষ্ট বুঝতাম না। তখন আরও বকা দিতাম। শেষমেষ ইচ্ছেমতো অভিশাপ দিয়ে ব্রেকআপ করে ফেলেছে।”
-” আপনি কি গালিও দেন?”
-” হ্যা দেই। সবচেয়ে বেশি গালি খায় জাহিদ আর আমার ম্যানেজার। আর ওদের চেয়েও বেশি গালি খেয়েছে আমার প্রথম প্রেমিকা। গালি দেয়ার টাইমে কিন্তু কখনো প্রতিবাদ করেনি। অামি ঠান্ডা হওয়ার পর আমাকে ধোলাই দিতো । তখন আমি ফোন কান থেকে রিয়ে রাখতাম। এরপর উল্টো অামাকেই সরি বলতো। মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে বলতো আমি মরে যাবো। একবার এক ক্লাইন্টের উপর মেজাজ খারাপ হয়েছিলো খুব। ক্লাইন্টের ঝাল ওর উপর ঝেড়েছি। সেদিন রাতে এই মেয়ে বিষ খেলো। ওর বাবা আমার উপর মামলা দিলো। এরপর আর কি ব্রেকআপ করে দিলাম।”
-” আপনি জেলও খেটেছেন?”
-” নাহ্। টাকা দিয়ে মামলা তুলেছি।”
-” এরপর ঐ মেয়ে যোগাযোগ করতে চায়নি?”
-” হুম করেছে। আমি পাত্তা দেইনি। কয়দিন পর বাপ মা বিয়ে দিয়ে দিলো ওকে। এখন দুই বাচ্চার মা। বেশ ভালোই আছে। এইবার আসি সেকেন্ড গার্লফ্রেন্ড প্রসঙ্গে। এইটা তো একদম গালির উপর পি এইচ ডি করা ছিলো। আমি একটা দিলে ও দিতো পাঁচটা। সবচেয়ে বেশি জ্বালিয়েছে এই মেয়েটা। মারাত্মক প্যানপ্যানানি স্বভাবের ছিলো। সারাক্ষন এটা করোনি কেনো? ওটা করনি কেনো? ফোন দিতে লেট করলে কেনো এগুলো চলতেই থাকতো। প্রতিটাদিন এই মেয়ের সাথে ঝগড়া হতো। শেষমেষ এটাকে বাদ দিলাম। ঠান্ডা, ঝামেলা ছাড়া মেয়ে মানুষ আমার খুব পছন্দ।”
-‘ আপনি কি অামাকেও গালি দিবেন?”
-” সেটা পরিস্থিতি নির্ভর।”
-” জোনাকি বুবুর সাথে কতদিনের চুক্তি করেছেন?”
-” সময় ফিক্স করিনি।”
-” আপনার ঘরে কে কে আছে?’
-” ঢাকার বাসায় আমি একা থাকি। দুইজন সার্ভেন্ট আছে। ফ্যামিলি চিটাগাং থাকে। ওখানে মা বাবা আর ছোট ভাই আছে। বাবা ওখানকার অফিস দেখে আর আমি এখানকার।”
-” আপনার পরিবার যদি জানে আপনি আমার মতো মেয়ের কাছে আসবেন উনারা বকবেনা?”
-” ফ্যামিলিটা আমার পছন্দ না। আসলে এটা ফ্যামিলি না। সবাই সবার প্রয়োজনের তাগিদে সবাইকে ব্যবহার করছি। ছোট থেকেই দেখে আসছি মা বাবা কুকুর বিড়ালের মতো ঝগড়া লেগে থাকে। দুজনেরই পরকিয়া চলছে বহুবছর আগে থেকে। কয়েকবার এদের দুজনকে বলেছি তোমরা ডিভোর্স নিয়ে নাও। এভাবে আমাকে আর সালমানকে টর্চার করো না। উনারা ডিভোর্স নিবে না। এভাবেই চলবে। অামরা দুইভাই আয়ার হাতে বড় হয়েছি। বাবা মা কে খুব কমই কাছে পেয়েছি। বাবার সাথে ব্যবসায়িক কথা ছাড়া কোনো কথা হয় না। মায়ের সাথে লাস্ট কথা হয়েছে পনেরোদিন আগে। বেশিরভাগ কথা হয় ছোটটার সাথে। ও বেশিরভাগ ফোন করে। মাঝে মাঝে অামার এখানে এসে থাকে। আমি তেমন একটা যাই না ওখানে। শান্তি লাগে না। ঐ বাড়িতে ঢুকা মাত্রই অশান্তি শুরু হয়ে যায় আমার।”
মায়া খুব মন দিয়ে সোহানের কথাগুলো শুনছে। লোকটার বাপ মা থেকেও নেই আর ওর বাবা কে সেটা ওর জানা নেই। কি অদ্ভুদ দুনিয়া! কেউ পায় না আর কারো কারো থেকেও নেই।
-” অাচ্ছা মায়া ঐটা কি তোমার মা ছিলো? ঐ যে চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলো যে?”
-” হুম।”
-” উনিও কি তোমার মতই?”
-” হ্যা। অামি জন্মসূত্রে পতিতা। অামার মা পনেরো বছর বয়সে অামাকে জন্ম দেয়। চেয়েছিলো ওখান থেকে অামাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে পারেনি। অাম্মার ডিমান্ড ছিলো বেশি। অাম্মাকে উনারা ছাড়েনি। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি। এরপর অামাকেও এই কাজে নামিয়ে দিলো আম্মা বলতো অামাকে পালিয়ে যেতে। দুবার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলামও। ঘন্টাখানেক বাদে ফিরে এসেছি মায়ের কথা ভেবে। মা তো একা হয়ে যাবে।অামিই বা যাবো কোথায়? রাস্তার লোকেরাও তো কেমন করে যেনো তাকায়। ভেবে দেখলাম বাহিরে যেয়েও লাভ নেই এরচেয়ে ভালো মায়ের কাছে যাই। ”
-” জীবন কেমন যেনো! খুব এলোমেলো। খুব ছন্নছাড়া। যাই হোক সেসব বাদ দাও। পেট ভরেছে তোমার? অারো কিছু খাবে?”
-” না।”
-” চলো অামার বাসায় যাবে?
-” অামার তো শরীরটা ভালো না অাজই?”
-” অামি সেসব কিছু করবো না। তুমি তোমার মত থাকবে। শোনো সুস্থ হওয়ার জন্য ভালো একটা পরিবেশ দরকার। ওটা তোমার ওখানে নেই। সুস্থ হলে তুমি চলে যেও। আবার অামার এখানেও থাকতে পারো। যাবে আমার সাথে?”
-” ………………”
-” অামাকে বিশ্বাস করতে পারো।”
-” হুম যাবো।”
(চলবে)
/