নাম_না_জানা_এক_পাখি পর্ব ২৬+২৭+২৮

#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ২৬

৪২.
আশীর্বাদ শেষ হতেই বেশি দেরি করে নি আর কেউ ই। দ্রুত বাড়ি চলে এসেছে। একদিন বাদে আবার রনিতের আশীর্বাদও। বাড়ি ভরা কাজ!

তপসীর মন ভালো নেই। সুব্রত সম্ভবত কাল চলে যাবে। এতো ব্যস্ততায় তপসী ভুলে গেছে সুব্রতের যাওয়ার তারিখ কবে।

তপসী কিচেনে কফি বানাচ্ছে সবার জন্য। সবাই ফ্রেস হয়ে এসেই কফি খাবে। রেহা বৌদিই সবার আগে ফ্রেস হয়ে এসে ড্রয়িং রুমে বসলো। টিভি ছেড়ে দিলো। তপসী একবার কিচেনের দরজার কাছে গিয়ে দেখলো কে বের হয়ে হয়েছে।

আবার ফিরে এসে দুধ গরম করতে লাগলো। মানুষ সত্যিই আশ্চর্য জনক। এই যে তপসী দুপুরে রেহা কে এতো কথা শোনালো, এরপর হয়তো তার উচিৎ ছিল বাড়ি ফিরে যাওয়া৷ অন্তত কেউ তপসীর সাথে এমন ব্যবহার করলে তপসী তাই করতো।

অথচ রেহা আপন মনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার স্বামীকে দেখা যাচ্ছে না। তপসী এখনো সঠিক জানে না সুমন সুব্রতের কেমন মাসতুতো ভাই! তপসীর জানা মতে তো তার শ্বাশুড়ির কোনো বোন নেই।

৪৩.
রাত সাড়ে ১১ টায় তপসী ঘরে আসলো। কাজে সাহায্য করার এক মাসির ছেলে অসুস্থ। সে আসতে পারে নি বলেই সব কাজ আজ দেরি হয়ে গেছে। তপসী যখন ঘরে ঢুকলো সুব্রত তখন বিছানায় আধ শোয়া হয়ে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছে।

তপসী তাড়া দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,

—— আপনার ব্যাগ কই? গোছগাছ করা শেষ?

সুব্রত চোখ মেলে তাকালো। তার বউটা পাক্কা সংসারী হয়ে গিয়েছে। অথচ সে তার সংসার করা দেখতে পাবে না। আগে তো জব টা মোটেও কষ্টকর মনেহতো না। এখন কেন মনে হয় অন্য কোনো পেশা অধিকতর ভালো হতো, এমনটা মনে হওয়া তো উচিত নয়।

তপসী আবার জিজ্ঞেস করলো,

—— কেমন বোকারামের মতো বসে আছেন আপনি! ব্যাগ কই জিজ্ঞেস করছি তো।

সুব্রত বিছানায় পুরোপুরি শুয়ে পড়লো।গায়ে কম্বল জড়াতে জড়াতে বললো,

—— ব্যাগ নিয়ে যাবো না। আমার ওইখানে তো সবই আছে।

—— আসার সময় একটা ব্যাগ এনেছিলেন না?

সুব্রত বিছানা থেকে নামলো। আলমিরা থ্রকে ব্যাগ টা বের করলো। ব্যাগের চেইন খুলতে খুলতে বললো,

—— আমার বোকাবউ, স্বামী ব্যাগে করে কি এনেছে তাও একবার খুলে দেখো নি?

তপসী ভ্রু কুঁচকালো। বললো,

—— আমি ব্যাগের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এতে কি আপনার জামা কাপড়ই না শুধু?

সুব্রত হাসলো। ব্যাগ থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন শপিং ব্যাগ বের করতে লাগলো। তপসী হাটু মুড়ে সুব্রতের সামনে বসে দেখতে লাগলো সুব্রতের ক্সজ৷

সুব্রত বললো,

—— আমি নাহয় বউ পেয়ে ব্যাগের কথা ভুলে গেছি তাই বলে তুমিও ভুলে গেলা? নাও এখন শপিং ব্যাগ থেকে সব কিছু বের করো তো।

তপসী ব্যাগ হাতে নিয়ে বসে আছে। ব্যাগে সব নতুন শাড়ি, জামা প্যান্ট আছে। জিজ্ঞেস করলো,

—— এগুলো কার জন্য?

—— সবার জন্য।

—— আপনি আসার আগে শপিং করে এনেছেন।

সুব্রত হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। বললো,

—— প্রত্যেকবারই আনি। আসার পরের দিনই ব্যাগ আনপ্যাক করি। এবার সত্যিই তোমায় পেয়ে ভুলে গেছি।

তপসী শাড়ি দেখতে লাগলো। সবগুলোই এতো সুন্দর। সুব্রত কোনটা কার জন্য দেখাতে লাগলো। তপসীর জন্য আনা শাড়ি তপসীর হাতে দিয়ে বললো,

—— অনেক টায়ার্ড তুমি?

তপসী বললো,

—— একটু। কিন্তু কেন?

—— চট করে শাড়ি টা পড়ে আসতে পারবে? আমি ছোট থেকে শুনেই এসেছি শুধু, বর রা তাদের বউকে সাজিয়ে দেয়।

তপসী জোরে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো,

—— আপনি সাজাবেন আমায়?

সুব্রত চোখ সরু করে বললো,

—— হাসার কি আছে?

তপসী হাসি থামিয়ে দিলো। বললো,

—— আপনি সাজাতে পারেন?

সুব্রত বললো,

—— সাজ বলতে কি শুধু কয়েক স্তরের মেকাপস মুখে লাগানো নাকি? আমি জানি আমার বউ কে কিভাবে প্রিটিয়েস্ট লাগে, আমি সেভাবেই সব সাজাবো!

তপসী স্মিত হাসলো। উঠে দাড়ালো। আলমারি থেকে শাড়ির সাথে ম্যাচ করে ব্লাউজ নিয়ে নিলো। ওয়াসরুমে চেঞ্জ করতে যাওয়ার আগে সুব্রত হাত টেনে থামালো।

সুব্রত কাচুমাচু করে জিজ্ঞেস করলো,

—— শাড়িটা আমি পড়িয়ে দেই?

তপসী সুব্রতের নাক টিপে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—— আপনি পারেন বুঝি?

সুব্রত তপসীর গালে টুক করে চুমু খেল। বললো,

—— আমার বউ আছে কি করতে? সে সব শিখিয়ে দিবে৷ তোমার মতো সে মোটেও পাজি না, হুহ।

তপসী শব্দ করে হেসে উঠলো। সুব্রত তপসীকে সবসময় বাচ্চা বলে, কিন্তু আজ নিজেই কেমন বাচ্চামো করছে।

তপসী ওয়াসরুমে গিয়ে ব্লাউজ চেঞ্জ করে আসলো। সুব্রতের সামনে এসে দাড়ালো কোনো রকম জড়তা ছাড়া।

সুব্রত শাড়ি তুলতেই তপসী শিখিয়ে দিলো কোন দিক থেকে শুরু করতে হবে। শাড়ি কোমড়ে গুজতে গুজতে দুষ্টুমি করে সুব্রত বললো,

—— এমন ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে দাঁড়িয়ে আছো, এই মেয়ে লজ্জা করছে না তোমার?

সুব্রত শাড়ি কোমড়ের চারদিকে গুঁজে সামনে ফিরে আসতেই তপসী সুব্রতের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,

—— না গো, একদম লজ্জা করছে না। একটা অসভ্য লোক আমাকে বিগড়ে দিয়েছে, আমার সব লজ্জা উড়িয়ে দিয়েছে।

সুব্রত তপসীর পেটে চিমটি দিয়ে বললো,

—— ছিঃ, তুমি নিজের স্বামী কে অসভ্য বলতে পারলে?

—— একশোবার বলবো, আমার স্বামীকে আমি বলবো তোমার কি?

সুব্রত গম্ভীর হয়ে বললো,

—— এইযে এখন সুন্দর করে তুমি করে বলা হচ্ছে। সবসময় এমন আপনি আপনি না করে তুমি করেও ডাকতে পারো তো নাকি!

আঙুলে প্যাঁচিয়ে শাড়ির কুঁচি তুলতে তুলতে তপসী বললো,

—— সবার সামনে বলতে আমার লজ্জা করে তো!

—— একটু আগে না বললে একজন অসভ্য লজ্জা সব খেয়ে নিয়েছে।

তপসী হেসে উঠলো। বললো,

—— সে যেমন অসভ্য শুধু আমার সামনে আমিও তেমন নির্লজ্জ শুধু তার সামনে।

—— ভালোবাসা প্রকাশ করলে তো ক্ষতি নেই!

—— প্রকাশ না করেও ক্ষতি নেই। যা আছে, তা সবসময় চাক্ষুসই হতে হবে তার কি কোনো ধরা বাধা নিয়ম আছে? যেটা মনে সুপ্ত থাকে, সেটাই বেশি প্রীতিকর। আর জানো, সবচেতে সুন্দর অনুভূতি কোনটা?

সুব্রত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

—— কোনটা?

—— যখন তুমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখ দেখেই বুঝতে পারবে ভালোবাসার গভীরতা কতোটা, মানুষটার ভালোবাসার স্রোত নিজের অস্তিত্বে অনুবভব করতে পারবে, সেই অনুভব করার অনুভূতি সবচেয়ে মিষ্টি অনুভূতি।

সুব্রত স্মিত হাসলো। সত্যিই অনুভূতি টা মিষ্টি। তপসীর কাঁধে আচল তুলে দিয়ে কপালে চুমু খেল। তপসীর সাহায্যই বাম কাধের দিকে একটা খোপা করিয়ে দিলো। আর্টিফিশিয়াল গোলাপের মালা জড়িয়ে দিলো খোঁপায়। সিঁথি রাঙিয়ে সিঁদুর পড়িয়ে দিলো নিজ হাতে। এরপর কপালে খয়েরি টিপ পড়িয়ে দিলো।

সুব্রত এরপর বললো,

—— চলো, আজ একটু উপন্যাসের নায়ক নায়িকা হবো। জ্যোৎস্না বিলাশ করিবো প্রয়সীকে নিয়ে ।

—— আহা, কাল সকালে তউমক জার্নি করবে কিভাবে এরপর!

—— উফফ, এখন দেখা যাচ্ছে তোমায় জোর করেই উপন্যাসের নায়িকা বানাতে হবে।

কথা শেষ করেই তপসীকে কোলে তুলে নিলো সুব্রত। ছাদের সিড়ির দিকে হাটতে লাগলো। তপসী গলা জড়িয়ে ধরলো তার।

ছাদে পৌঁছেও সুব্রত তপসীকে নামালো না। ছাদের ডান দিকে রাখা দোলনায় গিয়ে তপসীকে কোলে নিয়েই বসে পড়লো।

তপসী মৃদ্যু কণ্ঠে বললো,

—— এবার তো নামিয়ে দাও।

সুব্রত তপসীকে নামিতে দিলো। তপসী এক পাশে বসতেই সুব্রত তপসীর কোলে মাথা রেখে আকাশের পানে মুখ করে শুয়ে পড়লো। তপসী চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,

—— তুমি কাল সকালে কিভাবে যাবে? না ঘুমালে অসুবিধা হয়ে যাবে না?

—— এইজন্যই চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়াতে চাচ্ছো?

তপসী হেসে দিলো। আজ পূর্ণিমা না, তবে চাঁদ অনেকটা বড়োই। চাঁদের আলোতে তপসীকে মিষ্টি দেখতে লাগছে। সুব্রত তপসীর ঠোঁট আঙুল লাগিয়ে বললো,

—— এতো সুন্দর করে হাসতে হয়? এখন এমন করে হাসার জন্য জন্য তোমাকে ফাইন দিতে হবে তপসী।

—— আমি কোনো ফাইন দিবো না।

তপসী মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সুব্রত দুঃখী দুঃখী ভাব করে বললো,

—— এই যাহ, আমি ভাবলাম বাকি যে আরো পাঁচ দিন ছুটি আছে, ফাইন হিসেবে তোমাকে এই ক’দিন বেশি জ্বালাবো। কিন্তু তুমি তো ফাইন দিতে রাজিই না।

তপসীর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। খুশিতে লাফিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেল। নিচু হয়ে সুব্রতের মুখের সামনে গাল নিয়ে বললো,

—— নাও তো , এবার তুমি ফাইন ভরো। এতোদিন ছুটির কথাটা লুকিয়ে রাখার জন্য। যলদি করো, আমার এতো সময় নেই।

সুব্রত হেসে ফেললো। তপসীর গালে চুমু দিয়ে বললো,

—— ওকে ম্যাম?

তপসী সোজা হয়ে চোখ বন্ধ করে বললো,

—— উহু, এখনো অনেক বাকি!
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ২৭

৪৪.
ছাদে বসে থাকতে থাকতে তপসীর ঝিমুনি ধরে গেছে। সুব্রত এখন কথা বলছে না। চুপচাপ তপসীর হাত ধরে শুয়ে আছে। কোনো কথা ছাড়াই মুহূর্ত টা তার কাছে এতো মধুর লাগছে!

তপসী নড়েচড়ে উঠলো,

—— আমার ঘুম পাচ্ছে।

সুব্রত তুপসীর মুখের দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,

—— ক’টা বাজে বলো তো?

—— আমি কিভাবে বলবো? ঘড়ি তো পড়ি নি।

সুব্রত ঠোঁট টিপে হাসলো। বললো,

—— একটা নাগাদ বাজবেই তো। এখন যদি কালো ঘুটঘুটে ভূত সামনে চলে আসে তো? তখন কি হবে তপসী!

তপসীর ঘুম উবে গেল। সে আমতা আমতা করে বললো,

—— এই বাড়িতে ভূত নেই আমি জানি। মিথ্যা কথা বলবে না!

—— বাড়িতে তো নেই, কিন্তু ছাদে তো আছে।

তপসী একটা ফাঁকা ঢোক গিললো। মাথায় হাত দিয়ে দেখলো খোঁপা ঠিক আছে না-কি খুলে যাচ্ছে! চুল খুলে গেলে নিশ্চয়ই তাকে ভূত ধরে বসবে। সুব্রত জিহবা কামড়ে হাসি আটকাচ্ছে।

তপসী দোলনায় পা তুলে বসলো। বললো,

—— ঘুম পাচ্ছে তো আমার। চলো ঘরে চলো।

সুব্রত তপসীর নাক চিপে ধরলো। হেসে বললো,

—— পাগল মেয়ে৷

—— কি করলাম আমি?

—— ভূত হয় নাকি? ভয় পাচ্ছো কেন?

—— আমি কি বলেছি আমি ভয় পাচ্ছি?

—— তাহলে ঘরে যাওয়ার জন্য এতো উতলা কেন হচ্ছো শুনি?

—— ঘুম পাচ্ছে বললাম তো।

সুব্রত বললো,

—— মাদুর বিছিয়ে ছাদে ঘুমাবো আজ।

তপসী সুব্রতের হাত চেপে ধরলো। বললো,

—— প্লিজ ঘরে চলো। আচ্ছা আমি ভয় পাচ্ছি, এই যে স্বীকার করলাম। এইবার তো চলো, প্লিজ।

সুব্রত লাফিয়ে নেমে দাড়ালো দোলনা থেকে। স্মিত হেসে তপসীকে আবার কোলে তুলে নিলো।
বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,

—— ওহো, আপনি তাহলে আমার কোলে উঠার পায়তারা করছিলেন মিসেস. সুব্রত।

তপসী নিচের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। বললো,

—— বেশি কথা বলবে না সুব্রত৷ হাতে কামড়ে দিবো।

সুব্রত সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বললো,

—— এই মেয়ে তো সত্যিই পাগল।

,
সুব্রত ঘরে ঢুকে তপসীকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দিলো। তপসীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—— শাড়ি কি চেঞ্জ করে ঘুমাবে?

—— নাইট স্যুট পড়ে আসি?

—— তোমার ইচ্ছা। এতো ভারী শাড়ি নিয়ে তো ঘুমাতে পারবে না।

তপসী ওয়াসরুমে চলে গেল চেঞ্জ করতে। সুব্রত ঘড়ি দেখলো। দেড়ট বাজে প্রায়। সুব্রত বিছানা গুছিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো। তপসী চেঞ্জ করে আসতেই বললো,

—— ঘুমিয়ে পড়ো, অনেক রাত হয়েছে।

তপসী সায় জানালো। ডিম লাইট অন করে সুব্রতের পাশে এসে শুয়ে পড়লো। সুব্রতকে জড়িয়ে ধরলো নিজ থেকেই। সুব্রতও কাছে টেনে নিলো তপসীকে। তপসী সুব্রতের বুকের সাথে মিশিয়ে দিতে চাইছে নিজের অস্তিত্ব।

৪৫.
সকাল থেকেই বাজার সদাই দেখতে দেখতে তপসী ক্লান্ত হয়ে উঠলো। আগামীকাল রনিতের আশীর্বাদ। ছোট খাট একটা বিয়ের মতোই আয়োজন করা হচ্ছে। এতো কিছু সামলে উঠতে কষ্ট হচ্ছে। কাজের সাহায্য করার মাসি দুইজনও হাঁপিয়ে উঠেছে এতোসব খেয়াল রাখতে রাখতে।

তপসী বাজারের লিস্টের সাথে সব মিলাচ্ছিলো। সুব্রত হাতে দুইটা লেমনেড এর গ্লাস নিয়ে আসলো। একটা তপসীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

—— যলদি এটা ফিনিস করো তো। সারাদিন এতো কিছুর মধ্যে খেয়ালই রাখো না নিজের।

—— এইটুকু দ্বায়িত্ব বাড়ির বড়ো বউ কে নিতেই হয়। চাপুন তো, কাজ করতে দিন।

সুব্রত আশেপাশে তাকিয়ে তপসীর মাথায় গাট্টা মারলো। তপসী হা করে তাকিয়ে রইলো সুব্রতের মুখের দিকে।
সুব্রত চোখ রাঙিয়ে তাকালো। বললো,

—— আবার আপনি করে বলা হচ্ছে!

তপসী মাথায় হালকা ব্যাথা পেয়েছিলো। হাতের তালু দিয়ে ঢলতে লাগলো সেইখানে। এরপর বললো,

—— সবার সামনে বলতে গেলে লজ্জা লাগবে তো। তাই বলে আপনি আমায় মারলেন?

—— অন্যের বর কে ডাকছো না। আমাকেই ডাকবে। লজ্জা কেন পাবে?

—— আপনি বুঝবেন না।

—— তুপসী, তুমি কি ‘তুমি’ করে বলবে? নাকি আমি আবার মাথায় মারবো।

তপসী কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে বললো,

—— আচ্ছা বলবো। আপনি যান তো।

সুব্রত চোখ রাঙিয়ে আবার তাকালো তপসীর দিকে। তপসী ইষৎ হেসে বললো,

—— যাও তো তুমি। কাজ করো যাও।

সুব্রত চলে গেল। তপসী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

,

তপসী তার কাকি শ্বাশুড়ির সাথে দাঁড়িয়ে কিচেনে কাজ করছিলো। তুলি দৌড়ে এলো। তপসীকে বললো,

—— বৌদিদি, তোমায় দাদাবাবু ডাকছে।

—— কেন?

—— সেটা কি আর আমায় বলেছে নাকি?

—— আচ্ছা তুই যা আমি আসছি।

,
সুব্রত ঘরে পায়চারি করছিলো। তপসী ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো,

—— এতো জরুরি তলব করলে যে, কি হয়েছে?

—— পড়া লেখার খবরাখবর তো রাখো না বউ একদমই।

তপসী বিরক্তি তে মুখ কুঁচকে ফেললো। জিজ্ঞেস করলো,

—— এখন আবার পড়ালেখার কি হলো?

—— তোমার রেজাল্ট পাবলিশ হবে এই যে আর ১৩ দিন পর। খোঁজ খবর তো নেই।

—— মানুষের রেজাল্ট জানার ইচ্ছা থাকলে খোঁজ খবর রাখে৷ যখন আমার দরকারই নেই, তখন কেন আমি খোঁজ খবর নিতে যাবো?

সুব্রত বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,

—— কি?

—— আমি।বলতে চাচ্ছি আমি জানি আমাই মেডিকেলে চান্স পাবো না। এক্সাম দিতে বলেছো, দিয়েছি। চান্স আমি পাবো না তা তো আগেই বলে দিয়েছি।

সুব্রত তপসীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—— এতো যে প্রিপারেশন নিলে সব কই গেলো?

—— সবাই তো এতো ব্রিলিয়ান্ট হয় না। যারা কোচিং এর পড়া বুঝেছে, আয়ত্ত করেছে তারা পারবে। হাতের পাঁচ আঙুল তো আর সমান হয় না। আমি পড়া বুঝি নি, আয়ত্ত করতে পারি নি। তাই চান্স পাবো না, সিম্পল।

সুব্রত বললো,

—— এটা তোমার মায়ের ইচ্ছা ছিল তপসী। একটু বেশি করে ট্রাই করা যেতো না?

তপসী নির্লিপ্ত ভাবে বললো,

—— আমি আমার বেস্টটাই ট্রাই করেছি। আমার মা বেঁচে থাকলে অবশ্যই বুঝতে পারতেন আমি পারছি না। মা নিশ্চয়ই আমায় ক্ষমা করে দিবেন।

সুব্রত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,

—— এখনো রেজাল্ট পাবলিশ হয় নি। ততোদিন ওয়েট করি, যা হওয়ার তা হবে।

তপসী শান্ত হয়ে বসে রইলো বিছানায়। এই মেডিকেল এ পড়ার কথা বলাই তার ভুল হয়েছে। যা সে পারবে না, তা কারো কাছে মুখ ফুটে বলার দরকার ছিল না বোধহয়। এখন বার বার বিফলতার স্বাদ তার গলায় জাটার মতো আঁটকে আছে।
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ২৮

৪৬.
রোদ্র ক্লান্ত দুপুর। তপসী বারান্দার দোলনায় হাটু মুড়ে বসে আছে। বাড়ি মোটামুটি ফাঁকা। রায়ারাও চলে গেছে৷ রনিত গেছে তার মাসি বাড়ি। কাল আশীর্বাদের পর রাতেই মাসির সাথে মাসি বাড়ি চলে গেছে।

সুব্রত হয়তো কোনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছে। তপসীকে বলে যায় নি। সকাল বেলাই বেরিয়ে গেছে। গাড়িও সাথে করে নেয় নি।

তপসীর দুই শ্বাশুড়ি নিজেদের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এমন অলস দুপুরে তপসী নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো বারান্দায়। রাস্তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে।

তপসী হঠাৎ দেখতে পেলো রাস্তায় একটা পুরাতন গাড়ি এসে থেমেছে। গেটের সামনে। গাড়িটি সে চিনে! তার বাবার গাড়ি। তপসী বারান্দার কর্ণারে গিয়ে দাঁড়ালো। গাড়ির ভিতর থেকে তুষার মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছে।

তপসী খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। ভাইয়ের সাথে দেখা হয় না অনেকদিন। তাই ভাই ই হয়তো জিদ ধরে দেখা করতে এসেছে। দ্রুত পায়ে দৌড়ে দরজার কাছে গেল। কলিং বেল বাজানোর আগেই তপসী দরজা খুলে দিলো।

তুষার দিদি কে দেখে দূর থেকেই ছুটে আসলো। লাফিয়ে দিদির কোলে উঠে গালে চুমু খেয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো। তপসী প্রায় কান্না করে দেওয়ার অবস্থায়। খুশিতে দম আটকে আসছে।

তুষার তপসীর গালে হাত রেখে ভীষণ আদুরে গলায় বললো,

—— দি, তুমি কেন যাও না আমায় দেখতে? একটুও মনে পড়ে না আমার কথা?

তপসী ভাইকে নিয়ে সোফায় বসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

—— আমার সোনা ভাই, তোমার কথা মনে না পড়লে কার কথা মনে পড়বে? হ্যাঁ?

তুষার কিছু বলার আগেই তপসীর বাবা আর নিতা আন্টি বাড়িতে ঢুকলো। তাদের পিছন পিছন সুব্রতও আসলো। তপসী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সুব্রতের দিকে।

নিরঞ্জন ধর এগিয়ে আসলো তপসীর কাছে। তপসী সোফা থেকে উঠে গিয়ে নমস্কার করলো সবাই কে। তপসীর বাবা মেয়ের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,

—— কেমন আছো মা?

—— অনেক ভালো আছি। তোমরা সবাই কেমন আছো?

—— ভালো আছি রে মা।

তপসী নিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—— কেমন আছো নিতা আন্টি?

—— ভালো।

সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো নিতা। তঅপসীর বাবা তপসীর হাত ধরে গিয়ে সোফায় বসলেন। বললেন,

—— দেখ জামাই বাবার কান্ড, সকাল বেলা বাসায় গিয়ে হাজির। আমি যাবো অফিসে। রেডি হয়ে নিচে নেমে গেছি। এই কতো কথা বলে নিয়ে আসলো জোর করে।

তপসী সুব্রতের দিকে তাকালো। সুব্রত মুচকি হাসলো। তপসী সুব্রতের উদ্দেশ্যে বললো,

—— আপনি বাবার সাথে বসে কথা বলুন। আমি মা’কে আর কাকি’কে ডেকে নিয়ে আসি।

সুব্রত সম্মতি জানালো। তপসী উঠে দাড়াতেই নিতা বললো,

—— আমায় একটু ওয়াসরুমে নিয়ে চল না তপসী।

—— আমার ঘর তো চিনোই। ওখানে চলে যাও।

নিতা উঠে চলে গেল। তপসী তুষারের হাত ধরে তাকে নিয়ে শ্বাশুড়ির ঘরে গেলো। তাকে ডেকে নিতে আসলো। এরপর কিচেনে গিয়ে চা বসালো। কাজের মাসি’কে বললো রান্না বসাতে আবার।

,
তপসী ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে নিতা কে দেখতে পেলো না। সুব্রতের কাছে জিজ্ঞেস করলো,

—— আন্টি কই? আসে নি এখনো?

—— না তো। তুমি উপরে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসো তো।

তপসী সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। নিতা আন্টি এমনিই ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। তপসী বললো,

—— আন্টি নিচে চলো , তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?

—— দেখছি তোর রুমটা। আগের বার এসে ঠিক মতো দেখতেই পারলাম না।

—— ঘুরে দেখবে নাকি পুরো বাড়ি?

—— না, তোর রুমটাই দেখি শুধু। দেখি বড়লোক বাড়ির বউ হয়ে কেমন সাজালি সংসার!

তপসী অপ্রস্তুত ভাবে হাসলো। বললো,

—— সংসার তো সুখ দিয়ে সাজানো হয়, টাকা দিয়ে তো শুধু ঘর সাজানো হয়।

নিতা মুখ বাঁকা করে হাসলো। বললো,

—— তোর বেশি জ্ঞান দেওয়া কথা গুলো তোর শ্বাশুড়ির জন্য তুলে রাখ, আমায় শুনাতে আসবি না।

—— যার জ্ঞান কম, তাকেই তো জ্ঞান বাক্য শুনাতে হয় আন্টি।

নিতা হেসে উঠলো। বললো,

—— তুই জীবনেও সভ্য হবি না রে?

—— অসভ্য তো তুমি । অন্যের বাড়িতে এসে তার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় তা তো জানো না দেখছি।

—— তুই যদি মনে করিস বড়লোক বাড়ির বউ হয়েই তুই আমার চোখে সম্মানিত লোক হয়ে যাবি তাহলে সেটা তোর ভুল ধারনা।

—— তোমার সঠিক ভুল ধারনা তোমার কাছেই রাখো। আর নিচে চলো। আথিতেয়তা গ্রহন করে বিদেয় হও।

—— এমন ভাবে বলছিস, যেন তোর বাড়িতে আসার জন্য মরে যাচ্ছিলাম আমরা! তোর স্বামীই তো বিনা আমন্ত্রণে বাড়ি গেল, চৌদ্দ রকম কথা বলে নিয়ে আসলো এখানে।

—— কারন সে আত্নীয়তা রক্ষা করতে জানে।

—— আত্নীয়তা রক্ষা করতে জানে? আমার তো মনে হয় না। শুনলাম কাল তোর বিদেশ ফেরত দেবরের আশীর্বাদ গেল, কই আত্নীয়তার খাতিরে নিমন্ত্রণ তো পেলাম না।

তপসী বিছানায় বসলো। হামি তুলে বললো,

—— মা বলেছিলেন তোমাদের বলতে, কিন্তু কি বলতো সবাই তো অতি নিকট আত্নীয় কে আসতে বলেছে তাই আমি ভাবলাম তোমাদের নিমন্ত্রণ করার কোনো মানেই হয় না।

নিতা রাগী স্বরে বললো,

—— বাড়ি বয়ে ডেকে এনেছিস কি অপমান করার জন্য?

—— মান থাকলে না অপমান করা হবে। আর শুরুটা কে করেছিল? আমি চাই নি, আমার শ্বশুর বাড়ির লোকের সামনে তোমার ভালো মানুষীর মুখোস খুলুক।

—— আমি ভালো মানুষীর মুখোশ পড়ি?

—— কোনো সন্দেহ আছে বুঝি তোমার?

এ পর্যায়ে সুব্রত ঘরে ঢুকলো। নিতা রাগে দিশাহীন হয়ে বললো,

—— সুব্রত, এই জন্যই বাড়ি বয়ে ডেকে এনেছো? যেন এই মেয়ে আমায় অপমান করতে পারে?

সুব্রতের কিছু বলার আগেই তপসী বলে উঠলো,

—— আওয়াজ নামিয়ে কথা বলো আন্টি। এটা আমার বাড়ি, তোমার বাড়ি না যেখানে তুমি বিনা মাইকে গলা বাজাবে।

সুব্রত তপসীর কাধে হাত রেখে বললো,

—— কি ব্যাপার তপসী, উনার সাথে এমন ব্যবহার করছো কেন?

—— যে যেটার পাওনা, সেটা তো ভোগ করতেই হবে।

সুব্রত তপসীকে টেনে নিতার থেকে একটু দূরে নিয়ে গেলো। বললো,

—— তপসী, কাম ডাউন। উনাদের আমি নিয়ে এসেছি, উনাদের অসম্মান করা তো আমাকেও অসম্মান করা। আর এখন যদি উনি রেগে চলে যায়, তোমার বাবার সম্মান এর কি হবে?

—— আমিই কেন সব সহ্য করবো? আমিই কেন কম্প্রোমাইজ করবো?

—— সহ্য করতে বলি নি তো। শুধু স্থান বুঝে ব্যবহার করতে হবে, এটা আমাদের বাড়ি। এখানে আমরা উনাকে অসম্মান করতে পারি না, সেটা যেকোনো কারনেই হোক। উনার সব তিক্ত কথা তুমি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বুঝাবে যে তুমি তার মতো নিচু নও।

তপসী আর কিছু বললো না। নিতার সামনে গিয়ে বললো,

—— সরি আন্টি। আমার এভাবে বলা ঠিক হয় নি। আ’ম রিয়েলি সরি। প্লিজ নিচে চলো।

নিতা বাঁকা হাসলো। বললো,

—— ইস, তোর এই করুণ মুখটা দেখতে যে কি ভারী সুন্দর, যদি তুই জানতি তাহলে এভাবেই সারা জীবন থাকতি।

তপসী চোখ রাঙিয়ে তাকালো। নিতা মুখ ভেঙচি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
সুব্র‍ত তপসীর সামনে এসে দাড়াতেই তপসী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সুব্রত কপাল চাপড়ে উঠলো। সে ভালো কিছু করতে গেলে কেন সবসময় হিতে বিপরীত ই হতে হয়?

সুব্র‍ত নিজেও ড্রয়িং রুমে চলে গেল। সে যে নিতা কে এ বাড়িতে এনে একটা ভুল করে ফেলেছে তা বুঝতে পারছে। সে ভাবতেও পারে নি নিতা এখনো সেই আগের মতোই রয়েছে!

চলবে……………
চলবে…………
চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here