#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ০৩
৪.
তপসীর আশীর্বাদ এর অনুষ্ঠান শুরু হবে কিছুক্ষণ পর। রূপালী পাড়ের নীল বেনারসিতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। যে কারো জন্য চোখ ফেরানো মুশকিল হবে। তপসীর শ্বাশুড়ি এসে তিনবার ঘুরে গেছে তপসীর ঘরে।
প্রতিবারই তার মুখে এক কথা,
—— আমার ছেলেটা কি ভাগ্যবান! কি ভাগ্যবান!
তপসী হবু শ্বাশুড়ির কথা শুনে লজ্জায় লাল বর্ণ ধারন করে৷ তপসীর এক মাসি এসেছে। অন্য কোনো সময় না আসলেও আপন ভাগ্নীর আশীর্বাদ এ সে না এসে পারলো না।
তপসীর মায়েরা তিনবোন ছিল। এক বোন বর্তমানে সপরিবারে ভারত থাকে। অন্য বোন দেশেই থাকে। তপসীর মাসি সযত্নে তপসীর মাথায় টিকলি লাগিয়ে দিচ্ছে৷
হঠাৎ করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—— তোকে একদম তোর মায়ের মতো দেখতে হয়েছে তপসী। জানিস তুই?
—— আমার মা সবচেয়ে সুন্দর ছিল।
—— তুই ও৷ তোর শ্বাশুড়ির তো তোকে এতোই পছন্দ হয়েছে যে বার বার ঘরের সামনে দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে।
তপসী হাসলো৷ জিজ্ঞেস করলো,
—— ও বাড়ি থেকে কয়জন এলো?
—— ত্রিশ মতোন হবে। তোর শ্বশুর, শ্বাশুড়ি থেকে শুরু করে কাছের আত্নীয় সবাই এসেছে।
—— আচ্ছা মাসি, অর্পি কেন আসলো না?
তপসীর মাসি একটু বিষন্ন হয়ে গেল। অর্পি তার একমাত্র মেয়ে। নিতার অশোভনীয় ব্যবহারের কারনে সে এই বাসায় আসে নি৷ কিন্তু তপসী কে সে আসল কারন বলতে চায় না। মেয়েটার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন আজ। এইদিনে এমন কিছু সে বলতে চায় না, যার জন্য তপসীর মন খারাপ হয়!
মাসি মৃদ্যু হেসে বললো,
—— ওর তো কোচিং এ এক্সাম আছে রে। ওর খুব মন ছিল আসার। কিন্তু এক্সাম মিস দেওয়া যাবে না রে।
—— আচ্ছা, বিয়েতে কিন্তু আসতে হবে।
—— একদম আসবে৷ সব বাদ দিয়ে হলেও আসবে।
তপসী হেসে ফেললো। সে জানে অর্পির কোনো এক্সাম নেই। সে এ বাড়িতেই আসতে চায় না।
কিছুক্ষণ পর ঘরে তপসীর কাকি আসলো। তারা মিরপুর থাকে। তপসীর কাকা সরকারি চাকরি করে। যাতায়াতের সুবিধার জন্যই মিরপুর থাকা।
তপসীর কাকি তাড়া দেওয়ার স্বরে বললো,
—— দিদি ও’কে নিয়ে আসুন ড্রয়িংরুমে। দাদা বলেছে নিয়ে যেতে।
—— তপসী উঠ মা। শাড়ি টা ঠিক করে দেই।
তঅপসী বসা থেকে উঠে দাড়াতেই মাসি পায়ের কাছে বসে শাড়ির কুঁচি টেনে ঠিক করে দিল।
৫.
ড্রয়িংরুমের সোফা সড়িয়ে ফ্লোরে শীতল পাটি বিছানো হয়েছে। সবাই সেখানে জড় হয়ে বসেছে। তপসীর লজ্জা লাগতে শুরু হলো। এই এতো গুলো মানুষ কি সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে! আড়ষ্ট হয়ে এলো লজ্জায়।
তপসীর মনে হঠাৎ আনন্দ ও হলো। এই প্রথম এতো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো তার জন্য। শুধুমাত্র তার বিয়ে উপলক্ষে। তপসী চোখ তুলে একবার সুব্রত কে খুঁজলো। তার হবু স্বামীকে কেমন দেখতে সে অনেকটাই ভুলে গেছে। শুধু মনে আছে শ্যাম বর্ণের যুবকটি অত্যন্ত হ্যান্ডসাম। যেকোনো তরুণীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতে পারে সে।
তপসী সুব্রতকে কোথাও পেল না। পাওয়ার কথাও না । আশীর্বাদ এ কোনো পাত্রই কখনো আসে না। এছাড়াও সুব্রতের ছুটি শেষ। ক্যাম্প থেকে জরুরি তলব এসেছে৷ তাই সে দুইদিন আগেই চলে গেছে। বিয়ের আগে আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। তাই তপসীর বাবা চার দিন আগে কয়েকজন নিকট আত্নীয় নিয়ে আশীর্বাদ এর পালা শেষ করে এসেছে।
তপসীর শ্বাশুড়ি সবার আগে উঠে এলো আশীর্বাদ করতে। গলায় একটা ডায়মন্ড লকেটের স্বর্ণের চেইন পড়িয়ে দিল।
মুখে বললো,
—— মাগো, আশীর্বাদ করি আমার ঘরে যেন তুমি দুধে ভাতে থাকতে পারো। আমার ঘরের লক্ষ্মী হয়ে সারাজীবন আমার ঘর আলো করে রাখতে যেন পারো।
তপসী তার পা ছুয়ে নমস্কার করলো। তার কান্না পেয়ে গেল এতো মমতা ভরা কথায়। কারো মনে কতোটা মমতা থাকলে সে ছেলের বউয়ের জন্য এতো মমতাভরা কথা বলতে পারে!
একে একে সবাই এসে নিজেদের মতো উপহার দিয়ে আশীর্বাদ করলো। তপসীর মন ভালো হয়ে গেল। সুব্রতের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
তপসী মনে মনে আপসোস করে উঠলো,
—— ইস, মোবাইল নম্বরটা তো নেওয়া হলো না।
সন্ধ্যার পর পর সবাই চলে গেল। বিয়ের তারিখ পাঁকা করে গিয়েছে তারা। আগামী বাংলা মাসের ৯ তারিখ বিয়ে। হাতে এখন মাত্র ১৪ দিন আছে। এতো যলদি তারিখ দেওয়ার কারন সুব্রত এরপর আর ছুটি পাবে না অনেকদিন। তাই যতো তাড়াতাড়ি হয় বিয়ে দিয়ে দেওয়া গেলে ভালো।
পূরোটা অনুষ্ঠানে তপসী নিতা আন্টিকে যতবার দেখেছে ততবার তার মুখে চওড়া হাসি দেখতে পেয়েছে। এমন অখুশির মধ্যেও এতো চওড়া হাসি কিভাবে দিয়ে থাকলো তপসী তা ভেবে পায় না।
তপসীর শ্বশুর যৌতুক সমন্ধে কোনো কথা বলে নি। তাদের কোনো দাবি নেই। এ কথা তপসী তার কাকির মুখে শুনেছে।
অথচ নিতা আন্টি কাল রাতেও তাকে বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে বলেছে,
—— যেই না আমার মেয়ে, মুখের নাই শ্রী, এতো বনেদি ঘরে বিয়ে দিবে বলে যে লাফাচ্ছে, যৌতুক চাইবে কমপক্ষে ২০ লক্ষ টাকার জিনিস। আমিও দেখবো এই যৌতুক কোথায় পায় আর কিভাবে হয় এই বেয়াদবের বিয়ে।
তপসীর নিতা আন্টির সামনে গিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,
—— আন্টি, দেখুন বিনা যৌতুকে আমার বিয়ে হচ্ছে। আপনি কি এখনো জোনাকি পোকা আছেন? নাকি পশ্চাৎদেশের বাতি নিভেছে?
কিন্তু নিতান্তই নিতা আন্টির সাথে কোনো রূপ কথা বলার ইচ্ছে না থাকায় তপসী কোনো কথাই বলে নি।
,
তপসীর বিয়ের শপিং নিরঞ্জন ধর নিজের হাতে করছে। নিজের পছন্দসই মেয়েকে সাজাবে। রূপালী পাড়ের খয়েরী লাল রঙের বেনারসি কিনেছে সে।
বোনের ড্রেস কালারের সাথে ম্যাচিং করে তুষারের জন্য ড্রেস কিনে দিয়েছে নিরঞ্জন ধর। তুষার এখন আনন্দিত। তার দি তাকে বলেছে, সে সত্যিই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু মাঝেমাঝে দেখা করতে আসবে।
এর ফলে দি কে আর মায়ের বকা শুনতে হবে না। দি কষ্ট পাবে না। কান্নাও করবে না। তাই সে ভীষণ খুশি।
তপসীর কাছে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তার কেমন গহনা পছন্দ। সে তার পছন্দ সম্পর্কে কিছুই বলে নি। নিজের মায়ের গহনাগুলো চেয়ে নিয়েছে। গহনা গুলো মায়ের একেকটা স্মৃতি তে ভরপুর।
৬.
বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে তপসীকে তার কাকি। কাটগোলাপের গহনা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। একদম ছোট একটা পরীর মতো লাগছে থাকে।
তপসীর গায়ের রঙ মোটামুটি ফর্সা। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা সে। মোটামুটি স্লীম পর্যায়েই পড়ে সে। বাসন্তী রঙা শাড়ি টা যেন তার শরীরে প্যাঁচিয়ে নিজের শোভা আরো বাড়াচ্ছে।
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। বাড়ির ছাদে স্টেজ সাজানো। সেখানেই বসানো হয়েছে তাকে। হলুদের অনুষ্ঠান বলা হলেও মূলত তপসী কে হলুদ ছোঁয়ানো হচ্ছে না।
হিন্দু নিয়মানুযায়ী বিয়ের দিন সকালে হলুদ ছোঁয়ানো হয়। তাই কালই একেবারে হলুদ লাগানো হবে।
হঠাৎ তপসীর মোবাইলে একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন আসে।
তপসী রিসিভ করে কানে ধরতেই একটা সুন্দর কন্ঠস্বর ভেসে আসলো অপরপাশ থেকে।
—— আমি কি আমার হবু বউয়ের একটা ছবি দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারি?
তপসী যেন মুহূর্তেই একটা হার্টবিট মিস করলো। আনমনেই বলে উঠলো,
——কতো সুন্দর করে কথা বলতে পারেন আপনি!
সুব্রত জোরে হেসে উঠলো।
—— এই প্রথম কেউ আমার কথার প্রসংশা করলো। কিন্তু প্রসংশা করার মতো কিছু কি বলেছি আমি?
তপসী লজ্জায় পড়ে গেল। এই প্রথম সুব্রতের সাথে ফোনালাপ তার। আর কারো সাথে কথা বলতে তো এতো লজ্জা লাগে না। এতো ভালোও লাগে না। তপসী নিজের মনে নিজেই নিজেকে পাগল বলে আখ্যায়িত করলো।
সুব্রত আবার জিজ্ঞেস করলো,
—— কোথায় হারিয়ে গেলেন তপসী ম্যাডাম? শুনতে পাচ্ছেন কি?
—— জ্বি পাচ্ছি। আমি ছবি কিভাবে দেখাবো আপনায়?
—— সোস্যাল মিডিয়াতে একাউন্ট ওপেন করেছো ক্যান যদি ইউজই না করো।
—— আপনি এড আছেন নাকি?
—— চেক হোয়াটসঅ্যাপ।
—— আচ্ছা আমি পাঠাচ্ছি। আর হ্যাঁ শুনুন, ছবিতে কিন্তু আমায় খুব বিশ্রী লাগে দেখতে।
সুব্রত হেসে উত্তর দিলো,
—— তোমার অপূর্ব, বিশ্রী, কুৎসিত, সুশ্রী সবই আমি দেখবো তপসী। শুধু আমিই দেখবো।
তপসী যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রইলো। এতো সুখ তার কপালে সইবে তো! #নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ০৪
তপসী ছবি পাঠিয়ে দিলো সুব্রত কে। জবাবে সুব্রত কল করলো। রিসিভ করতেই আবারো সেই মন্ত্রমুগ্ধকারী স্বর ভেসে এলো কানে।
—— থ্যাংক ইয়্যু।
—— ওয়েল্কাম। আমি কিন্তু আগেই বলেছি ছবি ভালো লাগবে না।
—— ভালো কেন লাগবে না? আসলে মা খুব করে দেখতে চাইছিলো আজ তোমায় কেমন দেখাচ্ছে। এক ঘন্টা ধরে পিছন পিছন ঘুরছে। এখন ছবি দেখিয়ে শান্ত করেছি।
—— আরে, আপনি মা’কেও দেখিয়ে দিয়েছেন!
—— মা’য়ের জন্যই তো নিলাম।
—— ওহ।
তপসীর মন একটু খারাপ হলো। সে ভেবেছিল সুব্রত’র ই দেখতে ইচ্ছে করছিলো বুঝি।
তপসী চুপ করে থাকলো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সুব্রত নিজেও চুপ করে আছে। মেয়েটা একদম বাচ্চা। এমন ছোট বিষয়ে কেন মন খারাপ করলো! সুব্রত’র নিজেরও মনে হলো, শেষ কথা টা না বললেও পারতো।
সুব্রতই আবার বলতে শুরু করলো,
—— আচ্ছা, তুমি হলুদ টিপ কেন পড়েছো?
তপসী নড়েচড়ে উঠলো। সুব্রত খেয়াল করেছে তাহলে!
তপসী বললো,
—— বাজে লাগছে?
—— উহু। বাট, লাল টিপ দিতে পারতে।
—— শাড়ির সাথে ম্যাচ করে পড়েছিলাম আরকি।
—— আমার মনে হচ্ছে লাল টিপ দিলে তোমায় বউ বউ লাগতো।
—— এখনো তো বউ হয়নি।
সুব্রত হাসতে হাসতে বললো,
—— ওকে ওকে। কাল থেকে সারাজীবন কিন্তু লাল টিপ পড়তে হবে।
তপসী লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো। উত্তর দেওয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না।
সুব্রত আবারো হাসছে। হাসির আওয়াজ ফোনের এপাশ থেকেই তপসী শুনতে পাচ্ছে। হাসি না থামিয়েই বললো,
—— এই, বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করার তো এক অসুবিধা খুঁজে পেলাম। কিছু বললেই লজ্জায় লাল হয়ে মুখের কথা হারিয়ে ফেলে।
—— আমি লজ্জা পাই নি একদম।
—— তাহলে কি পাচ্ছো?
—— কিছুই পাচ্ছি না। আমায় বোন ডাকছে। আমি রাখছি।
—— আচ্ছা, রাখছি।
৭.
বেনারসীতে একদম দেবী প্রতিমার মতো লাগছে তপসী কে। চোখে মুখে যেন এক সৌন্দর্যের আভা ছড়িয়ে পড়েছে।
আজ সকালেই অধিবাস এর সময় হাতে শাখা পলা পড়িয়ে দিয়ে হয়েছে তপসীকে। তখন থেকেই তার নিজেকে সুব্রতের বউ বউ মনে হচ্ছে।
এমন হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা হয়তো তার জন্য এতো খারাপও হয় নি। এখনো জীবনের অনেকটা পথ বাকি ছিল। মেয়েদের জন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানো, এস্টাবলিশ হওয়া টা খুব জরুরি। তবুই তপসীর মন এই বাড়িতে টিকছিলো না।
ভাগ্য থাকলে নিজের জন্য বিয়ের পরেও কিছু করা যাবে৷ কিন্তু সৎ মায়ের কটু কথা রোজ শুনতে শুনতে গা রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। এখন আর সহ্য করা দায়, মুশকিল হয়ে পড়েছে৷
বাড়ির সামনের উঠোনে বিয়ের কুঞ্জ সাজানো হয়েছে। বরযাত্রী এখনো এসে পৌঁছায় নি। রাত একটা বেজে পচিশ মিনিটে লগ্ন।
বরযাত্রী এসে পৌঁছালো সাড়ে এগারোটা নাগাদ।
বর বাড়িতে প্রবেশ করার পরেই তপসীর মাসতুতো বোন অর্পি ছুটে এলো।
—— দি, তোর বর কে কি সুন্দর দেখতে রে। একদম হিরো হিরো লাগছে।
—— তোকে বলেছি এতো খেয়াল করে দেখতে? নজর লাগবে তো।
—— ওমা, আমি তো তোকে জানাতেই ভালো করে দেখে এলাম।
—— শোন না, তুই আমার পাশে বসে থাক না বোন। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে।
—— এই বোকা। এই খুশির দিনে অস্বস্তি কেন লাগবে!
—— হাজারটা মানুষ এসে দেখে যাচ্ছে। কতো শত ছবি তুলছে। আমার লজ্জা লাগছে। তুই একটু বস না আমার পাশে।
—— আচ্ছা বসছি। এমন প্যানিক করিস না তো।
তপসীর ঘর এখন সম্পূর্ণ খালি। শুধু অর্পি বসে আছে পাশে। তপসী জিজ্ঞেস করলো,
—— নিতা আন্টি কই রে?
—— আরে তুমি জানো না, মায়েদের তো সন্তানের বিয়ে দেখতে নেই। সে সেই নিয়ম পালন করছে।
অর্পি নিজের কথা শেষ করেই হেসে লুটপাট হতে শুরু করলো। যাকে সহ্য করতে পারে না, তার বিয়েতে কি সুন্দর করে মায়ের সব দায়িত্ব পালন করছে।
হাসি থামিয়ে অর্পি কাঠ কাঠ হয়ে বললো,
—— সব লোক দেখানো ভালোবাসা বুঝছিস। কেউ যেন তার উপর আঙুল না তুলতে পারে।
—— বাদ দে তো।
,
মুখের সামনে থেকে পান পাতা সড়াতেই সুব্রতের হাসিমাখে মুখ দেখতে পেল তপসী। এক মিনিটের জন্য স্থির হয়ে গেল সে। শুভ দৃষ্টি!
এতো ক্যান ভালো লাগছে সব! তপসীর মনে হলো সে হাওয়ায় উড়ছে। সত্যিই সে হাওয়ায় উড়ছেই। পিড়িতে বসিয়ে চারজন কোলে তুলে কুঞ্জের সামনে নিয়ে এসেছে তাকে। বিয়ে মানেই কি ভালোলাগার এক বাক্স অনুভূতি?
শুভ দৃষ্টির পরই মালা বদল হলো। এরপর বিয়ের পিড়িতে দুজনকেই বসানো হলো।
পুরোহিত মন্ত্র পড়ছে। সুব্রত তপসীকে আড়চোখে তাঁকিয়ে দেখছে বারংবার। মেয়েটা কে আজ একটু বড় বড় লাগছে।
সুব্রতের মা তার জন্য এমন একটা বাচ্চা বউ কেন এনে দিলো। মেয়েটাকে দেখতেই একদম আদর আদর লাগে। অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। এর নামই হয়তো বিয়ে। এক অদৃশ্য শিকলে বেধে দেয় দুটো মানুষ কে। দুটো পরিবারকে।
কুঞ্জের মাঝে রাখা মঙ্গল ঘটের উপর সুব্রতের হাতের উপর তপসীর হাত রেখে গামছা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছে। তার সাথে সাথে ঠোঁট নাড়িয়ে মন্ত্রের উচ্চারন করছে বর কনে।
,
লাল রাঙা সিঁদুরে ছেঁয়ে গেছে তপসীর সিঁথি। নাকে উপর পড়েছে খানিকটা। পিছন থেকে কয়েকজন রসিকতা করে বলে উঠলো,
—— নাক রাঙা হয়ে গেল যে। বউ তো ভাগ্যবতী। বরের সোহাগ বেশি পাবে।
সিঁদুরের মতো তপসীও রাঙা হয়ে উঠলো। সত্যিই কি সে ভাগ্যবতী! অনেক ভাগ্যবতী!
সত্যিই কি স্বামী সোহাগ দিয়ে জীবন ভরে থাকবে তার!
যজ্ঞের আগুনে কুলোয় করে খই দেওয়ার সময় সুব্রত তপসীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ধারালো। তপসী কেমন কেঁপে উঠলো। সুব্রত তার এতো কাছে। ইস, মাথা ঘুরাচ্ছে, জ্ঞান হারিয়ে যাবে কি এখনই!
সাত পাঁকে ঘোরার সময় বিভিন্ন প্রতিজ্ঞা করলো তারা একে অপরকে। তৈথীর পা অনবরত কাঁপছে। সারাদিনের অভুক্ত সে। এরপর এতোক্ষণ বসে থেকে পা অবশ মতোন হয়ে গেছে। ঘোরার শক্তি যেন পাচ্ছে না।
তপসীকে পিছন থেকে তার মাসি ধরে আছে। তবুও অনরত কাঁপছেই পা। সুব্রত হঠাৎই তার একটা হাত ধরলো শক্ত করে। তপসী চোখ নামালো হাতের দিকে। কি জানি সুব্রত কিভাবে বুঝলো তার শরীরের অবস্থা!
সাত পাঁক ঘোরা শেষ হলে বাকি আচার অনুষ্ঠান শেষ করা হলো। বিয়ের যাবতীয় কাজ শেষ হওয়ার পর এবার বিদায় এর পালা। তপসীর বুক চিড়ে আর্তনাদ বেড়িয়ে আসছে৷ এতোবছর যেই বাড়িতে থেকেছে তা ত্যাগ করা সত্যিই কঠিন।
তপসী নিজেই চেয়েছিল বাড়ি থেকে চলে যেতে৷ এখন তারই বুক ফেটে যাচ্ছে চলে যেতে। তুষার দূরে দাঁড়িয়ে অনবরত কাঁদছে। ছেলেটাকে এতো করে বুঝালো তপসী তাও আজ কেন এতো কাঁদছে!
তপসী চারপাশে তার বাবা কে খুঁজলো। বাবা কোথায় কে জানে! একবার এসে দেখাও দিল না কেন। তপসীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সুব্রত হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গাড়ির দিকে তপসীকে। তপসী এক সময় সুব্রতের কাঁধে মাথা রেখেই কান্না করতে শুরু করলো। সুব্রত অতি যত্নে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো৷ হাত ধরে উঠিয়ে বসালো।
গাড়িতে বসেও অনবরত কাঁদতেই থাকলো তপসী। সুব্রত মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। বললো,
—— এই বাচ্চা মেয়েটা কেন বিয়ে দিল আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি!
তপসী কোনো মতো উত্তর দিলো,
—— আমি বাচ্চা না। আ’ম নাইন্টিন।
—— ওহ বাব্বাহ, কত্তো বড় মেয়ে। আমার থেকে একদম আট বছরের বড় তুমি!
—— আমার বয়স ঠিকই আছে। আপনারই বিয়ের ডেট এক্সপায়ারড হয়ে গেছে।
—— এখন এই ডেট ফেইল মাল নিয়ে কি করবে তুমি বউ?
—— আমি কাঁদছি আর আপনি মজা করছেন!
—— যেন আর না কাঁদো তাই তো মজা করছি। আমার বাচ্চা বউটার চোখে এতো জল মানায় না। যলদি হাসো, হাসো।
তপসী চুপ করে মাথা এলিয়ে দিলো কারের সিটে। সুব্রত তপসীকে টেনে তার মাথা নিজের কাধের উপর রাখলো। তপসী সুব্রতের এক হাত জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
তপসীর নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। চাওয়ার তুলনায় অনেক বেশিই পেয়েছে সে।
চলবে……….
চলবো……….