#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ৪১
৬৭.
সুহানার শরীর দরদর করে কাঁপছে। তার সত্যিই ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। সেফটি সাথে রাখা দরকার ছিল। সুহানা দুই কদম পিছিয়ে গেল। হঠাৎই দৌড় দেওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তপসী হাত ধরে আটকে ফেললো।
তপসী বললো,
—— আমার শক্তি অথবা অভিজ্ঞতা আপনার চেয়ে কম হতেই পারে কিন্তু খানিক সময় আটকে রাখতেই পারবো।
এরপরই রনিতের উদ্দেশ্যে বললো,
—— রনিত দা, তোমার বউ কে কোলে করে নিচে নিয়ে চলো। নতুন বউদের এমনিতেও হেটে কুঞ্জ তে যেতে হয় না।
রনিত অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে রইলো তপসীর দিকে। তার মাথা কাজ করছে না। তপসী কি তাকে সত্যিই বিয়ে করতে বলছে? কিন্তু কেন! মেয়েটা এমন জানার পরও কেন ওর সাথেই বিয়ে দিতে চাইছে?
রনিত এক নজরে তাকিয়ে রইলো তপসীর দিকে। ততক্ষণে তপসীর হাতের বন্ধন থেকে সুহানা নিজেকে অনেকটাই আলগা করে নিয়েছে।
উপায় না দেখে সুব্রতই এগিয়ে আসলো। সুহানা কে শক্ত করে ধরে কোলে তুলে নিলো। তপসী বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে সুব্রতের দিকে তাকালো।
সুহানা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সুব্রতের শক্তির সামনে সে সামান্যই। সুব্রত তপসী দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হেসে বললো,
—— বিয়ের কনে কে তো তার ভাই, দুলাভাই পিড়িতে তুলে কুঞ্জ অব্দি নিয়ে যায়। এখানে ওর তো ভাই ও নেই, পিড়িও নেই। তাই আমিই কোলে নিয়ে নিলাম। আফটার অল ভাসুর তো বড় ভাইয়ের মতোই।
সুহানা রাগী স্বরে বললো,
—— লিভ মি সুব্রত। তোমাদের কি মনে হচ্ছে আমি ভয় পাচ্ছি? দেখো আমি জানি আমার সাথে তুমি তোমার ভাইয়ের বিয়ে কিছুতেই হতে দিবে না। শুধু শুধু ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমি ভয় পাচ্ছি না। যাস্ট লিভ মি।
তপসী রনিতের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো নিচে। সুহানার কথা শুনতে পেয়েই বললো,
—— আমরা জানি আপনি মিথ্যা বিয়ের ভয় পাবেন না। কিন্তু এটা তো মিথ্যা না। আপনার বিয়ের প্লান অভিনয় ছিল, আমরা অভিনয় করতে আসি নি। বিয়ে সত্যিই হবে।
সুহানা দ্বিগুণ রেগে গিয়ে সুব্রতের কান টেনে ধরলো। সুব্রত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাত চেপে ধরলো শক্ত করে। সুহানা তপসীর উদ্দেশ্যে বললো,
—— তোর মনে হচ্ছে বিয়ে করিয়ে ফেললেই সব মিটে যাবে? তোর মতো রাম বলদকে সুব্রত বিয়ে করেছে ভাবতেই আমার হাসি পাচ্ছে।
কথার মাঝে একটু দম নিলো সুহানা। আবার বলতে শুরু করলো,
—— আর শোন, বিয়ে করাবি তো, ওকে চল। আমিও বিয়ে করবো। এখন তো পরিবারের সম্মান ডুবেছে। এরপর তোদের সংসার টাও ডুববে। দেখে নিস।
তপসীর সাথে সুহানার এমন টোনের কথা শোনে সুব্রতের ইচ্ছা করলো কোল থেকে হুট করে সুহানা কে ফেলে দিতে। এটলিস্ট কোমড় টা ভেঙেই যাবে!
সুব্রত অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করলো। এখন মাথা গরম করা যাবে না। সে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে কেন তপসী বিয়ে করাতেই চাচ্ছে।
রনিত কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই তপসী হাতে ইশারায় রনিতকে থামতে বললো। সুহানার সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো,
—— আমি বয়সে, শিক্ষায়, সৌন্দর্যে সব দিক থেকেই আপনার ছোট। কিন্তু কি বলুন তো, আমার ধৈর্য্য শক্তি অনেক। আর আর, আপনাদের মতো কিছু মানুষকে কিভাবে সোজা করতে হয় তা আমি জানি।
সুহানা বিদ্রুপের স্বরে বললো,
—— খুব ভালোই মানুষকে সোজা করতে পারো তো তুমি৷ তাই তো সৎ মায়ের তাড়া খেয়ে বিয়ে করে নিলে।
তপসী চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রনিতের কাছে তো সুহানা একটা বিশ্বাসের জায়গাই ছিল। তাই হয়তো এই কথা টা বলেছে।
নিজেকে শান্ত করে সুহানার উদ্দেশ্যে তপসী বললো,
—— সবাইকে তো ছেড়ে কথা বলি না। সৎ মা কে কিছু বলি নি কারণ মা যেমনই হোক সম্মানের, কিন্তু এ ব্যাপার টা তো আপনার ক্ষেত্রে ভাবতে হবে না। আফটার অল বিয়ের পরই আপনি সম্পর্কে আমার ছোট হয়ে যাবেন। তখন আমি আপনাকে শাসন করার অধিকারও পাবো।
৬৮.
সোফার উপর হাতের কব্জি আর পা বেধে বসিয়ে রাখা হয়েছে সুহানা কে। সে অকথ্য ভাষায় কতোক্ষণ গালাগালি করে তো কতোক্ষণ দু নয়নে রাগ নিয়ে পুরো সেন্টারে চোখ বুলায়।
রনিত সুহানার সামনে বসে আছে হালকা ঝুকে। সুহানা রনিতকে বললো,
—— তোমার বিয়ের সাধ জেগেছে খুব? তোমার জীবন আমি নষ্ট করে দিবো।
—— অলরেডি যা করার করে ফেলেছো। এবার করার পালা আমার। তুমি শুধু অপেক্ষা করো সুহানা। তোমার ভাগ্যই বদলে যাবে একদম।
—— তোমাকে আমি এতোদিন ভালো, সহজ সরল ভাবতাম, অথচ তুমিও এই দুই উজবুকের মতোই। আমি কাউকে ছাড়বো না। সুব্রতের এক ভুলের পরিনতি আজ দেখলে। এখন তোমার এই অন্যায়ের পরিনতিও তুমি একদিন দেখবে।
—— আমিই ওয়েট করবো। তুমি আমার কতোভাবে কতো নিচে নামতে পারো তা না দেখে কি শান্তি পাবো মনে হয় তোমার সুহানা?
—— রনিত প্লিজ লিভ মি। আমার হাতের স্কিন ছিলে গেছে। জ্বালা করছে। খুলে দাও প্লিজ।
—— খুলে তো দিবোই। বিয়ে টা হয়ে যাক।
—— প্যেরেন্টস ছাড়া বিয়ে হয় না। বিয়ের চৌদ্দ রকমের নিয়ম। একটাও করা হয় নি। তুমি কি মনে করো শুধু সিঁদুরে কপাল রাঙিয়ে দিলেই হয়ে গেল বিয়ে?
—— হয় তো সুহানা। তুমি কখনো পালিয়ে বিয়ে করার কথা শুনো নি? ওরাও এমন শর্টকাটে বিয়ে করে। পুরোহিত মশাই মাত্র বললো কি কি করতে হবে।
—— আমি আমার বাবা মা ছাড়া কোনো ভাবেই বিয়ে করবো না, নেভার।
—— তোমার বাবা মার সামনেই গ্র্যান্ড সেরিমনি হবে একদিন। কিন্তু এখন না। যে বাবা মা মেয়ের এমন বিশ্রী কাজে সাহায্য করে আমি শুধু তাদের মানসিকতা দেখি।
—— মানসিকতা তোমার দেখতে হবে না। যখন চোখের সামনে মেয়ে মরতে বসে, ডিপ্রেশনে পাগল হয়ে যায় তখন বাবা মা এরচেয়ে অনেক বেশি অন্যায় কাজও করে ফেলতে পারে। দিস ইজ কল্ড লাভ।
—— আর সেই ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে তোমার বাবা মায়ের সাহায্যে এমন জঘন্য একটা কাজ করলে তুমি।
—— আমি কি করবো তা অবশ্যই তোমাকে শিখাতে হবে না।
—— অবশ্যই শিখাতে হবে। কারন তোমার পুরো ভবিষ্যৎ টাই আমার হাতে। তোমার জীবনটাই আমার হাতের মুঠোয়।
সুব্রত এসে বললো,
—— সব রেডি ওদিকে। চলে আয় ওকে নিয়ে।
রনিত সুহানার গালে আঙুল দিতে স্লাইড করে বললো,
—— চলো বেবি। তোমার ব্যাড টাইম শুরু হচ্ছে এখন থেকে। কাউন্টিং স্টার্টস নাউ।
সুহানা লালাভ নয়নে তাকিয়ে রইলো রনিতের মুখের দিকে।
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ৪২
৬৯.
সুহানা আপ্রাণ চেষ্টা করছে হাত খোলার। কিন্তু সকল চেষ্টাই বৃথা হচ্ছে।
সুব্রত হঠাৎ সুহানার সামনে এসে দাঁড়ালো। সুহানা আকুতি ভরা নয়নে তাকালো সুব্রতের দিকে। সুব্রত হাই তুলে আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগলো।
সুব্রত নিজের ফোনের ডায়ালা প্যাড সুহানার দিকে ঘুরিয়ে দেখালো। ওরপর বলল,
—— তোমার বাবা কিংবা মায়ের সাথে কথা বলবে? বিয়ের লাস্ট মুহূর্তে এসে? তারা হয়তো চিন্তায় আছে তুমি তোমার কুৎসিত প্ল্যান কাজে লাগাতে পারলে কি না।
সুহানা এতোক্ষণ আকুতি ভরা নয়নে তাকিয়ে ছিল।সুব্রতের এমন কথায় জ্বলে উঠলো সে। বললো,
—— আমার মা বাবাকে টানবে না এর মাঝে।
—— বিয়ে করার আগে পারমিশন নিবে না? তারা তো আর জানতো না যে তুমি সত্যি সত্যিই আজ বিয়ে করে ফেলবে।
সুহানা এবার আরো তেজী সুরে বললো,
—— শুয়োরের বাচ্চা, তুই যা পারিস কর। আর কোনো বাধা এই সুহানা দেবে না। কিন্তু মনে রাখিস, এর ফল তোদের ভোগ করতে হবে।
—— মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ সুহানা! বাবা মা তুলে গালি দিবে না।
সুহানা বিদ্রুপের হাসি হেসে বললো,
—— কেন? তোমার বাপ মা তুলে গালি দিলে বুঝি তুমি মারবে আমায়? নারী নির্যাতনের মামলা টা ঠিক মানতে পারবে তো তুমি?
—— হাহ্! করো মামলা। পাওয়ার তোমার চেয়ে আমারই বেশি আছে। চাইলেই সব এমনভাবে থামিয়ে দিবো যে কাকপক্ষীও কিছু টের পাবেনা। যদিও কখনো ক্ষমতা অসৎ ভাবে ব্যবহার করতে চাই নি, কিন্তু আমার ভাইয়ের অপরাধীকে আমি যেকোনো পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দিতে পারি।
—— সুব্রত শু…..
সুব্রত সুহানা কে থামিয়ে দিলো। সুহানা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
—— বলতে চাও কথা বাড়ির কারো সাথে? না বলতে চাইলে বলো, আমি তো আর জোর করছি না৷
—— বলবো না। আমার বাবা যদি এ মুহূর্তে জানতে পারে আমার সাথে তোমরা কি করছো, একেকটা কে এখনই লাশ বানিয়ে ফেলবো।
—— ওহ, তাহলে জানাচ্ছো না কেন? তুমিও তো আমাদের করুণ পরিণতিই চাও।
—— কারণ আমি চাই না তোমাদের মতো কুকুরকে মেরে আমার বাবা হাত নোংরা করুক।
—— উফ! উই নো সুহানা। খালি কলসি বাজে বেশি।
৭০.
বাড়ি অনেকটাই খালি। সবাই বরযাত্রায় গেছে। রনিতের মা খালি ঘরে শুয়ে ছিল। সারাদিনের ক্লান্তিতে তার শরীর অবসাদ হয়ে এসেছিল। শোয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঘুম লেগে যায় চোখে। তাই বিয়ে বাড়ির খবর আর ফোন করে নেওয়া হয় নি।
কলিং বেল বাজতেই কাজের মাসি গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সুব্রতের বাবা মা কে দেখে খানিক চমকালো। পিছনেই বাকি সবাই ও দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে কানাঘুষা করতে ব্যস্ত।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেই সুব্রতের বাবা চিৎকার করে উঠলেন সুব্রতের মা’য়ের উদ্দেশ্যে,
—— এতো বার করে জিজ্ঞেস করলাম, এতোবার করে যে কি হয়েছে! তোমার ছেলে এমন লায়েক হয়ে গেছে যে আমাদের কোনো জবাবদিহিতাই করে না? কেন? কি এমন হয়ে গেল যে বিয়েটা হলো না? কিচ্ছু হলো? বললো না কেন কি হয়েছে? আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো, এখন ওরা কই? ওর কেন আসলো না বাড়িতে?
সুব্রতের মা স্বামীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো,
—— ঘরে চলো তুমি। তোমার প্রেশার ফল করবে।
—— আমার চিন্তা এখন না করলেও চলবে। আগে বলো কি এমন হয়েছে?
—— আমি তো জানি না।
—— তুমি জানো না আমি জানি না, সব জানার দ্বায়িত্ব নিয়ে বসে আছে তোমার ছেলে। এতোগুলো প্রশ্ন করার পরও সে মুখ খুললো না!
—— তখন কি বলার মতো পরিস্থিতি ছিল? তুমি ঘরে চলো, কিছু খেয়ে ঘুমাবে। নিশ্চয়ই খুব জটিল কিছু হয়েছে। নয়তো সুব্রত এমন করার ছেলে না। আর ওইখানে তো সুহানাদের বাড়ির কেউ ই উপস্থিত ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে কি ওর মাথাই ঠান্ডা ছিল?
—— আমি জানি সুব্রত কারন ছাড়া কিছুই করে না। কিন্তু একটু তো বলতে পারতো। রনিতটা কোথায় ছিল? ছেলেটার মনটা কী ভার হয়ে গিয়েছিলো দেখেছিলে তুমি অনুপমা?
—— আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ড্রয়িং রুম এর পাশ কাটিয়ে নিশ্চুপ হয়ে হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেল রনিতের বাবা। সারা রাস্তা তার পাশে বড় ভাই কান্না করতে করতে এসেছে। তার নিজের মনের হালও ভালো নেই। ছেলেটার বিয়ের দিন এমন একটা কান্ড কেন ঘটতে হলো!
বিছানায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো সে। রনিতের মা ভাসুরের চিৎকার শুনে উঠে বসেছিল। এমন আচমকা ঘুম ভাঙায় সে থম মেরে ছিল। এছাড়া বুঝতেই পারছিলো না, সুব্রতের বাবার কন্ঠ এই সময় সে কিভাবে শুনতে পেলো! তাদের তো বিয়ের ওখানে থাকার কথা।
স্বামীকে হুট করে এসে গম্ভীর ভাবে বিছানায় বসতে দেখে ভড়কে গেলেন তিনি। তারা এ সময় বাড়িতে কেন আসলো? নাকি সকাল হয়ে গেছে? তড়িঘড়ি করে ঘড়ির দিকে তাকালেন আরেকবার। না, সকাল হয়নি। বারোটা বেজে আঠারো মিনিট।
বিস্মিত ভাব কাটাতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো তার। স্বামীর কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—— তোমার কি শরীর খারাপ করেছে? বিয়ে থেকে এই সময়ে কেন ফিরে আসলে? তোমার না রনিতদের সাথে সকালে ফেরার কথা ছিল?
রনিতের বাবা কিছু বললো না। কি বলবে খুঁজে পেল না। রাগ, দুঃখ, কান্না সব মিলিয়ে কেমন এক বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে। এমনটা কি কেউ কখনো কল্পনা করতে পারে? ছেলের বরযাত্রা নিতে গিয়ে চূড়ান্ত অসম্মানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়? এমন অসম্মানের কথা মুখে বলতেও তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
রনিতের মা স্বামীর থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
—— এই, শরীর কি বেশি খারাপ তোমার? আমি চা করে দিবো?
—— চুপ করো একটু। আপাতত কিচ্ছু লাগবে না, শুধু একটু শান্তি ছাড়া।
—— এই কি হয়েছে? এমন কথা বলছো কেন? সুহানার বাড়ির লোকের সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?
—— ওই মেয়ের নাম মুখেও আনবে না। আমার ছেলেকে কষ্ট দেওয়ার ফল ও পাবে। আমি জানি না কেন এমন বাজে একটা নাটক করলো! তবে কারণ যাই হোক, এর ফল হবে ভয়াবহ।
—— কি বলছো তুমি? রনিতের কিসের কষ্ট? বলছো না কেন কিছু?
রনিতের বাবা ও বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে সব বলতে লাগলো। সব শুনে রনিতের মা চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। সবটা তার উলোটপালোট লাগছে।
খানিক তব্দা মেরে রইলেন তিনি। তারপর বলতে লাগলেন,
—— সুহানাদের বাড়িতে হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে। নয়তো এমন কি হয়? তোমরা যাচাই বাছাই করে আসবে না? হুট করে চলে আসলে!
—— সুব্রত পাঠিয়ে দিলো। আর নাহলেও আমরা আধা ঘন্টা সময়ে ওদের একশো বারের উপরে ফোন কল করেছি। আর সমস্যা থাকলে তো কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে জানিয়ে দিবে নাকি? আমরা অপেক্ষা করতাম। আর কি এমন প্রলয় হয়ে গেছে ওদের বাড়িতে যে কেউ আমাদের রিসিভ করার জন্যও আসলো না?
—— তোমরা হয়তো ভুল সেন্টারে চলে গিয়েছিলে।
—— স্টপ টকিং ননসেন্স। আমাদের কপালে কি বড়ো করে বলদ লেখা আছে?
—— দেখো, আমার মনে হচ্ছে…
—— কিসের দেখা দেখি? ছেলের বিয়ে নিয়ে ছেলে খেলা হচ্ছে আর সে এখানে ওদের পক্ষে সাফাই গাইছে!
৭১.
রাত তখন সাড়ে তিনটা বাজে। পাড়া প্রতিবেশী সবাই চলে গেছে। যেসব আত্নীয়দের বাসা কাছে ছিল তারাও চলে গেছে। নিকটাত্মীয় কয়েকজন বাড়িতে রয়ে গেছে। রায়া সবাই কে খাইয়ে দাইয়ে দিয়েছে। কয়েকজন ঘুমাতেও চলে গেছে।
সুব্রতের বাবা ড্রয়িংরুমের সোফাতেই আধশোয়া হয়ে রইলো। রায়া অনবরত পায়চারি করছে। সে নিজেও কিছু বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। তার দুই ভাই তো তাকে কিছুই বলে নি। কি এমন হুট করে হয়ে গেছে।
রায়া সেল ফোনটা দিয়ে আবার কল করলো সুব্রতের নাম্বারে। এই নিয়ে বোধহয় কয়েক’শ বার কল করা হয়ে গিয়েছে। একবারো রেসপন্স পাওয়া যায় নি।
কলিং বেল বাজলো হুট করেই। রায়া এক প্রকার দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠে জোরে ডেকে উঠলো,
—— মা, কাকি দেখো ওরা কি করে এসেছে।
সুব্রতের মা দ্রুত দরজার সামনে আসলো। নববধূ রূপে সুহানাকে দেখে ঝটকা খেল যেন সে। এই মেয়েকে বিয়ে করে আনার হলে এতো কাহিনির কি দরকার ছিল?
সুব্রতের মা কৌতূহল মেটাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলো,
—— ওকে বিয়ে করতেই যদি হতো তাহলে এতো বড় নাটক কেন করলি তোরা?
সুব্রত বললো,
—— মা, ওতো কৈ মাছ। বুঝলে, খালি হাতে ধরতে চেয়েছিলো রনিত, তাই কাটা দিয়ে পালাতে চেয়েছিলো। এখন ছাই দিয়ে চেপে ধরতেই একদম নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে কেমন দেখো।
সুব্রতের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না তার মা। তপসীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—— তুমি অন্তত সহজ বাংলায় ভেঙে বলে বুঝাও কি হয়েছে?
—— মা সবই বুঝবে। আগে নতুন বউ কে বরণ করে ঘরে তো নিয়ে যাও।
রনিতের মা পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—— সব কি তোমাদের কথা মতোই হবে? আমরা যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর তো দিবে! আর রনিত, তোর বাবা যা বললো, এর মানে তো তোকে খুব অসম্মানিত হতেই হয়েছে। এরপরও একে কেন বিয়ে করেছিস?
—— অসম্মানিত হতে হয়েছে বলেই তো বিয়ে করে নিয়ে আসলাম। অসম্মান না করে বিয়ে ভেঙে দিলে তো আজ ওর এই দশা হতো না মা। বিশ্বাস রাখো, ভুল কিছুই করি নি।
—— তোর উপর বিশ্বাস করেই তো এই মেয়েকে পুত্রবধূ করতে চেয়েছিলাম। এই মেয়ের পরিবার যা রূপ দেখালো!
সুহানার গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। সুযোগ পেয়ে এরা যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে। এক এক জনকে এর শাস্তি পেতে হবে বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে।
তপসী রায়া কে বললো,
—— রায়া দি বরণ ডালা টা নিয়ে আসো না। নতুন বউকে এতোক্ষণ বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখবে?
তপসীর কথার পিঠে সুব্রতের বাবা বললো,
—— তপসী, তোমাদের এখানের কাজ শেষ হলে আমার ঘরে এসো তো। কথা আছে।
সুব্রতের বাবা নিজের কথা শেষ করেই নিজের ঘরে চলে গেলো। তপসী এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যা করতে চাইছে তা সব ঠিক ভাবে হলেই হলো। এখন সবাইকে তার কথা বুঝাতে পারলেই হবে।
রনিতের মা এগিয়ে গিয়ে বরণ ডালা দিয়ে বরণ করতে লাগলো। সুব্রতের মা উলুধ্বনি দিতে লাগলো। উলুধ্বনির শব্দ শুনে কয়েকজন বাহিরে বের হয়ে আসলো রুম থেকে।
সুব্রতের দৃষ্টি তাদের দিকে পড়তেই সুব্রতের মেজাজ চটে গেল। তার আত্নীয়দের উপর নয়, বরং সুহানার উপর। মানুষের কৌতুহল থাকেই আর এইজন্যই তারাও কি হচ্ছে দেখতে বের হয়ে আসছে।
সুব্রতের এক দূর সম্পর্কের পিসিমা বলে উঠলো,
—— এই মেয়ের সাথেই রনিতের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না? এতো কাহিনি…
সুব্রত দাতে দাত চেপে বিনয়ী ভাবেই বললো,
—— কাল সারা সকাল সারা দিন পাবেন এসব আলোচনার জন্য। আপনারা এখন ঘরে গিয়ে ঘুমান। আমাদের নিজেদের ও ঘুমের দরকার।
সুব্রতের কথার পিঠে আর কেউ কথা বললো না। ধীর পায়ে চলে গেল ঘরে। সুব্রত জানে এরা এখান থেকে চলে গেলেও এদের কানাঘুষা আজ সারারাত কেন আগামী কয়েক বছরেও শেষ হবার নয়।
চলবে……..
চলবে……..