#নিঃশ্বাসে_তুই |২৪|
বধূ সেজে বসে আছে পুষ্প। ভাবভঙ্গি পাথর মূর্তি। সাবিনা বেগম বাহিরে থাকা দরজা লক করে রেখে গেছেন। কাউকে পুষ্প’র সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিচ্ছেন না। তার এক কথা আগে বিয়ে সম্পন্ন হবে তারপর পুষ্পকে সবাই পাবে। প্রমি মায়ের কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে বিরক্ত। সকলের সামনে তার মানসম্মান শেষ করে দিল একেবারে। বিভোর দের পরিবার তার মায়ের সম্পর্কে কী ভাবছে এটা নিয়ে তুমুল ভাবনায় সে। অহমি অনেক বার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। সে বেশ বুঝতে পারছে এসব সাবিনা বেগমের কারসাজি। জোর পূর্বক কিছু করতে এগোতেই বিভোর ওকে ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। সবদিক নলেজে এনে অহমিও স্থির হয়ে আছে। কিন্তু ভেতরটা তার পুড়ে ছারখার। শত হোক ভাইয়ের হবু শ্বশুর বাড়ি এটা। সিনক্রিয়েট মানায় না।
—-
বরযাত্রী চলে এসেছে। অহমির অস্থিরতা বেড়েই চলেছে।এখন পর্যন্ত পুষ্প’র নাগাল সে পায়নি। সাবিনা বেগম এখনো দরজা খোলেননি। তবে একটু পরেই খুলবেন হয়তো। পুষ্পকে একেবারে বিয়ের আসরে নিয়ে যাবেন। অহমি সেই মুহূর্তটার অপেক্ষাতেই আছে। যখনই পুষ্পকে বের করবে চলতি পথেই চেপে ধরবে। সব প্রশ্নের উত্তর জেনে তবে ছাড়বে। প্ল্যান মোতাবেক সে দরজার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। অবশেষে চলেও এলো সেই কাঙ্খিত মুহুর্ত। সাবিনা বেগম এসে দরজার লক খুললেন। ক্ষণকালের মধ্যে সে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো বধূ রুপী পুষ্প। সাবিনা বেগম তাকে শক্ত হাতে ধরে নিয়ে আসছেন। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। অহমি মনে সা’হ’স জুগিয়ে ছুট্টে এসে সামনে দাড়িয়ে গেল ওদের। সাবিনা বেগম কটমট চোখে চাইলেন। কিন্তু পুষ্প একটিবারের জন্যও চেয়ে দেখল না। মূর্তির মতো সম্মুখে চেয়ে রইল। অহমি অস্থির হয়ে কিছু প্রশ্ন করতেই সাবিনা বেগম তেতে উঠলেন। বললেন,
“এই মেয়ে এখানে কী চাও? সরো বলছি। পাত্রপক্ষ অপেক্ষা করছে। লেট হচ্ছে আমাদের।”
অহমি অনেক আকুতি মিনতি করল কিন্তু সাবিনা বেগমের মন গললো না। তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল। পুষ্প কিছুই বলছে না। এখনো সেভাবেই চুপচাপ। সাবিনা বেগম পুষ্পকে নিয়ে চলে গেলেন। অহমি হতাশ হয়ে দাড়িয়ে রইল।
পুষ্পকে বসানো হয়েছে তার হবু বরের পাশে। পুষ্প একবারের জন্যও ফিরে দেখল না সেদিকে। অহমি দূর থেকে দেখল লোকটিকে। কেমন জানি বোকা বোকা টাইপ।
হঠাৎ বিভোর এসে অহমির পাশে দাড়াল। তার হাতে ফোন৷ হয়তো কথা বলছিল। বিভোর অহমির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। অহমিও একটু হাসার চেষ্টা করল।
—-
এতক্ষণের কঠোর পুষ্প এবার যেন গলে গেল মুহুর্তেই। নিজেকে ধরে রাখা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল। বিভোরকে দেখা মাত্র তার মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। দিন দুনিয়া ভুলে বিয়ের আসর থেকে নেমে ছুটল বিভোরের কাছে।
অকস্মাৎ কেউ জড়িয়ে ধরায় ভড়কে উঠল বিভোর। একই অবস্থা ওখানে উপস্থিত সকলের। বিয়ের কনে পাত্রপক্ষের সামনে অন্য পুরুষকে জড়িয়ে ধরে আছে ব্যাপারটা সমালোচক। সকলের মধ্যে ইতিমধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। হুঁশে আসতেই বিভোর টেনেটুনে নিজের বক্ষপিঞ্জর থেকে আলাদা করে পুষ্পকে। কঠিন গলায় বলে,
“এসব কী হচ্ছে পুষ্প?”
পুষ্প যেন নিজের মধ্যে নেই। বিভোরের কলার চেপে ধরে পাগলের মতো আচরণ করছে সে। বারেবারে বলছে,
“আমার আপনাকে চাই। চাই চাই চাই। আমি কিছুতেই আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না। ম’রে যাব বিশ্বাস করুন। প্লিজ আমার হয়ে যান। আপনার জায়গায় অন্য কাউকে আমি কল্পনাও করতে পারি না। কখনোই না৷”
বিলাপ করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়ছে পুষ্প। অহমি বাকরুদ্ধ। কী বলছে পুষ্প এসব? কেনো বলছে? তাহমিনা বেগম, অর্পা দু-জনের দৃষ্টিই অবিশ্বাস্য। কেউ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রমি তখন তৈরি হয়ে ওখানে আসছিল। পুষ্প’র এমন কান্ড দেখে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ মে’রে থাকে। পরক্ষণেই তীব্র ক্রো’ধে এগিয়ে আসে ওদের নিকট। পুষ্পকে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কষিয়ে চ’ড় বসায়। চিৎকার করে বলে,
“তুই বোন নামের ক’ল’ঙ্ক। এতো ভালবেসেছি আমি তোকে আর তুই আমার বিশ্বাস ভাঙলি। মা ঠিকই বলেছিল, দুধ কলা দিয়ে কা’ল’সা’প পুষেছি আমি কা’ল’সা’প। আমার খেয়ে আমার পড়ে আমার ঘরের চুরি করলি। এমন বোন আমার চাই না। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ তুই। এমন বোন থাকার চেয়ে ম’রে যাওয়া অনেক ভালো।”
প্রমি পড়নের শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে চলে গেল। বিভোর চরম বিরক্ত পুষ্পর ওপর। ভর বিয়ে মজলিসে এতো এতো লোকের সামনে কীভাবে অপ্রস্তুত করল তাকে। কষ্ট দিল প্রমিকে।
—
অহমি এগিয়ে এলো পুষ্পর কাছে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি জোড়ায় ছলছল করছে অশ্রুকণা। পুষ্প একবার সেদিক পানে চেয়ে দু-হাত জোর করে বলল,
“পারলে ক্ষমা করে দিস। পৃথিবীতে তুই একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে আমি অ’ন্যা’য় করেছি। অবহেলা করেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর নিরুপায় ছিলাম। এখন আমি মুক্ত।”
পুষ্প দৌড়ে বেড়িয়ে গেল একেবারে বাড়ির বাহিরে। অহমি কিছু বলতে নিবে তার আগেই এসব হয়ে গেল। অহমি ছুটল পুষ্পর পেছনে। বিভোর ছুটল অহমির পেছনে। অর্পা তাহমিনা বেগমকে অপেক্ষা করতে বলে সে ও ছুটল। এদিকে সাবিনা বেগম বরপক্ষ সামলাতে ব্যস্ত। বরপক্ষ তাকে চরম বেইজ্জতি করে চলে গেলো। সাবিনা বেগম অপমানে মুখ থমথমে করলেন। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলেন যে পুষ্প ফিরে এলে কখনোই আর জায়গা দেবেন না এ বাড়িতে।
—-
পুষ্পকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না। এতটুকু সময়ে মেয়েটা কোথায় চলে গেল। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। অহমি হাউমাউ করে কাঁদছে। এতক্ষণে সে কিঞ্চিৎ হলেও পুষ্পর পরিবর্তনের কারণটা আঁচ করতে পারছে৷ হঠাৎ যেন নিজের ভাইয়ের ওপরের তার রাগ হচ্ছে। তার ভাই কেন পুষ্পকে ভালবাসতে পারল না? কেন পুষ্প না হয়ে প্রমি হলো তার ভালবাসা? কেন কেন কেন?
খবর পেয়ে ধ্রুব ফোন করেছে অর্পাকে। অর্পা বিস্তারিত বলতেই সে জানিয়েছে যে করেই হোক অহমিকে আজকে রাতে তার কাছে পাঠাতে। পুষ্পর সঙ্গে অহমির বন্ডিং টা তার ভালোই জানা৷ পুষ্প নিখোঁজ এমন সিচুয়েশনে অহমির কী অবস্থা হচ্ছে তা সে আন্দাজ করতে পারছে। তার পিচ্চি বউটাকে আগলে রাখার জন্য হলেও আজ রাতটা তাদের একসঙ্গে থাকা প্রয়োজন। অন্তত অহমির ভালোর জন্য।
—
“মা আমার মনে হয় অহমির এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। আজকের জন্য ওকে ধ্রুবর বাড়িতে নিয়ে যাই। সেখানে আমরা সব ফ্রেন্ডরা একসঙ্গে থাকব৷ সকলের সঙ্গে থাকলপ ওকে সামলাতে সহজ হবে। বুঝতেই পারছ বাড়িতে একা একা থেকে যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসে৷”
অর্পার কথায় ভাবুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তাহমিনা বেগম। অতঃপর বললেন, “আচ্ছা যেটা ভালো বুঝিস কর। তবে সাবধানে রাখিস।”
অর্পা জবাবে ছোট্ট করে বলল,’হু।’
বিভোর প্রমিকে সামলাতে ব্যস্ত৷ মুখে মুখে প্রমি যতই পুষ্পর ওপর রাগ দেখাক না কেন বিভোর তো জানে প্রমির মনের খবর। পুষ্পকে সে কতটা ভালবাসে। রাগ করে হয়তো দূরে সরে আছে, বেশি কথা শুনিয়েছে কিন্তু সবথেকে বেশি কষ্ট ওপরই হচ্ছে। বিভোর,তাহমিনা বেগমের থেকে পারমিশন নিয়ে অর্পা সে রাতেই অহমিকে নিয়ে রওনা হলো ধ্রুবর বাড়িতে। অহমি কোথাও যেতে চাইছিল না কিন্তু অর্পা জোর করে এনেছে। আপাতত ধ্রুবর সঙ্গ ওর জন্য ভীষণ জরুরি।
#নিঃশ্বাসে_তুই |২৫|
ধ্রুবকে কাছে পেয়ে যেন দ্বিগুণ ভেঙে পড়ল অহমি।ধ্রুবর বুকে পড়ে এলোমেলো ভাবে কাঁদছে অবিরত। ধ্রুব যখন ওকে থামাতে চাইল তখন নাক টেনে টেনে বলল,
“জানেন ওর সঙ্গে আমার বন্ধুক্তটা সেই ছোট্ট বেলা থেকে। সেই ছোট থেকে দুজনে একসঙ্গে হেসেছি, একসঙ্গে কেঁদেছি। জীবনে প্রেম নামক শব্দটিকে কখনো প্রশয় দেয় এই একটি কারণে। পুষ্প বলত, প্রেম করলে নাকি আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। সেই ভ’য়ে কখনো প্রেম করা হয়নি। কিন্তু দেখুন আমার জীবনে আপনি এলেন, প্রেম হলো, সবার অগোচরে আমাদের বিয়েও হলো কিন্তু এতকিছু আমি আমার সবথেকে কাছের মানুষটিকেই জানাতে পারিনি। তার আগেই পুষ্প আমাদের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছে সুবিশাল দেওয়াল। অথচ দেখুন এমনটা কিন্তু কথা ছিল না। কথা ছিল দুজন দু’জনের বিয়েতে সেই আনন্দ করব। কিন্তু সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। শুরুতে অভিমান করে দূরে সরে থাকলেও এখন তো বুঝতে পারছি পুসি কতটা কষ্টে ছিল এতদিন। একা একা সকল কষ্ট সহ্য করেছে মেয়েটা। আচ্ছা বলুন তো ভাইয়া কেন পুষ্পকে ভালবাসতে পারল না? কেন প্রমি আপু এলো ওর জীবনে? কেন আজ পুষ্প আমার থেকে দূরে হারিয়ে গেল? কেন?”
অহমি আর কিছু বলতে পারল না। কান্নায় গলা আটকে আসছে তার। শরীর ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। নড়াচড়া করার ইচ্ছে বা ক্ষমতা কোনটিই হচ্ছে না। সে শুধু মনপ্রাণ দিয়ে এটুকুই চাইছে, ‘পুষ্প ফিরে আসুক। দুঃস্বপ্নের মতো এসব কিছু মুছে যাক। ঘুম ভাঙলেই যেন সব সুন্দর হয়। রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠে যেন চারপাশ।’ ওভাবেই ধ্রুবকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল অহমি। ধ্রুব অহমির মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরে সে ও ঘুমতে চেষ্টা করল। পুষ্পরেণু জন্য তারও ভীষণ খারাপ লাগছে। ছোট বোনের নজরে দেখত ওকে।
—-
পাঁচ বছর পর…….
দেখতে দেখতে কেটে গেল পাঁচটি বছর। জীবন থেমে নেই। সময়ের নিয়মে সে এগিয়ে চলছে ক্রমাগত। এই পাঁচ বছরে বদলেছে অনেক কিছু। পরিবর্তন এসেছে সকলের জীবনে। বিভোর-প্রমির বিয়েটা হয়ে গেছে। তবে বেশ ছিমছাম ঘরোয়া ভাবে। কিন্তু সাবিনা বেগমের সঙ্গে বিভোরের পরিবারের তেমন একটা সখ্যতা দেখা যায়নি। অর্পার বিয়ে হয়েছে এক সনামধন্য ইন্জিনিয়ারের সঙ্গে। ছেলে নিজে থেকে অর্পাকে পছন্দ করেছিল। অর্পাকে ডিরেক্ট জানিয়ে লাভ হয়নি অর্পা বলেছিল বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে। সেই মোতাবেক সেই ছেলে পরিবার সমেত অর্পার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব রাখে। ছেলের সবদিক ভালো হওয়ায় বিয়েটা দিয়েই দেয় সকলে। অর্পার বরের নাম অয়ন। এদিকে অহমি গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট করেছে। মাস্টার্স করবে কিন্তু ধ্রুবর জেদ আগে তার ঘরে ধুমধাম করে অহমিকে নিয়ে যাবে তারপর যা খুশি করুক। অর্পা আগে থেকেই তাহমিনা বেগমকে জানিয়ে রেখেছিল তাই তেমন একটা অসুবিধে হয়নি এটা নিয়ে। অবশেষে আজ সেই কাঙ্খিত মুহুর্ত এসেছে।
বধূ বেশে সজ্জিত হয়ে আছে অহমি৷ চতুর্দিকে ভীষণ কোলাহল। বিয়ে বাড়ি কোলাহলপূর্ণ হবে স্বাভাবিক। কিন্তু অহমির বিরক্ত লাগছে সবকিছু। কেমন অস্থির, অস্থির লাগছে। পুরোনো কিছু স্মৃতি মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে। অহমির ছটফটানি লক্ষ্য করল তিশা। হ্যাঁ সেই তিন বছরের পিচ্চি তিশা। অহনার মেয়ে। এখন আট বছরে পা দিয়েছে। তুখোড় বুদ্ধ সম্পন্ন হয়েছে। কাউকে ওপর থেকে দেখে তার মনের অভিব্যক্তি বোঝার ক্ষমতা তার আছে যা বড় বড় মানুষদেরও হয় না। অহমির সঙ্গে বসে থেকে তার এ অবস্থা দেখে সে চুপচাপ নেমে অর্পার কাছে চলে যায়। গিয়ে বলে,
“মেঝো আম্মু ছোট্ট আম্মুর না মন খারাপ। কাঁদছে। ওর কী কষ্ট হচ্ছে?”
অর্পা তিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “চলো তো গিয়ে দেখি।”
অহমির ঘরের দরজায় দাড়িয়ে অর্পা স্তব্ধ হয়ে গেল। এতগুলো বছর পরেও মেয়েটা কেমন কষ্ট পাচ্ছে। অহমি পুষ্পর একটি ছবির সঙ্গে কথা বলছে। ক্ষনে ক্ষণে বুকে চেপে ধরে এলোমেলো কাঁদছে। আর বলছে,
“এমন তো কথা ছিল না পুসি। তুই কোথায় পুসি। আজ আমার বিয়ে কিন্তু তুই নেই। তোকে খুব মিস করি পুসি। তুই কী বুঝিস সেসব। কোথায় হারিয়ে গেলি। একবারও আমার কথা ভাবলি না৷ এতগুলো বছরে এমন একটা দিন নেই যখন আমি তোকে ভাবিনি। প্রতি রাতে চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে তোর মুখশ্রী। আজ নিতে পারছি না আমি। বড্ড কষ্ট হয়। বড্ড বেশি।”
অহমি কাঁদছে। অর্পা এগিয়ে আসে ধীর পায়ে। অর্পার পেছনে গুটিশুটি মে’রে তিশা দাড়িয়ে। উঁকি দিয়ে অহমিকে দেখছে। অর্পা অহমির কাঁধে হাত রাখে। অহমি পেছন ফিরে তাকায়। অর্পার কোমর জড়িয়ে পুনরায় ডুকরে ওঠে। অর্পা অহমির মাথায় হাত রাখে। মনে মনে প্রার্থনা করে এই কান্নাই যেন অহমির জীবনে শেষ কান্না হয়।
—-
স্টেজের ওপরে পাশাপাশি বসে ধ্রুব – অহমি। ধ্রুবর চোখে মুখে উপচে পড়ছে তীব্র উচ্ছ্বাস। কিন্তু অহমি নিশ্চুপ। থমথমে, ফোলা ফোলা মুখশ্রী তার। ধ্রুব ভাবল হয়তো পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়ার দুঃখে কাতর। ধ্রুব শক্ত করে অহমির হাত চেপে ধরল। এতো লোকজনের মধ্যে অহমি অপ্রস্তুত হয়ে ধ্রুবর পানে চাহিল। হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলে ধ্রুব চোখরাঙায়। অহমি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা নিচু করে রয়। এই লোকটাকে নিয়ে সে আছে মজা যন্ত্রণায়। কিঞ্চিৎ লজ্জা শরম যদি থেকে থাকে লোকটার।
ধ্রুবর বাবা মা এসেছেন বিদেশ থেকে। ছেলের ব্যাপারে তাদের তেমন একটা মাথা ব্যথা নেই। তারা ভালো ভাবেই জানেন তাদের ছেলে নিজের মর্জিতে চলে। তাই অহমিকে বিয়ে করা নিয়ে তেমন কোনো বিরোধিতা করে নি। তবে মন থেকে খুশি হয়েছেন এমনটাও নয়। শুধু মাত্র মুখ রক্ষার্থে এসেছেন।
কাজী উপস্থিত। নিয়ম মোতাবেক সকল উপস্থাপন শেষ। এখন শুধু কবুল বলার পালা। ধ্রুবকে কবুল বলতে বলা হয়েছে। ধ্রুব এক পল অহমির দিকে তাকিয়ে ওর হাতটা দ্বিগুণ শক্ত করে চেপে ধরে। যখনই কবুল বলতে উদ্বুদ্ধ হয় তখনই ভেসে আসে এক চেনা পরিচিত কন্ঠস্বর। সকলেই থমকে যায়। দৃষ্টি ভেড়ায় সদর দরজায়।
“কনগ্রাজুলেশন্স মাই ডিয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড। কনগ্রাজুলেশন্স!
ওষ্ঠে প্রাণোচ্ছল হাসি। ঝলমলে চেহারা। জামদানী শাড়ির আদলে সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আগের চেয়ে বেশ মুটিয়ে গেছে। গুলুমুলু লাগছে একদম। যে চেহারায় কষ্ঠের বিন্দুমাত্র রেশ নেই। একেবারে ঝরঝরে উচ্ছ্বসিত মুখশ্রীর রমনীটি যখন প্রবেশ করল ভেতরে সকলে বিস্ময়ান্বিত না হয়ে পারল না। পলকহীন চেয়ে রইল। কারো কারো চোখে অশ্রু টলমল করে উঠল। বাকরুদ্ধ সকলে। অথচ সেই রমণী দিব্বি আছে। হেলেদুলে এগিয়ে আসছে। তার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে এগোচ্ছে এক সুদর্শন পুরুষ। যার হাবভাবে কৌতূহল। নতুন জায়গায় পা রাখার মতো অস্বস্তি। কেমন সংকুচিত ভাবে এগোচ্ছে সে। রমনীটি এক পলক তাকালো যুবকটির দিকে। কিঞ্চিৎ হেসে ধীর সুস্থে কৌতুকের ছলে বলল, “কী ব্যাপার, সর্বপরি আগে আগে চলা ব্যক্তিটি আজ আমার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলছে যে? ঘাবড়ে গেছে বুঝি?”
যুবকটি শিরদাঁড়া সোজা করল। দৃঢ় কন্ঠে বলল,”অভ্রনীল আহমেদের ডিকশনারীতে ভ’য়, শঙ্কা, ঘাবড়ানো,ভড়কানো বলতে কোনো শব্দ নেই।”
“হু তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
রমণীটির পুনরায় অধর লেপ্টে হাসল। যেন লোকটিকে ক্ষেপিয়ে ভীষণ মজা পাচ্ছে সে। চলতে চলতে একেবারে স্টেজের সম্মুখে এসে থামল তারা। অভ্র পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাড়িয়ে পড়ল। স্টেজের ওপর উঠল শুধু রমনীটি।
.