নিঃশ্বাসে তুই পর্ব -২৬ ও শেষ

#নিঃশ্বাসে_তুই |২৬|
(অন্তিম পর্ব)

পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে সমানে হেঁচকি তুলছে অহমি। সেই থেকে শুরু হয়েছে থামার নাম নেই। দু’জনে কেউ কিছু বলছে না। বাকিরাও স্তব্ধ। কারো কিছু বলার মতো অবস্থা নেই। নিরবতা ভেঙে পুষ্পই শুরুতে মুখ খুলল। একই অবস্থানে থেকেই ধীর স্থির কন্ঠে বলল,

“জিজু আর কতক্ষণ ওয়েট করে থাকবে? এবার তো থাম।”

অহমি আরও একটু শক্ত করে চেপে ধরল পুষ্পকে। অভিমানী কন্ঠে কিছু বলতে নেবে তার আগেই পুনরায় পুষ্পর কন্ঠ ভেসে এলো,

“উহুম আর কোনো কথা নয়। সব কথা সব অভিযোগ পরে শুনব। আগে চল কবুল বলতে হবে তো।”

পুষ্প জোর করে অহমিকে টেনে তুলল। বসিয়ে দিল আসনে। অহমি অশ্রুসিক্ত নয়নে এখনো পুষ্পর দিকে চেয়ে। পুষ্পর এক হাত নিজের এক হাতের মধ্যে শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। অবশেষে পুনরায় বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। ধ্রুবর পরপরই তিন কবুল পড়ল অহমি৷ সকলের একত্রে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। শেষ হলো শুভকাজ।

—-
ধ্রুবর বাবা – মা বিয়ে সম্পন্ন হতেই ফিরে গেছেন বাড়িতে। খুব শীঘ্রই তারা পুনরায় দেশ ছাড়বেন। সাবিনা বেগম কাউকে কিছু না বলেই চুপিচুপি বাড়িতে চলে গেছেন৷ অনেকটা চো’রের মতো। নিস্তব্ধতা বিরাজমান কক্ষে সকলে মিলিত হয়েছে। যার মধ্যমণি হলো পুষ্প। সে এখন তার জীবনের অজানা ঘটনা গুলোকে সকলের সামনে তুলে ধরবে। অধির আগ্রহ নিয়ে চেয়ে সকলে।

“সেদিন যখন বিয়ের আসর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলাম তখন বেখেয়ালিতে আমার এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়ে যায়। চোখ খুলে দেখি কোনো এক হসপিটালের কেবিনে আমি। আমার পাশে বসে আছেন একজন ভদ্র লোক ও একজন ভদ্র মহিলা। আমি প্রথমে ঘাবড়ে যাই পর মুহুর্তে তাদের ব্যবহারে স্বস্তি ফিরে পাই। তাদের গাড়ির সঙ্গেই আমার এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছিল। পরে তারা আমাকে জোর করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। আমার জীবন সম্পর্কে জানতে চায়। ভরসার হাত পেয়ে আমিও বলে দেই আমার ছোট্ট জীবনের চূড়ান্ত বিপর্যয়ের গল্প। সবশেষে তারা আমাকে আর ছাড়তে চায় না। আমিও অনেক ভেবে দেখলাম এখানে থাকলে নিজেকে ঠিক রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওখানেই থেকে গেলাম সেভাবে। ধীরে ধীরে সকল কিছু পরিবর্তন হতে লাগল। ওই যে, মি.অভ্রনীল আহমেদ উনিই আমার স্বামী। আমি যে বাড়িতে গিয়ে পড়েছিলাম ওটা ওনাদেরই বাড়ি। আর সেই ভদ্রলোক আর ভদ্র মহিলা ওনার বাবা-মা যারা বর্তমানে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি। বছর দুই আগে আমাদের বিয়ে হয়। তারপর ঘর সংসার গুছিয়ে নিয়ে সকলের কাছে ফিরে আসতে এতটা লেট হয়ে যায়। এই কয়েকমাস ধরেই ভাবছিলাম এখানে এসে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে যাব। গত সপ্তাহে যখন আমাদের পুরোনো ফ্রেন্ড লামিয়াকে কল করি তখন ও জানায় অমুর বিয়ে এক সপ্তাহ পর। তাই ভাবলাম একেবারে বিয়ের দিন এসে আমার পাগলামি টাকে চমকে দিব। তাই এই এক সপ্তাহে আর আসা হয়নি।”

কথা শেষ করে পুষ্প লম্বা শ্বাস ফেলল। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণা টুকু মুছে নিয়ে এগিয়ে গেল অহমির কাছে। অহমির দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

“আমাকে ক্ষমা করে দিস অমু অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে। কিন্তু কী করতাম বল এখানে থাকলে আমি কিছুতেই নিজের ভুল শোধরাতে পারতাম না। নিজের সঙ্গে সঙ্গে সকলকে কষ্ট দিতাম। তাই আর কি!”

পুষ্প থামল কী ভেবে অহমির কানের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,

“একটা সিক্রেট বলি, ওই যে মি.অভ্রনীল আহমেদ। আমার মহামান্য স্বামী মহোদয় তার জন্যই কিন্তু আমি জীবনে এতদূর অব্দি আসতে পেরেছি৷ শুরুতে তো দু’জনে সা’পে নে’উ’লে ছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারি আমরা একে অপরের পরিপূরক। সেবার যখন আমি তীব্র জ্বরে আ’ক্রা’ন্ত হয়ে দিকবিদিকশুন্য তখন ওই মানুষটার অবস্থা হয়েছিল পাগলপ্রায়। সারাদিন রাত এক করে সেবা করেছিল আমার। আমার শ্বশুর- শ্বাশুড়ি তো পুরো অবাক ছেলের এমন কান্ডে। পরে যখন আমি একটু সুস্থ হই জনাব তখন আর না পেরে পেটের কথা মুখে তোলে। বলেই ফেলে আমাকে ছাড়া তার চলবে না৷ আমি শুরুতে মানতে নারাজ হলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারি তিনি আমার কতটা জুড়ে। তাই বলে কিন্তু এখনো আমাদের মধ্যে সেই সা’পে-নে’উ’লে সম্পর্কটার ছিটেফোঁটা আঁচ রয়েই গেছে। সুযোগ পেলেই কেউ কাউকে খোঁচাতে ভুলি না।”

পুষ্প প্রাণ খুলে হাসছে। বহুদিন পর মনটা তার হালকা হয়েছে। অহমিও হাসছে। দুই প্রিয় সত্তার একত্রে মিলিত হওয়ার উচ্ছ্বাস সকলে চোখ জুড়িয়ে দেখছে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। মন শীতল, শান্ত করা অনুভূতি।

—-
বিভোর আর প্রমির থেকে মাফ চেয়ে নিয়েছে পুষ্প। কিশোরী বয়সের আবেগে ভেসে প্রমির মতো বোনকে মা’রা’ত্মক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে। প্রমির মতো বোন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সেই ছোট থেকে প্রমিই তো তাকে আগলে রেখেছে। এতিমখানা থেকে তুলে এনে বোনের স্নেহে বড় করে তুলেছে। পড়াশোনা করিয়ে সুন্দর জীবন দিতে চেয়েছে। প্রমির এতো এতো অবদানের বিন্দুমাত্র প্রতিদান দিতে পারেনি পুষ্প। উল্টে ভুল পথে গিয়ে কষ্ট দিয়ে বসেছে তাকে। এখন পুষ্প বুঝতে পারে ভালবাসা সবার ক্ষেত্রে আসে না। জোর করে কেউ কাউকে ভালবাসতে পারে না। কিশোরী বয়সের আবেগে পড়ে ভুল কিছু করা উচিত নয়। জীবনের একটা সময় এসে মানুষ সেগুলো ঠিক উপলব্ধি করতে পারে। সময় হলে সঠিক মানুষটি আসবেই তারজন্য আগে থেকে উতলা হলে চলবে না।

—–
পরিশিষ্টঃ—✨

দোলনার ওপরে পা তুলে বসে আছে অহমি। দৃষ্টি তার ওই দূর আকাশে। সেখানে কতশত অচেনা পাখিদের মেলা। সারি সারি পাখি উড়ে চলেছে। হয়তো সকলে নীড়ে ফিরছে। অহমি মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে। তখনই তার ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্কিনে তাকিয়ে তার ঠোঁটের হাসি বিস্তর হয়। উৎফুল্ল চেহারায় রিসিভ করে কানে ধরে ফোন।

“জানিস পুসি আমি এতক্ষণ কত সুন্দর পরিবেশ দেখছিলাম। ইস তুই থাকলে কী যে মজা হতো। একসঙ্গে দু’জনে মিলে প্রকৃতি উপভোগ করতাম।”

ওপাশ থেকে পুষ্প আমতা আমতা করে বলল,

“শোন না অমু তোকে একটা কথা বলার ছিল।”

“হ্যাঁ তো বল কী বলবি?”

“ইয়ে মানে আমি! মানে তুই খালামনি হতে চলেছিস।”

কথা শেষ করেই পুষ্প চোখ বন্ধ করে জিভ কামড়ে ধরল।এদিকে অহমি এক চিৎকার দিয়ে দোলনা থেকে নেমে পড়ল। চেঁচাতে চেঁচাতে বলল,

“পুসিইইইইইইই তুই জানিস না আমি কতটা খুশি হয়েছি। আনন্দে আমি বোধ ম’রে’ই যাব। আচ্ছা বল তো আমার এখন কী করা উচিত। ইস তোর কাছে থাকলে এতক্ষণে তোকে তুলে নিয়ে একচোট ঘুরিয়ে নিতাম আমি।”

পুষ্প হেসে কুটিকুটি। নিজেকে সংযত করে অহমি থামাতে সে বলল,

“হয়েছে হয়েছে এবার থাম। আর হ্যাঁ হানিমুনে গিয়েছিস ভালো কথা তবে গিয়েছিস দুজন ফিরবি তিনজন এই বলে দিলাম। দুই বান্ধবী একসঙ্গে মা হব।”

অহমি ঘোর বিরোধিতা করে বলল,

“এ্যাহহহ শখ কতো। নিজে তো দু বছর বরের সঙ্গে রোম্যান্স করে তারপর বেবি নিয়েছিস আর আমি সবে সবে হানিমুনে আসতে পারলাম না এখনই বেবি নিব? কখনোই না। একেবারে তিন বছর পর বেবি নিব। তোর একটা ছেলে বাবু হবে আর তিন বছর পর আমার একটা মেয়ে বাবু হবে। তারপর ওরা যখন বড় হবে ওদের একসঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমরা দুজন বেয়াইন হয়ে যাব। আইডিয়া টা কেমন বল বল?

” উহমমম মন্দ নয়।”

ফোনের এপাশ ওপাশ দুপাশেই শুধু হাসির শব্দ। বিধাতার ইচ্ছে থাকলে ওদের এই ইচ্ছেটাও হয়তো পূরণ হয়ে যাবে৷

—–
“এই মেয়ে দাড়াও বলছি একদম ছোটাছুটি করবে না। আমার আম্মাজানের কিচ্ছু হলে তোমাকে কিন্তু একেবারে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেব।”

“এখনো দুনিয়াতে এসে পারে নি তার জন্য এত দরদ আর আমি সয়ং উপস্থিত থাকতে আমাকে যেন চোখেই পড়ে না। ঠিক আছে ঠিক আছে আপনি থাকিয়েন আপনার আম্মাজানকে নিয়ে আমি হারিয়ে যাব বহুদূরে।”

অহমি ঠোঁট ফুলিয়ে বসে পড়ল। ধ্রুব একটানে ওকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল। প্রেগন্যান্সির আট মাস চলছে। আলট্রাসোনা রিপোর্টে এসেছে মেয়ে হবে। পুষ্পর ঠিকই ছেলে হয়েছে। কিন্তু ইদানীং অহমির শুধু মুড সুইং হয়। যার ফলে সারাক্ষণ উল্টোপাল্টা কথা বলে ধ্রুবকে জ্বালিয়ে মা’রে।

অহমি গুটিশুটি মে’রে পড়ে আছে ধ্রুবর বক্ষে। ধ্রুব চোখ বন্ধ করে জোর নিশ্বাস নিয়ে আবার ফেলছে। খানিক সময় পর ধীর,স্থির আওয়াজে তার কন্ঠ ভেসে এলো,

“আমার প্রতিটি #নিঃশ্বাসে_তুই। তুই বিহীন আমি যেন এক প্রকাণ্ড মরুভূমি। আমার দিনের আলোকপাত ঘটে তোকে দিয়ে। অহমি হারিয়ে গেলে এই ধ্রুব তো তাহলে বিলীন হয়ে যাবে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তোকে আমার চাই। আমাদের এই চাওয়া-পাওয়ার সুখানুভূতিতে না হয় যোগ হবে আরও একটি নাম। পরবর্তীতে যাকে ঘিরে সাজাবো আমরা আমাদের গোটা দুনিয়া। তোমার আমার ভালবাসার ফসল। আমাদের আম্মাজান।”

——সমাপ্ত —–

✍️অহমিকা মুনতাহাজ নিশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here