#নিবিদ্রিতা_কাহন—-৪১
®মেহরুমা নূর
★সেদিনের পর এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এর মাঝে আর আদ্রিতার মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। সবার জীবন আপন গতিতেই চলছে। আদ্রিতাকে এখন রোজ নিবিড়ই কলেজে দিয়ে আসে আর নিয়ে আসে। হাজার ব্যস্ত থাকলেও সে এই কাজ বাদ দেয়না। বরং কলেজ ছুটি হওয়ার আধাঘন্টা আগেই এসে অপেক্ষা করে সে। সেদিনের পর থেকে তার মাঝে এক অজানা ভীতি কাজ করে সর্বদা। তাইতো কোনো রিস্ক নিতে রাজিনা সে। এতে অবশ্য আদ্রিতার ভালোই লাগে। নিবিড়ের সাথে আসা যাওয়া করতে তার আনন্দ লাগে অনেক। তবে আজকাল নিবিড় ভাইয়া মাঝে মধ্যে কেমন যেন বিহেব করে। আদ্রিতার সব ব্যাপারে কেমন একটুতেই হাইপার হয়ে যায়।আদ্রিতা একটু কাশলেও সে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এসবের কারণ বুঝতে পারেনা সে।
আজও আধাঘন্টা আগেই কলেজে এসে উপস্থিত হয়েছে নিবিড়। আশেপাশের মেয়েগুলো আসতে যেতে তার উপর নজর টিকিয়ে যাচ্ছে। নিবিড়কে দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক টায়ার্ডনেস তার মাঝে।ঘামে ভিজে শার্ট টা লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। যেন অনেক কাজ শেষ করতে না করতেই আবারও তাড়াহুড়ো করে এখানে পৌছেছে সে। কিছুক্ষণ পরই সামনে থেকে আদ্রিতাকে আসতে দেখা গেল। তাকে দেখেই নিবিড়ের সব ক্লান্তি যেন মুহূর্তেই ছু মন্তর হয়ে গেল। স্বস্তিময় হাসি ফুটল তার ঠোঁটে । আজকাল মেয়েটাকে চোখের সামনে না দেখা পর্যন্ত যেন তার অশান্ত মন শান্তই হয়না। আদ্রিতা হেঁটে এসে হাসিমুখে নিবিড়ের সামনে দাঁড়াল। তার হাসিমাখা ওই মায়াবী মুখটায় নিবিড়ের হৃদয় মন খুঁজে পেল এক আকাশ প্রশান্তি। আদ্রিতা নিবিড়ের কাছে এসে বলে উঠলো,
“আপনি এতো আগে এসে রোদে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন! দেখুন কত ঘেমে গেছেন আপনি।!”
“এত বেশি পন্ডিতি করতে হবে না তোর। গাড়িতে বয়।”
আদ্রিতা নিবিড়ের পাশের সিটে বসলো।নিবিড় বসতেই আদ্রিতা গাড়িতে রাখা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু বের করে নিবিড়ের কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল,
“আগে এসেছেন যখন, গাড়িতে এসির মাঝে বসে থাকলেও তো পারেন। বাইরে রোদের মাঝে থাকার কি দরকার!”
নিবিড় মায়াময় শীতল চোখে তাকালো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার ঘাম মুছে দেওয়া হাতটা ধরে হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেল। তারপর এক হাতে আদ্রিতার মাথাটা এগিয়ে এনে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“তুই ঠিক আছিস?”
আদ্রিতা হাসিমুখে বলল,
“আমার আবার কি হবে! আমি একদম ফিট এন্ড ফাইন আছি।”
নিবিড় মুচকি হেঁসে বলল,
“তাহলে নিবিড়ও ঠিক আছে। তুই ঠিক থাকলেই হলো। তাহলে সব ঠিক।”
আদ্রিতাকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো নিবিড়। গাড়ি চালাতে চালাতে নিবিড় বলল,
“জানিস আজ ফাইজা ফোন দিয়েছিল। বলল,ও আর ওর শশুর বাড়ির পরিবার নাকি ঢাকায় বেড়াতে আসবে কিছুদিন পর।”
আদ্রিতা তা শুনে বলে উঠলো,
“ফাইজা! সে আবার কে?”
“দেবো এক থাপ্পড়। মজা করিস আমার সাথে! ”
“আরে মজা কেন করবো! সত্যি সত্যিই জিজ্ঞেস করছি, কে এই ফাইজা? কি হয় আপনার?”
আদ্রিতার এই কথা শুনে তৎক্ষনাৎই ঝট করে গাড়ির ব্রেক কষলো নিবিড়। এতো জোরে ব্রেক করলো যে আদ্রিতা সামনের দিকে ঝুঁকে গেল। গাড়ি ব্রেক করে চমকে উঠার মতো তাকালো নিবিড় আদ্রিতার দিকে। চোখে মুখে তার প্রচন্ড রকম ভীতি ছেয়ে গেল। যেন আৎকে উঠেছে সে।নিবিড় ঢোক গিলে শঙ্কিত গলায় বলল,
“দে….দেখ অরি, এমন ফালতু মজা করলে কিন্তু আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
আদ্রিতা কিছুটা অভিমানী সুরে বলল,
“আরে ধুর, বললাম তো মজা করছিনা। যান জিজ্ঞেসই করবোনা কিছু। ”
“তোর সত্যি মনে নেই ফাইজাকে!”
“নাতো। কেন আমার কি তাকে চেনার কথা নাকি!”
নিবিড়ের হাত পায়ের মাঝে হঠাৎ মৃদু কম্পন শুরু হলো যেন। এসির মাঝেও দরদর করে ঘামতে লাগলো সে। চোখে মুখে তার অজানা আতঙ্কের ছাপ স্পষ্টিত হচ্ছে। নিবিড় অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে জোরে জোরে কয়েটা ভারী অশান্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর জোরপূর্বক মুচকি হেঁসে নিজেকে স্বাভাবিক দেখিয়ে আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরে হ্যাঁ, তোর মনে না থাকারই কথা। অনেক ছোটবেলার দেখেছিলিতো। আমাদের চাচাতো বোন হয় সম্পর্কে।”
“ও আচ্ছা। ”
নিবিড় আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো। এর মাঝে আর একটা কথাও বললোনা সে। যেন ভেতরে ভেতরে সে গভীর চিন্তায় মশগুল আছে।
বাসায় এসেই নিবিড় দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে সবার আগে অপরাহ্নকে ফোন করলো। অপরাহ্ন ফোন ধরতেই নিবিড় উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“অপু, অরির কিছু হয়েছে।”
অপরাহ্ন মজার সুরে বলল,
“কস কি মামা! বিয়ার আগেই বাপ হওয়ার প্রসেসিং চালু কইরা দিছস!”
“শাট আপ অপু! আম সিরিয়াস।”
“আচ্ছা ওকে সরি। বল কি হয়েছে? ”
নিবিড় অপরাহ্নকে তখনকার ব্যাপারটা খুলে বলল। তারপর বলল,
“অপু, ও ফাইজাকে ভুলে গেছে। ভাবতে পারছিস তুই!”
“নিবিড় রিল্যাক্স, দেখ আগেই এত হাইপার হোসনা। হ্যাঁ বিষয়টা একটু সমস্যাজনকই মনে হচ্ছে। তবে এত জলদি কোনো সিদ্ধান্তে যাওয়া ঠিক হবে না। আমাদের আরও কয়েকদিন অবজারভেশন করতে অরির এক্টিভিটি। দেখতে হবে সে আরও অস্বাভাবিক কথা বা কাজ কিছু করে নাকি। তারপরই কিছু বোঝা যাবে। আর যদি তেমন কিছু না হয় তাহলে তো চিন্তার কিছু নেই। তুই একটু শান্ত হ আপাতত।”
ফোন কেটে দিলো নিবিড়। অপরাহ্ন যাই বলুক। তার ভেতরের ভীতি যেন কমছেনা। তার সব দোয়াতে শুধু একটাই চাওয়া। নিবিড়ের পুতুল টা যেন সবসময় ভালো থাকে।
বিকালে আদ্রিতাকে পড়াতে বসেছে নিবিড়। যদিও আদ্রিতার অন্য টিচার রাখতে দেখে রাগ করে আর নিবিড় পড়াতে চায়নি আদ্রিতাকে। তবে আদ্রিতা তার ভুল বুঝতে পেরে সেই টিচারকে আবার মানা করে দিয়েছে। আর নিবিড়কে পড়ানোর জন্য মানিয়েছে। পড়াতে নিবিড় বলল,
“গত সপ্তাহে যে অংক গুলো দিয়েছিলাম সেগুলো কমপ্লিট করেছিস!”
আদ্রিতা বলে উঠলো,
“অংক! গত সপ্তাহে কি অংক দিয়েছিলেন! কৈ আমারতো মনে নেই! ”
নিবিড় আবারও চমকে গেল আদ্রিতার কথায়। তবে পরক্ষণেই আবার ভাবলো এটা হয়তো আদ্রিতার পড়ার ফাঁকিবাজিও হতে পারে। তাই টেবিলের উপর কাঠের স্কেলটা দিয়ে সশব্দে একটা বাড়ি মেরে বলল,
“আবারও ফাঁকিবাজি শুরু করেছিস! তোর এসব ধুরন্ধরগিরি আমার সাথে চলবেনা। পড়া ফাঁকি দেওয়ার জন্য এখন ভুলে যাওয়ার বাহানা করছিস!”
আদ্রিতা ভয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
“সত্যি বলছি, মনে নেই আমার। এই দেখুন খাতা।”
আদ্রিতা ওর ম্যাথ খাতাটা নিবিড়ের সামনে দিলো। নিবিড় সেটা খুলে দেখতে লাগলো। নিবিড় খাতা খুলে দেখতে লাগলো। এবং খাতায় যা দেখলো তাতে নিবিড়ের ভীতি আরও বাড়ল৷ নিবিড় দেখলো,আদ্রিতা ওর খাতায় একই জিনিস বারবার করে লিখে রেখেছে। যেন সে ভুলেই গেছে যে, সে ওই জিনিস আগেও করেছে। এসব দেখে নিবিড়ের মাথা ঘুরতে লাগলো। সে কোনরকমে বলল,
“আচ্ছা আমি দাগিয়ে দিচ্ছি সেগুলো করতে থাক। আমার মাথা ব্যথা করছে। আজ আর পড়াতে পারবোনা। বাকিটা একাই কর।”
বলেই দ্রুত উঠে গেল নিবিড়। মন মস্তিষ্ক প্রচন্ড পরিমাণ অশান্ত হচ্ছে তার। অশুভ কিছুর আভাস তার ভেতর বাহির আতঙ্কের বশবর্তী করে দিচ্ছে।
__
রাতে খেতে বসলে আদ্রিতা অনিহা প্রকাশ করে বলল,
“সোনা মা,আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা একদম। আমি আজ খাবোনা।”
তানি হালকা শাসনের সুরে বলল,
“অরি,আবারও শুরু করেছ! আমি বলেছি না রাতে না খেয়ে শোয়া চলবেনা। ভদ্র মেয়ের মতো খেয়ে নাও।”
“সত্যি বলছি সোন মা ,আমার একদমই খেতে ইচ্ছে করছেনা। কেমন উকি উকি লাগছে। খাবার খেলেই বমি হয়ে যাবে। প্লিজ. ”
পাশ থেকে নিবিড় রাগী স্বরে বলল,
“তোর প্লিজ-এর আলু ভর্তা বানিয়ে খা। খাবার না খেয়ে যদি এক পা-ও নড়েছিস তাহলে টেবিলের সব খাবার তোর মুখে ঢুকাব আমি। এমনিতেই ঠাস ঠাস করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন ম্যাডাম। আরও না খেয়ে থেকে কি অজ্ঞান হওয়ার ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করতে চাস! চুপচাপ খাবার শেষ কর।”
পাশ থেকে বাকিরাও আদ্রিতাকে খাওয়ার জন্য জোর দিতে লাগলো। একেকজন একেক ভাবে বলছে তাকে। হঠাৎ আদ্রিতার কি যেন হয়ে গেল। তার চেহারর হাবভাব কেমন পাল্টে গেল। সে আচমকা ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের কাছে থাকা প্লেটটা উঠিয়ে ঠাস করে নিচে সজোরে আছাড় মেরে ফেলে দিলো সে। সিরামিকের প্লেটখানা মুহূর্তেই কয়েক টুকরোয় খন্ডিত হয়ে জমিনে ছড়িয়ে পড়লো। পরপরই আদ্রিতা পানি ভরা জগটাও উঠিয়ে একইভাবে আছাড় মেরে ফেলে দিলো। গ্লাসটাও ফেললো। ফেলতে ফেলতে ভীষণ ক্ষিপ্ত ভাবে বলতে লাগলো,
“বললাম না খাবোনা! কেন জোর করে সবাই? কেন? আমার কথা কেউ শোনেই না। সবাই খালি বকে।”
এসব বলতে পেছনের চেয়ারটাও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। ওখান থেকে সরে গিয়ে সোফার সামনের টি টেবিলের উপর রাখা জিনিসপত্র গুলোও এক এক করে ফেলতে লাগলো সব। আর মুখে পাগলের মতো একই কথা বারবার বলতে লাগলো। চোখ মুখের ভাব ভীষণ অস্বাভাবিক তার। তিরতির করে কাঁপছে চোখের পাপড়ি। মুখমণ্ডল লাল হয়ে উঠেছে। এভাবে ভাংচুর করে দৌড়ে উপরে নিজের রুমে চলে গেল সে।
পরিবারের সবাই যেন হতভম্ব হয়ে গেল সবাই আদ্রিতার হঠাৎ এমন আচরণে। সবাই শক খাওয়ার মতো স্তম্ভিত হয়ে গেল। যেন ঘোরের মাঝে আছে সবাই। এই মুহুর্তে যা ঘটে গেল তা যেন অকল্পনীয়। আদ্রিতার এমন আচরণের কারণ কিছুই বুঝতে পারলোনা তারা। সবাই থ মেরে গেল যেন৷ তবে নিবিড়ের চেহারায় আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। হাতের মুঠোয় থাকা চামচটা সজোরে চেপে ধরেছে সে। নিঃশ্বাসের চলন ক্রমেই গতি কমাচ্ছে তার। বিভ্রান্ত চোখের নজর অস্থির হয়ে এলোমেলো ছুটছে। ব্লা,ল প্রেশার দ্রুত গতিতে উর্ধ্বমুখী হচ্চে তার। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল সে। তানিসহ বাকিদেরও টেনশন হচ্ছে আদ্রিতাকে নিয়ে। মেয়েটার হঠাৎ হলোটা কি!
বাইরে এসে পাগলের মতো অস্থির ভাবে এলোমেলো পায়চারি করতে লাগলো। হাত পা কেমন কাঁপছে তার। কাঁপছে অন্তর আত্মা । কম্পিত হাতেই ফোন করলো অপরাহ্নকে। এক হাতে মাথার চুল টেনে ধরে, আরেক হাতে ফোন কানে ধরে অস্থির ভাবে পায়চারী করতে লাগলো সে। অপরাহ্ন ফোন ধরতেই নিবিড় অতিব উত্তেজিত, অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
“অপু,আমার পুতুল। আমার পুতুল ঠিক নেই অপু। আমার পুতুলের কিছু হয়েছে। আমি কি করবো! কি করবো আমি বলনা! আমার মাছুম পুতুলটার সাথে কি হচ্ছে! অপু কিছু কর প্লিজ…. ”
“শান্ত হ নিবিড়। আগে বল কি হয়েছে? অরি আবারও কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করেছে? ”
নিবিড় ওকে সব খুলে বলল। সব শুনে অপরাহ্ন বলল,
“হুমম, তুই ঠিকই বলছিস। আদ্রিতার সাথে কিছু একটা হচ্ছে। এখনতো অনেক রাত হয়ে গেছে। তুই কাল অরিকে ক্লিনিকে নিয়ে আয়। আমি চেকআপ করে দেখছি।”
ফোন রেখে দিলো নিবিড়। এখন এই রাত পার করাও অসম্ভব লাগছে নিবিড়ের কাছে। ভীতি আর অস্থিরতায় মাথার রগ ফেটে যাচ্ছে যেন তার। নিবিড় হঠাৎ ফোন নিচে রেখে সুইমিং পুলে ঝাপ দিলো। পানির মাঝে ডুব দিয়ে রইলো। অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে হাঁপাতে লাগলো সে। পুলের কিনারায় পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে মাথা পেছন থেকে এলিয়ে দিলো। মনে মনে আওড়াল, “তিমির রাতের পর একটা আলোকিত সকালের আশা। যে সকালে আবার তোর নিষ্পাপ হাসির সূর্যালোক হবে।”
___
সকালে খাবার টেবিলে তানি আদ্রিতাকে খাইয়ে দিচ্ছে।সকালেও খেতে চাচ্ছিল না সে। তানি অনেক আহ্লাদ করে বুঝিয়ে সুজিয়ে খাওয়াচ্ছে। মেয়েটাকে কেমন দূর্বল দেখাচ্ছে। তানির মন ভারী হয়ে উঠছে তা দেখে।যখন তানি কৌশলে রাতের কথা জিজ্ঞেস করতেই আদ্রিতা বলল তার মনে নেই কিছু।সেটা শুনে তানিসহ সবাই অবাক হয়েছিল। তখনই তানি বুঝতে পারলো আদ্রিতার শরীর ঠিক নেই । ভাবছে আজই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে সে। তখনই নিবিড় সেখানে এসে বলল,
“খেয়েদেয়ে জলদি রেডি হয়ে যা। অপুর ক্লিনিকে যাবো আমরা।”
আদ্রিতা বলল,
“কেন? কি হয়েছে আপনার? আপনার শরীর খারাপ করেছে?”
এমন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ সময়েও আদ্রিতার সরল কথা শুনে হাসি পেল নিবিড়ের। তবে আপাতত আসল বিষয়টা লুকিয়ে বলল,
“না, আমি ঠিক আছি। এমনিতেই রেগুলার চেকআপ এর জন্য যাবো। সবাই করবে। তবে একদিনেতো আর সবারটা সম্ভব না। তাই দিনে দিনে হবে। আজ তোর আর আমার চেক-আপ করাবো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আদ্রিতা চলে গেল রেডি হতে। তানি বুঝতে পারলো নিবিড় আদ্রিতার জন্যই ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে।
আধাঘন্টা পর নিবিড় আবার আদ্রিতাকে আবার ডাকতে এলো বেরোনোর জন্য । কিন্তু আদ্রিতাকে রুমে পেলনা সে। ওয়াশরুম, বেলকনিও দেখলো। সেখানেও পেলনা। নিবিড় আদ্রিতার নাম ধরে ডাকতে লাগলো জোরে জোরে। ডাকতে ডাকতে নিচে এলো। সেখানেও পেলনা আদ্রিতাকে। তানি বলল,
“কি হয়েছে! অরিতো রুমেই আছে বোধহয়। ”
“রুমে নেই মা। এজন্যইতো খুঁজছি। ওকে বললাম একটু পরে বের হবো তাহলে গেল কোথায় ও?”
তখনই হঠাৎ বাসার সিকিউরিটি গার্ডটা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলে ওদের কাছে। এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“সার….”
তানি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছে হানিফ? এমন আতঙ্কিত দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?”
দারোয়ান হাঁপাতে হাঁপাতে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“ম্যাডাম, ওই ছাঁদে…”
“ছাঁদে! কি হয়েছে ছাঁদে? ”
“ছাঁদে অরি আফা……
এই পর্যায়ে নিবিড় চমকে উঠে বলল,
” অরি! কি হয়েছে অরির? বলেন, কি হয়েছে ওর?”
“অরি আফা ছাঁদে…….
বাকি কথা শোনার জন্য নিবিড় আর দাঁড়াল না। প্রাণপণে দৌড়ে পড়িমরি করে ছুটলো সে ছাঁদের দিকে। পিছে পিছে তানিও গেল। ছাঁদে এসে আশেপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে আদ্রিতার নাম ধরে ডাকলো নিবিড়। কিন্তু আশেপাশে কোথাও নেই সে। হঠাৎ তখনই ছাঁদের উপরের আরেকটা ছোট ছাদের উপর নজর গেল নিবিড়ের। আর সেদিকে তাকিয়ে যা দেখলো তাতে নিবিড়ের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। সে দেখলো,উপরের ছাঁদের উপর একেবারে কিনারা ঘেঁষে আদ্রিতা হাঁটছে। কেমন আনমনা হয়ে একাই একাই হাসছে আর হাঁটছে সে। একটুখানি পা এদিক ওদিক সরে গেলেই সোজা নিচে পড়ে যাবে সে। নিবিড় যেন অনুভূতিশূন্য, হীমশীতল হয়ে পড়লো। প্রাণহীন জড়ো পদার্থের ন্যায় স্থির হয়ে গেল সে। বোধশক্তিহীন হয়ে শরীরের ব্যালেন্স হারিয়ে পেছন দিকে পড়ে যেতে লাগলো।তখনই তানি দৌড়ে এসে ধরে ফেললো তাকে। আদ্রিতাকে ওই অবস্থায় দেখে তানিও ভয়ে আৎকে উঠলো। উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলো সে আদ্রিতাকে। আদ্রিতা তানিকে দেখে হাসতে হাসতে বলল,
“সোনা মা,দেখো আমি পাখি হয়েছি। গাছের পাতায় হাঁটছি। কত্তো মজা না!”
তানি দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ততক্ষণে বাকিরাও হৈচৈ শুনে ছাঁদে চলে এসেছে। তারাও আদ্রিতাকে ওখানে ভীষণ আৎকে গেল। নূরান বোনকে বাঁচাতে দৌড়ে উপরে উঠে গেল।আবিরও ছুটলো। তানি আদ্রিতাকে ধরে কিনারা থেকে সরিয়ে আনতে চাইলো। কিন্তু আদ্রিতা আসবেনা। সে পাগলের হাসছে আর বলছে,
“ছাড়ো আমাকে, আমি পাতার উপর হাঁটবো।”
নূরান আর আবির এসে সবাই একসাথে মিলে আদ্রিতাকে জোর করে টেনে নিচে নামিয়ে আনলো। নিচে এসে আদ্রিতা নিবিড়কে দেখে বাচ্চাদের মতো হাসলো। তার সামনে এসে বলল,
“আমি আজ পাখি হয়েছি।উড়ে যাবো অনেক দূরে।”
নিবিড়ের হৃদপিণ্ডে হাজার খানা অদৃশ্য ধারালো ছু,রি একসাথে যেন খচ করে বিঁধল। নিঃশ্বাস ছাড়া দায় হয়ে যাচ্ছে তার। নিবিড় কাঁপা কাঁপা হাতটা আদ্রিতার দিকে এগুতেই আদ্রিতা হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে নিচে পড়ে যেতে নিলে নিবিড় ধরে ফেললো তাকে। আদ্রিতাকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো। আদ্রিতার রুমে এসে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাকে। সবাই আদ্রিতার এই অবস্থায় চিন্তায় ভেঙে পড়লো।তানি কাঁদতে কাঁদতে আদ্রিতার পাশে এসে বসলো। নূরানও তার কলিজার বোনটার এই অবস্থা সহ্য করতে পারছেনা।
নিবিড় আদ্রিতাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে পেছাতে লাগলো।দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে পেছাতে পেছাতে দেয়ালের সাথে ঠেকে গেল। একসময় দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো সে। নিবিড় যেন চোখের সামনে নিজের দুনিয়া নড়ে উঠতে দেখছে। বুকটা জ্বলছে ভয়ংকর ভাবে। বুকে হাত ঘষতে লাগলো সে। নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা। মুখ দিয়ে হাওয়া বের করে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে চাইলো সে। তবে তা যেন সম্ভব হচ্ছে না। বিছানায় অচেতন পড়ে থাকা আদ্রিতার ওই ফ্যাকাসে মুখটা তাকে বারবার দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে।
চলবে…