#নিবিদ্রিতা_কাহন—-৪২
®মেহরুমা নূর
★চোখ খুলে আদ্রিতা নিজেকে ক্লিনিকের বেডে পেল। অপরাহ্ন তার চেকআপ করছে। পাশেই চেয়ারে বিধ্বস্ত, ফ্যাকাসে মুখে নিবিড় বসে আছে। আদ্রিতা মাথা চেপে ধরে উঠে বসে বলল,
“কি হয়েছে আমার! আমি এখানে কখন এলাম!”
অপরাহ্ন জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
“আরে কিছুই হয়নি তোমার। এটাতো রেগুলার চেকআপ করছিলাম শুধু। তুমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলে তাই হয়তো মনে নেই কখন এসেছ।”
আদ্রিতা দূর্বল হেঁসে বলল,
“ও আচ্ছা।”
“আচ্ছা, আমি তোমার মেমোরি চেক করার জন্য কিছু প্রশ্ন করবো ঠিক আছে।”
“আচ্ছা।”
“আচ্ছা বলোতো আজ কি বার আর কোন মাস চলছে ?”
“আজ নভেম্বর মাসের মঙ্গলবার।”
“ঠিক। তোমার বাসার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার বলোতো।”
আদ্রিতা ঠিকানাটা ঠিক বলল,তবে নাম্বার টা বলতে গিয়ে আঁটকে গেল। নাম্বার মনে করতে পারলোনা। অপরাহ্ন বলল,
“আচ্ছা ব্যাপার না। তুমি কোন কলেজে পড়ো।”
“আমি……
আদ্রিতা আঁটকে গেল। মনে করতে পারছেনা কলেজের নাম। এভাবে অপরাহ্নের আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আঁটকে গেল সে। সেসব মনে নেই তার। সেসব দেখে নিবিড়ের হাত পা কাঁপছে। হৃদপিণ্ড চিপে আসছে তার। আদ্রিতা নিজেও ওসব মনে করতে না পেরে বিস্মিত হয়ে গেল। তবে অপরাহ্ন তাকে অজুহাত দিয়ে বুঝিয়ে দিলো সে ঠিক আছে। অপরাহ্ন আদ্রিতাকে বাইরে গিয়ে বসতে বলল।আদ্রিতা বাইরে যেতেই অপরাহ্ন নিবিড়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“দেখ শান্ত হয়ে আমার কথা শোন।আগেই হাইপার হোসনা।আদ্রিতার সিমটাম দেখে প্রথমে যা সন্দেহ হয় তা হলো, ” অ্যালজাইমার”। এই রোগে আক্রান্ত রুগী ধীরে ধীরে সব ভুলতে শুরু করে। প্রথমে ছোটমোটো জিনিস ভুলে যায়। তারপর আস্তে আস্তে সব ভুলতে শুরু করে। তবে এখানে একটা কিন্তু আছে। তুই আমাকে আদ্রিতার অন্য আচরণ গুলোর কথা যা বললি সেটা এই ডিজিজে দেখা যায় না। যেমন,হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যাওয়া,আবার বেহুশের মতো ছাদের উপর হাঁটা। এগুলো এই ডিজিজে কমন না। তাই এক্সাক্টলি আদ্রিতার সমস্যাটা কি তা আগেই বলা যাচ্ছে না। ওর ব্লাড সেম্পল নিয়েছি। সেগুলো ল্যাবে পরীক্ষা করাবো৷ আর একটা এমআরআই করাতে হবে।দুদিন লাগবে টেস্টের রিপোর্ট আসতে। এসবের রেজাল্ট দেখেই আসল বিষয় টা বোঝা যাবে।”
নিবিড়ের শ্বাসতন্ত্রে যেন জমাট বেঁধে গেল। আতঙ্কে হৃদপিণ্ড হিম হয়ে যাচ্ছে তার।আতঙ্কের ভয়াবহ ধারালো কা,টা যেন প্রতিটি স্নায়ুকোষে বিঁধে যাচ্ছে। সর্বশক্তি হ্রাস পাচ্ছে নিবিড়ের। চোখ বুজে নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে বাইরে বের হলো । বাইরে আদ্রিতা তানির কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে ।তানহাও আছে সাথে। আসার সময় ওরা সাথে এসেছে। আদ্রিতার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে দূর্বল দেখাচ্ছে। ওই মুখটা দেখেই নিবিড়ের বুকের মাঝে মুষড়ে ওঠে। সে এগিয়ে গেল ওদের কাছে। তানহার উদ্দেশ্যে বলল,
“তোমরা বস কিছুক্ষণ। আমি অরির এমআরআইটা করিয়ে নিয়ে আসি।”
আদ্রিতা বলে উঠলো,
“কেন? এমআরআই করাতে হবে কেন?”
নিবিড় আদ্রিতাকে স্বাভাবিক করতে বলল,
“কারণ তোর মাথায় গবর আছে নাকি বুড়িগঙ্গার পানি আছে তার খোঁজ করা হবে। চল এখন।”
আদ্রিতা ভেংচি কাটলো নিবিড়ের উপহাসে। নিবিড় আদ্রিতার হাত ধরে ল্যাবের দিকে নিয়ে গেল। ওরা যেতেই তানহার ফোনে অপরাহ্নের ম্যাসেজ এলো। কেবিনে যেতে বলেছে তাকে।তানহা মায়ের দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বলল,
“মা একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।”
“ঠিক আছে।”
তানহা অপরাহ্নের কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আচমকা অপরাহ্ন তানাহার হাত ধরে টান দিয়ে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। তানহা হুমড়ি খেয়ে অপরাহ্নের বুকে এসে পড়লো। অপরাহ্নের ঠোঁটে হাসির রেখা। তানহা লজ্জায় নুইয়ে গেল। অপরাহ্ন তানহার গালে হাত রেখে বলল,
“কেমন আছ? মুখটা এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?”
তানহা মলিন মুখে বলল,
“অরির এমন অবস্থা দেখে মন ভালো থাকবে কীভাবে! বাড়িতে সবার মাঝে চিন্তা বিরাজ করছে। অরির কি হয়েছে বলুননা? ও কবে ভালো হবে।”
“এখুনি কিছু বলা যাচ্ছে না। কেস অনেকটা কমপ্লিকেটেড। তবে চিন্তা করোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের অরি আবারও প্রাণচঞ্চল হয়ে যাবে।”
তানহা অপরাহ্নের বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
“তাই যেন হয়। অরি আমাদের পরিবারের জান। ওর কিছু হয়ে গেলে সবাই ভেঙে পড়বে।”
অপরাহ্ন মনে মনে বলল,”শুধু ভেঙে পড়বেনা। অরির কিছু হলে নিবিড়ও বাঁচবে না। এটা সে খুব করে জানে।”
ক্লিনিক থেকে দুপুরের দিকে বাসায় ফিরলো ওরা।নিবিড় ওদের বাসায় রেখে অফিসে চলে যায়।জরুরী একটা মিটিং রয়েছে তাই যেতে হয়েছে। নাহলে নিবিড়ের যাওয়ার ইচ্ছে ছিলোনা মোটেও। বাসায় তানি আদ্রিতাকে রুমো গিয়ে একটু আরাম করতে বলল। আদ্রিতা মাথা নেড়ে উপরে চলে গেল। তানি তানহাকে আস্তে করে বলল আদ্রিতার সাথেই থাকতে। ওকে একা রাখা ঠিক হবে না। তানহা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ওরা যেতেই তানি দুপুরের রান্নার আয়োজনের জন্য রান্নাঘরের দিকে এগুলো। তানহা আদ্রিতার রুমেই কিছুক্ষণ বসে থাকলো। একটু পর আদ্রিতা ঘুমিয়ে যেতে দেখলো সে। তানহা ভাবলো আদ্রিতা যেহেতু ঘুমিয়ে গেছে, এই সুযোগে গিয়ে একটু গোসলটা সেরে ফেলা যাক। এই ভেবে তানহা আদ্রিতাকে রেখে দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল।
মিটিং শেষ করে আড়াইটার দিকেই নিবিড় দ্রুত বাসায় ফিরে এলো। মিটিং শেষ করে বাসায় আসার সময়টুকুই যেন অসহ্য লাগছিল নিবিড়ের কাছে। বাসায় ফিরেই দ্রুত পায়ে উপরে উঠে আদ্রিতার রুমের দিকে এগুলো। মেয়েটাকে ঠিক না দেখা পর্যন্ত শান্তি হবেনা তার কিছুতেই। আদ্রিতার রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো নিবিড়। তবে রুমের কোথাও কাঙ্খিত মুখটার দেখা পেলনা সে। রুমের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো আদ্রিতা কোথাও নেই। বাইরে আছে ভেবে নিবিড় ফিরতে নিলেই হঠাৎ মেঝেতে পানি দেখতে পেল সে। পানির উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখলো পানি ওয়াশরুম থেকে আসছে। তা দেখে ভ্রু কুঁচকে আসলো নিবিড়ের। এভাবে পানি গড়িয়ে আসার কারণ খুঁজতে নিবিড় ওয়াশরুমের দরজায় নক করতে গিয়ে দেখলো দরজা লক করা নেই। তবুও নিবিড় একবার নক করে বলল,
“অরি! তুই কি ওয়াশরুমে আছিস! এত পানি আসছে কেন?”
ভেতর থেকে কোনো জবাব এলোনা। নিবিড়ের এবার খটকা লাগলো। সে দরজা ঠেলে এবার ওয়াশরুমের ভেতরে ঢুকে দেখলো পানি আসার কারণ। অতঃপর যা দেখলো তাতে অন্তর আত্মা ভয়ে আৎকে উঠলো তার। ওয়াশরুমের বাথটাবের পানির ভেতর ডুব দিয়ে আছে আদ্রিতা। ট্যাপের পানি বাথটাব ভরে নিচে গাড়িয়ে মেঝেতে চলে গিয়েছে। বাথটাবের পানির ভেতর শুয়ে থেকে থরথর করে কাঁপছে আদ্রিতা। মুখ একেবারে সাদা র,ক্তশূণ্য হয়ে আছে। আদ্রিতার এই অবস্থা দেখে নিবিড়ের হৃদপিণ্ড যেন আতঙ্কে ঝংকারিত হয়ে দেহান্তর করলো। ভয়ার্ত কন্ঠে উচ্চস্বরে চিল্লিয়ে সে বলল,
“অরি……….!!!”
পাগলের মতো ছুটে গিয়ে নিবিড় পানির ভেতর থেকে আদ্রিতাকে দুই হাতে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো। আদ্রিতা থরথর করছে কাঁপছে শুধু। নিবিড় আদ্রিতাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গালে হালকা ঝাঁকিয়ে উদ্বিগ্ন অস্থির কন্ঠে বলল,
“পুতুল সোনা, পানিতে কেন ডুবেছিলি তুই? তোর কিছু হয়ে যেত যদি। এমন কেন করছিস তুই! ”
ততক্ষণে নিবিড়ের চিল্লানো শুনে তানিসহ বাকিরাও দৌড়ে এলো আদ্রিতার রুমে। আদ্রিতার এই অবস্থা দেখে তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে গেল। তানি জলদি তোয়ালে এনে আদ্রিতার শরীর মুছে দিলো। সবাইকে যেতে বলে আদ্রিতার ভেজা কাপড় পাল্টে দিলো। কিন্তু আদ্রিতা কেমন ছটফট করছে এখনো। বিড়বিড় করে বলছে,”পানি, পানিতে যাবো আমি।” নিবিড় আবার এসে বসলো আদ্রিতার কাছে। আদ্রিতার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম সুরে বলল,
“কি হয়েছে পুতুল? আমাকে বল কেমন লাগছে তোর? কোথায় খারাপ লাগছে?”
আদ্রিতা বিছানায় ছটছট করতে করতে অসহ্য সুরে বলল,
“জ্বলছে, আমার সারা শরীর জ্বলছে। আমি সইতে পারছিনা। আমি পানিতে যাবো। পানিতে যেতে দাও আমাকে।”
নিবিড় আদ্রিতার গালে হাত বুলিয়ে আদুরে সুরে বলল,
“পানিতে যাওয়া যাবেনা। দেখবি একটু পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“না পারছিনা আমি। খুব জ্বলছে। পুড়ে যাচ্ছে আমার সারা শরীর।”
আদ্রিতা যন্ত্রণায় বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে কাতরাতে লাগলো।গলা কা,টা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগলো। সহ্য করতে না পেরে একসময় শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো সে। কাঁদতে কাঁদতে বেদনার্ত করুন সুরে বলতে লাগলো,
“অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে। সইতে পারছিনা। পানিতে নিয়ে যান নাহলে মরে যাবো আমি।”
নিবিড়ের মনে হচ্ছে তার হৃদপিণ্ড টা কেউ টেনে বের করে নিচ্ছে। সে থাকতে তার প্রাণভোমরাটা এতো কষ্ট পাচ্ছে এই অপারগতায় নিজেকে মেরে ফেলতে মন চাচ্ছে। নিজেকে এইসময় দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে যেন। আদ্রিতার এমন করুন অবস্থা দেখে তানিও সহ্য করতে পারলোনা। মুখে আঁচল চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে রুমের বাইরে চলে গেল সে। রুমে আপাতত অন্য কেউ নেই। আদ্রিতা এখনো ছটফট করছে আর কাঁদছে। আদ্রিতা শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নিবিড়ের উদ্দেশ্যে নিদারুণ সুরে বলল,
“নিবিড় ভাইয়া,প্লিজ কিছু করুন। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। আমাকে পানিতে নিয়ে চলুন। নাহলে মরে যাবো আমি এখুনি।”
নিবিড় দুই হাতে আদ্রিতার মুখখানা ধরে করুন আদুরে সুরে বলল,
“হুশ হুশ,এই পুতুল,আমার লক্ষী সোনাপাখিটা। তাকা আমার দিকে। কিচ্ছু হবেনা তোর। আমি কিছু হতেই দিবোনা।”
নিবিড় মুখ নামিয়ে আদ্রিতার কপালে চুমু খেল। পরপর সারা মুখে অধর ছোঁয়াল। তারপর আদ্রিতার মাথা তুলে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো। আদ্রিতার সব যন্ত্রণা যেন নিজের মাঝে নিয়ে নিতে চাচ্ছে সে। তবে আদ্রিতার যন্ত্রণা এখনো কমছেনা।কেউ আ,গু,ন ধরিয়ে দিয়েছে ওর সারা শরীরে। পুড়ুনির যন্ত্রণা সইতে না পেরে আদ্রিতা নিবিড়ের বুকের অংশে সজোরে কামড় দিয়ে ধরলো। এবং কামড় দিয়ে ধরেই রইলো। যন্ত্রণায় হুঁশ হারা আদ্রিতা শরীরের সবশক্তি প্রয়োগ করে কামড় দিয়ে ধরে রইলো। দাঁত গুলো সব চামড়ার ভেতর গেঁথে গেল। আদ্রিতার এমন ঘাতক কামড়ে নিবিড়ের সমস্ত লোমকূপ কাটা দিয়ে উঠলো। তবুও দাঁতে দাঁত পিষে নিবিড় চোখ বন্ধ করে চুপচাপ সব সহ্য করলো। এই ব্যাথা আদ্রিতার সামনে কিছুই না। আদ্রিতার ওই ছটফট করা বেদনার্ত অবস্থা দেখার চেয়ে এই ব্যাথাও ভালো। এতে যদি ওর পুতুলটার যন্ত্রণা কমে তাহলে এরচেয়ে হাজার গুণ ব্যাথা সে হাসতে হাসতে সইতে রাজি।এটাইতো তার সব দোয়াতে সর্বদা চাওয়া, আদ্রিতার সব কষ্ট নিবিড়ের ঠিকানা হয়ে যাক।
প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে এভাবে কামড়ে ধরে রাখলো আদ্রিতা। নিবিড়ের মুখমণ্ডলে ব্যাথার লাল আভা ফুটে উঠেছে। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে কপাল আর গলার রগ ফুলে উঠেছে। অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর ধীরে ধীরে আদ্রিতার দাঁতের দৃঢ়তা কমে এলো। বুক থেকে দাঁত সরিয়ে ফেললো আদ্রিতা। আস্তে আস্তে শরীর ছেড়ে দিলো তার। দূর্বল ক্লান্ত হয়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে হাঁপাতে লাগলো। নিবিড় আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। দূর্বল শরীরে একসময় ঘুমিয়ে গেল আদ্রিতা। নিবিড় তা বুঝতে পেরে আস্তে করে আদ্রিতাকে বালিশে শুইয়ে দিলো। মায়াময় করুন চোখে তাকিয়ে রইলো আদ্রিতার রুগ্ন মুখপানে। ছোটবেলায় আদ্রিতার জ্বর হলে নিবিড় বৃষ্টিতে ভিজে নিজেরও জ্বর বাধাত। ভাবতো তাহলে আদ্রিতার জ্বর ওর কাছে চলে আসবে। এতে করে আদ্রিতার কষ্ট ওর মাঝে চলে আসবে। আর ওর পুতুলটা হাসিখুশি হয়ে যাবে। কিন্তু আজ সে ওই কাজটা করতে পারছেনা। পারছেনা সে আদ্রিতার সব কষ্টটা নিজের করে নিয়ে আদ্রিতাকে আগের মতোই প্রাণচঞ্চল করে দিতে। আর এই অপারগতাই নিবিড়কে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। লাখোলাখো বিষাক্ত বিচ্ছুর দল চারদিক থেকে ঝেকে পড়ে ওর ভেতরটা হৃদপিণ্ড ছিন্নভিন্ন করে খাচ্ছে। এই যন্ত্রণা অসহনীয়। নিবিড় সব সইতে পারে। শুধু এই জিনিসটাই সহ্য সীমার বাইরে।
__
নিবিড় অপরাহ্নের ক্লিনিকে বসে আছে। আজ দুদিন পর আদ্রিতার রিপোর্ট এসেছে। অপরাহ্ন সব রিপোর্ট দেখে কিছুটা হতবাক সুরে বলল,
“এটা কীভাবে হতে পারে! ”
নিবিড় অস্থির হয়ে বলল,
“কি হতে পারে? কি হয়েছে? রিপোর্টে কি এসেছে বলনা!”
অপরাহ্ন বলল,
“কিছুই আসেনি। মানে অরির সব রিপোর্টতো একদম নরমাল দেখাচ্ছে। কোনো সমস্যাই নেই। তাহলে আদ্রিতা এমন করছে কেন?এটাতো।আরও বেশি ঘোলা হয়ে গেল।”
“কি বলছিস তুই এসব! কি বালের ডাক্তার হয়েছিস তুই! ওখানে আমার পুতুল দিনকে দিন অসুস্থতার আরও অবনতি হচ্ছে। কখন কি করে সে নিজেও টের পায়না। কখনো যন্ত্রণা ছটফট করে, কখনো বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে। এখনতো খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করতে পারেনা। বমি করে ফেলে। শুকিয়ে রোগাটে হয়ে গেছে। আর এসবকিছু আমাকে আমার নিজের চোখের সামনে দেখতে হয়।সেটাযে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তার আন্দাজাও করতে পারবিনা তুই। আর তুই কিনা বলছিস সব নরমাল! তুই কি আদৌও ডাক্তার! ”
“দেখ,আমি বুঝতে পারছি তোর পরিস্থিতি কেমন এখন। কিন্তু রিপোর্টে যা এসেছে তাইতো বলছি আমি। তুই এই রিপোর্ট নিয়ে যেখানেই যাস সে এটাই বলবে।”
“তাহলে অরি কি এসব নাটক করছে! ওর ওই অবস্থা এমনি এমনিই হচ্ছে!”
“সেটাতো আমিও বুঝতে পারছিনা। তবে তুই চিন্তা করিসনা৷ আমি আরও অন্যান্য ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করছি। বিদেশি ডাক্তারের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। তাদের সাথে এই ব্যাপারে ডিসকাস করে দেখবো। দরকার হলে আবারও কিছু টেস্ট করাবো। অরির সেম্পল আছে ওগুলো দিয়ে আবার করবো।”
এভাবে দেখতে দেখতে আরও এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। আদ্রিতার শারীরিক অবস্থা আরও অবনতি হয়েছে। খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। ধীরে ধীরে সবকিছু ভুলে যাচ্ছে সে। নিবিড়ের ভয় হয়, আদ্রিতা যদি কখনো তাকেও ভুলে যায়! এই খেয়াল মনে আসতেই হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায় তার। এমন কোনোদিন আসলে কি সেদিন নিবিড় বাঁচতে পারবে! হয়তো না। আর বেঁচে থাকলেও তা কেবল জীবন্ত লা,শ ছাড়া আর কিছুই না৷ যার শুধু দেহ থাকবে তাতে কোনো প্রাণ থাকবেনা।
এরমাঝে অপরাহ্ন আবারও আদ্রিতার টেস্টগুলো আবার করিয়েছে। কিন্তু আবারও কোন ফল পাইনি তার।আদ্রিতার রোগ ধরাই পড়ছেনা। নিবিড় ঢাকার সবচেয়ে বড়ো হাসপাতালে আদ্রিতাকে দেখিয়েছে। তারাও কোনো রোগ ধরতে পারেনি। চারিদিক থেকে শুধু নিরাশা ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছেনা নিবিড়।নিবিড় ভাবলো আদ্রিতাকে বিদেশে নিয়ে যাবে। তখন অপরাহ্ন ওকে ক্লিনিকে ডেকে বলল,
“দেখ শুধু শুধু দেশ বিদেশ ঘুরে কোনো লাভ নেই।রিপোর্টে কিছু না আসলে কেউ কিছুই বলতে পারবেনা। আমি অরির ব্যপারটা নিয়ে অনেক ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। এমনকি সিঙ্গাপুরের এক ডক্টরের সাথেও আলাপ করেছি। সেও সবটা শুনে একটু ভাবনায় পড়ে গিয়েছিল। পড়ে বলল,হতে পারে আদ্রিতার শরীরে কোনোরকম নেশাজাতীয় দ্রব্য যাচ্ছে। যার কারণে ও এমন করছে।”
নিবিড় রাগী স্বরে বলল,
“তুই কি বলতে চাচ্ছিস, অরি নেশা করে! তোর মাথা ঠিক আছে! ”
“দেখ, শান্ত হ। আমি বলছিনা ও ইচ্ছে করে নেয়। হতে পারে কেউ ওর অজান্তেই ওকে কোনো ধরনের মা,দ,ক দ্রব্য দিচ্ছে। সেটা ও বুঝতেও পারছেনা। এটা জাস্ট একটা ধারণা। যেটা হতেও পারে নাও পারে। তবে খতিয়ে দেখতেতো ক্ষতি নেই। এমুহূর্তে কোনোকিছুই আমাদের বাদ দেওয়া উচিত না।”
“আচ্ছা মানলাম, কিন্তু এমন কিছু হলেও তো রিপোর্টে আসার কথা।”
“হ্যাঁ, জানি। কিন্তু এখন দিনে দিনে সবকিছুই অনেক ইম্প্রুভ হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের ডক্টর বলল,এখন নাকি এমন কিছু ড্রা,গ,সও বের হয়েছে যা শরীরে গেলেও পরিক্ষায় ধরা পড়ে না। আর পড়লেও তা অনেক দেরিতে ধরা পড়ে। ততদিনে রুগীর অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়।”
নিবিড় চিন্তায় পড়ে গেল। আদ্রিতার মতো সহজ সরল মেয়েকে কে অসুস্থ করতে চাইবে!
আদ্রিতার অসুস্থতায় শুধু নিবিড় না, পুরো বাড়িতেই যেন শোকের ছায়া নেমেছে। আরমান সাহেব নাতনীর চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নূরানও আদরের বোনের এই অবস্থা দেখতে পারছেনা। তানিতো শুধু কাঁদতেই থাকে সারাদিন। আবিরও স্নেহের ভাতিজির এমন দশা দেখে ভেঙে পড়ছে। লিভিং রুমে বসে আবির ধরা গলায় বলল,
“আমি ভাইয়াকে কি জবাব দিবো? তার মেয়ের খেয়াল রাখতে অক্ষম হয়েছি আমি। ভাইয়া এমনিতেই হার্টের পেশেন্ট। মেয়ের এমন কথা শুনলে সইতে পারবেনা।”
আরমান সাহেব অসুস্থ গলায় বললেন,
“না না, আমার আদিকে জানিওনা তোমরা। আমার আদি সইতে পারবেনা। হার্ট অ্যাটাক করবে সে।”
নূরান বলল,
“হ্যাঁ চাচ্চু,দাদু ঠিকই বলেছে।বাবা এমনিতেই অসুস্থ। ওখানে চিকিৎসা হচ্ছে তার। অরির কথা জানলে তাকে বাঁচান যাবে না। আর মা-ও সইতে পারবেনা।”
আবির বলল,
“কিন্তু না বললে কীভাবে হবে? অরি তাদের মেয়ে। তাদের সব জানার হক আছে। অরির কিছু হয়ে গেলে তখন……”
“কিচ্ছু হবেনা অরির।”
আবিরের কথার মাঝেই হঠাৎ গমগমে গলায় কথাটি বলতে বলতে দরজা দিয়ে এগিয়ে এলো নিবিড়। সবার সামনে এসে আবার বলল,
“অরির কিচ্ছু হবেনা। একদম ঠিক হয়ে যাবে ও।ওর জন্য আমরা আছি। বড় বাবা আর মাকে শুধু শুধু টেনশন দেওয়ার দরকার নেই। বড়ো বাবার শেষ করে আসতে দাও।”
আবির বলল,
“দেখো নিবিড়, আমরা সবাইই তাই চাই। অরি মামুনি যেন সুস্থ হয়ে যায়। তবে আল্লাহ না করুক কোনো অরি মামুনির কিছু হয়ে গেল। তখন কি জবাব দেবো তাদের। তারাতো জানতে চাইবে আমরা কেন তাদের আগে জানাইনি! তখন কি জবাব দিবো আমি!”
নিবিড় গম্ভীর সুরে বলল,
“কাউকে কিছু বলতে হবে না। কারণ অরির কিছু হবেইনা। তাহলে কোনো জবাবাদিহির প্রয়োজনইতো পড়ছেনা।”
“আর যদি হয়! তখন কে নিবে এর দায়ভার! কেউ কি গেরান্টি দিতে পারবে! ”
নিবিড় আত্মগর্ব করে বলল,
“হ্যাঁ পারবো। আমি নিবো গ্যারান্টি। আমি সব দায়ভার নিবো”
“আচ্ছা! কোন হকে? কোন হকে তুমি এই দায়িত্ব নিতে চাও?”
“অরির স্বামীর দায়িত্বে। আমি আজ এক্ষুনি অরিকে বিয়ে করতে চাই।আজ থেকে অরির সকল দায় দায়ীত্ব আমার। ওর ভালো মন্দের দায়ভার আমার৷ আজ থেকে ওর উপর পূর্ণ হক থাকবে আমার।”
নিবিড়ের কথায় সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। তানি বলে উঠলো,
“কি বলছ তুমি এসব! মাথা ঠিক আছে! ”
“একদম ঠিক আছে মা। এমনিতেও এটা আগে পড়ে হওয়ারই ছিলো। তাহলে এখন সমস্যা কি!প্রশ্ন যখন হক নিয়ে তাহলে আজ সেটাই পরিপূর্ণ ভাবে হবে আমার। এরপর অরির যা হবে সবকিছুর দায়ভার আমার।”
“তাই বলে এখন! মেয়েটার এমন অসুস্থ সময়! আর অরির মা বাবাও এখানে নেই। তাদের ছাড়া কীভাবে বিয়ে হবে!”
“তাতে কি হয়েছে! অরির বাবারও বাবা আছে এখানে। দাদু যেখানে আছে সেখানে আর কারোর মত অমতের দরকার হয়না। বড়ো বাবাও নিশ্চয় তার বাবার মতে অসন্তুষ্ট হবেন না।”
নিবিড়ের কথায় সবাই আরমান সাহেবের দিকে তাকালো। আরমান সাহেব দ্বিধায় পড়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন না কি বলবেন উনি। তখনই হঠাৎ সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো আদ্রিতা। তানহা ওকে ধরে নিয়ে আসছে। আদ্রিতা নিচে এসে বলল,
“কিসের কথা হচ্ছে এখানে! আমাকেও বলো। ”
নিবিড় সোজাসাপটা বলে উঠলো,
“আমাদের বিয়ের কথা হচ্ছে। বিয়ে করবি আমাকে!”
আদ্রিতা ঢুলুঢুলু চোখে তাকালো নিবিড়ের দিকে। চোখের নজর কেমন মাতালদের মতোই। বোঝা যাচ্ছে হুঁশে নেই এখন সে। আদ্রিতা মাতালের মতো হেঁসে বলল,
“আরে হ্যাঁ করবোতো। অরি বিয়ে করবে। ইয়েএ কত্তো মজা।”
তানি উঠে এসে আদ্রিতাকে ধরে নিয়ে যেতে চেয়ে বলল,
“আরে ও মজা করছে। তুই চল আমার সাথে।”
আদ্রিতা বাচ্চাদের মতো জেদ করে তানির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে নিবিড়ের পেট জড়িয়ে ধরে বলল,
“না যাবোনা। আমি বিয়ে করবো। অরি বিয়ে করবে। নিবিড় ভাইয়ার বউ হবে অরি৷ আমাকে বিয়ে দাও এখুনি।”
তানি বুঝতে পারছে আদ্রিতার এখন হুঁশ নেই। তাই তাকে বুঝিয়ে বলল,
“এমন করে না মা। পরে তোমার বিয়ে দিবো ঠিক আছে। এখন চলো।”
আদ্রিতা তাও জেদ ধরে বলল,
“না না না, এখুনি করবো বিয়ে।”
আদ্রিতা নিবিড়কে ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফল কাটা ছু,রিটা হাতে নিয়ে বলল,
“অরিকে বিয়ে না দিলে অরি এখুনি মরে যাবে কিন্তু।”
আদ্রিতার কাজে সবাই ভয় পেয়ে গেল। নিবিড় দৌড়ে গিয়ে আদ্রিতার হাত থেকে ছু,রি টান দিয়ে নিয়ে ফেলে দিয়ে দুই হাতে আদ্রিতার মুখটা ধরে বলল,
“অরি করবেতো বিয়ে। নিবিড় আর অরির বিয়ে এখুনি হবে। ”
আদ্রিতা বাচ্চাদের মতো হেঁসে বলল,
“সত্যিই! আচ্ছা তাহলে অরি মরবে না। অরি বউ হবে।”
“হুম, নিবিড়ের পুতুল বউ।”
তারপর আর কি! সবাই অগত্যা কাজী ডাকা ছাড়া আর কোন উপায় পেলনা। বিয়ে হয়ে গেল দুজনের। আদ্রিতা হয়ে গেল নিবিড়ের পুতুল বউ।
চলবে…..