#নিয়তি
#নুসাইফা_আশরাফী_আনিফা
#পর্ব_০৩
ম..মা অপেক্ষা করছেন, আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। বলতে বলতে মেহের উধাও।
সালমা বেগম পান চিবুতে চিবুতে বলেন,
-হুন বাপ, আমার একবার দেশে যাওন লাগব। জমি লইয়া কি যানি ভেজাল হইছে। আর তোর ফুপ্পিও বেশ কিছুদিন ধইরা অসুস্থ। সামনের শুক্রবার যাওনের ব্যাবস্থা কর। ইস্কুল থাইকা কয়দিনের ছুটি নে।
মেহরাব মায়ের কথা শুনে বলে,
-মা, এখন তো ছুটি নেয়া যাবে না। আচ্ছা শুক্রবার তো এমনিতেই ছুটি। আমি নাহয় তোমায় পৌঁছে দেব।
-কছ কি আমি কি আমার যাওনের লাইগা কছছি।তুই সারাডা দিন ইস্কুলে থাকবি। আমার মাডারে ঘরে একলা কেমনে রাইখা যাই ক-তো।
-হুম….আচ্ছা মা ওসব নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি নাহয় ইস্কুল থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসব। তাছাড়া জায়গা জমির ব্যাপার কয়দিন লাগে কে জানে।ছাত্রদেরও সামনে এসএসসি এক্সাম। নাহয় ছুটি নেওয়া যেত কিন্তু এ সময় ছুটি নেয়া ঠিক হবে না মা, বুঝতে চেষ্টা করো।
সালমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
-হুম…তাও ঠিক। আচ্ছা জরিনারে রাইখা গেলে কেমন হয়। তুই না আসা পর্যন্ত ও মেহজাবিনের লগে থাকল।
-তা বলতে পারো।
.
আজ মেহেরের শরীর টা ভীষণ খারাপ। বেশ কয়েকবার বমিও করছে। জরিনার বাসায় মেহমান আসবে বলে আজ ও আসেনি। একসপ্তাহ হলো শাশুড়ি দেশে গেছেন। জমির ভেজাল নাকি শেষ হয়েছে। দুদিন পর উনি ফিরবেন।
মেহরাব স্কুল থেকে ফিরে দেখে মেহের শুয়ে আছে। চুপচাপ সে ফ্রেশ হয়ে মেহেরের পাশে বসে অনেক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে!
মেহেরের ঘুম ভেঙ্গে যায়, শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ দুটো লেগে এসেছে টেরই পায়নি সে! মেহরাবকে ওর মাথার পাশে বসে থাকতে দেখে ও উঠে বসে বলে,
-আপনি কখন এলেন?
-এইতো অনেক্ষণ.. কি ব্যাপার এই অসময়ে শুয়ে আছ যে, শরীর খারাপ?
-নাহ, তেমন কিছু না, মাথায় একটু ব্যাথা করছিল আরকি! আপনি বসুন আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি! বলে মেহের উঠে যেতে লাগল।
মেহরাব ওর হাত ধরে টেনে বসালো,
-আরে বসোতো, দেখি এখন ব্যাথা কমেছে?
-হুম এখন একটু ভালো লাগছে।
-কোন কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকো, আমি খাবার নিয়ে আসছি। নিশ্চয়ই তোমারও এখনো খাওয়া হয়নি, বলে মেহরাব ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উঠে গেল আর এক প্লেট খাবার হাত ফিরে এলো,
-নাও হা করো..
-আমার ভালো লাগছে না, এখন খাবো না, আপনি খেয়ে নিন…
-ওহ তাহলে প্রতিদিন এমন করো, না খেয়ে খেয়ে শরীরের কি অবস্থা করেছ সেদিকে খেয়াল আছে! নাও হা করো…নয়তো
মেহরাবের জুড়াজুড়িতে মেহের অনেক কষ্টে দুই লুকমা ভাত গিললেও তৃতীয় লুকমা মুখে দেওয়ার সাথে সাথে যেন ভেতরটা মুচড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিল। মেহরাব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, দু’এক মিনিট পর সেও গেল, গিয়ে দেখে মেহের বেসিন আকড়ে ধরে জুড়ে জুড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মেহরাব ভয় পেয়ে দৌড়ে ওর কাছে গেল,
-মেহের কি হয়েছে তোমার। তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেন।
-জা নি না মাথাটা…বলতে বলতে মেহরাবের বুকে মাথা এলিয়ে দেয় মেহের!
.
খুশির খবরটা শুনে সালমা বেগম আর থাকতে পারলেন না। সেদিনই চলে এলেন। এসেই মেহেরকে জড়িয়ে ধরে যেন খুশিতে কেঁদেই দিলেন। মেহরাবের খুশিও যেন আর ধরে না। সে বাবা হবে! এরচেয়ে খুশির খবর আর কি হতে পারে। মেহেরের জীবনটাও যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠল। মাতৃত্বের স্বাদ যে কতো মধুর তা একজন মা ব্যাতীত অন্য কেউ পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে পারবে না সেটা সম্ভবও নয়। সেও মা হবে তারও ফুটফুটে একটা বাবু হবে। এটা ভাবতেই মেহেরের মনে এক অদ্ভুত আনন্দগণ অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিল। এভাবে হাসি আনন্দের মধ্যেই চলছে তাদের দিন।
মেহরাবের মিষ্টি শাসন আর শাশুড়ির আদর যত্নে কাটছে প্রতিটা দিন। যেন মেহেরকে মাথায় রাখতে পারলেই তাদের শান্তি। এটা করো না ওটা করো না।ইদানিং ওরা মা ছেলে মিলে মেহেরকে কোন কাজই করতে দেয় না। দুপুরে না ঘুমালে শ্বাশুড়ির কড়া ধমক শুনতে হয় মেহেরকে। তিনি বিভিন্ন কথা বলতে বলতে নিজেই মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেন মেহেরকে,
-হুন মা এই সময় তোমার বেশি বেশি কইরা সুষম পুষ্টিকর খাবার খাওন লাগব। তুমি তো একদম খাইতে চাওনা। এইডা কিন্তু একদম ঠিক না। শাক-সবজি ফলমূল খেতে মন না চাইলেও জোর কইরা খাইবা। এতে লৌহের ঘাটতি পূরণ অইব। বেশি কইরা পানি খাইবা। ডাক্তার কি কইল হুন নাই। তোমার শরীর ডা খুব দুর্বল। এই সময় না খাইলে অইব! আর বেশি বেশি কইরা ইবাদত করবা। এতে কইরা আমার সোনামনি ডা নেকবখত অইব।
মেহের শ্বাশুড়ির কথা শুনে কেঁদে দেয়। নিঃশব্দে কান্না। হয়তো তার মা থাকলে আজ এভাবেই ওকে আদর করেতেন।
সালমা বেগম ওর চোখে পানি দেখে বলেন,
-আমার মাডার কি অইছে, চোখে পানি কেন? আমি খারাপ কিছু কইছি।
মেহের তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে বলে,
-ছি ছি মা কি বলছেন, আপনি খারাপ কিছু বলবেন কেনো…. চোখে কি যেন পড়ছে তাই..
-আমার লগে মিছা কথা কও? নিশ্চয় মেহেরাবে তোমারে কিছু কইছে! আজ ..
-না না মা উনি কিছু বলেননি। হঠাৎ ……
-হুম হঠাৎ
– মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিলতো তাই…
-কি কইলা মেয়ে, মায়ের কথা মনে পড়ছিল মানে, তাইলে আমি আমি কে?
বলেই মেহেরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উনি উঠে গেলেন।
মা…
সালমা বেগম জানালা থেকে হাত সরিয়ে চোখ মুছে পিছনে তাকালেন। মেহের দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল। মা..এরপর আবার কান্না।
-ছি মা এমন কইরা কেউ কাঁদে। দেখি, দেখো মুখের কি অবস্থা করছ, বলে উনি মেহেরের চোখ মুছে দিলেন। মেহের এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
-কি রে আমি এহনো তোর শ্বাশুড়ি না…মা হতে পারিনি!
মেহের আবার উনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-নাহ মা, আপনিই আমার মা.. আমি আসলে কথাটা ওভাবে বলিনি!
-যেভাবেই বলো, আর কখনো ওমন কইরা মন খারাপ করবা না। মারে রাইখা আবার মায়ের লাইগা কান্না হ্যাঁ, বোকা মেয়ে!
-কি ব্যাপার, মেয়েকে খুব আদর করা হচ্ছে না, করবেইতো আমিতো পর! গাল ফুলিয়ে পেছন থেকে বলে উঠল মেহরাব।
সালমা বেগম এগিয়ে এসে ওর কান টেনে বলেন,
-দুষ্টু ছেলে আইসাই আমাগো মা-মেয়ের ভালোবাসায় ভাগ নিতে চইলা আইলি। যা ভাগ গিয়া আগে ফ্রেশ হ।
-হুম…. আমি তো এখন পর সব আদর মেয়েকেই করো গে….. বিড়বিড় করতে করতে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরূমে ঢুকল মেহেরাব।
ওর ন্যাকামো দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল মেহের। সালমা বেগম মুচকি হেসে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মেহেরের দিকে, আর মনে মনে ভাবেন…
(চলবে ইনশাআল্লাহ…)