নিষিদ্ধ বরণ পর্ব ১৯+২০

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৯)

ছোট্ট খানা টেবিলে শরবতের গ্লাস রাখতে রাখতে স্বামীর দিকে তাকালেন আসমা রহমান। তারপরেই পাশের চেয়ারটাই। অল্প বয়সের সুস্বাস্থ্যের চঞ্চলপনা ছেলেটিকে খুব একটা মনে ধরল না তার। চোখের দৃষ্টি সরিয়ে দাওয়া থেকে ফিরে আসলেও দরজার কাছেই দাঁড়ালেন। পর্দার আড়ালে থেকে স্বামীর এদিকে তাকানোর অপেক্ষা করছিলেন। এরশাদ রহমান ছেলের বাবার সাথে কথা বলার ফাঁকে দরজার দিকে তাকালেন। সাথে সাথে স্ত্রীর ইশারামাখা চাহনিতে থেমে গেলেন। ছেলে ও বাবার হাতে শরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে চেয়ার ছাড়লেন। স্ত্রীকে খুঁজে পেলেন রান্নাঘরে।

” ডাকছিলে কেন? ”

আসমা রহমান বিরক্ত চোখে তাকালেন। স্বামীকে সমীহ করে চললেও মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ হারান। এবারও হারাচ্ছেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না তার সাথে কোনো প্রকার আলোচনা না করেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। আসমা রহমান কপট রাগ নিয়েই বললেন,
” ছেলে কী করে? ”
” আলাদাভাবে কিছু করে না। শুনেছি বাবার ব্যবসায় সহযোগিতা করছে। বিয়ের পর..”

স্বামীকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই আসমা রহমান প্রশ্ন করলেন,
” কী দেখে পছন্দ হলো তোমার? ”

স্ত্রীর এমন প্রশ্নে থতমত খেলেন এরশাদ রহমান। সেই সুযোগে আসমা রহমান বললেন,
” বয়স কত? দেখে তো মনে হলো বয়সে নিহিতার কাছাকাছি হবে। মাদরাসার ছাত্রও না। মসজিদে যায় তো? ”

এরশাদ রহমান দুর্বল কণ্ঠে বললেন,
” যায়। আমাদের মতো ধর্মপ্রাণ না হলেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সে। ”
” এটুকুতেই খুশি হয়ে গেলে? নিহিতার মত নিয়েছ? যদি পছন্দ না হয়? তাছাড়া এই পিচ্চি ছেলে সংসারের বুঝবে কী? তার মধ্যে করছেও না কিছু! ”

এরশাদ রহমান স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখলেন। মৃদু হেসে বললেন,
” শান্ত হও। ”

আসমা রহমান শান্ত হলে এরশাদ রহমান বললেন,
” ছেলেকে আমি পছন্দ করিনি। তোমার মেয়ের জামাই করেছে। ”

আসমা রহমানের চিন্তিত বদনখানা বিস্ময়ের রূপ নিল,
” মাহদী! ”
” হ্যাঁ। ”

আসমা রহমান আগ্রহ নিয়ে বললেন,
” ছেলে কি ওর পরিচিত? ঢাকার ওদিকে থাকে নাকি? ”
” না, বাড়ি দিনাজপুরেই। মাহদীর পরিচিত নাকি জানি না। যখন ছেলের খোঁজ দিয়েছিল তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম। পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল, অন্য কারও সামনে নিহিতাকে নেওয়ার পূর্বে এই ছেলের একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে। মাহদীর কথা শুনেই বুঝেছিলাম সব রকম খোঁজ খবর নিয়েই আমাকে বলেছে। তবুও মনের সন্দেহ দূর করতে একটু খোঁজ খবর নিয়েছিলাম। ”

আসমা রহমান আবার রেগে গেলেন। বললেন,
” তোমার এখনও মাহদীর উপর সন্দেহ হয়? ”
” না। ”
” তাহলে আবার খোঁজ-খবর নিলে কেন? ”

এরশাদ রহমান সাথে সাথে উত্তর দিলেন না। কিছুক্ষণ পর শীতল কণ্ঠে বললেন,
” বাবা হই যে তাই। নিজ চোখে পাত্রের গুণ না দেখে কন্যা দান করি কী করে? ”

আসমা রহমান অপ্রতিভ হয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। নিচু স্বরে বললেন,
” সব ঠিক আছে। কিন্তু নিহিতা কি রাজি হবে? আগে থেকে কথা বলে নিলে ভালো হতো না? ”

এরশাদ রহমানের উত্তর দেওয়ার মুহূর্তে নিহিতা উপস্থিত হলো। রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিবুক নামিয়ে বলল,
” আমি রাজি। ”

মেয়ের কণ্ঠে বাবা-মা দুজনেই চমকে তাকালেন। নিহিতা পিলপিল পায়ে ভেতরে ঢুকে বলল,
” আমি জানি, বাবা আমার ভালো চান। তাঁর প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত আমার ভালো থাকাকে ঘিরে। মেয়ে হয়ে জন্মদাতার উপর এতটুকু বিশ্বাস তো থাকতেই হবে তাই না, আম্মু? ”

আসমা রহমান মেয়েকে জড়িয়ে নিলেন। খুশিতে চোখে পানি জমে গেছে। মায়ের আদরে বন্দী অবস্থায় নিহিতা বলল,
” বাবা, আমি কি উনার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে পারি? ”

বাবা উত্তর দেওয়ার পূর্বে মা জিজ্ঞেস করলেন,
” কার সাথে? ”
” যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে। ”

এ পর্যায়ে আসমা রহমান স্বামীর দিকে তাকালেন। এরশাদ রহমান স্ত্রীর দিক থেকে চাহনি সরিয়ে আনলেন মেয়ের দিকে। ক্ষণকাল চুপ থেকে বললেন,
” অবশ্যই। বিয়ে যখন হচ্ছেই তখন দেখাদেখির পর্বটা শেষ হওয়াই ভালো। ”

এরশাদ রহমান আর দেরি করলেন না। ছেলেকে বসার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে দাওয়াই বসলেন। বাকি কথা-বার্তা স্ত্রীর সামনেই হোক।

_____________
” বিশ্বাসই হচ্ছে না, তুমি বোরকা ছাড়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছ! ”

আহাদের বিস্মিত অভিব্যক্তিতে একটুও অবাক হলো না নিহিতা। সাধারণভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকালে আহাদ আকাশ মাপের বিস্ময় নিয়ে বলল,
” তুমি সত্যি আমার দিকে তাকিয়েছ? আমাকে দেখছ? নিহিতা, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? ”

এবার নিহিতার চোখে-মুখে বিরক্ত ধরা পড়ল। দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
” আপনি কি স্বাভাবিক হবেন? আমার জরুরি কথা ছিল। ”

আহাদ বিস্ময় কাটাতে চাইল, পারল না। বাধ্য হয়ে বলল,
” কী করে স্বাভাবিক হব বলো? তোমার বিয়ে হয়ে গেছে শুনে যখন দিশাহারা হয়ে পড়লাম ঠিক সে সময় শুনলাম ওটা নাটক ছিল। আমাকে মিথ্যা বুঝানো হয়েছিল। তার মধ্যে তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পেলাম। ”

নিহিতা চোখ তুলে তাকাল। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো প্রস্তাবটা কে দিয়েছে। পর মুহূর্তে মাহদীর মুখটা ভেসে উঠল চোখের পাতায়। সাথে সাথে বুকের বা পাশে ক্ষীণ একটা ব্যথা সৃষ্টি হলো। চোখ বন্ধ করে বলল,
” আমি কি আমার কথা বলতে পারি? ”

এবার নিজেকে সামলাতে সফল হলো আহাদ। বলল,
” কী কথা? ”

নিহিতা চোখ মেলল। একটু চুপ থেকে বলল,
” আপনাকে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু..”
” কিন্তু? ”

আহাদের কৌতূহলী বদনে এক বার দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল,
” আমার একটু সময় চাই। বিয়েটা কি এক মাস পিছিয়ে নেওয়া যায় না? ”

আহাদ কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হওয়ার পূর্বে নিহিতা দ্রুত বলল,
” আপনি না করবেন না, প্লিজ। ভয়ও পাবেন না। আমি আপনাকেই বিয়ে করব। কথা দিচ্ছি। ”

নিহিতা চুপ হয়ে গেলেও আহাদ কিছু বলল না। নিহিতা উৎসুকমনে অপেক্ষা করছে আহাদের উত্তরের। কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে যেতেও যখন সে চুপ থাকল তখন নিহিতা অস্থির হয়ে পড়ল। ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,
” বাবাকে বললে উনি আমার অনুরোধ ফেলতেন না। কিন্তু আমি চাচ্ছিল না…”
” কথা দিচ্ছ তাহলে? ”

কথার মাঝে প্রশ্ন করায় নিহিতা থমকে গিয়েছিল। বোকা চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
” জি? ”
” এক মাস পরে আমাকেই বিয়ে করবে। ”

নিহিতা দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,
” হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি। ”

আহাদ হালকা হেসে বলল,
” ঠিক আছে। আমি আংকেলের সাথে কথা বলব। ”

নিহিতা কৃতজ্ঞপূর্ণ হাসলে আহাদ বলল,
” তোমাকে কিছু দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। সেটাও কি এক মাস পর দেব? ”

নিহিতা কিছু না ভেবেই ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
” এখনই পরাতে পারেন। ”

আহাদ নিহিতার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলে সে লজ্জা পেল। বুঝতে পারল কৃতজ্ঞতা দেখাতে গিয়ে বেহায়ার মতো কাজ করে ফেলেছে। আড়ষ্টতায় হাত সরিয়ে নিলে আহাদ সামান্য হাসল। হাসি নিয়ে নিজের হাত থেকে একটা আংটি খুলল। নিহিতার বাম হাত টেনে নিয়ে অনামিকা আঙুলে আংটি পরিয়ে বলল,
” মাপে বড় হয়েছে। দেখ, আবার হারিয়ে ফেল না। ”

নিহিতা লজ্জায় কথা বলতে পারল না। মনে মনে নিজেকে ধমকাচ্ছে। আহাদ আংটি পরানো শেষে ভাঁজ করা একটি কাগজ রাখল তালুতে। বলল,
” সেদিনের চিঠিটা কে লিখেছিল জানি না। আমি ভেবেছিলাম তুমি লিখেছ। সে ভাবনা থেকে আমিও একটা লিখেছিলাম। তোমার নামে, তোমাকে কল্পনা করে। নিহিতা, আমি তোমাকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করি। তোমার চালচলন অন্যরকম দেখে কখনও বলার সাহস পাইনি। আজ একটু সাহস করে বললাম। চিঠি দিলাম, আংটিও পরিয়ে দিলাম। এখন শুধু এক মাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা। ”

নিহিতা নীরব থাকলে আহাদ বুঝে নিল তার কথা বলা শেষ। সেও আর কথা বাড়িয়ে বিরক্ত করতে চাইল না। বসার রুম ত্যাগ করার পূর্বে আরেক বার নিহিতার মুখটার দিকে তাকাল। স্নিগ্ধ মুখে চেয়ে থেকে সুধাল,
” তুমি আমার বউ হবে তো, নিহি? ”

আহাদের প্রশ্নটায় খানিকটা কেঁপে উঠল নিহিতা। কাঁপা কাঁপা পলকে আহাদের দিকে তাকালে সে বলল,
” আমি যে নিহিতাকে ভালোবেসেছি সে কখনও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। ভবিষ্যতেও করবে না এই বিশ্বাস নিয়ে চলে যাচ্ছি। ”

_________

ট্রেন থেকে নেমে কমলাপুর রেলস্টেশনে চারপাশটায় চোখ রাখল নিহিতা। আসমা রহমান পাশে এসে দাঁড়াতে নিহিতা আনন্দিত কণ্ঠে বলল,
” আম্মু, ঢাকা শহর অনেক সুন্দর, তাই না? ”

আসমা রহমান স্বামীর হাত থেকে ভারী ব্যাগ নিয়ে নিচে রেখে বলল,
” সুন্দরের কী দেখলি? আমার তো এখনই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এত মানুষ একসাথে জীবনেও দেখিনি! ”

নিহিতা নীঃশব্দে হাসল। এরশাদ রহমানও ততক্ষণে নেমে পড়েছিলেন। স্ত্রীর কথা শুনে খানিকটা হাসলেন। পর মুহূর্তে চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
” মাহদীকে না জানিয়ে আসাটা কি ঠিক হলো রে, মা? ”

নিহিতা হাসি বন্ধ করে বাবার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” জানিয়ে দিলে কি সারপ্রাইজ হবে, বাবা? ”
” তা ঠিক। কিন্তু আগে তো কখনও যাইনি। বাসা খুঁজে বের করতে সমস্যা হলে? তাছাড়া ওর এই সময় বাসায় থাকার কথা না। বাসায় কে কে আছে জানিও না। যদি বিপদে পড়ি? ”
” কিসের বিপদ? আমরা কি অচেনা কেউ? নাকি দূর সম্পর্কের কেউ? ”
” তারপরেও। মাহফিল শেষে আমি এবার দেখা করে যেতাম। তোরা নাহয় পরের বার আসতি। ”

নিহিতার মন খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলল, ‘ পরের বার আসতে আসতে যদি আমার বিয়ে হয়ে যায়? উনি যে অন্যায়টা করেছেন এর শাস্তি না দিয়ে বিয়ের পিড়িতে কীভাবে বসব, বাবা? ‘ সামনাসামনি বলল,
” আল্লাহ হয়তো চাচ্ছিলেন আমার বিয়ের দাওয়াতটা আমিই দেই। ”

_________
ঠিকানা জানা থাকায় মাহদীর বাসা খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগলেও খুব একটা কষ্ট হলো না। গেইটের দায়িত্বে থাকা দারোয়ানের কাছে নিজেদের পরিচয় দিয়ে সিঁড়ি কাটছিল নিহিতারা। মাহদীরা এই বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় থাকে। এক তলা পেরিয়ে দোতলায় উঠতে আসমা রহমানের মনে পড়ল, মন চারপাশের মানুষদের নিয়ে এত গল্প করলেও কখনও দাদা-দাদীকে নিয়ে কিছু বলেনি। তাহলে কি তাদের সাথে তার দেখা-সাক্ষাৎ হয় না? নায়রার মুখে শুনেছিল মাহদীর যাতায়াতের সুবিধার জন্য অফিসের কাছে বাসা ভাড়া নিয়েছিল। শ্বশুর-শাশুড়িরা নিজস্ব বাসাতেই থাকতেন। কিন্তু এখন? এখন তো নায়রা নেই। তাহলে মাহদী কোথায় আছে? ভাড়া বাসায় নাকি বাবা-মায়ের সাথে? স্বামীকে প্রশ্ন করার জন্য উদ্যত হতে মনে পড়ল, মাহদী তার শ্বশুরকে দাওয়াত দিয়েছিল নায়রার নিজ হাতে সাজানো সংসার দেখতে। তাহলে কি এটা ভাড়া বাসা? ভাবতে ভাবতে প্রশ্ন করে বসল,
” বাসা যদি তালা দেওয়া থাকে? ”

নিহিতা পাশ থেকে বলল,
” ভেঙে ফেলব। ”

মেয়ের রসিকতায় এরশাদ রহমান হেসে ফেললেন। বললেন,
” ভাঙতে হবে না। মাহদী বাসায় না থাকলেও মন আছে। ”

আসমা রহমান দ্রুত প্রশ্ন করলেন,
” কী করে বুঝলে? ”

এরশাদ রহমান ঘড়ি দেখিয়ে বললেন,
” আড়াইটা বাজে। মনের স্কুল ছুটি হয় বারোটায়। ভাগ্য ভালো হলে মাহদীকেও পেতে পারি। দুপুরের খাবার খেতে ও বাসায় আসে। ”

___________

অফিস শেষে রিকশায় বসতে বসতে ফোন কানে নিল মাহদী। ডায়াল করা নাম্বারটা বিকেল থেকে বন্ধ দেখাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া অবস্থা। কাজের চাপ বেশি থাকায় বাসায় কল করে বলেছিল আজ খেতে আসবে না। মন প্রথমে মানতে চাচ্ছিল না। কেঁদেও ফেলেছিল প্রায়। সময় নিয়ে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কল কাটার পর পুনরায় কল দিয়েছিল বিকেলে। তখন থেকেই বন্ধ দেখাচ্ছে।

মাহদী রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিচ্ছে আর বাসায় কল করে যাচ্ছে। ভয়ে, আতঙ্কে তার মুখ রক্তশূন্য। দুশ্চিন্তারা ঝেঁকে বসেছে মুখজুড়ে। বাসার সামনে এসে রিকশা থামতে মাহদী বিশ টাকার জায়গায় একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিল রিকশাওয়ালাকে। ভাংতি টাকা ফেরত নেওয়ারও বুঝি সময় নেই।

সিঁড়ি কেটে চারতলায় পৌঁছিয়েই নিজের রুমের দরজার দিকে দৃষ্টি রাখল সে। যত কাছে এগুচ্ছিল বুকের ধুকপুকানি ততই বাড়ছিল। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিতে তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা! মন কোথাও নেই। সে সভয়ে ডাকল,

” মন? ”

উত্তর এলো না। মাহদী মাত্রাতিরিক্ত ভয়ে শরীরের জোর হারিয়ে ফেলেছে যেন। ধীরে ধীরে বসার রুম পার হয়ে নিজের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আরেক বার ডাকল,
” মন? আমার বাবাটা? ”

এবারও উত্তর এলো না। তবে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো। সেই শব্দে মাহদীর হারিয়ে যাওয়া শক্তি ফিরে এলো বুঝি। চট করে ভেবে বসল মন তার সাথে লুকোচুরি খেলছে। তাই সাবধানে রুমের ভেতর ঢুকে উচ্চস্বরে বলল,
” বাবা, মনকে দেখে ফেলেছে। ”

কথাটা বলে সহাস্যে সামনে তাকাতে তার শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল যেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। চোখের এক স্থির দৃষ্টি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শাড়ি পরিহিতার দিকে।

চলবে#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২০)

মেরুন রঙের শাড়ির সাথে পিঠময় ছড়িয়ে আছে ঘন গোছার চুল। উল্টো দিকে ঘুরে থাকলেও একপাশে কানের লতিকায় ছোট্ট ঝুমকা জ্বলজ্বল করছে! মাহদীর পুরো মনোযোগ যখন দুলটায় এসে পড়ল ঠিক তখনই ঝুমকাটা নড়ে উঠল। চুড়ির ঝনঝন শব্দে তার কর্ণলতা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। বুকের মধ্যে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া সাইক্লোনটা থেমে গেল। ভ্রম কাটিয়ে চেতনা ফিরতে খেয়াল করল একটা মেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে। পাখার হাওয়াই এলোমেলোভাবে উড়ে যাওয়া চুলগুলো ঠিক করতে গিয়েই হাতটা বার বার ঝুমকোতে বাড়ি খাচ্ছে। চিকন দুটো চুড়ি একে অপরের সাথে লেগে মৃদু শব্দ তুলছে। মাহদী এক হাতে পাখা বন্ধ করল অন্য হাতে দরজায় ঝুলে থাকা পর্দা টেনে ছিঁড়ে ছুঁড়ে মারল শাড়ি পরা মেয়েটির দিকে। মাথাসহ মুখ ঢেকে যেতে মাহদী ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,
” দুই মিনিটের মধ্যে নায়রার ব্যবহৃত জিনিস খুলে রাখবে। ”

নিহিতা ভয়ে কেঁপে উঠলেও দমে গেল না। পর্দা ফেলে মাহদির দিকে ঘুরে বলল,
” কেন? আমি কি আপুর শাড়ি পরতে পারি না? ”

মাহদি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আগুনের ফুলকির মতো উত্তপ্ত চাহনি! নিহিতা পুড়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলে মাহদী বলল,
” অবশ্যই পার। কিন্তু বউ সাজতে পার না। ”
” বউ সাজতে যাব কেন? আমি তো শুধু শাড়িটা পরে দেখছিলাম আমাকে কেমন লাগে। ”

নিহিতা দুর্বল জবানবন্দি দিয়ে মাহদীর দিকে তাকাল। খেয়াল করল সে তার হাতের চুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। নিহিতা চট করে হাতদুটো পেছনে নিলে, মাহদী রুষ্ট স্বরে বলল,
” আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। মনে রেখ, তোমার হাতে মাত্র দুই মিনিট সময়। ”

মাহদী বেরিয়ে যেতে নিলে নিহিতা জেদ ধরে বলল,
” খুলব না। ”

মাহদী দরজা চেপে ধরল শক্ত চাপে। চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করেও রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। মুখমণ্ডল কাঁপছে অনবরত!

সেই সুযোগে নিহিতা তার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমি কিছু বলার আগেই সব বুঝে যান কেন, বলুন তো? আপনার এই বিশেষ গুণটি আমাকে আরও বেশি পাগল করে দেয়। এখনও দিচ্ছে। ”

মাহদী তখনও নীরব, চুপচাপ, বাক্যহীন। নিহিতা উৎসাহ নিয়ে বলল,
” ভালোই হয়েছে, আমাকে কষ্ট করে কিছু বলতে হয়নি। লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ। ”

নিহিতার অনুভূতি প্রকাশে মাহদী কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালে সে আরও উতলা হয়ে পড়ে। মাহদীর কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে লাজুক কণ্ঠে বলল,
” কেমন লাগছে বলবেন না? ”

নিহিতার লজ্জামাখা তুলতুলে মুখটার দিকে তাকায় মাহদী। তাকিয়েই থাকে। তাকিয়ে থেকেই তার হাত থেকে চুড়িগুলো খুলে বলল,
” পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুখটির অধিকারী আমার নায়রা, আমার বউ। যে লজ্জা পেলে জোসনা গলে পড়ে। হাসলে তারা খসে পড়ে। কাঁদলে অমাবস্যা হয়। সেই নিষ্কলঙ্ক, পবিত্র, স্নিগ্ধ মুখটিতে প্রসাধনী মাখতে হয় না। আমি তাকালেই সৌন্দর্যের প্রলেপ ভারী হয়। ”

নিহিতার কান থেকে দুলজোড়া খুলে বলল,
” এগুলো আমার দেওয়া উপহার ছিল বলে পড়ে থাকত। মুগ্ধ করতে নয়, ভালোবাসা প্রকাশ করতে। আমার সেই বিশেষ গুণটি তৈরি হয়েছে তোমার আপুর জন্য। কারণ, সে মনের কথা মুখে আনতে লজ্জা পেত। ”

মাহদী নিহিতাকে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিহিতা পিছু নিয়ে বলল,
” মানছি আপু দেখতে সুন্দর ছিল। কিন্তু আমার থেকে বেশি নয়। বিশ্বাস না হলে ভালো করে চেয়ে দেখুন। ”

মাহদী থমকে দাঁড়িয়ে না ঘুরে বলল,
” আমার চোখদুটো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নায়রা ছাড়া আর কাউকে দেখবে না। ”

নিহিতার চোখ জলে টলমল। হাল ছাড়তে রাজি নয়। দৌড়ে এসে বলল,
” যে নেই, তার নামে প্রতিজ্ঞা রেখে কী লাভ? ”
” প্রতিজ্ঞার সাথে থাকা- না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। নিহিতা, এটা আমার থেকেও তোমার খুব ভালো করে জানা। ”

নিহিতা কিছু একটা বলার জন্য প্রস্তুত হতে দূর থেকে আসমা রহমানের গলা ভেসে এলো,
” মাহদী? কখন এলে? ”

নিহিতার দিক থেকে সম্পূর্ণ মনোযোগ সরিয়ে হালকা হাসল মাহদী। শাশুড়ির দিকে এগুতে এগুতে সালাম দিয়ে বলল,
” এইতো কিছুক্ষণ হলো। আপনারা কখন এসেছেন, আম্মা? বাসা খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়? একটা কল করলেই হতো। আমি মনকে নিয়ে স্টেশনে চলে যেতাম। ”

আসমা রহমান আন্তরিক হেসে বললেন,
” কষ্ট হবে কেন? নিহিতার বাবা ছিলেন তো সাথে। ঢাকা শহরের সব চেনা হয়ে গেছে তার। ”

দুজনের কথপোকথনের মধ্যে মন বের হয়ে আসল পাশের রুম থেকে। ঘুম চোখে নানির কোমরের সাথে ঘেষে দাঁড়ালে মাহদী জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় ছিলে তুমি? বাসার ফোন বন্ধ কেন? কামাল কোথায়? ”

কামাল এ বাসার বিশ্বস্ত কাজের লোক। মনকে দেখাশুনাসহ প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কাজ করে। বয়সে মাহদীর চেয়ে কিছুটা ছোট হবে। মন বাবার প্রশ্ন দেওয়ার বদলে চোখ বন্ধ করে নিলে আসমা রহমান বললেন,
” কামালকে নিয়ে উনি একটু বেরিয়েছেন। এখনও আসেনি বোধ হয়। মন আমার সাথেই ছিল। আগরিবের নামাজ পড়ে একটু শুয়েছিলাম। কখন যে চোখ লেগে এসেছে বুঝতে পারিনি। ”

মনের অবস্থা দেখে মাহদী বুঝে নিল নানির সাথে সেও ঘুমিয়ে পড়েছিল, এখনও ঘুমাচ্ছে। ছেলেকে দাঁড়িয়ে ঘুমাতে দেখে তার খুব হাসি পেল। হাসি চেপে তাকে কোলে তুলে বলল,
” সমস্যা নেই, আম্মা। অনের দূর থেকে এসেছেন তো তাই শরীর ক্লান্ত। আমি মনকে শুয়িয়ে দিয়ে আসছি। ”

মনকে নিয়ে মাহদী চলে গেলে আসমা রহমানের নজর পড়ল নিহিতার উপর। চোখ কপালে তুলে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
” তোর পরনে শাড়ি! কোথায় পেলি? ”

নিহিতা বিরক্ত চোখে তাকাল। নিরুত্তরে মায়ের পেছনের রুমে ঢুকে পড়ল। তিনি রুমের দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরের দিকে পা চালালেন।

___________

রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, আক্রোশ, অভিমানে যখন নিহিতার চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল তখন ফোনটা বেজে ওঠল। ভেজা পাতা মেলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল। অপরিচিত নাম্বার দেখে প্রথমবারে ধরল না। দ্বিতীয়বারেও না। তৃতীয়বারে রিসিভ করে কানে ধরে সালাম দিল। ওপাশ থেকে সালামের উত্তর নিয়ে বলল,
” আমি আহাদ, চিনতে পারছ? ”

আহাদের নামটা শুনতে তার সর্বাঙ্গে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হলো। বাকশক্তি হারিয়ে বসলে আহাদ বলল,
” আমি জানি তুমি ছেলেদের সাথে ফোনে কথা বলো না। হয়তো আমার সাথেও বলবে না। তাই মন চাইলেও কল দিইনি। আজ মনটা বড্ড আনচান করছিল, নিহি। কল না দিয়ে থাকতে পারলাম না। একটু কি কথা বলার অনুমতি পাব? ”

নিহিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখ মুছল। ঢোক গিলে গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলল,
” জি বলুন। ”

অনুমতি পেয়ে আহাদের কণ্ঠস্বর পালটে গেল। সহজ স্বরে ভালো-মন্দের খোঁজ নেওয়া শেষে জিজ্ঞেস করল,
” চিঠিটা পড়েছিলে? ”

নিহিতা চিঠি পড়েনি। কোথায় রেখেছিল তাও মনে নেই। এদিকে আহাদকে ‘ না ‘ বলতেও খারাপ লাগছে। তাই চুপ করে থাকল।

আহাদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল,
” আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে চিঠি পড়ার পর তোমার কেমন লেগেছে। বলবে না? ”

নিহিতা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তন্মধ্যে আহাদ বলল,
” আর আংটিটা কী করেছ? এখনও পরে আছ নাকি খুলে রেখেছ? ”

নিহিতা চট করে হাতের দিকে তাকাল। অনামিকা আঙুলে আংটি নেই। কোথায় গেল? সে তো খুলে রাখেনি! নিহিতা ফোন কানে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিছানার বালিশ সরিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। সে সময় মন দৌড়ে এসে বলল,
” খালামনি, বাবা বলেছে এটা তোমার। ”

মনের হাতে আংটি দেখে নিহিতা খুশি হলো। পর মুহূর্তে মন খারাপের ঢেউ আছড়ে পড়ল মনপাড়ায়। খানিকটা ভীত হলো এই ভেবে যে, মেয়েলি আংটি না হওয়া সত্ত্বেও বুঝে গেছে এটা তার। তাহলে কি সে জানে আহাদের দেওয়া উপহার গ্রহণ করেছে?

নিহিতার মনখারাপের মধ্যে মন ছুটে চলে যাচ্ছিল। সে দৌড়ে আটকাল। কোলে করে খাটে বসিয়ে বলল,
” ছোট আব্বু, আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? ”

মন প্রথমে বুঝতে পারল না। যখন বুঝতে পারল তখন নিহিতার দিকে তাকাল বেশ কৌতূহলে। চুপচাপ গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
” খুব সুন্দর। ”

মনের ছোট্ট প্রশংসায় পুলক অনুভূত হলো নিহিতার। মনখারাপ উবে গেল নিমিষেই। চোখের তারায় খুলি ঝিলিক দিল। আবেগে ভেসে মনের কপালে, গালে, নাকে চুমু খেয়ে বলল,
” বাবার কাছে যাও, আমি একটু পর আসছি। ”

মন ছুটি পেয়ে চলে যাচ্ছিল। কী মনে করে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পেছন ঘুরে বলল,
” তুমি আম্মু না সেজে খালামনি সাজলে বেশি সুন্দর লাগে। ”

একটু থেমে আবার বলল,
” বাবা, বলেছে আমি এখন বড় হয়েছি। তোমার সাথে কথা বলার সময় এক হাত দূরে থাকতে হবে। খালামনি, তুমি যে আমাকে চুমু খেলে আল্লাহ কি রাগ করবে? ”

নিহিতা জবাব দিল না। ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছে। নিজের মতো যে ছেলেকেও তার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে খুব বুঝতে পারছে। ইচ্ছে করছে মাহদীর কাছে ছুটে যেতে। মনের জ্বালা মেটাতে যা যা করা দরকার সব করতে। মা জেগে আছে বলে রাগটা ভেতরে ধরে রাখল। এর মধ্যে বাবার গলা পেতেই মন ‘নানা’ ডাকতে ডাকতে চলে গেল।

____________

সে রাতে ঘুম হলো না নিহিতার। পরের দিন সকালে ফজরের নামাজ কাযা করে ফেলায় মায়ের হাতে বকুনি খেল খুব। যার সবটাই কর্ণগোচর হলো মাহদীর। নীরবে সবটা সহ্য করে চুপচাপ নাস্তা করে শ্বশুরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তাকে মাহফিলের স্থানে পৌঁছে দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে আসল। তিনি আজ রাতে বাড়ি ফিরবেন না। ফিরতে ফিরতে পরের দিন সকালে। শ্বশুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে পৌঁছাতে একটু দেরি হলো।

দুপুরে খাবার খাওয়ার জন্য বাসায় ফিরে রক্ত গরম হয়ে গেল মাহদীর। নিহিতা আজও নায়রার শাড়ি পরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” সীমা লঙ্ঘন করো না, একদম ভালো হবে না। মাফ কিন্তু বার বার করা যায় না। ”

নিহিতা পেছন থেকে বলল,
” মাফ করতে বলেছে কে? আপু যদি আপনার রাগকে ভালোবসতে পারে, আমিও পারব। ”

কথার মাঝেই নিজের গাল বাড়িয়ে বলল,
” চাইলে চড়ও মারতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। ”

চলবে

বিঃদ্রঃ দুলাভাই আর শালির প্রেমে হওয়া- না হওয়াটুকু বাদ দিয়ে অন্য কিছু খুঁজুন। এটি কিন্তু শুধু প্রেমের উপন্যাস নয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here