নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-২৫

#নিস্তব্ধ_বিচরণ
#তানজিলা
#পর্ব-২৫

স্নিগ্ধর বাবা মা ডিভোর্সের পর নিজেদের জীবনে এগিয়ে গেলেও এগোতে পারেনি স্নিগ্ধ। একবার এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ধাক্কা খেতে খেতেই শৈশব জীবন কেটেছে। বাবা মায়ের সান্নিধ্যের স্বপ্ন যেন স্বপ্নই রয়ে গেল। সৎ মায়ের ঘৃণা এমনকি মায়ের নতুন পরিবারেও জায়গা হয়নি ওর। ছোট্ট মনে পুষে থাকা অভিমান কষ্ট যেন কারোরই মনে নাড়া দেয়নি। এক সময় অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছিলো সব। আনিসা খাতুন প্রায়ই স্নিগ্ধকে নিজের কাছে রাখতে চাইলেও তার শ্বাশুড়ির জন্য পারেনি। যতবারই স্নিগ্ধকে বাড়ি এনেছে স্নিগ্ধর বিরুদ্ধে তার যেন অভিযোগের শেষ নেই। এক সময় সব কিছু পরিবর্তন হলো। আনিসার হাসব্যান্ড এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ায় পর পরই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে ওকে। ততদিনে আনিসার শ্বাশুড়িও মারা গেছে। স্নিগ্ধর সাথে যোগাযোগ থাকলেও সম্পর্কটা আর আগের মতো ছিল না। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির খোঁজে ব্যাস্ত ছিল স্নিগ্ধ।

শেষ বারের মতো মায়ের মুখটা দেখার সুযোগ হয়নি ওর। যতক্ষনে জানলো পৌঁছাতে পৌঁছাতে কবর দেয়া হয়ে গেছে। আফসোস, অনুশোচনা, কষ্ট কিছুই যেন পৌঁছায়নি ওর হৃদয় পর্যন্ত। কয়েক দিন আগে বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিলো স্নিগ্ধ। আর কখনো যে নিজের মাকে দেখা হবে না ওর সেটা ওর ধারণার বাইরে ছিলো। বন্ধু মহলে স্নিগ্ধ বেশ শক্ত মনের মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলো। তবে এতটা কেউই বুঝতে পারেনি। কয়েকদিনের মধ্যেই নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায় ও! অন্তত আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছিলো। দুই মাস পর হাবিব নামের কেউ স্নিগ্ধর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য ওর মায়ের খুনের ব্যাপারে কোন ইনফরমেশন দেয়া। যদিও ফোনালাপের পর হুট করেই হাবিব মিসিং! হাবিব কে সেটা স্নিগ্ধ জানতো। আনিসার খুনের ব্যাপারে ওর মনেও ছিলো একাধিক ধোঁয়াশা। হাবিবের ভাতিজিকে পড়ানোর বাহানায় হাবিবের বাড়িতেও যাওয়া হয় স্নিগ্ধর। তবে কোন লাভ হয়নি।
কয়েক দিন আগে এক লোক একটা পেনড্রাইভ দিয়ে চলে যায়। মাঝরাস্তায় হুট করেই ওর হাতে পেনড্রাইভ ধরিয়ে চোখের আড়াল হয়ে যায় লোকটা। তবে পেনড্রাইভে এমন কিছু ছিলো যার তালাশে ও মাসের পর মাস ঘুরেছে! মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলো স্নিগ্ধ। হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কালো মেঘের ছায়া রয়ে গেল দৃষ্টির অগোচরে!
_____________________________________________

ঘুম ভেঙে আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসলো জেরিন। বুকের ব্যাথাটা বেশ বেড়েছে। আজও জান্নাতের সাথে এক দফা ঝগড়া হলো ওর। ধীর গতিতে বিছানা থেকে পা নামিয়ে পাশে থাকা পানির জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেলো ও। না চাইতেও মাথায় চড়ে বসলো পুরনো স্মৃতি।

ধুমধাম করে বিয়ে করে এসেছিলো এ বাড়ির। বাড়ির একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে জেরিন ছিলো বেশ আদরের। তবে বছর খানেক পর তা আর স্থায়ী হলো না। রিয়াদের জন্মের এক বছরের মাথায় রিয়াদের বাবা মারা গেল। পুরো বাড়ি জুড়ে ছেয়ে গেছিলো শোকের ছায়া।

এর মাঝে জেরিনের মধ্যে দেখা দিলো বেশ পরিবর্তন। সবাই মনে করেছিলো কয়েক দিন পর হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। তবে দিন দিন জেরিনের অবস্থা অবনতির দিকে যেতে শুরু করলো। রাতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ছাদে বসে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করতো। শ্বশুর বাড়ির লোক একসময় চিকিৎসা করাতে যেয়ে হিমশিম খেয়ে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিলো ওকে। দীর্ঘ তিন মাস সেখানেই ছিলো জেরিন। নিজের বাড়ির মতো সুরক্ষা আর ঐখানে ছিলো না। ওর সাথে সেখানে ছিল আরও অনেকেই। যাদের শুধু একটাই পরিচয়ে ট্রিট করা হতো, পাগল। দিনশেষে নিজের পরিবারে ছুটে যাওয়ার আকুতি আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে এসেছিলো ওর মন। অল্প কিছুতেই কারেন্ট শর্টের স্বীকার হতে হয়েছিল ওকে! জানোয়ারদের মতো বেঁধে রাখা হতো রোগীদের। যদিও তিন মাস পর সেই মেডিকেল বন্ধ করে দেয়া হয় আর ডাক্তারদের লাইসেন্সও কেন্সেল করে দেয়া হয়। মাথা উঁচু করে একদম সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে নিজ বাড়িতে ফিরেছিলো জেরিন। হয়তো!

-“আপনার পুরো পরিবার পাগল! নিজের নাতির বদ মেজাজি স্বভাব চোখে পড়ে না আপনার! অফিসে কোন ডিসিপ্লিন পর্যন্ত নেই! আমি খুব শিঘ্রই রিজাইন লেটার জমা করবো…..!”

অসহ্য যন্ত্রণায় দুই হাতে মাথা চেপে ধরলো জেরিন!

-“আপনার পুরো পরিবার পাগল!”

মাথায় ঘুরছে শুধু এই একটাই কথা। না! ও কোন পাগল না! সম্পূর্ণ সুস্থ ও। ড্রয়ার থেকে একটা ওষুধের পাতা বের করে ওষুধ খেয়ে নিলো জেরিন। হঠাৎ করেই সেই মুহূর্তে রেহানের ঘর থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ শুনেই পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও।

রিয়াদ, ইয়াসমিন আর নাজনীনও রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বেশ শব্দ করেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো রেহান। তবে ইনায়ার কোন সাড়াশব্দ নেই। রক্তচক্ষু নিয়ে ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে আছে রেহান।

-“সব কিছু জেনেও না জানার ভান করে ছিলে তুমি, বাহ্!”

রেহানের চোখে অবিশ্বাসের রেখা।

-“রেহান আমি…!”
-“মা প্লিজ! আর কোন মিথ্যা বলো না। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি এসবে! সব সত্যি জেনেও তুমি আমাকে কিচ্ছু জানাও নি। আর আপনার ওপর এর চেয়ে বেশি আর কিইবা আশা করা যায়!”

শেষের কথাটা রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো রেহান। জেরিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রেহানও হয়তো জেরিনের দিকে তাকাতে ঘৃণাবোধ করছে।

-“আমি যা করেছি আমার মাকে বাঁচাতে করেছি! কিন্তু তুই কী করছিস রেহান! একটা বাইরের মেয়ের জন্য নিজের পরিবারের সাথে লড়ছিস!”

তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে রিয়াদের চোখ চোখ রাখলো রেহান।
-“পরিবার শুধু তোমার আছে! আনিসা খাতুনের পরিবার নেই! হাবিব সাহেবের পরিবার নেই!”

জেরিন দুই হাতে মাথা চেপে ওখানেই বসে পড়েছে। নাজনীন দৌড়ে গিয়ে ধরলো ওর দাদুকে। নাজনীনের বুকেই ধলে পড়লো জেরিন। এতক্ষণ পুরো ঘরে যুদ্ধ চললেও জেরিনের এভাবে পড়ে যাওয়ায় রিয়াদ, রেহানও দ্রুত এগিয়ে গেল জেরিনের দিকে।
_____________________

হসপিটালের করিডোরে পুরো পরিবার অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে। অপরদিকে রিয়াদ ফোনে কারও সাথে কথা বলে আসতেই ইয়াসমিন বেশ সন্দেহের নজরে তাকায় রিয়াদের দিকে। কিন্তু কিছু বলার আগেই ডাক্তার এসে বলে,

-“আপনাদের মধ্যে রেহান আর ইনায়া কে? রোগী এই দুই জনের সাথে দেখা করতে চাচ্ছে!”

রেহান তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে একবার ইনায়ার দিকে তাকালো। কারও মুখে কোন কথা নেই। বিধ্বস্ত মুখের চাহনিতে এক অদ্ভুত মায়া কাজ করছে ইনায়ার মনে। দুইজনই নিরব হয়ে প্রবেশ করলো কেবিনে।

রেহান গিয়ে জেরিনের হাত ধরতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। ইনায়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসার শেষ চেষ্টা করলো জেরিন। হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই নিশ্বাস ভারী হতে শুরু করলো জেরিনের। চোখ মুখ যেন বেরিয়ে আসছে। স্তব্ধ হয়ে শুধু সবটুকু দেখে যাচ্ছে রেহান। নার্স এসেই জেরিনের হাত থেকে রেহানের হাত সরাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু রেহান হাত ছাড়লো না। জেরিনের হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরলো। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত রেহানের দিকে তাকিয়ে ছিলো জেরিন।কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে মৃত ঘোষণা করলো জেরিনকে। আর জেরিনের হাত ধরে ওখানেই পড়ে রইলো রেহান। আশেপাশে কান্নার রোল পড়ে গেছে। তবে সেদিকে কোন খেয়াল নেই রেহানের। এক দৃষ্টিতে জেরিনের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আছে ও!

রিয়াদের চোখেও আজ পানি। সাথে আংশিক ক্রোধও যেন ফুটে উঠেছে। জেরিনের লাশ গাড়িতে রাখা হলো মাত্র। গাড়ির পাশে নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো রেহান। কারও সাথে কথা বলছে না । ইনায়া ইয়াসমিনকে গাড়িতে বসিয়ে রেহানের খোঁজে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। আকাশটা আবারও মেঘলা হয়ে গেছে। রেহান সামনে যেতেই হুট করে ইনায়ার হাত থেকে ওর ফোনটা পড়ে গেল। রেহানের ইনায়ার দিকে কোন খেয়াল নেই। ইনায়া ফোন তুলতে নিচু হতেই এক বিকট শব্দ ওর কানে ভেসে এলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই রেহানের শরীরটা জমিন স্পর্শ করলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here