#নীড়ের_খোজে♥
পর্বঃ০২+০৩
#জান্নাতুল_বিথী
০২
আমার অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে শৈবাল ভ্রু কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
‘অদ্ভুত তো আমার বিয়ে তো কি হইছে আমি তো আর বাবার বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি না।বরং বাবার বাড়ি যাচ্ছি।উল্টো দিকে তোমাকে দেখো?’
লোকটার কথা শুনে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।কিছু না বলে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাই।বাবার বাড়িতে যাদের শৈশব ভালো কাটে,যাদের বাবা মা সন্তানদের আদর-ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখে তারাই আপনজন,আপন নীড় ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কান্না করে।অপরদিকে আমি?মা হারা মেয়ে।আমার বয়স যখন চার বছর তখন বাবা তার প্রা*ক্তন প্রেমিকাকে বিয়ে করার জন্য ডিবোর্স দেয় মা কে।আমার দাদি নিজে পছন্দ করে বাবাকে কে বিয়ে করাইছিলো।ছেলের এমন কাজ দেখে মানুষটা অসুস্থ হয়ে পড়ে।কিন্তু ছেলে কে কোনো ভাবেই মানাতে পারেনি বুড়ো মানুষটা।ডি*বোর্সের পর মা অনেক আকুতি-মিনতি করেছিলো আমাকে তার সাথে নেওয়ার জন্য,কিন্তু বাবা আমাকে মায়ের সাথে যেতে দেয়নি।বরং মা যখন চুরি করে আমার খোজ-খবর নিতো আমাকে কিছু কিনে দিতো তখন সৎ মায়ের অত্যাচার আমার উপর বেড়ে যেতো।এক পর্যায়ে দাদি মায়ের হাত ধরে কান্না করে বলেছিলো,
‘রেখা মা আমার নাতনি টাকে ওরা জ্যান্ত মেরে ফেলবে।তুই ওর সাথে আর দেখা করিস না মা।দেখবি আল্লাহ্ যদি কখনো চায় তাহলে তোর মেয়ে তোর কাছেই ফিরে যাবে।’
মা সেদিন কাঁদতে কাঁ*দতে বেরিয়ে গেছে।যাওয়ার সময় অবশ্যই বাবাকে হুমকি দিয়ে গেছিলো,
‘আমার মেয়ের যদি পড়া-লেখা বা কোনো কিছুতে ত্রু*টি হয় তাহলে আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে দেবো না।আমি চাইলে এখনো তোমাকে জেলে ঢুকাতে পারি।তার অবশ্যই অনেক কারনও আছে।তাই যদি জেলে ঢুকতে না চাও তাহলে আমার মেয়ের পড়া-লেখায় যেনো কোনো ত্রুটি না হয়।’
বাবার বর্তমানে যে মুদি দোকানটা আছে তা সে সময় মায়ের টাকা দিয়েই কিনেছিলো।তাই মায়ের হুমকিতে ভয় পেয়ে বাবা কখনো আমার পড়া-লেখা বন্ধ করেনি।এছাড়া বাকী সব অত্যাচার আমার উপর করেছিলো।শেষ যে কোন দিন তাকে বাবা বলে ডেকেছিলাম তাও মনে নেই আমার।এমনো দিন গেছে সারাদিন কাজ করে এক বেলা খেতে দিয়েছে আমাকে সৎ মা।রাত্রে যখন সবাই মিলে খেতে বসে তখন তাদের পাশে দাড়িয়ে কার কি লাগবে সব কিছু গুছিয়ে/এগিয়ে দিতে হয় তাদের।অথচ সেই মেয়েটাই কতো রাত যে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে তার খোজ কখনো কেউ করেনি।সারাদিনের সব অভিযোগ মনে পুষিয়ে রেখে রাতে আকাশের ওই তারাদের দিকে তাকিয়ে মা কে খুজতাম আর সব অভি*যোগের কথা তাকে বলতাম।আচ্ছা মা কি দেখছে তার ছোট্ট তুহা কতো বড় হয়ে গেলো?আজ তার বিয়ে ছিলো?
‘এ্যাই মেয়ে কোথা হারিয়ে গেলে তুমি?কখন থেকে ডাকছি তোমায়?’
হঠাৎ পুরুষালী কারো কন্ঠে এমন কথা শুনে চম*কে উঠে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি আমি।পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি শৈবাল আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি কিছুটা হকচকিয়ে যাই।লোকটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?
‘কি হলো কি বলছি তোমাকে?’
‘কি বলছেন?’
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করায় চোখ বন্ধ করে ফোস করে নি*শ্বাস চাড়ে সে।আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি।আজব লোকটা বিরক্ত বোধ করছে কেনো?আমি তো তাকে জ্বালাইনি।তাহলে?
‘কিছু খাবে তুমি?না মানে বাবা বললো তুমি নাকি দুপুর থেকে কিছু খাওনি আর এখন তো সন্ধ্যা হয়ে আসছে।এখনো কিছু খাবেনা?’
আজব শেষ কোন দিন কেউ আমাকে এই কথা জিজ্ঞেস করছে মনে পড়ছেনা।গত পনেরো বছরে হয়তো কেউ জিজ্ঞেস ও করেনি।আর এই মানুষটা যার স*ঙ্গে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একটা পবিত্র স*ম্পর্কে জড়িয়েছি সে এখন আমাকে কথাটা জিজ্ঞাস করছে।তাও কতো মোলা*য়েম কন্ঠে ভেবেই আমার চোখ ছল*ছল করে উঠে।মনে পড়ে গত রাত্রে শেষ খেয়েছিলাম।সকাল থেকে এখনো কিছুই খাওয়া হয়নি।এতো কিছুর ভীড়ে খাওয়ার কথা মাথাতেই আসেনি।আমি কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি।শৈবাল ড্রাইভার কে গাড়ি থামাতে বলে একটা হোটেলের সামনে।ইতোমধ্যে আমরা গ্রাম থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘বুঝলাম তুমি স্বল্প ভাষী তাই বলে যেখানে কথা বলা উচিত সেখানেও কথা বলবে না?’
কথাটা শুনে আমি অবাক চোখে তাকাই শৈবালের দিকে।মনে পড়ে যায় পনেরো বছর আগের কথা।যখন মা আমাকে এতো বেশি কথা বলার জন্য বাচাল বলতো।তখন বাচাল,চঞ্চল ছিলাম।এখন সব কিছুই ধোয়াসায় ঘেরা অতীত।ভেবেই শৈবালের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি।লোকটা এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে কিছুটা অস্বস্তি হয়।শে হয়তো আমার অস্বস্তি বুঝতে পেরেই তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।দশ মিনিট পর ফিরে আসে একহাতে বিরিয়ানির প্যাকেট আর এক হাতে এক বোতল পানি।আমার দিকে বিরিয়ানির প্যাকেট টা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘নাও খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।’
প্রচুর খিদে পেয়েছে কারনে কোনো বাক্য ব্যয় না করে তার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খেতে শুরু করি।আড় চোখে একবার শৈবালের দিকে তাকিয়ে দেখি সে নিউজফিডে স্ক্রল করতে ব্যস্ত।এদিকে তার হুশ নেই।খাওয়া শেষ করে সিটে শরীর এলিয়ে দেই।প্রচুর ক্লান্ত লাগছে।অন্য দিকে গা গুলিয়ে আসছে।আমি শৈবালের দিকে তাকিয়ে বলি,
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
শৈবাল আমার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দেয়।ছোট্ট করে বলে,
‘শহরে।’
‘কতক্ষণ লাগবে যেতে?’
‘চার ঘন্টা।’
চার ঘন্টা শুনে আমি আতঁকে উঠি।এতো ঘন্টা জার্নি করতে গেলে মরেই যাবো হয়তো।গ্রামের বাহিরে এতোদূরে কখনো যাইনি।কিভাবে সম্ভব?
_____________
সাড়ে চার ঘন্টার পরঅবশেষে গন্তব্যে পৌছালাম।এর মধ্যে আমার অবস্থা অনেক শৌচ*নীয়।তিনবার বমি করেছি।ক্লান্ত হয়ে সিটে হেলান দিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি টেরই পায়নি।হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়া ঘুম ভে*ঙ্গে যায় আমার।সদ্য ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারিনি আমার অবস্থান বর্তমানে কোথায়।অতঃপর চারপাশে তাকিয়ে দেখি আমার পাশেই শৈবাল বসে ছিলো যে ইতোমধ্যেই গাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে।আমার পাশে এসে গাড়ির ডোর খুলো দেয় দ্বিতীয় ভদ্রলোক।যিনি আমার শ্বশুড়।আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘বেশি খারাপ লাগছে মা?এসো বের হয়ে এসো।’
‘না আঙ্কেল।সারা রাস্তা তো ঘুমিয়েই এসেছি।’
আমার কথা শুনে শ্বশুড় মশাই মুচকি হাসে।আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে।আমরা একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছি।ইতোমধ্যেই বাড়ি থেকে এক এক করে সবাই বের হয়ে আসে।অচেনা পরিবেশে অচেনা মানুষ জন দেখে আমি লজ্জা আর অ*স্বস্তিতে মাথা নুইয়ে ফেলি।
‘চলো মামুনি।’
শ্বশুড় মশাইয়ের কন্ঠ শুনে তার দিকে তাকাই আমি।মুচকি হেসে সামনে পা বাড়াতে যেতেই চেনা মুখ দেখে আমি থমকে যাই।এই মানুষটাকে ছিনতে আমার কখনো অসুবিধে হয় না।হওয়ার কথাও না।আমি অবাক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছি।অস্ফুট স্বরে গলা থেকে বেরিয়ে আসে একটি মাত্র শব্দ।
‘মা’
চলবে,,,,,,#নীড়ের_খোজে♥
পর্বঃ০৩
#জান্নাতুল_বিথী
মায়ের কোলে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছি আমি।একটু পর পর হেচঁকি তুলে কাঁদছি।মায়ের চোখেও পানি।হয়তো এতো বছর পরে সন্তানকে কাছে পেয়ে আ*বেগে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন রেখা বেগম।আমি একের পর এক বিচার দিতে থাকি মায়ের কাছে।আর মা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে আমার এতো দিনের জমানো অভিযোগ।এক মুহূ*র্তেই যেনো আমার সব ক্লান্তি কর্পূরের ন্যায় উড়ে যায়।দু’চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম।
_____________
‘তুহাকে ডেকে দাও মেজোপা।মেয়েটা আসার পর থেকে সেভাবেই শুয়ে আছে।’
বড় জায়ের কথা শুনে চোখ তুলে তাকায় রেখা বেগম।মলিন হেসে বলে,
‘আরেকটু ঘুমাক না আপা।মেয়েটা কতো কাল শান্তিতে ঘুমায় না কে জানে?’
‘আমার পূত্র বধু আর তোমার মেয়ে এই বাড়িতেই তো থাকবে এখন থেকে মেজো।এতো চিন্তা করছো কেনো।কতো রাত হয়ে গেলো মেয়েটা এখনো না খেয়ে আছে।সবাই ওর জন্য না খেয়ে বসে আছে।তুমি ওকে তুলে দিয়ে নিজেও খেতে আসো।’
রেখা বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা কতো শান্তি তে ঘুমাচ্ছে। ডাকতে ইচ্ছে করছেনা।তারপরো রেখা বেগম মেয়েকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য তুহা বলে দু-তিনবার ডাকতেই আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসি।আমি এভাবে উঠায় মাও হয়তো কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।তাই আমার গালে হাত রেখে বললো,
‘কি হলো মা ভয় পাচ্ছিস কেনো?’
মায়ের কথা শুনে পিটপিট করে তাকাই তার দিকে।প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনা আমার বর্তমান অবস্থান কোথায়।মাথায় একটু চাপ প্রয়োগ করতেই সব কিছু মনে পড়ে।মা এখনো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।তাই বললাম,
‘হঠাৎ ডাকায় ভয় পেয়ে গেছিলাম।স্যরি আম্মু।’
আমার কথা শুনে আম্মু হাসে।বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,
‘জলদি ফ্রেস হয়ে নিচে আয়।সবাই তোর জন্য না খেয়ে বসে আছে।’
ইশশ কি আদুরে ভাব আম্মুর কন্ঠে।সেকেন্ডের মাঝেই আমার চোখ ভিজে উঠে।ইতোমধ্যে বোঝা হয়ে গেছে আমার ওই বাড়িতে ঠিক যতোটুকু অত্যাচার সহ্য করেছি এই বাড়িতে তার চাইতেও বেশি ভালোবাসা পাবো।এখন থেকে আর সৎ মায়ের চড় খাপ্পড় খেয়ে বা চুলের মুঠি ধরে ঘুম থেকে উঠাতে হবেনা।নিজের আপন মায়ের আদুরে গলার ডাক শুনেই ঘুম ভাঙ্গবে আমার।তখন আম্মু ডাকাতে এই কারনেই ভয় পেয়ে গেছিলাম।সৎ মা কখনো আমাকে ঘুম থেকে ডেকে উঠাতো না।নিজে থেকেই উঠতাম যদি কখনো উঠতে একটু দেরি হতো তখনই তার মুখ থেকে অক*থ্য ভাষায় গালা*গাল বের হতো আর তা শুনেই ঘুম ভাঙ্গতো আমার।
.
ফ্রেস হয়ে রুম থেকে বের হয়ে দেখি সবাই গভীর কোনো আলোচনায় মগ্ন।সিরিয়াস কিছু নিয়ে তারা আলোচনা করছে মনে হলো আমি তাই টেবিলের কাছে যেতে কিছুটা ইতস্ত বোধ করছি।এর মাঝেই হঠাৎ শৈবাল নিচু স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
‘বিয়ে করতে বলছো বিয়ে করেছি বাবা কিন্তু সংসার করতে বলছো কেনো?ছিনি না জানিনা এমন একজনকে বিয়ে করেছি এখন হুট করে চাইলেই কি সংসার করা যায় নাকি?আমাকে অন্তত মানিয়ে নেওয়ার সময় টুকু দাও।এর মাঝে আমি আমার পড়া টাও কমপ্লিট করি?’
শৈবালের কথা শেষ হতেই পাশ থেকে একজন বললো,
‘হ্যা ভাইজান শৈবাল তো ঠিকই বলেছে।ছেলেটা এখনো পড়া-লেখা শেষ করে নাই।এর মাঝে বিয়ে।ওকেও একটু সময় দেওয়া উচিত তোমাদের।’
একজন ভদ্র মহিলা বললো,
‘তুহাও তো ছোট এখনো।ওকেও সময় দেওয়া উচিত।কিছুদিন পর মেয়েটার এইচএসসির রেজাল্ট বের হবে।তারপর নাহয় ওকেও ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিলে তোমরা।’
আমি কিছু না বলে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাই টেবিলের কাছে।আমাকে দেখেই তারা আলোচনা মাঝ পথে বন্ধ করে দেয়।হঠাৎ আমাকে বারো-তেরো বছরের একটা ছেলে টেনে নিয়ে গিয়ে সবার সামনে দাড় করিয়ে বলে,
‘ওই যে ডানপাশের কর্নারে যে বসে আছে সে হলো তোমার শ্বশুড় ইউসুফ পাটওয়ারী।তার পাশের জন হলো তোমার আর আমার বাবা দুলাল পাটওয়ারী,আর সর্বশেষ উনি হলেন গিয়ে আমাদের ছোট চাচ্চু নুরুল পাটওয়ারী,ওই যে শৈবাল ভাইয়ের পাশে দাড়িয়ে আছে উনি তোমার শ্বাশুড়ি সারা পাটওয়ারী,তার পাশের জন আমাদের মম রেখা পাটওয়ারী,ছোটমা তার বাপের বাড়ি আছে।আর ওইযে নীল টি-শার্ট পরা ছেলেটা দেখছো সে হলো তোমার দেবর সৈকত ভাই।এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে।তার পাশের জন হলো তোমার স্বামী ফাহাদ পাটওয়ারী শৈবাল।এবার মাস্টার্স লাস্ট ইয়ারে।আরো দুজন পিচ্চি আছে ওরা বর্তমানে বাড়িতে নেই।’
দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামলো ছেলেটা।আমি হা করে তাকিয়ে আছি।এতো পিচ্চি একটা ছেলে এতো কথা বলে কিভাবে আল্লাহ্।সবার দিকে তাকিয়ে দেখি সবাই মিটিমিটি হাসছে।শুধু শৈবাল বাদে।সে এক মনে বসে খাবার চিবুচ্ছে।যেনো এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আসে পাশে আর একটাও নেই।আমি অবাক চোখে মানুষটা কে পরখ করছি।গাড়িতে আমার সাথে কতো সুন্দর ব্যবহার করলো।এখন দেখো আসার পর থেকে একটা কথাও বলেনি আমার সাথে।শৈবালের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলি,
‘সবার পরিচয়ই তো দিলে।তা নিজের টা বাদ রাখলে কেনো?’
আমার কথা শুনে সবাই ফিক করে হেসে দেয়।সৈকত ভাই হাসতে হাসতে বললো,
‘ওর নাম হলো ডি*স্টার্ব।যার কাজ হলো সবাইকে ডি*স্টার্ব করা।আর কাজের মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটানো।তাইনা হিমেল?’
তার কথা শুনে ছেলেটা ফুসে উঠে বলে,
‘এটা কিন্তু ঠিক না ব্রো।আমি কখনো তোমাকে ডিস্টার্ব করিনা।’
এক কথার বিনিময়ে আরেক কথা এভাবে দুজনের খুনশুটি লেগেই থাকে।শ্বাশুড়ি মা আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন যেনো আমি শৈবালের পাশের চেয়ারে বসি।আমিও তার কথায় দ্বিরুক্তি প্রকাশ না করে চুপচাপ তার পাশের চেয়ারে এসে বসে পড়ি।আমার কাজে শৈবাল একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবারো খাবারে মনোযোগ দেয়।আমাকে একজন একদিক থেকে একটা প্রশ্ন করছে আর আমি তার উত্তর দিচ্ছি।যার বেশির ভাগ প্রশ্নই সৎ মা আর বাবাকে নিয়ে।তারা আমার সাথে কতোটুকু খারাপ ব্যবহার করছে কেউ তাদের প্রতিবাদ করেছে কিনা এসব প্রশ্ন।কথা বলার মাঝে হঠাৎ তারা ভাইয়েরা ভাইয়েরা কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আমার দিকে কেউ তাকিয়ে নেই কারনে আমি নিচু স্বরে শৈবাল কে জিজ্ঞেস করি,
‘আপনি কি বিয়েটা মেনে নেননি?’
কথাটা শুনে শৈবাল ভ্রু কুচকে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার খেতে মনোযোগ দেয়।তার কাছ থেকে জবাব না পেয়ে আমি হতাশ হই।মানুষটা কেরকম যেনো গিরগিটির ন্যায় পাল্টে গেলো হঠাৎ করে।
‘তুহাকে বড় মাছের পিস টা দাও রেখা।’
হঠাৎ দুলাল পাটওয়ারীর কথা শুনে আমি চমকে উঠে তার দিকে তাকাই।আরেকবার নিজের প্লেটে তাকাই।ইতোমধ্যেই পুরো প্লেট বিভিন্ন আইটেম দিয়ে ভরে গেছে।তাই তড়িৎ গতিতে তার দিকে তাকিয়ে দুইদিকে মাথা নেড়ে না না করতে করতে বলি,
‘না না আঙ্কেল আমি আর কিছু নিবো না।’
আমার কান্ডে সবাই হেসে দেয়।ছোট চাচ্চু বললো,
‘কি ব্যাপার বউমা নিজের শ্বশুড় কেও আঙ্কেল ডাকো নিজের বাবাকেও আঙ্কেল ডাকো এটা কি ঠিক?’
আমি কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি।কিই বা বলবো তাকে।শ্বশুড় কে বাবা ডাকা বিষয়টা অন্য কিন্তু নিজের আপন মায়ের দ্বিতীয় স্বামীকে কি করে বাবা বলে ডাকবো?আর তাছাড়া সেই মানুষটাই বা কি ভাববে।আমার এতো ভাবনার মাঝে হিমেল বললো,
‘তুহাপু আমি আমার বাবাকে তোমার সাথে শেয়ার করলাম।তুমিও তাকে বাবা বলে ডাকতে পারো।আমি কিন্তু কখনো আমার জিনিস কারো সাথে শে*য়ার করিনা।তোমার সাথে করলাম।তোমাকে ভালোবাসি বলে।’
হিমেলের কথা শুনে আমি হেসে ফেলি।
‘আমার কোনো মেয়ে নেই কথাটা কখনো আমি মানিনি মা।কেউ আমাকে কয় সন্তানের পিতা জিজ্ঞেস করলেই বলতাম আমার এক মেয়ে এক ছেলে।আমি সব সময় মেনে এসেছি আমার একটা ছোট্ট সোনামনি আছে যাকে সময় হলেই নিজের কাছে তুলে নিয়ে আসবো।আর এখন দেখো সত্যি সত্যিই তুলে নিয়ে আসলাম তোমাকে।ওরা তোমাকে আমাদের সাথে দিতে অস্বীকার করার কারনেই তোমাকে বউ হিসেবে এনেছি।নয়তো আমরা কিন্তু তোমাকে মেয়ে হিসেবেই নিয়ে আসতে গেছিলাম।যাই হোক তাতে কি আমার মেয়ে আমার ঘরে ফিরে এলো তো।’
ইশশ মানুষটা কতো নির্ধিদ্বায় বলে দিলো “আমার মেয়ে” অথচ যার রক্ত আমার শরীরে বইছে সে মানুষটা এখনো অবধি একটি বার আমাকে “আমার মেয়ে” বলেনি।উনার কথা শুনে চোখে অশ্রুরা ভীড় জমায়।অতঃপর অশ্রু লুকানোর জন্য নিচের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বেছে নেই নিজের পিতাকে।রক্তের সম্পর্ক দিয়ে কি হবে যদি আত্মার সম্পর্ক না থাকে?
.
খাওয়া শেষে হিমেল আমাকে টেনে নিয়ে আসে।সবার সামনে বলে আসে আমাকে আমার রুমে দেখাতে নিয়ে আসছে।ওর এসব কাজ দেখে আমার প্রচুর হাসি পাচ্ছে।অনেক কষ্টে নিজেকে কনট্রোল করছি।এদিকে তার যতো আজগুবি বকাবকির শেষ নেই।এর মধ্যে জেনেছি ছেলেটা ক্লাস নাইনে পড়ে।এখনো তার একটা গার্লফ্রেন্ডও নাই এজন্য কিছুক্ষণ দুঃখ প্রকাশ করলো।আমরা দুজন হাটতে হাটতে দোতলায় চলে এসেছি।একটা রুম ক্রস করার সময় হঠাৎ রুমের দরজা খুলে শৈবাল বেরিয়ে আসে।হিমেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘যা গিয়ে পড়তে বস।এখানে কি তোর?’
শৈবালের ধ*মক শুনে হিমেল আমার দিকে কাচুমাচু করে তাকায়।শৈবাল আবারো ধ*মক দিয়ে বলে,
‘কি হলো এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো ওর দিকে?যেতে বললাম তো।’
দ্বিতীয় বার ধ*মক শুনে ছুটে পালায় হিমেল।এতক্ষন কি হলো সব কিছুই আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল।যখন বোধগম্য হলো তখন আমি তার দিকে তাকিয়ে বলি,
‘এটা কি হলো?ওর সাথে এভাবে কথা বললেন কেনো?’
‘যাক বাবা তুমি এতো কথা বলতে জানো এই ই বা কম কি?’
এরপর আমার দিকে হালকা ঝু*কে বলে,
‘বিয়েটা আমি মেনে নেইনি ঠিক তবে কোনো ব্যাপার না।মানিয়ে নিবো একসময়।’
চলবে,,,,,,
[তুহা আর শৈবালের পক্ষ থেকে একটি করে বাক্য বলে যাবেন।তাদের কেমন লাগে?]