#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ১২
.
“কি হলো? এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”
“না, কিন্তু….. ”
“কি কিন্তু কিন্তু শুরু করছো? বাসায় যাবা না?”
খানিকটা বিরক্তির সুরে’ই বলে উঠলো তাসফি। তার কথায় আবারও আমতা আমতা করতে লাগলো রূপা। বাসায় তো সেও যেতে চায়, কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়। এই যে, তাসফি তার বাইকে বসে আছে, আর তাকে উঠতে বলছে। মূলত এটাই তো তার সমস্যা। না…. এমন নয় যে রূপা এর আগে কখনোই বাইকে উঠে নি, অসংখ্য বার বাইকে উঠেছে সে। কোন প্রয়োজনে বাইরে গেলেই বড় বাবার বাইকে গেছে সে। কিন্তু তাসফি? তাসফির বাইকে কখনোই ওঠা হয় নি তার, সেই সাথে তাসফির এই বাইক। যেটা দেখেই রূপার মনে বিপদের আশঙ্কা জাগছে।
নানান কিছু ভাবলো রূপা, বুঝতে পারলো বাইকে না উঠেও কিছু করার নেই তার। তাসফির কথায় মাথা ঝাকালো মেয়েটা, অতঃপর অনেকটা সাহস জুগিয়ে উঠে বসতে লাগলো। রূপার বাইকে ওঠার গতিতে কিছুটা হলেও আন্দাজ করে ফেললো হয়তো তাসফি। বললো,
“ভয় পাচ্ছো রূপা?”
“উহুঁ! একদমই না।”
সামান্য হাসলো তাসফি। হালকা মাথা বাকিয়ে রূপার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে, “আচ্ছা! ভালোভাবে ধরে বসো আমাকে।”
বলেই বাইক চালাতে শুরু করলো তাসফি। হঠাৎ এভাবে বাইক চলতে শুরু করবে সেটা ভাবতেই পারে নি রূপা। কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে এক হাতে ব্যাগ ও অপর হাতে তাসফির পিঠের কাছ’টায় শার্ট খামচে ধরলো মেয়েটা। বলে উঠলো,
“এতো জোরে কেন? প্লিজ! ধীরে চালান।”
সামনের আয়না দিয়েই রূপার দিকে তাকালো তাসফি। মেয়েটার ভাবভঙ্গি দেখে সামান্য হাসলো। বাইকের স্পিড কমিয়ে আনলো না, বরং একই গতিতে চালাতে লাগলো। বলে উঠলো,
“ভয় লাগছে?”
“নাআআ! তবুও ধীরে চালান, প্লিজ! এত জোরে যাচ্ছেন কেন? এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে তো।”
“আরে কিছু হবে না, ভয় পাচ্ছো কেন? আমি আছি তো পাগল।”
এরপর আর শব্দ উচ্চারণ করতে পারলো না রূপা। সামান্য ভয়ের রেশ থাকলেও সেটাও গায়েব হয়ে গেল তাসফির বলা কথাটায়। মনোযোগ সম্পন্ন পড়লো তাসফির কথায়, অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে লাগলো।
এভাবে ঠিক কতটা সময় অতিক্রম হলো বুঝতেও পারলো না রূপা। বাইক’টা যখন নিজ গন্তব্যে এসে থামলো তখনই খেয়াল এলো তার। অজান্তেই বলে উঠলো, “এসে গেছি? এত তাড়াতাড়ি চলে আসলাম?”
“ইয়েস! ম্যাডাম। কেন? এত তাড়াতাড়ি আসা উচিত হয় নি বুঝি?”
বলেই একটু থামলো তাসফি। রূপা বাইক থেকে নামার মাঝেই সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলো, “আচ্ছা বুঝলাম, ঘুরতে চাইছিলে?”
“একটু বেশিই বুঝছেন, তাই না? আমি মোটেও ঘুরতে চাই নি।”
এবার ঠোঁটের হাসিটা যেন প্রসস্থ হলো তাসফির। আবারও একই সুর তুলে বললো, “আচ্চাআ…. বুঝলাম।”
“এবার কি বুঝলেন?”
“এটাই যে, বউয়ের বাইকের ভীতি কাটাতে হলে তাকে প্রতিদিন বাইকে নিয়েই বেরুতে হবে।”
.
কে’টে গেছে সপ্তাহ দুয়েক। এই অতিক্রম হওয়া দিন গুলোর মাঝেই ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে রূপার মাঝে। অন্য কেউ নয়, সে নিজেই যেন তার এই পরিবর্তনের উপলব্ধি করতে পারছে। উঁহু! ঢাকা শহরের আবহাওয়া গায়ে লাগার পরিবর্তন নয়, পরিবর্তন এসেছে তাসফির প্রতি তার মনোভাবের। হ্যাঁ! তাসফির প্রতিটি কথায়, কাজে এবং সেই মানুষটার প্রতি’ই যেন সে হারিয়ে যাচ্ছে, দূর্বল হয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। শুরু দূর্বল’ই নয়, মাঝে মাঝে চোখেও যেন হারায় তাসফি কে। বাইরে থেকে আসতে সামান্যক্ষণ দেরি হলেই বারবার ঘড়ি দেখতে লাগে, অপেক্ষা করতে থাকে তাসফির জন্য। পরমুহূর্তেই নিজের করা কান্ডে নিজেই হতভম্ব হয়ে যায়। এর কারণ যে তাসফির স্ত্রী হয়ে দ্বায়িত্ব পালন, এটা কিন্তু নয়। তার কাছে ব্যাপার’টা পুরোপুরি’ই ভিন্ন বলে মনে হয়।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তাসফি’কে নিয়েই ভেবে চলেছে রূপা। বিরবিরিয়ে আনমনেই বলে উঠে,
“ক্ষণিকের হলেও আপনি তো আমার জন্য নিষিদ্ধ মানব। কিন্তু সেই আপনাতেই কেন বারংবার আমাকে আকর্ষিত করছেন?”
আবারও ভাবনার অতলে তলিয়ে গেল রূপা, সেই ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে তাসফি ‘কেই রাখলো।
“কি ভাবছো গভীর মনোযোগে? কলেজে যেতে হবে না? লেট হয়ে যাচ্ছে তো।”
তাসফির কথায় কিঞ্চিৎ চমকে গেল রূপা, পরমুহূর্তেই সামনে নিলো নিজেকে। স্থির থাকা হাত দু’টো নিয়ে আবারও চুলগুলো মুছতে লাগলো, তাকালো তাসফির দিকে। মাত্রই গোছল সেরে বেড়িয়েছে তাসফি। ইতিমধ্যে গায়ের শার্ট’টাও পড়তে শুরু করেছে। তার দিকে তাকাতেই রূপা বলে উঠলো,
“এই তো হয়ে গেছে। হিজাব’টা পড়ে নেই।”
আর কথা বাড়ালো না তাসফি। নিজের মতো রেডি হতে লাগলো। রূপা আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো তাকে। সাদা শার্ট ইন করছে। ভেজা চুল গুলো লেপ্টে রয়েছে কপালের সাথে। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর গলার বেশ খানিকটা জুড়ে বিন্দু বিন্দু পানির কোণা। এমতাবস্থায় গভীরভাবে তাসফিকে পর্যবেক্ষণ করতেই হঠাৎ কিছু একটা হলো রূপার, তাকিয়ে থাকতে পারলো না আর। চোখ দুটো ফিরিয়ে নিলো, শরীরের মৃদু কম্পনের রেশ নিয়েই নিজের চুলগুলো মুছতে লাগলো। হঠাৎই যেন খুব বাজে ভাবনাগুলো উঁকি দিলো তার মনে, নিজের করা ভাবনায় নিজেই আশ্চর্য! রকমের অবাক হল রূপা। বিরবির করে বলে উঠলো,
“ছিঃ! রূপা, এতটা ডার্টি মাইন্ড এর ভাবনা কবে থেকে ভাবতে শুরু করছিস?”
.
কলেজের সামনে তাসফি বাইক’টা থামাতেই নেমে পড়লো রূপা। বেশ বিরক্তি নিয়েই নিজের ব্যাগে হাত দিলো। উদ্দেশ্য তার ফোন নেওয়া। বাসায় থাকতে ডাটা অন করেছিলো, তারপর অফ করতে ভুলে গেছে। তার ফলেই একাধিক মেসেজের টুং টুং শব্দ তখন থেকে থামবার নাম’ই নেই। ক্লাসের কয়েক জনের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে রূপার। দু’জনের সাথে বন্ধুত্বের রুপও ধারণ করেছে যেন। তারা সবাই মিলিয়েই ক্লাসের সব আপডেটের জন্য মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলেছে, সেটাতেই অতিরিক্ত মেসেজের কারণে লাগাতার টুং টুং আওয়াজ তুলে যাচ্ছে।
খানিক বিরক্তির রেশ নিয়েই ডাটা অফ করতে লাগলো রূপা, কিন্তু শেষ মেসেজ’রায় চোখ আঁটকে গেল। গ্রুপে ঢুকে কয়েকটা মেসেজ পড়েই বুঝতে পারলো তাদের ক্লাস হবে না, আর কেউ’ই আসবেও না। তার কারণ, গত পরশু তাদের নবীন বরণ। আর সেটারই আয়োজনে ব্যস্ত পুরো কলেজ। এবার খানিকটা আফসোস হতে লাগলো রূপার। বাসায় থাকতে মেসেজগুলো দেখলে তো আর কলেজে আসতে হতো না।
“এ্যাই মেয়ে, দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
হঠাৎ তাসফির বলা কথায় কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠলো রূপার ঠোঁটে, তাকালো পিছন ফিরে। তাসফি যে এখানেই ছিলো, সেটা তো সে ভুলেই বলেছিলো।
এগিয়ে এসে দাঁড়ালো রূপা। তাসফি জিজ্ঞেস করলো কিছু বলবে কি না। মাথা ঝাকালো রূপা, বোঝালো –না। বলে উঠলো,
“ক্লাস হবে না আজকে, কলেজে থেকে কি করবো?”
“কেন হবে না?”
“পরশু তো নবীনবরণ, তার’ই আয়োজন চলে।”
“তাইলে? বাসায় যাবা?”
মাথা ঝাকালো রূপা, বললো –হ্যাঁ! বাসায় যাবে। সামান্যক্ষণ চুপ করে থাকলো তাসফি। তারপর বলে উঠলো,
“বাসায় ব্যাক করলে তো অনেকটা সময় যাবে, আমার তো লেট হবে।”
“আমি রিক্সা নিয়ে চলে যাবো, আপনি…..”
তাসফির মোবাইল’টা শব্দ করে বেজে উঠতেই চুপ হয়ে গেল রূপা। সময় ব্যায় না করে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে লাগলো তাসফি। কিছুটা সময় অতিক্রম হতেই হাসি ফুটে উঠলো তার চোখে মুখে। দেখতে লাগলো রূপা, পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো তাসফি কে। হঠাৎ খুশি হবার কারণটা ঠিক ধরতে পারলো না, তাসফির একপাক্ষিক কথা বলায় বুঝতেও পারলো না সারমর্ম। তবে তাসফির মুখে সারপ্রাইজ নিয়ে কিছু বলায় ভেবে নিলো কেউ তাকে সারপ্রাইজ দেবার প্ল্যান করছে।
খানিকটা সময় নিয়ে কথা বলে মোবাইল রেখে দিলো তাসফি, রূপার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলো। রূপা বলে উঠলো,
“আপনি ভার্সিটিতে যান, আমি রিক্সা নিয়ে চলে যাবো।”
“যেতে হবে না কোথাও। বাইকে উঠো।”
“মানে…. কেন?”
“আজকে আমার ভার্সিটিতে চলো, ঘুরে আসো।”
তাসফির কথায় বাঁধা দেয় রূপা, যাবে না সেটাও জানিয়ে দেয়, কিন্তু তার কোন কথায় যেন কানে তুলে না তাসফি। তার সাথে যেতেই হবে বলে জানিয়ে দেয়। অবশেষে বাধ্য হয়েই রাজি হতে হয় রূপাকে। সেই সাথে মনের কোণে উঁকি দেয় একটা প্রশ্ন —তাসফি হঠাৎ তাকে তার ভার্সিটিতে নিয়ে যাবার জন্য একটা জোর করছে কেন?”
.
কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে রূপা। বারংবার দেখে চলেছে তাসফি কে। মিনিট দশেক হতে চললো তাকে ক্যান্টিনে বসিয়ে
“তুমি একটু বসো, আমি এক্ষুনি আসছি।”
বলে চলে গেছে তাসফি, মিনিট দশেক অতিক্রম হলেও আসার খবর নেই। রূপার অস্বস্তির কারণ অনেকেই কেমন নজরে তাকিয়ে আছে তার দিকে। থাকারই কথা। ক্যান্টিনের টিচারদের টেবিলটায় তাকে বসিয়ে গেছে তাসফি। তাতেও হয়তো কারোর নজরবন্দী হতো না রূপা, যদি না তাসফি তাকে এখানে বসিয়ে যেতো। তাসফির সাথে একটা মেয়েকে দেখেই যেন অনেকের কৌতুহলের শেষ নেই।
সুপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে নিজের মোবাইল’টা বের করলো রূপা। মোবাইলে মনোনিবেশ করলে হয়তো খানিকটা সময় অতিক্রম হবে। সেটা ভেবেই মেবাই বের করে টিপতে লাগলো। মিনিট দুয়েক সময় অতিক্রম হতেই হঠাৎ ভেসে আসলো এক নারী কণ্ঠ। রূপা’কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“এই মেয়ে, কে তুমি? এখানে কি করছো?”
.
.
চলবে…..