নীরবে তুমি রবে পর্ব -১৯ ও শেষ

#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
অন্তিম পর্ব

.
“উফ্! তোমার এই জেদ’টা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেছে রুপু, সাথে নতুন ভাবে শিখেছো এই গাল ফুলানো।”

খানিকটা জোরেই রূপা’কে উদ্দেশ্য করে বললো তাসফি। জবাব দিলো না রূপা, গাল ফুলিয়ে পিছন ফিরে বসে রইলো। সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো তাসফি, কি করবে সহসায় বুঝে উঠতে পারলো না।
রূপা’র প্রেগন্যান্সির সাড়ে আট মাস চলে এখন। পেট’টা ফুলেফেঁপে অনেকটা উঁচু হয়েছে, সেই সাথে বেড়েছে রূপার রাগ, জেদ, অভিমান আর গাল ফুলানোর মাত্রা’টা, সাথে ঘন ঘন মুড সুইং। মাঝে মাঝে কি করবে ভেবে পায় না তাসফি, খানিকটা বিরক্তিও হয়। কিন্তু তা প্রকাশ করতে গিয়েই যেন বাঁধা পড়ে যায় রূপার অদৃশ্য এক মায়ায়, আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তাকে। অবশেষে হার মানতে হয় রূপার কাছে, মেনে নিতে হয় মেয়েটার করা জেদ গুলো। কিন্তু রূপার করা আজকের জেদ’টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তাসফি, এই অবস্থায় তো একদম’ই নয়।

এই আট মাসে রূপার প্রেগন্যান্সিতে বেশ কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছে। রেগুলার ওষুধের উপর ভরসা করে থাকতে হয়েছে, পনের দিন বা এক মাস পর ছুটতে হয়েছে হসপিটালের দোরগোড়ায়। আজকেও তাকে নিয়ে যেতে হবে হসপিটালে। যদিও আগের তুলনায় বেশ সুস্থ স্বাভাবিক আছে রূপার শরীর, তবুও চেকআপ করে জানতে হবে তার বর্তমান পরিস্থিতি। কিন্তু হঠাৎই মেয়েটা জেদ দেখিয়ে বসে আছে বগুড়া যেতে চায় রূপা, কিছুদিন থাকতে চায় গ্রামের আবহাওয়াতে। কাজিন মহলের সবার ছুটি একসাথে পড়েছে, একসাথে হবার প্ল্যান করতেই রূপা গ্রামে যাবার জেদ ধরেছে। ডেলিভারির ডেট আর দু’মাস পর হওয়ায় যেন সুযোগ পেয়েছে, বারংবার তাসফি ‘কে বলে যাচ্ছে —মাত্র ক’টা দিনের জন্য’ই তো যাবো, শহরের এই বদ্ধ পরিবেশ থেকে গ্রামের খোলামেলা জায়গায় একটু স্বস্তি পাবো।
কিন্তু রূপার কোন কথায় যেন কানে তুলতে চাইছে না তাসফি, মূলত মেয়েটাকে নিয়ে কোন রিক্স নিতেই রাজি নয় সে। রূপার জেদ’টা থামাতেই খানিকটা ধমকে উঠে তাসফি।

“কিই হলো, কথা বলছো না কেন?”

রূপার চুপ থাকা’টা লক্ষ্য করতেই সামান্যক্ষণ পর বলে উঠলো তাসফি। তবে এবারও জবাব দিলো না রূপা, সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো তাসফি। এই মেয়েটার অভিমানের কাছে তার রাগ’টা যেন কিছুই নয়।
এগিয়ে গিয়ে রূপার সামনে দাঁড়ালো তাসফি, আবারও জিজ্ঞেস করলো কথা বলছে না কেন? এবারও কোন জবাব দিলো না রূপা, মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। হাসলো তাসফি, দু’হাতে রূপার গালে হাত রেখে মুখটা তার দিকে ফেরালো। বলে উঠলো,
“এ্যাই! মেয়ে, এত অভিমান কেন হু? নিজের শরীরের দিকে তাকিয়েও তো একটু জেদ’টা কমানো যায়।”

“হ্যাঁ! যায়, একটু আমার কথা শুনলেই কমানো যায়। এখন তো শরীর ভালো আছে আমার, তাহলে? গ্রামের আবহাওয়ায় আরও ভালো লাগবে, বুঝতে পারছেন না?”

“এতটা পথ জার্নি করে অসুস্থ হয়ে যাবে তো রুপু।”

ধীর কণ্ঠে’ই বললো তাসফি। প্রতিবাদ জানালো রূপা। বলে উঠলো,
“উফ্! বাবা, বললাম তো আমি ঠিক আছি। দেখেন আজকে ডাক্তার বলবে, একদম ঠিক আছি আমি।”

“যেতেই হবে? না গেলে হয় না?”

“উহুঁ! প্লিজ! প্লিজ! আর না করবেন না। আপনি তো আছেন, কিছু হবে না আমার।”

তাসফি’র কোমর জড়িয়ে পেটে মুখ গুঁজে বলে উঠলো রূপা। ব্যাস! আর কিছু বলতে পারলো না তাসফি, বরাবরের মতোই হার মানতে হলো রূপার জেদের কাছে। নিজেও মেয়েটাকে দু’হাতে জড়িয়ে বলে উঠলো,
“তবে হ্যাঁ! আজ ডাক্তার যদি বলে এখনো কিছু কমপ্লিকেশন আছে, তাহলে কিন্তু আর যাবার কথা মুখে আনতে পারবে না।”

“আহহ্! তারমানে রাজি? আমি জানতাম আপনি রাজি হবেন, এইজন্যই তো আপনাকে অনেক ভালোবাসি তাসফি।”

“হ্যাঁ! আজকের রিপোর্ট যদি খুব ভালো আসে তবেই। মনে থাকবে তো?”

“থাকবে, থাকবে। ইস্! কতদিন পর বাড়ি যাবো, সবার সাথে দেখা হবে। ভেবেই মজা লাগছে।”

সহসায় কিছু বললো না তাসফি, শুধু দেখে গেল রূপার খুশির মাত্রা। এই মেয়েটার একটুখানি খুশিতেই তার বুকে স্বস্তির রেশ মেলে। এর চেয়ে বেশি কিছু তো তার আর চাই না।
রূপা’কে কাছে টেনে আবারও জড়িয়ে ধরলো তাসফি, বেশ শক্ত করে চেপে ধরলো নিজের সাথে। সামান্যক্ষণ পর বলে উঠলো,
“তোমার এই জেদময়ী অত্যাচার গুলো আর কতদিন আমার উপর চালাবে রুপু?”

“যতদিন শুধু আপনার রবো।”

.
মিনিট পনেরো সময় একইভাবে হসপিটালের করিডরের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থেকে বেশ বিরক্ত রূপা। থেকে থেকে তার পাশে বসা তাসফির কাঁধে মাথা রাখছে, আবার একটু পর পর মাথা উঠিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ বিরক্ত সে।
তাসফি’র দৃষ্টি মোবাইলে নিবদ্ধ থাকলেও সম্পন্ন মনোযোগ যেন রূপার প্রতি। এক হাতে আগলে ধরে অপর হাতে মোবাইল টিপে যাচ্ছে। রূপার করা কান্ড পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। রূপার টেস্ট গুলো করার জন্যই অপেক্ষা করছে তারা। বাকিগুলো হয়ে গেলেও আলট্রাসনোগ্রাফি করা বাকি। এখনো ডাক্তার আসে নি। আসছে আসছে বলেও সময় নিচ্ছে বেশ, এদিকে রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাদিক নেই আজকে হসপিটালে। কোন কাজে ঢাকার বাইরে গেছে, তার চেম্বার বন্ধ হওয়ায় সেখানেও বসতে পারে নি। এখানেই বসে থাকতে হয়েছে।

তাসফি রূপা হসপিটালের জোড়া লাগানো চেয়ারের একপাশ চেপে বসেছে, পাশেই বসেছে হালকা বয়সের একটা মেয়ে। বয়স’টা রূপার চেয়ে বছর সাতেকের বেশি’ই হবে হয়তো। সাথেই রয়েছে প্রায় দু’বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। সম্ভবত ওনারই মেয়ে। দেখতে পুরাই একটা পুতুলের মতো, সেভাবেই ছোট ছোট চুলগুলো মাথার উপরে দু’টো ঝুঁটি করা। খানিকটা সময় নিয়ে সেই মেয়েটাকেই খেয়াল করছিলো রূপা, পর্যবেক্ষণ করছিলো মেয়েটার কর্মকাণ্ড। কিছু নিয়ে হয়তো জেদ করছিলো মেয়েটা, সহ্য করতে না পেরে ধমকে উঠে তার মা। সাথে সাথে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠে বাচ্চা মেয়েটা।রূপাও খানিকটা চমকে উঠে, পুতুলের মতো এই মেয়েটার কান্না সহ্য করতে পারে না। চমকে উঠে তাসফি’র কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে নেয়। তাকে এভাবে উঠতে দেখে তাসফি মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রূপার দিকে তাকায়। চাপা স্বরে ধমকে উঠে বলে,
“কি সমস্যা রুপু, এভাবে ছটফট করছো কেন? একটু শান্ত হয়ে থাকা যায় না?”

তাসফি’র কথার পাত্তা দিলো না রূপা, তাকিয়ে রইলো মেয়েটার কান্নারত মুখের দিকে। এবার যেন সহ্য করতে পারলো না রূপা। তাসফি’র দিকে একবার তাকিয়ে, “দেখেন না পিচ্চি’টা কান্না করছে।”

বলেই তাসফি’র জবাবের অপেক্ষা করলো না রূপা। পিচ্চি’টার একহাত টেনে বলে উঠলো,
“ইস্! এভাবে কান্না করছো কেন আপু? কি হয়ছে?”

মেয়ে’টা একবার তাকালো শুধু রূপার দিকে, কিন্তু উত্তর এলো পিচ্চি’টার মা’য়ের থেকে। বললো,
“উফ্! এতটুকু মেয়ের এত জেদ। একে সামলাতেই আমার জীবন শেষ।”

“কি হয়েছে?”

“কি আর বলি, বলো? জেদ করছে চকলেট খাবে। এখন কোথায় থেকে ওকে চকলেট এনে দিবো? এখন বাইরে যাওয়া’টাও তো সম্ভব নয়।”

কথাটা শুনতেই পিচ্চি’র কান্নার মাত্রা’টা বৃদ্ধি পেল যেন। তা দেখে সামান্য হাসলো রূপা। নিজের ব্যাগ থেকে দু’টো পালস্ চকলেট বের করে পিচ্চি’টার হাত টেনে কাছে টেনে আনলো। চকলেট দু’টো সামনে ধরে বলে উঠলো,
“ইস্! কান্না করে কি অবস্থা করেছো? এই নেও চকলেট।”

মুহুর্তেই বাচ্চা’টার কান্না থেমে গেল যেন, রূপার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চকলেট দু’টো হাতে নিলো। তা দেখে হাসলো রূপা, পিচ্চি’টার কান্না থেমে যাওয়ায় স্বস্তিও পেল। পিচ্চি’টা খুশি হয়ে একটা তার মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিলো খুলে দেবার জন্য। খুলে দিতেই তা মুখে পুড়ে নিলো মেয়েটা। রূপা জিজ্ঞেস করে উঠলো,
“নাম কি তোমার, হু?”

“আফলা….”

কপাল কুঁচকে ফেললো রূপা, ঠিক বুঝতে পারলো না নামটা। আবারও জিজ্ঞেস করলেই একই ভাবে বলে উঠলো মেয়েটা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পিচ্চিটার মায়ের দিকে তাকালো রূপা, তা দেখে পিচ্চিটার মা বলে উঠলো,
“আফরা ওর নাম।”

“বাহ্! অনেক সুন্দর নাম তো। দেখতেও একদম পুতুল।”

“শুধু দেখতেই। কাজকর্মে শয়তানের হাড্ডি। উফ্! এই বয়সেই যে এমন কিভাবে হলো?”

হাসলো রূপা, তাকালো আফরা’র দিকে। একটা চকলেট খাওয়া শেষ করে অপরটা ধরেছে। তার মা বারণ করলেও শুনছে না। রূপা জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার সাথে কেউ আসে নি আপু?”

“না! ওর বাবা ঢাকায় নেই, অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছে। একা ফ্যামেলি ঢাকায় থাকি, এদিকে হসপিটালে না আসলেও চলছিলো না।”

“কি সমস্যা হয়ছে?”

“চার মাস হচ্ছে কনসিভ করেছি, পেটে প্রচুর ব্যাথা হয়। ওর সময়টায় এমন হয় নি।”

চুপ হয়ে গেল রূপা, তাকালো তাসফি’র দিকে। এই সময়গুলো তো সে নিজেও পার করে এসেছে, উপলব্ধি করেছে প্রতিটি ক্ষণ। নিজের সেই সমস্যা গুলোর কথা বলতে লাগলো, কিছু হবে না বলে সাহস দেবার চেষ্টা করলো। এর মাঝে পিচ্চি’টা রূপার কাছে এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
“তকলেট খাবো।”

ধমকে উঠলো আফরার মা, এত চকলেট খাওয়া ঠিক না, সেটাও বললো। তাকে শান্ত করলো রূপা। সব দেখে তাসফি রূপা’কে জিজ্ঞেস করলো,
“আর চকলেট নেই?”

মাথা নাড়ালো রূপা, বোঝানো নেই। টই চকলেট গুলো তাসফি’ই তার ব্যাগে রেখে দিয়েছিলো। হুটহাট গা গুলিয়ে আসলেই তা মুখে পুড়ে বমির হাত থেকে বাচার জন্য। অনেকগুলোই চকলেট ছিলো, সবগুলো খাওয়ার পর এই দু’টোই ব্যাগে ছিলো।
রূপাকে সাবধানে থাকতে বলে উঠে গেল তাসফি, রূপা ও পিচ্চি’টার জন্য কিছু চকলেট আনতে। তাসফি যেতেই আফরা ও তার মায়ের সাথে মেতে উঠলো রূপা, এতক্ষণে পিচ্চিটাও বেশ মিলে গেল রূপার সাথে।

খুব বেশি সময় না নিয়েই ফিরে এলো তাসফি। পিচ্চি’টার হাতে চকলেট গুলো ধরিয়ে দিতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল, তার মা বারণ করলেও শুনলো না তাসফি। বাকি টক ঝালের চকলেট গুলো ঢুকিয়ে দিলো রূপার ব্যাগে।

.
খানিকটা সময় পরেই আলট্রাসনোগ্রাফি’তে ডাক পড়লো আফরার মায়ের। পিচ্চি’টাকে তাদের কাছে রেখেই যেতে বললো রূপা। তার পরের সিরিয়ালেই ছিলো রূপা। টেস্ট করার পর একসাথেই রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো আবারও। ততক্ষণে পিচ্চিটা পুরোই রূপার পাগল প্রায় হয়ে উঠলো, তার সাথেই শান্ত হয়ে সময় কাটাতে লাগলো। রূপাও মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করতে লাগলো পিচ্চি’টার প্রতি, অদ্ভুত এক টান অনুভব করলো।

টেস্ট রিপোর্ট গুলো হাতে পেতেই ডাক্তারকে দেখাতে এলো তারা। ভেতরে রোগী থাকায় সামান্য ওয়েট করতে হলো তাসফি রূপা’কে, তবে সাদিকের কলিগ ও রূপার রেগুলার চেকআপ করায় ঝামেলা পোহাতে হলো না। এতক্ষণে আফরার মা অন্য ডাক্তার দেখিয়ে বেড়িয়ে এসেছে, একটু সমস্যা আছে বলে আরও সামান্য কথা বলে বিদায় নিয়ে চলে আসতে নিলো। কিন্তু বাধ সাধলো আফরা। রূপার সাথেই থাকবে বলে জেদ করতে লাগলো। তাকে নানান কিছু বুঝিয়ে তার মা বেড়িয়ে গেল। এতে রূপার মনটা যেন কিঞ্চিৎ পরিমাণ খারাপ হলো। তাসফি’র দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“পিচ্চি’টা কিন্তু অনেক কিউট ছিলো তাই না তাসফি?”

“হু! তা তো ছিলোই। আর….”

“আর?”

“ওর মতোই একটা কিউট বাচ্চা কিছুদিন পর আমাদের কোলে আসবে, আমাদের মা বাবা বলে ডাকবে।”

“ইস্! কবে আসবে বলেন তো? আমার তো ভেবেই এক অদ্ভুত প্রশান্তি হচ্ছে, বাকিদের মতো আমরাও মা বাবা হবো তাসফি।”

সামান্য হাসলো তাসফি। রূপার গালে একহাত রেখে বললো,
“এই তো খুব জলদি, রুপু।”

হাসি ফুটে উঠলো রূপার ঠোঁটে। এক হাতে চেপে ধরলো তাসফির হাত।

.
“দেখলেন তো, আমি বলেছিলাম না? রিপোর্ট গুলো একদম নরমাল আসবে। এবার তো নিয়ে যাবেন আমায়? আপনি কিন্তু কথা দিয়েছিলো।”

“আচ্ছা, আচ্ছা! ঠিক আছে, কথা যখন দিয়েছি তখন তো রাখতেই হবে।”

তাসফির বলা কথায় প্রচন্ড খুশি হলো রূপা, এক হাত জড়িয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। হ্যাঁ! আজকের রিপোর্ট গুলো নরমাল এসেছে রূপা’র। ডক্টর বলেছে, আর কোন কমপ্লিকেশন নেই তার। দীর্ঘ আট মাস স্বাভাবিক হয়েছে রূপা, তার প্রেগন্যান্সিতে কোন রকম সমস্যা নেই।
কথাগুলো শোনার পরই স্বস্তি পেয়েছে তাসফি, বুক থেকে যেন বড়সড় একটা পাথর সরে গেছে।

প্রায় সন্ধ্যা রাত। এই সময়টায় রূপা’কে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে এলো তাসফি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো রিকশার জন্য। রূপা’কে রাস্তার মোরে দাঁড়িয়ে রেখে রিকশাওয়ালা মামার সাথে কথা বলছে তাসফি। পাশেই, প্রায় দুই হাত দূরত্ব বজায় রেখেই তাসফি’কে দেখে চলছে রূপা। ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোয় তাসফি’কে দেখে আবারও যেন প্রেমে পড়ে গেল রূপা। হ্যাঁ! এই মানুষটার প্রেমে বারংবার পড়তে রাজি সে, বারংবার নতুনভাবে ভালোবাসতে রাজি।

হঠাৎ রূপার মনে হলো তাকে কেউ ডাকছে। তবে তাসফি ছাড়া এখানে তাকে ডাকার মতো কাউকে পেল না। কিন্তু তাসফি তার কাজে ব্যস্ত। ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই আবারও অনুভূত হলো তাকে ডাকছে কেউ। আশেপাশে নজর বুলাতেই দেখতে পেল হসপিটালের সেই পিচ্চি’টা। তাকে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে হাত নেড়ে উঠতেই আচমকা এক কাজ করে বসলো পিচ্চি’টা। মায়ের ধরে রাখা হাত’রা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে ছুটে আসতে লাগলো রাস্তার অপর পাশ থেকে, রূপা’র কাছে। মুহুর্তেই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল রূপা, মুখের হাসি’টা বিলীন হয়ে হতভম্বের ন্যায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। সেকেন্ডের গড়িতেই মুখ ফুটে উচ্চারণ করলো,
“তাসফিইই… ওকে বাচাঁও….”

তারপর আর নিজেও দাঁড়াতে পারলো না, অদৃশ্য এর শক্তি যেন টেনে নিয়ে গেল রূপাকে। ছুটে গেল রাস্তার মাঝে, পিচ্চি’টাকে টেনে সরালেও নিজে আর ভারী শরীর নিয়ে সরে আসতে পারলো না। একটা মিনি ট্রাকের ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে পড়লো অদূরে। থেমে গেল ট্রাক’টা, মুহুর্তেই হৈ চৈ পড়ে গেল চারদিকে। এদিকে স্তব্ধের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো তাসফি, স্থির হয়ে গেল তার সবকিছু। ঠিক কি ঘটে গেল তা বুঝতেই যেন কয়েক সেকেন্ডের মতো সময় লেগে গেল। রূপার র’ক্তা’ক্ত চেহারা চেখে ভেসে উঠতেই মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো, পাগলের মতো ছুটে গেল রূপার কাছে। দু’হাতে র’ক্তা’ক্ত মাখা মুখে হাত রেখে বিলাপ করতে লাগলো,
“রুপু, এ্যাই! রুপু। তাকাও আমার দিকে, দেখো আমি তাসফি। কিছু হবে না তোমার, কিচ্ছু না….”

পিটপিট চোখে তাকালো রূপা। তাসফির দিকে তাকিয়ে আধো গলায়, অস্পষ্ট সুরে বলার চেষ্টা করলো,
“তা..তাসফি আমাদের সন্তানকে বাঁচাও। কিছু হতে দিও না ওর, কিছু হবে না ওর, তুমি আছো তো….”

ব্যাস! সেখানেই স্থির হয়ে গেল তাসফি, মুখ ফুটে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারলো না, শুধু নিপলক তাকিয়ে রইলো রূপার পানে।

.
অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাসফি, ছটফট করে চলেছে সনানে। তার সাথে দাঁড়িয়ে আছে তাসফি’র মা বাবা। তাদের দু’জনের চোখেই ভরে আছে অশ্রুকণায়। রূপাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়ছে অনেকক্ষণ আগেই। এতক্ষণেও কেন কেউ বের হচ্ছে না, কোন আপডেট দিচ্ছে না সেটা ভেবেই সবাই অস্থির প্রায়। মনে মনে শুধু একটায় প্রশ্ন চলছে —রূপা ঠিক আছে তো?

আরও খানিকটা সময় পর খট করে দরজা খুলে গেল অপারেশন থিয়েটারের। চমকে উঠলো তাসফি, তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে। বেরিয়ে এলো নার্স, তারপরই একটু সময় নিয়ে সাদিক সহ আরও একজন ডাক্তার বেড়িয়ে এলো। তাকে দেখেই দূর্বল কণ্ঠে তাসফি ডেকে উঠলো,
“সাদিক….”

তাকালো সাদিক। প্রাণপ্রিয় বন্ধকে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না। তবুও মনকে শক্ত করে পালন করলো ডাক্তারি ডিউটি। বললো,
“তাসফিই, তোর বাচ্চাটাকে আমরা….”

“বাচাঁতে পারিস নি, তাই তো?”

মাথা ঝাকালো সাদিক, তার উত্তর’রা বুঝে গেল তাসফি। আবারও একই ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“আমার রুপু?”

“সরি! তাসফি আমার ওকে…..”

বাকিটা আর শোনার অপেক্ষায় থাকতে পারলো না তাসফি, চোখের সামনে ঝাপসা হতে হতে ঘোর অন্ধকার নেমে এলো। মুখ ফুটে শুধু উচ্চারণ করলো, “আমার রুপুউউ…..”

.
ধরফর করে শোয়া থেকে উঠে বসলো তাসফি, জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিতে লাগলো। পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে তার। ছটফট করে বিছানা ছেড়ে মেনে দাঁড়ালো তাসফি, রুমের লাইট জ্বালিয়ে হাঁটতে লাগলো। সেই ঘটনার সাড়ে চার মাস পেড়িয়েছে, কিন্তু বিগত এক সপ্তাহ ধরে এই স্বপ্ন’টা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, ঘুমাতে দিচ্ছে না রাতে। দেখতে চাইছে না তাসফি, কিন্তু চাইলেও পিছু ছাড়াতে পারছে না যেন। এই মুহুর্তে রূপাকে খুব কাছ থেকে দেখার তৃষ্ণা’টা যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল, জানে তাসফি, যা চাইলেও সম্ভব নয়।

কিন্তু না, পারলো না যেন তাসফি। কোন এক অদৃশ্য শক্তি টানতে লাগলো তাকে, রূপাকে খুব কাছ থেকে দেখার আকাঙ্ক্ষাতে।
ঘড়িতে সময় দেখে নিলো তাসফি। ভোর রাত এখন, চারদিক থেকে আজানের প্রতিধ্বনি ভেসে আসবে এখনি। ফজরের নামাজ আদায় করেই হাঁটতে হাঁটতে বেড়িয়ে যেতে পারবে সে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়লো আজকে একবার হলেও ভার্সিটিতে যেতে হবে তাসফি’র, ঠিক এই জায়গাটায় যেন ফেঁসে গেল। কিন্তু হাল ছেড়ে দিলো না তাসফি।

এগারোটার মাঝেই ভার্সিটির সমস্ত কাজ শেষ করে ফেললো। সেখান থেকে আর বাড়িমুখো হলো না। বাড়িতে বাবা মা না থাকায় প্রশ্নবিদ্ধতেও পড়তে হলো না তাসফিকে। বারোটার বাসেই টিকিট কেটে উঠে পড়লো।

.
গোধুলি মাখা বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা এখন। পশ্চিমাকাশে সূর্য’টা ডুবে গেছে মিনিট দুয়েক আগে, চারদিক থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজানের প্রতিধ্বনি। ছোট, বড়, বয়ষ্ক অনেকেই পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি পড়ে বেশ তাড়ায় ছুটে চলেছে মসজিদে, গ্রামের রাস্তা বেয়ে দিনমজুর’রাও নিজেদের গৃহে ফিরছে। শুধু তাড়া নেই তাসফি’র। গ্রামের পিচঢালা ছোট রাস্তার সামান্য দূরে মাঝারি আকৃতির গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে তাসফি, তাকিয়ে আছে অদূরে পর পর তিনটে সাড়ি করা ক’ব’রের দিকে। তার ছোট মামা মামী’র কবরের পাশেই গড়ে উঠেছে ছোট আরেকটা ক’ব’র। একদম’ই নতুন, মাত্র সাড়ে চার মাস আগের। তাতেই যেন বাঁশের বেড়ার অর্ধেকটা লতাপাতায় ঘিরে ধরেছে। ঠিক এটাই যেন সহ্য করতে পারছে না তাসফি। পাবেই বা কিভাবে? ওখানটায় যেন তার কাছের কেউ, তার অস্তিত্বের একাংশ জুড়ে থাকা কেউ সেখানেই রয়েছে।

সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো তাসফি, বিগত দিনগুলোর কথা ভাবতেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলেও নিলো। আজানের প্রতিধ্বনি গভীরভাবে কানে প্রবেশ করতেই বিরবির করে বলে উঠলো,
“কেন এসেছি আমি এখানে, কেন? এই সার্থপর মানুষগুলোর কাছে তো আমি আসতে চাই নি, দেখতে চাই নি তাদের।”

হ্যাঁ! এখানে আসতে চায় নি তাসফি, আর না এই সাড়ে চার মাসে কখনো এসেছে এখানে। কিন্তু আজকে হঠাৎ কেন এলো, কিসের টানে’ই বা এলো সেটায় বুঝতে পারছে না তাসফি।
আর দাঁড়াতে চাইলো না এখানে তাসফি। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেল তিন চারজন বয়ষ্ক লোক পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি পড়ে মসজিদের দিকে যাচ্ছে। তাদের দেখেই মনে পড়লো নামাজ পড়তে হবে, মোনাজাতে দু’হাত তুলে দোয়া করতে হবে কারোর জন্য। আর সেখানে দাঁড়ালো না তাসফি, পাকা রাস্তায় উঠে হাঁটতে লাগলো মসজিদের দিকে।

নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরুতেই পরিচিত কিছু মানুষের সাথে দেখা হয়ে গেল তাসফি’র। তাকে দেখেই বাড়ির সবার কথা জিজ্ঞেস করলো, নানান কথা বলতে লাগলো। থাকার কথা বলতেই সোজা বারণ করে দিলো। তাসফি’র মনের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করে নিলো। আর কথা বাড়াতে চাইলো না তাসফি, আর না কথা বলার মতো অবস্থায় রইলো। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আবারও গ্রামের পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো।

.
নিশুতি রাত। নিস্তব্ধ নয়, চাঁদের আলোয় আলোকিত হওয়া কোলাহল পূর্ণ শহর। চেনা শহরের অতি পরিচিত রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে চলেছে তাসফি। জানে তার গন্তব্যের ঠিকানা, তবুও বাস থেকে নামার পর গত দেড় ঘন্টা সময় নিয়ে হেঁটে চলেছে রাস্তার পাশ বেয়ে।
ঢাকা থেকে সরাসরি গ্রামেই গিয়েছিলো তাসফি। কিন্তু কেন গিয়েছিলো, তার কারণ জানা নেই। বগুড়াও আসতে চায় নি তাসফি, কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে টেনে এনেছে এখানে। চেনা শহরের, কাছের মানুষের কাছে।

সরু পাকা রাস্তায় সোজা আরও সামান্য হেঁটে চার তালা বাড়ির সামনে থেমে গেল তাসফি। মাথা উঁচিয়ে তাকালো পুরো বাড়িটায়। তার মামাদের বাড়ি, যেখানে শৈশবের কিছুটা কাটিয়ে, রয়েছে কাছের কিছু মানুষ। প্রায় দেড় মাস পর এসেছে তাসফি, কিন্তু ভেতরে যাবার সাহস’টা যেন পাচ্ছে না। উঁহু! পাচ্ছে না নয়, যাচ্ছে না। ঘড়ির কাটা দশের ঘর পেড়িয়ে সাড়ে দশটার ঘরে, এটাকেই কারণ হিসেবে ভেবে নিলো। ভেবেই সামান্য হাসলো তাসফি, মনে মনে, “মামার বাড়ি’তে যেতে বুঝি কারণ লাগে?”

বলতেই যেন ঠোঁটের হাসিটা প্রসস্থ হলো। এবার বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
“উহুঁ! শুধু মামা বাড়ি নয়, শ্বশুর বাড়ি। এত রাতে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া’টা তো ঠিক নয়। সামান্যতম লজ্জাটুকু কর তাসফি।”

বাসার পাশেই একাংশ নিচু ফাঁকা জায়গায় ছোট করে জায়গা দখল করার মতো দেওয়ালে বসে পড়লো তাসফি। পা ঝুলিয়ে অদূরে তাকিয়ে রইলো চাঁদের আবছায়া আলোতে। এক সময় চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো, নিজ মনে ভাবতে লাগলো নানান কিছু।
ঠিক কতটা মুহুর্ত, কতটা সময় কেটে গেল জানা নেই তাসফি’র। তবে হঠাৎই কারোর অস্তিত্ব অনুভব করলো। নীরবে তার পিছন থেকে নিশ্চুপে বসে পড়লো তার পাশে, তার মতোই পা ঝুলিয়ে। তাসফি জানে, কে সে। কে-ই বা তার পাশে এভাবে অধিকার নিয়ে বসতে পারে। ভেবেই চোখ মেললো তাসফি, তবে পাশে তাকালো। বলে উঠলো,

“রুপু।”

আলতো স্বরে ডেকে উঠতেই হাসি ফুটে উঠলো তাসফি’র ঠোঁটে। সেই ঠোঁটের হাসিটা প্রসস্থ হলো অপর পাশের জবাব আসতেই।

“ইস্! ধরা খেয়ে গেলাম। কিভাবে বুঝে যান, আমি এসেছি?”

“এভাবেই।”

“সবসময় কিভাবে বুঝেন আপনি? আমি তো নিশ্চুপে, নীরবে এসেছি। তাহলে এভাবেই কিভাবে, হু?”

সামান্য হাসলো তাসফি, তবে সেই হাসির শব্দ হলো না যেন। হালকা মাথা ঘুরিয়ে তাকালো তার পাশে বসা মেয়েটার দিকে। এই মেয়েটা যেন তাসফি’কে একটু বেশি’ই টানে, সেই সাথে বাধ্য করে তাকেও কাছে টেনে নিতে, বুকে টেনে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে রাখতে। ঠোঁটের হাসিটা বজায় রেখেই রূপা’কে বলে উঠলো,

“তুমি এসেছিলে’ই তো আমার জীবনে, নীরবে! খুব গোপনে।”

“নীরবে আপনার মাঝে বিচরণ করতে গিয়েও তো নিজের স্থায়িত্ব গড়ে তুলতে পারলাম না।”

মুহুর্তেই তাসফি’র ঠোঁটের হাসিটা বিলীন হয়ে গেল, গম্ভীর হয়ে উঠলো মুখখানা। কয়েক সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে রূপা আবারও বললো,
“আপনার মুখে কখনো ‘ভালোবাসি!’ শব্দ’টা শুনতে পেলাম না।”

“রুপু আমি….”

“ভালোবাসি! আপনাকে ভালোবাসি তাসফি।”

তাসফি’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠলো রূপা। নিপলক তাকিয়ে রইলো তাসফি। কিছু একটা আছে এই মেয়েটার মাঝে, যা আজও তাসফি ধরতে পারে নি। শুধু’ই উপলব্ধি করতে পারে, অতিরিক্তের চেয়েও অতিরিক্ত তাকে টানে এই মেয়েটা, খুব করে কাছে টানে, যা চাইলেও দূরে ঠেলার সাধ্য নেই তার। আর সেই টানে’ই এখানে ছুটে এসেছে তাসফি।

এবারও তাসফি’কে কিছু বলার সুযোগ দিলো না রূপা। তাকে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
“হঠাৎ…. কেন এলেন এখানে?”

“তোমার টানে।”

নিদারুণ জবাব দিলো তাসফি। তাকিয়ে রইলো রূপার পানে। রূপাও খুব একটা সময় নিলো না। সহসায় জবাব দিলো,
“আমার টানে আসার কথা ছিলো বুঝি? উঁহু! একদমই না। আমাকে নিয়ে তো আপনার কখনো টান ছিলো না।”

“কখনোই ছিলো না?”

“উহুঁ! কয়েক মাসে তো আমার কথা মনেও পড়ে নি, আমার টানে এখানেও এলেন না। তাহলে আজকে হঠাৎ?”

“জানি না?”

“জানেন না, না কি বলতে চাইছেন না?”

সামান্য হাসলো তাসফি, প্রসস্থ হলো ঠোঁটের হাসি। রূপার দিকে তাকিয়ে, “আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো?”

তাসফি’র কথায় রূপাও হেঁসে উঠলো। খানিকটা শব্দ করেই। যে হাসিটা রূপার থেকে কখনোই আশা করে নি তাসফি। হাসিমুখেই জবাবে, “পুরো আপনি’টাকেই হয়তো ফিরিয়ে দিচ্ছি।”

বিলীন হয়ে গেল তাসফি’র ঠোঁটের হাসিটা, মুহুর্তেই আধার নেমে এলো চেখে মুখে। বিষন্নতায় ঘেরা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“সহ্য করতে পারছি না রুপু, তোমার এই দূরত্ব’টা মেনে নিতে পারছি না।”

“আমিও পারছি না তাসফি, আপনার হয়েও আপনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে।”

সামান্য পর রূপার থেকে চোখ ফিরিয়ে দিলো তাসফি, তাকালো চাঁদের আলোয় আলোকিত হওয়া দূর ওই আকাশের দিকে। কয়েক সেকেন্ডের মতো চুপ থেকে বলতে লাগলো,
“দূর ওই বিশাল আকাশের মতোই তোমাকে ভালোবাসি রুপু, সীমাহীন ভালোবাসি। যার কোন কিনারা নাই, নেই কোন সীমাবদ্ধতা। ভালোবাসি রুপু, আমার রুপু’কে ভালোবাসি….. ”

চুপ হয়ে গেল তাসফি, মুহুর্তে’ই বেড়ে গেল শ্বাস-প্রশ্বাসের আনাগোনা। এদিক ওদিক তাকিয়েও আর দেখতে পেল না সেই কাঙ্ক্ষিত মুখ’টা, আর না শোনাতে পারলো তার কথাগুলো। হ্যাঁ! নেই রূপা, আর না এসেছিলো তাসফি’র কাছে, যা ছিলো তার সব’টাই কল্পনামাত্র, নয়তো তার ভ্রম। কিন্তু মানতে চাইলো না তাসফি, আর না মানতে পারলো। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
“এভাবে আমাকে ধোঁকা দিতে পারো না রুপু, বেইমানি করতে পারো না আমার সাথে, আমাকে ভালোবাসা শিখিয়ে দূরে ঠেলতে পারো না নিজেকে।”

বলেই পাশে দেওয়ালে বার দুয়েক হাত বাড়ি দিলো। ব্যাথা পেলেও যেন তা মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছালো না। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্থির করলো তাসফি, উঠে দাঁড়ালো সেখান থেকে।
আজকে নতুন নয় রূপা’কে নিয়ে তার কল্পনা। গত দেড় মাসে ঠিক একইভাবে রূপা’কে কল্পনা করে আসছে তাসফি। উহুঁ! কল্পনা করছে না, এভাবেই ভাবে চলে আসছে তার কল্পনায়। তাসফি’কে জ্বালাতে, নিদারুণ ভাবে পোড়াতে। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো তাসফি। বলে উঠলো,
“থাকতে চেয়েছিলাম তোমার কল্পকথায়, স্থায়ীত্ব গড়ে নিলে আমার কল্পনায়!”

থামলো তাসফি, সময় নিলো সেকেন্ডের মতো। সামান্যক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলতে লাগলো,
“পারবো না রুপু, বাস্তব হীনা কল্পনায় তোমাকে রাখতে পারবো না আমি। প্লিজ! আবারও ফিরে আসো, আমাদের সেই অসমাপ্ত গল্পের সূচনা গড়ো।”

“বাস্তবতার চাইতে মানুষতে কল্পনা’তেই সুখী হয় তাসফি।”

চিরচেনা সেই কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই চোখ মেলে তাকালো তাসফি। হ্যাঁ! তার পাশে রূপা’ই দাঁড়িয়ে আছে। বাস্তবতায় নয়, শুধুই তাসফি’র কল্পনামাত্র।
তাসফি বলে উঠলো,
“কিন্তু আমার তো তোমায় বাস্তবতায় চাই রুপু, একটুখানি ভালোবাসায় তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোড়ায়।”

হাসালো রূপা, খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। বললো,
“ভালোবাসা শব্দ’টা আপনার মুখে অদ্ভুত শোনায় তাসফি, বড্ড হাসি ওায় আমার।”

একটু থামলো রূপা। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে বলে উঠলো,
“আকাশের ওই বিশাল চাঁদ’টা যেমন আমাদের ছোঁয়া কাম্য নয়, তেমনি সব চাওয়া পাওয়ার নয় তাসফি।”

সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো তাসফি, উড়িয়ে দিলো আকাশ পানে। বিশাল আকাশের দিকে তাকাতেই বলে উঠলো,

“এসেছিলে আমার জীবনে, নীরবে! খুব গোপনে। একাকী আমার হয়ে, নীরবে ভালোবাসে, তুমি কি রবে?”

.
.
সমাপ্ত…..!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here