এ মন মেলুক পাখনা পর্ব -০১

বসের আসনে ‘মুন্তাসির শাহরিয়ার অভ্র’কে দেখে খানিক চমকে গেলাম। এই অভ্রর জন্য গত দু’দিন আমি থা/নাতে ছিলাম। নি/ষ্ঠু/রের মতো পু/লিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তার জন্য ইন্টারভিউ-ও দিতে পারি নি। ফাইলপত্র হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম চেম্বারের ভেতরে। অভ্রও আমাকে দেখে চমকে গেছে। হুরমুর করে ম্যানেজার সাহেব ভেতরে ঢুকে বললেন, “স্যার দেখুন না, পরশুদিন আমাদের অফিসে এই মেয়েটার ইন্টারভিউ ছিল। সে ইন্টারভিউ দিতে আসেনি। এখন এসে বলছে, ইন্টারভিউ দিবে। কতবার বোঝালাম, কিন্তু তিনি বুঝতেই চাইছেন না।”

অভ্র স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার দৃষ্টি বেশ তীক্ষ্ণ। বামহাত দিয়ে আলতো মুখ ঢেকে নিলাম। তবুও নিজেকে আড়াল করার চেষ্টায় ব্যর্থ হলাম। উৎকণ্ঠার সাথে বললেন, “আপনি, আপনি এখানে কী করছেন? এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান।”

“আমি ইন্টারভিউ দিতে এসেছি।” এইটুকু বলে অপমানে মুখে খিল দিলাম। উপস্থিত সবাই বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখছে আমাদের। ম্যানেজার সাহেব বিচলিত হয়ে বললেন, “কোনো সমস্যা স্যার? আপনি মোমকে চিনেন?”

অভ্র স্যার নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। বলার মতো ভাষা নেই। অ্যা-পয়েন্ট লেখার আমার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
অভ্র স্যার প্রতিক্রিয়া করলেন না, আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসেছেন। সাথে আছে আরও চারজন। অফিসের জিএম মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, “স্যরি, এখন আর ইন্টারভিউ সম্ভব নয়। আটজনের সাতজনের ইন্টারভিউ শেষ। আমরা এখন আলোচনার মাধ্যমে তাদের থেকে তিনজনকে নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। পরেরবার যখন সার্কুলার দেওয়া হবে, তখন এপ্লাই করুন আবার।”

মুখ হাসির রেখা ফুটে উঠল। এখনো একজনকেও সিলেক্ট করা হয় নি। উত্তেজিত হয়ে বললাম, “আপনারা তো এখনো সিলেক্ট করেননি। আমার ইন্টারভিউ একবার নিয়েই দেখুন। হতেও পারে আমি তাদের থেকে ভালো জানি। ভালো ডিজাইন করতে পারলে আপনাদের ফ্যাশন হাউসের সুনাম বাড়বে।”

উত্তরের আশায় সবাই অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। রিনরিনে গলায় বললাম, “পরশুদিন আমি আপনার অফিসে ইন্টারভিউ দিতে আসছিলাম স্যার। আপনি আমাকে পু/লি/শে দিয়ে দিয়েছেন। কতবার বললাম, তবুও আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি।”

“স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি আপনি আমার অফিসেই ইন্টারভিউ দিতে আসছিলেন। কিন্তু আজ আর আপনার ইন্টারভিউ নিচ্ছি না।” ফুঁ দিয়ে নিজের কোঁকড়ানো চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে বললেন।

“স্যার, আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। গ্ৰাম থেকে। এখানে কেউ নেই। আজ থা/না থেকে ছাড়া পেয়ে এখানে এসেছি। প্লীজ, আপনি আমার অবস্থা একটু বোঝার চেষ্টা করুন।” আশা নিয়ে বললাম আমি। উপস্থিত সবাই নিরুপায়। অভ্রর মুখের উপর কারো কথা বলার সাহস নেই। পেটে ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে। দু’দিন থা/নাতে মুড়ি ছাড়া কিছু জোটে নি।

অভ্র সিটের দিকে ইশারা করে বলেন, “প্লীজ, সিট।”

আমি সৌজন্য হাসলাম। সিটে বসে ফাইল থেকে সার্টিফিকেট বের করে এগিয়ে দিলাম। এক এক করে সার্টিফিকেট দেখে বলেন, “আপনার রেজাল্ট ভালো। আমাদের এখানে ইন্টারভিউ দেওয়া সব থেকে হাইস্ট মার্ক।”

আরেকজন বললেন, “ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার কারণ কী?”

“ফ্যাশন ডিজাইন এমন একটি শিল্প মাধ্যম, যার সাহায্যে একজন ডিজাইনার তার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় একটি পোশাককে আকর্ষণীয় করে তুলেন। এ ছাড়া তার ধৈর্য এবং সৃজনশীলতার পরিচয় দেন তার তৈরি বা ডিজাইন করা পোশাকে।” আমার উত্তর তাদের মনে ধরল। একে অপরের দিকে মুচকি হেসে তা জানান দিলেন। আরেকজন বললেন, “মূলত ফ্যাশন ডিজাইন বলতে কী বোঝায়? আমাকে একটু সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলতে পারবেন। ধরুন আমি ফ্যাশন সম্পর্কে কিছু বুঝি না।”

“ফ্যাশন ডিজাইন হচ্ছে এমন একটা শিল্প, যেখানে পোশাক থেকে শুরু করে জুতা, ব্যাগ, স্কার্ফ, গয়না ইত্যাদির উপর নকশা প্রয়োগ করে নান্দনিকতা ফুটিয়ে তোলা হয়। আবার চলমান কোন একটা ধারাকে, পোশাকে প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তোলাও ফ্যাশন ডিজাইনের অন্তর্ভুক্ত।”

করতালি দিলেন সকলে। অভ্রর স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার মনে হয়, আপনি যোগ্য ডিজাইনারের সন্ধান পেয়েছেন স্যার।”

অভ্র স্যার তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চমকে গেল উভয়ে। গভীর ভাবে ভেবে বললেন, “পড়াশোনা থাকলেও তো চলে না। আপনার তৈরি করা কোনো ডিজাইন দেখান।”

পড়লাম ফ্যাসাদে। পু/লি/শ তো আমাকে সেই ডিজাইন দেয়নি। কোথায় আছে, তা-ও জানি না। আমতা আমতা করে বললাম, “আমার কাছে কোনো ডিজাইন নেই।”

“কীসের ভিত্তিতে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন আপনি? আপনি বরং আসুন।”

“ফ্যাশন ডিজাইনারদের ডিজাইন নিয়ে ঘুরতে হয় না স্যার। আমি এক্ষুনি তৈরি করে দেখাচ্ছি।” বলেই উঠে দাঁড়ালাম। ফ্যাশন হাউস বলে কথা, বস্ত্রের শেষ নেই। কিছু কাপড় আর ব্যাগ থেকে কা/চি, সু/তা, ফি/তা নিয়ে বসলাম কাজে। তড়িগড়ি করে মিনিট পাঁচেকের ভেতরে নতুন ডিজাইন করে ফেললাম। আরেক দফা খুশি হলো সকলে। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “আপনি কালকে একবার আসুন। আপাতত আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে দিন।”

প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র রেখে সালাম দিয়ে বেরিয়ে এলাম। এবার আমাকে একটা ফ্লাট খুঁজতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে পরশুদিনের কথা ভাবতে লাগলাম।

চাকুরির জন্য সুন্দরনগর থেকে এলাম শহরে। বাসস্টপে বাস এসে থামতেই নেমে গেলাম। সময় তখন নয়টা আটচল্লিশ। দশটা বাজে শাহরিয়ার ফ্যাশন হাউসে আমার ইন্টারভিউ। আমি মোম। মামা বাড়িতে বড়ো হয়েছে। মামি দেখতে পারে না। বাবাকে দেখিনি, মা আট বছর বয়সে গত হয়েছেন। আমি ফ্যাশন ডিজাইনার। অনলাইনে সিভি জমা দেওয়ার পর অ্যা-পয়েন্টমেন্ট লেটার ই-মেল করে পাঠিয়েছে। চাকুরি পাওয়ার আসাতে গ্ৰাম ছেড়ে এসেছি। রাস্তাঘাট আমার অচেনা। একপাশে দাঁড়িয়ে ফ্যাশন হাউসের ঠিকানা দেখছিলাম। তখন একটা বাচ্চা মেয়ের কান্না শুনতে পেলাম। ডানপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। এতিম হওয়ার কারণে বাচ্চাটার প্রতি অদৃশ্য টান অনুভব করলাম। ছুটে গেলাম তার কাছে। আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে বাবু, কাঁদছো কেন?”

বাচ্চাটা কোনো জবাব না দিয়ে কেঁদেই চলেছে। বুঝলাম ভয় পাচ্ছে। নিশ্চয়ই হারিয়ে গেছে। কোলে তুলে নিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, “কাঁদে না, সোনা। তুমি কি হারিয়ে গেছো? আমাকে তোমার ঠিকানা বলো, আমি পৌঁছে দিবো।”

বাচ্চাটা তবুও কাঁদছে। দেখতে মাশাআল্লাহ! কোঁকড়ানো চুলগুলো মেয়েটার কোনো জবাব না পেয়ে বেজায় বিরক্ত হলাম আমি। মায়াও জন্মেছে, রেখে যেতে পারব না। অন্যদিকে ইন্টারভিউ সময় হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাকে দেখিয়ে অনেক জনকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ হদিস দিতে পারল না। সময় তখন সাড়ে দশটা। বাধ্য হয়ে ছোটো বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে রিকশা ভাড়া করলাম। আপাতত একটা থা/না/য় রেখে ইন্টারভিউ দিতে যাবো। ইন্টারভিউ শেষ‌ করে বাচ্চাটাকে পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার সেই আশা পূর্ণ হলো না। কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর পু/লিশের গাড়ি এসে থামল সামনে। রিকশা থেমে গেল। গাড়ি থেকে নামল এক তরুণ। যেই অভ্র! বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলে, “উদিতা, আমার উদিতা। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল বাবাই।”

বাচ্চাটা বাবা পেয়ে কেঁদে যাচ্ছে। পু/লি/শের কাছে উদিতাকে দিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নামালেন রিকশা থেকে। উচ্চ স্বরে বলেন, “এই মেয়েটাই আমার মেয়েকে কি/ড/ন্যা/প করেছে, তাকে অ্যা/রেস্ট করুন।”

হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম, “আমি তাকে কি/ড/ন্যা/প করি নি স্যার। আমি ওকে রাস্তায় পেয়েছি। আপনি আপনার উদিতাকে জিজ্ঞেস করুন।”

“চুপ, একদম চুপ। একদম ভালো সাজবেন না। এর আগেও ওকে কি/ড/ন্যা/প করার চেষ্টা করেছিলেন। পারেন নি। আমার কাছ থেকে মোটা মু/ক্তিপ/ণ দাবি করতে চেয়েছিলেন না? এবার দেখুন, আপনার অবস্থা কী করি। ওনাকে ধরে নিয়ে যান।” অভ্রর কথাতে মহিলা ক/নস্টে/বল এসে আমার হাতে হাতক/ড়া পরিয়ে দিল। হতভম্ব হলাম আমি। উত্তেজিত হয়ে বললাম, “বিশ্বাস করুন, আমি মোম। আমি গ্ৰাম থেকে ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। এইগুলো আমার কাগজপত্র। একবার যাচাই করে দেখুন।”

মহিলা ক/নস্টে/বল আমার বাহু ধরে বললেন, “ধরা পড়াতে সবাই এমন মিথ্যা সাজায় এটা নতুন নয়। চল আমাদের সাথে‌। তোর ইন্টারভিউ ছুটিয়ে দিবো।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#এ_মন_মেলুক_পাখনা 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০১

রেসপন্স করার অনুরোধ রইল। রেসপন্সের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী পর্ব দেওয়া হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here