এ মন মেলুক পাখনা পর্ব -০৪

#এ_মন_মেলুক_পাখনা 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৪

“তুমি তো মেয়ে, এই ওয়ালেট ছেলেরা ব্যবহার করে। ছেলেদের ওয়ালেট তোমার কাছে কি করছে মোম?” দু’হাত বুকে গুঁজে বললেন অভ্র স্যার। আমি সৌজন্য হাসি উপহার দিলাম। আমতা আমতা করে বললাম, “এটা আমার। ওয়ালেটে নাম লেখা নেই, এটা ছেলেদের নাকি মেয়েদের। চাইলে সবাই ব্যবহার করতে পারে।”

হাত থেকে টাকা, চেক ও ওয়ালেট ছিনিয়ে নিলেন একপ্রকার। বন্ধন দৃঢ় করার পূর্বেই বদল হলো হাত। নেওয়ার প্রচেষ্টা করলাম কয়েকবার, কিন্তু অসফল আমি। করুন দৃষ্টিতে বললাম, “প্লীজ, দিন না?”

“চু/রি করেছ কার থেকে এটা আমাকে আগে বলো। এত টাকা তোমার মতো একটা মেয়ের কাছে থাকার কথা নয়। সত্যিটা স্বীকার না করলে পু/লি/শে দিবো।” হতবাক, বিস্মিত আমি। নিজের ওয়ালেট নিজেই চিনতে পারছেন না। অবাক করা ব্যাপার। আর থা /নাতে যেতে চাই না। নিজেকে সামলে দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, “আপনার জন্য করেছি। আমাকে অফিস থেকে বের করে দিয়েছেন? গ্ৰাম থেকে এসেছি আমি। খাবো কি, চলবে কীভাবে? চাকুরিটাও কেড়ে নিলেন। চলব কীভাবে? তাই করেছি। আর করব না।”

“ফিফটি পার্সেন্ট লাগবে। নাহলে এক্ষুনি ফোন করব আর পু/লিশ চলে আসবে।”

“মাত্র পাঁচ হাজার আছে। যদি আপনি চেকটা তুলে দিতে পারেন। তাহলে ফিফটি দিতে পারব। আমি ব্যাংকের ব্যাপারে তেমন ভালো জানি না। ঝামেলায় জড়াতে চাই না। ডান?”

“ডান!” বলেই আমাকে কোলে তুলে নিল। তাজ্জব বনে গেলাম। আশেপাশে মানুষ ঘুরছে। চিৎকার করে বললাম, “কী করছেন কী? নামান আমাকে। নামান দ্রুত। মানুষ দেখছে। চলে আসলে তাদেরও ভাগ দিতে হবে।”

বেসামাল তার দৃষ্টিশক্তি। এই দৃষ্টির সাথে অপরিচিত আমি।
“এটা শহর। এইসব কিছু এখানে নরমাল ব্যাপার। এখানে কেউ অন্যের ব্যাপার দেখে না। নিজের কাজে ব্যস্ত‌।” বলেই আমার হাত ধরলেন পুনরায়। এগিয়ে গেলেন নিজের পথে। আমি অভ্র স্যারকে দেখে যাচ্ছি। উনি অভ্র স্যার নয়। অন্য কেউ। দুদিনের পরিচয় হলেও এত সহজে অন্য কাউকে তুলে ঘুড়াতে পারে না।

__

“তিনটা পরোটা, তিনটা পুরি, বিশ টাকার ভাজি। ব্যস। এগুলো দিয়ে দিন। কত হয়েছে বলুন।” হোটেলের সেল্স ম্যানকে উদ্দেশ্য করে বললাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মেঘে অন্ধকার করে রেখেছে যেন রাত দশটা। বৃষ্টি ঝরছে ঝিরিঝিরি ধারায়। বাড়ি ওয়ালার থেকে ছাতা নিয়ে এসেছি। আশেপাশে তাকিয়ে পুনরায় তাড়া দিয়ে বললাম, “ভাইয়া, একটু তাড়াতাড়ি করুন। বৃষ্টি জোরে নামলে ভিজতে হবে।”

“এক মিনিট আপু। এখনই দিচ্ছি। আপনি আশি টাকা কাউন্টারে দিন।” বলেই সে প্যাকেটে অর্ডার দেওয়া খাবারগুলো রাখছে। একশো টাকা কাউন্টারে দিয়ে বিশ টাকা ফেরত নিলাম। খাবারের প্যাকেট নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলাম।

খরগোশের জন্য গাজর কিনতে বাজারে গিয়েছিলাম। দু’দিনে আমার সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে তার। এই দুইদিনে পাঁচশো টাকার বাজার করেছি। একটা ভালো চাকুরী খুঁজতে হবে। সালোয়ার উঁচু করে ছাতা নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার একাধারে পানি জমে আছে। বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ে কাঁদা ছিটকে উঠছে সালোয়ারে। বিপরীত দিক থেকে সুট পড়া এক আগন্তুক ছুটে আসছে। কাঁধে ধাক্কা লাগল আমার। পা পিছলে পড়লাম জমা পানির ভেতরে। কপালে রুদ্র রাগ ফুটিয়ে বললাম, “কানা না-কি দেখে চলতে পারেন না?”

পরক্ষণেই চমকে উঠলাম। অভ্র স্যার ভিজে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অফিস থেকে বের করে দিয়েছে, আবার টাকায় ভাগ বসিয়েছে। দৃষ্টি নত করে অগ্ৰসর হওয়ার প্রয়াস করতেই তার কথায় থামলাম। উদ্বিগ্ন হয় বলে উঠেন, “মিস্ মোম, আমাকে একটু সাহায্য করবেন? একটু সাহায্য?”

‘একটু সাহায্য’ শব্দটা করুন শোনালো। পিছু ফিরে বললাম, “কী সাহায্য?”

“আমাকে একদল চাঁ/দা/বাজ লোক তাড়া করেছে। চাঁ/দা বিশ লক্ষ টাকা চাইছে। এই মুহুর্তে আমার কাছে কোনো টাকা নেই। আপনি আমাকে কিছু সময় আপনার বাড়িতে রাখবেন? বিপদ মুক্ত হলেই চলে যাবো।” তার এমন অনুরোধে প্রত্যুত্তরে কোনো ভাষার সন্ধান পেলাম না। একা থাকি একটা ফ্লাটে। পরপুরুষ দেখলে সবাই আমাকে ছিঃ ছিঃ করবে। আমার জবাব না পেয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে অভ্র স্যার বললেন, “আমার জন্য বলছি না। আমার মেয়েদের জন্য বলছি। প্লীজ আমাকে সাহায্য করুন।”

উদিতার মুখশ্রী দৃশ্যমান হলো চোখের পাতায়। নিজের আত্মসম্মানের কথা ভুলে গেলাম নিমিষেই। মৃদু স্বরে বললাম, “ঠিক আছে, চলুন। আশা করি, এমন কিছু করবেন না যাতে আমি বিপদে পড়ি।”

“বিশ্বাস রাখতে পারেন।”

বৃষ্টির ভেতরে দ্রুত পা চালালাম। অভ্র পেছনে পেছনে আসছে। সিঁড়ি পেরিয়ে চার তলায় উঠে গেলাম। তালা খুলে প্রবেশ করলাম অভ্যন্তরীণে। খরগোশটা ছুটে এলো নিকটে। দ্রব্য সামগ্রী রান্নাঘরে রেখে দু’হাতে তুলে নিলাম খরগোশটাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

অভ্র পেছনে পেছনে হাজির। ততক্ষণে মাগরিবের আযান পড়েছে। আমি মোমবাতি ধরিয়ে দিলাম। অভ্র স্যার এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, “মোমবাতি না জ্বালিয়ে ইলেকট্রিক বাতিটা জ্বালিয়ে দিন। আসার সময় নিচে বিদ্যুৎ দেখে এসেছি।”

“বাতি নেই। তাছাড়া আমি বিদ্যুৎ ব্যবহার করি না, বিদ্যুৎ খরচ করলে বিল দিতে হবে।” বলেই বারান্দায় গেলাম। রোদে মেলে দেওয়া টাওয়াল নিয়ে ফিরে এলাম। অভ্র স্যারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “আমার ঘরে কোনো খাট নেই। আপনাকে এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে হবে আজ রাতটুকু।”

টাওয়াল সাথে নিয়ে বললেন, “আমি আপনার মতো মানুষ আমার জীবনেও দেখিনি। সত্যি বলছি, দেখি নি। কিপ্টা থাকার একটা লিমিট থাকে, আপনি তার উর্ধে।”

সম্পূর্ণ কথা শ্রবণ না করে রান্নাঘরে এলাম।পানি ডেক্সিতে দিয়ে জানালার কাছে বসলাম। আমি অভ্র স্যারকে বুঝতে পারি না, একবার দেখা বলে তিনি আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে। আরেকবার দেখা হলে ‘আপনি’। বিষয়টা সেনসিটিভ। ভেরি সেনসিটিভ। চিনি ও চা পাতা দিয়ে কাপে ঢেলে নিলাম। পুরি একটা থালাতে নিলাম। কারণ হাতে গোনা কয়েকটা বাসন কিনেছি মাত্র। পুনরায় ফিরে এলাম কক্ষে। অভ্র স্যার ব্লেজার খুলে ফেললেন, খুলেছেন শার্ট। শরীরে টাওয়াল প্যাঁচিয়ে বসে আছেন। চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “চা খান, শরীর গরম হয়ে যাবে।”

অভ্র স্যার চা নিলেন। রঙ চা! চুমুক দিয়ে নাক কুঁচকে ফেললেন। কাপের অভাবে আমার চা গ্লাসে নিয়ে এসেছি। চুমুক দিয়ে বললাম, “আসলে বেশি চিনি খেলে ডায়াবেটিস হবে। তাই কম কম চিনি খাই।”

“এটাও আপনার কিপ্টামি, আমি বুঝতে পেরেছি। গ্যাস বিলটা নিশ্চয়ই বাড়ি ওয়ালার, নাহলে এত তাপ দিতেন না।” অভ্র স্যারের কথাতে সৌজন্য হাসলাম। ফোন বাজল তার। আড়চোখে ‘অগ্নি’ নামটা দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। রিসিভ করে বলেন, “হ্যাঁ অগ্নি বল।”

“ব্রো কোথায় তুই? উদিতা আর ঊষা বাবা বাবা বলে কাঁদছে।”

“বৃষ্টির কারণে আমার একজন ইমপ্লোয়ির বাড়িতে আটকে পড়েছি। বৃষ্টি কমলেই চলে আসব। ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি, বৃষ্টি থামলে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিস।”

“আচ্ছা।”

অভ্র স্যার ফোন রেখে দিলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “জব খুঁজেছেন?”

“না, এখনো খুঁজে পাইনি। তবে সিভি জমা দিয়েছি। আল্লাহ ভরসা।”

“আমার ফ্যাশন হাউসে আবার জয়েন করবেন?”

“না, যেখানে মানুষের দাম নেই। সেখানে যেতে নেই। আপনি যতই আমাকে বের করে দিন। একটা কথা আপনি মানতে বাধ্য, আমি বাকীদের চেয়ে ভালো এঁকেছি।” বলেই জানালার দিকে তাকালাম। মেঘ গর্জে উঠছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বৃষ্টি থেমে গেছে ততক্ষণে। চায়ের কাপটা মাটিতে রেখে বলে, “জানি, পরে সেটা উপলব্ধি করেছি। FD বস আপনার ডিজাইন দেখে প্রশংসা করেছে। আপনাকে ফিরিয়ে নিতেও বলেছি, আমি রাজি হয়নি।”

নিরবতায় পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ। খরগোশ ছানাটা অভ্র স্যারের কোলে এসে বসেছে। আদর করতে করতে বলেন, “এটা কি আপনার?”

“আগে অন্যকারো ছিল, এখন যেহুতু আমার কাছে আছে, সেহুতু আমারই।”

গাড়ির হর্ন বাজছে। অভ্র স্যারের গাড়ি চলে এসেছে। এখন তিনি চলে যাবেন। কাপসহ বাকি জিনিস রান্নাঘরে নিয়ে এলাম। পোশাক পড়তে স্পেশ দিলাম তাকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পোশাক পরিধান করে বেরিয়ে এলেন। আমি মুচকি হেসে সৌজন্যতা বজায় রেখে বললাম, “তাহলে চলেই যাবেন। আজকের রাতটা থেকে যেতে পারতেন।”

“সম্ভব নয়, কোনোভাবেই নয়। আমি যেখানেই থাকি রাতে বাড়িতেই থাকব। ঘুম থেকে উঠে মেয়েরা আমাকে না দেখলে অস্থির হয়ে যায়।” অভ্র স্যার এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে তার পেছনে দাঁড়ালাম। ছিটকিনি নামিয়ে বললেন, “শেষবারের মতো বলছি, আপনি চাইলে আবার শাহরিয়ার ফ্যাশন হাউসে জয়েন করতে পারেন। আপনি জয়েন করলে আমরা আবার সেই গ্ৰেড ডিজাইনা ফিরে পেতাম।”

“ট্রাই।”

দরজা খুলতেই হতভম্ব হলাম। ফ্লাটের বাকি ভাড়াটে দাঁড়িয়ে আছে। আমি একবার অভ্রর দিকে তাকাচ্ছি আরেকবার ভাড়াটেদের দিকে।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here