এ মন মেলুক পাখনা পর্ব -০৩

#এ_মন_মেলুক_পাখনা 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৩

অভ্র স্যারের দোলাতে দুলছি আমি। একদম তুলতুলে বিছানার মতো। গতকাল শক্ত মাটিতে শুয়ে শরীর হাত পা ব্যথা হয়ে গেছে। এই নিয়ে তিনবার অফিসের একজন স্টার্ফ ডাকতে এসেছে। প্রতিবার ঘুমের অভিনয় করে ঘুমিয়ে ছিলাম। এবার অভিনয় করার পূর্বেই দেখে ফেললেন আমায়। স্টার্ফ তারা দিয়ে বললেন, “উঠেছেন আপনি, এখন নিয়ে তিনবার এসেছি। দ্রুত ডিজাইনারদের কক্ষে যান। আরও তিনজন এসেছে। অভ্র স্যার সেখানে সবাইকে যাবতীয় সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আপনি উঠলে সেখানে যেতে বলেছে।”

আশেপাশে না তাকিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে গেলাম ‘ডিজাইনার’ কক্ষে। মাঝপথে হাঁটুর সাথে ধাক্কা লাগল টেবিলের। পুনরায় ব্যথা তাজা হলো। ‘কোনো এক জায়গায় ব্যথা পেলে বারবার সেখানেই ব্যথা পাওয়া হয়’ – এ যেন এক নিয়ম। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম কক্ষে। মৃদু করাঘাত করে বললাম, “আসব স্যার?”

“কাম ইন। সবেই শুরু করেছি। আপনার তেমন কিছু মিস্ হয়নি।”
কর্ণারে একটি চেয়ার ফাঁকা ছিল। আমি সেখানে বসলাম। তিনজনসহ পুরাতন চারজন ডিজাইনার আছে। অভ্র স্যার বলতে শুরু করলেন, “আমাদের এখানে নিয়োজিত দুইজন FD বস। সেই দুজন আজকে আসেনি। তাই আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। গতকাল আপনাদের মেসেজ করার সময় আমি টাইম উল্লেখ করে দিয়েছিলাম। আপনাদের ভেতরে দুইজন সেই সময় মানেনি। লেট করে এসেছেন। এমন ‘লেট লতিফা’ আমার প্রয়োজন নেই। আশা করি এমন ভুল হবে না।”

“নো স্যার।” সবাই একসাথে আওয়াজ তুলে বললাম। তারমানে লেট লতিফা আমি একা নয়!
অভ্র স্যার বক্তিতা দেওয়া শেষ করে সবাইকে একটা ডিজানার করতে বললেন। গালে হাত দিয়ে ভাবছি, কী ডিজাইন করা যায়। অভ্র স্যার ফোনে কথা বলছেন। তারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আনমনে আঁকিবুঁকি করছি কাগজে। ধ্যান ভাঙল অভ্র স্যারের ডাকে। তিনি ডিজাইন দেখতে চাইছেন। দীর্ঘ আধঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর কাগজের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম আমি। কাগজে অভ্র স্যারের স্ক্যাচ এঁকেছি আমি। পুরোপুরি হয়নি, কিন্তু একবার দেখাতে বলে দেওয়া সম্ভব কার স্ক্যাচ। মুছতে ইচ্ছে করছে না। মেধা খাটিয়ে স্যারের ব্লেজারটাকে সুন্দর একটি রূপ দিলাম।

তৎক্ষণাৎ উদিতা ছুটে এলো। জড়িয়ে ধরল অভ্র স্যারকে। পেছনে দু’জন স্টার্ফ হাজির হলো। নতজানু করে বলে, “স্যরি স্যার। আসলে উদিতা আমাদের সাথে থাকতে চাইছে না।”
অভ্র স্যার উদিতাকে কোলে নিয়ে গালে চুমু এঁকে দিলেন। আদুরে গলায় বলেন, “কী হয়েছে মা। ওদের সাথে থাকছ না কেন?”

উদিতা তার বাচ্চা সূলভ দৃষ্টিতে থেকে ইশারায় একবার নিজের হাত ধরছে একবার না বোঝাচ্ছে। যার মানে, “ওরা আমাকে ধরতে পারছে না বাবাই।”
স্টার্ফরা নরম গলায় বলে, “উদিতাকে ধরলে বলে, ‘খেলা শেষ। এবার বাবাইয়ের কাছে যাবো।’ না ধরলে বলে, ‘তোমরা ধরতে পারো না, খেলব না তোমাদের সাথে।’ কী করব এখান?”

“উদিতা, সোনা মা আমার। তোমার দোলনায় বসে বসে গেমস খেলো। বাবাই কাজ করছে না।” বলেই অভ্র স্যার তার ফোনটা এগিয়ে দিলেন উদিতার উদ্দেশ্য। উদিতা মাথা নেড়ে ফোন নিয়ে ছুটে গেল। পেছনে পেছনে ছুটল স্টার্ফ দুজনে। মেয়ের দিকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললেন, “উদিতা আমার মেয়ে। আমার লক্ষী একটা মেয়ে। অথচ কথা বলতে পারে না, বোবা। আপনারা আমার এখানে কাজ করবেন, আমার মেয়ে ভুল করলে তাকে বোঝাবেন। ধমক দিবেন না। সে বুঝে যাবে। মা মরা মেয়েদের আমি অনেক কষ্টে আগলে রেখেছি।”

“চিকিৎসা করালে কথা বলতে পারতো নিশ্চয়ই।” একজন বলে।

“তা পারতো, কিন্তু এতকম বয়সে মেয়েকে নিয়ে রি/ক্স নিতে চাই না।”

আফসোস লাগল। ফুটফুটে একটা মেয়ে।যদি কথা বলতে পারত, তাহলে নিশ্চয়ই সেদিন বলতো আমি ওকে কি/ড/ন্যা/প করিনি। আমি শুধু রাগ করেছিলাম।
অন্যদিকে দিয়ে তাজ্জব বনে গেলাম আমি। ঘনঘন পলক ফেলে বললাম, “কী বলছেন আপনি? গতকাল বললেন-না, উদিতা আপনার ভাইয়ের মেয়ে। এখন বলছেন নিজের মেয়ে।”

দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “গতকাল আপনার সাথে ইন্টারভিউ ছাড়া কোনো কথা হয়নি, তাহলে কখন বললাম উদিতা আমার মেয়ে নয়।”

“কেন? ফুলের দোকানে। আপনি উদিতার জন্য ফুল কিনছিলেন তখন।”

“আপনি হয়তো স্বপ্ন দেখেছেন।”

পায়ের দিকে ইশারা করে বললাম, “গতকাল আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম বলে ফার্মেসীতে নিয়ে গেছিলেন। আপনার কিছু মনে নেই?”

“হঠাৎ? ফার্মেসীতে আমি? আমার ডাক্তার প্রয়োজন হলে, কল করার সাথে সাথে এখানে চলে আসবে? আমার মনে হচ্ছে, আপনার মাথার তার ছিঁ/ড়ে গেছে। নো ওয়ার্ড।” বলেই অভ্র স্যার মৃদু হাসলেন। তার সাথে যোগদান করে অনেকে ব্যঙ্গ করছে আমায়। নিজেকে এক মুহুর্তের জন্য পাগল মনে হলো।

এক এক করে সবার ডিজাইন চেক করে আমার কাছে আসলেন। রিনরিনে গলায় বললেন, “আপনার ডিজাইন দেখতে পারি?”

এতক্ষণের কল্পনা থেকে এবার বাস্তবে প্রবেশ করলাম আমি। অভ্র স্যার তীক্ষ্ণ গলায় বলছেন, “কেউ ডাকলে সাড়া দিতে হয় মোমবাতি।”

ফুঁ দিয়ে চুলগুলো উড়িয়ে মোলায়েম স্বরে বললাম, “স্যরি স্যার।”

তিনি পুনরায় বললেন, “আপনাকে যে দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে, সেটা দেখান।”

পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে আছি। স্যারের হাতে দেওয়ার সাহস অবশিষ্ট নেই। আমার ইতস্ততের মাত্রা বাড়িতে তুলে অভ্র স্যার নিজেই নিলেন। পৃষ্ঠাতে নিজের স্ক্যাচ দেখে চিৎকার করে উঠলেন, “ওয়াট ইজ দিস, মিস্ মোম? এটা কোন ধরনের অস/ভ্যতা/মি? আমি আপনাকে ডিজাইন আঁকতে দিয়েছিলাম। আপনি আমাকে এঁকে রেখেছেন।”

ধমকে মৃদু টলে গেলাম। বাকি তিনজন উৎকণ্ঠা অভ্র স্যারের ব্যবহারে। সাউন প্রুভ কক্ষে বহিরাভাগে শব্দ বের না হলেও কেঁপে উঠছে দেয়াল। কম্পিত গলায় বললাম, “আসলে, আমি..

“আসলে কী? যতই আপনি আমার জন্য থা/নাতে থাকুন। আপনাকে আমি চাকরি দিতে চাইনি। ম্যানেজার, জিএম, পিএম বলেছেন, তাই দিয়েছি। এখন আমার মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি। এই মুহূর্তে আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যাবেন। গেট আউট মোম।” টেবিলের উপর আ/ঘাত করে বললেন। অপমানিত বোধ করলাম। দু পায়ের‌ পর তিনপা ফেলতেই পিছলে গেল পা। ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়ে পড়লাম অভ্র স্যারের উপর। নিরবে আদান-প্রদান হলো দৃষ্টি। পলক থেমে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে অভ্র বললেন, “উঠবেন নাকি এভাবেই থাকবেন?”

“স্যরি।” বলেই উঠে দাঁড়ালাম। নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে পেছন ‘না’ ফিরে বেরিয়ে এলাম ফ্যাশন হাউজ থেকে।

পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটছি। অজানা অচেনা একটা মেয়ের আগমন ঘটল। অজানা কিছু খুঁজতে খুঁজতে বলে, “আপু, কোনো খরগোশ দেখেছেন? আমার একটি খরগোশ আছে। খুঁজে পাচ্ছি না।”

“স্যরি আপু, দেখিনি।” মুগ্ধতা মিশিয়ে বলে পুনরায় পা বাড়ালাম। একটু দূরে দেখা পেলাম খরগোশটার। কোলে তুলে ওড়না দিয়ে আড়াল করে নিলাম।

‘মোম, জোরে দৌড়া। চু/রি করে ধরা পড়লো জা/বিন নেই।’ বলেই ছুটলাম। বিপদ সীমানার বাইরে এসে এক হাত থেকে খরগোশ অন্যহাত থেকে অভ্র স্যারের ওয়ালেট বের করল। আজ ভালো একটা দা/ও মা/রা গেছে। খরগোশটা কাঁধে রেখে ওয়ালেট খুলে পাঁচশো টাকার দশটা নোটের সন্ধান পেলাম, পেলাম পয়ত্রিশ হাজার টাকার একটা চেক! নিজেকে বাহবা দিয়ে বললাম,

“মোম, ইউ আর সো ইন্টালিজেন্ট গার্ল। জিঙ্গালালা-জিঙ্গালালা, হৈয়-হৈয়। অভ্র স্যারের পকেট মে/রে/ছি, হৈয় হৈয়! হি! হি! হি!”

আমার খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী রইল না। তার পূর্বেই সমুখে হাজির মহাদয়।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here