নূরবাহার পর্ব -০৪

#নূরবাহার ( ৪ )
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )

নুহাশের বাবা হচ্ছে একজন মাঝি। কিছুদিন আগেই নানুবাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে তারা। নুহাশের মা তাহেরা বেগম বাহার কে বড্ড আদর করে। নিজের সইয়ের মেয়েকে নিজের মেয়ের চেয়ে কম দেখে না। রাজলক্ষ্মী তার ছেলেবেলার সই। বেচারীর কপাল মন্দ! কমবয়সে মা’রা গেল। স্বামীর সুখও কপালে জুটল না। যে স্বামীর জন্য নিজের জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিলো শেষ অবদি সেই স্বামীর সুখ তার ভাগ্যে লেখা ছিল না। বাহার বাড়িতে পা রাখতেই না রাখতেই চেঁচিয়ে বলল, –“চাচি ও চাচি!

রান্নাঘর থেকে তড়িখড়ি করে বেরিয়ে এলো তাহেরা। মাথার ঘোমটা টেনে কইলো, –“এতো তাড়াতাড়ি আইয়া পড়লি?

—“নুহাশ যে কইলো তুমি পিঠা বানাইয়া রাখছো।

—“তা তো রাখছি, বস দিতাছি। তা নুহাশ গেলো কই, তুই একলা যে।

—“ওই বিহারীনি গো বাইত গেছে।

—“ক্যান? ওখানে কি ওর?

—“তাগো আম গাছে নাকি আম ধরছে। তাই গেছে, তুমি কি আমারে এমনে বসাইয়া রাখতে আইতে কইছো। কিছু তো দিতাছো না।

—“একটু ধৈর্য্য ধরে বস না বাপু। হাতের কাজটা শেষ কইরা দিতাছি। খালি ছটফটানি তোর। দিদিমা কেমন আছে তোর?

[ বি দ্র: যেহেতু বাহার তার নানুর কাছে থাকে সেই হিসেবে ঠাকুমা না বলে দিদিমা ডাকবে। ভুলে প্রথম কয়েক পর্বে ঠাকুমা দিয়ে ফেলি। এবার থেকে দিদিমা বলে ডাকবে ]

—“দিদিমা ভালাই আছে। কিছুক্ষণ পর পর হরি রে ডাকে। হ্যা গো,‌ দিদিমা ঠাকুররেও একটু শান্তিতে থাকতে দেয় না।

তাহেরা হেসে বলল, –“পিচ্চি মাইয়ার কথা হুন।

থালায় করে কয়েক রকমের পিঠা নিয়া বাহারের সামনে রাখলো। চট করে দুই হাতে দুটো পিঠে উঠিয়ে নিল সে। তাহেরা ব্যস্ত হয়ে বলে, —“ও কি করে? শান্ত হয়ে বোস না।

—“এখন বসে থাকার সময় না। সূর্য ডুবতাছে, বাড়ি যাইতে হইবো।

—“দু’দন্ড দাঁড়া। তোর দিদিমার লইগা একটু পিঠা রাখছি। নিয়া আসি!

—“তাড়াতাড়ি করো, তোমার লইগা বুড়ি আজ আমারে আর ঘরে ঢুকতে দিবো না।

—“দিতাছি, দিতাছি!

বলে ছুটে রান্না ঘরে গেলেন তাহেরা বেগম। পুঁটলিতে করে কিছু পিঠা এনে দিলেন বাহারের হাতে। এরইমধ্যে একটা পিঠে শেষ করে আরেকটা খেতে শুরু করেছে বাহার। মাগরিবের আজানে চারদিক মুখরিত! তাহেরা বেগম জলদি করে পুকুরের ঘাটে গেলেন অযু করতে। এদিকে বাহার ঝড়ের গতিতে দৌড়ে যাচ্ছে। পথের মধ্যে নুহাশ আবারো হাঁক ছাড়ল তাকে দেখে। কাছে এসে দুটো আম ধরিয়ে বলল, —“এই নে!

—“দুটো দিলি শুধু,আর একটা দে না!

—“ইশ্ শখ কতো? কইছিলাম না আমার লগে যাইতে গেছিলি?

—“ওই বাড়িতে গেলেই বিহারিনী আমারে ধইরা রাখে, তাই যাইতে ইচ্ছে করে না।

—“আচ্ছা ল! ( বলেই ছোট একটা কাঁচা আম হাতে ধরিয়ে দিল। বাহার হেসে উঠলো। নুহাশ বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। পথিমধ্যে থেমে গিয়ে বলল ) বাহার বিহারিনী দিদি তোরে যাইতে কইছে?

—“কেন কইছে?

—“জানি না, কইছে অনেকদিন যাস না, একবার যাইয়া দেখা কইরা আইতে!

বলেই নুহাশ আবারো দৌড়াতে লাগল। বাহার তার রাস্তায় ছুটছে! তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে তাকে!
______

জমিদার সাহেব রাতের খাবার খেতে বসেছেন! তার ছোট্ট মেয়েটি তার পাশে বই নিয়ে বসেছে। মেয়ের বয়স বেশি না, তিন বছর! বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখছে আর হাসছে। এই মেয়ের নাম আয়রা! বড় ছেলে ফজল , ভালো নাম আসিফ মাসাউদ। তার বয়স ৭ বছর। সে আছে তার নানাবাড়ি! জমিদার সাহেবের স্ত্রী মুনতাহা বেগম গরম তরকারির বাটিটা এনে রাখলেন তার সামনে। বাটি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। খাবারের আয়োজন মন্দ নয়। রুই মাছের কালিয়া, ইলিশ ভাজা, ইলিশ মাছের‌ মাথা দিয়ে ডাল রান্না, দুই পদের ভাজা, গরম গরম ভাত! এরপর মিষ্টি কিছু একটা থাকবেই। তিনি খান আর না খান, মুনতাহা বেগম সেই ব্যবস্থা করে রাখবেই। কিন্তু খাবারের পর পান খাওয়ার ব্যাপারটাই তিনি অধিক গুরুত্ব দেন। মুনতাহা বেগম পুরো মুখটা ঘোমটার আড়ালে রেখে‌ নিচু স্বরে বললেন, —“খাইতাছেন না যে! রান্না কি ভালো হই নাই।

—“তোমার রান্না ভালো না হলে আর কার রান্না ভালো হবে। কিন্তু আমি একটা কথা ভাবছি!

—“কি কথা? এখন খাবারের সময়,এসময় কাজের কথা বাদ দেন।

—“কাজের কথা না ফজলের মা। বাহারের কথা ভাবতাছি।

—“খাওনের সময় এই কার কথা ভাবেন?

—“বাহারের জন্য আমার মায়া লাগে মুনতাহা। মেয়েটা বড় নিষ্পাপ!

—“আপনে জমিদার, আপনের মায়া থাকবো না তো কার মায়া থাকবো। কিন্তু এই মাইয়ার কথা বাদ দেন এখন?

—“আচ্ছা, একদিন দুপুরে বাহার কে আনলে কেমন হয়?

—“তওবা তওবা এসব কি কন?

—“তুমি এসব কি বলছো?

—“ওই মাইয়া কি ভালো মাইয়া, আল্লাহর অভিশাপ পড়ছে ওই মাইয়ার উপর। ওই মাইয়ারে বাড়িতে আনলে আমার সংসারের অমঙ্গল হইবো।

—“বাজে বকা বন্ধ করো মুনতাহা। বাচ্চারা কখনো অভিশপ্ত হয় না, বুঝলে!

—“না বুঝি নাই। এতো বুঝাবুঝির দরকার নাই। আপনে কি ওই বাড়িতে যান নাকি। খবরদার, আমি মানা করতাছি ওই দিকে আপনে যাইবেন না। এখানকার কেউ ওই মাইয়ারে ভালা কয় না। গেরামের সবাই জানে তাগো কথা।

—“মুনতাহা, তোমার বুদ্ধি কম! মানুষের কথায় চলা তোমার স্বভাব হয়ে গেছে। নিজের ভাবনা চিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের কথায় কেন নাচো!

—“আমার ইচ্ছা করে তাই আমি নাচি। নিজের সংসারের মঙ্গল আমার নিজেরই দেখতে হইবো। ওই মাইয়ার কথা আপনে আর কখনো বলবেন না।

—“তোমার চেয়ে আরো বুদ্ধি নিয়ে ওই বাচ্চাটা সুন্দর কথা বলে জানো!

—“কি এতো বড় কথা? এতো বড় কথা আপনে কইতে পারলেন!

জমিদার সাহেব জবাব না দিয়ে খেতে বসলেন। মুনতাহা বেগম রাগে কাঁপছে। পরের মাইয়ার লইগা এতো দরদ দেইখা তার শরীর জইলা জ্বাইতাছে। আয়রা কে কোলে তুলে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। জমিদার সাহেব আর খাওয়া শেষ করতে পারলেন না। কিছু না খেয়েই উঠে পড়লেন।
______

দিদিমা বইসা বাহারের খাওন দেখাতাছে। বেচারী জন্মের পর থেকেই দিদিমার কাছে থাইকা বড় হইছে। না পাইছে বাপের আদর, না পাইছে মায়ের আদর। মা তো জন্ম দিইয়াই মইরা গেল। বিধাতার লীলা খেলা কেউ বুঝে না ‌,‌সবার সাথে সাথে এই মাইয়ারে কেন নিইয়া গেলো না। নইলে আর দুদিন বেশিই কাঁদতো। কিন্তু এই মাইয়া বাইচা থাইকা সে কষ্ট পাইতাছে তা কি সহ্য করা যায়। গেরামের একটা লোক সহ্য করতে পারে না তারে। সবাই ওত পেতে থাকে। কি জানে? কখন কি হয়? দিন দিন আরো বড় হইবো তখন তার কি হইবো। এই বুড়ি আর বাঁচবো কয়দিন, তখন তারে কে দেখবো। চিন্তা যেন বুড়ির শেষ হয় না। শাড়ির আঁচল দিয়ে অশ্রু টুকু ঢেকে নিল। বাহার বলল, —“দিদিমা , ও দিদিমা! আরেকটু দুধ দাও না আমায়!

দিদিমা পাতে দুধ ঢেলে দিলেন। বাহার আনন্দ নিয়ে খাচ্ছে। কখনো অভিযোগ করে নাই , কখনো বলে নাই আইজ মাছ না হলে ভাত খামু না, ডিম না থাকলে ভাত ছুঁইয়া দেখমু না। মেয়েটা যে বড্ড লক্ষ্মী! এমন লক্ষ্মী মন্তর মেয়ে এই গেমারমের মানুষ কি আর দেখছে।
তখন বাহার ছোট? দুধের শিশু! গেরামের মানুষজন বাহার আর এই বুড়িরে গ্রামে থাকতে দিবো না। গ্রাম থেকে তাড়ানোর লইগা উইঠা পইড়া লাগছে। বাড়ি থেকে বাইর হওয়াই মুশকিল আছিলো। সেই রাতে এক ঘটনা ঘটলো, ভয়াবহ ঘটনা! গেরামের মানুষজন তেইড়া আইলো আগু’ন হাতে, বাড়িঘর সব জ্বা’লাইয়া দিবো। কিছু রাখবো না এহানে কিছু না। দরকার পড়লে বুড়ি আর এই নাতনীরে আগু’নে জ্বালাইয়া দিবো। তবুও এই গেরামে থাকতে দিবো না। এহনো এই কথা মনে পড়লেই বুক কাইপা উঠে। দিদিমা ঘন ঘন শ্বাস লইতাছে। বাহার খাওয়া ততোক্ষণে শেষ কইলা থালা ধুইয়া এদিকে আইনা রাখলো। দিদিমার কাছে যাইতে, বাহার কে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরল। সেই রাইতের মতো এতো আ’গুন আর কখনো দেখেনাই বুড়ি। এ যে স্বচোখে নিজের চিতা সাজানো! তহন স্বর্গদূতের মতো জমিদার সাহেব আইসা বাচাইলো। লোকটা বড় ভালা মানুষ। সে আছে বইলাই এহনো এই গেরামে তারা আছে। নইলে বাহারের বাপের মতো তাগোরেই মা’ইরা ফেলতো তারা। বাহার কি জানে, তার বাপের মরা’র পেছনে কারা আছে। না জানে না, তারা কি আবার বাহারের ক্ষতি করতে আইবো না!

—“কি হইছে বুড়ি, তুই কাঁদোস কেন?

—“মুখপুরী তুই দেবী হইয়া কেন আমার এই পুড়া কপালে আইলি ক তো! কেন আইলি!

—“তাইলে কার ঘরে যাইতাম?

—“তোর মতো দেবী জন্মাইতো কোন জমিদারের ঘরে,‌ জমিদার তহন সোনা দানা দিয়ে সাজাইয়া রাখতো তোরে।

—“সত্যি দিদিমা!
চোখমুখে এক ধরণের উচ্ছাস! তার চোখ দুটো চক চক করছে। সত্যি সত্যি কি এমন হতে পারতো। দিদিমা তারে আরো জড়াইয়া ধরল। কপালে চুম্বন করে করুণ স্বরে কইলো,

—“তোর কপাল মন্দ দিদিমা! তোর যে কোন সুখ নাই।আমি মই’রা গেলে তোর কি হইবো?

—“আমিও মই’রা যামু!

—“ছিঃ ছিঃ ওমন কথা মুখে আনতে নাই। হরি হরি মাফ করো। হুন মুখপুরী, আমি ম’ইরা গেলে তুই ম’রবি না। তুই যাবি জমিদারের কাছে?

—“তার কাছে কেন যামু?

—“হেই যে স্বর্গদূত রে মা!

—“স্বর্গদূত!

—“হ, আর তুই হলি আমার মা। মা রে পরের জন্মে তুই আমার মা হইয়া জন্মাইস। আমি তইলে তোরে মাথায় কইরা রাখমু!

বাহার হেসে উঠলো। মাঝে মাঝে দিদিমার কথায় তার বেশ হাসি পায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই হাসি সে লুকিয়ে রাখতে পারে না। তার চাঞ্চল্য, রূপ, হাসি এগুলো যেন আড়াল হবার নয়!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here