#নয়নতারা_১৮
#জেরিন_আক্তার_নিপা
দু’দিন পর ওরা বাড়ি ফিরে এলো। খালামনির মন খারাপ ছিল বলে নক্ষত্র আরও দুইদিন থেকেছে। তারপর মনিকা চলে এলে নক্ষত্র নয়নতারাকে নিয়ে চলে এসেছে। দুই সপ্তাহ সে বাড়িতে ছিল না। কাউকে বলেও বের হয়নি। মা নিশ্চয় টেনশন করছে। গাড়িতে বসে নয়নের মন কেমন করছিল। দু’টা সপ্তাহ কীভাবে কেটে গেল বলতেই পারল না। সবার সাথে কত হাসিখুশি ছিল। এবাড়ির মানুষ গুলোও কত ভালো। সবাই কত মিলেমিশে থাকে। ওই বাড়িতে তো প্রথম কথা মানুষই নেই। বিয়ের পর থেকে শ্বশুরের মুখ দেখেনি নয়ন। শাশুড়িকে যাও কয়দিন দেখেছে কিন্তু শাশুড়ি মা বড় ঝগড়াটে। তাকে সেদিন কতগুলো কথা শোনাল। এখানে আসবে শুনে আসার ইচ্ছে হয়নি। আর এখন যাওয়ার সময় যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মন খারাপ লাগছে। সবাইকে এক বাড়িতে নিয়ে থাকতে পারলে কত মজা হত। বাবার বাড়ির সবাই। শ্বশুরবাড়ির সবাই। কারো জন্যই তখন মন খারাপ হতো না। দুঃখ বলে কিছুই থাকত না তখন।
নক্ষত্র অনেকক্ষণ ধরে পাশে বসে থাকা নয়নতারাকে লক্ষ করছিল। মন খারাপ নাকি? মুখ গোমড়া করে এরকম চুপ মেরে আছে কেন? সকাল থেকে সে একটা বকাও দেয়নি। মুখ কালো করেও কথা বলেনি। তাহলে সমস্যা কোথায় হলো? কে কী বলল!
সামনে নির্জন ফাঁকা রাস্তায় চোখ রেখে ড্রাইভ করতে করতে নক্ষত্র আড়চোখে নয়নকে দেখল। তার দিকে নয়নের খেয়াল নেই। সে নিজের দুনিয়ায় ডুবে আছে। নক্ষত্র মুচকি হাসল। বলল,
—-কী হয়েছে? মন খারাপ কেন?’
নয়নতারা সোজাসাপ্টা উত্তর দিল।
—-এতদিন সবার সাথে ছিলাম। এখানে কত মানুষ। সময় কীভাবে কেটে যায় বোঝাই যায়নি। ফিরে গেলেই তো আমি আবার একা হয়ে যাব। আপনাদের বাড়িতে কোন মানুষ নেই। আপনি নিজেও বাড়িতে থাকেন না। সারাটা দিন আমাকে বাড়িতে একা থাকতে হয়। অত বড় বাড়িতে একা থাকতে আমার ভালো লাগে না। ভয় লাগে।’
নয়নতারা সত্যি সত্যিই মন খারাপ করে বসে রইল। নক্ষত্র এই মেয়েকে বুঝতে পারে না। এখানে আসার সময় মানা করছিল। আসতে চাচ্ছিল না। আর এখন যাওয়ার সময় মন খারাপ করছে। সে নয়নের মন ভালো করার জন্য বলল,
—-আচ্ছা, ফিরে গিয়ে নাহয় অনেকদিন তোমাদের বাড়িতে থেকে আসবে।’
নক্ষত্রর এই কথায় নয়নতারা কিছুটা খুশি হলেও পুরোপুরি হতে পারল না। কেন পারল না সে নিজেও জানে না। নয়নতারা এখনো তার মন খারাপ হওয়ার আসল কারণটাই হয়তো বুঝতে পারছে না। এখানে চৌদ্দ দিনের সবটা সময় নক্ষত্র তার আশেপাশে, চোখের সামনেই ছিল। ফিরে গিয়ে অনেক কিছুই বদলে যাবে। নক্ষত্র আবার তাকে বকাবকি করবে। তার উপর রাগবে। এখানে নক্ষত্র তার কত খেয়াল রেখেছে।
নয়নতারা বাবার বাড়ি যাবার কথা শুনেও খুশি হয়নি দেখে নক্ষত্র নিজেও কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল। এই চাপা স্বভাবের মেয়ের মন খারাপের কারণ কখনও জানতে পারবে না সে।
বাড়িতে এসেই মায়ের সামনে পড়ল নক্ষত্র।
—-নক্ষত্র! কোথায় গিয়েছিলে তোমরা? আমাকে বলে যাওয়ারও প্রয়োজন মনে করলে না! মা হিসেবে তোমার কোন কথা জানার অধিকার আমার নেই। ফোন তুলছ না। নিজেও কিছু বলে গেলে না। তোমার জন্য আমার কতটা টেনশন হয়েছে জানো তুমি? তুমি এতটা কেয়ারলেস কীভাবে হলে নক্ষত্র? আমাকে টেনশন দিতে তোমার ভালো লাগে?’
—-বাহ! শুনে ভালো লাগল। আমার জন্য তোমার টেনশন হয়। একমাত্র ছেলের কথা ভাবো তাহলে তুমি! আমি তো জানতামই না। এখন শুনে সত্যিই ভালো লাগছে। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে।’
মা ছেলের দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকাল। পরক্ষণে চোখ সরিয়ে নয়নকে দেখল। উনার এখন মনে হতে লাগল, সব এই মেয়ে করেছে। সেদিন এই মেয়েকে কথা শুনিয়েছিল বলে, এই মেয়ে তার ছেলেকে তার বিরুদ্ধে উসকানি দিয়েছে। তাই নক্ষত্র উনার সাথে এভাবে কথা বলছে। এর আগে নক্ষত্র কখনও উনাকে না বলে কোথাও যায়নি। মনে মনে তিনি নয়নের বাবা মা তুলে গালি দিয়ে ওকে শায়েস্তা করার কথা ভাবছে।
—-ছোট লোকের বাচ্চা! আমার থেকে আমার ছেলেকে দূর করবি তুই! নইলে তো এই বাড়ির উপর নিজের রাজত্ব ছড়াতে পারবি না। হানিমুনে গিয়েছিলি! হানিমুন! এই বাড়ির মালকিন হওয়ার তোর স্বপ্ন আমি বের করছি। ঝেটিয়ে তোকে এই বাড়ি থেকে বিদায় করতে না পারলে আমিও নক্ষত্রর মা না। দেখি ছেলের কাছে কে বড়। মা নাকি বউ?’
মা’কে দাঁড় করিয়ে রেখেই নক্ষত্র নয়নের হাত ধরে ভেতরে চলে এলো।
—-চলো তারা। অনেকটা পথ জার্নি হয়েছে। ঘরে গিয়ে রেস্ট নিবে।’
—-এই মেয়েকে বেশিদিন আমি আমার বাড়িতে থাকতে দেব না। খুশি শীঘ্রই এই মেয়েকে আমার ছেলের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।’
পরের দিনটা বাড়িতেই কাটল। অবশ্য নয়নতারা একাই বাড়িতে ছিল। বাড়ি ফিরে আসার পর নক্ষত্র দু’মিনিটের জন্য বাড়িতে স্থির থাকছে নাকি? নয়নের রাগই হলো। পুরোটা সময় একা একা এই ভূত বাড়িতে সে কী করে এই খোঁজটাও লোকটা রাখে না। পরের দিন নক্ষত্র নিজে নয়নতারাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল।
—-আজ তোমাদের বাড়িতে যাব। রেডি হয়ে নাও। তোমাকে রেখে আমি রাতে চলে আসব।’
নয়নতারার বাবার বাড়ি যাবার আনন্দ কিছুটা কমে গেল যেন। আজকাল তার কী হয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। অদ্ভুত এক রোগে ধরেছে তাকে। কয়দিন আগেও যে মানুষটা তার চোখে বিষের মতো লাগত। এখন তাকেই সর্বক্ষণ তার চোখ খুঁজে বেড়ায়। মানুষটা আর কেউ না, ওই বদ লোকটা। এমনটা কেন হচ্ছে? নক্ষত্র বাড়িতে থাকলে সবকিছুই তার কেমন ভালো লাগে। ও বেরিয়ে গেলেই মন কেমন করে। নক্ষত্র কখন ফিরবে সেই আশায় ব্যাকুল হয়ে বসে থাকে।
নক্ষত্র নয়নকে ওর বাবা মা’র কাছে রেখে সত্যি সত্যিই চলে এলো। সবাই অনেক সাধাসাধি করলেও সে থাকেনি। নয়নতারা মন খারাপ করে নক্ষত্রকে বিদায় দিয়েছে। ঝিনুক তাকে দেখে বলল,
—-কি রে নয়ন! বরকে ছাড়া তুই দেখছি এক মুহূর্ত থাকতে পারছিস না। চেহারার কী অবস্থা হয়েছে দেখ! যেন অতি আপন কেউ এক্ষুনি ইন্না-লিল্লাহ হয়েছে। মুখ ঠিক কর। কয়দিনই তো থাকবি এখানে। তারপর তো চলেই যাবি। নাকি আজই যাবি? নক্ষত্র এখনো হয়তো বাড়ি পৌঁছায়নি। ফোন করে মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে আনব?’
—-আপু তুমি বড্ড বাজে বকো। আমি এখানে থাকার জন্য এসেছি। অত তাড়াতাড়ি যাচ্ছি না। কম করে হলেও পনেরো দিন তো থাকবোই।’
—-যাক, তবুও তো তোর সুবুদ্ধি হয়েছে। শুনে ভালো লাগল। তুই সারাজীবনের জন্য চলে আসিসনি। গতবার কিন্তু অন্য সুরই গাইছিলি। এবার অন্য সুর। আর কয়দিন পর নতুন সুর ধরবি, আপু তোমাদের জামাই না থাকলে আমিও থাকব না।’
ঝিনুক হাসছে। নয়নের রাগ লাগছে। আপু ফালতু কথা কেন বলছে! সে কখনও ওরকম বলবে না। লোকটা নিজের বাড়িতে গিয়ে থাকুক। সে তার বাড়িতে থাকবে।
—-তোদের দাম্পত্য জীবন কেমন চলছে রে? এখনও পাগলামি করিস? বেচারার কিন্তু ধৈর্য আছে বলতে হবে। তোর মতো একটা চিজ সামলানো চারটে খানি কথা না।’
—-বিয়ে করেছিল কেন? আমি জোর করে তোমার বেচারার ঘাড়ে চেপেছি নাকি? সে ইচ্ছে করে আমাকে ঘাড়ে চাপিয়েছে। এবার তাহলে মজাও তাকেই বুঝতে হবে।’
—-বাবাহ! ফটরফটর কথাও বলতে শিখে গেছিস। তোর বর তোকে কথা শেখানোর ক্লাস দিয়েছে নাকি? মুখে কথার খই ফুটছে। আর কী কী শিখিয়েছে রে?’
নয়ন রাগ করে বলল,
—-তোমার সাথে কথা বললেও দোষ। আমি আর কিছু বলবোই না।’
ঝিনুক নয়নের চরিত্রের পরিবর্তন গুলো বেশ বুঝতে পারছে। হয়তো ওরা আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মত স্বাভাবিক সংসার করছে না। তবুও ওদের মাঝে অনেক কিছুই আগের থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। নয়ন নিজেও বুঝতে পারছে না ও একটু একটু করে সংসারে জড়িয়ে যাচ্ছে।
তিন নাম্বার দিন পর্যন্ত নয়নের ভালোই কাটল। চার
নাম্বার দিনটাও কোনোভাবে কেটে গেল। পাঁচ নাম্বার দিন আর কাটতে চায় না। এখন যেন নিজের বাড়িতেই তার কোন কাজ নেই। বরং এটাই এখন অন্যের বাড়ি মনে হচ্ছে। কেউ তাকে কিছু করতে দিচ্ছে না। নক্ষত্রও এখানে নেই। সে-ও নয়নকে একশো ফুটফরমাশ দিচ্ছে না। তারা আমার এটা পাচ্ছি না। তারা ওটা কোথায় রেখেছ? তারা এই জিনিসটা এখানে রেখেছিলাম। কোথায় গেল দেখ তো। নয়নকে একেকজনে একেক নামে ডাকে। বাড়ির সবাই নয়ন ডাকে। বাবা তারা মা ডাকে। নক্ষত্রই শুধু তাকে এত সুন্দর করে তারা ডাকে। নক্ষত্রর মুখে তারা ডাক মিস করছে সে।
—-দূর! কী যে হলো আমার! সারাক্ষণ ওই লোকটাকে নিয়েই ভাবতে থাকি। আমার কী ভাবার অন্য কোন বিষয় নেই? মাথাটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।’
নয়নের মা তাকে ডেকে বলল,
—-জামাইকে আজ আসতে বল। সেই যে গেল। অনেক দিনই তো হয়ে গেছে। ওকেও এসে কয়টা দিন থাকতে বল।’
—-আচ্ছা।’
মা’র বলতে দেরি হয়েছে। নয়নের ঘরে এসে নক্ষত্রকে কল করতে দেরি হয়নি।
রিং হচ্ছে। রিসিভ করছে না কেন? দূর, রাগ লাগছে।
—-কী খবর তারা? বাবার বাড়িতে সময় কেমন কাটছে? নিশ্চয় অনেক ভালো। তাইতো আমার কথাও ভুলে বসেছিলে এতদিন।’
নক্ষত্রর গলা শুনে নয়নের বুকের ভেতর মুচড় দিচ্ছে। আজ কতদিন পর মানুষটার গলা শুনল। তার ভাবনায় সারাদিন যে মানুষটা থাকে। যাকে নিয়ে ভেবে ওর দিন কাটে, সে বলছে আমাকে ভুলে বসেছিলে! মানে হয় কিছু?
—-মা আপনাকে আসতে বলছিল।’
—-মা বলছিল বলেই বললে? তুমি চাও না আমি আসি?’
তাৎক্ষণাত নয়ন কোন উত্তর দিতে পারল না। নক্ষত্র হাসল। বলল,
—-মজা করছিলাম। শাশুড়ি মা’কে বলে দিও, আজ আমি আসতে পারব না। কালও পারব কিনা সন্দেহ। পরশু চেষ্টা করতে পারি। সময় পেলে আসব।’
নয়নের বলতে ইচ্ছে করছিল, এত কিসের ব্যস্ততা আপনার? একটা দিনের জন্য আসতে পারবেন না? কী অত কাজ করেন হ্যাঁ৷ শুনি তো একটু। কিন্তু মুখে বলল,
—-অহ। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি মাকে বলে দেব।’
কল কেটে দিল নয়ন। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কই এতদিন পর ফোন পেয়ে জিজ্ঞেস করবে, বেড়ানো শেষ? আমি তোমাকে নিতে আসব? তা না। বলে কিনা আমার সময় নেই।
—-কোন রাজ কার্য নিয়ে ব্যস্ত আছে কে জানে।’
আরও দু’টা দিন কেটে গেল। নয়নতারার আর কিছুই ভালো লাগছে না। অকারণে রাগ হচ্ছে। সবকিছু অসহ্য লাগছে। কারো কথাই শুনতে পারছে না। মেজাজ এত খিটখিটে হয়ে আছে যে, নক্ষত্রকে নিয়ে আকিবের সাথে ঝগড়া হয়ে গেল। ঝগড়া তেমন না, তবে কথা কাটাকাটি হয়েছে। নক্ষত্রকে নিয়ে কেউ কিছু বললে কেনই যে তার সহ্য হয় না। ঝিনুক ঝগড়ার কথা শুনে নয়নের কাছে আসে।
—-আপু আকিব ভাইয়াকে নিয়ে তুমি একটা কথাও বলবে না আমার সাথে। ওকে নিয়ে আমি কোন কথা শুনতে চাই না।’
—-আরে ঝগড়াটা কী নিয়ে হলো। সেটা তো বলবি নাকি।’
—-আকিব ভাইয়ার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এটা কি তুমি জানো? ও বলছে আপুকে নাকি উনিই ভাগিয়ে দিয়েছে। কেন দিয়েছে জানো? আমাকে বিয়ে করতে। উনার নজর নাকি তোমাদের বিয়ের সময় থেকেই আমার উপর ছিল। এমন বাজে কথা সহ্য হয় বলো তো।’
—-আকিবের কী? মুখে যা আসে বলে দিলেই হলো। তুই ওর কথায় কান দিস না তো।’
—-দেইনি তো। তাইতো ঝগড়াটা হলো।’
—-ভালো করেছিস। নিজের বরের জন্য ঝগড়া করবি না তো অন্য বেডার জন্য করবি নাকি?’
ঝিনুক মনে মনে চিন্তায় পড়ে গেল। নয়ন এখনো জানে না, নক্ষত্র ইলা ওরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতো। ওদের বিয়ে পরিবার ঠিক করলেও আগে থেকেই ওদের মাঝে সম্পর্ক ছিল।
—-নয়ন যখন জানবে নক্ষত্র তার বড় বোনকে ভালোবাসতো। তখন ব্যাপারটা কীভাবে নিবে ও? বড় বোনের প্রেমিককে নিজের স্বামী হিসেবে দেখা যেকোনো মেয়েরই খারাপ লাগবে। নয়ন হয়তো এ-ও বুঝতে পারবে, নক্ষত্র শুধু তার খেয়াল রাখে। তাকে ভালোবাসে না। নক্ষত্র ওর জন্য যা যা করে সবই দায়িত্ব কর্তব্য থেকে। ভালোবাসা থেকে নয়।
চলবে___