নয়নতারা পর্ব ৩৩+৩৪

#নয়নতারা [৩৩]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
#বোনাস_পার্ট

নক্ষত্র কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। তার বোঝার দরকারও নেই। সে নয়নকে খুঁজছে। ইলার ব্যাপারে ভাবতে গিয়ে মাথা হ্যাং হয়ে আসে তার।
ইলাকে তাকে ধোঁকা দেয়নি। সে-ও তো ইলাকে ধোঁকা দেয়নি। ইলা কেন তাকে বলে যায়নি। ইলার সাথে যা কিছু হয়েছে তা তার নিজের দোষে হয়েছে। সে কেন বিয়ের দিন ওই ছেলেটার জীবন বাঁচাতে গিয়েছিল। গিয়েছে ভালো কথা। নক্ষত্রকে কেন জানিয়ে যায়নি। নক্ষত্র তাহলে ইলাকে অবিশ্বাস করতো না। ইলার মেসেজ দেখেও সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ইলার ভাই নিজের চোখে দেখেছে। তারপর আর তার কী করার ছিল?
নয়ন এখন তার বউ। নয়নকে বিয়ে করেছে সে। ইলাকে এটা জানিয়ে দিলেই সব ঝামেলা মিটে যাবে।

—-ঝিনুক, তারাকে দেখেছ?”

ঝিনুক একবার নক্ষত্রর মুখের দিকে দেখল। মাথা নেড়ে বলল,

—-নয়নকে অনেকক্ষণ ধরে দেখিনি। ঘরে নেই?”

—-না। ঘর থেকে দেখে এসেছি আমি।”

ঝিনুক কোনোভাবেই উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারল না। তার চোখে অস্থিরতা দেখে নক্ষত্রও ব্যাপারটা বুঝে গেল।

—-কিছু বলবে?”

—-হ্যাঁ। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে। এদিকে এসো তুমি।”

ঝিনুক নক্ষত্রকে আড়ালে টেনে নিয়ে গেল। নক্ষত্র জানে ঝিনুক কী বলবে।

—-বলো।”

—-নক্ষত্র আমি কিন্তু তোমাকে ভাই বানিয়েছি। সেটা তুমিও জানো। নয়নের দিক থেকে না। আমাদের বিয়ের সময়ই আমি এই জায়গাটা তোমাকে দিয়েছি।”

—-আমি জানি ঝিনুক।”

—-সত্যি করে বলো এখন তুমি কী করবে?”

—-কিছুই করব না।”

—-ইলা পালিয়ে যায়নি। ওকে ফাঁসানো হয়েছে। এতে ওর কোন দোষ ছিল না৷ তেমনি নয়নের কোন দোষ নেই। তুমি ওকে বিয়ে করেছ। এখন চাইলেই তুমি নয়নের কথা না ভেবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারো না। তোমার আর ইলার মাঝে যেন নয়নের জীবনটা নষ্ট না হয়। ইলার জন্য আমারও কম কষ্ট হচ্ছে না। বেচারির সাথে যা হয়েছে মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু নয়ন তোমার বউ। বিয়ে করেছ তুমি ওকে।”

—-ঝিনুক, আমার পক্ষে তারাকে ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব না। ইলার জন্য আমার মনে যা ছিল তা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। ইলার জায়গা কবেই নয়ন নিয়ে ফেলেছে। তুমি কী ভাবছো ইলাকে আমি ফিরিয়ে নেব! নয়নকে ছেড়ে দিয়ে! এমনটা ভাবলে বলতে হবে, তুমি আমাকে চিনোই নি ঝিনুক। ইলার কষ্ট হলেও সত্য মেনে নিতে হবে। আমি জীবনে অনেকটা এগিয়ে গেছি। আরে আমরা তো বেবি নেওয়ার কথা ভাবছিলাম। তার মাঝে এসব হয়ে গেল।”

ঝিনুক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।

—-যাক বাবা! মাথা থেকে অনেক বড় বোঝা নেমে গেল। এসব ভেবে ভেবে আমি পাগল হচ্ছিলাম।”

নক্ষত্র হাসল। ঝিনুককে অভয় দিয়ে বলল,

—-আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো তুমি। এই জীবনে নয়নতারাকে ছাড়তে পারব না আমি। আমি যতদিন বেঁচে আছি ওকে আমার সাথেই থাকতে হবে।”

নক্ষত্র নয়নকে খুঁজতে খুঁজতে ওর ঘরে চলে এলো। ঘরেও কোথাও নয়ন নেই। গেল কোথায় মেয়েটা? তখনই ওয়াশরুম থেকে শব্দ ভেসে এলো। নক্ষত্র ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল,

—-তারা, তুমি ভেতরে? বের হও। কথা আছে তোমার সাথে।”

নয়ন বের হচ্ছে না। নক্ষত্র দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগল। নয়ন কোনো রকমে কান্না চেপে চোখে মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো। নক্ষত্র ওর মুখ দেখেই বুঝে গেল কেঁদেছে সে এতক্ষণ। নক্ষত্র নয়নের হাত ধরে ওকে ঘরের মাঝে টেনে নিয়ে এলো। চোখ গরম করে বলল,

—-এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি? কখন থেকে আমি তোমাকে খুঁজছি। ওয়াশরুমে বসে ছিলে তুমি!”

নয়ন নক্ষত্রর দিকে তাকাচ্ছেও না। নক্ষত্র মনে মনে এটাই তো ভয় পাচ্ছিল। এই মেয়ে এরকমই। এতদিনে হাড়ে হাড়ে চেনা হয়ে গেছে ওকে।

—-কেঁদেছ কেন?”

নয়ন চুপ। নক্ষত্র শক্ত গলায় ধমক দিয়ে বলল,

—-কী বলছি কথা কানে যাচ্ছে না? কেঁদেছ কেন? কথা বলো। চুপ করে থাকলে খুব খারাপ হয়ে যাবে তারা। আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে।”

নক্ষত্র যতই পরিস্থিতি সহজ করতে চাক নয়নের মনের ভেতর কেমন ঝড় চলছে তা শুধু সে-ই জানে। নক্ষত্র নয়নকে জড়িয়ে ধরল। অনুরোধ করে বলল,

—-আমার সাথে কথা বলো প্লিজ।”

—-আপু আপনাকে ধোঁকা দেয়নি। ঠকায়নি আপনাকে।”

নক্ষত্র ওকে ছেড়ে দাঁড়াল। কপাল কুঁচকে বলল,

—-তো! আমি ওকে ধোঁকা দিয়েছি? আমি ঠকিয়েছি? না, না? তাহলে এসব কথা আসছে কেন?”

—-আপু এখনও আপনাকেই ভালোবাসে।”

—-আমি তো বাসি না। আমি আমার বউকে ভালোবাসি।”

—-আপু শুনলে কষ্ট পাবে।”

—-তাতে কি আমার কিছু করার আছে তারা? আমার কারণে কি ও কষ্ট পাচ্ছে? ইলা ওর নিজের ভুলের জন্য কষ্ট পাবে। কেন বলে গেল না ও আমাকে? আমাকে জানিয়ে গেলে আমি কিছু অন্তত করতে পারতাম।”

নয়ন কেঁদে ফেলল। নক্ষত্র অবাক হয়ে ওকে দেখছে। কাঁদতে কাঁদতেই নয়ন বলল,

—-আপনি এই কথাগুলো এত সহজে কীভাবে বলতে পারছেন? এতটা কঠিন হতে পারবেন আপনি? আপুর জায়গায় যদি আমি হতাম! তাহলে আমাকেও ভুলে যেতেন আপনি, তাই না? হ্যাঁ, ভুলতেনই তো। এখন যেমন আপুকে ভুলে গেছেন।”

নক্ষত্র হতভম্ব। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে সে। এই মেয়ে কি পাগল? মাথা খারাপ ওর? ব্যাপারটা কিছুটা এরকম হয়ে গেল না যে, যার জন্য করলাম চুরি সে-ই বলে চোর।

—-এখন তুমি কি চাও? তুমি চাও আমি আবার ইলাকে বিয়ে করি? তোমাদের দুই বোনের স্বামী হই? ইলাকে সতীন হিসেবে চাও তো তুমি? আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি বললে আমি ইলাকেও বিয়ে করব। শুধু ইলাকে কেন? তুমি আর যাকে যাকে সবাইকে করব। দুইটা কেন? তুমি চাইলে আমি চারটা বিয়ে করতে রাজি আছি। তুমি তো মহান, না! নিজে কষ্ট পেতে রাজি কিন্তু বোনের কষ্ট দেখতে পারবে না। সেজন্য নিজের স্বামীর ভাগ দিতেও রাজি আছো। কোন সমস্যা নেই তোমার। করব বিয়ে। শুধু ইলাকে কেন? আর কাকে কাকে করতে হবে? বলো। বলছো না কেন?”

হঠাৎ নক্ষত্রর এত রাগ উঠে যাবে সে নিজেও বুঝেনি। নয়ন তাকে কী করতে বলছে সে নিজেও কি বুঝতে পারছে! নিজের সংসারের কথা না ভেবে বোনের কথা আগে ভাবছে।

—-কি হলো? চোখে পানি কেন এখন? তোমার তো কষ্ট হয় না। সব দরদ তোমার মানুষের জন্য। আমাকে তোমার বুঝতে হবে না।”

নয়ন সত্যিই সহ্য করতে পারছে না। আপুর কোন দোষ না থাকা স্বত্বেও আপুকে কীভাবে কষ্ট পেতে দিবে সে? আবার নক্ষত্রকে ছাড়াও সে বাঁচবে না। নয়ন এই পরীক্ষায় কেন পড়ল।
নক্ষত্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল নয়ন। নক্ষত্র রাগে তাকে সরিয়ে দিতে চাইছে।

—-ছাড়ো আমাকে। ছাড়ো বলছি। আমার মন তো কিছু না। আমার অনুভূতি কত সস্তা দেখলে না! তাই তো ইলাকে ভুলে গিয়ে তোমাকে ভালোবাসতে পেরেছি। এখন তো আমাকে শাস্তি পেতেই হবে।”

—-এরকম বলবেন না আপনি। আমার ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে। আপনাকে ছাড়া থাকা আমার মৃত্যুর সমান। কিন্তু আপুকেও এই অবস্থায় দেখতে পারছি না আমি। আপু আপনার আশাতেই ওরকম বাজে পরিস্থিতির সাথে লড়ার সাহস পেয়েছে। এখন যদি জানতে পারে, তাহলে আপু ভেঙে পড়বে। হয়তো মেনে নিতে পারবে না। সেদিন আমি জেনেছিলাম আপনি আপুকে ভালোবাসতেন, সেদিন আমারও এরকম কষ্ট হয়েছিল।”

নক্ষত্র কি রাগ করে থাকবে? এই মেয়ের উপর রাগ করে থাকা যায়? নয়নের উপর থেকে তার সব রাগ চলে গেল। নয়নকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,

—-তুমি এত ভালো কেন? কেন তুমি নিজের আগে বাকিদের কথা ভাবো। তুমি একটু স্বার্থপর কেন হতে পারো না। তুমি শুধু ইলার কথাই ভাবছ। তুমি নিজে কি কম কষ্ট পাচ্ছ? ওর ভুলের জন্য আগেও তুমি কষ্ট পেয়েছ। বিশ্বাস করো তারা, ইলা পালিয়ে গেছে জেনে আমিও ভেঙে পড়েছিলাম। অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। শুধুমাত্র ইলার থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু কখন যে তোমার প্রতি আমি এতটা দুর্বল হয়ে পড়লাম তা আমিও জানি না। স্বামীর স্ত্রীর মাঝে আল্লাহ তায়ালা নিজে ভালোবাসা তৈরি করে দেন। আমাদের সম্পর্ক পবিত্র ছিল তারা। তাইতো আমরা নিজেদের জন্য টান অনুভব করেছি। একে অপরের কাছে এসেছি। ভালোবাসার পবিত্র বন্ধনে বাঁধা পড়েছি। মৃত্যু ছাড়া আমাদের আলাদা হওয়া সম্ভব না। আমি তোমাকে ছাড়া আমার এক মুহূর্ত ভাবতে পারি না। ইলাকে সত্য বলে দেওয়াই ভালো হবে। ও কষ্ট পেলেও মেনে নিতে হবে। এটাই সত্য।”
#নয়নতারা [৩৪]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

নক্ষত্র আজ নয়নদের বাড়িতে থাকল না। বাড়ি যাবার আগে সে একবার নয়নের বাবার সাথে দেখা করে গেল। শ্বশুর আব্বা কী বলে সেটা জানা দরকার। নয়নের বাবা বিছানার একপাশে বসে আছে। নক্ষত্র ঘরে এসে বসল না। উনার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ একইভাবে চুপ করে বসে থাকার পর তিনি মাথা তুলে নক্ষত্রর দিকে তাকালেন। মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললেন,

—-চলে যাচ্ছ?”

—-হ্যাঁ বাবা।”

—-থেকে গেলেই পারতে আজ।”

কথাটা উনি বলেছেন ঠিকই। কিন্তু কথাটাতে জোর ছিল না। যতক্ষণ ইলাকে নয়ন আর নক্ষত্রর বিয়ের কথা জানানো না হয়, নক্ষত্র এখানে না থাকাই ভালো। ইলা সব কিছু জেনে স্বাভাবিক ভাবে নিলেই হলো। দুই মেয়ের থেকে কোন মেয়ের কষ্টই বাবা হয়ে তিনি দেখতে পারবেন না। নয়নের প্রতি উনার টান বেশি থাকলেও ইলা উনার বড় মেয়ে। বড় মেয়ের ভালোবাসাও কম নয়। দু’জনই উনার দুই চোখ। চারপাশটা ভালো ভাবে দেখার জন্য দু’টো চোখই দরকার।

—-তারাও যাবে আজ?”

—-না।”

—-ও যাচ্ছে না তোমার সাথে? আচ্ছা, কাল এসো তাহলে। আজ তো রাতও অনেক হয়েছে।”

নক্ষত্র ভেবেছিল ইলার ব্যাপারে হয়তো শ্বশুর আব্বা কথা তুলবেন। কিন্তু তার কথাবার্তায় তেমন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নক্ষত্র দাঁড়িয়ে রইল। শ্বশুর, জামাই অনেকটা সময় নীরবতা পালন করল। তারপর নক্ষত্রই নিজে থেকে বলল,

—-বাবা আমি আপনার সাথে আরও কিছু কথা বলতে চাই।”

—-হা? হ্যাঁ, হ্যাঁ বলো।”

নক্ষত্র চেয়ার টেনে এখন শ্বশুরের সামনে বসল। উনার চোখে চোখ রেখে বলল,

—-কথাটা আপনার ছোট মেয়েকে নিয়ে। আপনি ওর বাবা। আপনার থেকে ভালো তারাকে কেউ জানবে না। আপনি আপনার মেয়েকে খুব ভালো ভাবেই জানেন। ইলা ফিরে আসার পর নয়নতারার মনে কী চলছে তা-ও বুঝতে পারছেন। আমি ওর সাথে কথা বলেছি। তাতে যেটুকু বুঝতে পেরেছি, বোনের কষ্ট সহ্য হচ্ছে না ওর। ও নিজে কষ্ট পেতে রাজি তবুও ইলাকে খুশি দেখতে চায়। আমার ভয় হচ্ছে তারা কোনো একটা পাগলামি করে না বসে। তাই ভাবছিলাম ইলাকে যদি সত্যিটা জানিয়ে দেওয়া হতো তাহলে আমাদের সবার জন্যই পরিস্থিতিটা কিছুটা সহজ হয়ে যেত বাবা।”

নক্ষত্র কথা শেষ করল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

—-হাহ্! আমিও এই কথাই ভাবছিলাম। তারাটা সবার থেকে আলাদা। ওর মনে কোনো পাপ নেই। কোনো প্রকার চালাকি বা প্যাঁচ নেই। আমার এই মেয়েটা ভীষণ সহজসরল। তার জন্যই তো ওকে আমি সব সময় আগলে রেখেছি। বাইরের পরিবেশ থেকে দূরে রেখেছি। ও বাইরের মানুষ গুলোর সাথে খাপখাওয়াতে পারবে না। ইলাকে আমিই বলব। তোমাদের কারোর বলতে হবে না। আমি ওকে বোঝাবো। তুমি কাল এসে তারাকে নিয়ে যেও।”

নক্ষত্রর মাথা থেকে যেন সব চিন্তা দূর হয়ে গেল। আর কোন ভয় নেই। ইলার বাবাই ইলাকে সামলাবে। সে কাল নয়নতারাকে নিয়ে যাবে। নইলে চোখের সামনে বোনকে কষ্ট পেতে দেখলে নয়নও কষ্ট পাবে।
ইমন পুলিশে খবর দিয়েছিল। নক্ষত্র চলে যাবার পর রাতে বাড়িতে পুলিশ আসে। ইলার স্টেটমেন্ট নেয়। ইমন পুলিশের সাথে জিসানের ফ্ল্যাটে যায়৷ ওখানে গিয়ে জিসানকে পায় না। ওখান থেকে রাসেলের ফ্ল্যাটে গিয়ে ওকে ধরে ফেলে। রাসেল ভয়ে সব স্বীকার করে নেয়। পুলিশকে এটাও জানায় জিসান কাল থেকেই পালিয়েছে। ইলা যেন কীভাবে কাল তার ফ্ল্যাট থেকে পালিয়ে যায়৷ হয়তো জিসান মনের ভুলে ইলার ঘরের দরজা লক না করেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিল। রাসেলকে অ্যারেস্ট করা হয়। ইমন বাড়ি ফিরে আসে। সবাইকে এই খবর জানায়। জিসানকেও দু’তিন দিনের ভেতর খুঁজে বের করা হবে। উপযুক্ত শাস্তি পাবে ওরা। রাতে ইলার সাথে মা ঘুমিয়েছিল। ইলা হঠাৎ মাঝরাতে জেগে উঠে জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকে। তার চিৎকারে মা জেগে যায়।

—-আমাকে মেরে ফেলবে! ও আমাকে মেরে ফেলবে। বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও। বাবা! বাবা, নক্ষত্র। বাঁচাও।”

মেয়ের এই অবস্থা দেখে মা’র বুক ফেটে যায়। মেয়েটা এতগুলো দিন মানসিক, শারীরিক অত্যাচার সহ্য করেছে। ওর গায়ে মারের দাগ গুলো এখনও তাজা। ওগুলো শুকায়নি।

—-ইলা! ইলারে, তোকে কেউ মারবে না মা। কিচ্ছু হবে না তোর। ভয় পাস না মা।”

—-মা ও আমাকে মেরে ফেলবে মা। আমাকে ছাড়বে না। এত অন্ধকার কেন মা? আমার ভয় লাগে মা। আলো, আলো জ্বালো মা। আমার ভয় করছে।”

ইলার চিৎকার শুনে বাকি সবারও ঘুম ভেঙে যায়। এতক্ষণে সবাই ইলার ঘরে চলে এসেছে। ইলা পাগলের মতো করছে। এতদিন ইলা যেখানে ছিল সে হয়তো ভাবছে এখনও ওখানেই আছে সে। ঘুমানোর আগেও ইলার অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হয়তো ভয়ংকর কোন স্বপ্ন দেখেছে। নয়তো ওই বাজে স্মৃতি গুলো ঘুমের মাঝে ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আর তাই জেগে গিয়েও ইলা ওই ঘোরের মাঝেই আছে। হাঁটু ভাঁজ করে বুকের সাথে দু’হাতে চেপে ধরে বিড়বিড় করে ইলা। নয়ন ইলার কাছে এসে ইলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

—-আপু! ও আপু, কী হয়েছে তোমার? কেন ভয় পাচ্ছ? আমরা সবাই আছি তো।”

—-আমার কাছে আসবে না। ন-না। একদম কাছে আসবে না। যে-যেতে দাও। যেতে দাও আমাকে।”

সেই সাহসী, মুখের উপর সব বলে দেওয়া ইলার এই অবস্থা বাড়ির কেউই সহ্য করতে পারছে না। মেয়েটা নরক থেকে ফিরে এসেছে। রাতেই ডাক্তার আসে।

—-ও কেন এমন করছে ডাক্তার? কী হয়েছে মেয়েটার?”

ইলার বাবা অস্থির হয়ে প্রশ্নটা করল। ডাক্তার ইলাকে এতক্ষণ পরীক্ষা করেছে। উনাকে সবকিছুই জানানো হয়েছে। মারের দাগ গুলো দেখতে দেখতে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

—-ও এখনও মাথা থেকে সেই স্মৃতি গুলো বের করে দিতে পারছে না। জেগে থাকলে সবাই সামনে থাকছে যার ফলে ওসব কথাও ভুলে থাকছে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে মানুষের মন মস্তিষ্কের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ও না চাইতেও সেই বাজে দিনগুলো স্বপ্ন হয়ে ওকে তাড়া করছে। ভয়ের কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাবে। তবে সময় লাগবে। আর আপনাদেরও সাপোর্ট লাগবে। আপনারা যতটা পারবেন ওকে হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করবেন। ওর যাতে মন খারাপ না হয়। বা আপনাদের থেকে অবহেলা না পায়। এখন ওর মনের অবস্থা কেমন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। আপনারা ওর পরিবার। আপনাদের সাহায্যে ইলা খুব তাড়াতাড়িই সেড়ে উঠবে।”

ডাক্তার চলে যাবার পর সবাই একটা কথাই ভাবছে, ইলার এরকম মানসিক অবস্থায় ওকে নয়ন আর নক্ষত্রর বিয়ের কথা কীভাবে জানাবে? ইলা জানে তাদের বিয়ে হয়নি। সে পালিয়ে গেছে ভেবে যে নক্ষত্র নয়নকে বিয়ে করেছে এটা ইলা হয়তো ভাবতেও পারছে না।
চিন্তিত মুখে ইমন বলল,

—-ইলা যতদিন পুরোপুরি সুস্থ না হয়ে উঠে ততদিন ওকে কিছু না জানানোই ঠিক হবে। আগে ও সুস্থ হয়ে উঠুক তারপর নাহয় বুঝিয়ে বলা যাবে। এখন বললে ও নিতে পারবে না।”

ঝিনুক ইমনের কথায় সমর্থন করল।

—-হুম। ইলার যা পরিস্থিতি ওর উপর এত চাপ সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। আমাদের ওর খেয়াল রাখতে হবে। নইলে ইলা সহজে ওসব স্মৃতি ভুলতে পারবে না।”

পরের দিন নক্ষত্র এলে ইলা ওকে দেখেই কাঁদতে লাগল। নক্ষত্র ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। নক্ষত্র এটাও বুঝতে পারল ইলাকে কিছুই জানানো হয়নি। ইলা নক্ষত্রর হাত ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে নক্ষত্রর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

—-নক্ষত্র তুমি আমাকে এখনও ভালোবাসো তো? আমাকে তুমি ঘৃণ্য করো না তো? আমি পালিয়ে যাইনি। আমি তোমাকে ধোঁকা দিইনি। তুমি আমাকে ভুল বোঝো না। আমাদের বিয়ে তো হয়নি। তুমি আমাকে বিয়ে করবে না? বলো না নক্ষত্র। চুপ করে আছো কেন তুমি?”

নক্ষত্রর অস্বস্তি লাগছে। কী বলবে সে?

—-ইলা দেখো, অনেক গুলো দিন তুমি ছিলে না তার মাঝে অনেক কিছুই…

নয়ন এসে নক্ষত্রকে মাঝ কথায় থামিয়ে দিল। নক্ষত্র অসহায় ভাবে নয়নের দিকে তাকাল। নয়নের চোখ ছলছল করছে। বোঝা যাচ্ছে নিজেকে অনেক কষ্টে কান্না করা থেকে আটকে রাখছে।

—-আপু বাবা তোমাকে ডাকছে।”

—-নয়ন তুই নক্ষত্রকে বল না একটু, বিয়ের দিন আমি পালিয়ে যাইনি। ও যেন আমাকে ভুল না বুঝে।”

নয়ন মাথা নীচু করে চোখের পানি মুছল। ইলা নক্ষত্রকে ভালোবাসে। একসময় নক্ষত্রও বাসতো। নয়ন কীভাবে নিজের সুখের জন্য বোনের ভালোবাসা কেড়ে নিবে। অথচ তারা তিনজনই জীবনের এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে এখান থেকে কারো পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব না। আবার এগিয়ে গেলেও একজনকে না একজনকে তো কষ্ট পেতেই হবে।

নক্ষত্র নয়নের ঘরে এসেই ওর উপর রাগে ফেটে পড়ল।

—-আমাকে বলতে দিলে না কেন তারা?”

—-আপুকে এখন কিছু জানাবেন না। রাতে আপুর অবস্থা আপনি দেখেননি। ওর কষ্ট আমি আর বাড়াতে চাই না।”

ভ্রু কুঁচকে নক্ষত্র তীক্ষ্ণ চোখে নয়নকে দেখছে।

—-তার মানে? তুমি নিজেই তো দেখছিলে ইলা কী বলছিল। ও এখনও সেই আগের জায়গায়ই থেমে আছে।”

—-সেটা তো আপুর ভুল না। ও আপনাকে ভালোবাসে।”

—-অহ তাহলে তুমি বলতে চাইছ সব ভুল আমার। আমি কেন ইলার জন্য অপেক্ষা করলাম না। কেম তোমাকে বিয়ে করে নিলাম। এই তো!”

নয়ন কাঁদছে। নক্ষত্রর বিরক্তি আরও বাড়ছে।

—-কাঁদবে না একদম। চলো আমার সাথে। বাড়ি যাবে।”

—-না।”

—-না! না কেন? যাবে না তুমি আমার সাথে? কী চাইছো তুমি তারা? তুমি কী তোমার বোনের জন্য আমাকে ছেড়ে দিবে! অহ গড! তোমাকে এখন আমার অসহ্য লাগছে তারা। ইলার জন্য কষ্ট আমারও হচ্ছে। তাই বলে ওকে আমার বিয়ে করা সম্ভব? তুমি আমাদের মাঝে যেকোন একজনকে বেছে নাও। আর পারছি না আমি।”

নক্ষত্র রাগে গজগজ করছে। তার এখন মনে হচ্ছে এই মেয়ে তাকে ভালোই বাসে না। বাসলে বোনের দুঃখ দেখে তাকে ছাড়ার কথা ভাবত না।

—-তুমি কী চাও? আমাকে চাও তো!”

—-হুম।”

—-হুম না। স্পষ্ট করে বলো। নাকি তুমি মহান সেজে আমাকে আবার ইলাকে বিয়ে করতে বলবে। তা দুই বোন তো একসাথে ঘর করতে পারবে না। তুমি কি চলে আসবে?”

নয়ন শব্দ করে কাঁদতে লাগল। নক্ষত্র জানে নয়নের দুর্বল জায়গা কোনটা। নয়ন নক্ষত্রর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওকে মারতে মারতে বলল,

—-এত নিষ্ঠুর কেন আপনি? আপনার অনেক ইচ্ছে আমি চলে আসি! বারবার এই কথাগুলো কেন বলছেন? আমি বাড়ি যাব। সারাজীবন আপনার সাথেও থাকব। শুধু একটু সময় দিন। আপু সবটা মেনে নিক।”

—-ওকে না জানালে মানবে কীভাবে? এখনও তো কিছু জানাওনি। আগে তো চলো সত্যটা কী তা ইলাকে বলি।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here