নয়নতারা পর্ব ৩৫+অন্তিম

#নয়নতারা [৩৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

ইলা মেঝেতে বসে বাবার কোলে মাথা রেখে কাঁদছে। বাবা সযত্নে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। উনার চোখও ভেজা। ইলার পিঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে।

—-বাবা তোমরা কীভাবে ভেবে নিলে আমি পালিয়ে গেছি! তোমার মেয়ের উপর কি তোমার এটুকুও বিশ্বাস নেই! নয়নের সাথে এরকম হলে তুমি বিশ্বাস করতে পারতে নয়ন পালিয়ে গেছে? তাহলে আমার বেলায় তোমাদের এই অবিশ্বাস কেন এলো বাবা?”

বাবার মুখে কোন কথা নেই। উনি রাগ করে মেয়েকে খোঁজার চেষ্টা করেনি এটাই উনার সবথেকে বড় ভুল। এই অপরাধ বোধেই তিনি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছেন।

—-আমি নক্ষত্রকে ভালোবাসতাম বাবা। আমরা দু’জন কত কষ্ট করে বিয়েতে তোমাদের রাজি করিয়েছি। এত সবকিছুর পর আমি বিয়ে না করার জন্য পালিয়ে যাব! এটা ভাবতে পারলে তোমরা?”

ইলার কথা শুনে বাবা কয়েক মিনিটের জন্য স্থির হয়ে গেল। তিনি কি ভুল শুনেছেন? ইলা কী বললো একটু আগে? ভালোবাসা! ইলা নক্ষত্রকে ভালোবাসতো? মানে কী এসবের!

—-আমি তোর কথা বুঝলাম না রে মা। তোরা দু’জন আমাদের রাজি করিয়েছিস মানে? নক্ষত্রর মা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। ছেলে ভালো, পরিবার ভালো দেখে আমরা রাজি হই। তোদের মাঝে সম্পর্ক ছিল! কই আমরা তো কিছুই জানি না। কখনও তো বলিস নি।”

—-আমাদের পরিবারে তো কেউ ভালোবেসে বিয়ে করেনি বাবা। আমি যদি তোমাদের বলতাম আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করি, তাহলে হয়তো তোমরা মেনে নিতে না। সেই ভয়েই কাউকে জানাইনি। তবে ঝিনুক আপু জানতো।”

—-ঝিনুক জানতো!”

বাবা স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। উনারা নাহয় না জেনেই নক্ষত্রর সাথে নয়নের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু ঝিনুক সব জেনেও কিছু বলেনি! উনার দুই মেয়ের জীবন আজ একজন মানুষের জন্য নষ্ট হতে যাচ্ছে। নক্ষত্র এমন ছেলে ভাবতেই পারেননি তিনি। ঝিনুক নিজের বোনদের কথা একবারও ভাবলো না!
উনি কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ইলার মানসিক অবস্থা এমনিতেই ভালো না। আচ্ছা, নয়ন কি এসব জানে? না, আর কিচ্ছু ভাবতে পারছেন না তিনি।
নক্ষত্র, নয়ন এসে ইলাকে বাবার ঘরে দেখল। বাবা সামনেই আছে, এখনই ইলাকে সব কথা বলে দিলে ভালো হবে ভেবে নক্ষত্র বলতে যাচ্ছিল।

—-ইলা তোমার সাথে আমাদের কিছু কথা আছে।”

সবটুকু কথা বলার আগেই ইলার বাবা নক্ষত্রকে থামিয়ে দিলেন। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্র কিছুটা অবাক হলো। এই সহজসরল মানুষটার চোখ কখনও এরকম অশান্ত, রাগান্বিত, গম্ভীর দেখেনি সে। থমথমে গলায় তিনি বললেন,

—-ইলা মা তুই তারাকে নিয়ে বাইরে যা একটু। আমি নক্ষত্রর সাথে একা কিছু কথা বলতে চাই।”

ইলা মনে মনে ভাবছে বাবা হয়তো তার আর নক্ষত্রর বিয়ের কথা বলবে। যতই হোক, বিয়ের দিন ওরকম একটা ঘটনার জন্য তার কোন দোষ নেই। সে নক্ষত্রকে ধোঁকা দেয়নি।
নয়নতারা একবার নক্ষত্রর দিকে একবার বাবার দিকে দেখল। কী হয়েছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। বাবা নক্ষত্রর সাথে একা কী কথা বলবে?
নয়ন ইলার সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে নক্ষত্র শ্বশুরের উদেশ্যে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই তিনি নক্ষত্রকে চড় মেরে বসেন। রাগে রীতিমতো কাঁপছেন তিনি। নক্ষত্র হতভম্ব হয়ে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে রইল। কাঁপা গলায় তিনি বললেন,

—-আমার দুই মেয়ের জীবন নিয়ে খেলার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে?”

নক্ষত্র যা ভয় পাচ্ছিল হয়তো সেটাই হয়েছে। বাবা ইলার আর তার সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছে। ইলাই হয়তো বলেছে।

—-বাবা, আমার কথাটা অন্তত শুনুন।”

—-আর কী বলতে চাও তুমি? কী শুনতে বলছো আমাকে? কোন মেয়ের সুখ বেছে নেব আমি? আমাকে এই পরীক্ষায় কেন ফেললে তুমি হ্যাঁ। ইলা তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছিল। তুমি আমার মেয়েটার উপর ছিটেফোঁটাও বিশ্বাস করো নি। উল্টো আমাদের সবাইকে বোকা বানিয়েছ। আমাদেরকে তুমি তোমাদের সম্পর্কের সত্য জানাও নি। সব লুকিয়ে তুমি তারাকে বিয়ে করেছ! আমার ছোট মেয়েটাকে তো তুমি ভালো করে জানতেই না। ওকে কেন এসবের মাঝে টানলে?”

ঘনঘন মাথা দুলাতে লাগলেন তিনি। চোখ বুজে কিছু ভাবছেন।

—-বাবা নয়নতারাকে আমি সব বলে দিয়েছি।”

ঝট করে চোখ খুললেন তিনি। নক্ষত্রর দিকে তাকালেন।

—-বলে দিয়েছ!”

—-হ্যাঁ বাবা। নয়নতারা আমাকে বুঝেছে। এবার শুধু ইলাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।”

—-না। আমার কথা ছাড়া কাউকে কিছু জানাবে না তুমি। তুমি জানো ইমনের কানে এসব কথা গেলে ও কিছু বুঝতে চেষ্টা করবে না তার আগেই…

থেমে গেলেন তিনি।

—-তাছাড়া ইলাও এই মুহূর্তে এই নির্মম সত্য গ্রহণ করতে পারবে না। সময় দরকার। সময়। তার আগে তুমি আমার চোখের সামনে আসবে না। তোমার মতো স্বার্থপরকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিব না। আমার দুই মেয়ের থেকে এক মেয়েও যদি তোমার জন্য কষ্ট পায় তাহলে আমি তার জন্য তোমাকে চরম শাস্তি দিব।”

নক্ষত্রর নিজেকে অসহায় লাগছে। বাবাও তাকে ভুল বুঝেছে। পরিবারের সবাই তাকে ভুল বুঝবে। নক্ষত্রর কাছে নিজেকে কি কম অপরাধী লাগছে? সে কি কম অনুশোচনায় ভুগছে?
নক্ষত্র সেদিন কারো সাথে কোন কথা না বলে চলে যায়। ইলা নক্ষত্রকে খুঁজেও পায় না। নয়ন সাথে সাথে নক্ষত্রকে কল করে।

—-আপনি ওভাবে চলে গেলেন কেন? কী হয়েছে? বাবার সাথে আপনার কী কথা হয়েছে বলুন না।”

নক্ষত্র কণ্ঠস্বর যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,

—-কিছু হয়নি। জামাই শ্বশুরের পার্সোনাল কথা তোমাকে জানাব কেন?”

—-মজা না। প্লিজ বলুন বাবা আপনাকে কী বলেছে।”

—-তেমন কিছুই বলেনি।”

—-আপুকে নিয়ে কথা হয়েছে।”

—-ধরে নাও তেমনই। আচ্ছা তারা বাসায় ফিরেছি। রাখি এখন। পরে কল করব।”

নয়ন কিছুই বুঝল না। মানুষটার হঠাৎ করে কী হলো? তার সাথেও কথা বলতে চাইছে না। বাবা কি কিছু বলেছে?
সময় পার হওয়ার সাথে সাথে ইলাও স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। যতই ইলা সুস্থ হচ্ছে সে তার আর নক্ষত্রর বিয়ে নিয়ে চিন্তিত হচ্ছে। এখন তো সে সুস্থ তাহলে নক্ষত্র কেন নিজে থেকে বিয়ের কোনো কথা বলছে না? নক্ষত্র কি পাল্টে গেছে? হ্যাঁ নক্ষত্রর মাঝে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করেছে সে। ইলা নিজেকেই প্রশ্ন করে, কিছুটা নাকি অনেকটাই? নক্ষত্র বাড়ি এলেও তাকে এড়িয়ে চলে। তার সাথে আলাদা ভাবে একান্তে কথা বলে না। তার জন্য যে নক্ষত্র পাগল ছিল আগের সেই নক্ষত্রকে ইলা এখনকার নক্ষত্রর মাঝে খুঁজে পায় না। নক্ষত্র এমন কেন হয়ে গেছে? সে ফিরে আসার পরে একটা বার নক্ষত্র তাকে জড়িয়ে ধরেনি। তার মনের অবস্থা জানার চেষ্টা করেনি। এমন কেন করছে নক্ষত্র!

—-তুমি কি এখনও আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি নক্ষত্র? আমার কী দোষ ছিল বলো? আমি যদি জানতাম ওরকম কিছু হবে তাহলে কি আমি নিজেও বিয়ের দিন বের হতাম? তিনটা মাস আমি নরকের শাস্তি ভোগ করে এসেছি। আমার জন্য মায়া হয় না তোমার? তুমি এতটা কঠিন কীভাবে হলে?”

—-তারা আজ আমার সাথে যাবে তুমি। তুমি আমার বউ। তোমাকে নিয়ে গেলে কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না। আর বাধা দিলেও আমি কারো বাধা মানব না।”

—-কেন পাগলামি করছেন আপনি?”

—-পাগলামি আমি করছি! নাকি তোমরা করছো? নিজের বউকে কেন বাড়ি নিয়ে যেতে পারব না আমি? অনেক দিন হয়েছে, ইলা এখন সুস্থ। তুমি আজ এই মুহূর্তে আমার সাথে বাড়ি ফিরবে।”

নক্ষত্রর কাছে সবকিছু অসহ্য লাগছে। শ্বশুর মশাই রাগ করে বসে আছে। এদিকে তার বউও বোনের কথাই ভাবছে। তার কথা কারো ভাবার প্রয়োজন নেই। নয়ন নক্ষত্রকে শান্ত করার জন্য ওর কাছে এগিয়ে গেল। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখল। নক্ষত্রর রাগ আজ কমবে না। সে রেগে নেই। নিজেকে অসহায় লাগছে তার। ইলা এখনও তাকে নিজের প্রেমিক ভাবছে। অথচ নক্ষত্র এখন ইলাকে মোটেও সেই নজরে দেখে না। ইলা তার হাত ধরে, কাছে আসতে চায়। সেদিন তো জড়িয়েই ধরে ফেলেছিল। নক্ষত্রর বড় অস্বস্তি লাগে।

—-তারা তুমি তো আমাকে ভালোবাসো, তাই না? তাহলে চলো আমার সাথে। ইলা মেনে নিতে পারবে। ওর কষ্ট হবে এটা ভেবে কি সারাজীবন আমরা ওর থেকে এই সত্য লুকিয়ে রাখতে পারব? একদিন না একদিন তো ইলা জানবেই। তাহলে এখনই ওকে জানিয়ে দেওয়া ভালো না?”

নক্ষত্র নয়নের সাথে কথা বলার জন্য ওকে ছাদে নিয়ে এসেছিল। নক্ষত্র এখন এ বাড়িতে এলে নয়নের ঘরে গিয়ে বসতে পারে না। কারণ ইলা সন্দেহ করবে। আর তার থেকে বড় কথা ইলা তাকে টেনেটুনে নিজের ঘরে গিয়ে যায়। বাড়ির সবাই নক্ষত্রর উপর রেগে আছে। সবার মতে সে নয়নকে মিথ্যা বলে বিয়ে করেছে।
নয়ন আদুরে গলায় বলল,

—-ওসব কথা এখন রাখুন তো। কতদিন ধরে আপনি আমাকে আদর করেন না। আজ কতদিন পর আপনার বুকে মাথা রাখতে পারলাম বলুন তো। সেটাও আমি নিজে থেকে। আপনি তো রাগ দেখিয়েই সময় পান না। এখন আমাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন তো। তারপর গভীর, লম্বা একটা চুমু দিন। যেন সেই চুমুর রেশ অনেকদিন থেকে যায়।”

ঠিক তখনই পেছন থেকে ইলার গলা শোনা গেল।

—-নক্ষত্র!”
#নয়নতারা [৩৬]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

সিঁড়ির কাছে ইলার গলা শুনে নক্ষত্র নয়নকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল। ওরা ছাদের অন্ধকার পাশটায় ছিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ওদের দেখা যাবে না। এই পাশে এলে তবেই দেখতে পাবে। নয়ন ভয় পেয়ে গিয়েছে। সে ভেবেছে আপু হয়তো ওদের একসাথে ওভাবে দেখে ফেলেছে। কিন্তু আপু দেখেনি। নয়ন বুক ভরে দম নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।

—-নক্ষত্র! নক্ষত্র তুমি কি ছাদে?”

গলা পরিষ্কার করে নিয়ে নক্ষত্র জবাব দিল।

—-হ্যাঁ।”

—-অন্ধকারে একা একা ছাদে কী করছো তুমি?

ইলা ছাদে উঠে এই পাশটায় এসে দাঁড়াল। নক্ষত্রর সাথে নয়নকে দেখে বলল,

—-নয়ন তুইও এখানে। কী গল্প করছিস রে তোরা? অন্ধকারে কেন তোমরা? এদিকে এসো। আমি তোমাকে খুঁজছিলাম নক্ষত্র।”

—-তারার সাথে কথা বলছিলাম। কেন খুঁজছিলে?”

—-এমনি। দেখছিলাম না তোমায়৷ ভেবেছিলাম আজও না বলেই চলে গেলে।”

—-ইলা শোনো…

—-আপু চলো নিচে যাই। আপনিও আসুন।”

নয়ন নক্ষত্রকে বলতে না দিয়েই ইলাকে নিয়ে চলে গেল। নক্ষত্রর রাগ লাগছে। এ কোন পরিস্থিতিতে ফেঁসে গেছে সে!

নয়ন বুঝতে পারছে তার মাঝে কিছু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু কেন এই পরিবর্তন তা নয়ন ঠিক বুঝতে পারছে না। কী হয়েছে তার?
ইদানিং শরীরটা ভালো লাগছে না। সব কিছুতে কেমন দুর্গন্ধ লাগে। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠে।
সেদিন সবার সাথে খেতে বসেছে নয়ন। কিছুই খেতে পারছে না সে। ইমন একবার ধমক দিয়েছে।

—-ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছিস, খাচ্ছিস না কেন হ্যাঁ?”

নয়ন জোর করে খেতে চায়। কিন্তু তার বমি হয়ে যায়৷ মুখে হাত চেপে ধরে কোনোরকমে বেসিনে চলে আসে। গরগর করে বমি করে ফেলে। সবাই হতবাক হয়ে নয়নকে দেখছে। সবার মনে একটাই সন্দেহ হচ্ছে। নয়ন প্রেগন্যান্ট নয় তো? ইলা অবশ্য এমনটা সন্দেহ করেনি। সবার মাঝে সে-ই শুধু কথা বলল,

—-উল্টাপাল্টা খেলে এরকমই হবে। সন্ধ্যায় না করলাম এতগুলো আচার খাস না। উঁহু কে শুনে কার কথা। তারপর আবার একগাদা মরিচ দিয়ে লেবুর কী ঢঙ বানিয়ে খেয়েছে। এখন হলো তো! এজন্যই বলে বড়দের কথা শুনতে হয়, বুঝলি।”

ঝিনুক নয়নের সাথে আলাদা কথা বলতে আসে। একবার বমি করেই বেচারীর অবস্থা কাহিল। ঝিনুককে আসতে দেখে নয়ন মৃদু হাসে। ঝিনুক অন্য কথায় যায় না। সরাসরি জিজ্ঞেস করে,

—-নয়ন তুই কনসিভ করেছিস?”

—-না আপু। ওরকম হলে আমি বুঝতাম। আর তাছাড়া আমার তো পিরিয়ড মিস হচ্ছে না।”

—-তাহলে তখন যে সবার সামনে কাণ্ডটা করলি! সবাই তো এটাই ভাবছে, তুই মা হতে যাচ্ছিস।”

নয়ন হেসে ফেলল। বলল,

—-বাংলা সিনেমা দেখে দেখে কাউকে বমি করতে দেখলে বাঙালির মাথায় একটা কথাই আসে। অন্য কারণে কি বমি হয় না। বদহজম হয়ে গেছিল হয়তো।”

—-তবুও তুই একবার টেস্ট করিয়ে দেখ। খবরটা সত্যি হলে তো আলহামদুলিল্লাহ। না হলে শীঘ্রই এরকম একটা খুশির খবর শোনার অপেক্ষায় থাকব।”

—-ইলা আপু…

—-ওর চিন্তা তোকে করতে হবে না। তুই নিজের চরকায় তেল দে। ইলা অবুঝ শিশু না। ওকে বুঝতে হবে। আমি তোকে যেটা বলেছি সেটা কর তুই। রেজাল্ট পজিটিভ হলে নক্ষত্রকে জানা। বাবা, মা হওয়ার খুশি পৃথিবীর সব খুশির থেকে বড়। বেচারা তোকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে আছে। আমাদের বাড়ির মানুষ গুলো আজব। শুধু শুধু ও বেচারার উপর রাগ করে আছে। ওর পরিস্থিতি তখন যেমন ছিল তাতে যা ভালো মনে হয়েছে করেছে। এখন তো সব ঠিক আছে। তোকে নক্ষত্র কতটা ভালোবাসে তা কি ওদের চোখে পড়ে না!”

কয়েকদিন যাওয়ার পর নয়নের সত্যি সত্যিই মনে হতে লাগল ঝিনুক আপুর কথাই হয়তো ঠিক। তার নিজের ভেতর ছোট একটা প্রাণ এসে পড়েছে। সে সত্যিই মা হতে যাচ্ছে। নিজের ভেতর নতুন পরিবর্তন গুলো অনুভব করেও নয়ন শিওর হতে পারছে না। নক্ষত্রকে জানানোর আগে একবার শিওর হয়ে নেওয়া উচিত। নইলে যদি পরে গিয়ে দেখা যায় সবই ভুল।
নয়নের মনে সুখের দোলা লেগেছে। সে হাওয়ায় উড়ে সময় পার করছে। এত খুশি কোথায় ছিল এতদিন। মা হওয়ার অনুভূতি কতটা সুখের তা নয়ন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না।
তার টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। খুশিতে নয়ন প্রথমে কেঁদে ফেলেছিল। কিন্তু তার এই খুশি দীর্ঘস্থায়ী হলো না। নয়ন ঝিনুককে জানাতে গেলে ইলা তার ঘরে এসে প্রেগ্ন্যাসি কিটা দেখে ফেলে। ওটা পজিটিভ এসেছে দেখে ইলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। নয়নের ঘরে এই জিনিস কেন? নয়নের আচরণে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করেছে ইলা। কিন্তু সেগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে গেছে এতদিন। ভেবেছিল সে অনেকদিন পর বাড়ি এসেছে তাই হয়তো তার কাছে এমন মনে হচ্ছে। ইলা ওটা হাতে নিয়েই নয়নকে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

—-নয়ন। নয়ন, এদিকে আয় তুই। কোথায় তুই?”

ইলার ডাক শুনে মা ছুটে আসে। ইলা নয়নকে ডাকছে কেন? নয়ন নিজেও ঝিনুকের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। ইলার সামনে এসে দাঁড়াতেই ইলা নয়নকে চড় মারে।

—-কী করেছিস তুই নয়ন! এটা কী? আমাকে বল এর মানে কী?”

ইলা তার হাতের জিনিসটা নয়নকে দেখালো। আপু তাকে চড় মেরেছে! নয়নের চোখ পানিতে টলমল করে উঠল। মা এসে ইলাকে ধমক দিয়ে বলল,

—-কী হচ্ছে ইলা! নয়নকে তুই মারলি কেন? কী করেছে ও?”

—-কী করেছে! তুমি জিজ্ঞেস করছ কী করেছে তোমার মেয়ে? আমাদের মানসম্মান ডুবিয়েছে তোমার মেয়ে। আমি কখনও ভাবতে পারিনি আমাদের নয়ন এমন জঘন্য নোংরা একটা কাজ করবে।”

মা ইলার কথায় বিরক্ত হচ্ছে।

—-আহ, এত কথা না বলে এটা বল কী জঘন্য কাজ করেছে নয়ন।”

—-এই দেখো। তোমার মেয়ের ঘর থেকে এটা পেয়েছি। এর মানে কি তুমি নিশ্চয় জানো মা।”

মা অবাক চোখে নয়নকে দেখল। নয়ন কাঁদছে। সে কখনও কল্পনাও করেনি এই খুশির খবরটা সবাই এভাবে জানবে। মা গিয়ে নয়নকে বুকে টেনে নিল। চুমুয় চুমুয় নয়নের মুখ ভরিয়ে দিতে লাগল। ইলা হতভম্ব হয়ে মায়ের আচরণ দেখছে। মা নয়নকে কিছু না বলে ওকে আদর করছে! আশ্চর্য! এতবড় একটা ঘটনা ঘটেছে অথচ মা পাত্তাই দিচ্ছে না। ইলা ঝাঁঝিয়ে উঠল,

—-তুমি ওকে কিছু বলবে না মা!”

—-চুপ কর তুই। একদম চুপ। তোর একটা কথাও শুনতে চাই না আমি। আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার অধিকার কে দিয়েছে তোকে? তুই কোন সাহসে নয়নকে মারলি।”

—-তোমরা সবাই কি পাগল হয়ে গেছ মা! নয়নের এতবড় অপরাধ তোমরা দেখতে পারছ না। নয়ন প্রেগন্যান্ট মা। সমাজে কীভাবে মুখ দেখাব আমরা? এই খবর লোকজন জানতে পারলে আমরা বাড়ির বাইরে যেতে পারব? লোকে ছি ছি করবে না!”

—-আর একটা কথা বললে চড়িয়ে তোর দাঁত ফেলে দেব ফাজিল মেয়ে। না জেনে অত বড় বড় কথা বলতে কে বলেছে তোকে।
কাঁদিস না মা। কবে জেনেছিস তুই? আজই?”

নয়ন মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল। মা ফিসফিস করে বলল,

—-জামাই জানে?”

—-উঁহু।”

—-ওকে জানা। আসতে বল ওকে।”

ইলার হতভম্ব ভাব এখনও কাটছে না। মা মনে হয় শোকে পাগল হয়ে গেছে। উনার ছোট মেয়ে এমন কিছু করতে পারবে এটা মা’র ভাবনারও বাইরে ছিল। তাই ধাক্কাটা সহ্য করতে পারে না।

—-তুমি নয়নকে জিজ্ঞেস করো মা। কার পাপ ও পেটে…

ইলা কথা শেষ করার আগে মা ইলার গালে সজোরে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়। ইলা টাল সামলাতে না পেরে দু’পা পিছিয়ে যায়। মা ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

—-শয়তান মেয়ে, মুখ সামলে কথা বল। ফাজলামি শিখেছিস! কাকে কী বলছিস তুই। নয়নের বিয়ে হয়েছে। ওর সন্তান কারো পাপ হতে যাবে কেন? তোর দাঁত ফেলে দিব আমি বজ্জাত মেয়ে।”

—-নয়নের বিয়ে হয়েছে! কার সাথে? আমাকে তোমরা জানাওনি কেন? আমি তো কিছুই জানতাম না মা।”

—-তোর কারণেই তোকে জানাতে পারিনি। অনেক হয়েছে। আর লুকোচুরি না। আমার মেয়ের জীবনের সবথেকে খুশির দিনে তুই এমন একটা ঝামেলা করলি। সারাজীবন মনে থাকবে ওর।”

কলিংবেল বাজলে ঝিনুক গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে। নক্ষত্র ভেতরে ঢুকেই আকুল চোখে নয়নকে খুঁজে। নয়নকে কাঁদছে দেখে ছুটে আসে ও। সবার সামনেই নয়নকে জড়িয়ে ধরে। ঝিনুক ফোনে তাকে কথাটা জানানোর পর খুশিতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল ওর। কীভাবে সে এতটা পথ ছুটে এসেছে নক্ষত্র নিজেও জানে না। নয়নের চোখে পানি দেখে সে আর আশেপাশের কিছু খেয়াল করল না। ইলা হতবুদ্ধি হয়ে নক্ষত্রকে দেখছে। নক্ষত্র দু’হাতে নয়নের গাল ধরে নরম গলায় বলছে,

—-কী হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি? এই পাগলি, এই খুশির খবর জেনে কাঁদে কেউ? প্লিজ কাঁদে না।”

নক্ষত্র নয়নের চোখ মুছে দিয়ে কপালে গভীর চুমু খেল। নয়ন নক্ষত্রকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইলার আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। এখন সবই বুঝতে পারছে সে। এইজন্যই নক্ষত্র তাকে এড়িয়ে যেত। নয়নের সাথে অনেকটা সহজ হয়ে কথা বলতো। আগে এমনটা ছিল না। সেদিন ছাদেও ওরা দু’জন একসাথে ছিল। ঘনঘন নক্ষত্র এবাড়িতে আসত ঠিকই কিন্তু ইলার সাথে তার তেমন দেখাই হয়নি। ইলার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। নক্ষত্র নয়নকে বিয়ে করেছে। নয়ন নক্ষত্রর বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে। তার ভালোবাসার মানুষটা এভাবে হারিয়ে গেল! অনেক আগেই তার থেকে দূরে সরে গেছে। বাড়ির সবাই তার থেকে এই সত্য লুকিয়েছে।
বাড়ির পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে, ইলার জন্য কষ্ট পাবে নাকি নয়নের খুশিতে খুশি হবে কেউ বুঝতে পারছে না। ইলা তখন থেকে ঘরে দরজা দিয়ে বসে আছে। নয়নকে ঘিরে রেখেছে সবাই। নক্ষত্র একা একা বসে আছে। অনেকটা সময় পর
ইলা লাল টকটকে ফোলা চোখ নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
নক্ষত্র অপরাধ বোধে ইলার দিকে তাকাতে পারছে না।

—-ইলা আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।”

—-তুমি কেন ক্ষমা চাইছ নক্ষত্র? তুমি তো কোন অন্যায় করোনি। নয়নও করেনি। ওকে আমি ভুল বুঝেছি। আমার বোনটার জীবনের সবথেকে বড় খুশির দিনটা মাটি করেছি। আমি আর যাই করি, নিজের বোনের সুখের পথে আসব না। আসলে তুমি আমার ভাগ্যে লেখা ছিলে না। তাইতো বিয়ের দিন ওরকম হয়ে গেল। আমাদের তিনজনের জীবন নতুন মোড় নিল। কারো প্রতি আমার কোন রাগ অভিযোগ কিচ্ছু নেই। ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি আমি। তুমি শুধু আমার বোনকে সুখে রেখো। ওকে ভালোবেসো। বিশ্বাস কোরো ওকে।”

নক্ষত্র ভাবেনি ইলা তার বোনের সুখের জন্য নিজের মধ্যে কষ্ট গুলোকে লুকিয়ে রাখবে। ইলার মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পারছে নক্ষত্র। ভেতরে কষ্টে শেষ হয়ে গেলেও বাইরে কতটা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে ও। ইলার বড় মনের কাছে নক্ষত্রর নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। এটা ভেবেও স্বস্তি পাচ্ছে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। নয়ন আর তার মাঝে আর কেউ নেই এখন।

সমাপ্ত

নক্ষত্র আর নয়নের সুখের সংসার হলো।সব কিছু ভুলে নতুন করে শুরু করলো তারা তাদের ভালোবাসার ফসল প্রিয় সন্তানকে নিয়ে❤️

(যারা প্রতিদিন চমৎকার সব গল্প পড়তে চান তাহলে গল্পের শহর চ্যানেল ভিজিট করুন এবং সাবস্ক্রাইব করে রাখুন কারণ গল্পের ঠিকানা এবং গল্পের শহর ওয়েবসাইটের গল্প গল্পের শহর চ্যানেল ছাড়া আর কোথাও শেয়ার দেওয়া হবে না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here