১.
“একটু প্রেম দিবেন, ডাক্তার সাহেব? ভীষণ রকমের প্রেম? যে প্রেমে হৃদয়টা নাকানিচুবানি খাবে, সে প্রেম?”
ব্যস্ত রাস্তার মাঝে আসমানী রাঙা শাড়ি পরিহিতা রমনী’র এমন কথায় ভ্রু কুঁচকালো বর্ণ। পিছে তাকিয়ে সে অবাক। শ্যামবর্ণা নারী দাঁড়িয়ে আছে। সে চিনে না এই অপরিচিতা’কে। মেয়েটা তাকে এসব কথা কেনো বলছে!
বর্ণ অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘দুঃখীত! আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না। কে আপনি?’
বর্ণের কথায় রমনী কৌতুক হাসে। রিনরিনে কণ্ঠে আবার বললো,
-‘নীলাম্বরী। পথের ধারে থাকা দুর্বা ফুলের মতন আমি। ভীষণ অবহেলার দামী ফুল।’
বর্ণ অবাক হলো। মেয়েটার কী মাথায় সমস্যা আছে! ধূর,এত ব্যস্ত সময়ে এসব কী ভালো লাগে?
বর্ণের সামনে তখন রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সা চালকটা হেসে দিয়ে বললো,
-‘মামা,মামী তো খুইব সুন্দর কইরা কথা কয়। আফনি কী রাগ করছেন মামী’র উপর? থাক মাফ কইরা দেন মামীরে। ম্যালা সুন্দর কইরা কথা কয়।’
বর্ণ রিক্সা চালকের কথায় সাত আসমান থেকে পড়লো। সে বিষ্ময়মাখা কণ্ঠে কিছু বলার আগেই তার পাশে থাকা রমনী বলে উঠলো,
-‘হ্যাঁ মামা, উনার যে বড্ড রাগ। দেখছেন না,রাগ করে আমাকে চিনতেই পারছে না। তা মামা,তুমি রমনা যাবে? তোমার মামা’র সাথে একটু তোমার রিক্সায় ভ্রমণ করাবে?’
বর্ণের যেনো অবাক হওয়ার পালা শেষই হচ্ছে না। তার অবাক হওয়ার মাঝেই ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে রিক্সা চালক টা বললো,
-‘হ মামী,যামু তো। চলেন।’
কথা শেষ হতেই হুড়মুড় করে রিক্সায় চড়ে বসলো রমনী। উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বর্ণের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘চলে আসুন,ডাক্তার সাহেব। পথের ধারের দুর্বাফুলের সাথে ঘুরার সুযোগ সবার হয় না। চলুন চলুন।’
বর্ণ যেনো একটা ঘোরে চলে গেলো। কী হচ্ছে সেটা বোধগম্য হচ্ছে না বর্ণের। কিন্তু এমন একটা মুহূর্ত হাত ছাড়া করতে চাচ্ছেও না সে। দেখুক না, কী হয় আজ।
বর্ণ উঠে বসলো রিক্সায়। রিক্সার ড্রাইভারও বেশ আনন্দে রিক্সা চালানো শুরু করলো।
কাঠ ফাঁটা রৌদ্র পরিবেশে। তরতর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে, শরীরে শিরদাঁড়া বেয়ে। এই গরমেও লাল সাদা জামাকাপড় পড়া মানুষের অগণিতো মেলা রাজপথে। এইতো, আজ বাংলা নতুন সনের আগমন। পহেলা বৈশাখ বলা হয় যাকে। নতুন সনের আগমনে সবার রাজকীয় সাঁজ।
বর্ণের অন্যমনষ্কতার মাঝে তার পাশের রমনী ঠাট্টার স্বরে বললো,
-‘আপনার ভেতর কী একটুও রসকষ নেই? আজকের দিনেও হসপিটাল যাচ্ছেন? এত কাজ করে কী হবে? একদিন তো বউয়ের কথা’ই নাচতে হবে।’
বর্ণের যেনো আজ অবাক হওয়ার দিন। ভীষণ অবাক হতে হবে আজ, এমন প্রতিজ্ঞা করেছে কোথাও। মেয়েটার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই তার নিজেকে এলিয়েন এলিয়েন মনে হচ্ছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, মেয়েটার মাথা খারাপ! নাকি মাথাটা তার খারাপ!
রিক্সাচালক মামা হাসতে হাসতে বললেন,
-‘পরিশ্রম তো বেডা মানুষ গো করতেই হইবো। নাহয় বউয়ের শখ আহ্লাদ পূরণ করবো কেমনে? দেহেন না মামী,এই আনন্দের দিনেও রিক্সায় প্যাডেল ঘোরাতে হচ্ছে। নাহয় বউয়ের শখ পূরণ করুম কেমনে? আজকের দিনেও একটু ফুলের তোড়া, চুড়ি না দিলে হয় কন?’
বর্ণ এবার অবাক হলো না,বরং মুগ্ধ হলো। স্বামী হলে এত দায়িত্ব বুঝি এত সুনিপুণ ভাবে পালন করতে হয়?
বর্ণের ভাবনার মাঝে নীলাম্বরী বলে উঠলো,
-‘বাহ্,মামা। আপনি তো ফাটিয়ে দিছেন। মামী অনেক ভাগ্যবান।’
ঘামে সিক্ত হওয়া মানুষটা কেবল মাথা দুলালো।
এবার রমনী বর্ণের দিকে ধ্যান দিলো। ফিসফিস করে বললো,
-‘তা ডাক্তার সাহেব, এত ভদ্র হয়ে যে একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে একই রিক্সায় উঠেছেন, আপনার জাত যাবে না?’
বর্ণ এবার পূর্ন দৃষ্টি দিলো রমনী’র পানে। এমন অদ্ভুত মেয়ে সে দেখে নি। কেমন চঞ্চলতা ঘেরা মানুষ! মুখে যেনো সবসময় একটা হাসি ঝুলানো। আসমানী রাঙা শাড়ির সাথে খোপায় কত গুলো সাদা সাদা ফুল একসাথে গোঁজা। এ ফুল তো সবাই মাথায় দেয় না। বরং ভীষণ অবহেলায় পায়ে মূর্ছে যায়। কারণ এরা পথের ধারের দূর্বা ফুল। অযত্নে বেড়ে উঠে বলে কেউ এটার মর্যাদা’ই দেয় না। আবার মাথায় খুব যত্নসহকারে লাগবে! এ যেনো দিবাস্বপ্ন।
বর্ণকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীলাম্বরী ঠাট্টার স্বরে বললো,
-‘কী দেখছেন? আমায় খুব সুন্দর লাগছে বুঝি?’
বর্ণ দৃষ্টি সরালো। প্রশ্নটার উত্তর হ্যাঁ দিতে ইচ্ছে হলেও নিজের গাম্ভীর্যতা রক্ষা করে সে বললো,
-‘নাহ্। মোটেও না।’
-‘দূর্বা ফুল তো,অযন্তের জিনিস,সুন্দর না লাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দূর্বা ফুলও,ফুল। আর ফুল পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর সৃষ্টি। সেটা জানেন তো?’
বর্ন বুঝলো,তার কথার ভুল অর্থ বের করেছে রমনী। সে কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
-‘আপনি কীভাবে জানেন আমি ডাক্তার? আমার শরীরে তো সেরকম কোনো কিছু নেই যা ডাক্তারি’র পরিচয় বহন করে। আর আপনাকে আমি দেখিও নি এর আগে। তবে?’
-‘আপনি আমায় দেখেন নি বলে,আমিও যে আপনায় চিনিনা তেমনটা তো না, তাই না?’
বর্ণ বুঝলো, সে ভুল কথা বলেছে। এ রমনী পাগল না। তবে উন্মাদনা আছে। মাদকতা আছে তার হাসিতে। না চাইতেও মুগ্ধতা ভর করে।
ভাবনা’র মাঝে রিক্সা এসে পৌঁছায় রমনার সামনে। রমনী তার মুক্ত হাসি ঝুলিয়া রিক্সাচালক আর বর্নের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘আপনারা এই অধম নারীর জন্য পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবেন? এখানেই দাঁড়ান। আমি ছুটে যাবো আর আসবো।’
রমনীর কথার বিপরীতে কথা বলার সুযোগ পায় না তারা। শাড়ি পড়ে কী সুন্দর ছুটে যাচ্ছে সে। মনে হচ্ছে আকাশ যেনো। বর্ণ মনে মনে আওড়ালো,”আসমানী রঙে মানবী, আকাশ জেনো।”
টিংটিং করে ঘড়ির কাঁটা ঘুরে। রমনায় তখন উপচে পড়া ভীড়। কপোত-কপোতী, পরিবার,বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মেতে উঠেছে মানুষ। নতুন বছরের প্রথম দিন যেনো মানুষের মনে উল্লাস নিয়ে এলো। বর্ণেরও ভালো লাগছে এখন। নিত্য নতুন বাঁধা ধরা নিয়মের বাহিরে আজ আসতে পেড়েছে তাও ঐ রমনীর জন্য। কী যেনো নাম খানা? নামটা মনে পড়ার আগেই রমনী হাজির। হাত ভর্তি ফুলের তোড়া, চুড়ির প্যাকেট,আর ছোট্ট বেলী ফুলের মালা।
বর্ণ হা হয়ে তাকিয়ে রয়। কি হবে তা বুঝার জন্য। রমনী তার হাতের জিনিসপত্র গুলো রিক্সা চালকের দিকে এগিয়ে দিয়ে ঝলমলে কণ্ঠে বললো,
-‘এই নেন মামা,মামীর জন্য আপনার তরফ থেকে উপহার। এগুলো মামীকে দিবেন। আজ আর রাজপথে রিক্সায় প্যাডেল ঘোরাতে হবে না। মামীর সাথে বরং ঘুরতে বের হোন। আর মামা,সবাই আপনাদের মতন কিন্তু মিঙেল না। আমরা প্রেমে হাবুডুবু খেয়েও পিউর সিঙেল। তবে দোয়া করেন, আপনার মামী ডাকটার মান যেনো রাখতে পারি।’
রিক্সা চালক যেনো আকাশের চাঁদ পেয়ে গেলো। খুশিতে চকচক করে উঠলো তার মুখ খানা। কৃতজ্ঞতায় তার মুখের হাসিটা চওড়া হলো।
এবার মানবী তার হাতে থাকা বেলি ফুলের মালাটা পেঁচিয়ে দিলো বর্নের হাতে,ভীষণ যত্নে। পৃথিবীর দরকারী কাজ যেনো এটা। চারপাশের ভাবনা বাদ দিয়ে সে গভীর মনযোগ দিয়ে কাজটা শেষ করলো। তারপর বিশ্ব জয়ের হাসি হেসে বললো,
-‘নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রিয়,
মাঝে মাঝে খোঁজ নিও,
দূর্বা ফুল থাকে পথের ধারে
সবাই যারে পায়ে মারে,
তুমি নাহয় আগলে নিও,,
নতুন সনের শুভেচ্ছা প্রিয়।’
বর্ন যেনো একটা ঘোরের মাঝে চলে গেলো। ভ্রম ভাঙতে ভাঙতে রমনী মিশে গেলো বিশাল জনসমুদ্রের ঢেউয়ে। বর্ন ঠাঁই বসে রইলো। তার জেনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে সব। এবারের বৈশাখ প্রেমময় বৈশাখ। রঙিন বৈশাখ জেনো। রমনীর নাম জেনো কী ছিলো? ওহ হ্যাঁ,দূর্বা ফুল! পথের ধারের দূর্বা ফুল।
#পথের_ধারে_দূর্বাফুল
©মম
[