#পদ্ম_পাতার_জল
#পর্ব_১
#সাহেদা_আক্তার
#গল্প_কথার_ঝুঁড়ি
আশ্বিনের বাতাস বইছে। আজকে একটু বেশিই বইছে। আকাশের সাদা মেঘগুলো খুব দ্রুত এক দিগন্ত থেকে অপর দিগন্তের দিকে ছুটে চলছে বাতাসের তোড়ে। গাছের পাতাগুলো শির শির করে শব্দ করছে। এই শব্দটাই বেশ ভালো লাগে পদ্মের। সময় পেলেই একটা গাছের মোটা ডালটা বেছে নিয়ে ওটাতেই চড়ে বসে। তারপর চিৎ হয়ে চোখ বন্ধ করে বাতাসের সাথে গাছের পাতার শব্দ শুনতে থাকে। তার মধ্যেই শুনতে পেল ফরহাদ মিয়ার গলা। বাড়ির উঠোন থেকেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। প্রত্যেকদিনের কথা। শুনতে শুনতে পদ্মের অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রত্যেকদিন ওকে গাছে ওঠা নিয়ে একটা ছোটখাট বক্তৃতা শুনতে হয় পদ্মকে। সে নাকি মেয়ে মানুষ। মেয়ে মানুষের গাছে উঠতে নাই। তার উপর ও নাকি ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে গাছের ডালে শুয়ে থাকে। শুধু নাকি পড়ে হাত পা ভাঙার অপেক্ষা।
অনেকক্ষণ ধরে চেঁচামেচি শুনতে শুনতে পদ্ম নিজেই গাছ থেকে নেমে বাড়ির উঠানের দিকে রওনা দিল। যত এগিয়ে যাচ্ছে ততই ফরহাদ মিয়ার চিৎকারের শব্দ তত তীব্র হচ্ছে। পদ্ম যেতে যেতে ডানে বামে মাথা নাড়াতে নাড়াতে উঠোনে পা রাখল।
ফরহাদ- মেয়েটাকে কতবার বলেছি এমন দুরন্তপনা একটু কমা। কদিন পর ভার্সিটি উঠবি। কত বড় জায়গায় যাবি। সেখানে এমন দুরন্তপনা চলে না। মেয়েটা আমার কোনো কথা শোনে না। দিনে দুপুরে গাছে গাছে ঘোরে আর রাতে নাক ডেকে ঘুমায়। কি যে করি।
পদ্ম- ওহো, বাবা কয়দিন হল চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে এলাম। কাল রেজাল্ট দিবে। মনটা অস্থির অস্থির করছিল তাই বাইরে গিয়েছিলাম।
ফরহাদ- মা রে, যাই কর, আর এমন হুটহাট গাছে চড়ে বসিস না। জিনিসটা খারাপ দেখায়। গ্রামের সবাই শুধু বলাবলি করে এমন বড় মেয়ে যখন তখন শুধু গাছে চড়ে বসে। বিয়ের পর কি যে করবে।
পদ্ম- এমন হলে আমি বিয়েই করব না। কি করব বাবা, এই প্রকৃতিকে যে আমার ভীষণ ভালো লাগে।
ঘরের ভেতর থেকে শাপলা হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে বলল, বাবা, সবাই দেখবে বিয়ের রাতে বরকে নিয়ে আপু গাছের ডালে বাসর পেতেছে।
পদ্ম শাপলার কান ধরে জোরে মলতে মলতে বলল, ক্লাস এইটে উঠে বেশি পাকা হয়ে গেছো না?
শাপলা- উঁ, লাগছে। ছাড়ো না আপু। আচ্ছা আর বলব না।
পদ্ম ছেড়ে দিতেই শাপলা বলল, আপু, তোমাকে যে বিয়ে করবে তার কম টাকা খরচ হবে।
পদ্ম- কেন?
শাপলা- তুই তো প্রকৃতি কন্যা। তাই তুই ঘাস লতা পাতা ছাড়া কিছুই খাবি না।
পদ্ম- তবে রে।
শাপলা মাইর খাওয়ার ভয়ে দৌঁড়ে ঘরে চলে গেল। ফরহাদ মিয়া মেয়েদের কান্ড দেখে হাসতে লাগলেন। হাসি শেষে জিজ্ঞেস করলেন, তোর মা কইরে?
ভেতর থেকে শাপলা বলল, পাশের ঝিলে গেছে। শাপলা তুলতে। আজকে শাপলা ভাজি করবে।
ফরহাদ কিছু বলার আগেই একটা গামছা আর কাপড় নিয়ে পদ্ম ঝিলের দিকে ছুটল। ফরহাদ মিয়া কপাল চাপড়িয়ে বলল, কেন যে জিজ্ঞেস করতে গেলাম। মেয়ে আমার এবার ঝিলের দিকে ছুটল। ঐ ধুলার শহরগুলোতে যে কেমনে নিঃশ্বাস নিবে আল্লাহই জানে।
.
.
.
.
কাপড়গুলো ঝিলের পাড়ে রেখে পানিতে নেমে পড়ল। শরতের গরমে পানিটা বেশ লাগছে ওর। মরিয়ম বেগম অনেকক্ষণ ধরেই শাপলা নিচ্ছিলেন। পদ্ম এসে যোগ দিল। দুজনে মিলে বেশ অনেকগুলো শাপলা তুলল। শাপলা তোলা শেষে পদ্ম বলল, মা তুমি বাড়ি যাও। আমি গোছল সেরে একসাথে যাবো।
মরিয়ম- বেশিক্ষন থাকবি না। ঝিলে নামলে তো আর উঠতেই মন চায় না তোর। তাড়াতাড়ি চলে আসিস মা। আর এদিকে মানুষ চলাচলের রাস্তা। বাইরের মানুষের আনাগোনা বেশি। কখন কে কোনদিক থেকে এসে পড়ে।
পদ্ম- আচ্ছা বাবা। এখন যাও তো, ভেজা কাপড়টা ছেড়ে নাও। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
মরিয়ম বেগম হতাশ হয়ে ঘরে ফিরে এলেন। পদ্মের দশ মিনিট এক ঘন্টার সমান। সেটা উনি খুব ভালো করেই জানেন। মেয়েটাকে নিয়েই তার হাজার চিন্তা। চিন্তার ভীড়ে কিছুক্ষণ থেকে রান্নার কাজে লেগে গেলেন।
.
.
.
.
‘আজকের শাপলাগুলো অনেক ভালো ছিল। বেশ মোটা শোটা ডাটা গুলো। খেতে সেই লাগবে। আহা! শরতের বাতাসে ঝিলের পানিতে গোছল। এই আরাম কোথায় পাবো।’ পদ্ম নিজের মনে মনে বলতে লাগল আর হাসতে লাগল আপন মনে।
ঝিলের স্বচ্ছ পানিতে পদ্ম নিজের শাড়ির আঁচল খুলে খেলা করছে। বাচ্চাদের মতো আঁচলটা ঝাপটিয়ে পানিতে রেখে বাতাস ভরে নিয়ে ওটা দিয়ে দুষ্টুমি করছে। হঠাৎ গাড়ির শব্দে রাস্তার দিকে তাকাল। গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে একটা ঝিপ আসছে। তারসাথে কিছু ছেলেমেয়ের হইচই কানে আসছে। পদ্ম উৎসুক হয়ে ঝিল থেকেই উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল। জিপটা হঠাৎ ঝিলের সামনে এসেই দাঁড়ালো। পথটা ঝিল থেকে কিছুটা দূরে তাই পদ্মকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শাপলাগুলো নিজের রঙ বেরঙের পাপড়ির ডালা মেলে বসে আছে। তাই দূর থেকে ঝিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যা হোক, ঝিলের সৌন্দর্যেই হোক বা উৎসাহের কারণেই হোক, ছেলেমেয়ে গুলো জিপ থেকে নেমে এল। একটা ন্যাকা মেয়ে তার পাশে থাকা হিরো টাইপের ছেলেটাকে বলল, জানু, আমাকে ঐ শাপলাগুলো এনে দেবে?
ছেলে- আমি এখন ঐ কাঁদা জলে নামব?
মেয়ে- দাও না, প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
আরেকটা ছেলে বলল, যা না, ইয়াশ। তোর জানু যখন এতো করে বলছে।
ছেলেটার কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। ইয়াশ বিরক্ত হয়ে বলল, ধুর, এসেই পানিতে নামতে হবে! এজন্যই আসতে ভালো লাগে না।
মেয়েটা হঠাৎ কাঁদো কাঁদো ফেস করে বলল, তোমার জানুর জন্য এটুকু করতে পারবে না?
মেয়েটার পেত্নী মার্কা চেহারা দেখে পদ্মের খুব হাসি পেল। একে তো আটা ময়দা মেখে ভুত হয়ে আছে তার উপর এমন চেহারা করায় মেলার জোকার লাগছে। ইয়াশকে দেখে পদ্মের মায়া হল। ভাবল একবার নিজে গিয়ে কিছু শাপলা তুলে দেবে কি না। পরে ভাবল, থাক, যার কাজ সেই করুক। আমি মজাটা দেখি।
ইয়াশ বিরক্ত হয়ে ঝিলের দিকে এগিয়ে গেল। পদ্ম ওকে দেখে একটা ডুব দিল।
চলবে……