#পদ্ম_পাতার_জল
#শেষ_পর্ব_২৫
#সাহেদা_আক্তার
#গল্প_কথার_ঝুঁড়ি
রুমে ঢুকতে না ঢুকতে নতুন বউ এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে চোখের জলে নাকের জলে এক হয়ে গেছে। ইয়াশ ছাড়াতে গিয়েও থেমে গেল। এ কে?
– এতক্ষণ কেউ নতুন বউকে বসিয়ে রাখে? একবার ঘড়িতে দেখছো কটা বাজে?
ইয়াশ- তুমি এখানে।
– এখানে থাকব না তো কই যাবো?
ইয়াশ- কিন্তু …
– কি কিন্তু। বুঝেছি শাস্তি কম হয়ে গেছে। আরও লাগবে।
ইয়াশ গিয়ে লাইট জ্বালালো। পদ্ম কেঁদে কেঁদে চোখ নাক লাল করে ফেলেছে। ইয়াশ ওর কাছে এসে বলল, তুমি না তোমার বরের কাছে থাকার কথা। যে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আর তুমিও অনেক ভালোবাসো।
পদ্ম- চুপ। একদম বাজে কথা বলবা না।
ইয়াশ- বাজে কথা কই বললাম।
পদ্ম- আসলেই মিস্টার নেংটি ইঁদুর। মাথায় ঘিলু নাই।
ইয়াশ- কে বলেছে ঘিলু নাই। যদি আমার সাথেই বিয়ে দিবে তো এত নাটকের কি ছিল।
পদ্ম- তোমার শাস্তি।
ইয়াশ- আমি আবার কি করলাম।
পদ্ম- নিলা আপুর বিয়েতে যা করেছ তার জন্য আমি একটুও শান্তি পাই নাই। যেদিকে যেতাম সবাই হা করে তাকিয়ে থাকতো। লজ্জায় একেবারে শেষ হয়ে যেতাম। তাই ঐদিন সবাইকে বলেছিলাম যাতে কেউ না বলে কার সাথে আপনার বিয়ে হচ্ছে।
ইয়াশ- ও, তাহলে এই ব্যাপার।
পদ্ম- আমার কিছু জানার ছিল।
ইয়াশ- কি?
পদ্ম- আমি যখন প্রথম আপনাকে পুকুর পাড়ে দেখেছিলাম আপনি না চেনার মতো ভান করেছিলেন কেন? কেন আমার উপর রাগ দেখালেন?
ইয়াশ টেনে এনে ওকে বিছানায় বসাল। তারপর ওর কোলে মাথা রেখে বলল, তুমি আমার বন্ধুদের সামনে ওমন ভেজা গায়ে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? যতই হোক ওরা ছেলে। তোমার এটা একদম উচিত হয়নি।
পদ্ম- আমি কি ইচ্ছে করে করেছি নাকি? আপনার ঐ ন্যাকা জানু……
ইয়াশ- একদম জানু বলবে না। না পারতে সহ্য করতাম। ভালো লাগে না আর।
পদ্ম- আচ্ছা, বাবা। বলব না। কিন্তু মনিকা আর আকাশকে আর দেখলাম না যে।
ইয়াশ- ওরা বিদেশে চলে গেছে।
পদ্ম- কেন?
ইয়াশ- কারন ওরা জানে আমাদেরকে আলাদা করতে পারবে না।
ইয়াশ হঠাৎ ওর পেটের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। শাড়িটা সরিয়ে নাক ঘষতে লাগল। পদ্ম বলল, আরে কি করছেন। কাতুকুতু লাগছে। ধুর বাবা। সরুন সরুন।
ইয়াশ- কেন সরবো?
পদ্ম- আপনার আরও শাস্তি বাকি তো।
ইয়াশ- আরও।
পদ্ম- হুম। আমাকে যে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছেন তার শাস্তি হবে না?
ইয়াশ- আজ আর না। পরে সব পুষিয়ে দেব।
পদ্ম- আচ্ছা ঠিক আছে। এখন উঠুন।
ইয়াশ- কেন?
পদ্ম- নামাজ পড়তে হবে দুজনকে।
ইয়াশ উঠে বসল। দুজনে ওযু করে নামাজ পড়ে নিল। নামায পড়েই পদ্ম গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ইয়াশ ওকে জোর করে উঠে বসিয়ে বলল, শুয়ে গেলে যে?
পদ্ম- আমার ঘুম পাচ্ছে।
ইয়াশ- এখনও তো কিছুই করিনি।
পদ্ম- এই একদম না। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমান। একটু পরে আবার উঠতে হবে নামাজের জন্য।
পদ্ম আবার শুয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ইয়াশের জ্বালায় টিকতে পারল না। কাতুকুতু দিয়ে লাগল ওকে। পদ্ম অসহ্য হয়ে বলল, আচ্ছা, ঘুমাব না। এবার থামুন। মেরে ফেলবেন নাকি!
ইয়াশ- একদম এসব কথা বলবে না। এখনও বাচ্চা কাচ্চা হল না। বুড়া বুড়ি হইলাম না। তোমার সাথে হাত ধরে শেষ বয়সে সাগরে ঘোরা হল না। তার আগেই চলে যাওয়ার কথা বলছে।
পদ্ম- আচ্ছা বলব না।
ইয়াশ- সত্যি তো।
পদ্ম- হুম। সত্যি সত্যি সত্যি। এই এই……
পদ্মের ডায়রীটা বন্ধ করল পৌষী। চোখের পানির দুয়েক ফোঁটা টপটপ করে পড়ল ডায়রীটার উপর। আজান দিয়ে দিয়েছে ফজরের। নামায পড়তে হবে। কাঁথার তলা থেকে বের হয়ে গরম হয়ে যাওয়া টর্চটা টেবিলে রাখল। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে কাঁদল। বাইরে দরজায় আয়েশা আমানের গলা।
আয়েশা- দিদিভাই, আজান দিয়ে দিয়েছে। ওঠো দিদিভাই।
পৌষী ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল, উঠছি দাদুমনি।
পৌষী উঠে বসল। ওযু করে নামায পড়ে নিল। তারপর পুরানো বক্সটা ঘেটে আরেকটা জিনিস বের করল। একটা এ্যালবাম। এ্যালবামটা নিয়ে বারান্দায় চলে এল। বাইরে আলো ফুটছে। সেখানে চেয়ার টেনে বসল। খুলল এ্যালবামটা। প্রথমেই পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে একটা বড় বিয়ের ছবি। সাদা কালো। একটা শাড়ি পরা ছোট মেয়ে আর পাঞ্জাবী পরা একটা ছেলে। মেয়েটা ছেলেটার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। পৌষীর দেখে হাসি পেল। মনে মনে বলল, আমি যদি ঐ সময় থাকতাম তাহলে আব্বু আম্মুর গাল দুটো টিপে দিয়ে আসতাম। পুরা কিউটের ডিব্বা ছিল। হেসে পরের ছবি উল্টালো। একের পর এক স্মৃতি ঘেরা ছবি। পদ্মের স্কুলের ড্রেস পরা ছবি, কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে ফুসকা খাওয়ার ছবি, ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় ঘামে ভেজা মুখটার ছবি, ভার্সিটিতে প্রথমদিন যাওয়ার ছবি। সব ক্যামেরা বন্দি করে এই এ্যালবামে স্বযত্নে লুকিয়ে রেখেছে ইয়াশ। প্রত্যেকটা ছবি এক ফোঁটা পানি হয়ে পৌষীর চোখ থেকে ঝরতে লাগল। ছবি দেখা শেষ হলে এ্যালবামটা আবার ঢুকিয়ে বাক্সটা নিয়ে চুপিচুপি ইয়াশের রুমে আসল। ইয়াশ এখনও ঘুমে। পৌষী বাক্সটা আলমারীর উপরে রেখে রুম থেকে চলে যাওয়ার সময় ডাক পড়ল।
ইয়াশ- পৌষী।
পৌষী- হ্যাঁ, আব্বু। তুমি ঘুমাওনি?
ইয়াশ- কি করে ঘুমাব? আজকের দিনে কি আমার ঘুম আসে। পড়া শেষ?
পৌষী- না মানে……
ইয়াশ- কালকে বাক্সটা না দেখতে পেয়েই বুঝেছিলাম। কাছে আয়।
পৌষী ইয়াশের কাছে গিয়ে বসল। ইয়াশ হেলান দিয়ে বিছানায় বসেছে। পৌষীর মাথায় হাত রাখতে ও কান্না করে দিল। ইয়াশ ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ধুর পাগলী। কাঁদছিস কেন?
পৌষী- আমাকে না বাঁচালে কি হতো? আম্মু তাহলে আজ বেঁচে থাকত।
ইয়াশ- তুই চলে গেলেও যে তোর আম্মু মরে যেত।
পৌষী- আব্বু, আমার ভালো লাগে না আম্মুকে ছাড়া।
ইয়াশ- কে বলেছে তোর আম্মু নেই। তোর আম্মু তোর মাঝে বেঁচে আছে। আজকে না আমার পৌষী মনির পনের বছর হয়েছে। এখন তার কি চাই?
পৌষী- উম………আমার দুটো জিনিস চাই।
ইয়াশ- কি জিনিস?
পৌষী- আমাকে একটা গান শোনাবে আব্বু?
ইয়াশ কিছুক্ষণ চুপ করে বলল, যা গিটারটা নিয়ে আয়।
পৌষী গিটারটা নিয়ে এল। পদ্ম চলে যাওয়ার পর সব গান হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। আজ পনের বছর বাজানো হয়নি। তালটাও ভুলে গেছে। তবু যতটা পারল তা দিয়ে গান ধরল।
♪তোমার চোখে আঁকা স্বপ্নগুলো
আমায় ডাকে একাকী,
তোমায় ঘিরে লোখা গল্পগুলোয়
হঠাৎ ওড়ে জোনাকি।
আমার আকাশেতে মেঘেরা ওড়ে
হাসে ঝুম বর্ষায়
দূরের তারাগুলো থমকে থাকে পাহারায়……
তোমার ঠোঁটের ঐ মিষ্টি হাসি
কোথায় বলো হারিয়ে,
আমার মনটা মিছে বাজায় বাঁশি
ভুল সে মায়ায় জড়িয়ে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে
অভিমানী রাজপথ
চোখের কোণে জল লুকিয়ে থাকে আড়ালে……
কেন দুটো পথ, বেঁকে কেন দুদিকে জানি না
কেন দুটো পথ, অজানাতে হারালো জানি না।
কোথায় আছো আজ, কেমন আছো হায়, কেন দিশেহারা,
আমি পথের মাঝে একা থমকে দেখি আকাশটা।
সবই শূণ্য হয়, আবার পূর্ণ হয়, হয়ে পাগলপারা,
তুমি তোমার মতো করে বদলে দিলে শহরটা।
আমার চোখে আঁকা স্বপ্নগুলো জানি তোমায় ডাকে নীরবে,
আমায় ঘিরে সব প্রশ্নগুলো জানি মলিন হয়ে হারাবে।
তোমার আকাশে কি মেঘেরা ভাসে
কাঁদে ঝুম বরষায়
দূরের তারাগুলো থমকে আজও পাহারায়…♪
ইয়াশের চোখের কোণায় পানি জমলো। পৌষী চোখ মুছে গিটারটা নিয়ে আগের জায়গায় রাখল। ইয়াশ বলল, আর কি চাই?
পৌষী- আম্মুকে দেখতে যাব।
ইয়াশ- চল।
ওরা নিচে নামল। সোফায় মাহফুজ আমান বসে আছেন। করিম চাচা প্রেশার মেপে দিচ্ছেন। আজকাল বড্ড হাই প্রেশার থাকে। পৌষীর দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছো দিদি ভাই?
পৌষী- আম্মুকে দেখতে। দাদামনি, খালামনিরা আসবে না?
মাহফুজ- আসবে। ইরিনা আর ইনুর একটু টাইম লাগবে। লন্ডন থেকে রাত নয়টায় ফ্লাইট ছিল। রিনিও ফ্রান্স থেকে কাল রাতেই রওনা দিয়েছে। চলে আসবে।
পৌষী- ছোট ভাই বোন গুলারে যে কখন দেখব। চলো আব্বু।
ওরা বাড়ির পেছন দিকটায় গেল। ওখানে একটা ছোট পুকুর আছে। কোমর পর্যন্ত পানি। সেখানে একটা পদ্ম ফুটে আছে। পৌষী নেমে ফুলটা নিয়ে আনল। ইয়াশ বলল, তুই নামতে গেলি কেন? কাউকে একটা বলতাম।
পৌষী- কিছু হবে না। চলো যাই।
দুজনে পদ্মের কবরের দিকে এগিয়ে গেল। পুকুর থেকে কিছু দূরেই পদ্মের কবর। ওরা কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আশ্বিনের বাতাস বইছে। সেই বাতাসে পদ্ম থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে ভিজল কবরটা। ফুলটা কবরের পাশে রেখে দুজনেই দাঁড়িয়ে রইল। মনে হল এই বুঝি কেউ বাতাসে ফিসফিস করে বলবে, কেমন আছিস মা?
———————–সমাপ্তি
Ata kintu thik holo na sesh ta happy ending daoya utchit chilo tobuo bolbo valo hoyeche ☺☺☺
Very nice 👌👌…. but… ending এ কষ্ট পেয়েছি।