পদ্মপাতা পর্ব ২৯+৩০ ও শেষ

(২৯+সমাপ্তি পর্ব)

#পদ্মপাতা
#পর্ব-২৯
#লেখিকা-আনিকা_রাইশা_হৃদি

৮৫.
চাঁদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কি বলবে সে? কি বলার আছে?

-এই চাঁদ বল না। আলাদা করবি না।
-এসব কি করছেন আপনি? আপনি আমার বড়। তাছাড়া আপনি একজন সম্মানিত লোক এসব আপনাকে মানায় না। আমাকে ছোট করবেন না এসব করে।

আবির পা ছাড়েনা। বিড়বিড় করে,
“আমার কিছু চাইনা। ক্যারিয়ার, সম্মান, চাকুরী কিছু না। শুধু তোকে চাই। আমার দুইটা সন্তানকে চাই।”

চাঁদ আবিরের মাথা ছুঁয়ে দেখলো গরম। একেবারে হাত পুড়ে যাওয়ার মতো গরম। আবির তখনো জ্বরের ঘোরে বকবক করছে। চাঁদ দাড়োয়ান আনোয়ার চাচাকে ডাক দিয়ে বললো,
-চাচা, আমাকে একটু সাহায্য করেন দয়াকরে।

আনোয়ারের সহায়তায় আবিরকে ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো চাঁদ। আবিরের ভিজা কাপড় শুকিয়ে গিয়েছে। রত্না অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-ওঁর কি হয়েছে।

চাঁদ চোখের ইশারায় জানালো,
“পরে বলছি”

আবিরকে বিছানায় শোয়ানো হলো। পাশেই আহির আর মৃদুলা ঘুমাচ্ছে। আনোয়ারকে একশ টাকা দিয়ে ধন্যবাদ জানালো চাঁদ। তিনি খুশি হয়ে চলে গেলেন। আবির ঘুমিয়ে পড়েছে।

ড্রয়িং রুমে রাখা টিভি কেবিনেটের ড্রয়ারে থার্মোমিটার খুঁজতে ব্যস্ত চাঁদ। রত্না পিছনে এসে দাঁড়ালেন। চাঁদের কাঁধে হাত রাখলেন। চাঁদ ছলছল চোখে পিছনে তাকিয়ে কেঁদে দিলো।
-মা ওঁর গায়ে প্রচুর জ্বর মা। ও কেন এমন পাগলামি করছে মা। কেন আমার নরম জায়গায় আঘাত করছেন তিনি।
রত্না মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-এসব কথা বাদ দে এখন। ডাক্তার হাসানের নাম্বার আছে না?

চাঁদ মাথা নাড়ায়। যার মানে তার কাছে আছে। চাঁদ দৌঁড়ে এসে আবিরের জ্বর মেপে দেখলো ১০৩° ফারেনহাইট। তৎক্ষনাৎ ফোন লাগালো ডাক্তার হাসানকে। ডাক্তার হাসানের বলা ঔষধ আর আবিরের জন্য জামা আনতে চাঁদ বাইরে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে রত্নাকে বলে গেলো তিনি যেন আবিরের মাথায় জলপট্টি দেন।

৮৬.
রত্না মাত্রই জলপট্টি দেওয়া শেষে বেরিয়েছেন। আবির সেই যে চোখ বুজেছে আর খুলেনি। হঠাৎই বুকের উপর ভারী কিছুর অনুভবে ঘুম ভেঙে যায় তার। চোখ খুলে দেখতে পায় তার বুকের উপর একটা ছোট মেয়ে বসে। ঠিক যেন তার মতো দেখতে। গালগুলো ফোলা ফোলা। কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আবির ভেজা কন্ঠে ডাক দেয়,
“মা”
মৃদুলা কি বুঝলো কে জানে। আবিরের পুরো মুখে নিজের মুখের লালা ভরিয়ে দিলো। আবিরের নাকে কামুড় দিলো। গালে চার পাঁচটা আঁচড় দিলো। চুলে টান দিলো। অতঃপর খুশিতে গদগদ হয়ে ডাকলো,
-পাপা। পাপা।

আবির এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের মায়ের দিকে। ঠোঁটে তার হাসি। মেয়েটা কি তার মতো স্বভাব পেলো নাকি। নিজের গালে আরেকটা ছোট হাতের ছোঁয়া পেয়ে পাশ ফিরে তাকালো আবির। আহির চুপ করে বসে আছে। আবির ডাকলো,
“বাবা”
আহির আবিরের গাল ছুঁয়ে আবার হাত সরিয়ে নিলো।
-পাপা, গলম। তোমাল গাল গলম।

আবির ছেলের কথা শুনে মৃদু হাসলো। তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না এই দুইটা পুতুল তার। একদম নিজের। খুশিতে দুফোঁটা জল বেয়ে পড়লো তার চোখ দিয়ে।ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো,
-আমার বাবার নাম কি?
-আমাল নাম আহিল।

আবির অবাক। আহিল মানে কি আহির? তার নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে চাঁদ! মেয়েটা গাল ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
-পাপা, আমাল নাম শুনো। আমাল নাম শুনো।
আবির হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-আমার মায়ের নাম কি?
-মিদুলা।

বাবাকে কাছে পেয়ে দুষ্টুমিতে মেতে উঠলো ছোট দুই প্রাণ। একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো আবিরের বুকে। ডানপাশে ছেলে। বামপাশে মেয়ে। আবির দুজনের মাথায় ভালোবাসার পরশ দিয়ে বললো,
“আমার বাবা-মা। আমার কলিজা। আমার জান।”
তার ক্লান্ত শরীরেরও চোখ বুজে এলো।

চাঁদ ঔষধ আর আবিরের জন্য কেনা কাপড় নিয়ে ছুটে এলো বেডরুমে। আবিরের বুকের উপর আহির আর মৃদুলাকে দেখে চোখ যেন ভরে এলো তার। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি পৃথিবীতে আরেকটি আছে?
চাঁদ এগিয়ে এসে মৃদুলা আর আহিরকে কোলে নিয়ে অপর পাশে রেখে আবিরকে ডাকলো,
-এই যে শুনছেন। স্যার।

আবির চোখ খুলে তাকালে। চাঁদ বললো,
-এখানে আপনার জন্য টি-শার্ট আর টাউজার আছে৷ ঐ যে বাথরুম চেঞ্জ করে আসুন।

৮৭.
আবির কোনো কথা না বলে চুপচাপ চেঞ্জ করতে গেলো। জ্বরের কারণে মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে তার। চাঁদ বেরিয়ে আবার খাবার নিয়ে আসলো। আবির তখন খাটে বসে।
-স্যার আমি এখানে ঔষধ রেখে যাচ্ছি। খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবেন। আপনার কিছু হলে আপনার মা হয়তো আবার আমাকেই দোষ দিবে।

চাঁদ অন্যদিকে ফিরে কথাটা বলে বের হতে নিলে টান পড়লো তার বেণীতে। চাঁদ একটুও বিরক্ত হলোনা। একটুও না। তবে পিছনে ব্যাক্তিটিকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা। এই লোকটার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে চাঁদ। চাঁদ পিছনে ফিরে চোখ রাঙালো। আবির ভয়ে বেণী ছেড়ে দিলো। কি অদ্ভুত কিছু বছর আগেও মেয়েটা তার ভয়ে কাপঁতো আর আজ সে ভয় পাচ্ছে। বউ হলে সব মেয়েরা কি এভাবেই পাল্টায়?
আবির মুখ কাচুমাচু করে বললো,
-আমাকে তুই ক্ষমা করেছিস তো চাঁদ?
-সেটা বলতে পারবোনা। তবে আপনি এবাড়িতে চাইলেই আসতে পারবেন আহির-মৃদুলার পাপা হয়ে।
-চাঁদ আমার কথাটা শুন একবার।
-আপনি খেয়ে নিন।

চাঁদ আর দাঁড়ালো না। আবির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে খাবারের প্লেট টা হাতে নিয়ে দুই লোকমা খেলো। তবে তার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। হঠাৎ খাবার গলায় আটকে অদ্ভুত ভাবে কাশতে লাগলো আবির। চাঁদ পানি নিয়ে দৌঁড়ে এসে আবিরের পিঠে আলতো চাপড় দিতে দিতে বললো,
-দেখে খেতে পারেন না আবির ভাই?

আবির পানি খেয়ে খপ করে চাঁদের হাতটা ধরলো। অনর্গল বলে গেলো,
-চাঁদ বিশ্বাস কর। বিদেশ থেকে হঠাৎ জানতে পারি দাদি মারা গিয়েছেন আর তুই পালিয়েছিস। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। আমি দেশে আসি। তখন বাবা আমাকে অনুরোধ করলেন তোর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতে। মায়ের অনুরোধ, তোর চিরকুট, দাদির মৃত্যু, পারিপার্শ্বিক অবস্থা আমি হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম। কেন যেন বিশ্বাস টা করতে পারছিলাম না। তুই বিশ্বাস কর চাঁদ আমি ভালো ছিলাম না। আবির কি করে তার চাঁদকে ছাড়া ভালো থাকবে বল?
-আপনার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাহলে এই পাগলামি কেন? হাত ছাড়েন।

চাঁদ হাত ছাড়াতে চাইলো। আবির ছাড়লো না।

-আমি বিয়ে করিনি চাঁদ। আমি বিয়ে করিনি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর কখনো দেশে ফিরবো না। তবে মা আমাকে বাবার অসুস্থতার কথা বলে দেশে নিয়ে আসেন। দেশে এসে জানতে পারি সব মিথ্যা। মা আমাকে নিতির সাথে বিয়ে দিতে চান । আমি বারণ করে দেই। পরে মা আর চাচির কথোপকথন শুনে জানতে পারি আমার চাঁদ প্রেগন্যান্ট ছিলো। এইসব তাদের স্বরযন্ত্র। এসব জানার পর আমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসি। এই চাঁদ ক্ষমা করে দে। আমাদের কারোরই পরিস্থিতি অনুকূলে ছিলোনা।
-আমি এসব বিষয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাইনা। আমি তো আপনাকে আমার সন্তানদের বাবার স্বীকৃতি দিয়েছি।
-আমার যে তোকেও চাই।
-এতো সহজে সব ভুলে যাওয়া সম্ভব না।

চাঁদ ছুটে গেলো। আবির নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো। আবিরের মনে দৃঢ় বিশ্বাস তার চাঁদ তাকে একদিন অবশ্যই মেনে নিবে।

(চলবে)……

#পদ্মপাতা
#লেখিকা-আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৩০

৮৮.
চাঁদের সাথে সম্পর্ক ভালো না হলেও রত্না, আহির, মৃদুলার সাথে বেশ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আবিরের। ছেলে মেয়ে দুইটা তো বাবা বলতে অজ্ঞান। রত্নাও এই তিনমাসে কেবল আবিরের প্রশংসাই করে গেলেন। করবেন নাই বা কেন বাজার থেকে শুরু করে বাচ্চাদের প্রতিটা জিনিস, রত্নার ঔষধ সব কিছুর খেয়াল রাখে আবির। চাঁদের আগেচোরে চাঁদেরও। এসবের পাশাপাশি চাঁদের মনোযোগ আর্কষণেরও চেষ্টা করে তবে চাঁদ ভাবলেশহীন। আবির সকালে ভার্সিটি যাবার আগে আবার বিকালে ভার্সিটি থেকে ফিরে অনেক রাত অবধি বাচ্চাদের সাথে থাকে। বাচ্চারা ঘুমালে চলে যায়। নয়তো দুইটা কান্না করে ঘর মাথায় তুলে। মেয়েটা তো রণচণ্ডী। ঘুম থেকে উঠে তাকে না পেলে মুখ ফুলিয়ে হাত পা ছড়িয়ে কান্না করবে। পরে আবিরকে সামনে পেলে প্রথমেই নাকে একটা কামড় দিয়ে বুঝাবে সে রেগে আছে আর আবির একটা চকোলেট এগিয়ে দিলে সব রাগ শেষ। ছেলে আহির বরাবরই শান্ত, ভদ্র।
এই তিনমাসে আবির চাঁদের সাথে কথা বলতে চেয়েছে, রাগ ভাঙাতে চেয়েছে তবে চাঁদ সেসব পাত্তাই দেয়নি।

এই তো সেদিনের কথা ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে প্রচুর বৃষ্টির মুখোমুখি হয়েছিল চাঁদ। আবির গাড়ি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো, উঠতে বলেছিলো তবে চাঁদ বৃষ্টির মাঝেই গটগট করে হেঁটে বাসায় ফিরেছে। আবিরের রাগ লেগেছিলো প্রচুর। এতো জেদ কেন মেয়েটার? সে তো ভুল স্বীকার করেছে।

আবির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ অভিমানীনির অভিমান ভাঙাবেই। বাচ্চাদের নিয়ে রত্না গিয়েছেন পাশের বাসায়। সেখানে আহির-মৃদুলার সমবয়সী রাহির জন্মদিন। চাঁদ বাসায় একা। আবির এই মাত্রই এসেছে। সে এখন সোফায় বসে আছে। রত্না আগেই আবিরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তারা বাসায় থাকবে না। আবির যেন নিজের অভিমানীনির অভিমান ভাঙায়। আবির অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। একটা মানুষ এতো ভালোও হয়? রত্না কেবল বলেছিলেন,
“আমি আমার মেয়ের সুখ দেখতে চাই।”
চাঁদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে গোলাপ গাছটার পাতা ছাঁটাই করছিলো। আবির পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো চাঁদকে। ঘটনার আকস্মিকতায় চাঁদ স্তব্ধ, হতভম্ব। অদ্ভুত এক অনুভূতি বিরাজ করছে তার মাঝে। স্তম্ভিত ফিরে চাঁদ কাঁপা কন্ঠে বলে,
-স্যার, কি.. কি করছেন এসব। ছাড়েন।

আবির চাঁদের ঘাড়ে মুখ গুঁজে বললো,
-উঁহু।

চাঁদের ঘাড়ে নরম স্পর্শে ভরিয়ে দিতে লাগলো। চাঁদের সমস্ত শরীরে বয়ে যাচ্ছে শিহরণ। কিছুক্ষণ পর চাঁদ আবার বলে,
-স্যার, এসব কি? ছাড়েন আমায়।

আবির মুখ তুলে পকেট থেকে একটা চেন বের করে তা চাঁদের গলায় পরিয়ে বললো,
-আমার পটরপটর রাণী আমার সাথে কথা না বললে যে আমার বুকটায় ব্যথা লাগে। সে কেন বুঝে না।
-সে বুঝতে চায় না।

চাঁদকে নিজের দিকে ফিরালো আবির। চোখে চোখ রেখে বললো,
-আর কখনো অবিশ্বাস করবো না। আর কখনো হাত ছাড়বোনা। আর কখনো কষ্ট দিবোনা। ক্ষমা কি করা যায় না?
-জানিনা।

আবির দুষ্টু হেসে বলে,
-জানিস না।
-না।
-ঠিক আছে।

আবিরের অধর ছুঁয়ে দেয় চাঁদের অধর। চাঁদ প্রথমে ছটফট করলেও আস্তে আস্তে অনুভব করে সে স্পর্শ। কিছুক্ষন বাদে চাঁদকে ছেড়ে দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে আবির বলে,
-এখনও জানিস না?

চাঁদ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলে,
-বেশরম, বেহায়া।
-শুধু তোমারই জন্য।

৮৯.
চাঁদকে কোলে তুলে নিলো আবির। চাঁদ আবিরের বুকে মাথা রাখলো।এতো শান্তি কেন এই জায়গাটায়! আবির দুষ্টু হেসে বললো,
-কে যেন আমার সাথে রাগ করেছিলো। সেই আমার বুকেই মাথা রাখলো তো।

চাঁদ আবিরের বুকে কয়েকটা কিল দিয়ে মাথা উঁচিয়ে চোখ রাঙালো। আবির ঢোক গিলে বললো,
-এভাবে তাকানোটা কবে শিখলি বলতো। ভয় লাগে তো আমার।

মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো চাঁদ। আবিরও প্রশান্তির হাসি হাসলো। যাক অবশেষে হরিণীর অভিমান ভাঙলো। হঠাৎ কি মনে হওয়ায় আবিরের কোল থেকে নামতে চাইলো চাঁদ। আবির বিরক্তির সুর তুলে বললো,
-এতো ছটফট করছিস কেন তুই?
-আপনি একদম আমার সাথে কথা বলবেন না। গিয়ে আপনার ছাত্রী সুমাইয়াকে কোলে নিন।
-কে সুমাইয়া? আমি কেন ওকে কোলে নিবো?
-ন্যাকা, যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা। খুব তো হা হা হি হি করছিলেন ওঁর সাথে।

আবির প্রথমে না বুঝলেও পরে ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই বাঁকা হেসে বললো,
-পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি।
-আমার বয়ে গেছে।
-হুমম। সব বুঝি। ও আমাকে তোর ঠিকানা দিয়েছিলো। তাই ওকে সেদিন ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম। এক মিনিট তুই দেখলি কিভাবে? তুই তো আমার দিকে তাকাতিও না।
-জানিনা।
– জানতে হবেনা। চল তোকে আজ ভালোবাসার ব্যাখা শিখাবো।
– আপনি আসলেই বেশরম।

সেদিন আবিরের ভালোবাসার ছুঁয়ায় চাঁদের রাগ, অভিমান সব ভেঙে গিয়েছিলো। ভালোবাসার মানুষটির সামনে কি এতো রেগে থাকা যায়?

________________
পেরিয়ে গেলো তিন বছর। দীর্ঘ আট বছর পর চৌধুরী বাড়িতে পা রেখেছে চাঁদ। একদিন নিস্তব্ধ এক সন্ধ্যায় এই বাড়ি থেকে পালিয়ে নিজের অনিশ্চিত জীবনের দিকে পা বাড়িয়েছিলো সে। আজ আবার রাজরানীর বেশে স্বামীর হাতে হাত রেখে সন্তানদের নিয়ে এই বাড়িতে প্রবেশ করেছে সে। মতিনের অনুরোধে আসা। মোহনা এগিয়ে আসলেন চাঁদের কাছে। ডাকলেন,
-চাঁদ।
-জ্বি।
-আমাকে ক্ষমা করে দে মা।
-এভাবে বলবেন না। আমি আপনাকে ক্ষমা করতে না পারলেও আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।

করিম, মতিনও ক্ষমা চাইলো চাঁদের কাছে।নিতি বিকালে এসেছিলো তার স্বামীকে নিয়ে।নিজের এক কলিগকে বিয়ে করেছে সে।চাঁদের সাথে অনেক কথা হলো তার। দিমা এখন মেন্টাল হসপিটালে। বিয়ের পর চারবার বাচ্চা মারা যায় তার। সেই কষ্টে আজ সে মানসিক ভারসাম্যহীন। তবে তিলোত্তমা সেই আগের মতো। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কখনো পরিবর্তন হয় না। তিনিও সে দলেই পড়ে। হয়তো একদিন তার পাপের শাস্তি সে পাবে। চাঁদ আনোয়ারার ঘরে ঢুকে প্রচুর কাঁদলো। চাঁদের জীবন বাঁচিয়ে আজ তিনি নেই। জীবন সত্যি অদ্ভুত। আহির-মৃদুলা তো সারাবাড়ি মাথায় তুলে রাখলো। দাদা-দাদি পেয়ে তারা ভিষণ খুশি। মৃদুলা এই নিয়ে দশবার মতিনের সাদা দাঁড়িগুলো টেনে দিয়েছে। মোহনার চোখ ভরে আসে। তিনি সেদিন চাঁদের কথা শুনলে হয়তো আজ এতো কিছু হতো না। তার ছেলেও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো না।

৯০.
স্নিগ্ধ আকাশে হাজারো সাদা মেঘেদের ভেলা। চারিদিকে বাতাস বইছে মৃদু। দূর থেকে উত্তাল পদ্মার ঢেউয়ের ডাক শোনা যাচ্ছে। দুইটা টিয়ে পাশের গাব গাছটায় বসে টোকর টোকর করে গাব খাচ্ছে। বিকালের এই আবহাওয়া যেকোনো প্রেমিক যুগলের মন কাড়বে।

সবুজ শাড়ি পরিহিতা চাঁদ সবুজ পাঞ্জাবি পরিহিত তার প্রেমিক পুরুষের কাঁধে মাথা রেখে ধুরী দিঘীর বাঁধানো ঘাটে বসে আছে। তার কোলে মেয়ে মৃদুলা ঘুমাচ্ছে আর আবিরের কোলে ছেলে আহিরও ঘুম। সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত তারা। এখন বসে ধুরী দিঘীর সৌন্দর্য উপভোগ করছে। মেয়েকে সবুজ শাড়ি পরিয়েছে আর ছেলেকে পাঞ্জাবি। এতো সুন্দর লাগছে পুতুল দুইটাকে।

ধুরী দিঘীতে প্রচুর পদ্মফুল ফুটেছে। সবুজের মাঝে সাদা, হলুদ, গোলাপীর মিশ্রণে ফোটা ফুলগুলোকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। চাঁদ আবিরের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
-আমি যেন আপনার কি আবির ভাই?

আবিরও ফিসফিসিয়ে বললো,
-তুই আমার পদ্মপাতা রে চাঁদ।

চাঁদ আবিরের ডান হাতটা নিয়ে তার পেটে রাখলো। আবির চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে প্রথমে চেঁচিয়ে পরে আস্তে আস্তে বললো,
-সত্যি।

চাঁদ লজ্জায় মাথায় নিচু করে হুমম বললো। আবির খুশিতে চাঁদের কপালে ভালোবাসার পরশ দিলো। পরে মেয়ে আর ছেলের কপালে।

এভাবেই মান-অভিমান, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পালা শেষে আজ তারা সুখী। বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে চাঁদ আপন করে পেলো তার আবির ভাইকে। আবির পেলো তার হরিণী তার প্রেয়সীকে। পূর্ণতা পেলো তাদের ভালোবাসা।

(সমাপ্ত)….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here