অনুভূতির অন্বেষণ পর্ব -০১

—-যেই মেয়েকে মাঠভর্তি মানুষের সামনে প্রত্যাখান এবং অপমান করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মেয়েকেই আজ নিজের জীবনসঙ্গিনী রূপে কামনা করতে আপনার সম্মানে বাঁধছে না মিস্টার আরিয়ান?

—-তখন সম্মানে বেঁধেছিলো বলেই যে আজ অনুভূতিরা মরে গিয়েছে। সেই অনুভূতি যা আমার সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের জন্য জাগ্রত হয়নি।

—-তাহলে আজ সেই অনুভূতি আবার জীবিত করতে এলেন যে?

—-জীবন বাঁচিয়ে রাখতে কিছু স্বর্গীয় এবং সুখকর অনুভূতির জীবিত থাকা খুব প্রয়োজন মিশরাত। এভাবে যান্ত্রিক জীবনযাপন আমি আর করতে পারছি না। হাঁপিয়ে গিয়েছি।

—-এতোদিন মৃত ছিলেন বুঝি?

—-শুধু অক্সিজেন আর কার্বনডাইঅক্সাইডের আদান প্রদানের মাধ্যমে যদি মানুষ জীবিত থাকতো, তাহলে সুখ দুঃখ প্রকাশ করার মতো তার মধ্যে কোনো আলাদা ক্ষমতা থাকতো না। যেমন উদ্ভিদের নেই। প্রাণ আছে, কিন্তু সুখ-দুঃখের অনুভূতি প্রকাশের উপায় নেই।

—-তো এখন আমার কাছে আসার কারণ?

—-অনুভূতির অন্বেষণ।

—-আর আপনি আসলেই যে আমি আপনাকে গ্রহণ করে নেবো সেটা আপনি ভাবলেন কী করে?

—-তোমার করতে হবে মিশরাত।

—-আমি বাধ্য নই। শুনেছেন আপনি? আমি বাধ্য নই। এই ঝড়বৃষ্টির রাতে লিফট দেওয়ার কথা আপনি আমাকে এজন্য বলেছিলেন? এসব বলার জন্য? আমি তো আপনার গাড়িতে উঠতে চাইনি। আপনার অনুনয় করা দেখে উঠেছি। কিন্তু একবার উঠেছি বলে যে আমি আর নামবো না, সেই আশা করবেন না। চুপচাপ গাড়ি চালাতে পারলে চালান। নয়তো আমাকে বলে দিন, আমি নেমে যাচ্ছি। আপনার এসব কথা এখন আমাকে বলা আর উলুবনে মুক্ত ছড়ানো একই কথা। আপনার এসব কথা শুনে আমি গলে যাবো না।

আরিয়ান আর কিছু বললো না। চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলো।

—-তোমার বাসা কোথায় সেটা ঠিকঠাক মতো বললে না তো এখনো?

—-আমাকে আপনার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া লাগবে না। আপনি শুধু আমি যেখানে বলেছি সেখানে নামিয়ে দিন। বাকিটা পথ আমি যেতে পারবো।

—-আমি তো তোমাকে একা ছাড়ছি না। একে তো রাত এগারোটা বাজতে চলেছে প্রায়। তার উপর তুমুল বৃষ্টি নেমেছে।

—-জীবনের মাঝ রাস্তায় যখন ছেড়ে দিয়েছিলেন তখন আপনার বিবেকে বাঁধেনি। আর এখন এই রাস্তায় ছাড়বেন না বলে আমাকে বলছেন?

—-আমি অনুতপ্ত মিশরাত।

—-আপনার অনুতপ্ত হওয়া না হওয়া দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না মিস্টার আরিয়ান।

—-হয়তো। কিন্তু তোমার নিরাপত্তার কথা তুমি না বললেও আমি ভাববো।

—-কীসের নিরাপত্তা?

—-তোমার জীবনের আর সম্মানের।

—-সেসব ভাবার জন্য আমার জীবনে আরও কেউ না কেউ আছে। আপনার না ভাবলেও চলবে।

—-কেউ আছে মানে? কে আছে?

—-আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো অধিকার আপনার নেই।

—-তুমি ব্যক্তিটাই তো আমার। তাহলে সেই জীবনের উপর আমার অধিকার নেই এটা বলছো কীভাবে?

—-নিজের মুখের কথায় লাগাম টানুন। আমি আপনার কেউ হই না। আর না আপনি আমার কেউ হন।

—-যেই কাজ আমার পাঁচ বছর আগে করার কথা ছিলো, তা পাঁচ বছর পরে করতে চাইছি। এটাই তো তোমার রাগের কারণ?

—-আপনার এটা মনে হয় কীভাবে যে আপনাকে আমি জীবনে এতোটুকুও গুরুত্ব দেই যে আপনার উপর রাগ করে থাকবো? আপনার উপর রাগ নিয়ে বসে থাকার মতো সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই।

—-তোমার না খুব ইচ্ছে ছিলো আমার সাথে বৃষ্টি বিলাস করার? পরিবেশটা কিন্তু দারুণ! চলো না বৃষ্টিতে ভিজি?

—-গাড়ি থামান।

—-অ্যাঁ?

—-গাড়ি থামান নয়তো আমি চিৎকার করবো।

—-এতো রাতে তোমার চিৎকার শোনার জন্য কে আসবে বলো তো ময়নাপাখি?

—-এসব উদ্ভট নামে আমাকে আর কখনো সম্বোধন করবেন না। খবরদার বলছি! আর আমার সাহসের পরীক্ষা নেবেন না। আমি পাঁচ বছর আগের সেই বোকা আর ভীতু মিশু নই যে একটা টিকটিকি দেখে আপনার কাছে ভয়ে দৌড়ে চলে যাবো। আমার সাহসের পরীক্ষা নিতে যাবেন না। প্রয়োজন হলে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দেবো। এরপর হাত-পা ভাঙ্গবে না থাকবে সেটা পরে দেখা যাবে।

—-একটু স্বাভাবিক হও না মিশরাত আমার সাথে, প্লিজ?

—-শেষবারের মতো বলছি। গাড়ি থামান।

—-এখান থেকে তুমি কোথায় যাবে? বোকা সাহস দেখিও না। তোমার জন্য গাড়ি থামবে এখন একটাও? কোনো বাস দেখতে পাচ্ছো তুমি? বা সিএনজি? রিকশা তো এই ঝড়ের রাতে চলবেই না।

—-ওই যে বললাম, আমার জন্য আপনি ছাড়াও অনেকে আছে?

—-তোমার জীবনে কে আছে আর কোন ধরনের সম্পর্ক নিয়ে আছে তা আমি জানি না। জানতেনও চাই না। কিন্তু এতোটুকু মাথায় রেখো, আমার স্থান অন্যকেউ দখল করতে আসলে আমি তাকে ছেড়ে দেবো না।

—-আমার জীবনে আপনার কোনো স্থানই নেই। দখলের কথা এখানে আসছে কোথা থেকে?

—-তুমি আমাকে ভালোবাসো মিশরাত।

—-একটু শুধরে নিন। বাসতাম। সেটা আমার অপরিপক্ক আবেগ ছিলো যেটা আমি অনেক আগেই ভুলে গিয়েছি। আর বর্তমান নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সামনে আগাচ্ছি। সেখানে আরিয়ান হক নামে কেউ নেই।

—-তাহলে কে আছে?

—-সেটা আপনাকে বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না। আর আপনি একজন বাইরের লোক হয়ে আমার অভ্যন্তরীন বিষয়ে নাক গলাতে আসবেন না।

—-আমি তোমার বাইরের লোক মিশরাত? তুমি না আমাকে বলেছিলে যেহেতু তোমার কোনো ভাই নেই তাই তোমার বাবার পরে শুধু একজন পুরুষ তোমার জীবনে থাকবে আর সেটা আমি?

—-ঠিক তাই। বলেছিলাম। অতীত কাল সেটা। কিন্তু এখন আমরা কেউ অতীতে নেই। বর্তমানে আছি তাই বর্তমানের সাথে চলতে ভালোবাসি। অতীতকে বহুদিন আগেই অতীতের জায়গায় ফেলে এসেছি। পুরোনো শহর, পুরোনো মানুষ, পুরোনো স্মৃতি— সবকিছু ছেড়ে নতুনভাবে বাঁচতে শিখেছি। যেখানে শুধুমাত্র কাউকে একটু মনের কথা জানাতে গেলে চরিত্র নিয়ে বা পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে কথা উঠে না।

—-মিশরাত, আর কতোবার বলবো আমি দুঃখিত?

—-আপনার সুখ-দুঃখ দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। ঠেকায় পড়ে আপনার গাড়িতে উঠেছি শুধুমাত্র কোনো গাড়ি আশেপাশে দেখিনি বলে। আর আপনি এটার ফায়দা লুটছেন তাই না?

—-ফায়দা কোথায় লুটলাম আমি!

—-আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন কেন তাহলে? আপনি বুঝতে পারছেন না যে আমি কথা বলতে আগ্রহী নই আপনার সাথে?

—-ঠিক আছে, তোমার কথা বলতে হবে না। আমাকে তোমার বাসার ঠিকানা দাও।

—-মানে? বাসায় গিয়ে আপনার কী কাজ?

—-সেটা তোমার এখন জানা লাগবে না।

—-আপনি এই শহরে কী করছেন বলুন তো? যতোটুকু আমি জানি আপনার এই শহরের সাথে তো কখনো কিছু নিয়ে সম্পর্ক ছিলো না। না কোনো কাজের সূত্রে আর না কোনো নিকট আত্মীয় আছে এখানে। তাহলে এখানে কেন? আর আমার বাসা খোঁজার আপনার কী দরকার পড়লো?

—-সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু একজনই। যে এখন আমার পাশে বসে আছে।

নিজেকে ভেতর থেকে আরেকটু শক্ত করে তুললো মিশরাত।

—-আমি আপনাকে শেষবারের মতো, আই রিপিট, শেষবারের মতো বলছি গাড়ি থামান।

—-আমিও তোমাকে একবার, আই রিপিট, একবার যেহেতু বলেছি নামতে দেবো না তার মানে দেবো না।

মিশরাত বুঝতে পারলো আরিয়ান তার সাথে মজা করছে। নিজের ভেতরের রাগটাকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলো না মিশরাতের পক্ষে। গাড়ির দরজা খোলার জন্য সবেমাত্র হাত বাড়িয়েছে, এর মধ্যেই তাড়াতাড়ি গাড়ি থামালে আরিয়ান। মেয়েটা কী সত্যি সত্যি গাড়ি থেকে লাফ দেবে নাকি!

গাড়ি থামানোর পর একবার আরিয়ানের দিকে এক পলক তাকিয়ে সাথে সাথে গাড়ির দরজা খুলে ব্যাগের ভেতর ফোন ঢুকিয়ে ছাতা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল মিশরাত। আরিয়ান তার উপর এখনো নজর রাখছে। খুবই ক্ষীণ বেগে গাড়ি চালাচ্ছে যাতে মিশরাতের পেছন পেছন যেতে পারে। মিশরাত সেটা লক্ষ্যও করেছে। কিন্তু পাত্তা দেয়নি। একসময় তীব্র অবহেলা সহ্য করেছে সে। তখন এই মানুষটির সেই বিষয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিলো না। এবার বুঝুক, যখন নিজে কারোর থেকে অবহেলা পায় তখন কেমন লাগে।

বৃষ্টির বেগ প্রবল হওয়ায় সামনে আগানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। তবুও মিশরাত আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কারণ বাসায় তো পৌঁছাতে হবেই। প্রায় বিশ মিনিট পর আরিয়ান দেখতে পেল একটি ছেলে ছাতা নিয়ে মিশরাতের দিকে দৌড়ে আসছে। মিশরাত এবং ছেলেটা দু’জনই ভিজে গিয়েছে। শুধু মাথায় পানি পড়েনি। নয়তো কাঁধ থেকে শুরু করে প্রায় পুরো শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে গিয়েছে।

—-একটু আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারলে না? এতো তাড়াহুড়ো করার কী দরকার ছিলো?

—-আরে আমি কী নিজের ইচ্ছায় করেছি নাকি? পার্টি শেষ, সবাই যার যার মতো চলে যাচ্ছিলো বাসায়। আমাকে দু একজন অফার করলো যদি খুব বেশি সমস্যা থাকে তাহলে তাদের বাসায় যেতে। তুমি তো জানোই আব্বু কেমন। আমাকে রাতে অন্য কোথাও থাকতে দেবে ভেবেছো? তাই তোমার অপেক্ষা করতে করতে আর না পেরে বাধ্য হয়ে আসতেই হলো।

—-এতোটা রাস্তা আসলে কীভাবে? হেঁটে?

—-না। একজন লিফট দিয়েছিলো।

—-ছেলে না মেয়ে?

—-ছেলে। কেন?

—-ভবিষ্যতে এই কাজটা আর কখনো করবে না। এভাবে রাত-বিরেতে বৃষ্টি বাদলের সময় অচেনা অজানা কোনো ছেলে থেকে লিফট নেওয়ার পরিণতি কতোটা ভয়াবহ হতে পারে তুমি জানো?

—-আচ্ছা, আর করবো না এমন।

—-কিন্তু তুমি লিফট যদি নিলেই, তাহলে একেবারে বাসা পর্যন্ত কেন গেলে না? এখানে নেমে গেলে যে? সত্যি করে বলো তো, ওই ছেলে উল্টো পাল্টা কিছু করার চেষ্টা করছিলো না তো তোমার সাথে? তুমি পালিয়ে আসোনি তো?

—-আরে না রে বাবা। তুমি অহেতুক চিন্তা করছো। বাসায় চলো। আমি তোমাকে সব শুরু থেকে বুঝিয়ে বলছি।

—-ঠিক আছে। বাসায় গিয়েই বলো তবে। এমনিতেও এখন যতো দ্রুত পা চালিয়ে বাসায় পৌঁছা যায় ততোই মঙ্গল।

এতোক্ষণ যাবত মিশরাত আর তার সাথে থাকা ছেলেটির প্রতিটা কথা আরিয়ান শুনেছে। মাথা এখন ভনভন করছে তার। যার তার উপর ভরসা করার মতো মেয়ে তো মিশরাত নয়। যার তার সাথে রাতের বেলা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বাসায় যাওয়ার মতো মেয়েও সে নয়। বিশেষত যদি সেই মানুষটা হয় কোনো ছেলে। আবার বলছে ছেলেটার সাথে পার্টিতে ছিলো? মিশরাত তাহলে এখন পার্টিতেও যায়? তবে কী মিশরাত কে সে হারিয়ে ফেললো? তার আসতে কী খুব বেশি দেরি হয়ে গেল? ততোদিনে কী মিশরাত অন্যকারোর হয়ে গিয়েছে?

রাগে আর চিন্তায় নিজের হাতে নিজেই কামড় দিচ্ছে আরিয়ান। এটা তার একটা অদ্ভুত অভ্যেস। যখন রাগ এবং চিন্তার সংমিশ্রণ ঘটে এবং দু’টোই সীমা অতিক্রম করতে নেয়, তখন নিজেকেই নিজে শারীরিকভাবে কষ্ট দিতে শুরু করে সে। কখনো কামড়িয়ে তো কখনো খামচিয়ে। সব থেকে ভয়ংকর হলো যদি তখন সামনে আঘাত করার মতো কোনো বস্তু থাকে তখন সেটা দিয়েও নিজেকে আঘাত করে দ্বিধাবোধ করে না। এইটা দেখে সেই ছোট্ট মিশু কতোটা ভয় পেয়েছিলো সেদিন! অদ্ভুত শোনালেও এটাই সত্য যে, যার অভ্যেস দেখে ভয় পেয়েছিলো আবার তার কাছেই ছুটে গিয়েছিলো ভয় নিবারনের জন্য। অথচ সেদিন আরিয়ান কী জঘন্য ব্যবহারই না করেছিলো মিশরাতের সাথে!

রাগ হচ্ছে, প্রচুর রাগ হচ্ছে। মিশরাতের ওই ছেলের সাথে এতো কথা কীসের হ্যাঁ? এমনটা তো হতে পারে না। মিশরাত এই পাঁচ বছরের ব্যবধানে তাকে ভুলে অন্যকারোতে মত্ত হতে পারে না। আরিয়ান সেটা হতে দেবে না। সহজ উপায়ে কিছু না পেলে তা ছিনিয়ে আনতে জানে সে। কিন্তু, মিশরাত আবার বিবাহিত না তো? যদি শুধু একটা সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে মিশরাতের সাথে ওই ছেলের ব্যাপারটা তবে ঠিক আছে। আরিয়ান যে করেই হোক মিশরাতকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনবেই। কিন্তু যদি বিয়ে হয়ে যায় তখন!

কামড়ে কামড়ে দু’হাত লাল করে ফেলেছে আরিয়ান। রক্ত বের হওয়ার উপক্রম। হয়তো রক্ত বের হলেও সে থামতো না। কিন্তু থামতে হলো হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায়। স্ক্রিনে স্পষ্ট অক্ষরে একটা নাম ভেসে উঠেছে “আরাভ”।

(২)

কলিংবেল বাজার প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে দিলেন একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। উনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এতোক্ষণ উনি একটা জায়গায় শান্ত হয়ে বসতে পর্যন্ত পারেননি। চিন্তার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়ে কোমায় চলে যাওয়ার মতো অবস্থা। মিশরাতকে দেখামাত্রই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে একটা প্রসস্থ হাসি দিলেন।

—-তুই আর সাদমান দু’জনের দেখি একই অবস্থা। একেবারে প্রায় আপাদমস্তক ভিজে ফিরেছিস। তোদের আসতে এতো সময় লাগলো কেন? আর মিশু, তুই ফোন ধরিসনি কেন? দেখ তো কতোগুলো ফোন দিয়েছি আমি?

—-আম্মু, বাইরের অবস্থা দেখেছো? তুফান শুরু হয়েছে। এরমধ্যে হেঁটে হেঁটে ফোন ধরা যায়? ফোনে কথা বলা যায়?

—-হেঁটে হেঁটে মানে? তুই কী সারা রাস্তা হেঁটেই এসেছিস? সাদমান, গাড়ি ছিলো না তোমাদের সাথে?

—-আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি আন্টি। আসলে পার্টি থেকে আমি আর মিশরাত একসাথেই ফিরতাম। কিন্তু এরমধ্যে আমার আরেক কাজ পড়ে বসলো৷ আমার চাচা চাচি আজকে আসছেন আমাদের বাসায়। আম্মু ফোন করে বললো যাতে উনাদের বাসায় দিয়ে আসি। তাই মিশরাতকে বলে আমি গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম। ভেবেছিলাম চাচা চাচিকে পৌঁছে দিয়ে এসে আবার গাড়ি নিয়ে পার্টিতে চলে গিয়ে মিশরাতকে নিয়ে বাসায় ফিরবো। কিন্তু বিধি বাম! গাড়ি গেল নষ্ট হয়ে। আর কী করার! সিএনজি পাচ্ছিলাম না। নিলাম একটা রিকশা। সেটাও এই বৃষ্টির মধ্যে আগাতে পারছিলো না। পরে হেঁটে হেঁটে আগাতে লাগলাম। এরমধ্যে মিশরাতের দেখা পেয়ে গেলাম। তো চলে এলাম বাকিটা পথ এভাবেই দু’জনে।

—-ভালোয় ভালোয় ফিরতে পেরেছো সেটাই অনেক আল্লাহর রহমতে। তুমি মিশুর সাথে আসা-যাওয়া করো বলেই একটু চিন্তামুক্ত থাকতে পারি। তোমার আংকেল থাকে না এখানে। দু’টো মেয়ে নিয়ে আমি একা একটা মহিলা। বুঝতেই তো পারো আমার চিন্তার কারণ। এখনকার যুগে রাস্তাঘাটে মেয়েদের নিরাপত্তা তো নেই বললেই চলে। তুমি আমাদের সাথে একই ফ্ল্যাটে থাকো, মিশরাতের সাথে একসাথে কাজে যাও আবার ফিরে আসো, এটাতে যে কতোটা উপকার হয় আমাদের!

—-আন্টি, এভাবে বলে আমাকে ছোট করো না প্লিজ। আমি তো তোমার ছেলের মতোই।

—-হ্যাঁ, তা আর বলতে!

কথাটা বলার পরপরই একটা হাসি দিলেন মহিলাটি এবং হাসতে হাসতে মাথা নত করে ফেললেন। তার কারণ এখানে উপস্থিত আরও বাকি দু’জন মানুষ বুঝতে পারলো। বুঝতে পেরেই মিশরাত আর সাদমান একে অপরের দিকে তাকালো। এরপর একসাথে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো দু’জনে। মিশরাত মুখাবয়বে কিছুটা বিরক্তি ছাপিয়ে বললো

—-আম্মু, দেখছো দু’জন মানুষ বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে আছি। কোথায় এখন তাড়াতাড়ি যে যার মতো জামাকাপড় পাল্টে ফ্রেশ হবো, তা নয় তুমি এখনো আমাদের দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে আজকে সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি কী হয়েছে আর কী হয়নি তার উপর ছোটখাটো গবেষণা চালিয়ে দিয়েছো। তোমার একটু মর্জি হলে আমি কী রুমে যেতে পারি? সাদমান কী নিজের বাসায় যেতে পারে?

মহিলাটির মুখটা শুকনো হয়ে গেল হঠাৎ এর মধ্যেই। উনাকে দেখে এখন মনে হচ্ছে এতোক্ষণ যাবত কথা বলে যেই সময়টুকু উনি নষ্ট করেছেন তার জন্য আগাগোড়া তিনি অনুতপ্ত। উনি আর কিছু বলবেন তার আগেই মিশরাত বললো

—-সাদমান, কালকে কী কাজে যেতে হবে? আমি নোটিশ পাইনি এখনো। তুমি শুনেছো কিছু?

—-হ্যাঁ। বস না করে দিয়েছেন। যেহেতু আজকে এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গিয়েছে সকলের বাসায় পৌঁছাতে। আর আজকে তো এমনিতেও সেলিব্রেশন পার্টি ছিলো। বস এর খুশি মুখ দেখোনি? উনাকে দেখে তো মনে হচ্ছিলো বুঝি ডিল ফাইনাল হয়নি, বরং নতুন করে আরেকটা বিয়ে করছেন!

অনুচ্চ স্বরে হাসলো মিশরাত।

—-আচ্ছা, গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আগামীকাল ছুটি তো কী হয়েছে। এরপরের দিন থেকেই তো আবার কাজ। ঠান্ডা লেগে গেলে পরে আবার সমস্যা হবে।

মিশরাত সাদমানকে বিদায় বলে চলে গেল। সাদমানও মিশরাত মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল হাসিমুখে।

(৩)

—-পাগলের প্রলাপ বকিস না আরিয়ান। তুই মিশরাতকে ফিরিয়ে দিয়েছিলি। তুই মিশরাতকে অপমান করেছিলি। মেয়েটা বয়সের তুলনায় মানসিকভাবে ততোটা পরিপক্ব ছিলো না। ইমোশন বেশি কাজ করতো। তাই তোর প্রতি তার ভালো লাগার অনুভূতি সকলের সামনে প্রকাশ করেছিলো। এখন পাঁচ বছর পর তোর মনে হলো মিশরাতকে তোর লাগবে? আরে শালা আমাকে একটা ফোন তো করতে পারতি যে কোথায় আছিস। তুই তো জানিস যে আংকেল আন্টি মনে করে তোর আমি বন্ধু কম বরং পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট বেশি। উনারা ভাবে যে তোর সকাল, বিকেল, দুপুর, রাত সবসময়কার খবর আমি একেবারে হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে থাকি। আমাকে একের পর এক ফোন দিয়েই যাচ্ছে তোকে না পেয়ে। আন্টি কতোটা অসুস্থ তুই তো জানিস। বলা নেই কওয়া নেই কোথায় চলে গেলি সেটা কেউ জানে না। এখন বলছিস মিশরাত কে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিস? পাগল তুই? ওই মেয়ের কী মান সম্মান বলে কিছু নেই যে এতো অপমানের পর আবার ঢেঙ ঢেঙ করতে করতে তোর কাছে চলে আসবে? তার উপর বলছিস সে রিলেশনে আছে এমনকি বিয়েও করে নিতে পারে। হ্যাঁ, এটা হতেই পারে। অসম্ভব কিছু না। সে যেমন আছে তাকে তেমন থাকতে দে। গিয়েছিলি তাকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সে তার জীবনে এগিয়ে গিয়েছে। তাহলে তার ব্যক্তিগত জীবনে আর না ঢোকাটাই ভালো। তুই তোর মতো থাক, তাকে তার মতো থাকতে দে।

ভিডিও কলে কথা বলছে আরিয়ান আর আরাভ। আরাভ সম্পর্কে আরিয়ানের শুধু বন্ধু হলেও আসলে তা নয়। বরং দু’জন একে অপরকে নিজের ভাইয়ের থেকেও বেশি ভাবে। এতোক্ষণ আরিয়ান আরাভকে মিশরাতের সাথে যা যা কথা হয়েছে সব বলেছে। আর সেগুলো শুনেই আরাভ উপরের কথাগুলো বলেছে। কিন্তু কথাগুলো বলার পর আরাভের মনে হলো এই একটা কথাও আরিয়ান কানের তলেও নেয়নি। বরং তাকে দেখে আরাভের মনে হচ্ছে যে সে খুব গভীর চিন্তায় মগ্ন।

—-আরে ওই! আমি তোকে কিছু বলছি তো? কোন দিকে তাকিয়ে কী ভাবছিস বল তো?

—-যদি মিশরাত বিবাহিত হয় তাহলে আমি কী করবো? এরপর যদি মনে কর তার বাচ্চাকাচ্চাও থাকে! না, না। এতো তাড়াতাড়ি এতদূর মিশু আগাবে না।

—-বাচ্চাকাচ্চা বাদ দে। এমনকি বিয়েও বাদ দে। মিশরাত যদি স্রেফ একটা সাধারণ সম্পর্কেও কারোর সাথে জড়িয়ে পড়ে তাহলে চুপচাপ যেভাবে গিয়েছিস এই শহর ছেড়ে, ঠিক তেমনভাবে চুপচাপ চলে আয়।

—-নিজের পছন্দের কিছু নিয়ে আমি কখনো কম্প্রোমাইজ করিনি সেটা তুই ভালো করেই জানিস। যা আমার তা আমি অন্যকে চাইলেই দিয়ে দেবো এরকম মানুষ না আমি।

—-একদম না! আমি তোকে সতর্ক করে দিচ্ছি কিন্তু আরিয়ান। ভুলেও জোরাজোরি করতে যাবি না। জোর করে কিছু পাওয়া যায় না। আর তুই এতো স্বার্থপরের মতো কথা বলছিস কী করে? নিজে ভালো নেই দেখে এখন মেয়েটার কাছে গিয়ে তাকে বিরক্ত করবি?

—-আমি প্রচন্ড রকমের স্বার্থপর জানিস তো? নিজে ভালো থাকার জন্য আমি সব করতে পারি?

—-কেন? এখন তোর ভালো থাকার জন্য মিশরাতকে কেন প্রয়োজন? এখন তোর আত্মগরিমা কোথায় গেল? এখন তোর তথাকথিত গার্লফ্রেন্ড কোথায় গেল? এখন কেন সেই মেয়েটার পেছনে ছুটে এসেছিস যাকে একসময় পারিসনি একেবারে পায়ের তলায় পিষে ফেলার মতো মনোভাব ছিলো?

ফোন কেটে দিলো আরিয়ান। চোখের সামনে নিজের অন্যায়গুলো ক্ষণে ক্ষণে ভেসে উঠছে। আফসোস করা ছাড়া আর এখন কিছুই করার নেই। খুব ইচ্ছে হয় সেই সময়টাতে ফিরে যাওয়ার। নিজের করা ভুলগুলো তখন শুধরে নেওয়ার। কিন্তু সময় যে থেমে থাকেনি।

(৪)

পার্টিতে ডিনার সেরে এসেছে বলে বাসায় এসে আর খাওয়া লাগেনি। ফ্রেশ হয়ে সরাসরি বিছানায় চলে গিয়েছে মিশরাত। চোখে ঘুম নেই এখন। কিন্তু একটু ক্লান্তিভাব আছে। মোবাইল হাতে নিয়ে আজকের পার্টিতে তোলা কিছু ছবি দেখছিলো মিশরাত। এরমধ্যেই পেছন থেকে কেউ একজন এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। সেদিকে না তাকিয়েই মিশরাত জিজ্ঞেস করলো

—-পরীক্ষা কেমন হলো?

—-বেশ ভালো। ফুল আন্সার করেছি। আর পরীক্ষার পর বই আর শীট মিলিয়ে দেখেছি। সব ঠিক আছে।

—-আজকেই শেষ পরীক্ষা ছিলো না?

—-হুম। এখন কিন্তু আমার আবদার পূরণ করতে হবে আপু। তুই বলেছিলি পরীক্ষা সবগুলো ভালোমতো শেষ করতে পারলে আমাকে ট্যুরে যেতে দিবি। আব্বুর থেকে অনুমতি নেওয়া আর আম্মুকে রাজি করানোর দায়িত্ব কিন্তু তুই নিবি বলেছিলি।

—-আমি আব্বুর থেকে অনুমতি নিয়ে নিয়েছি। শুধু আম্মুর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলা বাকি। সেটাও হয়ে যাবে। এখন ঘুমা। রাত হয়েছে।

—-না, আমি গল্প করবো তোর সাথে। তোকে তো রাতে ততোটা পাই না। আগামীকাল শুনেছি কাজে যাওয়া লাগবে না তোর? আম্মু বললো।

—-হুম। ছুটি।

—-তাহলে আজকে শুধু গল্প হবে।

—-আমাকে কী তোর ঠাকুরমার ঝুলি মনে হয়?

—-না, তুই মিশুআপুর ঝুলি। হি হি। শোন না, আজকে পার্টিতে কী কী হয়েছে একটু বল তো? কী কী মজা করলি?

—-এই যে ছবি দেখছি এখন ফোনে। পাশে এসে শুয়ে শুয়ে দেখ আমার সাথে।

বিগলিত বদনে দৌড়ে এসে মিশরাতের পাশে শুয়ে পড়লো তার একমাত্র ছোট বোন ইশরাত। একজন আরেকজনকে ছাড়া একদিনও টিকতে পারে না। ইশরাত তার আম্মুর সাথে খুব কমই ঘুমায়। মিশরাত থাকলে যেন তার আর কিছু লাগে না। এখন বড় বোন ফোনে স্ক্রল করে করে ছবি দেখছে এবং তাকেও দেখাচ্ছে। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ছবি ইশরাত জুম করে দেখছে। কে কেমন সেজে এসেছে সেটা দেখতে বড্ড ইচ্ছে তার। হঠাৎ একটা ছবি দেখে তার উৎসুক দৃষ্টিতে লাজুকতার ছোঁয়া দেখা গেল। সদ্য প্রস্ফুটিত একটা লাল গোলাপের মতো তার মুখখানা লাল টুকটুকে হয়ে গেল। এই মানুষটাকে দেখলে তার কেমন যেন বুকটা ধুকধুক করে। মনে হয় যেন হৃদযন্ত্রের গতি বেড়ে যায়। ছবিতে মানুষটা ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। তবে মুখে হাসি। বাঁকা হাসি। এই হাসি-ই যথেষ্ট ইশরাতের ভেতরে তোলপাড় শুরু করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতেই তার মুখে বিরক্তির ছাপ চলে আসলো। প্রশ্নটা মনে জমিয়ে না রেখে চটপট বোনকে জিজ্ঞেস করে ফেললো

—-সাদমান ভাইয়ের কী আর কোনো জুতো নেই আপু? বিগত চার মাস নয় দিন ধরে একই জুতো পরছে দেখছি। আর হাতের ঘড়িটা দেখ। এটা কোনো কালার হলো? কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগে না? গত মাসের পাঁচ তারিখ দেখেছিলাম স্কাই ব্লু রঙের একটা ঘড়ি পরেছিলো। ওটাতে দারুণ লাগছিলো। কিন্তু একদিন পরেই আবার সেটা খুলে রেখে দিয়েছিলো। কেন বল তো?

ভ্যাবাচেকা খেয়ে ইশরাতের দিকে তাকিয়ে আছে মিশরাত। তবে ইশরাত এখনো ভ্রূ কুঁচকে মোবাইলে সাদমানের ছবিটার দিকে তাকিয়ে। মিশরাতের দিকে এখনো নজর যায়নি তার। তাহলে দেখতে পেত যে তার বোনের চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ। কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে মিশরাত প্রশ্ন করলো

—-আজকে রাতে কী দিয়ে ভাত খেয়েছিলি বল তো?

—-ধুর, সেসব কী মনে আছে নাকি? এতো কথা মনে রাখে কে? আমি তো তখনের কথা এখন ভুলে যাই। আমাকে ওসব জিজ্ঞেস করে লাভ নেই।

—-গত মাসের পাঁচ তারিখ তুই কোন জামা পরেছিলি? কী রঙের জামা পরেছিলি?

—-আরে এক কথা বারেবারে জিজ্ঞেস করছিস কেন? এসব মনে থাকে না বললাম না?

—-সাদমান তাহলে কোন রঙের ঘড়ি পরেছিলো সেটা মনে রাখলি কীভাবে?

দাঁত দিয়ে জিহ্বায় হালকা করে একটা কামড় দিলো ইশরাত। এই যা! গেল তো ধরা পড়ে।

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না। পরবর্তী পর্ব চলমান গল্প শেষ হলে পাবেন।)

#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here