পরিত্রাণ পর্ব ৩

#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৩

সকাল থেকেই রুমু রেডি হয়ে বসে আছে। আজকে তাঁর বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা। রহমান, ইউসুফ সাহেবের সাথে জরুরি একটা কাজে বাইরে গেছে। সে ফিরলেই রুমুকে বাসায় নিয়ে যাবে। সেজেগুজে তারজন্যই অপেক্ষা করছে রুমু।

ড্রয়িংরুমে বসে থাকাকালীন হঠাৎ সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো রুমু। অনিক সেজেগুজে নিচে নামছে। হাতে একটা ফাইল। রুমু বোকার মত চেয়ে রইলো! সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি? এই বেশে কখনো অনিককে দেখতে পাবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। ব্যক্তিগতভাবে রুমুর ধারণা ছিলো অনিক অকালকুষ্মাণ্ড, গুড ফর নাথিং একটা ছেলে। বাবার টাকায় বসে বসে মদ গেলে। কিন্তু এ কি অবতার তাঁর? ওকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনিক মৃদু শিষ দিয়ে বললো,’এই যে রুমু,চুমু! তুমি যাও নি এখনো?’

-‘আমার নাম রুমু।’, মুখ ভেংচি দিলো রুমু।

-‘আমি তো তাই বলেছি রুমু, চুমু।’

রুমু বিরক্ততে ঠোঁট উল্টালো। আড়চোখে তাকিয়ে দেখে বললো,’সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছো তুমি?’

-‘অফিসে। বিয়ের চক্করে এই দুদিন অফিসে যাওয়া হয় নি।’

রুমু মুখটা এবার বড়সড় হাঁ হয়ে গেলো! ভূতের মুখে রামনাম! অনিক আর চাকরী? এরা বাপ ছেলে কি শক দিয়ে দিয়ে রুমুকে মেরে ফেলতে চায়? নাহ! আর একমুহূর্তও এই বাড়িতে থাকা যাবে না। এরা রুমুকে পাগল করে দেবে! অনিক তাঁর চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বললো,’কি ভাবছো? ডিসিশন চেইঞ্জ করে ফেলার চিন্তাভাবনা করছো নাকি? ভুলেও এমন কাজ করো না। আমি কিন্তু ভালো ছেলে নই। নিজের টাকায় মদ কিনে খাবো বলেই চাকরী করি। সুতরাং নো চেইঞ্জ। নিজের জায়গায় অনড় থাকো। এখানে থাকলে কখন আবার আমার প্রেমে পড়ে যাও তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে?

রুমুর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে সব। এসব কি হচ্ছে তাঁর সাথে? অনিক নিজের টাকায় মদ কিনে খাবে? মাতালের আবার আত্মসম্মান? হায় খোদা! কলিকালে আর কত কি দেখাবে!

প্রেমের কথা শুনে অবজ্ঞাভরে হেসে উঠে বললো,’খুব কনফিডেন্স মনে হয় তোমার? কি দেখে তোমার প্রেমে পড়বো বলতো? চেহারা দেখে? অতো ভালো চেহারা তোমার নয়।’

-‘সেটা আমি জানি। আমি তো শুধু সম্ভাবনার কথা বলেছি।’

-‘সম্ভাবনা জিরো টু দ্যি পাওয়ার মাইনাস জিরো পার্সেন্ট! তোমার মত বদ্ধ মাতাল, বেকুব, বদমাইশ, ফাজিল এবং বেয়াদব যে কিনা নিজের বাবাকে পর্যন্ত নাম ধরে ডাকে তার প্রেমে পড়ার চেয়ে একটা গরুর প্রেমে পড়লেও নিজেকে ধন্য মনে করবো। তোমার ভাগ্য ভালো আমি এই বাড়িতে থাকছি না, বেঁচে গেছো। নইলে তোমার এসব বদমাইশি দুদিনেই ছুটিয়ে দিতাম।’

অনিকের মুখ কালো হয়ে গেলো। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে ধমকের সুরে বললো,’কথাবার্তা হিসেব করে বলো। আমি শুরু করলে কিন্তু কানে হাত চাপা দিয়েও কুল পাবে না। আমি তোমার চাইতে অনেক লেটেস্ট মডেলের গালি জানি। সো ডোন্ট ডেয়ার টু অ্যাবিউজ ! স্পিক পোলাইটলি!’

রুমুর বেকুবের মত চেয়ে রইলো। সে যা ভেবেছে তার চাইতে কয়েক গুন বেশি লেভেলের আত্মসম্মান এই ভদ্র মাতালটার! একটা বেপার ক্লিয়ার মাতাল অবস্থায় সে যতটা এলোমেলো সুস্থ অবস্থায় তার চেয়ে অনেক বেশি গোছালো।

অনিক ভ্রু কুঁচকে বললো,’মদ নিয়ে তোমার এত সমস্যা কেন? তুমি তো আমেরিকাতে বড় হয়েছো? এসব তো তোমার কাছে নরমাল হওয়ার কথা।

-‘আমি তোমার মত অভদ্র নই।’

-‘কথাবার্তায় তো মনে হয় না।’

রুমু রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’আমার সামনে থেকে সরো তুমি।’

-‘না সরলে কি করবে?’

-‘বাবাকে ডাকবো!’

-‘ডাকো। তারপর দেখো আমি কি করি?’

-‘কি করবে?’

অনিক ঠোঁট কামড়ে অশালীন একটা ইঙ্গিত করলো। মুখে অশালীন হাসি! রুমু থমকে গেল। চোখমুখ লাল করে বললো,’তুমি শুধু অভদ্র নও ইতরও!’

অনিক হেসে উঠে বললো,’এক্ষুনি এত হাইপার হলে তো চলবে না? এখনো কত কিছু জানার আছে আমার সম্পর্কে! ইউসুফ চৌধুরী হয়ত তোমাকে বলেন নি। কিন্তু কোন সমস্যা নেই তুমি যদি শুনতে চাও তবে আমিই বলবো..’ এটুকু বলে অনিক থামলো। রুমু কান খাড়া করে রইলো শোনার জন্য!

অনিকের মায়ের নাম অনিলা চৌধুরী। যুবতী বয়সে বিয়ের আগে শরীফ নামক এক লোকের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মন দেওয়া নেওয়া হয়েছিলো তাঁর। তাই পারিবারিকভাবে যখন ইউসুফ চৌধুরী সাথে যখন তাঁর বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো, ঘোর আপত্তি জানান তিনি। কিন্তু পরিবারের লোকজন তার আপত্তি গ্রাহ্য করলো না। ইউসুফ চৌধুরীর মত ধনকুবের লোকের কাছে শরীফের মত নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের একটা ছেলে কিছুই না। তাই খুবই চালাকির সাথে ইউসুফ চৌধুরীর কাছে শরীফের কথা গোপন করে গেলেন তাঁরা। অনিলা চৌধুরীর ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও জোর করে ইউসুফ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে দিলেন তাঁকে।

কিন্তু মন থেকে কোনদিন ইউসুফ চৌধুরীকে ভালোবাসতে পারেন নি অনিলা চৌধুরী। কিন্তু চৌদ্দ বছরের দাম্পত্য জীবনে একমুহূর্তের জন্যেও ইউসুফ চৌধুরীকে ভালোবাসেন নি তিনি। প্রতিনিয়ত পালানোর পথ খুঁজে চলছিলেন। যার পরবর্তীতে প্রতিফলন অনিকের জন্মের পরেও দেখা যায়।

অনিকের যখন বারোবছর বয়স সেবার মারাত্মক টাইফয়েড হলো ইউসুফ চৌধুরীর। হাড় জিরজিরে, কঙ্কালসার হয়ে গেলেন তিনি। ব্যবসায়িক অবস্থা রসাতলে! দেশবিদেশে নানারকম চিকিৎসা নেওয়ার পরেও লাগাতর শয্যাশায়ী ইউসুফ চৌধুরী। এর মাঝেই একদিন হঠাৎ জানতে পারলেন তার স্ত্রী তারই অধিনস্ত শরিফ নামক সামান্য এক ম্যানেজারের সাথে পালিয়ে গেছেন। এবং পালানোর সময় তাদের একবছরের ফুটফুটে কন্যা সন্তান আরিয়াকে সাথে করে নিয়ে গেছেন। যাওয়ার সময় ইউসুফ সাহবের জন্য একখানা পত্র লিখে যান তিনি। দুর্ভাগ্যবশত সেই চিঠি অনিকের হাতেই প্রথম পড়েছিলো। পুরো চিঠিতে ছিলো অনিলা চৌধুরীর তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। চিঠির মাধ্যমেই ইউসুফ সাহেব জানতে পারেন আরিয়া তার মেয়ে নয়। বিয়ের পরেও শরীফের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন অনিলা চৌধুরী। আরিয়া তাঁরই সন্তান। তাই অনিলা চৌধুরী তাকে সাথে করে নিয়ে গেছেন কিন্তু অনিকের ব্যপারে তিনি নিশ্চিত নন।
চিঠিটা পড়ে চারদিক ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে শুরু করলো ইউসুফ চৌধুরীর। শুধুমাত্র স্বামীর প্রতি ঘৃণা থেকে কোন মা তার নিজের সন্তানের জন্ম পরিচয় নিয়ে এমন জঘন্য, কুরুচিপূর্ণ তামাশা করতে পারে এটা যেন তাঁর কল্পনাতীত! মানসিক ভাবে আরো বেশি ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। তার অসুস্থতার সময় মা-হারা অনিকের মানসিকতার খোঁজ নেওয়ার মত কেউ ছিলো না। রহমানের স্ত্রী সফুরার তত্ত্বাবধানে বড় হতে লাগলো অনিক।

ধীরে ধীরে সুস্থ হলেন ইউসুফ সাহেব। আত্মীয়রা অনেকেই দ্বিতীয়বার পাণিগ্রহণের কথা বলেছিলেন তাকে। কিন্তু নিতান্ত লজ্জা, ঘৃণা, অপমানে ইউসুফ সাহেব রাজী হলেন না। নিজের কাজে ডুবে রইলেন। এদিকে অনিকের যখন খুব করে একজন কাছের মানুষের প্রয়োজন ছিলো সেই সময়টাতে ইউসুফ সাহেব নিজের দুঃখ ভুলতে কর্মব্যস্ততায় দিন কাটাতে এটাই মগ্ন ছিলেন যে ছোট্ট অনিকের দুঃখ বোঝার মতন অবসর তাঁর হলো না। তাই ধীরে ধীরে অনিকের ভেতরে গড়ে ওঠা তীব্র ঘৃণা, ক্ষোভ, আত্মগ্লানি সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না তিনি।

এতকিছুর মাঝেও পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো অনিক। এসএসসি, ইন্টারমিডিয়েট খুব ভালোভাবে পাশ করলো। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে বিবিএ কমপ্লিট করলো। সেখানেও রীতিমত টপার ছিলো। তারপর ঐ একইভাবে এমবিএ কমপ্লিট করলো। এরপর শুরু হলো আস্তে আস্তে অধঃপতন। মদ খাওয়া, নেশা করা, বন্ধুদের সাথে ক্লাবে ক্লাবে ঘুরে বেড়ানো অনিকের নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ালো। বস্তুত অনিক যেন বুঝিয়ে দিতে চাইছিলো সে ইচ্ছে করেই নিজের জীবন ধ্বংস করছে। তাকে আটকানোর ক্ষমতা কারো নেই। টের পেয়ে ইউসুফ সাহেব ওকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য জোর চেষ্টা চালালেন। কাজের মাঝে থাকলে হয়ত অনিক ভালো থাকবে তাই ভেবে নিজের সমস্ত ব্যবসাবাণিজ্য অনিকের হাতে তুলে দিতে চাইলেন। কিন্তু যার ভেতরেই ঘাঁ তাকে উপর দিয়ে মলম লাগালে লাভ হবে কি? অনেক দেরী করে ফেলেছিলেন ইউসুফ সাহেব। যতদিনে অনিকের ব্যপারে তাঁর বোধোদয় হলো ততদিনে অনিক অনেকটাই বিকৃতমনোস্ক। শেষ চেষ্টা হিসেবে হিতৈষীরা বিয়ের করিয়ে দেওয়া বুদ্ধি দিলেন। কিন্তু তাতেও ইউসুফ চৌধুরীকে নাকানিচোবানি খাইয়ে ছেড়েছে অনিক। পরপর দুবার বিয়েতে রাজী হয়েও আসর ছেড়ে পালিয়েছে। শেষমেশ রুমুই টিকলো!

রুমুর উৎসাহী মুখের দিকে তাকিয়ে রহস্যজনক ভাবে হাসলো অনিক। রুমুর খুব গিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,’কাউকে বলবে না কিন্তু কেমন?’

রুমু এতটাই উত্তেজিত ছিলো যে,অনিকের দুষ্টুমিটা ধরতে না পেরে বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।

অনিক ফিসফিস করে বললো,’আই ওয়া’না কিস ইউ! ইউ আর দ্যা হটেস্ট গার্ল আই হ্যাভ এভার মিট। আই লং ফর আ কিস! আমি তোমাকে একটা চুমু খেতে চাই।’

রুমু অগ্নিদৃষ্টিতে অনিকের দিকে চাইতেই অনিক হো হো করে হেসে উঠে বললো,’কি করবো বলো। ইচ্ছে হলো তাই বলে দিয়েছি। যদিও আই হেইট গার্লস!’

রুমু বিরক্ত হয়ে অনিকের কাছ থেকে সরে গিয়ে বললো,’তোমার এসব ফালতু ইচ্ছে তোমার কাছেই রাখো। আই অ্যাম নেভার গ’না কিস ইউ!’

অনিক হাসলো। রুমুর কৌতূহল তখন পুরোপুরি দমন হয় নি। তাঁর মন বলছিলো অনিক নিশ্চয়ই আরো কিছু বলবে!
অনিক কিছুক্ষন নিরবে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,’ইউসুফ চৌধুরীকে আমি কেন বাবা ডাকি না জানো? কারণ আমি সত্যিই জানি না তিনি আমার বাবা কি না! ইনফেক্ট উনিও জানেন না। ছোটবেলায় শুনেছি আমি আমার মায়ের অবৈধ সন্তান। ইংরেজিতে যাকে ব্লাডি সান ! আমার যখন বারো বছর বয়স তখন অনিলা চৌধুরী মানে আমার মা আমাকে রেখে ইউসুফ চৌধুরীর পুরোনো ম্যানেজার শরীফের সাথে পালিয়ে যান।’ এটুকু বলে হাসলো অনিক। তারপর আবার সেই হো হো করা হাসি দিয়ে বললো,’ হিসেবমতে আমার সম্ভাব্য বাবা তালিকায় আছেন ইউসুফ চৌধুরী এবং তার ম্যানেজার শরীফ! এখন তুমিই বলো পুরোপুরি সিয়র না হয়ে আমি কাকে বাবা বলে ডাকবো?’

রুমু মুখে ‘রা’ নেই। এসব কি শুনছে সে? অনিক? ইয়া আল্লাহ! এই কোন জাহান্নামে এসে পড়লো রুমু। হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থেকে বললো,’তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?’

-‘নিজের বাবা মাকে নিয়ে কেউ মজা করে?’

তারপর রুমুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অনিক অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো। রুমুর মাথা ঘুরছে! এইপ্রথম নিজের ভেতরে প্রবল ধাক্কা অনুভব করলো সে! এই প্রথম অনিকের জন্য কিছু অনুভব করলো! একটা মানুষ এতবড় কষ্ট নিয়ে কি করে ভালো থাকতে পারে? একজন মা কি করে তাঁর সন্তানের এতবড় সর্বনাশ করতে পারে?
চোখ ছলছল করে উঠলো তাঁর!
দিশেহারা হয়ে অনিক চলে যাওয়ার পর পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলো রুমু। কিন্তু কিছুই বের করতে পারলো না। একটা ডায়েরি পর্যন্ত নেই অনিকের! চিন্তায় পড়ে গেলো সে অনিক কি সত্যি বলেছে? রুমু কি ইউসুফ চৌধুরীকে একবার জিজ্ঞেস করবে? কিন্তু এসব অশালীন কথাবার্তা উনার সঙ্গে কি করে আলোচনা করবে রুমু? এখন একমাত্র বাবাই তার ভরসা। রহমানের আসার অপেক্ষা না করে নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রুমু। উদ্দেশ্য আসিফ ইকবালের কাছ থেকে পুরো ঘটনা জানা।


আসিফ ইকবাল অপরাধির ন্যায় মুখ করে মেয়ের সামনে বসে আছেন। পিতা হয়ে তিন নিজে তাঁর মেয়ের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করেছেন। জেনেশুনে একটা মাতাল, বিকৃতমনোস্ক , উন্মাদ ছেলের সঙ্গে তাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। যাকে সারাজীবন স্নেহ, ভালোবাসায়, মায়া মমতায় বুকে আগলে রেখে বড় করেছেন তাকে নিজ হাতে অকুল পাথারে ভাসিয়ে দিয়েছেন তিনি। রুমু তার পায়ের কাছে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তিনি ওর মাথায় হাত রেখে শূন্য, ফাঁপা দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে আছেন।
তাঁর মত অসহায়, দুর্ভাগা পিতা আর কেউ নেই যে তার সন্তানের অনিষ্ট নিজের হাতে সাধণ করেছেন। কিন্তু এই ছাড়া আসিফ ইকবাল আর কি করত পারতেন? ইউসুফ চৌধুরী কাছে তাঁর অনেক ঋণ। পারিবারিক অসচ্ছলতার দরুণ আসিফ ইকবালের মা যখন বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছিলো খবর পেয়ে ইউসুফ চৌধুরীই তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালো। তার প্রাপ্তবয়স্ক দুই বোনের বিয়ের সব দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। যদিও ইউসুফ চৌধুরী সচ্ছল ছিলেন তবে এখনকার মত এত অঢেল টাকা পয়সা তাঁর ছিলো না। কিন্তু মনটা বরাবরই বড় ছিলো! তাই তো বন্ধুপরিবারের দুর্দশা দেখে নিজের টাকায় বন্ধুকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এবং আসিফ ইকবাল আমেরিকা যাওয়ার পর তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর বাবা মায়ের যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেন।

তারপর আসিফ ইকবালের বাবা মা মারা গেলো!এরপর আর অনেক কাল আর দেখা হয় নি দুজনের। আসিফ ইকবাল প্রবাসী এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করে আমেরিকাতে সংসারী হলেন। আর ইউসুফ চৌধুরী দেশে থেকেই নিজের ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু এতবছর করে হঠাৎ করে ইউসুফ চৌধুরীর মত নিঃস্বার্থ সেই বন্ধুটি আসিফ ইকবালের সামনে এমন করে বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে দাঁড়াবেন সেটা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি। ব্যবসায়িক কারণে গতমাসের প্রথমদিকে সপ্তাহখানেকের মত আমেরিকাতে যেতে হয়েছিলো ইউসুফ চৌধুরীর। হঠাৎ করেই ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করেন বন্ধুর সাথে। তখনই আমেরিকাতে বসবাসকারী বাঙালী অনুশাসনে বড় হওয়া সর্বগুণে গুণান্বিতা রুমুকে দেখে ভীষণ পছন্দ হয়ে যায় ইউসুফ চৌধুরীর। অসহায় ভাবে আসিফ ইকবালের কাছে নিজের ছেলের দুর অবস্থার কথা সব খুলে বলেন। আসিফ ইকবাল মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেন কিন্তু তিনি অকৃতজ্ঞ নন। বিপদের সময় যেই বন্ধুটি নিজের সবটুকু দিয়ে তাঁর পাশে দাড়িয়েছিলো তাঁর অনুরোধ তিনি ফেলতে পারলেন না। সেদিনই বুঝতে পারলেন সৃষ্টিকর্তা তাকে সব দিয়েছে কিন্তু এখনো এতটা স্বার্থান্বেষী করে তৈরী করেন নি যে ইউসুফ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেওয়ার মত ক্ষমতা তার হবে।তাই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রবিয়েতে মত দিয়ে দিলেন। সব শুনে রুমু ফ্যালফ্যাল করে তাকয়ে থেকে বললো,’আমি এখন কি করবো বাবা?’

রুমুর চোখের দিকে চাইতে পারলেন না আসিফ ইকবাল। তাঁর আদরের মেয়েটার চোখে পানি ছলছল করছে, বাবা হয়ে এই দৃশ্য সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। মুখ ফিরিয়ে নিলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,অনিকের কাছে ফিরে যাও মা। একবার অন্তত চেষ্টা করে দেখো ওকে শুধরাতে পারো কি না। প্রয়োজনে কঠোর হও, কোমল হও, মোমের মত গলে যাও, কিন্তু হাল ছেড়ো না ! অনিক কেবল নারীর একটা রূপই দেখেছে। নারী ছলানাময়ী! তুমি তাঁকে নারীর মমতাময়ী, স্নেহরূপী, বিজয়িনী রূপ দেখিয়ে দাও মা। তোমার বাবা মনে প্রাণে তোমার জন্য দোয়া করবেন। প্রয়োজনে আমি ইউসুফের সাথে কথা বলবো। সে তোমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’

রুমু যদি অপরিণত, বদরাগী কিংবা তথাকথিত ডোন্ট কেয়ার টাইপের কোন মেয়ে হতো তাহলে এই মুহূর্তে বাবার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো। যেই বাবা নিজের মেয়ের এতবড় সর্বনাশের পরেও এখনো তার বন্ধুর কথা, বন্ধুর ছেলের কথা ভাবছে তাকে আর যাই হোক আদর্শ পিতা বলা যায় না। কিন্তু সে পারলো না। কারণ পিতৃভক্তি তার শিরায় শিরায় মিশে আছে। নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আফিস ইকবাল কতটা অসহায় রুমু তা অনুভব করতে পেরেছে। সুতরাং আরেকটি কথাও বললো না সে। যেমনি এলো, তেমনি ফিরে গেলো। যাওয়ার সময় বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করে বেরিয়ে গেলো। আসিফ ইকবাল তেমনিভাবে ঠায় বসে রইলেন। দ্বিতীয়বারের মত মেয়েকে বিসর্জন দিয়েছেন তিনি!

বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে দরজা আটকে বসে রইলো রুমু। অনিক এখনো ফেরেনি, আদৌ কি ফিরবে রুমু জানে না। হয়ত অফিস শেষে কোন বন্ধুর সাথে মদ গিলতে বেরিয়ে যাবে। মন খারাপ বারান্দায় ইজিচেয়ারে গিয়ে বসলো। মাথার ভেতর হাবিজাবি আকাশ পাতাল চিন্তাভাবনা ঘুরছে। মানুষের জীবন কড় অদ্ভুত! কতটা আনপ্রেডিক্টেবল! একমুহূর্তেই সব কিছু পালটে দিতে পারে। এই তো, কিছুক্ষণ আগেও রুমু অনিকের কাছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আসার পাগলের মত বাসায় ছুটে গেছিলো। মনেপ্রাণে প্রার্থণা করছিলো অনিকের বলা কথাগুলো যেন সব মিথ্যে হয়। এই বিভীষিকাময় জীবন থেকে রুমুর যেন পরিত্রাণ ঘটে। কিন্তু হায়! যার কাছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আসায় রুমু এত হাঁসফাস করছিলো, এত দমবন্ধ লাগছিলো সুযোগ বুঝে সৃষ্টিকর্তা তাঁর পরিত্রাণের দায়ভারই রুমুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। এর চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস আর কি হতে পারে?
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here